দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অশ্বচোর
ভূমিনিবদ্ধ দৃষ্টি তুলিয়া সুগোপা চমকিয়া দেখিল, এক পুরুষ দেবদারু ছায়ার তলে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কখন এই অপরিচিত আগন্তুক নিঃশব্দ পদে তাহাদের অত্যন্ত সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে তাহারা জানিতে পারে নাই।
সুগোপা বলিয়া উঠিল— ‘কে তুমি?’
আগন্তুক উত্তর করিল— ‘পথিক। তুমি প্রপাপালিকা? জল দাও।’
সুগোপা পথিককে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল। আগন্তুক যে বিদেশী তাহা তাহার বেশভূষা দেখিয়া সন্দেহ থাকে না। একটি জীর্ণ লৌহজালিকে ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত, মস্তকেও অনুরূপ লৌহজালিকের শিরস্ত্রাণ। কটিতে চর্ম-কোষবদ্ধ তরবারি, পদদ্বয় স্থূল বৃষচর্মের পাদুকায় চর্মরজ্জু দ্বারা আবদ্ধ। দেহে কোথাও মাংসের বাহুল্য নাই, বরং দৈর্ঘ্যের অনুপাতে ঈষৎ কৃশ। সমস্ত মিলাইয়া ছিলাহীন ধনু-দণ্ডের মত দেহ ঋজু ও নমনীয়; কিন্তু মনে হয়, প্রয়োজন হইলে মুহূর্তমধ্যে গুণসংযুক্ত হইয়া প্রাণঘাতী আকার ধারণ করিতে পারে।
আগন্তুকের বয়ঃক্রম অনুমান করা কঠিন, তবে ত্রিশ বৎসরের অধিক নয়। মুখাবয়বের মধ্যে চক্ষু ও নাসা অতিশয় তীক্ষ্ণ। ভ্রমরকৃষ্ণ চক্ষুর দৃষ্টিতে একটা সতর্ক দুঃসাহসিকতা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। বাহুবল ও কূটবুদ্ধির উপর নির্ভর করিয়া যাহাদের জীবনধারণ করিতে হয়, তাহাদের চক্ষে এরূপ দৃষ্টি বোধকরি স্বভাবসিদ্ধ হইয়া পড়ে।
ফলত আগন্তুক যে একজন যুদ্ধজীবী তাহা সহজেই অনুমান করা যায়। তাহার মুখে ও বাহুতে অগণিত সূক্ষ্ম ক্ষতরেখা দেখিয়া এই অনুমান দৃঢ় হয়। ছিন্ন লৌহজালিকের ফাঁকে বক্ষের উপরেও বহু রেখা অঙ্কিত রহিয়াছে, দেখিলে মনে হয় গৌরবর্ণ ত্বকের উপর কজ্জল দিয়া কেহ রেখাগুলি আঁকিয়া দিয়াছে। উপরন্তু ভ্রূযুগলের মধ্যস্থলে গোলাকৃতি তিলকের ন্যায় একটি তাম্রবর্ণ চিহ্ন আছে। ইহা ক্ষতচিহ্ন অথবা সহজাত জটুল তাহা নির্ণয় করা যায় না।
সুগোপা ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে আগন্তুককে দেখিয়া লইয়া জল আনিবার জন্য কুটির অভিমুখে প্রস্থান করিল। আগন্তুক মন্থরপদে আসিয়া তাহার পরিত্যক্ত শিলাপট্টের উপর বসিল। তাহার বসিবার ভঙ্গিতে একটু ক্লান্তভাব প্রকাশ পাইল।
মোঙ্ এতক্ষণ কৌতূহল সহকারে নবাগতকে দেখিতেছিল, এখন বলিল— ‘তুমি দেখিতেছি বিদেশী। তোমার দেশ কোথায়?’
বিদেশী উত্তর না দিয়া এমনভাবে হস্ত সঞ্চালন করিল, যাহাতে গান্ধার হইতে পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত যে-কোনও দেশ হইতে পারে।
মোঙ্ আবার প্রশ্ন করিল— ‘তুমি যুদ্ধ ব্যবসায়ী?’
