০২.
অ্যানসনের প্রু টাউনে সপ্তাহে দুদিন কাজ থাকে, সেরাতটা সে মার্লবোরর হোটেলেই কাটাল।
ফে ললির সঙ্গে আগে থেকেই বন্দোবস্ত করা ছিল। সে একটু বেশী রাতে আসবে। সে ঠিক পাকা পতিতা নয়, দিনের বেলায় একটা সিগারেটের দোকানে কাজ করে আর রাত্রে এরকম দু একটা উপায়ে উপরি রোজগার করে।
মার্লবোরো হোটেলের বাই অ্যানসনের পরিচিত। প্রু টাউনে এলে সে এখানেই রাত কাটায়। সুতরাং কেউ কিছু মনে করে না। যখন তার ঘরে মেয়েরা আসে তখন হোটেলের কেউ দেখেও দেখে না।
অ্যানসন হোটেলে ফিরে দাড়ি কামাতে বসল। তার মনে বার বার মেগের সুঠাম চেহারা ভেসে উঠতে লাগল। মেগের পাশে ললিকে তুলনা করতে গিয়ে তার মনে হল কোথায় মেগ সৌন্দর্যের প্রতিমা আর কোথায় ললি কুমড়োর মতো মোটা-সোটা থলথলে। কারণে-অকারণে হা হা করে হাসে। গায়েও কেমন যেন আঁশটে গন্ধ। ছিঃ এইসব মেয়ের সঙ্গে রাত কাটানো আর মেগের সঙ্গে। কোথায় মেগ আর কোথায় ললি। চাঁদে আর বাঁদরে।
সে একদলা থুতু ছিটালো মেঝের ওপর। উঠে ললির নম্বর ডায়াল করলো। কিন্তু ফোনটা কেউ ধরল না বেজেই চলল, বিরক্ত হয়ে সে ফোন রেখে দিল। ফোনে ললিকে পেলে সে আসতে না করে দিতো।
আর ললি-টলি নয় এখন মেগ, মেগ- বারলো তার স্বপ্নের রাণী। আসলে মেগ নিশ্চয়ই তার দিকে ঝুঁকেছে, তাই সোম আর বৃহস্পতি কথাটা অমন কায়দা করে জানিয়ে দিলো। সোজা বাংলায় একেই বলে কাছে আসার আমন্ত্রণ।
এবার দাড়ি কামিয়ে চানের জন্য অ্যানসন বাথরুমে ঢুকল। সেখান থেকে শুনতে পেল কে যেন ঘরে ঢুকেছে। বেরিয়ে উঁকি মেরে দেখলো যে ললি বিছানার উপর রাখা তার মানি ব্যাগটা খুলে কি যেন দেখছে।
অ্যানসনের সাড়া পেয়েই ললি চমকে উঠল তার হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গেল। সে হেসে বললো-একটু তাড়াতাড়ি চলে এলাম আজ। মনে হয় আমাকে দেখে খুব চমকে গেছ।
অ্যানসন চোখে বিরক্তির ভাব নিয়ে এগিয়ে এল। অথচ সাতদিন আগে এই ললিই ছিল তার হৃদয়ের রাণী। সে আবার একদলা থুথু ফেলে ললিকে বলল–মনে হয় আমার থেকে তুমিই বেশি চমকে উঠেছে।
ললি হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর বললো জন ডার্লিং তোমাকে একটা কথা বলবো।
অ্যানসন অন্য দিকে তাকিয়ে বললো বলল।
একটু মুশকিলে পড়েছি, বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে এক মাসের। আগামীকাল বাড়িওয়ালাকে একশো ডলার দিতে না পারলে ঘরটা ছাড়তে হবে।
তা আমি কি করবো? রাস্তা-ঘাটে কত একশ ডলার ঘুরে বেড়াচ্ছে। দু-একটা ধরে নাও না। জন ডার্লিং তুমি এরকম কথা বলছ। তোমার কাছ থেকে একথা আমি আশা করিনি।
ব্যাগ থেকে ছটা কড়কড়ে দশ ডলার ললিকে দিয়ে অ্যানসন বলল দেখ ললি এর থেকে বেশী। কিছু আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আজ তুমি যাও, শরীরটা গড়বড় লাগছে। দরকার হলে পরে তোমাকে ফোনে জানাব।
নোট কটা দেখে ললির চোখ দুটো চকচক করে উঠল। সে বলল–একশো ডলার পেলে ভাল হতো।
