আমা নিতে ভরত আইলে পুনর্ব্বার।
কেমনে অন্যথা করি বচন তাহার।।
চিত্রকূট অযোধ্যা নহে ত বহু দূর।
ভরত ভ্রাতার ভক্তি আমাতে প্রচুর।।
রঘুনাথ এমত চিন্তিয়া মনে মনে।
চিত্রকূট ছাড়িয়া চলিলেন দক্ষিণে।।
কতদূর যান তাঁরা করি পরিশ্রম।
সম্মুখে দেখেন অত্রিমুনির আশ্রম।।
প্রবেশিয়া তিন জন পুণ্য তপোবন।
বন্দনা করেন অত্রিমুনির চরণ।।
রামে দেখি মুনিবর উঠিয়া যতনে।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া বসাইলেন আসনে।।
আপন পত্নীর ঠাঁই সমর্পিলা সীতা।
বলেন পালহ যেন আপন দুহিতা।।
দেখি মুনি পত্নীকে ভাবেন মনে সীতা।
মূর্ত্তিমতী করুণা কি শ্রদ্ধা উপস্থিতা।।
শুক্লবস্ত্র পরিধানা, শুক্ল সর্ব্ব বেশ।
করিতে করিতে তপ পাকিয়াছে কেশ।।
ধরিয়া তপস্বী মূর্ত্তি করেন তপস্যা।
জ্ঞান হয় গায়ত্রী কি সবার নমস্যা।।
কৃতাঞ্জলি নমস্কার করিলেন সীতা।
আশীর্ব্বাদ করিলেন অত্রির বনিতা।।
মুনিপত্নী বসাইয়া সম্মুখে সীতারে।
কহেন মধুর বাক্য প্রফুল্ল অন্তরে।।
রাজকুলে জন্মিয়া পড়িলে রাজকুলে।
দুই কুল উজ্জ্বল করিলা গুণে শীলে।।
এ সব সম্পদ ছাড়ি পতি সঙ্গে যায়।
হেন স্ত্রী পাইলা রাম বহু তপস্যায়।।
সীতা কহিলেন, মা সম্পদে কিবা কাম।
সকল সম্পদ মম দূর্ব্বাদলশ্যাম।।
স্বামী বিনা স্ত্রীলোকের কার্য্য কিবা ধনে।
অন্য ধনে কি করিবে পতির বিহনে।।
জিতেন্দ্রিয় প্রভু মম সর্ব্ব গুণে গুণী।
হেন পতি সেবা করি, ভাগ্য হেন মানি।।
ধন জন সম্পদ না চাহি ভগবতি।
আশীর্ব্বাদ কর যেন রামে থাকে মতি।।
শুনিয়া সীতার বাক্য তুষ্ট মুনি-দারা।
আমার যেমন মন সীতার সে ধারা।।
সমাদরে সীতারে দিলেন আলিঙ্গন।
দিব্য অলঙ্কার আর বহুমূল্য ধন।।
তুষ্টা হয়ে সীতারে কহেন ভগবতী।
তব পূর্ব্ব বৃত্তান্ত কহ গো সীতা সতী।।
জানকী বলেন, দেবী কর অবধান।
আমার জন্মের কথা অপূর্ব্ব আখ্যান।।
একদিন ঊর্ব্বশী যাইতে বস্ত্র উড়ে।
তাহা দেখি জনক রাজার বীর্য্য পড়ে।।
সেই বীর্য্যে জন্ম মোর হইল ভূমিতে।
উঠিল আমার তনু লাঙ্গল চষিতে।।
অযোনিসম্ভবা, মম জন্ম মহীতলে।
লাঙ্গল ছাড়িয়া রাজা মোরে নিল কোলে।।
কন্যা বলি রাজা মনে অনুমানি।
হেনকালে আকাশে হইল দৈববাণী।।
দেবগণ ডাকি বলে, জনক ভূপতি।
জন্মিল তোমার বীর্য্যে কন্যা রূপবতী।।
অযোনিসম্ভবা এই তোমার দুহিতা।
লাঙ্গলের মুখে জন্ম, নাম রাখ সীতা।।
এতেক শুনিয়া রাজা হরষিত মন।
দ্বিজ দীন দুঃখীরে দিলেন বহু ধন।।
প্রধান দেবীর ঠাঁই দিলেন আমারে।
আমারে পালেন দেবী বিবিধ প্রকারে।।
দিনে দিনে বাড়ি আমি মায়ের পালনে।
আমা দেখি জনক চিন্তেন মনে মনে।।
যেই জন গুণ দিবে শিবের ধনুকে।
তাঁরে সমর্পিব সীতা পরম কৌতুকে।।
দারুণ প্রতিজ্ঞা এই ভুবনে প্রচার।
তের লক্ষ বীর এল রাজার কুমার।।
ধনুক দেখিয়া সবাকার প্রাণ কাঁপে।
না সম্ভাষি পিতাবে পলায় মনস্তাপে।।
