ঊনত্রিংশ অধ্যায়
শাপগ্রস্ত গজ-কচ্ছপবৃত্তান্ত
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, এক ব্রাক্ষণ ভার্য্যা সমভিব্যাহারে গরুড়ের কণ্ঠদেশে প্রবেশ করিয়াছিলেন। তিনি জ্বলন্ত অঙ্গারের ন্যায় তাঁহার কণ্ঠদাহ করিতে লাগিলেন। তখন গরুড় মাতৃবাক্য স্মরণ করিয়া কহিলেন, “হে দ্বিজোত্তম! আমি মুখব্যাদান [প্রসারণ—বড়রকমের হা ] করিতেছি, তুনি অতি সত্বর বহির্গত হও; ব্রাহ্মণ সর্ব্বদা পাপচরণতৎপর হইলেও আমার অবধ্য।” ব্রাক্ষণ খগাধিরাজ গরুড়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া প্রত্যুত্তর করিলেন, “তবে আমার ভার্য্যা, নিষাদীও আমার সহিত বহির্গত হউক।” গরুড় কহিলেন, “ভাল, তুমি নিষাদীকে সঙ্গে লইয়া অবিলম্বে আমার আস্যবিবর [মুখগহ্বর] হইতে বহির্গত হও। তুমি এখনও আমার উদরে প্রবেশ করিয়া ভস্মাবশেষ হও নাই। অতএব বিলম্ব না করিয়া শীঘ্র আত্মরক্ষা কর।” তখন ব্রাক্ষণ নিষাদীর সহিত নিষ্ক্রান্ত হইয়া গরুড়কে সংবর্দ্ধনা করিয়া অভিলষিত প্রদেশে প্রস্থান করিলেন।
এইরূপে ব্রাহ্মণ ও তদীয় ভার্য্যা নিষাদী বহির্গত হইলে খগরাজ স্বকীয় পক্ষজাল বিস্তার করিয়া প্রবলবেগে অন্তরীক্ষে উত্থিত হইলেন এবং অনতিবিলম্বে স্বীয় পিতা কশ্যপকে দেখিতে পাইলেন। মহর্ষি কশ্যপ আপন সন্তানের সন্দর্শন পাইয়া কুশলপ্রশ্নানন্তর জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস! মনুষ্যলোকে তোমার পর্য্যাপ্ত আহার-লাভ হইয়া থাকে?” তখন গরুড় কহিলেন, “পিতাঃ! আমার মাতা ও ভ্রাতা কুশলে আছেন এবং আমারও সর্ব্বাঙ্গীণ মঙ্গল বটে; কিন্তু মর্ত্ত্যলোকে আমার প্রচুর আহারদ্রব্য প্রাপ্ত হওয়া দুষ্কর হইয়াছে।” আরও কহিলেন, “নাগেরা আমাকে অমৃত আহরণ করিতে প্রেরণ করিয়াছে; আমি জননীর দাসীভাব মোচন করিবার নিমিত্ত অদ্য তাহা আনয়ন করিব; মাতা নিষাদগণকে ভক্ষণ করিতে কহিয়াছিলেন, বহুসংখ্যক নিষাদ ভক্ষণ করিয়াছি, তথাপি আমার সমুচিত তৃপ্তিলাভ হয় নাই; অতএব হে ভগবান্! এক্ষণে অপর কোন ভক্ষ্যদ্রব্য নির্দ্দেশ করিয়া দিন, যাহা আহার করিলে আমি অমৃত আহরণ করিতে সমর্থ হইব। হে প্রভো! বলবতী ক্ষুৎপিপাসায় আমার কণ্ঠতালু শুষ্কপ্রায় হইয়াছে।”
তখন মহর্ষি কশ্যপ কহিলেন, “বৎস! অনতিদূরে ঐ পবিত্র সরোবরটি দেখিতেছ. উহা দেবলোকেও বিখ্যাত। ঐ স্থলে দেখিতে পাইবে, এক হস্তী অবাঙ্মুখ [অধোবদন—নিম্নমুখ] হইয়া কূর্ম্মরূপী স্বকীয় জ্যেষ্ঠ সহোদরকে আকর্ষণ করিতেছে। উহাদিগের আকারের পরিমাণ ও জন্মান্তরীণ বৈরবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ কর।”
বিভাবসু নামে অতি কোপনস্বভাব এক মহর্ষি ছিলেন। তাঁহার কনিষ্ঠ সহোদর মহাতপা সুপ্রতীক ভ্রাতার সহিত একান্নে থাকিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক; এই নিমিত্ত তিনি আপন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিকট সর্ব্বদা পৈতৃক ধনবিভাগের কথা উত্থাপন করিতেন। একদা বিভাবসু ক্রুদ্ধ হইয়া সুপ্রতীককে কহিলেন, “দেখ, অনেকেই মোহপরবশ হইয়া পৈতৃকধন বিভাগ করিতে অভিলাষ করে; কিন্তু বিভাগানন্তর ধনমদে মত্ত হইয়া পরস্পর বিরোধ আরম্ভ করে। স্বার্থপর মূঢ় ব্যক্তিরা স্বীয় ধন অধিকার করিলে শত্রুপক্ষ মিত্রভাবে প্রবেশ করিয়া তাহাদিগের আত্মবিচ্ছেদ জন্মাইয়া দেয় এবং ক্রমশঃ দোষ দর্শাইয়া পরস্পরের রোষবৃদ্ধি ও বৈরভাব বদ্ধমূল করিতে থাকে। এইরূপ হইলে তাহাদিগের সর্ব্বদাই সর্ব্বনাশ ঘটিবার সম্ভাবনা। এই কারণে ভ্রাতৃগণের ধনবিভাগ সাধুদিগের অভিপ্রেত নহে। কিন্তু তুমি নিতান্ত অনভিজ্ঞের ন্যায় ঐ কথারই বারংবার উত্থাপন করিয়া থাক। আমি বারণ করিলেও তাহাতেও কর্ণপাত কর না; অতএব তুমি বারণযোনি [হস্তি-জন্ম] প্রাপ্ত হও।” সুপ্রতীক এইরূপে শাপগ্রস্ত হইয়া বিভাবসুকে কহিলেন, “তুমিও কচ্ছপযোনি প্রাপ্ত হও।”