না, আমার পক্ষে আর দেওয়া সম্ভব নয়। দয়া করে এখন কেটে পড়ো আমাকে আর জ্বালিও না।
ললি বললো, আচ্ছা চলি আসছে হপ্তায়ে আবার দেখা হবে, এই বলে নোটগুলো ব্যাগে পুরতে পুরতে বললো অবশ্য আজকেও আমি থাকতে পারি। ভেবে দেখো আর একটু, তবে যখন বললে শরীর খারাপ তাহলে আজকে আসি, আবার দেখা হবে।
বিছানায় শুয়ে বাকি রাতটুকু মেগের চিন্তায় কেটে গেলো। ভোরের দিকে চোখে ঘুম এলো।
পরদিন তার কাজ ল্যাম্বসৃভিলে। কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করার দরকার ছিল। কাজকর্ম শেষ হতে হতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। এবার ব্রেন্টে ফেরার পালা। প্রু টাউন হয়েই ব্রেন্টে যাবার পথ।
অ্যানসন চলতে চলতে নানান কথা ভাবলো। টাউনে থামবো নাকি। মেগ-এর সঙ্গে একবার দেখা করে যাবো নাকি, আজ তো তার রাতে একা থাকার কথা। কিছু মনে করবে কি। কিন্তু গল্পের আইডিয়া। সে বিষয়ে তো কিছু ভাবা হয় নি। মেগ জানতে চাইলে বোকা বনতে হবে, কিন্তু পরে সে ভাবলো এত ঘন ঘন গেলে বরং আমার ক্ষতি হবে। কি ভাবতে কি ভেবে বসবে। তার থেকে একটা মোটামুটি আইডিয়া মাথায় নিয়েই ওর কাছে যাবে। আগামী সোমবার ও তো একাই থাকবে সেদিনও নয় রাতে যাওয়া যাবে। সে ব্রেন্টে চলে গেল।
অ্যানা আরভিন অবাক চোখে অ্যানসনের দিকে তাকিয়ে বলল এত কি ভাবছে মিঃ অ্যানসন।
অ্যানসন চমকে উঠল। তার চিন্তায় ছেদ পড়লো। সে অনার দিকে ফিরল। চোখে অপার কৌতূহল নিয়ে অ্যানা ছোট্ট টাইপ মেসিনটার ওপাশে বসে আছে।
অ্যানা গত দুবছর ধরে তার সঙ্গে কাজ করছে। মেয়েটা ভালো হাসিখুশি প্রকৃতির। কাজে কর্মেও বেশ চটপটে। পুরুষদের কাছ থেকে সবসময় দূরে দূরে থাকে। তাই পোষাক-আষাক একটু অদ্ভুত, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
গল্পের একটা জবরদস্ত প্লট ভাবছিল সে। অ্যানা তার বারোটা বাজিয়ে দিল।
অ্যানসন ফিরে তাকাতেই অ্যানা বলল, এই নিয়ে দুবার ডাকলাম আপনাকে, এমন তন্ময় হয়ে বসে আছেন মনে হয় কাউকে খুন করবার প্ল্যান করছেন মনে মনে। ব্যাপারটা কি?
কি, তা নিয়ে তোমার মাথা ব্যাথার কোন দরকার নেই। মন দিয়ে নিজের কাজ কর।
জানালার কাছে উঠে গেল অ্যানসন।.তারপর সে নীচে তাকিয়ে দেখল মেইন স্ট্রীট দিয়ে পিলপিল করে গাড়ি ঘোড়া চলছে। সেদিকে তাকিয়ে সে একটা সিগারেট ধরাল।
আজ শনিবার। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর এক বন্ধুর সঙ্গে গলফ খেলতে যাবার কথা। কিন্তু খেলায় আজ তেমন উৎসাহ নেই কারণ তার মন পড়ে আছে টাউনে। কাজে কিছুতেই মন বসছে না। টেবিলে একগাদা চিঠি পড়ে আছে। কিন্তু মনে পড়ছে শুধু সুন্দরী মেগ বারলোর কথা।
সত্যি সত্যিই তার মাথায় একটা খুনের পরিকল্পনা ঘুরছিল। অবশ্য বাস্তবেনয়। মেগ-এর গল্পের প্লট ভাবছিল সে। আচ্ছা সে যদি সত্যি সত্যিই খুনটা করে তাহলে কি কেউ বুঝতে পারবে। অ্যানা কিভাবে বুঝল? ও কি চশমার কাছে মনের কথাও পড়তে পারে নাকি?
