প্রায় আকাশ ছোঁয়া কালো গ্রানাইটের হলঘরটিতে বিজ্ঞান একাডেমির সভা শুরু হয়েছে। হলঘরটি যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন সেটি কত বড় করে তৈরি করার প্রয়োজন ছিল কারো জানা ছিল না, এখন বোঝা যাচ্ছে এটি অকারণে অনেক বড় করে তৈরি করা হয়েছে। কালো গ্রানাইটের ছাদ অনেক উঁচু, অল্প কয়টি কলামের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, এনরয়েডের যুগে এটি তৈরি করা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় কিন্তু মানুষের যে যুগে এটি তৈরি হয়েছিল তখন নিঃসন্দেহে এটি প্রযুক্তির একটি বড় উদাহরণ ছিল। বিশাল হলঘরে একটি সুদীর্ঘ টেবিলের এক প্রান্তে বসে ক্লাউস ট্রিটন এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করেন।
সামনে টেবিলে তাকে ঘিরে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকেন্দ্রের পরিচালকেরা বসে আছেন। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক তার যান্ত্রিক গলায় বললেন, যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে বলছি, আমরা যে মহাকাশযানটি তৈরি করতে যাচ্ছি আমাদের প্রযুক্তি সেটি তৈরি করতে এখনো প্রস্তুত নয়।
ক্লাউস ট্রিটন বললেন, আমি জানি।
তা হলে আমরা কেন সেটি তৈরি করার চেষ্টা করছি?
ত্রাশিয়ান বললেন, কারণ এক সময় সূর্য একটি রেড জায়ান্টে পরিণত হবে, পৃথিবীকে পর্যন্ত সেটি গ্রাস করে ফেলবে। তার আগেই পৃথিবী থেকে সকল বুদ্ধিমত্তাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পাঠাতে হবে।
মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালক একটু উষ্ণ স্বরে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই তামাশা করছেন মহামান্য ত্রাশিয়ান। সূর্য রেড জায়ান্ট হবে আরো চার বিলিয়ন বছর পরে। আমাদের কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
আছে।
কী জন্য?
বুদ্ধিমত্তার একটি সংজ্ঞা হচ্ছে যেটুকু ক্ষমতা তার চাইতে বেশি অর্জন করা। তাই আমাদের প্রযুক্তি প্রস্তুত হবার আগেই আমাদেরকে এই মহাকাশযানটি তৈরি করতে হবে।
ক্লাউস ট্রিটন এতক্ষণ ত্রাশিয়ান এবং মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালকের কথোপকথন শুনছিলেন। এবারে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন, এই ব্যাপারটি নিয়ে দীর্ঘসময় আলোচনা করা যেতে পারে কিন্তু আমরা সেটি করব না। যে কারণেই হোক আমরা সেই আলোচনায় যাব না। আমরা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এক শ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এই মহাকাশযানটি আমরা তৈরি করব এবং তার মাঝে পৃথিবীর বুদ্ধিমত্তার সকল নমূনা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পাঠাব। কোথায় পাঠাব আমরা জানি না, কতদিনে সেটি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবে সেটাও আমরা জানি না। সত্যি কথা বলতে কী, এর কোনো গন্তব্যস্থল আছে কি না সেটাও আমরা জানি না। মহাকাশযানটি তৈরি করা হবে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে। বাইরে থেকে কোনোকিছু না নিয়ে এটি অনির্দিষ্টকাল টিকে থাকতে পারবে। হাজার হাজার কিংবা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পরে এটি হয়তো কোথাও কোনো গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবে, সেখানে এটি হয়তো নিজের সভ্যতা সৃষ্টি করবে, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। প্রতি এক হাজার বছরে আমরা এরকম একটি করে মহাকাশযান পাঠাব বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণে। আমাদের প্রযুক্তি উন্নত হলে সেই মহাকাশযান হবে আরো উন্নত, তার টিকে থাকার সম্ভাবনা হবে অনেক বেশি। আমাদের বুদ্ধিমত্তা যেন ধ্বংস না হয়ে যায় সেটি যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে সেটাই হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য।
ক্লাউস ট্রিটন থামলেন এবং কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। দীর্ঘ টেবিলের শেষপ্রান্তে বসে থাকা বুদ্ধিমত্তা বিজ্ঞান–কেন্দ্রের পরিচালক নিচু গলায় বললেন, মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন, আপনি অনুমতি দিলে আমি একটু কথা বলতে চাই।
বল।
এই বিশাল মহাকাশযানে আমরা আমাদের বুদ্ধিমত্তার সকল নমুনা পাঠাব বলে ঠিক করেছি। কিন্তু তার কি সত্যিই প্রয়োজন আছে? নিনীষ স্কেলে সাতের কম কোনো কিছু পাঠানোর উদ্দেশ্য কী?
তুমি ভুলে যেও না এটি পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি মহাকাশযান। এই মহাকাশযানের বুদ্ধিমত্তাগুলো হাজার বছর, এমনকি মিলিয়ন বছর নিজেদের বিকাশ করবে। আমরা নিজেদের একভাবে বিকাশ করেছি কিন্তু সেটি হয়তো প্রকৃত বিকাশ নয়। হয়তো অন্যভাবে বিকশিত হলে বুদ্ধিমত্তা আরো পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হতে পারত। সে কারণে আমাদের নিম্নশ্রেণীর বুদ্ধিমত্তাকে এই মহাকাশযানে পাঠাতে হবে।
মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন বুদ্ধিমত্তা–কেন্দ্রের পরিচালক কষ্ট করে নিজের গলার স্বরে উত্তেজনাটুকু প্রকাশ হতে না দিয়ে বললেন, আপনি কি তার গুরুত্বটুকু বুঝতে পারছেন?
