২৮তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠির-শোকাপনোদনে অশ্মা ও জনসংবাদ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহর্ষি বেদব্যাস জ্ঞাতিগণের বধজনিত অত্যন্ত সন্তাপবশতঃ প্রাণত্যাগে সমুৎসুক জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবাত্মজ যুধিষ্ঠিরের শোকাপনোদন করিতে লাগিলেন। ব্যাস বলিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ। এই বিষয়ে অশ্মা নামে এক মহাত্মা ব্রাহ্মণ যাহা কহিয়া গিয়াছেন, সেই পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা বিদেহদেশাধিপতি জনক দুঃখ শোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়া স্বীয় সংশয়চ্ছেদনের নিমিত্ত মহাত্মা অশ্মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্ৰহ্মণ! জ্ঞাতি ও সম্পত্তির বৃদ্ধি ও বিনাশসময়ে লোকে কিরূপ অবস্থায় অবস্থান করিলে কল্যাণভাজন হইতে পারে?’
“তখন মহামতি অশ্ম জনকের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘রাজন্! মনুষ্যের জন্ম হইবামাত্র সুখ ও দুঃখ তাহার আত্মাকে আশ্রয় করে। ঐ উভয়ের মধ্যে অন্যতরের প্রাদুর্ভাব হইলেই মনুষ্যের চৈতন্য বায়ু-সঞ্চালিত মেষমণ্ডলের ন্যায় অন্তর্হিত হয়, জন্মের পর মনুষ্যের মনে ক্রমে ক্রমে ‘আমি কেবল মানুষ নহি, একজন সদ্বংশজাত কৃত্তী পুরুষ” বলিয়া অহঙ্কার জন্মে। সেই অহঙ্কার প্রভাবে সে বিবিধ ভোগে আসক্ত হইয়া পিতৃসঞ্চিত সমুদয় অর্থ নৃত্যগীতাদিতে ব্যয় করিয়া পরিশেষে চৌর্য্যবৃত্তিই হিতকর বলিয়া অবলম্বন করে। তখন ব্যাধ যেমন শরসংযোগদ্বারা মৃগের প্রাণসংহার করে, তদ্রূপ নরপতি সেই উন্মার্গপ্রস্থিত [বিপরীত-পথাবলম্বী-উচ্ছৃঙ্খল] ব্যক্তির বধসাধন করিয়া থাকেন। যে সকল ব্যক্তি বিংশতি বা ত্রিংশদ্বর্ষ বয়ঃক্রমকালে তস্করবৃত্তি [চৌর্য্য] অবলম্বন করে, তাহাদিগের প্রায়ই শত বৎসর পর্য্যন্ত জীবিত থাকিতে দেখা যায় না। লোকে দারিদ্র্যদোষে এইরূপে অপার দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়। অতএব জীবগণের ব্যবহার পর্য্যবেক্ষণ করিয়া বুদ্ধিপূৰ্ব্বক সেই সকল দুঃখের প্রতিকার করা অবশ্য কর্ত্তব্য। বুদ্ধিবিপর্য্যয়[বুদ্ধিভ্রংশ] ও অনিষ্টপাত এই দুইটি মানসিক দুঃখের মূল কারণ। এই ভূমণ্ডলে দুই কারণেই বিবিধ প্রকার দুঃখ মানবগণের অনুসরণ করিয়া থাকে। জরা ও মৃত্যু বৃকের ন্যায় মনুষ্যগণের প্রাণ সংহার করিয়া থাকে। কি বলবান, কি দুর্ব্বল, কি খৰ্ব্ব, কি দীর্ঘ, কাহারই, জরামৃত্যু অতিক্রম করিবার ক্ষমতা নাই। যিনি এই সসাগরা বসুন্ধরা জয় করেন, তাঁহাকেও জরামৃত্যুর বশীভূত হইতে হয়। মানবজাতির সুখ বা দুঃখ যাহাই কেন উপস্থিত হউক না, অনাকুলচিত্তে তাহা সহ্য করা কর্ত্তব্য। সুখ ও দুঃখ পরিহার করিবার উপায় নাই। কি বাল্যাবস্থা, কি প্রৌঢ়াবস্থা, কি বৃদ্ধাবস্থা, কোন অবস্থাতেই লোকে জরামৃত্যুর হস্ত হইতে পরিত্রাণলাভে সমর্থ হয় না। অপ্রিয়সমাগম, প্রিয়বিচ্ছেদ, অর্থ, অনর্থ, সুখ, দুঃখ, উন্নতি, ক্ষয়, লাভ ও বৃথা পরিশ্রম সমুদয়ই অদৃষ্টসাপেক্ষ। যেমন কোনরূপ রস, গন্ধ ও স্পর্শ স্বভাবতঃই জন্মিয়া থাকে, সুখ-দুঃখ তদ্রূপ স্বভাবতঃই জীবনের অনুসরণ করে। জীবমাত্রকেই