মন থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সে চেয়ারে ফিরল, অ্যানাকে বলল, এসো খাতা পেনসিল নিয়ে, ডিটেকশান নিতে হবে।
ব্রেন্ট রেল স্টেশনের কাছে অ্যালান আর্মস নামের বিরাট পাঁচতলায় অ্যানসনের এক কামরার ফ্ল্যাট। বড় রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে এই বাড়ি। ইনসুরেন্স করপোরেশনের চাকরী পাবার পর থেকেই সে এখানে আছে। প্রত্যেক ফ্ল্যাটের জন্যই আলাদা গ্যারেজ আছে। অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও মোটামুটি ভালো।
আজ গলফ খেলাটা মোটেই জমেনি। রাতের খাবার তার মুখে বিস্বাদ লাগলো। একমাত্র ভালো লাগল হুইস্কি। প্রায় এক বোতল হুইস্কি সে বসে বসে গিলল।
খানিকটা নেশা হল। মাথাটাও হালকা লাগলো। গাড়ি চালিয়ে সে সোজা বাড়িতে এলো। গ্যারেজে ঢুকে ইঞ্জিন বন্ধ করে হেডলাইট নিভালো। তারপর বেরিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে– পেছন ফিরলল। দেখল গ্যারেজের অন্ধকার কোনে একটা ছায়া নড়ে উঠল।
আজ এ সময় তো লোজন এমনিতেই বাড়িতে নেই। সকলেই প্রায় গেছে ব্রেন্ট-এ, দেড় দিনের ছুটি কাটাতে। তাহলে এ ছায়াটা কার।
ছায়াটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল। লম্বা গাট্টাগোট্টা চেহারার এক পুরুষ। সে অ্যানসনের সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখেই অ্যানসন একটা ঢোক গিলল।
লোকটা ভরাট গলায় বলল-এই যে দোস্ত এতক্ষণে এলে তাহলে। তোমার জন্য এখানে দু-ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
অ্যানসনের হৃৎপিণ্ডের গতি হঠাৎ বেড়ে গেল। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। ইস্ এ কদিন জো ডানকানের টাকা শোধ দেবার কথাটা একেবারেই মনে ছিল না। মেগ এর ভাবনায় এই কটা দিন যেন কিভাবে কেটে গেল, ডানকান তত তাকে বলেই ছিলো যে শনিবারের মধ্যে অন্ততঃ আসলটা মিটিয়ে দিতে, না হলে সে গেলার হেগনকে পাঠাবে।
সেই গেলার হেগানই এখন মূর্তিমান যমদূতের মতো সামনে দাঁড়িয়ে।
গেলার সম্বন্ধে তার একটা গল্প মনে পড়ল। একজন লোক জোর টাকা শোধ করতে পারেনি। পরদিন গেলার গিয়েছিল তার সঙ্গে মোলাকাত করতে। গেলার কিছুই করেনি শুধুদুহাতে সপাটে লোকটাকে মেঝের ওপর দুটো আছাড় মেরেছে। অনেক চিকিৎসার পরেও লোকটাকে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হয়। পুলিশ গেলারকে ধরেছিল। কিন্তু পাঁচ জায়গার পাঁচজন লোক গেলার-এর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছে যে এই ঘটনার সময় গেলার তাদের সঙ্গে জুয়ো খেলছিল। অতএব গেলার ছাড়া পেয়ে গেছে।
মাত্র দুহাত দূরে গেলার। সে এক পা পেছোলে গেলার এক পা এগোল। মুখে তার ফুটে। উঠল এক বিচিত্র হাসি। সে বলল–টাকা নিতে এসেছি টাকা দাও।
অ্যানসন-এর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হল। তুমি জোকে বোলো আমি সোমবার টাকা দিয়ে দেবো। ভয়ে অ্যানসন তোতলাতে লাগল।
–সোমবার না জো আমাকে আজই টাকা নিয়ে যেতে বলেছে। আজই তার টাকা চাই। নাও মাল ছাড়ো দোস্ত। বলে সে এগিয়ে এল।
অ্যানসন বলল-বলছি তো সোমবার ঠিক টাকা দিয়ে দেবো। তুমি এগোচ্ছো কেন?