প্রতিজ্ঞা করিয়া আগে না পান ভাবিয়া।
কেমনে সম্পন্ন হবে জানকীর বিয়া।।
হেনকালে উপস্থিত শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
ধনুক দেখিয়া হাস্য করেন তখন।।
ধনুকেতে দিতে গুণ সর্ব্ব লোকে বলে।
ধনুখান ধরি রাম বামহাতে তোলে।।
গুণ যোগ করিতে সে ধনুখান ভাঙ্গে।
সবে স্তব্ধ তার শব্দ ত্রিভুবনে লাগে।।
ধনুকের শব্দ যেন পড়িল ঝঞ্ঝনা।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে কাঁপিল সর্ব্বজনা।।
শিরে পঞ্চঝুঁটি তাঁর বিক্রম বিস্তর।
চূড়া কর্ণবেধ হয়, লোকে চমৎকার।।
বিবাহ করিতে পিতা বলেন আমারে।
না করেন স্বীকার পিতার অগোচরে।।
রাজ্যসহ দশরথ আসিয়া সম্বাদে।
রামের বিবাহ দেন পরম আহ্লাদে।।
শ্রীরাম করিলেন আমার পাণিগ্রহ।
লক্ষ্মণের দারকর্ম্ম ঊর্ম্মিলার সহ।।
কুশধ্বজ কুড়ার যে দুই কন্যা ছিল।
ভরত শত্রুঘ্ন দোঁহে বিবাহ করিল।।
ভগবতী পূর্ব্বকথা এই কহিলাম।
হেনমতে মিলিলেন মম স্বামী রাম।।
এত যদি সীতাদেবী কহেন কাহিনী।
পরিতোষ পাইলেন মুনির গৃহিণী।।
ব্রাহ্মণী সীতার ভালে দিলেন সিন্দূর।
কণ্ঠে মণিময় হার, বাহুতে কেয়ূর।।
কর্ণেতে কুণ্ডল, করে কাঞ্চন কঙ্কণ।
নূপুরে শোভিত হয় কমল চরণ।।
নাসায় বেশর দেন গজমুক্তা তায়।
পট্টবস্ত্র অধিক শোভিত গৌর গায়।।
প্রদোষ হইল গত, প্রবেশে রজনী।
রামের নিকটে যান শ্রীরাম-রমণী।।
উমা রমা নাহি পান সীতার উপমা।
চরাচরে জনক-দুহিতা নিরুপমা।।
দেখিয়া সীতার রূপ হৃষ্ট রঘুমণি।
মুনির আশ্রমে সুখে বঞ্চেন রজনী।।
প্রভাতে করিয়া স্নান আর যে তর্পণ।
তিনজন বন্দিলেন মুনির চরণ।।
আশীর্ব্বাদ করিলেন অত্রি মহামুনি।
কহিলেন উপদেশ উপযুক্ত বাণী।।
শুন রাম রাক্ষস-প্রধান এই দেশ।
সদা উপদ্রব করে, দেয় বহু ক্লেশ।।
অগ্রেতে দণ্ডকারণ্য অতি রম্য স্থান।
তথা গিয়া রঘুবীর কর অবস্থান।।
মুনির চরণে রাম করিয়া প্রণতি।
দণ্ডক কানন মধ্যে করিলেন গতি।।
আগে যান রঘুনাথ, পশ্চাৎ লক্ষ্মণ।
জনক-তনয়া মধ্যে, কি শোভা তখন।।
ফল পুষ্প দেখেন গন্ধেতে আমোদিত।
ময়ূরের কেকাধ্বনি ভ্রমরের গীত।।
নানা পক্ষী কলরব শুনিতে মধুর।
সরোবরে কত শত কমল প্রচুর।।
বনমধ্যে অনেক মুনির নিবসতি।
শ্রীরামের দেখিয়া হরিষে করে স্তুতি।।
রাজ্যে থাক, বনে থাক, তোমার সমান।
যথা তথা থাক রাম তুমি ভগবান।।
রম্য জল রম্য ফল মধুর সুস্বাদ।
আহার করিয়া দূরে গেল অবসাদ।।
দেখিতে হইল ইচ্ছা দণ্ডক-কানন।
তিন জন মনঃসুখে করেন ভ্রমণ।।
আগে রাম, মধ্যে সীতা পশ্চাৎ লক্ষ্মণ।
নানা স্থালে কৌতুকে করেন নিরীক্ষণ।।
হেনকালে দুর্জ্জয় রাক্ষস আচম্বিত।
বিকট আকারে সে সম্মুখে উপস্থিত।।
রাঙ্গা দুই আঁখি তার খোঁখর হৃদয়।
বন-জন্তু ধরে মারে, কারে নাহি ভয়।।
দুর্জ্জয় শরীর ধরে পর্ব্বত সমান।
জ্বলন্ত আগুন যেন রাঙ্গা মুখখান।।
শিরে দীর্ঘজটা কটা, দীর্ঘ সর্ব্ব কায়।
লম্বোদর অস্থিসার, শিরা গণা যায়।।
বান্ধিয়া লইয়া যায় মাংসভার স্কন্ধে।
পলায় লইয়া প্রাণ সবে তার গন্ধে।।
মেঘের লইয়া যায় মাংসভার স্কন্ধে।
পলায় লইয়া প্রাণ সবে তার গন্ধে।।
মেঘের গর্জ্জন ন্যায় ছাড়ে সিংহনাদ।
মহাভয়ঙ্কর মূর্ত্তি রাক্ষস বিরাধ।।
সীতারে রাক্ষস গিয়া লইলেক কক্ষে।
তর্জ্জন গর্জ্জন করে থাকি অন্তরীক্ষে।।
সীতারে খাইতে চাহে মেলিয়া বদন।
শ্রীরামেরে কটু কহে করিয়া তর্জ্জন।।
তপস্বীর বেশে রাম ভ্রমিস কাননে।
দেখাইয়া কামিনী ভুলাস মুনিগণে।।
বলিল, মনুষ্য আজি করিব ভক্ষণ।
ঝাট পরিচয় দেহ তোরা কোন জন।।
শ্রীরাম বলেন, আমি ক্ষত্রিয়-কুমার।
লক্ষ্মণ অনুজ, জায়া জানকী আমার।।
দেখি হে তোমার কেন বিকৃত আকৃতি।
বনেতে বেড়াও তুমি, হও কোন্ জাতি।।
রাক্ষস বলিল, আমি যে হই সে হই।
সবারে খাইব আমি, ছাড়িবার নই।।
বিরাধ আমার নাম, থাক থাক তথা।
কাল নামে মম পিতা বিদিত সর্ব্বথা।।
কত মুনি বধিলাম বিধাতার বরে।
অভেদ্য শরীর মোর, ভয় করি কারে।।
লক্ষ্মণেরে শ্রীরাম কহেন, পেয়ে ভয়।
জানকীরে খায় বুঝি রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
আইলাম নিজ দেশ ছাড়িয়া বিদেশে।
সীতারে খাইল আজি দারুণ রাক্ষসে।।
লক্ষ্মণ বলেন, দাদা না ভাবিহ তাপ।
রাক্ষসের মারিয়া ঘুচাও মনস্তাপ।।
লক্ষ্মণের বাক্যে শ্রীরামের বল বাড়ে।
মারিলেন সাত বাণ রাম তার ঘাড়ে।।
সাত বাণ খাইয়া সে কিছু নাহি জানে।
হাতে ছিল জাঠাগাছ মারিল লক্ষ্মণে।।
তাহা দেখি শ্রীরাম ছাড়েন এক বাণ।
জাঠাগাছ তখনি হইল খান খান।।
জাঠাগাছ কাটা গেল রাক্ষসের ত্রাস।
অস্ত্র নাহি নিশাচর উঠিল আকাশ।।
ছাড়েন ঐষিক বাণ দশরথ-সুত।
পড়িল বিরাধ, যেন কৃতান্তের দূত।।
খণ্ড খণ্ড হইয়া শরীর রক্তে ভাসে।
মরি মরি করি যায় শ্রীরামের পাশে।।
আছাড়িয়া ফেলে সীতা, আঘাতে ব্যগ্রতা।
ভূমিতে পড়েন সীতা হইয়া মূর্চ্ছিতা।।
যোড়হাতে রাক্ষস শ্রীরামে করে স্তুতি।
তব বাণ স্পর্শে রাম পাই অব্যাহতি।।
শাপে মুক্ত করিলা আমার এ শরীর।
লইলাম শরণ চরণে রঘুবীর।।
ধন্য ধন্য সীতাদেবী, রাম যাঁর পতি।
তোমা পরশিয়া হয় শাপে অব্যাহতি।।
পূর্ব্বকথা আমার শুনহ রঘুপতি।
কুবেরের শাপেতে আমার এ দুর্গতি।।
কিশোর আমার নাম, কুবেরের চর।
আমারে সর্ব্বদা তুষ্ট ধনের ঈশ্বর।।
একদিন কুবের লইয়া নারীগণে।
রঙ্গস্থলে কেলি করে মাতিয়া মদনে।।
কর্ম্মদোষে আমি তথা হই উপনীত।
আমারে দেখিয়া তাঁরা হইলা লজ্জিত।।
কোপে শাপ দিলেন আমারে ধনেশ্বর।
দণ্ডক-কাননে গিয়া হও নিশাচর।।
পশ্চাতে করুণা করি বলেন বচন।
শ্রীরামের শরে হবে শাপ বিমোচন।।
পাইলাম তোমার দর্শনে অব্যাহতি।
মৃতদেহ পোড়াইলে পাইব নিষ্কৃতি।।
লক্ষ্মণের উদযোগে দানব-দেহ পুড়ে।
দিব্যদেহ ধরিয়া সে দিব্য রথে চড়ে।।
রাম দরশনে দৈত্য গেল স্বর্গবাস।
রচিল অরণ্যকাণ্ড দ্বিজ কৃত্তিবাস।।