নিয়মিত সময়ে শয়ন, উপবেশন, গমন ও অন্নাদি ভোজন করিতে হয়। এই জগতে কালপ্রভাবে বৈদ্যও আতুর, বলবানও দুর্বল এবং সুন্দর পুরুষও নিতান্ত কদাকার হইয়া যায়। লোকে অদৃষ্টক্রমেই সত্বংশে জন্মগ্রহণ করে এবং বলবান, রূপবান, সুস্থশরীর, সৌভাগ্যসম্পন্ন ও ভোগী হয়। বিধির কি বিচিত্র মহিমা! দরিদ্র ব্যক্তিরা ইচ্ছা না। করিলেও তাহাদিগের অনেক সন্তান-সন্ততি হয়, আর মহাসমৃদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা কামনা করিলেও পুত্ৰমুখ নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয় না। ব্যাধি, অগ্নি, জল, অস্ত্র, বুভুক্ষা[ক্ষুধা], বিষপান, উদ্বন্ধন[আত্মহত্যা] বা অধস্খলন[অধঃপতন] ইহার মধ্যে যাহার অদৃষ্টে যাহাতে মৃত্যু নিরূপিত হইয়াছে, সে তাহাতেই কলেবর পরিত্যাগ করে। নির্দিষ্ট নিয়ম উল্লঙ্ঘন করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। ইহলোকে যাহারা সৎকুলসম্ভূত ও বিপুল বিভবশালী, তাহারা যৌবনাবস্থাতেই পতঙ্গের ন্যায় কলেবর পরিত্যাগ করে; আর যাহারা দরিদ্র, তাহারা জরাজীর্ণ হইয়া বহুকষ্টে দীর্ঘকাল জীবিত থাকে। প্রায়ই ধনবান ব্যক্তিদিগের ভোজনশক্তি থাকে না, আর দরিদ্র ব্যক্তিরা কাষ্ঠ পৰ্য্যন্ত জীর্ণ করিতে পারে। দুরাত্মারা কালের বশবর্ত্তী হইয়া অসন্তোষ নিবন্ধন পাপকাৰ্য্যে রত হয়। বিদ্বান ব্যক্তিদিগকেও অনেকবার সজ্জননিন্দিত মৃগয়া, পাশক্রীড়া, পরস্ত্রীসমাগম, মদ্যপান ও কলহে আসক্ত হইতে দেখা যায়। হে মহারাজ! এইরূপে কালপ্রভাবে ইষ্ট ও অনিষ্ট বিষয়-সকল জীবকে আক্রমণ করিয়া থাকে। অদৃষ্ট ভিন্ন উহার আর কিছুমাত্র কারণ লক্ষিত হয় না। যিনি বায়ু, আকাশ, অগ্নি, চন্দ্র, সূৰ্য্য, দিবা, রাত্রি, নক্ষত্র, নদী ও পৰ্ব্বতের সৃষ্টি করিয়াছেন এবং পালন করিতেছেন, তিনিই মনুষ্যের অন্তঃকরণে সুখ-দুঃখ প্রদান করিয়াছেন। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা প্রভৃতি ঋতু-সমুদয়ের ন্যায় মনুষ্যের সুখ-দুঃখ কালসহকারে পরিবর্ত্তিত হয়।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! ঔষধ, হোম, মন্ত্র ও জপ-প্রভাবে মনুষ্যকে জরা ও মৃত্যু হইতে পরিত্রাণ করা যায় না। সমুদ্রে যেমন কাষ্ঠে কাষ্ঠে সংযোগ ও বিয়োগ হয়, তদ্রূপ এই ভূমণ্ডলে প্রাণীসমুদয় একবার সংযুক্ত ও পুনরায় বিযোজিত হইতেছে। যে সকল মনুষ্য সতত গীতবাদ্য শ্রবণ ও মহিলাগণের সহিত বিহার করিয়া থাকে, আর যাহারা অনাথ হইয়া পরান্নভোজন করে, কৃতান্ত তাহাদের সকলের প্রতিই তুল্যরূপ ব্যবহার করিয়া থাকেন। এই সংসারে অনেকেরই মাতা, পিতা, পুত্র ও কলত্র আছে; কিন্তু বস্তুতঃ কেহই কাহার নহে। জীবের লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে আর কাহারও সহিত কোন সম্পর্ক থাকিবে না। বন্ধুবান্ধবসমাগম পান্থসমাগমের ন্যায় অচিরস্থায়ী। আমি কে? কোন্ স্থানে অবস্থান করিতেছি? কোথায় বা গমন করিব? আমি এই স্থানে কি জন্য বিদ্যমান আছি? আমি কি নিমিত্ত অনুতাপ করিতেছি? মনোমধ্যে এইরূপ চিন্তা করিয়া মনকে সুস্থির করিবে। ফলতঃ এই সংসার চক্রের ন্যায় নিরন্তর পরিভ্রমণ করিতেছে; ইহাতে কিছুরই স্থিরতা নাই।
