২৮তম অধ্যায়
বলি-প্রহ্লাদ উপাখ্যান
দ্রৌপদী কহিলেন, “এই স্থলে পৌরাণিকেরা বলি-প্ৰহ্লাদসংবাদনামক এক প্রাচীন ইতিহাস কীর্ত্তন করিয়া থাকেন, এক্ষণে তাহা বৰ্ণনা করি, শ্রবণ করুন। একদা দানবরাজ বলি ধর্ম্মজ্ঞ স্বীয় পিতামহ প্ৰহ্লাদকে জিজ্ঞাসিলেন, “হে তাত! ক্ষমা ও তেজ এই উভয়ের মধ্যে কোনটি শ্রেয়স্কর? এ বিষয়ে আমার সাতিশয় সংশয় জন্মিয়াছে, আপনি অনুকম্পা-প্রদর্শনপূর্ব্বক আদ্যোপান্ত সমস্ত কীর্ত্তন করুন। আপনি এ বিষয়ে যাহা শ্রেয়স্কর বিবেচনা করিয়া আদেশ করিবেন, আমি মহাশয়ের নির্দেশানুসারে অসন্দিগ্ধচিত্তে তাহারই সম্যক অনুষ্ঠান করিব।” সর্ব্বজ্ঞ পিতামহ প্ৰহ্লাদ বলিকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “হে বৎস! নিরবিচ্ছিন্ন তেজ আশ্রয় করিলে কদাচ শ্রেয়োলাভ হইতে পারে না এবং একমাত্র ক্ষমা অবলম্বনেও শুভলাভের ব্যতিক্রম ঘটিয়া থাকে। যে ব্যক্তি প্ৰতিনিয়ত কেবল ক্ষমা আশ্রয় করিয়া কালব্যাপন করে, সে বহুবিধ দোষের আকর হইয়া উঠে, ভৃত্য, উদাসীন ও শত্ৰুগণ তাহাকে অনায়াসেই পরাভব করিয়া থাকে; কোন ব্যক্তিই তাহার বশীভূত হয় না; সেই নিমিত্ত সুবিজ্ঞ পণ্ডিতেরা নিরন্তর ক্ষমা অবলম্বন করা অতি বিগর্হিত কর্ম্ম বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। ভূত্যেরা ক্ষমাশীল প্রভুকে অনাদর করিয়া বহুবিধ দোষজনক কর্ম্ম করিয়া থাকে। ক্ষুদ্রাশয় লোকেরা সতত তাঁহার অর্থ অপহরণ করিবার অভিলাষ করে। হীনমতি অধিকৃত পুরুষেরা ক্ষমাপর প্রভুর যান, বস্ত্ৰ, অলঙ্কার, শয়ন, আসন, ভোজন, পান ও অন্যান্য উপকরণদ্রব্য-সকল স্বেচ্ছানুসারে গ্রহণ করে। তাহারা স্বামীর আদেশলাভ করিয়াও আদিষ্ট দেয়দ্রব্যাজাত অন্যকে প্রদান করিতে পরাঙ্মুখ হয়। তাহারা তাঁহাকে সমুচিত উপচারদ্বারা কদাচ অর্চনা করে না। হে বৎস! লোকে যে অবজ্ঞাকে মরণ অপেক্ষাও গৰ্হিত বিবেচনা করিয়া থাকে, ক্ষমাপর প্রভুকে সেই অবজ্ঞার ভাজন হইতে হয়। প্ৰেষ্য, পুত্র, ভৃত্য ও উদাসীন সকলেই ঈদৃশ ক্ষমাশীল স্বামীকে কটুবাক্য প্রয়োগ করে। তাঁহাকে পরাভব করিয়া সকলেই তদয়ি ভার্য্যাকে গ্রহণ করিতে অভিলাষ করিয়া থাকে ও তাঁহার ভাৰ্য্যাও স্বেচ্ছাচারিণী হয়। যদি ক্ষমাপর প্রভু দুষ্টস্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তিকে অল্প দণ্ডও না করেন, তাহা হইলে সে ক্রমশঃ অভ্যুদয়লাভ করিয়া বহুদিন দোষপ্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহারই অপকার করিতে চেষ্টা করে। অতএব হে বৈরোচনে! ক্ষমাশীল ব্যক্তির এই সকল ও অন্যান্য বহুবিধ দোষ দৃষ্ট হইতেছে।
“এক্ষণে ক্ষমাহীন ব্যক্তিদিগের দোষ কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। রজোগুণ-পরিবৃত ক্রোধী যদি নিরবচ্ছিন্ন স্বীয় তেজদ্বারা দণ্ডার্হ বা দণ্ডানর্হ উভয়বিধ ব্যক্তির প্রতি নানাপ্রকার দণ্ডবিধান করেন, তাহা হইলে তাহার বান্ধববর্গের সহিত বিরোধ হইয়া উঠে। তিনি ক্রমশঃ আত্মীয় ও অন্যান্য লোক হইতে বিরাগ সংগ্ৰহ করিতে থাকেন ও অনেকেরই অবমাননা করেন, সুতরাং তাঁহাকে অর্থহীন এবং তিরস্কার, অনাদর, সন্তাপ, দ্বেষ ও মোহের বিষয়ীভূত হইতে হয়, অধিকন্তু অনেকেই তাহার