গেলার দাঁত বের করে হাসতে লাগল। সে বলল-আরে দোস্ত অত ভয় পেলে চলে। জোর কাছে কাজ করার আগে আমি ছিলাম অ্যান-এর সঙ্গে। মনে আছে তো সেই অ্যানবার্নস্টেন, সে তোমার কাছে আট হাজার ডলার পায়? সে অবশ্য ভেবেই রেখেছে যে তুমি আর উপুড় হস্ত করছেনা। এখনও অবশ্য শোধ দেয়ার সময় পেরিয়ে যায়নি। সময় আছে, কিন্তু সে এখন থেকেই চিন্তায় পড়েছে। বেশ সোমবার কিন্তু ঠিক টাকা মিটিয়ে দিও।নইলে আবার আমাকে আসতে হবে। আর এখন থেকে অ্যান-এর টাকাটাও জোগাড় করার চেষ্টা করো। কেন শুধু শুধু আট হাজার ডলারের জন্য জীবনটা অনর্থক খোয়াতে যাবে।
–হ্যাঁ হ্যাঁ সে আর বলতে। সে আমি আগেই জমাতে শুরু করেছি। অ্যানসনের ধড়ে যেন প্রাণ এলো। বুকের স্পন্দনটা একটু কমলো।
–তাহলে ঐ কথাই রইলো। সোমবার শোধ দিচ্ছো কথার যেন নড়চড় না হয়। হারে বাবা হা। দিচ্ছি, দিচ্ছি। অ্যানসন মনে মনে ভাবলো যাক বাবা তাহলে এই কথাই রইল। দুটো দিন সময় পাওয়া গেল। সোমবার রাত্রে আমি পগার পার। মেগ-এর সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খাবো। তাহলে এখনকার মতো ঝামেলা মিটল।
কিন্তু না ঝামেলা মিটল না। গেলার চোখের নিমেষে তার তলপেট লক্ষ করে চালাল এক ঘুষি। অ্যানসনের মুখ দিয়ে কোৎ করে একটা শব্দ বেরল। তারপর লাফিয়ে উঠে মাটিতে পড়ে গেল।
অ্যানসনের চোখের সামনে হাজার সরষে ফুল ফুটে উঠলো। বহুদূর থেকে যেন ভেসে এলো গেলার-এর গলার স্বর। সোমবার যেন ভুল না হয়? তাহলে মনে রেখো, আর আট হাজারের জন্য এলে তোমাকে আর জ্যান্ত রেখে যাবো না। আজ তাহলে চলি।
অ্যানসন দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে রইল। গেলার এর বুটের শব্দ তার কানের পর্দায় আওয়াজ তুলল। শরীরের কোষে কোষে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল।
অ্যানসন চোখ খুলল। অবশ হাত চোখের সামনে এনে ঘড়ি দেখলো। সময় সকাল এগারোটা। তারিখটা একদিন এগিয়ে গেছে। আজ রবিবার প্রায় বারোঘণ্টা একটানা ঘুমিয়েছে সে।
একটু মাথা তুলে পেটের দিকে তাকাল। দেখল নাভির কাছে চামড়ায় গোল হয়ে কালশিরা পড়েছে।
গেলার চলে যাবার পর বঙ্কষ্টে যন্ত্রণাকাতর শরীরটা টেনে নিয়ে সেলিফটে করে কোনরকমে নিজের ফ্ল্যাটে আসে। তারপর ঘরে ঢুকে আর হুশ হয়নি। গেলারটা একটা আস্ত শয়তান।
নাঃ সোমবারের মধ্যে টাকাটা শোধ করতেই হবে। এবার গেলার রক্তপাত না করে ফিরে গেছে, এর পরের বার রক্ত না ঝরিয়ে যাবে না। অ্যান-এর টাকাটাও জুনের মধ্যে যেভাবেই হোক শোধ করা চাই। আট হাজার ডলার কম কথা নয়। তখন মাথাটাই বোধহয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। না হলে খবরের উপর ভরসা করে কেউ কখনো ঘোড়ার পেছনে আট হাজার ডলার খেলে? একে বোকামীনা বলে বলে মতিচ্ছন্নতা। লাভটা কি হলো?টাকায় যে টাকা গেলো একগাদা ধার হলো, এখন সেই ধার শুধতে জীবন-মরণ আশংকা।
