০২. অধ্যাপক ভার্গবের বাড়ি

অধ্যাপক ভার্গবের বাড়িটি একটি টিলার ওপরে। এখান থেকেও সমুদ্র দেখা যায়। বাড়ির সামনে অনেকখানি বাগান, গেটের সামনে দুজন বন্ধুকধারী গার্ড। একবার অধ্যাপক ভার্গবের ওপর গুন্ডারা হামলা করেছিল। তারপর থেকেই এরকম পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে।

কাকাবাবুদের গাড়িটা থামতেই একজন গার্ড এগিয়ে এল পরিচয় জানবার জন্য। কিন্তু কাকাবাবুকে দেখেই চিনতে পেরে সে স্যালুট দিয়ে বলল, আসুন স্যার।

গাড়ি থেকে নেমে জোজো বলল, কী সুন্দর জায়গায় বাড়িটা। ইতালিতে এরকম একটা বাড়িতে আমি থেকেছি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেটা কার বাড়ি ছিল?

জোজো বলল, এক সময় সে বাড়ি ছিল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির। নাম শুনেছিস তো? তারপর সেই বাড়িটা নিয়ে নেয় মুসোলিনি। এর নাম শুনেছিস?

সন্তু দুবারই মাথা নাড়ল দেখে জোজো বলল, খুব তো মাথা নেড়ে যাচ্ছিস। সত্যি সত্যি চিনিস? বল তো—

সন্তু বলল, মোনালিসা নামের বিখ্যাত ছবিটা এঁকেছিলেন মুসোলিনি, আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন হিটলারের চামচে!

কাকাবাবু হেসে ফেললেন।

জোজো বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে?

সন্তু বলল, আমি ভুল বললে তুই ঠিক করে দিবি কী করে? সেইজন্য উলটে দিয়েছি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, জোজো, তুই যখন বাড়িটাতে ছিলি, তখন তার মালিক কে?

জোজো বলল, কাউন্ট কুইজারলিং। আপনি এর নাম শুনেছেন?

কাকাবাবু বললেন, কাউন্ট কুইজারলিং? না, এ নাম তো শুনিনি!

জোজো বলল, ইনি তিমি মাছের গান রেকর্ড করে বিখ্যাত হয়েছেন। আমার বাবার শিষ্য ছিলেন।

কাকাবাবু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, হ্যাঁ, তিমিও গান গায়, কোথায় যেন পড়েছি। তুই শুনেছিস সেই গানের রেকর্ড?

জোজো বলল, অনেকবার। তিমি মাছের গলার আওয়াজ অনেকটা ভীমসেন। যোশীর মতন। ওই বাড়িটাতে আবার ভূত ছিল। খুব জ্বালাতন করত।

সন্তু বলল, তাই নাকি? তুই ভূতও দেখেছিস?

জোজো বলল, সবাই দেখেছে। খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত হ্যাংলার মতন। কার ভূত জানিস? মুসোলিনির। সেই ভূত তাড়াবার জন্যই তো বাবাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সন্তু বলল, উনি কী করে ভূত তাড়ালেন?

জোজো বলল, বাবা তিব্বত থেকে একটা মন্ত্র শিখে এসেছিলেন, যাতে ভূতদের ছোট করে ফেলা যায়। মনে কর, ভূতটার সাইজ ছ ফুট, সেটা হয়ে গেল ছ ইঞ্চি। তারপর বাবা সেই ছ ইঞ্চি ভূতটাকে পুরে ফেললেন একটা কাচের বোতলে। ভূতরা জানিস তো দেওয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারে, লোহার দরজাও ভেদ করে যেতে পারে, কিন্তু কাচকে ভয় পায়। নিজের ছায়া দেখতে পায় তো!

কাকাবাবু বললেন, এটাও একটা নতুন খবর। ভূতরা যে কাচের দেওয়াল ভেদ করতে পারে না, এটা আগে জানা ছিল না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তারপর সেই বোতলটা কী হল?