শত্ৰু-শ্রেণীতে পরিগণিত হইয়া উঠে। যিনি ক্রোধাভরে অন্যায়পূর্ব্বক মনুষ্যকে বহুবিধ দণ্ড প্ৰদান করেন, তিনি অচিরাৎ স্বজন, ধন ও প্রাণ হইতে পরিভ্রষ্ট হয়েন, সন্দেহ নাই। যিনি উপকর্ত্তা ও হন্তা উভয়ের প্রতি বিরবচ্ছিন্ন তেজই প্রকাশ করিয়া থাকেন, গৃহান্তর্গত ভুজঙ্গের ন্যায় তাঁহাকে দেখিয়া সকলেই ভীত হয়। যাঁহাকে সন্দর্শন করিয়া সকলেরই শঙ্কা উপস্থিত হয়, তাহার আর ঐশ্বৰ্য্যলাভের প্রত্যাশা করা কিরূপে সম্ভবে? সুযোগ পাইলেই লোকে তাঁহার অপকার করিতে ক্ৰটি করে না। অতএব একবারে তেজঃপ্রদর্শন করা অথবা একবারে মৃদুস্বভাব অবলম্বন করা উভয়ই একান্ত বিরুদ্ধ। হে বৎস! সময়ানুসারে তেজস্বিতা বা মৃদুভাব আশ্রয় করিবে। যিনি যথাযোগ্য কালে মৃদুভাবাবলম্বী বা রোষপরবশ হয়েন, তিনিই ইহকাল ও পরকালে অশেষ সুখসম্ভোগ করিয়া থাকেন।
“পণ্ডিতেরা যাহা অপরিত্যাজ্য ও অনুল্লঙ্ঘনীয় বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন, এক্ষণে সবিস্তার সেই সমস্ত ক্ষমার অবসর কহিতেছি, শ্রবণ করা। হে বৎস! পূর্ব্বে যে ব্যক্তি তোমার বহুবিধ উপকারসাধন করিয়া পরে কোন গুরুতর অপরাধে পতিত হয়, তাহার উপকার করিয়া সেই অপরাধ মার্জ্জনা করা উচিত। যে ব্যক্তি অজ্ঞানবশতঃ অন্যের নিকটে অপরাধী হয়, তাহাকে ক্ষমা করা বিধেয়; কারণ, সকলে শ্রেয়স্করী বুদ্ধিলাভ করিতে পারে না। কিন্তু যাহারা বুদ্ধিপূর্ব্বক অপরাধ করিয়া তাহার অপলাপে প্ৰবৃত্ত হয়, অপকার অল্প হইলেও সেই সকল পাপাত্মা কুটিল লোকদিগকে সংহার করিবে। প্রথমাপরাধে সকল প্ৰাণীকেই ক্ষমা করা কর্ত্তব্য; কিন্তু দ্বিতীয়পরাধ অণুমাত্ৰ হইলেও অপরাধীকে বধ্য বলিয়া স্থির করিবে; যদি কেহ অজ্ঞতাবশতঃ কোন প্রকার অপরাধ করে, তাহা হইলে উত্তমরূপ পরীক্ষা করিয়া তাহাকে ক্ষমা করা বিধেয়। সামরূপ উপায় দ্বারা কি উগ্ৰস্বভাব, মৃদুস্বভাবসম্পন্ন সকলকেই সংহার করা যায়। জগতীতলে সামের অসাধ্য কিছুই নাই, অতএব সামই বলীয়ান উপায়। তথাপি দেশ, কাল ও স্বীয় বলাবল বিবেচনা করিয়া লোকযাত্ৰা নির্ব্বাহ করিবে। কারণ, দেশকাল ভিন্ন অন্য পদার্থে এ বিষয়ের ফলোপযোগিতা কিছুমাত্ৰ নাই, অতএব দেশকালের প্রতীক্ষা করা সর্ব্বতোভাবেই বিধেয়। এইরূপ লোকভয়েরও অপেক্ষা করিয়া অপরাধীকে ক্ষমা করিবে। হে বৎস! ক্ষমার এই সমস্ত অবসর নির্দ্দিষ্ট রহিয়াছে; ইহার বিপরীত হইলেই তেজঃপ্রকাশের অবসর বিবেচনা করিবো।” ”
“দ্রৌপদী। এইরূপে উল্লিখিত উপাখ্যান সমাপন করিয়া যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হে মহারাজ! আমার বোধ হয়, আপনার তেজঃপ্রকাশেরই সময় সমুপস্থিত হইয়াছে। ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা নিয়তই অর্ধগৃধু হইয়া আপনাদিগের নানাপ্রকার অপকার করিয়া আসিতেছে; সুতরাং তাহাদিগকে ক্ষমা করা কোনক্রমেই বিধেয় নহে। এক্ষণে তেজের সময় উপস্থিত, তেজঃপ্রকাশ করাই কর্ত্তব্য। মৃদু হইলে লোকে অবজ্ঞা করে ও উগ্ৰস্বভাবসম্পন্ন হইলে তাহাকে দেখিয়া সকলেই শঙ্কিত হয়, অতএব সময়ানুসারে যিনি মৃদুতা বা উগ্রতা প্রকাশ করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ প্রকৃতিরঞ্জন মহীপতি, তাহাতে সন্দেহ নাই।”