একইভাবে বিছানায় শুয়ে রইল অ্যানসন। ভয়ে-আতঙ্কে হতাশায় সে বারবার শিউরে উঠল। নাঃ একটা উপায় বের করতেই হবে। টাকা চাই টাকা।
দেখতে দেখতে চার ঘণ্টা কেটে গেলো। তার মাথায় একের পর এক চিন্তা এসে ভিড় করল। কোনোটাই তেমন জোরাল নয়। তাই শেষমেষ সব কটাই ছেটে বাদ দিতে হল।
না, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। সদুপায়ে অর্থ উপার্জন, সৎভাবে জীবন-যাপন এসব স্রেফ উপদেশ, কাজের কথা নয়। সততায় পয়সা আসে না, এর জন্য সুযোগ বুঝে অসাধুতার আশ্রয় নিতে হয়।
হঠাৎ তার মেগ-এর কথা মনে পড়লো।
মনে হয় মেগও টাকা রোজগারের ধান্দায় আছে। আলবৎ আছে, নাহলে সেদিন তাকে ডেকে গয়না দেখিয়ে বীমা করতে ডাকত না। এটা তো স্রেফ ভনিতা। আসলে তার কাছ থেকে বীমা কোম্পানিকে ফাঁসাবার দু-একটা কায়দা-কানুন জেনে নেওয়াই হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য। না হলে কেনই বা সে তাকে আমন্ত্রণ জানাবে, কেনই বা কায়দা করে বলবে যে বৃহস্পতি আর সোমবার এই দুটো দিন তার স্বামী বাড়ি থাকে না, সে একা থাকে। হা মেগকে দিয়ে কাজ হবে, ওকে হাতে রেখে সবদিক ভেবেচিন্তে এগোতে হবে। এই তার একমাত্র বাঁচার পথ।
তার চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। ধীরে ধীরে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। সেদিন আর সে ঘুম ভাঙলো না। ঘুম ভাঙলো পরদিন সোমবার।
ফ্রামলের দোকানের সামনে গাড়ি রেখে সে এগুলো।
তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। পেটের মধ্যে সমানে মোচড় দিচ্ছে।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল অ্যানসন। সে রিসেপশানে জেনে নিল যে ফুলের বিভাগটা কোথায়।
মেয়েটা বলল-লিফটে সোজা নেমে যান। নীচের তলায় একেবারে কোণের দিকে পুষ্প বিভাগ। ফুলের কাউন্টারে প্রচণ্ড ভীড়। সবারই সমান তাড়া, সমান ব্যস্ততা, সবারই কোনো না কোন জরুরী কাজ পড়ে আছে।
অ্যানসন চুপচাপ দাঁড়িয়ে নানারকম পুষ্প দেখতে লাগল। একপাশে জিনিয়া ফুলের কয়েকটা জোড়া, সে দেখেই বুঝলো যে এগুলো বারলো বাড়ির ফুল। নাঃ ফিল বারলো নিঃসন্দেহে গুনী লোক। তার হাতের কাজ খুব সুন্দর।
কাউন্টারের ওপাশে ফুলের মতই সুন্দর চারটে মেয়ে ছোটাছুটি করে খদ্দের সামলাচ্ছে।
বারলো, হ্যাঁ আলবত এই লোকটাই ফিল বারলো ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে অর্ডার-বই এবং পেনসিল। সে মেয়েদের কাজ তদারকি করছে।
কিন্তু এটা কেমন হল। হিসেব তো ঠিক মিলছে না। অমন সুন্দরী অপরূপা স্ত্রী, নিজে সে এমন কুৎসিত কেন?