বিদেশী সতর্ক দৃষ্টি তাহার দিকে ফিরাইয়া তাহাকে একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লইল, তারপর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল।
মোঙের ভেকধ্বনিবৎ ব্যঙ্গহাস্য আবার উত্থিত হইল— ‘ভাগ্যদেবতা দেখিতেছি তোমার প্রতি সুপ্রসন্ন নয়; অস্ত্রক্ষত ছাড়া যুদ্ধ ব্যবসায়ে আর কিছু লাভ করিতে পার নাই। কোন্ রাজ্যের সেনাভুক্ত ছিলে?’
বিদেশী এবারও উত্তর দিল না, ঊর্ধ্বদিকে তাকাইয়া যেন অন্যমনস্ক রহিল। মোঙের কৌতূহল উত্তরোত্তর বাড়িতেছিল, সে অতঃপর গাম্ভীর্য অবলম্বনপূর্বক পৌরুষ সহকারে বলিল— ‘যুবক, তুমি এ রাজ্যে নূতন আসিয়াছ, বোধহয় জান না ইহা হূণ অধিকৃত। মহাপরাক্রান্ত হূণ কেশরী রোট্ট ধর্মাদিত্য এই বিটঙ্ক রাজ্যের অধীশ্বর। আমিও হূণ। হূণগণ বিজাতীয়ের স্পর্ধা সহ্য করে না। তোমার নাম কি?’
যুবকের স্বল্প গুম্ফের অন্তরালে একটু হাসি দেখা দিল; সে বলিল— ‘আমার নাম চিত্রক।’
‘চিত্রক! চিতা বাঘ!’ মোঙের চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল— ‘তোমার নাম সার্থক বটে, তোমার সর্বাঙ্গে অস্ত্রাঘাত চিহ্ন দেখিয়া তোমাকে চিতা বাঘ বলিয়াই মনে হয়। এরূপ নাম কেবল হূণদের মধ্যেই ছিল— সিংহ শূকর নাগ বৃষ— যাহার যেরূপ আকৃতি প্রকৃতি সে সেইরূপ নাম গ্রহণ করিত। এখন আর কিছু নাই—’ সখেদ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া আগ্রহভরে মোঙ্ বলিল— ‘তুমি বয়সে নবীন, কিন্তু নিশ্চয় অনেক যুদ্ধ করিয়াছ। বহু নগর লুণ্ঠন করিয়াছ। এই বিটঙ্ক রাজ্য একদিন আমরা— কিন্তু এদেশে যুদ্ধবিগ্রহ আর হয় না। মেষপাল কাহার সহিত যুদ্ধ করিবে? পঁচিশ বৎসর পূর্বে একদিন ছিল—’
যুবক জিজ্ঞাসা করিল— ‘কপোতকূট এখান হইতে কত দূর?’
মোঙ্ বলিল— ‘তুমি কপোতকূট যাইবে? অধিক দূর নয়, দু’দণ্ডের পথ। এক প্রহর এখানে বিশ্রাম করিয়া যাত্রা করিলেও সন্ধ্যার পূর্বে রাজধানী পৌঁছিতে পারিবে। তোমার অশ্ব নাই দেখিতেছি, হূণ যোদ্ধা কিন্তু অশ্ব বিনা এক পা চলে না। উষ্ট্র রোমের শিবির এবং অশ্বের পৃষ্ঠ— হূণের ইহাই বাসস্থান। পঁচিশ বৎসর পূর্বে আমরা দ্বাদশ সহস্র অশ্বারোহী—
সুগোপা মৃৎপাত্রে জল লইয়া ফিরিয়া আসিল, সুতরাং মোঙের গল্পে বাধা পড়িয়া গেল। পথিক সত্যই তৃষ্ণার্ত ছিল, সে সাগ্রহে উঠিয়া আসিয়া প্রথমে হস্তমুখ প্রক্ষালন করিল, তারপর গণ্ডূষ ভরিয়া তৃপ্তিসহকারে জল পান করিল। সুগোপা তাহার অঞ্জলিতে জল ঢালিয়া দিতে দিতে মোঙের দিকে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল— ‘মোঙ্, আর বিলম্ব করিও না, দাঁতন লইয়া গৃহে ফিরিতে বিলম্ব হইলে তোমার নাগসেনা দাঁতনের পরিবর্তে তোমার মুণ্ডটি চিবাইবে।’
মোঙ্ চকিতভাবে ঊর্ধ্বে চাহিল, সূর্যদেব মধ্য গগন অতিক্রম করিয়া পশ্চিমে হেলিয়া পড়িয়াছেন। মোঙ্ শঙ্কিতমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল; জঙ্গলের মধ্যে করঞ্জ কাষ্ঠ অন্বেষণ করিতে সময় লাগিবে, তারপর গৃহে ফিরিবার পথও অনেকখানি। বৃদ্ধ বয়সে দ্রুত চলিবার শক্তি নাই, নাগসেনার সম্মুখে ফিরিয়া যাইতে হয়তো সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া যাইবে। সেটা মোঙের পক্ষে সুখকর হইবে না। পারিবারিক ব্যাপারে যুদ্ধবিগ্রহ মোঙ্ ভালবাসে না।
পঁচিশ বৎসর পূর্বেকার বীরত্ব কাহিনীটা আগন্তুককে শুনাইবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তাহা আর ঘটিয়া উঠিল না। মোঙ্ গাত্রোত্থান করিল; কাহাকেও কোনও সম্ভাষণ না করিয়া ক্ষুব্ধ অস্পষ্ট স্বরে তরবারির নখ, ঘোড়ার ক্ষুর ও স্ত্রীজাতির কটাক্ষ সম্বন্ধীয় প্রবাদবাক্যটি আবৃত্তি করিতে করিতে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল।
এদিকে তৃষ্ণা নিবারণ করিয়া চিত্রক আবার শিলাপীঠের উপর বসিয়া ছিল। সুগোপা দেখিল, সে দুই জানুর উপর কফোনি রাখিয়া মুষ্টিবদ্ধ হাতের শীর্ষে চিবুক ন্যস্ত করিয়া স্থিরনেত্রে তাহার পানে চাহিয়া আছে। হঠাৎ সুগোপা একটু অস্বস্তি অনুভব করিল। সে মাসের পর মাস একাকিনী এই জলসত্রে দিন কাটায়, কত পথিক আসে যায়, কেহ নবীনা প্রপাপালিকাকে দেখিয়া দু’টা রঙ্গ পরিহাসের কথা বলে, সুগোপা চটুলকণ্ঠে তাহার উত্তর দেয়; কেহ বা প্রগল্ভতার সীমা অতিক্রম করিলে দুই চারিটি কঠিন বাক্যবাণে জর্জরিত করিয়া তাহাকে অধোবদনে বিদায় করে। কোনও অবস্থাতেই সুগোপার আত্মপ্রত্যয় বিচলিত হয় না। কিন্তু আজ এই জীর্ণবেশ বিদেশী যুবকের নিষ্পলক চাহনি তাহাকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিল।
স্খলিত নিচোলপ্রান্ত বুকের উপর টানিয়া দিয়া সুগোপা বলিল— ‘তুমি তো কপোতকূটে যাইবে, তবে বিলম্ব করিতেছ কেন?’
চিত্রক তেমনিভাবে চাহিয়া থাকিয়া মৃদুস্বরে বলিল— ‘শ্রান্তি দূর করিতেছি। আমার ত্বরা নাই।’
কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল; চিত্রকের অচঞ্চল দৃষ্টি সুগোপার উপর বিন্যস্ত হইয়া আছে। সুগোপা ক্রমে অধীর হইয়া উঠিল, ঈষৎ রুক্ষস্বরে কহিল— ‘তুমি কোন্ বর্বর দেশের মানুষ— স্ত্রীলোক কখনও দেখ নাই?’
এইবার চিত্রক সুগোপার মুখ হইতে দৃষ্টি সরাইয়া সাবধানে চারিদিকে চাহিল। তাহার অধরোষ্ঠ একবার সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হইল। তারপর আবার মুষ্টির উপর চিবুক রাখিয়া সে ধীরে ধীরে বলিল— ‘স্থানটি বেশ নির্জন।’
এই অসংলগ্ন উত্তরে সুগোপা রুষ্টভাবে অধর দংশন করিল, তারপর ভূমি হইতে জলপাত্র তুলিয়া লইয়া কুটিরের দিকে চলিল।
‘তুমি সুন্দরী এবং যুবতী।’
সুগোপা চকিতে গ্রীবা বাঁকাইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। চিত্রকের কণ্ঠস্বরের সমতা বিন্দুমাত্র বিচলিত হইল না, সে পুনশ্চ বলিল— ‘তুমি সুন্দরী এবং যুবতী। এই জনহীন স্থানে একাকিনী থাকিতে তোমার ভয় করে না?’
ভ্রূভঙ্গ করিয়া সুগোপা বলিল— ‘ভয়! কিসের ভয়?’
‘বনে হিংস্র জন্তু আছে।’
‘হিংস্র জন্তুকে আমি ভয় করি না।’
‘আর— মানুষকে?’
‘মানুষ ধৃষ্টতা করিলে আমার অস্ত্র আছে।’
‘কী অস্ত্র?’
সুগোপা তর্জনী তুলিয়া কুটিরের প্রাঙ্গণ দেখাইল। চিত্রক ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে একটি সম্মার্জনী রহিয়াছে। তাহার কণ্ঠে একটু নীরস হাস্যধ্বনি পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। সে বলিল— ‘তুমি সাহসিকা বটে। কিন্তু ঐ অস্ত্রের দ্বারা লোলুপ পুরুষকে নিবারণ করিতে পারিবে বলিয়া মনে হয়?’
‘হয়।’ অস্পষ্টস্বরে এই কথাটি বলিয়া সুগোপা আবার কুটিরের দিকে পা বাড়াইল। কিন্তু তাহাকে এক পদের অধিক অগ্রসর হইতে হইল না।
চিত্রক এতক্ষণ নিতান্ত নিশ্চেষ্ট ভঙ্গিতে বসিয়া ছিল, এখন সহসা বন্য বিড়ালের মত লম্ফ দিয়া সুগোপার সম্মুখে দাঁড়াইল, তাহার মুখের অত্যন্ত নিকটে মুখ লইয়া গিয়া বলিল— ‘সাহসিনি, এখন কোন্ অস্ত্র ব্যবহার করিবে? তাহার কণ্ঠস্বরে গভীর ব্যঙ্গের সহিত গভীরতর একটা উত্তেজনার আভাস স্ফুরিত হইয়া উঠিল।
সত্রাস চক্ষু তুলিয়া সুগোপা দেখিল, চিত্রকের দুই চক্ষু হীরকখণ্ডের মত জ্বলিতেছে, তাহার ললাটস্থ তাম্রবর্ণ চিহ্নটা রক্ত তিলকের মত লাল হইয়া উঠিতেছে। সুগোপা ক্ষণকাল স্তম্ভিতবৎ থাকিয়া বলিল— ‘পথ ছাড়, বর্বর।’
‘যদি না ছাড়ি?’
সুগোপা অসহায় নেত্রে চারিদিকে চাহিল। এই সময়, যেন তাহার বিভ্রান্ত উৎকণ্ঠার সাক্ষাৎ প্রত্যুত্তর স্বরূপ শিলাকঙ্করপূর্ণ পথের উপর দ্রুত অশ্বের আস্কন্দিত ধ্বনি শুনা গেল। পরীক্ষণেই একটি সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে উচ্চ আহ্বান আসিল—
‘সুগোপা! সুগোপা!’
চিত্রক সুগোপার পথ ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল। ক্ষণেক পরে আশ্বারোহীকে দেখা গেল; বিদ্যুতের মত দ্রুতগতি অশ্ব পথ হইতে দেবদারু বৃক্ষের তলে আসিয়া দাঁড়াইল। আরোহী এক লম্ফে ভূমিতে অবতরণ করিতেই সুগোপা ছুটিয়া গিয়া তাহাকে দুই বাহুতে জড়াইয়া ধরিল।
অশ্বারোহীর বয়স অধিক নয়, কিশোর বলিলেই হয়; মুখে শ্মশ্রুগুস্ফের চিহ্নমাত্র নাই। মস্তকে উজ্জ্বল ধাতুনির্মিত উষ্ণীষ, বক্ষে বর্ম, পৃষ্ঠে ধনু ও তূণীর। অপরূপ সুন্দর আকৃতি, দেখিয়া মনে হয় দেবসেনাপতি কিশোর কার্তিকেয় শত্রু বিজয়ে বাহির হইয়াছেন।
তরুণ বীর প্রফুল্ল রক্তাধরে হাসিয়া বলিল— ‘সুগোপা, কী হইয়াছে সখি?’
সুগোপার মন হইতে ক্ষণিক বিপন্নতার সমস্ত গ্লানি মুছিয়া গিয়াছিল, সে গদগদ আনন্দের স্বরে বলিল— ‘কিছু না— ঐ বিদেশী গ্রামীণটা প্রগল্ভতা করিয়াছিল মাত্র। এস— ঘরে এস। শিকারে বাহির হইয়াছিলে বুঝি? গাল দু’টি যে রৌদ্রে রাঙা হইয়া গিয়াছে।’
চিত্রক ইতিমধ্যে নিঃশব্দে সরিয়া গিয়া দেবদারু বৃক্ষের কাণ্ডে এক হাত রাখিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অন্য হস্তটি অবহেলাভরে তরবারির উপর ন্যস্ত ছিল। তরুণ ঈষৎ বিস্ময়ে তাহার দিকে দৃষ্টি ফিরাইল। ক্ষণিকের জন্য উভয়ের চক্ষু মিলিত হইল। তারপর অবজ্ঞাপূর্ণ তাচ্ছিল্যের সহিত অশ্বের বল্গা চিত্রকের দিকে নিক্ষেপ করিয়া সুকুমারকান্তি তরুণ বলিল— ‘আমার অশ্ব রক্ষা কর— পারিতোষিক পাইবে।’ বলিয়া সুগোপার কটি বাহুবেষ্টিত করিয়া হাসিতে হাসিতে কথা কহিতে কহিতে কুটিরের দিকে চলিল।
সুগোপা সোহাগ-বিগলিত কণ্ঠে বলিল— ‘তুমি যে এই নিভৃত স্থানে আমাকে দেখা দিতে আসিবে তাহা আমার সকল দুরাকাঙ্ক্ষার অতীত।’ তরল হাসিয়া তরুণ বলিল— ‘প্রপাপালিকা কিরূপ কর্তব্য পালন করিতেছে রাজপক্ষ হইতে তাহাই পরিদর্শন করিতে আসিলাম।’
তাহারা কুটির মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেলে চিত্রক ধীরে ধীরে অশ্বের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। সুন্দর কম্বোজীয় অশ্ব, প্রস্তর মূর্তির মত স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। মধুপিঙ্গলবর্ণ ত্বকে চীনাংশুকের মসৃণতা, গ্রীবার চামর মুক্তামালায় মণ্ডিত, পৃষ্ঠে কোমল রোমাবলি নির্মিত আসন, বল্গার রজ্জু স্বর্ণালঙ্কৃত।
চিত্রক অশ্বের গ্রীবায় একবার লঘু স্পর্শে হাত বুলাইল, অশ্ব আপ্যায়িত হইয়া নাসা মধ্যে ঈষৎ হর্ষসূচক শব্দ করিল। চিত্রক তখন সঙ্কুচিত সতর্ক চক্ষে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। নিস্তব্ধ অপরাহ্ণ; কেবল কুটিরের অভ্যন্তর হইতে মাঝে মাঝে কলহাস্যের ধ্বনি প্রকৃতির বৈকালী তন্দ্রালসতা বিচ্ছিন্ন করিয়া দিতেছে। পথে জনমানব নাই।
চিত্রকের ওষ্ঠ্যপ্রান্তে ঈষৎ হাসি দেখা দিল; কুটিল তিক্ত হাসি, তাহাতে আনন্দ বা কৌতুকের স্পর্শ নাই। তাহার ললাটের তিলকচিহ্ন আবার ধীরে ধীরে আরক্ত হইয়া উঠিল।
অশ্বের বল্গা ধরিয়া চিত্রক সন্তর্পণে তাহাকে পথের দিকে লইয়া চলিল; শষ্পাকীর্ণ ভূমির উপর শব্দ হইল না। তারপর একবার পিছনে কুটিরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া এক লম্বেফ সে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া বসিল। আসনের উপর ঝুঁকিয়া বসিয়া জঙ্ঘা দ্বারা তাহার পঞ্জর চাপিয়া ধরিতেই অশ্ব তড়িৎপৃষ্ট্রের ন্যায় লাফাইয়া ছুটিতে আরম্ভ করিল। প্রস্তরময় পথের উপর তাহার ক্ষিপ্র ক্ষুরধ্বনি কয়েকবার শব্দিত হইয়াই আবার পরপারের তৃণভূমির উপর নীরব হইয়া গেল।
নিমেষমধ্যে অশ্ব ও আরোহী পথিপার্শ্বস্থ গভীর বনের মধ্যে অন্তর্হিত হইল।