জোজো বলল, সেটা রোমের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রাখা আছে। যে কেউ গিয়ে দেখে আসতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, একবার গিয়ে দেখতে হবে তো। জোজোর কাছ থেকে কত কিছু শেখা যায়।

সন্তু বলল, মুসোলিনির ভূত নাম দিয়ে তুই একটা গল্প লিখে ফেললে

পারিস!

জোজো বলল, লিখব, লিখব। যেদিন আমি লিখতে শুরু করব, দেখবি তখন অন্য সব লেখকরা ফ্ল্যাট হয়ে যাবে!

কাকাবাবু দরজায় বেল টিপলেন। স্বয়ং প্রফেসর ভার্গব খুলে দিলেন দরজা।

প্রফেসর ভার্গবের ছোট্টখাট্টো চেহারা। মাথায় টাক, মুখে সাদা দাড়ি। হলুদ রঙের একটা সিল্কের আলখাল্লা পরে আছেন। কাকাবাবুকে দেখেই তিনি উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, আসুন, আসুন, ওঃ, রায়চৌধুরী, এই নিয়ে দুবার আপনি আমাকে বাঁচালেন। আমার মানসম্মান সব যেতে বসেছিল।

কাকাবাবু বললেন, আরে না, না, আমি আর এমন কী করেছি!

প্রফেসর ভার্গব কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।

ঘরের মধ্যে অনেক পুরনো আমলের পাথরের মূর্তি সাজানো রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে কাচের আলমারিতেও বিভিন্ন যুগের মাটির বাসনপত্র আর ছোটখাটো জিনিস। যেন মিউজিয়ামের একখানা ঘর।

অবশ্য সোফাসেট আর চেয়ারও আছে। তাতে বসে আছেন আরও পাঁচ-ছজন। মানুষ। এঁরাও নিমন্ত্রিত। একজনকে কাকাবাবু চিনলেন। পুলিশ কমিশনার পদ্মনাভন। অন্য সবাই ইতিহাসের পণ্ডিত।

আর একজন লম্বা, ছিপছিপে লোক এদিকে পেছন ফিরে দেওয়ালের আলমারির জিনিসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। তিনি এবার মুখ ফিরিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন না?

কাকাবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, আরে নরেন্দ্র, তুমি হঠাৎ এখানে এলে কী করে?

নরেন্দ্র ভার্মা হেসে বললেন, কেন, তুমি নেমন্তন্ন পেতে পারো, আর আমাকে বুঝি প্রফেসর ভার্গব নেমন্তন্ন করতে পারেন না?

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু তুমি এ-সময় ভাইজাগে এসেছ, সেটাই তো জানি না। সুকুমার রায়ের লেখা তো পড়োনি, পড়লে তোমায় বলতাম, গেছো দাদা! কখন যে কোথায় থাকো, তার ঠিক নেই!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হায়দরাবাদে এসেছিলাম একটা কাজে। খবরের কাগজে দেখলাম, তুমি এই শহরে আছ। তাই চলে এলাম তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে! এখানে এসে পড়েছি গেট ক্র্যাশ করে।

প্রফেসর ভার্গব বললেন, নরেন্দ্রজি, এবার মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী কীভাবে আমাকে বাঁচিয়েছেন, তা সবটা শুনেছেন?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, খবরের কাগজে যেটুকু পড়েছি।

নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ইতিহাসের অধ্যাপক বললেন, আমরাও সবটা জানি না। বলুন না, শুনি, শুনি?

প্রফেসর ভার্গব বিস্তারিতভাবে বলতে শুরু করলেন। ভার্গব এক সময় ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন, রিটায়ার করেছেন অনেক দিন আগে। এখনও তিনি বহু মূর্তি সংগ্রহ করেন, বহু পুরনো আমলের ছবি, মুদ্রা, অস্ত্রও আছে তার কাছে। এসবের কিছু কিছু তিনি মাঝে-মাঝে বিক্রিও করেন। মাসখানেক আগে একজন খুব বড় ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে সম্রাট শাহজাহানের আমলের পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা কিনেছিলেন সাড়ে সাত লক্ষ টাকা দিয়ে। কয়েকদিন পরেই সেই ব্যবসায়ীটি থানায় ডায়েরি করলেন যে, ওই পাঁচটা কয়েনই নকল, প্রফেসর ভার্গব জেনেশুনে তাঁকে জাল জিনিস বিক্রি করেছেন।

পুলিশ যখন খোঁজ নিতে এল, তখন প্রফেসর ভার্গব তো খুবই অবাক হলেন। তিনি ওই কয়েনগুলো সংগ্রহ করেছিলেন রাজস্থানের এক রাজার বংশধরের কাছ থেকে। তিনি নিজে একজন বিশেষজ্ঞ, কেনার সময় তিনি ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছিলেন, ওগুলো জাল হতেই পারে না।

সেই ব্যবসায়ীটির কাছ থেকে পাঁচখানা মুদ্রা নিয়ে যাচাই করতে দেওয়া হল। তারা তিনজনই জানালেন যে, মুদ্রাগুলি সত্যিই জাল, শাহজাহানের আমল তো দূরের কথা, ওগুলো বানানো হয়েছে হাল আমলে। প্রফেসর ভার্গব রাজস্থানের যে রাজার নাম বলেছিলেন, পুলিশ খোঁজ নিয়ে দেখল, রাজস্থানে ওই নামে কোনও রাজা বা রাজকুমার কখনও ছিল না, সে নামটাও জাল।

এর মধ্যেই আর একজন ব্যবসায়ী থানায় অভিযোেগ জানাল যে সেও প্রফেসর ভার্গবের কাছ থেকে তিনটি আকবরি মোহর কিনেছিল, সেগুলোও জাল।

এর পর প্রফেসর ভার্গবকে গ্রেফতার করা ছাড়া পুলিশের আর কোনও উপায় নেই।

ইতিহাসের অধ্যাপক সুভাষ রাও বললেন, আমরা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রফেসর ভার্গব এতবড় পণ্ডিত, তিনি মুদ্রাগুলো আসল না নকল তা চিনবেন না, এমন তো হতে পারে না। অথচ তার কাছ থেকেই লোকে এগুলো কিনেছে।

পুলিশ কমিশনার পদ্মনাভন বললেন, আমি ভার্গবকে অনেকদিন ধরে চিনি, শ্রদ্ধা করি। অথচ আমারই আদেশ নিয়ে ওকে গ্রেফতার করতে হল। অবশ্য কোর্টে ওর জামিন পাওয়া নিয়ে আমরা আপত্তি করিনি।

ভার্গব বললেন, জামিনে ছাড়া পেলাম তো বটে, কিন্তু তারপর মামলা চলবে। আমার দারুণ বদনাম রটে গেল। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। আমার তখন দিশাহারার মতন অবস্থা। তাই একদিন রায়চৌধুরীকে ফোন করে পরামর্শ চাইলাম।

পদ্মনাভন বললেন, রায়চৌধুরী, এর পরের অংশটা আপনি বলুন!

কাকাবাবু বললেন, অপরাধ জগৎ নিয়ে তো আমার কারবার নয়। আমি রহস্যসন্ধানী। ভার্গব আমার অনেক দিনের বন্ধু, আমিও ইতিহাসের ভক্ত। পুরনো আমলের মুদ্রা নিয়ে কিছু নাড়াচাড়া করেছি এক সময়। যাদের আমি বন্ধু বলে মেনে নিই, তাদের আমি একশো ভাগ বিশ্বাস করি। সুতরাং আমি ধরেই নিলাম, ভার্গবের পক্ষে জাল মুদ্রা বিক্রি করা একেবারেই সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনও ষড়যন্ত্র আছে।

পদ্মনাভন বললেন, এমনিতে পঞ্চাশ টাকা—একশো টাকার নোট কেউ কেউ জাল করে, ধরাও পড়ে যায়। কিন্তু ইতিহাসের আমলের কয়েনও যে জাল হয়, সে কথা আগে শুনিনি।

কাকাবাবু বললেন, এটা একটা খুব লাভজনক ব্যবসা, সারা পৃথিবীতেই চলে। ভার্গবের ফোন পেয়ে ভাবলাম, গিয়ে দেখাই যাক ব্যাপারটা। ভার্গবকে বললাম, আমি ভাইজাগ যাচ্ছি, কিন্তু তোমার বাড়িতে উঠব না। আমার কথা কখনও জানাবারও দরকার নেই। তাই আমার দুই চেলা, সন্তু আর জোজোকে নিয়ে এসে উঠলাম একটা হোটেলে, যেন বেড়াতে এসেছি।

ভার্গব বলল, আশ্চর্য ব্যাপার, মাত্র তিনদিনের মধ্যে রায়চৌধুরী ওদের ধরিয়ে দিতে পারলেন!

পদ্মনাভন বললেন, সত্যি, আপনি আমাদেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, ব্যাপারটা তো খুব সোজা। আপনারা যদি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ভার্গবের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভবই নয়, তা হলেই উলটো দিকটা দেখতে পেতেন। তা নয়, আপনারা ভেবেছিলেন, হলেও হতে পারে। মানুষকে চেনা শক্ত। ভার্গবকে দেখে ভাল মানুষটি মনে হয়, কিন্তু সেই গোপনে দুনম্বর কারবার করে।

ইতিহাসের অধ্যাপকরা মাথা নিচু করলেন। পদ্মনাভন বললেন, সত্যিই আমাদের তাই মনে হয়েছিল। সেজন্য আমি ক্ষমা চাইছি।

কাকাবাবু বললেন, উলটো দিকটা হচ্ছে এই, কিছু লোক এসে ভার্গবের কাছ থেকে অনেক টাকা দিয়ে কিছু দুর্লভ মুদ্রা কিনে নিয়ে গেছে। তারপর সেগুলোকে চটপট জাল করে সেই জাল টাকাই জমা দিয়েছে থানায়। দোষ চাপিয়েছে। ভার্গবের ঘাড়ে। এবার তারা ভার্গবের কাছ থেকে টাকা ফেরত আদায় করবে, আর আসল মুদ্রাগুলো বিক্রি করে দেবে অন্য জায়গায়। যদি বিদেশে চালান করে দিতে পারে, তাতে অনেক বেশি লাভ!

জোজো বলল, এবারেই প্রথম কাকাবাবুকে ছদ্মবেশ ধরতে দেখেছি।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি খোঁড়া মানুষ, আমার পক্ষে ছদ্মবেশ ধরা বেশ শক্ত। আমার চেহারাটা অনেকেই চেনে, আর খোঁড়া পা-টা তো লুকোতে পারব না। তাই একটা হুইল চেয়ার ভাড়া করে আরও বুড়ো সাজলাম। থুথুড়ে বুড়ো আর দুটো পা-ই অচল। সেই হুইল চেয়ার নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম কয়েকটা

দোকানে। প্রত্যেক শহরেই কিছু অ্যান্টিক জিনিসপত্রের দোকান থাকে। মূর্তি, ভাস, কয়েন, ছবি এইসব পাওয়া যায়। বিখ্যাত জিনিসগুলো এদেশের কোথায়, কার কাছে আছে, ওরা সব খবর রাখে। আমার পরিচয় হল পাতিয়ালার মহারাজার কাকা। পাতিয়ালার মহারাজের সত্যিই একজন কাকা আছেন, যাঁর শখ হচ্ছে খুব দামি দামি পুরনো জিনিস সংগ্রহ করা। এখানে একটা বড় অ্যান্টিকের দোকানে গিয়ে বললাম, আমার কয়েকখানা আকবরি মোহর চাই, যত টাকা লাগে দেব। প্রথমে ওরা বলল, ওদের স্টকে ওরকম জিনিস নেই। দ্বিতীয় দিন গিয়ে বললাম, যেখান থেকে পারো জোগাড় করে দাও। এক-একটা মোহরের দাম দেব দশ লাখ টাকা। অত টাকার লোভ ওরা সামলাতে পারল না। এক দোকানদার বলল, আপনি সন্ধের পর আসুন। গেলাম সাড়ে সাতটার সময়। এবারে প্রথম থেকেই সন্তুকে সঙ্গে নিইনি, ওকেও কেউ কেউ চিনে ফেলতে পারে, শুধু জোজো আমার হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে যায়। অবশ্য ওকেও দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে বয়স্ক সাজিয়ে ছিলাম।

জোজো বলল, বাকিটা আমি বলব? দোকানদারটা আমাদের নিয়ে গেল ডলফিনস নোজ পাহাড়ের কাছে একটা বাড়িতে। সে বাড়ির মাটির তলায় ঘর আছে। দুজন লোক বসে ছিল সেখানে, তাদের একজন বলল, আপনি আকবরি মোহর খুঁজছেন? দিতে পারি, ক্যাশ টাকা এনেছেন?

কাকাবাবু বললেন, লাখ লাখ টাকা কি সঙ্গে আনা যায়? সে তো বিরাট বোঝ। আমার কাছে ডলার আছে। ডলার শুনে ওদের লোভ আরও বেড়ে গেল। তারপর কাকাবাবু বললেন, আমি বুড়ো হয়েছি বলে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। নকল চালাবার চেষ্টা কোরো না। প্রত্যেকটা কয়েন আমি পরীক্ষা করে দেখে নেব। এবার ওরা একটা ভেলভেটের বাক্স নিয়ে এল, তার মধ্যে রয়েছে সেই তিনটে সোনার টাকা। কাকাবাবু বললেন, মোটে তিনটে? আর নেই?

ওরা আরও তিনটে এনে দিল।

কাকাবাবু দুখানা মোহরই ডান হাতের তালুতে রেখে পরীক্ষা করতে লাগলেন, তারপর সেগুলোর মধ্য থেকে তিনখানা বেছে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, এগুলো ঝুটো মাল! শোনো, সারা পৃথিবীর যারা কয়েন এক্সপার্ট তারা আমাকে চেনে। আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ ঠকাতে পারেনি। আসল মাল মোটে তিনটের বেশি নেই, তা বললেই পারতে!

ওদের একজন বলল, আমরা তো স্যার এত বুঝি না। দালালদের কাছ থেকে কিনি। মুঘল আমলের অন্য কয়েন চলবে? শাজাহানের মোহর।

কাকাবাবু বললেন, শাজাহানের আমলের মোহর আমার নিজের কালেকশানে বেশ কয়েকটা আছে। তবু নিয়ে এসো তো দেখি।

এবার ওরা নিয়ে এল আরও কয়েকটা ভেলভেটের বাক্স। তার একটা খুলেই কাকাবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, মোহন সিং, এখন কটা বাজে? ঠিক নটার মধ্যে আমাকে ডিনার খাওয়ার জন্য ফিরে যেতে হবে।

এই কটা বাজে ছিল আমাদের আগে থেকে ঠিক করা কোড। আমি ঘড়ি দেখে সময় বলে দিয়ে ওদের জিজ্ঞেস করলুম বাথরুমটা কোথায়? আমার আজ দুপুর থেকে পেট খারাপ।

আমি পেটটা চেপে ধরতেই ওরা আমাকে একটা বাথরুম দেখিয়ে দিল। তার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আমি মোবাইল ফোনে খবর দিলুম পুলিশ কমিশনারের অফিসে। সেটাও কাকাবাবু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। দশ মিনিটের মধ্যে কাছাকাছি থানা থেকে পুলিশ এসে গেল। তখনও কাকাবাবু ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে মোহরগুলো পরীক্ষা করছেন।

কাকাবাবু বললেন, এতে বোঝা গেল মোবাইল ফোনের উপকারিতা। গোপনে খবর দেওয়ার খুব সুবিধে। পুরো দলটাই ধরা পড়ে গেল।

প্রোফেসর ভার্গব বললেন, আসল কয়েনগুলো উদ্ধার হল বলেই আমি বেঁচে গেলাম।

সুভাষ রাও বললেন, রোমহর্ষক কাহিনী। তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করব রায়চৌধুরীসাহেব? আপনি বুড়ো মানুষ, সঙ্গে মাত্র এই ছেলেটি। ওই গুন্ডাদের ডেরায় ঢুকেছিলেন, যদি আপনাদের খুন করে সব টাকা পয়সা কেড়ে নিত! ওরা নিশ্চয়ই ভেবেছিল, আপনার কাছে অনেক ডলার আছে। এখানে তো যখন-তখন খুন হয়।

কাকাবাবু বললেন, অপরাধ জগতেও নানারকম শ্রেণী ভেদ আছে। যারা জালিয়াত, তারা সাধারণত খুনজখমের মধ্যে যায় না। স্মাগ্‌লাররা যেমন ডাকাতি করে না। তা ছাড়া, একজন সাধারণ লোককে খুন করতে পারে, কিন্তু পাতিয়ালার মহারাজার কাকাকে খুন করলে যে খুব হইচই পড়ে যাবে, তা ওরা জানে। আর আমি বুড়ো সাজলেও তেমন বুড়ো তো নই, আমার একখানা থাপ্পড় অনেকেই সহ্য করতে পারে না। তা ছাড়া আমার কাছে রিভলভার ছিল, একবার সেটা হাতে নিলে অন্তত দু-চারজন লোক সামনে দাঁড়াতে পারবে না।

সুভাষ রাও বললেন, তবু আপনার সাহস আছে বটে। বাপ রে!

জোজো বলল, আজকেই তো সন্ধের সময়…

পদ্মনাভন বললেন, আজ আবার সন্ধেবেলা কী হয়েছিল?

কাকাবাবু তার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পিন্টু ডিমেলো কে বলুন তো?

পদ্মনাভন বললেন, আরে সে এক মজার ব্যাপার। এই মুদ্রা জালিয়াতির যে প্রধান পাণ্ডা তার নাম ধুমল কোল। রায়চৌধুরী, আপনি তো তাকে ধরিয়ে দিলেন। তারপর তাকে জেরা করতে করতে সে এক সময় ওদের দলের একজন হিসেবে পিন্টু ডিমেলোর নাম ধাম বলে দিল। এই ডিমেলো লোকটা অনেক বড় ক্রিমিনাল, ওকে আমরা অনেকদিন থেকে খুঁজছি, বেশ কয়েকবার আমাদের হাত পিছলে পালিয়েছে। এবার ও ধরা পড়ে গেল, এটা বিনা ক্যাচ বলা যেতে পারে। ধুমলের সঙ্গে বোধহয় ওর শত্রুতা আছে। সে ওকে ইচ্ছে করে ধরিয়ে দিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, সাবধান, ও যেন পালিয়ে না যায়। আজ সন্ধেবেলাতেই সে রকম একটা চেষ্টা হয়েছিল। জোজোই ঘটনাটা বলুক। না থাক, জোজো বেশি লম্বা করে ফেলবে। এখন খেতে হবে। সন্তু বলুক।

সন্তু সংক্ষেপে ঘটনাটা জানাল।

প্রোফেসর ভার্গব বললেন, উঃ বাপ রে বাবা। আবার আজই এরকম কাণ্ড। হয়েছে। রায়চৌধুরী, আপনাকে আমি যত দেখি ততই অবাক হয়ে যাই। আপনার তো যে-কোনও সময় সাংঘাতিক একটা কিছু হয়ে যেতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, এটা এক ধরনের খেলা। একদিন-না-একদিন তো মরতেই হবে। আমি মৃত্যু নিয়ে খেলা করতে ভালবাসি। এপর্যন্ত তো এ খেলায় হারিনি।

পদ্মনাভন বললেন, ওরা ধরা পড়লেও সব ব্যাপারটা এখনও মেটেনি বোঝা যাচ্ছে। আরও অনেক কিছু ঘটবে। ডিমেলোর দল সহজে ছাড়বে না।

কাকাবাবু বললেন, সেসব সামলাবার দায়িত্ব আপনাদের পুলিশের ব্যাপার। আমি আর এর মধ্যে নেই। আমি প্রোফেসর ভার্গবকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছি মাত্র। এখন খাবার দেওয়া হবে না?

এবার সবাইকে যেতে হল পাশের লম্বা হল ঘরে।

সেখানে বড় টেবিলের ওপর অনেকরকম খাবার সাজানো। মাছ-মাংস নেই বটে। কিন্তু নিরামিষ পদই তেরো-চোদ্দোরকম। আর পাঁচরকমের মিষ্টি।

নরেন্দ্র ভার্মা মুদ্রা-জালিয়াতি বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখাননি। এতক্ষণ একটা প্রশ্নও করেননি। এখন খাবারের প্লেট নিয়ে কাকাবাবুর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন নরেন্দ্র, তুমি তো ভার্গবের কেসটা মিটিয়ে দিয়েছ, এখন কী করবে? ফিরে যাবে কলকাতায়?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ফিরে যাব। আমাদের পশ্চিম বাংলায় এর মধ্যে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। এই সময় শান্তিনিকেতনে থাকতে খুব ভাল লাগে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, আমিও একবার শান্তিনিকেতনের বর্ষা দেখতে যাব। তুমি এখানে আরও দিনসাতেক থেকে যাও না। দুজনে মিলে সমুদ্রে সাঁতার কাটব। এক সময় গোয়ার বিচে দুজনে অনেক সাঁতার কেটেছি মনে আছে?

কাকাবাবু বললেন, তখন আমার পা খোঁড়া ছিল না। তখন কমপিটিশানে তুমি আমার সঙ্গে পারতে না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সাঁতারের সঙ্গে খোঁড়া পায়ের কী সম্পর্ক? মাসুদুর রহমান নামে একটি ছেলের দুটো পা-ই কাটা। সেও তো সাঁতারে ইংলিশ চ্যানেল ক্রস করেছে। এসো, আবার তোমার সঙ্গে একবার কমপিটিশানে নামা যাক।

কাকাবাবু বললেন, ভাইজাগের সমুদ্রে তো সাঁতার কাটাই যায় না শুনেছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এখানে অনেক ড়ুবো পাথর আছে, তাই বিপজ্জনক। তবে এখান থেকে খানিকটা দূরে ঋষিকোণ্ডা নামে একটা জায়গা আছে। ভারী চমকার, নিরিবিলি, আর সাঁতারও কাটা যায়। ছেলে দুটিকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়ে, তুমি আরও সাতদিন থেকে যাও।

সন্তু কাছেই দাঁড়িয়ে খাবার খাচ্ছে। সে শুনতে পেয়ে বলল, মোটেই আমরা ফিরে যেতে চাই না। আমাদের এখন ছুটি।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস বলেন, তুমি সাঁতার জানো, সন্তু?

সন্তু বলল, মোটামুটি জানি।

কাকাবাবু বললেন, আছে নরেন্দ্র, তুমি জানো না, সন্তু তো সাঁতারে চাম্পিয়ন। অনেক পুরস্কার-টুরস্কার পেয়েছে।

নরেন্দ্র বললেন, ও, তাই বুঝি? আর জোজো?

এই একটা ব্যাপারে বাক্যবাগীশ জোজো একেবারে চুপ করে যায়। সে জলকে ভয় পায়। সন্তু অনেক চেষ্টা করেও জোজোকে সাঁতার শেখাতে পারেনি।