বয়েস চল্লিশের বেশী ছাড়া কম নয়। এক মাথা ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল। রোগা, বেঁটে, গর্তে ঢোকা দুটো ছোট ছোট কুতকুতে চোখ। চোখের কোণে কালি। পাতলা ঠোঁট। মুখ দেখলেই বোঝা যায়, বদমেজাজী। খড়গর মতো তীক্ষ্ণ, বাঁকানো নাক। সুন্দরের মধ্যে শুধু ওর হাত দুখানা। যেমন লম্বা, তেমন সুন্দর হাতের গড়ন, ঠিক যেন শিল্পীর হাত, এছাড়া মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সুন্দরের চিহ্নমাত্র নেই।
অ্যানসন ধীরে ধীরে কাউন্টার ছেড়ে বাইরে এলো। গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে ভাবল নাঃ ভয়ের কিছু নেই। ফিল বারলোর মতো বিরোধী দলের প্রতিযোগীকে কায়দা করতে আমার একেবারেই বেগ পেতে হবে না, একটুও না। তার বুক চিরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল।
পাশেই এক সারি টেলিফোন বুথ। সে ঢুকে পড়লো একটাতে। টেলিফোন বই দেখে প্রু টাউনের বারলোদের নম্বর পেতে দেরী হলো না।
রিসিভার তুলে সে ডায়াল করলো। ফোন মেগই তুলল। হ্যালো কাকে চাই?
নমস্কার মিসেস বারলো। আমি জন অ্যানসন কথা বলছি?
কে?
এ কিরে বাবা, এর মধ্যেই ভুলে গেলেন নাকি?
জন অ্যানসন, ন্যাশানাল ফাইডেলিটি ইনসুরেন্স-এর জন অ্যানসন। মনে পড়েছে?
আরে ছি ছি! দেখুন কাণ্ড, কিছু মনে করবেন না। আমি এতক্ষণ লিখছিলাম, মনটা তাই অন্য দিকে পড়ে ছিল।
আমি আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো?
না না বিরক্তির কি? আমি তো আজ সকালেও আপনার কথা ভাবছিলাম, আমার গল্পের আইডিয়ার কতদূর কি করলেন।
আপনাকে তো সেই জন্যই ফোন করলাম। একটা জব্বর আইডিয়া মাথায় এসেছে। গল্পের জন্য খুব ভালো একখানা প্লট। ভাবছিলাম যে…
কি ভাবছিলেন?
আচ্ছা আজ রাতে কি আপনার কোন কাজ আছে?
কাজ মানে কয়েকটা জরুরী টেলিফোন করতে হবে তারপরেই কাজ শেষ। সাতটা নাগাদ যদি আপনার বাড়িতে পৌঁছই তাহলে খুব অসুবিধে হবে কি?
না না, অসুবিধে কি? আজ তো আমি সারারাত একলাই থাকবো। আসুন না আজ কিন্তু এখানেই খাওয়া-দাওয়া করবেন। তারপর বেশ জমিয়ে গল্প-স্বল্প করা যাবে।
অ্যানসনের বুকে হাতুড়ি পেটা শুরু হল। এত জোর শব্দ, মেগ ফোনে শুনতে পাচ্ছে না তো।
ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইল। সন্ধ্যে সাতটা, ছাড়ছি। আনন্দে-উত্তেজনায় তার হাত কাঁপতে লাগল।
গায়ের রং মাজা, পরনে নীল সার্ট ও সাদা স্ন্যাক্স বেশ সম্ভ্রান্ত গোছের চেহারা, মেয়েটি হেঁটে এসে ফিল বারলোর সামনে দাঁড়ালো। তার নীল চোখের তারায় জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল–আচ্ছা এটা কি ম্যাগনোলিয়া লাগাবার সময়?
বারলোর চোয়াল শক্ত হলো, বুকের স্পন্দন বাড়লো, না আরো কটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের বললে আমরাই লাগিয়ে দিয়ে আসবো, এসব কাজ আমরা প্রায়ই করে থাকি।
বেশ তো তাহলে অর্ডারটা লিখে নিন। মিসেস ভ্যান হার্ভজ, দু-ডজন ম্যাগনোলিয়া। এখানে আমার নামে অ্যাকাউন্ট আছে। টাকা পয়সা যা খরচ হয়, সেই অ্যাকাউন্ট থেকেই নিয়ে নেবেন। যেন দেরী না হয়। বলে আর দাঁড়াল না।
ওপাশে পোষাকের কাউন্টারের দিকে এগুলো। হাঁটার ছন্দে হিল্লোল উঠলো।
বারলো অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল।