২৯তম অধ্যায়
দ্ৰৌপদীর প্রতি যুধিষ্ঠিরের সান্ত্বনা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “প্রিয়ে! ক্ৰোধ মনুষ্যকে সংহার করে ও ক্রোধই মঙ্গলের কারণ হয়, সুতরাং সমস্ত শুভাশুভ ঘটনা ক্ৰোধ হইতেই সমুদ্ভূত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি ক্ৰোধ সংবরণ করিতে সমর্থ হয়, তাহারই মঙ্গল হয়; কিন্তু যাহার ক্রোধাবেগ ধারণ করিবার সামর্থ্য নাই, নিদারুণ ক্ৰোধ তাহারই অমঙ্গলের কারণ হয়। ক্রোধই প্ৰজাদিগকে সমূলে নির্মূল করে; অতএব হে শোভনে! মাদৃশ ব্যক্তি কিরূপে লোকবিনাশন ক্রোধহুতাশন অবলম্বন করিয়া কালাতিপাত করিবে? মানবগণ ক্ৰোধাবিষ্ট হইলে অশেষবিধ পাপানুষ্ঠান ও গুরুজনদিগের প্রাণবিনাশ করিতে পারে; অতি কঠোরবাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক শ্রেষ্ঠলোকেরও অবমাননা করিয়া থাকে। রোষাপরবশ ব্যক্তির কদাচ বাচ্যাবাচ্যুজ্ঞান ও অকাৰ্য্যের বিচারণা থাকে না। সে ক্ৰোধপূর্ব্বক অবধ্যের বধ ও বধ্যের সৎকার করিয়া থাকে। অধিক কি, ক্ৰোধানল উত্তেজিত হইলে ক্রুদ্ধ ব্যক্তি অনায়াসে আপনাকেও শমন-সদনে প্রেরণ করে। এই সমস্ত দোষ প্রদর্শনপূর্ব্বক অশেষজ্ঞানশালী পণ্ডিতেরা ক্রোধকে পরাজয় করিয়া ইহলোকে ও পরলোকে অশেষ সুখসম্ভোগ করিতেছেন, অতএব এই সকল দোষ দেখিয়া আমি কিরূপে সাধুজন-বিগৰ্হিত ক্ৰোধ অবলম্বন করি? হে দ্ৰৌপদি! এই সমস্ত বিষয় পূর্ব্বাপর পর্য্যালোচনা করিয়া আমি ক্রোধানল শীতল করিয়াছি। যে ব্যক্তি ক্রোধীর প্রতি ক্ৰোধ প্রকাশ না করে, সে আত্ম-পর উভয়কেই মহদ্ভয় হইতে পরিত্রাণ করে; সুতরাং সে ব্যক্তি আত্ম-পর উভয়েরই উপকারক হইয়া উঠে। যদি রোষপরবশ দুর্ব্বল মূঢ় ব্যক্তি বলবান লোকের নিকট পরাভূত হইয়া ক্লেশভোগ করে, তাহা হইলে সে স্বতঃই আত্মহত্যা করিয়া থাকে। সেই অসংযতচিত্ত আত্মঘাতীর পরলোক নষ্ট হয়; অতএব হে দ্ৰৌপদি! দুৰ্ব্বলের ক্ৰোধ সংবরণ করাই বিধেয়। বলশালী বিদ্বান ব্যক্তি অশেষ ক্লেশভোগ করিয়াও যদি ক্রোধাপরবশ ও ক্লেশদাতাকে বিনাশ করিতে উদ্যত না হয়েন, তাহা হইলে তিনি পরলোক আনন্দ-সন্দেহলাভ করিয়া সুখে কালব্যাপন করেন। অতএব আপৎকাল উপস্থিত হইলে বলবান ও দুর্ব্বল উভয়েই পীড়য়িতাকে ক্ষমা করিবে। সাধুলোকেরা জিতক্ৰোধ ব্যক্তিকে সাতিশয় প্রশংসা করিয়া থাকেন। ক্ষমাপর সজ্জন ব্যক্তির নিশ্চয়ই জয়লাভ হইয়া থাকে। মিথ্যা অপেক্ষা সত্যই শতগুণে শ্রেষ্ঠ ও নৃশংসাচার অপেক্ষা অনৃশংসতাই নিতান্ত শ্ৰেয়ঃ। হে দ্ৰৌপদি! মাদৃশ ব্যক্তিরা দুৰ্য্যোধন হইতে নিধনপ্রাপ্ত হইলেও বহুদোষোকর সাধুবিগৰ্হিত ক্ৰোধকে কিরূপে প্রকাশ করিবে? যিনি বুদ্ধিবলে প্রবল ক্ৰোধ বশীভুত করিতে সমর্থ হয়েন, যাঁহার হৃদয়াভ্যন্তরে কিঞ্চিম্মাত্র ক্ৰোধের সঞ্চার থাকে না, তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতেরা তাঁহাকেই তেজস্বী বলিয়া নির্দেশ করেন। হে সুন্দরি! ক্রুদ্ধ ব্যক্তি প্ৰণালীক্ৰমে কদাচ কাৰ্য্যপৰ্য্যালোচনা করিতে পারে না, মৰ্য্যাদারও অপেক্ষা রাখে না। এবং অবধ্যের বধ ও গুরুজনের পীড়াপ্রদানে রত থাকে, অতএব তেজস্বী পুরুষ অবশ্যই ক্ৰোধ পরিত্যাগ করিবে। দেখ, ক্ৰোধাভিভূত ব্যক্তি দক্ষতা, অমর্ষ, শৌৰ্য্য ও আশুকারিতা এই কয়েকটি তেজোগুণ কোনক্রমেই লাভ করিতে পারে না। ক্ৰোধ পরিত্যাগ করিলে লোকে তেজপ্রাপ্ত হইয়া থাকে, কিন্তু রোষপরায়ণ ব্যক্তির পক্ষে যথাকলোৎপন্ন সেই তেজ একান্ত দুঃসহ হইয়া উঠে। মূর্খেরাই ক্রোধকে তেজ বলিয়া নির্ণয় করিয়া থাকে। বিধাতা লোকসংহারার্থ মানবগণের মনোমধ্যে রজোগুণপরিণাম ক্ৰোধ বিধান করিয়া দিয়াছেন; অতএব সুশীল ব্যক্তি এককালে ক্ৰোধ পরিত্যাগ করিবে। যদি ধর্ম্মপরিত্যাগ হয়, তাহাও করিবে, তথাপি কোনক্রমে ক্রোধাবিষ্ট হইবে না। হে পাঞ্চালি! হীনমতি মূঢ় ব্যক্তিই ক্ষমা আর্জ্জবাদি গুণসকল লঙ্ঘন করিয়া থাকে, কিন্তু মাদৃশ ধীমান লোকের ঐরূপ গুণগ্রাম অতিক্রম করা কোনক্রমেই উচিত নহে। যদি মনুষ্যমধ্যে কোন ব্যক্তি সর্বংসহা পৃথিবীর ন্যায় ক্ষমাশীল না হইত, তাহা হইলে সন্ধিস্থাপনের কথা দূরে থাকুক, কেবল ক্ৰোধমূলক যুদ্ধই উপস্থিত হইত। তাপিত হইলেই তাপপ্রদান করিবে ও গুরু কর্ত্তৃক আহত হইলেই তাহাকে আঘাত করিবে, কেহ আক্রোশ কিরলে তাহার উপর আক্রোশ প্রকাশ করিবে, হিংসা করিলেই হিংসা করিবে, এইরূপ রীতি-পদ্ধতির অনুসরণ করিলে সমুদয় জগৎ বিনষ্ট ও অধর্ম্ম পরিবদ্ধিত হইত। হে পাঞ্চালি! এইরূপে লোকসকল কোপাবিষ্ট হইলে পিতা পুত্ৰদিগকে ও পুত্র পিতাকে, ভর্ত্তা ভাৰ্য্যাকে ও ভাৰ্য্যা ভর্ত্তাকে বিনষ্ট করিত, তাহা হইলে একেবারে সৃষ্টির লোপ হইয়া যাইত, আর কাহারও উৎপত্তি হইত না। হে শোভনে! প্ৰজাদিগের জন্মের কারণ সন্ধি; তাহার অন্যথা হইলে তাহাদিগের ক্রোধানল প্রজ্বলিত হইয়া সমস্ত সংসার ভস্মসাৎ করিত ও অভ্যুদয়ের আর সম্ভাবনা থাকিত না। হে দ্রুপদরাজতনয়ে! এই জগতীতলে পৃথিবীর ন্যায় ক্ষমাশীল লোকসমুদয় বিদ্যমান থাকাতেই প্ৰজাগণের জন্ম ও শ্ৰীবৃদ্ধি হইতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। সর্ব্বপ্রকার আপদেই ক্ষমা করা বিধেয়। কারণ, ক্ষমাশীল ব্যক্তিই ভূতসৃষ্টির প্রধান কারণ। যে ব্যক্তি আক্রুষ্ট, তাড়িত ও ক্রুদ্ধ হইয়াও বলিষ্ঠের প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শন করিয়া থাকে এবং যে ব্যক্তি প্রভাবসম্পন্ন হইয়া ক্রোধকে জয় করিয়া ক্ষমাশালী হয়, সেই ব্যক্তিই বিদ্বান ও শ্রেষ্ঠ; তাঁহারই সনাতন লোকলাভ হইয়া থাকে। কিন্তু অল্প-বিজ্ঞানসম্পন্ন রোষপর ব্যক্তির ইহকাল ও পরকাল উভয়ই বিনষ্ট হয়। মহাত্মা কাশ্যপ ক্ষমাশীল ব্যক্তির এক গাঁথা উল্লেখ করিয়াছেন, শ্রবণ কর। ক্ষমা ধর্ম্ম, ক্ষমা যজ্ঞ, ক্ষমা বেদ ও ক্ষমাই শাস্ত্ৰ, যিনি ইহা সম্যক অবগত আছেন, তিনি সকলকেই ক্ষমা করিতে পারেন। ক্ষমা ব্ৰহ্ম ও সত্য, ক্ষমা ভূত ও ভবিষ্যৎ, ক্ষমা তাপ ও শৌচ এবং ক্ষমাই এই পৃথিবীকে ধারণ করিয়া রহিয়াছে। ক্ষমাশীল ব্যক্তি যজ্ঞবেত্তা, বেদবেত্তা ও তপস্বীদিগের লোক অপেক্ষা উপরিতন লোক প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। যাদুর্ব্বেদবিহিত কর্ম্মকারী ও অন্যান্য কর্ম্মশীল ব্যক্তিদিগের লোক-সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন করিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, কিন্তু ক্ষমাপর ব্যক্তিদিগের লোক ব্ৰহ্মলোকেই প্রতিষ্ঠিত ও পূজিত হইয়া রহিয়াছে। ক্ষমা তেজস্বীদিগের তেজঃস্বরূপ ও তপস্বিগণের ব্ৰহ্মস্বরূপ। সত্যপরায়ণ ব্যক্তিদিগের ক্ষমাই সত্য, ক্ষমাই যজ্ঞ ও ক্ষমাই শান্তি। অতএব মদ্বিধ লোক এক্ষণে কিরূপে ক্ষমা পরিত্যাগ করিতে পারে? হে কৃষ্ণে! ক্ষমাতেই সত্য, ব্রহ্ম, যজ্ঞ ও লোকসমুদয় প্রতিষ্ঠিত আছে। জ্ঞানসম্পন্ন সৎপুরুষেরা সতত ক্ষমাপ্রদর্শন করেন বলিয়া তাহাদের শাশ্বত ব্ৰহ্মলোকপ্ৰাপ্তি হয়। ক্ষমাপর ব্যক্তিদিগের উভয় লোকই হস্তগত। তাহারা ইহকালে সম্মান ও পরকালে শ্রেয়সী গতি প্ৰাপ্ত হইয়া থাকেন। যাঁহাদিগের ক্ৰোধ ক্ষমাপ্রভাবে পরাহত হয়, তাহাদিগের পরমপবিত্ৰ লোকলাভ হইয়া থাকে, সুতরাং ক্ষমাই শ্রেষ্ঠ পদার্থ। হে দ্ৰৌপদি! মহর্ষিকাশ্যপ ক্ষমাশীল ব্যক্তিদিগের উদ্দেশে সতত এই গাঁথা গান করিয়া থাকেন। এক্ষণে তুমি ক্ষমা বিষয়ক গাঁথা শ্রবণ করিয়া ক্ৰোধসংবরণপূর্ব্বক সন্তোষ অবলম্বন কর। পিতামহ ভীষ্ম ও দেবকীনন্দন কৃষ্ণ ইহারা শান্তিকে পূজ্য বলিয়া স্বীকার করেন। আচাৰ্য্য কৃপ, বিদুর, সঞ্জয়, সোমদত্ত, যুযুৎসু, দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা, আমাদিগের পিতামহ ব্যাস। ইহারাও প্রতিনিয়ত শান্তির কথা উত্থাপন করিয়া প্ৰশংসা করেন; এক্ষণে আমার বোধ হইতেছে, এই সকল ব্যক্তিদ্বারা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বা তাহার পুত্র শান্তিপথে প্রেরিত হইলে আমাদিগকে রাজ্য প্ৰদান করিতে পারেন; কিন্তু লোভপরতন্ত্র হইলে অবশ্যই বিনাশ ঘটিবে, সন্দেহ নাই। হে দ্ৰৌপদি! ভারতবংশীয়দিগের বিনাশের নিমিত্ত এই নিদারুণ কাল উপস্থিত হইয়াছে; বলিতে কি, আমি পূর্ব্বেই ইহা অবধারিত করিয়া রাখিয়াছি। দুৰ্য্যোধন রাজকাৰ্য্যে নিতান্ত অযোগ্য, এই নিমিত্ত সে কদাচ ক্ষমাবলম্বন করিবে না, কিন্তু আমি তাহাদিগের মধ্যে যোগ্যপাত্ৰ, এই জন্য ক্ষমা আমাকেই আশ্রয় করিয়াছে। ক্ষমা ও অনুশংসতা মহাত্মাদিগের চরিত্রস্বরূপ ও সনাতন ধর্ম্ম; অতএব আমি এক্ষণে প্রকৃতরূপে ক্ষমা অবলম্বন করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।”