হেম কলসেতে বারি লয়ে দুইজন।
রাজার নিকটে যায় আনন্দিত মন।।
যথায় আছয়ে রাজা তথায় চলিল।
দুর্য্যোধন নিকটেতে জল আনি দিল।
দেখি আনন্দিত অতি কৌরবের পতি।
অভিষেক করিতে উঠেন শীগ্রগতি।।
উরু ভাঙ্গি পড়িয়াছে উঠিতে না পারে।
স্পর্শ করি দিল বারি অশ্বন্থামা করে।।
আপনি লইয়া বারি ঢালিলেক শিরে।
এইরূপে সেনাপতি করিল দ্রৌনীরে।।
বিদায় হইয়া তবে বীর তিনজন।
পান্ডব শিবিরে যান সত্বর গমন।।
ঘোর অন্ধকার নিশি পথ নাহি চিনি।
ধীরে ধীরে চলি যায়, শব্দ নাহি শুনি।।
হেনমতে কতদূর যায় তিনজন।
বৃক্ষতলে বসি করে কথোপকথন।।
হেনকালে রাজা সেই বৃক্ষের উপরে।
দারুণ সঞ্চান পক্ষী পান দেখিবারে।।
জাগি রহিয়াছে সেই ভক্ষণের তরে।
নিদ্রিত সকল পক্ষী সকল সংসারে।।
দেখিয়া উপায় পেয়ে বলে অশ্বথামা।
এক বুদ্ধি পাইলাম কৃপাচার্য্য মামা।।
কহিতে লাগিল পরে দ্রোণের কুমার।
পাঞ্চাল পান্ডবে আজি করিব সংহার।।
এইমত অম্বথামা কহি দুই বীরে।
হরষিত হয়ে যায় পান্ডব শিবিরে।।
রণজয় করিয়া হরিষ বড় মনে।
সুখে নিদ্রা যায় সব পান্ডব নন্দনে।।
এইকালে তিনজন উত্তরিল তথা।
বীরদর্প করি দ্রোণি কহিলেন কথা।
সবংশে পান্ডবে আজি মারিব সমূলে।
একজন না রাখি ব পান্ডবের কুলে।।
বলিলেন কৃপ ইহা না হয় উচিত।
নিদ্রিত জনেরে নাহি মারি কদাচিত।।
ভয়ার্ত্ত শরণাগত নিদ্রিত যে জন।
কখন না হেন জনে করি প্রহরণ।।
নিষেধ না মানি ইহা যেই জন করে।
পঞ্চম পাতকী মধ্যে গণি যে তাহারে।।
আমার বচন তুমি শুন সাবধানে।
হেন কর্ম্ম বাসনা না কর কদাচনে।।
আপন কুকর্ম্মে মজিলেক দুর্য্যোধন।
ধার্ম্মিক পান্ডবে হিংসা করে অনুক্ষণ।।
পান্ডবের সহায় সম্পদ নারায়ণ।
তাহার অহিত করি জীবে কো জন।।
দুর্য্যোধন হিতাহিত বিচারিয়া মনে।
যত শক্তি আছিল যুঝিল প্রাণপণে।।
তখন নারিলে যুদ্ধ করিবে এখন।
দুর্ব্বদ্ধি ছাড়িয়া তাত স্থির কর মন।।
পিতৃবৈরী যদি চাহ করিতে নিধন।
রণমধ্যে ধরি বাপু কর নিপাতন।।
সংকর্ম্ম করিবে তাত মনে বিচারিলে।
অসৎপথে পদার্পন কিহেতু করিলে।।
সৎকর্ম্ম সাধন তাত করহ যতনে।
অসৎকর্ম্ম করিবারে ইচ্ছা কেন মনে।।
এখন যে কহি আমি গুন সাবধানে।
তিনজন চল যাই ধৃতরাষ্ট্র স্থানে।।
সবাকার অধিকারী হন অন্ধরাজ।
সে যেমত কহিবে করিব সেই কাজ।।
সৌপ্তিকপর্ব্বের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে শুনিলে এ ভব হবে পার।।
কৃপের বচন গুনি দ্রোণের নন্দন।
ইচক্ষু রক্তবর্ণ কহিছে বচন।।
করিয়াছি প্রতিজ্ঞা রাজার বিদ্যমানে।
সকল করিব নষ্ট তোমার বচনে।।
শুভ্রধর্ম্ম আছে হেন কহে জ্ঞানিজন।
শুভ্রধর্ম্ম হয়ে করিবেক প্রতিজ্ঞা পালন।।
দ্রৌণি বলে যাব আমি শিবির ভিতর।
তার ছাড়ি দেহ যদি প্রাণে থাকে ডর।
দুনিয়া কহেন শিব ছদ্মবেশধারী।।
বিকেশ্বর আছি আমি দ্বারের রক্ষণে।
কামা না জিনিয়া পুরে যাইবে কেমনে।।
দুনিয়া কুপিত দ্রৌণি মারে নানা বাণ।
বধ মেলি সে সব গিলেন ভগবান।।
বাণ এড়ে দ্রৌণি খান ত্রিলোচন।
পাখিয়া বিস্ময় মানে দ্রোণের নন্দন।।
বিদ্য ভুণ হৈল আর অস্ত্র নাহি তাতে।
বিস্ময় মানিয়া দ্রোণি লাগিল ভাবিতে।।
অমান্য মনুষ্য নাহি হবে এইজন।
প্রাণ গিলে নর হয়ে, না দেখি এমন।।
জিজ্ঞাসা করিল তবে দ্রোণের নন্দন।
এক নিবেদন মম গুন মহাজন।।
অরুণ আমার অস্ত্র আপনি গিলিলা।
অত্র বাণ খেয়ে কিছু ব্যথিত নহিলা।।
বিদ্য হৈল তুণ মম, বাণ নাহি আর।
তোমার চরিত্র দেখি লাগে চমৎকার।।
কোন দেব তুমি হও কহ মহাশয়।
অনুগ্রহ করি নাশ করহ সংশয়।।
বাতেক বলিল যদি দ্রোণের নন্দন।
বোধিয়া তাহারে কহেন ত্রিলোচন।।
নাহি জান দ্রোণপুত্র আমি কোনজন।
অম্বনাথ নাম মম জানে বিশ্বজন।।
তবশুনি কহে দ্রৌণি ষোড় করি হাত।
পা করি মোরে দ্বার ছাড় বিশ্বনাথ।।
ধূর্জ্জটি বলেন ইহা কেমনে পারিব।
পান্ডবের আজ্ঞা বিনা ছাড়িতে নারিব।।
চিন্তিত হইল দ্রৌণি শুনিয়া বচন।
ভাবে মনে উপায় কি করিব এখন।।
কি করিব কি হইবে ভাবে দ্রৌণি বীর।
শিব পূজা করিব অন্তরে করে স্থির।।
এত বলি গড়ে লিঙ্গ মৃত্তিকা লইআ।
বিশ্বনাথে অর্চ্চিলেন বিল্বপত্র দিআ।।
শত্রুরে করিয়ে ক্ষয় অশেষ প্রকারে।
বলে ছলে কৌশলে নাশিব অকাতরে।।
ক্ষভ্রধর্ম্ম লইয়াছি ব্রাক্ষ্মণ হইয়া।
রাখিব ক্ষভ্রিয়ধর্ম্ম রিপু সংহারিয়া।।
আমারে মন্ত্রণা দিলা নিজশক্তিমত।
কেবা এত অজ্ঞান করিবে সেইমত।।
দুরাচার রিপু মম দ্রুপদ নন্দন।
অন্যায় সমরে তাতে করিল নিধন।।
সেই কোপে আজিও আমার তনু জ্বলে।
নিতান্ত বধিব আজি নিজ বাহুবলে।।
তাহে যেইজন তার হইবে সহায়।
তার সহ মারিয়া পাঠাব যমালয়।।
যেই দিন ধৃস্টদ্যুন্ন নাশিলেক তাতে।
অঙ্গীকার করিয়াছি সবার সাক্ষাতে।।
ব্রক্ষ্মবধী পাতকী অধম দুরাচার।
তাহাকে মারিতে হেন উদ্যম আমার।।
পাঞ্চাল পান্ডবে আমি করিব নিধন।
পরিতুষ্ট হইবে ভুপতি দুর্য্যোধন।।
হর্ত্তা কর্ত্তা অন্নদাতা জনম অবধি।
প্রাণপণ করিয়া তাহার কার্য্য সাধি।।
গৃহমধ্যে শ্রেষ্ঠ যেইজন অন্নদাতা।
তাহারে তুষিতে পাপ নাহিক সর্ব্বথা।।
দুর্য্যোধন তুষিব মারিব পিতৃবৈরি।
সন্তুষ্ট হইবে মোরে কুরু অধিকারী।।
এত বলি গর্জ্জে বীর দ্রোণের নন্দন।
নিঃশব্দে রহেন কৃপ না কহে বচন।।
মহাবেগে যান দ্রৌণি অতি ক্রোধমনে।
পাছু পাছু দুইজনে চলে তাঁর সনে।।
শিবির নিকটে উত্তরিল তিন জন।
পশিতে বিরোধী হৈল নর এক জন।।
বিভূতি ভূষণ তার অঙ্গে ফণিহার।
চতুর্ভূজ ত্রিলোচন শিরে জটাভার।।
ব্যাঘ্রচর্ম্ম পরিধান করতে ডম্বুর।
দিব্যরূপ দ্বার রক্ষা করেন শঙ্কর।
নিষেধ করেন তারে যাইতে ভিতর।।
গঙ্গালজলে পুষ্প দিয়া করিল, অর্চ্চন।
পূজা সারি স্তব করে দ্রোণের নন্দন।।
কাশীরাজ দাস কহে গুন সর্ববজন।
যেইরূপ স্তব করে দ্রোণের নন্দন।।