০২. অদ্ভুত হুটোপুটির আওয়াজ

অদ্ভুত হুটোপুটির আওয়াজ আমার ঘুম ভাঙাল, সঙ্গে-সঙ্গে কানে এল কুঁই কুঁই শব্দ। একটু অবাক হলাম। সার অথবা মেয় কখনওই ওই শব্দ করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। আজ কী হল! আলো জ্বালতেই দেখলাম সার তার বীভৎস দাঁত বের করে আলমারির ওপরদিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি অনুসরণ করতেই চমকে উঠলাম। কী ওটা? মুখ দেখা যাচ্ছে না, এদিকে পিঠ ফেরানো এবং সেই পিঠ ব্রাউন রঙের লোমে ঢাকা। আমায় উঠতে দেখে উৎসাহিত হয়ে সার লাফিয়ে খাটের ওপর উঠে আলমারির নাগাল পেতে চাইল। কিন্তু সেটা অনেক দূরত্বে হলেও জানোয়ারটা মুখ ফেরাল। ওরাং ওটাং।

লম্বা হাত-পা থাকা সত্ত্বেও ওরাং ওটাং যে সারকে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে তা শরীরের থরথরানি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। মুহূর্তেই অবনীমোহনের কথা মনে পড়ল। তা হলে এই সেই ওরাং ওটাং, যে চুরি করে বেড়ায়। বেচারা এখন দুহাতের তালুতে মুখ ঢেকেছে কিন্তু ওর কুতকুতে চোখ আমায় দেখছে। বোধ হয় আমাকে সারের চেয়ে নিরীহ ভাবছে।

আমি দুপা এগিয়ে যেতে বুঝলাম, ওর গলায় একটা রুপোলি চেন রয়েছে। অর্থাৎ পোষা জীব। কিন্তু এব্যাটা বাড়ির ভেতর ঢুকল কী করে? সব দরজা-জানলা তো বন্ধ। সার তখনও প্রবল রাগ নিয়ে আলমারি আঁচড়ে যাচ্ছে। প্রথমে ওর গলায় চেন পরিয়ে টেবিলের পায়ের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম। তারপর দরজা বন্ধ করে ওরাং ওটাংটাকে ডাকলাম। চার-পাঁচবার বাংলায় ডেকেও কোনও সাড়া না পেয়ে গলা চড়িয়ে ইংরেজিতে বললাম নেমে আসতে। এবার হাত সরাল মুখ থেকে, সারকে ভাল করে দেখল ওরাং ওটাং। কিন্তু নামার কোনও চেষ্টাই করল না। সারকে ও ভয় পাচ্ছে, কিন্তু আমি শছে গেলে কামড়ে দিতে পারে। তার চেয়ে অবনীমোহনকে ফোন করে খবর দেওয়াই ভাল।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। এখন রাত দুটো। ঠিক করলাম এখন নয়, ভোর হলেই ফোন করব। কিন্তু ওরাং ওটাংটা ঢুকল কোনখান দিয়ে? শোয়ার ঘরের দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে আমার বাড়িটা দেখতে লাগলাম আলো জ্বালিয়ে। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। সিঁড়ি ভেঙে আমার গবেষণার ঘরের কাছে যেতেই চোখে পড়ল জানলার শার্সি ভাঙা। যে ফোকশ্রটি হয়েছে তা দিয়ে মানুষের গলে আসা সম্ভব নয়, কিন্তু ওরাং ওটাংয়ের পক্ষে সহজ। গবেষণার ঘরের আলো জ্বালতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ! সবকিছু এলোমেলো। এমনকী আমার নতুন মেশিনটা কাত হয়ে আছে। আর তখনই চোখে পড়ল মেশিনের তলায় চাপা পড়ে আছে মেয়। ওর খুব ভাগ্য ভাল যে, মেশিনের একপাশে যে চোঙ রয়েছে সেটি ওর গলার ওপর এসে থেমে গিয়েছে কারণ মেশিনটি কাত হয়ে পড়েছিল। নইলে চোঙটি ওর গলায় বসে যেতে পারত। এই সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করেছে নিশ্চয়ই ওই ওরাং ওটাং। মেয় বোধ হয় ওকে দেখতে গিয়ে এই ঘরে চলে এসেছিল। কুকুরের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এই ঘরের যন্ত্রপাতি উলটেপালটে প্রাণীটি নীচে পালায়। আর তখনই মেয় বেচারা চাপা পড়ে গিয়েছে।

আমি কয়েকবার ডাকা সত্ত্বেও মেয় চোখ মেলল না, সাড়াও দিল না। যন্ত্রটা সরিয়ে সোজা করে রেখে মেয়র গায়ে হাত বোলালাম। না, ও মরে যায়নি, তবে জ্ঞান হারিয়েছে। মেয়র মাথায় অল্প জল ছড়িয়ে দিলাম। যেরকম অলস ও, অজ্ঞান হয়ে থাকার সময় ঘুমের আমেজ উপভোগ করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মেশিনটাকে দেখলাম, একপাশে চোট লেগেছে। চোঙের যে মুখটা মেশিনের সঙ্গে লাগানো থাকে, সেটি সামান্য সরে গিয়েছে। হয়ে গেল, আমার এতদিনের সব চেষ্টা একটা ওরাং ওটাং বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেল। কয়েকটা বই মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তাদের তুললাম। লন্ডনে একজন বিজ্ঞানী আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, শব্দের জন্ম ঘর্ষণ বা পারস্পরিক আঘাত থেকে। অর্থাৎ মিডিয়াম ছাড়া শব্দ তৈরি হয় না। আমাদের আকাশে মেঘ আছে যা শব্দসৃষ্টিতে মিডিয়ামের কাজ করে। কিন্তু মহাকাশে যেহেতু জলীয় কণা নেই, তাই মেঘের অস্তিত্ব নেই। অতএব আমি মেঘের স্তরের বাইরে কী করে শব্দের অস্তিত্ব কল্পনা করছি।

আপাতচোখে কথাটা ঠিকই। মহাকাশে যেখানে হাওয়া নেই, মেঘ নেই, যেখানে শুধুই ধুধু শূন্যতা, সেখানে শব্দ বাজবে কী করে? আমি তাদের নৈঃশব্দ্যের শব্দ, সাউন্ড আর সাইলেন্স বোঝাতে চেষ্টা করব না। কিন্তু অবিরত যে সমস্ত নক্ষত্রের অংশ খসে পড়ছে এবং পড়ার সময় অন্য নক্ষত্রকে আঘাত করছে, তার শব্দমালার কথা বিস্মরিত হলে চলবে কী করে? দূর কোনও মহাকাশে সেই মুহূর্তে যে ভয়ঙ্কর শব্দ বাজে, তা পৃথিবীতে এসে পৌঁছয় না। কিন্তু যদি সেটা নিয়ে আসা যেত। আমি অবশ্য এসব কথা বলিনি। বব আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে কাজ শেষ না করে সামান্য মুখ খোলাও ঠিক নয়।

মেঝের ওপর নড়াচড়া শুরু করল মেয়। অর্থাৎ ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। বেশ জব্বর একটা আড়মোড়া দিয়ে সে চোখ খুলল। আমি আদর করে ডাকলাম, মেয়! খুব লেগেছে? মেয় মুখ তুলল। তারপর আমাকে চমকে দিয়ে ডেকে উঠল, ঘেউ!

আমি যেমন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, তেমনই মেয় বোধ হয় খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। সে পিটপিট করে চারপাশে তাকাল। তারপর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড জোরে ডেকে উঠল, ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ।

নিজের গলায় স্বর ফিরে পেয়ে যেন পাগল হয়ে গেল মেয়। ঘরময় লাফিয়ে তীব্রবেগে নেমে গেল নীচের দিকে। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ কী ব্যাপার হল? একটা বোবা কুকুর স্বর ফিরে পেল কী করে? হ্যাঁ, একথা ঠিকই, আমি অনেক সময় ভেবেছিলাম ওদের কোনও ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দেখি ভোকাল কর্ডে গোলমাল আছে কিনা। থাকলে অপারেশন করলে গলা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু নানা ঝামেলায় এটা আর করা হয়নি। সেই ব্যাপারটা অপারেশন ছাড়াই হয়ে গেল কী করে? আমি ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলাম। মেয় তার সদ্য আবিষ্কৃত আওয়াজ মনের আনন্দে ব্যবহার করে চলেছে। আমাকে দেখে ছুটে এসে কুঁইকুঁই করে লেজ নাড়ল।

নিচু হয়ে মেয়-কে আদর করলাম। বললাম, তুই খুব লাকি। ভগবানের অশেষ করুণায় শব্দ পেয়েছিস গলায়।

এবার আমার সারের কথা খেয়াল হল। ঘরের দরজা বন্ধ। দরজাটা খুললাম। সার দরজার ওপাশে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আলমারির ওপর তখনও বসে থাকা ওরাং ওটাংটাকে লক্ষ করে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার পেছন থেকে মেয় ছুটে এসে ঘরে ঢুকে ওরাং ওটাংটাকে প্রচণ্ড জোরে বকতে শুরু করল। ওরাং ওটাং আরও গুটিয়ে গেল। কিন্তু এই সময় আমি সারের মুখ দেখে খুব কষ্ট পেলাম। কেমন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে সে মেয়র দিকে। এতদিন সে মেয়র চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিল কিন্তু আজ গলার আওয়াজ ফিরে পেয়ে মেয় তাকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। মাথা নিচু করে সে মেয়র দিকে ফিরে লেজ নাড়তে লাগল।

ওই রাতটায় আর ঘুমোতে পারিনি। এর পেছনে মেয়র অবদানও ছিল। মাঝে-মাঝেই সে গলা খুলে ডেকে গিয়েছে। এতদিন যত ডাক সে ডাকতে পারত তা এক রাতে ডেকে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা যেন তাকে পেয়ে বসেছিল। তা ছাড়া দুটো চিন্তা একই সঙ্গে আমাকে কুরে খাচ্ছিল। ওরাং ওটাংটা কীভাবে এ বাড়িতে এল এবং কেন এল? দ্বিতীয়ত, আমার মেশিনটা কী এমন কাণ্ড করল যাতে মেয় গলার আওয়াজ ফিরে পেয়েছে। যদি মেশিন কাজটা করে থাকে তা হলে বুঝতে হবে আমি সঠিক পথে এগিয়েছি। কিন্তু ওপরের ছাদ বন্ধ ছিল। মেশিনটাকেও আমি চালু করতে পারিনি। ইদানীং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় সামান্য অনুরণন ছাড়া কিছুই টের পাইনি। কিন্তু ওই অনুরণন আমাকে খুব উৎসাহিত করত। মনে হত, মেশিনটার যন্ত্রপাতির যথাযথ ব্যবহার বা সামান্য কোনও পরিবর্তন যা আমি বুঝতে পারছি না, তা করলে সাফল্য আসবে। আচ্ছা, এমন তো হতে পারে, ওই ওরাং ওটাং হুটোপুটি করে যন্ত্রটাকে ফেলে দেওয়ার সময় ওটা সঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, যা আমি এতকাল চেষ্টা করেও করতে পারিনি। আর মেশিনের ভেতর হয়তো শব্দের কোনও সামান্য মাত্রা সঞ্চিত ছিল, যা চোঙের মধ্যে দিয়ে মেয়র স্বরনালীতে আঘাত করে বৈপ্লবিক কাজটা করে দিয়েছে।

উত্তেজিত হয়ে বিছানা থেকে উঠে প্রায় দৌড়ে ওপরের ঘরে গেলাম। যন্ত্রটাকে আঁতিপাঁতি করে পরীক্ষা করেও নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না। ভোর হয়ে আসছিল। এক কাপ কফি বানিয়ে ছাদে চলে এলাম। বেশ আরামদায়ক বাতাস বইছে। মেয় ঘুরঘুর করছে বেশ গর্বের সঙ্গে। এই সময় গঙ্গাপদ এল। ওর কাছে ভেতরে ঢোকার জন্যে দরজার চাবি দেওয়া আছে। সে দরজা খুলতেই মেয়র ডাক শুনতে পেল। খুব ঘাবড়ে গিয়ে সে অবাক চোখে মেয়কে দেখতে লাগল। আমি ওপর থেকে ওর মাথাটা দেখতে পাচ্ছিলাম। তারপরে দৌড়ে ছাদে উঠে এল গঙ্গাপদ, কী করে হল বাৰু?

হয়ে গেল।

সার? সারও ডাকতে পারছে?

না। এখনও পারেনি।

ওমা! এটা কেন হল? একজন ডাকবে আর একজন বোবা হয়ে থাকবে?

এ-প্রশ্নের জবাব আমার কাছে ছিল না। কফিতে চুমুক দিলাম। গঙ্গাপদ ফিরে যাচ্ছিল মেয়র দিকে তাকাতে-তাকাতে, আমি পেছন থেকে ডাকলাম, গঙ্গাপদ।

বলুন বাবু।

নীচের ঘরের দরজার সামনে কাল রাত থেকে সারকে বেঁধে রাখতে হয়েছে। কারণ ঘরের ভেতর আলমারির ওপর একটি ওরাং ওটাং আশ্রয় নিয়েছে।

ওরাং ওটাং।

একটি বনমানুষ। বানর এবং হনুমানের স্বজাতি। কিন্তু চেহারায় পার্থক্য আছে। হাত-পা বেশি লম্বা। মাথায় অনেক বেশি বুদ্ধি। ওরাং ওটাং ভারতবর্ষের জঙ্গলে নেই। সম্ভবত আফ্রিকা থেকে একে কেউ এ-দেশে নিয়ে এসেছে।

বনমানুষ। গঙ্গাপদর চোখ বড় হয়ে উঠল।

হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়ামাত্ৰ নীচে বেল টিপল কেউ। এত ভোরে কেউ আমার বাড়িতে সচরাচর আসে না। গঙ্গাপদ নীচে নেমে গেল দেখতে।

আজ আকাশ পরিষ্কার। ভোরের আলো চমৎকার। এই আলো দেখে রাত জাগার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল আমার। আজ বেশ মন দিয়ে কাজ করা যাবে। কিন্তু তার আগে ওই বনমানুষের সমস্যা মিটিয়ে ফেলা দরকার।

গঙ্গাপদ আবার উঠে এল, বাবু, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

কী নাম?

বললেন, নাম বললে আপনি চিনতে পারবেন না। কিন্তু খুব জরুরি ব্যাপার।

সাধারণত সকালে আমি বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করতে চাই না। অনর্থক সময় নষ্ট করা ছাড়া হয়তো এমন কোনও কথা অবোধের মতো বলে যাবে, যা সারাদিন আমার মাথায় পাক খাবে। তাই না বলতে যাচ্ছিলাম। পরে ভাবলাম এত ভোরে এসেছেন যখন, তখন নিশ্চয়ই কোনও জরুরি প্রয়োজন রয়েছে।

গঙ্গাপদকে সহবত শেখাতে হবে। বাড়িতে কেউ এলে তাকে বসার ঘরে না নিয়ে এসে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। দরজাটা সামান্য খোলা, শেকলে আটকানো। শেকল খুলে বললাম, ভেতরে আসুন।

গাটাগোট্টা চেহারা, চোখ দুটো ছোট, বছর পঞ্চাশেক বয়স, সাত সকালে এসেছেন বলে পরনে ট্র্যাকসুট, অর্থাৎ বেশি দূরে থাকেন না।

নমস্কার। আপনাকে এই সময় বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।

আপনি ভেতরে এসে কথা বলুন।

ভদ্রলোক ভেতরে এলে তাঁকে সোফা দেখিয়ে দিলাম। বলুন কী করতে পারি?

আমার নাম মন্মথ দত্ত। ব্যবসা করি। এই পাড়ায় যে গোল চত্বরটি আছে তার পাশে থাকি। ব্যাপারটা বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে।

নিঃসঙ্কোচে বলুন। কাছাকাছি না হলেও একই পাড়ায় যখন থাকি।

আজ্ঞে, আমি সামান্য ব্যবসা করে থাকি। একটু অদ্ভুত ধরনের ব্যবসা।

কীরকম?

আমার বেশ কিছু ক্লায়েন্ট আছেন। তাঁরা অর্থবান এবং বিচিত্র ধরনের। যেসব জিনিস খুবই বিরল তা সংগ্রহ করার নেশী তাঁদের প্রবল। এঁদের সবাই অবশ্য একই জিনিসে আগ্রহী নন।

কেউ স্ট্যাম্প, কেউ কয়েন–।

হ্যাঁ, কেউ হয়তো শাল। কতরকমের কাজকরা শাল পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে তা আমি আগে জানতাম না। এই ধরুন কম। পুরনো কলম সংগ্রহ করা দুজনের নেশা। কারও নেশা পাথর বা মাটির তৈরি বিভিন্ন গড়নের পাচা অথবা গণেশ মূর্তি। আমি খোঁজখবর নিয়ে ওঁদের জানালে ওঁরা এসে যাচাই করে কিনে নেন। এই তো গত মাসে উত্তরবঙ্গের এক গ্রাম থেকে কালাপাহাড়ের ব্যবহার করা তরোয়াল উদ্ধার করেছি। বংশপরম্পরায় ওই তরোয়াল অবহেলায় পড়ে ছিল। মন্মথ দত্ত হাত-পা নেড়ে বোঝাচ্ছিলেন।

আমার কাছে সেরকম কোনও বিরল বস্তু তো নেই। আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন।

না সার। আমার ভুল হয়নি। এব্যাপারে শকুনের ঘ্রাণশক্তি নাকি পেয়েছি। লোকে তো তাই বলে। এখন আপনি যদি সহযোগিতা করেন তা হলে কৃতজ্ঞ হব।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

তা হলে খুলেই বলি সার। আপনার দুটো পোষা প্রাণী আছে। তাই না?

আমি অবাক হয়ে তাকালাম।

ওই কুকুরদুটো যদি বিক্রি করেন–!

আশ্চর্য! আমার বাড়িতে যে কুকুর আছে, তাদের স্বজাতিরা পশ্চিমবাংলার পথেঘাটে জন্ম নিয়ে পথেঘাটেই মারা যায়। আপনার কোনও ক্লায়েন্ট নেড়ি কুকুর কিনবে? আর নেড়ি কুকুর বিক্রি করতে তো আপনাকে পরিশ্রম করতে হবে না। রাস্তা থেকে ধরে চালান করে দিন। আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম এভাবে সময় নষ্ট হচ্ছিল বলে।

মন্মথ দত্ত মাথা নাড়লেন, না সার। শুনেছি, আপনার কুকুরদুটো নাকি বোবা। সামান্য কুঁইকুই শব্দও করে না। পৃথিবীতে কেউ বোবা কুকুরের কথা শোনেনি। ফিজিতে আমার এক ক্লায়েন্টের চিড়িয়াখানা আছে। উনি এমন জোড়া বোবা কুকুর পেলে লুফে নেবেন।

এবার আমি হেসে ফেললাম, মানুষের শখ সত্যিই অদ্ভুত!

যা বলেছেন! আর ওটা অদ্ভুত বলে আপনাদের আশীর্বাদে আমি করে খাচ্ছি।

এবার উঠে দাঁড়ালাম, কিন্তু মন্মথবাবু, আপনি যা শুনেছেন তা এতকাল ঠিক ছিল। আমার কুকুর এখন এক বাড়াবাড়ি রকমের ডাকাডাকি করছে।

মন্মথ দত্তের চোখেমুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠল। সেটা লক্ষ করে বললাম, আসুন।

ভেতরের বারান্দায় পা দিতেই চোখে পড়ল গঙ্গাপদ মেয়কে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। নতুন লোক দেখে মেয় প্রচণ্ড জোরে গর্জন করে উঠল। গঙ্গাপদ তাকে সামলাচ্ছিল। মন্মথ দত্ত বললেন, তা হলে সবাই মিথ্যে কথা বলে?

না। বললাম তো। গত রাতে ও স্বর ফিরে পেয়েছে।

সে কী! আর একটা কুকুর, তার কী অবস্থা?

সে বেচারার এখনও ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি।

ভাকে একবার দেখাবেন?

লোকটার কৌতূহল আমাকে বিরক্ত করছিল। কিন্তু সারকে দেখে যদি ও বিদায় নেয় তা হলে দেখিয়ে দেওয়াই ভাল। আমি ওঁকে দাঁড়াতে বলে বন্ধ ঘরটার সামনে গেলাম। ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে সার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু টানটান হয়ে-যাওয়া চেন ছেড়ার ক্ষমতা তার নেই। আমি তাকে বাঁধন-মুক্ত করতেই ছুটে গেল মেয়র কাছে। মেয় বেশ অহঙ্কারীর মতো চাপা গর্জন করে উঠতেই সার তার সামনে বসে লেজ নাড়তে লাগল বোকার মতন। আমি এবার মন্মথ দত্তকে বললাম, আশা করি, আপনার দেখা শেষ হয়েছে।

মন্মথ মাথা নাড়লেন। উঠোনের পাশ দিয়ে একটি দরজা আছে বাইরে যাওয়ার। হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে মন্মথসেই দরজা খুলে দিতেই তীরের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরাং ওটাংটা। আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় ও সামান্য ধাক্কা খেল। তারপর মেয়র চিৎকার উপেক্ষা করে মন্মথ দত্তর খোলা দরজা দিয়ে বাইরে উধাও হয়ে গেল।

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, এ হেপালাল, পালাল।

মন্মথ খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আরে? এটা কী?

ওরাং ওটাং। ও গঙ্গাপদ, দ্যাখো তো ওটা কোথায় গেল?

গঙ্গাপদর পক্ষে তখনই সার এবং মেয়কে সামলে বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিল

দেখে আমিই ছুটলাম। মন্মথ দত্ত আমার পেছন-পেছন এলেন। চোখের সামনে কোথাও ওরাং ওটাংটি নেই। শুধু বড়বড় গাছগুলোকে ঘিরে কাকেরা চিৎকার করে চলেছে। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। মন্মথ দত্তকে বললাম, কী দরকার ছিল ওইভাবে দরজা হাট করে খুলে ধরার। অদ্ভুত মানুষ তো আপনি।

মন্মথ দত্ত বললেন, কী করে বুঝব বলুন আপনি ওরাং ওটাং পুষেছেন।

আমি পুষিনি। ওব্যাটা একটি ট্রেন্ড চোর। পুলিশ ওকে খুঁজছে। কাল রাত্রে এ বাড়িতে চুরি করতে এসেছিল। এ হে, ভেবেছিলাম আজ সকালে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। ঠিক আছে, এখন আপনি আসতে পারেন।

আমি আর দাঁড়ালাম না। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কয়েক পা এগোতেই সার এসে আমার পায়ের ওপর চলে এল। তার গলা দিয়ে আমার পা ঘষতে লাগল সে। ওর এই পরিবর্তন আগে কখনও দেখিনি। ওর মাথায় হাত বোলালাম। বললাম, দাঁড়া, একটু সময় দে। যদি আমার মেশিন মেয়র গলায় স্বর এনে দিতে পারে, তা হলে তুইও ডাকতে পারবি।