পারছি।
নিনীষ স্কেলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা আট। কাজেই এই মহাকাশযানে আমাদের মানুষকেও পাঠাতে হবে। যদিও বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে এখন মানুষের কোনো ভূমিকা নেই।
উপস্থিত সকল পরিচালকেরা প্রায় একই সাথে উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ক্লাউস ট্রিটন সংকেত দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমরা ব্যাপারটি নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু দেখেছি বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে সাথে নিম্নবুদ্ধির মানুষকেও এই মহাকাশযানে পাঠাতে হবে। বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য একই সাথে নানা স্তরের বুদ্ধিমত্তা থাকতে হয়।
কিন্তু মানুষ না পাঠিয়ে আমরা মানুষের সমপরিমাণ বুদ্ধিমত্তার একটি প্রাচীন এনরয়েড কেন পাঠাই না?
সেটি অর্থহীন একটি কাজ হবে। এনরয়েডদের বুদ্ধির বিকাশ হয় একভাবে, মানুষের বিকাশ হয় অন্যভাবে। আমাদের বিবর্তন নামের এই অপরিকল্পিত বিকাশের ধারাটি রাখা দরকার।
মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন, জিনেটিক বিজ্ঞান–কেন্দ্রের মহাপরিচালক প্রায় আতঙ্কিত স্বরে বললেন, আপনি জানেন মানুষ জৈবিক প্রাণী। তাকে বাচিয়ে রাখতে হয়। তাকে খেতে হয় এবং নিশ্বাস নিতে হয়। তাকে শিক্ষা দিতে হয় এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাদেরকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিলে তাদের মাঝে বিচ্ছিন্ন এক ধরনের আকর্ষণের সৃষ্টি হয় এবং দুটি ভিন্ন প্রজাতি তেইশটি করে ক্রমোজম দান করে নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়। মানুষের জীবন প্রক্রিয়া অত্যন্ত আদিম। সেটিকে রক্ষা না করলে তারা বেঁচে থাকতে পারবে না।
ক্লাউস ট্রিটন শান্ত গলায় বললেন, তা হলে তাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের খাদ্য নামক এক ধরনের জৈব পদার্থ সৃষ্টি করতে হবে। মহাকাশযানের বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অক্সিজেনের অনুপাত নিশ্চিত করতে হবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সীমিত রাখতে হবে।
প্রয়োজন হলে করতে হবে।
মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালক একটু ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, এই মহাকাশযানটি তৈরি করা হাজার গুণ বেশি কঠিন হয়ে গেল মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন।
সেটি সম্ভবত সত্যি।
ত্রাশিয়ান এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল, এবারে ক্লাউস ট্রিটনের অনুমতি নিয়ে বলল, মহামান্য ক্লাউস। এই মহাকাশযানটি মহাকাশে তার অনির্দিষ্ট যাত্রা শুরু করার কয়েক দশকের মাঝেই সকল মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ক্লাউস ট্রিটন বললেন, আমি সে ব্যাপারে তোমার মতো নিশ্চিত নই।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত। মহাকাশযানের এনরয়েডরা যখন আবিষ্কার করবে নিনীষ স্কেলে বুদ্ধিমত্তা আট একধরনের জৈবিক প্রাণীকে রক্ষা করার জন্য মহাকাশকেন্দ্রের বিশাল শক্তিক্ষয় হচ্ছে তখন তারা সেই প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো অর্থ খুঁজে পাবে না। মহাকাশযানে মানবজাতি আবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
তবুও আমাদের এই মহাকাশযানের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ত্রাশিয়ান।
কেউ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালক তার যান্ত্রিক চক্ষুকে প্রসারিত করে বললেন, এই মহাকাশযানের নামকরণ কি করা হয়েছে মহামান্য ক্লাউস?
হ্যাঁ। আমরা এটিকে ডাকব মেতসিস।
মেতসিস? এর কি কোনো অর্থ আছে?
না। এখন এর কোনো অর্থ নেই। কিন্তু হয়তো কখনো এর একটি অর্থ হবে। মেতসিস শব্দটি হয়তো কোনো একটি বিশেষ প্রক্রিয়া হিসেবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে স্থান করে নেবে। এখন কেউ সেটি বলতে পারে না।
বিজ্ঞান একাডেমির সভা শেষে সবাই চলে গেলে ত্রাশিয়ান ক্লাউস ট্রিটনের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, মহামান্য ক্লাউস
বল।
এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। মানুষ তার দায়িত্ব পালন করেছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বুদ্ধিমত্তার জন্ম দিয়েছে। এখন সেই বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণতা করতে হবে আমাদের। মানুষ আর। কখনো পারবে না।
তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ ত্রাশিয়ান। তবে—
তবে কী?
হয়তো বুদ্ধিমত্তাকে পরিপূর্ণ করা সৃষ্টিজগতের উদ্দেশ্য নয়। হয়তো সৃষ্টিজগতের উদ্দেশ্য
উদ্দেশ্য কী?
আমি জানি না।
ত্রাশিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনি জানেন, কিন্তু বলতে চাইছেন না!
বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি ক্লাউস ট্রিটন ত্রাশিয়ানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।