অষ্টাবিংশ অধ্যায়
অমৃত আহরণে গরুড়ের যাত্রা
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, গরুড় এইরূপ অভিহিত হইয়া মাতার নিকট যাইয়া কহিলেন, “জননি! আমি অমৃত আহরণ করিতে চলিলাম; পথে কি আহার করিব, বলিয়া দাও।” বিনতা বলিলেন, “বৎস! সমুদ্রমধ্যে বহুসহস্র নিষাদ বাস করে, তুমি তাহাদিগকে ভোজন করিয়া অমৃত আনয়ন কর; কিন্তু হে বৎস! দেখিও, যেন ব্রাহ্মণবধে কদাচ তোমার বুদ্ধি না জন্মে। অনলসমান ব্রাহ্মণগণ সর্ব্বজীবের অবধ্য। ব্রাহ্মণ কুপিত হইলে অগ্নি, সূর্য্য, বিষ ও শস্ত্রতুল্য হয়েন। ব্রাহ্মণ সর্ব্বজীবের গুরু; এই নিমিত্ত ব্রাহ্মণ সর্ব্বভূতের আদরণীয়। অতএব হে বৎস! তুমি অতিশয় কুপিত হইয়াও যেন কোনক্রমে ব্রাহ্মণের হিংসা বা তাঁহাদিগের সহিত বিদ্রোহাচরণ করিও না। নিত্যনৈমিত্তিক জপহোমাদি ক্রিয়াকলাপে নিয়ত, বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হইলে যেরূপ দগ্ধ করিতে পারেন, কি অগ্নি কি সূর্য্য, কেহই সেরূপ পারেন না। ব্রাহ্মণ সর্ব্বজীবের অগ্রজাত, সর্ব্ববর্ণের শ্রেষ্ঠ এবং সর্ব্বভূতের পিতা ও গুরু।”
গরুড় মাতৃসন্নিধানে ব্রাহ্মণের এইরূপ অভাবনীয় প্রভাব অবগত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাতা! ব্রাহ্মণের কীদৃশ আকার, কি প্রকার স্বভাব ও কিরূপই বা পরাক্রম? ব্রাহ্মণ কি হুতাশনের ন্যায় সর্ব্বদা প্রদীপ্ত কিংবা অতিশয় সৌম্যমূর্ত্তি? যে-সকল শুভলক্ষণ দ্বারা ব্রাহ্মণকে চিনিতে পারা যায়, তুমি হেতুনির্দ্দেশপূর্ব্বক তাহা আমাকে বিশেষরূপে কহিয়া দাও।” বিনতা কহিলেন, “যিনি তোমার জঠরদেশে প্রবেশ করিলে বড়িশের ন্যায় নিতান্ত দুঃসহ ক্লেশদায়ক হইবেন এবং প্রজ্বলিত অঙ্গারের ন্যায় কণ্ঠদাহ করিবেন, তিনিই সুব্রাহ্মণ। তুমি অতিমাত্র ক্রুদ্ধ হইয়াও ব্রাহ্মণকে বধ করিতে প্রবৃত্ত হইও না।” বিনতা পুৎত্রবাৎসল্য প্রযুক্ত গরুড়কে পুনর্ব্বার কহিলেন, “বৎস! যিনি তোমার জঠরদেশে জীর্ণ হইবেন না, তাহাকেই সুব্রাহ্মণ বলিয়া জানিবে।” সর্পবঞ্চিতা পরমদুঃখিতা বিনতা পুৎত্রের অতুল পরাক্রম বুঝিতে পারিয়াও অতি প্রীতমনে তাঁহাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন, “বৎস! বায়ু তোমার দুই পক্ষ রক্ষা করুন, চন্দ্র ও সূর্য্য তোমার পৃষ্ঠ, অগ্নি মস্তক এবং বসুগণ ত্বদীয় সর্ব্বাঙ্গ সর্ব্বদা নির্ব্বিঘ্নে রাখুন। হে পুৎত্র! আমিও তোমার স্বস্তি-শান্তি-বিষয়ে তৎপর হইয়া নিরন্তর ত্বদীয় শুভানুধ্যানে এই স্থানেই রহিলাম। তুমি কার্য্যসিদ্ধির নিমিত্ত নিরাপদে প্রস্থান কর।”
গরুড় মাতৃবাক্য-শ্রবণানন্তর পক্ষদ্বয় বিস্তারপূর্ব্বক গগনমার্গে উড্ডীন হইয়া বুভুক্ষা [ক্ষুধা] প্রযুক্ত সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় নিষাদ-পল্লীতে উপনীত হইলেন এবং নিষাদ-সংহারের নিমিত্ত ধূলিরাশি দ্বারা নভোমণ্ডল আচ্ছন্ন ও সমুদ্রের জল শোষণ করিয়া সমীপস্থ সমস্ত মহীধরগণকে বিচালিত করিতে লাগিলেন। পরিশেষে বিহঙ্গরাজ প্রকাণ্ড মুখব্যাদানপূর্ব্বক নিষাদনগরীর পথ রুদ্ধ করিয়া বসিলেন। বিষাদসাগরে নিমগ্ন নিষাদগণ প্রবলবাত্যাহত ধূলিপটলে অন্ধপ্রায় হইয়া ভুজঙ্গভোজী গরুড়ের অতি-বিস্তীর্ণ আননাভিমুখে ধাবমান হইল। যেমন প্রবল বায়ুবেগে সমস্ত বন ঘূর্ণিত হইলে পক্ষিগণ আকাশমার্গে উঠে, সেইরূপ নিষাদেরাও গরুড়ের অতি বিশাল মুখবিবরে প্রবিষ্ট হইল। পরিশেষে ক্ষুধার্ত্ত বিহঙ্গরাজ মুখ মুদ্রিত করিয়া বহুসংখ্যক নিষাদ ভক্ষণ করিলেন।