এইরূপে সুপ্রতীক ও বিভাবসু পরস্পরের শাপপ্রভাবে গজত্ব ও কচ্ছপত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন। এক্ষণে তাঁহারা রোষদোষে তির্য্য্গযোনি-প্রাপ্ত, পরস্পর বিদ্বেষরত এবং শরীরের গুরুত্ব ও বলদর্পে একান্ত দর্পিত হইয়া জন্মান্তরীণ বৈরাসুসারে এই সরোবরে অবস্থান করিতেছেন। ঐ দেখ, গজের বৃংহিত [সক্রোধ ধ্বনি] শব্দে মহাকায় কচ্ছপ সরোবর আলোড়িত করিয়া জলমধ্য হইতে সত্বর উত্থিত হইতেছে। গজ তাহাকে দেখিতে পাইয়া অতি প্রকাণ্ড শুণ্ডাদণ্ড [শুঁড়] আস্ফালনপূর্ব্বক জলে অবগাহন করিতেছে। উহার শুণ্ডদণ্ড, লাঙ্গুল ও পদচতুষ্টয়ের তাড়নে সরোবরে অবস্থান করিতেছেন। উহার শুণ্ডাদণ্ড, লাঙ্গুল ও পদচতুষ্টয়ের তাড়নে সরোবর বিক্ষোভিত হইতেছে। অতি-পরাক্রান্ত কূর্ম্মও মস্তক উন্নত করিয়া যুদ্ধার্থে অভ্যাগত হইতেছে। গজের কলেবর ছয় যোজন উন্নত ও দ্বাদশ যোজন আয়ত। কূর্ম্ম তিন যোজন উন্নত ও তাহার পরিধি দশ যোজন। হে বৎস! উহারা পরস্পরের বিনাশে কৃতসঙ্কল্প হইয়া যুদ্ধে মত্ত হইয়াছে, উহাদিগকে ভক্ষণ করিয়া আপনার অভীষ্টসিদ্ধি কর। যাও, তুমিও এই মহাগিরিসদৃশ ঘোররূপী হস্তীকে ভোজন করিয়া অমৃত আহরণ কর।”
মহর্ষি কশ্যপ গরুড়কে ভক্ষ্যদ্রব্য নির্দ্দেশ করিয়া দিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন, “বৎস! দেবতাদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে। পূর্ণকুম্ভ, গো, ব্রাহ্মণ এবং আর যে কিছু মাঙ্গল্যবস্তু আছে, সে সকলই তোমার শুভপ্রদ হউক। হে মহাবলপরাক্রান্ত! যৎকালে তুমি দেবতাদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে, তখন ঋক্, যজু:, সাম এই তিন বেদ, যজ্ঞীয় পবিত্র বহিঃ ও রহস্য [বেদের শক্তি—দৈবশক্তি] তোমার বলাধান করিবে।” গরুড় পিতার আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করিয়া অনতিদূরে সেই নির্ম্মল জলপূর্ণ হ্রদ দেখিতে পাইলেন এবং তাহাতে নানাবিধ জলচর পক্ষিসকল কলরব করিতেছে দেখিলেন। তখন তিনি পিতৃবাক্য স্মরণ করিয়া এক নখে গজ ও অপর নখে কচ্ছপকে গ্রহণ করিয়া সত্বরে আকাশপথে উত্থিত হইলেন; অনন্তর অলম্ব নামক তীর্থে সমুপস্থিত হইয়া দেববৃক্ষগণের উপর আরোহণ করিতে ইচ্ছা করিলেন। বিটপি-মণ্ডলী [বৃক্ষশ্রণী] গরুড়ের পক্ষ-পবনে [পাখার বাতাস] আহত হইয়া শাখাভঙ্গভয়ে শঙ্কিত ও কম্পিত হইতে লাগিল। বিহঙ্গরাজ সেই অভীষ্টফলপ্রদ দিব্য সুবর্ণময় তরুদিগকে ভঙ্গভয়ে কম্পিত দেখিয়া অতীব উন্নত অন্যান্য বৃক্ষের সমীপে গমন করিলেন। সেই পরম রমণীয় বৃক্ষগুলির সুস্বাদু ফলসকল কাঞ্চনময় ও রজতময়, শাখাসমুদয় প্রবালময় এবং উহাদিগের মূলদেশ সর্ব্বদা সাগরজলে প্রক্ষালিত হইতেছে। তম্মধ্যে অত্যুচ্চ এক বটবিটপী পক্ষিরাজ গরুড়কে আগমন করিতে দেখিয়া কহিল, “হে গরুত্মন! তুমি আমার এই শত যোজন-বিস্তীর্ণ, অতিপ্রকাণ্ড শাখায় উপবেশন করিয়া গজ-কচ্ছপ ভক্ষণ কর।” মহীধর-তুল্য-কলেবর পতগেশ্বর প্রবলবেগে বহুসহস্রপক্ষিসেবিত সেই বৃক্ষশাখায় আরোহণ করিবামাত্র তাহা ভগ্ন হইল।