“পরলোক কেহ কখন নিরীক্ষণ করে নাই; কিন্তু শাস্ত্রযুক্তি অনুসারে মঙ্গলার্থী ব্যক্তির পরলোকের অস্তিত্ববিষয়ে শ্রদ্ধা করা এবং তন্নিবন্ধন পিতৃলোকের শ্রাদ্ধ তর্পণ, যাজ্যজ্ঞাদি বিবিধ কার্য্যের অনুষ্ঠান ও পর্য্যায়ক্রমে ত্রিবর্গের অনুশীলন করা কর্ত্তব্য। এই জগৎ যে জরামৃত্যুরূপ গ্রাহসম্পন্ন কালরূপ অতি গভীর সাগরে নিমগ্ন হইতেছে, তাহা কেহই হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হয় না। আয়ুৰ্ব্বেদবিশারদ অনেকানেক বৈদ্য ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হইয়া নিরন্তর কষায়রস পান ও ঘৃত ভোজন করিতেছে, কিন্তু মহাসাগর যেমন বেলাকে অতিক্রম করিতে পারে না, তদ্রূপ তাহারা কখনই মৃত্যুকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইবে না। অনেক রসায়নবিদ্যাপারদর্শী মনুষ্য জরাব্যাধিনাশক ঔষধ সেবন করিয়াও মহাগজবিদলিত বৃক্ষের ন্যায় জরাপ্রভাবে জীর্ণশীর্ণ হইতেছেন। তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন, অতিবদান্য, যজ্ঞশীল ব্যক্তিরাও জরা-মৃত্যু অতিক্রম করিতে সমর্থ নহেন। যে বৎসর, যে মাস, যে পক্ষ, যে দিবস ও যে রাত্রি একবার অতিক্রান্ত হয়, তাহা আর পুনরায় আগমন করে না। হে মহারাজ! অবশ্য মনুষ্য কালপ্রভাবে সর্ব্বসাধারণ সংসারমার্গ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। কেহ কেহ বলেন, জীব হইতে দেহের উৎপত্তি এবং কেহ কেহ বলেন, দেহ হইতে জীবের উৎপত্তি হইয়া থাকে। সে যাহা হউক, এই জীবলোকে পুত্ৰকল-সমাগম যে পান্থসমাগমের ন্যায় অচিরস্থায়ী, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। অন্যের কথা দূরে থাকুক, স্বীয় শরীরের সহিতও লোকের চিরকাল সহবাস হয় না। হে মহারাজ! এখন তোমার পিতা ও পূৰ্ব্বপিতামহগণ কোথায়? আজ তুমিও তাঁহাদিগের সন্দর্শন লাভ করিতেছ না; তাঁহারাও তোমাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইতেছেন না। মনুষ্য ইহলোকে অবস্থানপূৰ্ব্বক স্বর্গ ও নরক দেখিতে পায় না; শাস্ত্রই সাধুগণের চক্ষু; তাঁহারা শাস্ত্রপ্রভাবেই সমুদয় অবগত হইয়া থাকেন। অতএব তুমি সেই শাস্ত্রেরই অনুশীলন কর। পিতৃলোক, দেবলোক ও মর্ত্যলোকের ঋণ হইতে বিমুক্ত হইবার নিমিত্ত মনুষ্যের ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন, পুত্রোৎপাদন ও যজ্ঞানুষ্ঠান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। অতএব লোকে হৃদয়দুঃখ অপনীত করিয়া পবিত্রদৃষ্টি হইয়া ঐ সমস্ত কার্য্যানুষ্ঠানপূর্ব্বক উভয়লোকে সুখী হইবে। যে রাজা রাগদ্বেষবিবর্জ্জিত হইয়া ধৰ্ম্মানুষ্ঠান ও ন্যায়ানুসারে দ্রব্যজাত আহরণ করেন, সমুদয় লোকে তাঁহার যশোরাশি পরিবর্দ্ধিত হয়।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! বিদর্ভরাজ জনক অশ্মার মুখে এইরূপ যুক্তিপরিপূর্ণ বাক্য শ্রবণ করিয়া শোকতাপ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক তাঁহার অনুমতি লইয়া গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। অতএব এক্ষণে তুমিও শোকসন্তাপ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রফুল্লচিত্ত হও। তুমি ক্ষাত্ৰধৰ্ম্মানুসারে পৃথিবী অধিকার করিয়াছ, স্বচ্ছন্দে উহা উপভোগ কর; কদাচ ইহাতে অনাদর প্রদর্শন করিও না।”