সৌতি বলে, অপূর্ব্ব শুনহ মুনিগণ।
কহিব বিচিত্র কথা পুরাণ-বচন।।
অবন্তীনগরে দ্বিজ নাম শান্তিপন।
তাঁর স্থানে শিষ্যগণ করে অধ্যয়ন।।
এক শিষ্যে দ্বিজ গাভী কৈল সমর্পণ।
গুরু-আজ্ঞা পেয়ে তারে করেন রক্ষণ।।
কতদিনে বলে গুরু, কহ শিষ্যবর।
বড় পুষ্ট দেখি যে তোমার কলেবর।।
কিবা খাও কোথা পাও কহ সত্যবাণী।
শুনিয়া বলেন শিষ্য করি যোড়পাণি।।
গাভী দোহনান্তে যবে পিয়ে বৎসগণ।
পশ্চাতে খাই যে আমি করিয়া দোহন।।
গুরু বলে, এতদিনে সব জানা গেল।
এই হেতু বৎসগণ দুর্ব্বল হইল।।
আর কভু তুমি না করিহ হেন কাজ।
গাভী দুহি খাও তুমি নাহি ভয় লাজ।।
গুরু-আজ্ঞা শুনি দ্বিজ গেল গাভী লৈয়া।
কতদিনে পুনঃ বিপ্র কহিল ডাকিয়া।।
উচিত কহিলে শিষ্য না হইও রুষ্ট।
পুনশ্চ তোমারে বড় দেখি হৃষ্টপুষ্ট।।
গাভী-দুগ্ধ পুনঃ বুঝি তুমি কর পান।
শিষ্য বলে, গোসাঞি করহ অবধান।।
যেই দিন হৈতে তুমি করিলা বারণ।
ভিক্ষা করি নিত্য করি উদর পূরণ।।
গুরু বলে, ভিক্ষা করি পূরহ উদরে।
এবে ভিক্ষা করি সব আনি দিও মোরে।।
এত শুনি গাভী লৈয়া গেল শিষ্যবর।
পুনঃ জিজ্ঞাসিল কত দিবস অন্তর।।
কহ শিষ্য, বড় পুষ্ট দেখি তব কায়।
কি খাইয়া আছ তুমি বলহ আমায়।।
শিষ্য বলে, গাভী রাখি অরণ্য-ভিতর।
রক্ষক রাখিয়া আমি যাই যে নগর।।
দিবসেত যত ভিক্ষা, দিই তব ঘরে।
সন্ধ্যাতে মাগিয়া ভিক্ষা ভরি যে উদরে।।
হাসিয়া বলেন গরু, এ কোন্ বিচার।
শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা রাত্রে তুমি কর আপনার।।
রাত্রিদিবা যত পাও, আনি দিবে মোরে।
এত শুনি গাভী লৈয়া গেল বন ঘোরে।।
ক্ষুধায় আকুল তনু ভ্রমে বনে-বন।
অর্কের কোমল পত্র করয়ে ভক্ষণ।।
নয়ন হইল অন্ধ শীর্ণ হৈল কায়।
দেখিতে না পায়, তবু গোধন চরায়।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে দেখ দৈবের লিখন।
নিরুদক-কূপ-মধ্য পড়িল ব্রাহ্মণ।।
সমস্ত দিবস গেল, হৈল সন্ধ্যাকাল।
গৃহেতে আইল যত গোধনের পাল।।
শিষ্যে না দেখিয়া গুরু দুঃখিত অন্তর।
অন্বেষণে গেল দ্বিজ অরণ্য-ভিতর।।
কোথা গেলে উপমন্যু! ডাকে দ্বিজবর।
উপমন্যু বলে, চক্ষে না পাই দেখিতে।।
অর্কপত্র খাইয়া নয়ন অন্ধ হৈল।
শুনিয়া আশ্চর্য্য তবে উপদেশ কৈল।।
দেব-বৈদ্য অশ্বিনীকুমার দুইজন।
শীঘ্র কর দ্বিজবর তাঁদের স্মরণ।।
এত শুনি দ্বিজ বহু স্তবন করিল।
ততক্ষণে দুই চক্ষু নির্ম্মল হইল।।
কূপ হৈতে উঠিয়া ধরিলা গুরুপাদ।
সন্তুষ্ট হইয়া গুরু কৈল আশীর্ব্বাদ।।
চারি বেদ, ষাট্ শাস্ত্র, জানহ সকলে।
যাহ দ্বিজ নিজ গৃহে পরম কুশলে।।
আজ্ঞা পেয়ে গেল দ্বিজ আহ্লাদিত মনে।
সর্ব্বশাস্ত্রে জ্ঞান হৈল গুরুর বচনে।।
আরুণি-নামেতে শিষ্য ছিল অন্য জন।
ডাকি তারে গুরু আজ্ঞা কৈল ততক্ষণ।।
ধান্য-ক্ষেত্রে জল সব যাইছে বহিয়া।
যত্ন করি আলি বাঁধি জল রাখ গিয়া।।
আজ্ঞামাত্র আরুণি যে করিল গমন।
আলি বাঁধিবারে বহু করিল যতন।।
দন্তেতে খুঁড়িয়া মাটি বাঁধালেতে ফেলে।
রাখিতে না পারে মাটি, অতি বেগ জলে।।
পুনঃ পুনঃ শিষ্যবর করিল যতন।
না পারিল ক্ষেত্রজল করিতে বন্ধন।।
জল বহি যায়, গুরু পাছে ক্রোধ করে।
আপনি শুইল শিষ্য বাঁধাল উপরে।।
সমস্ত দিবস গেল, হইল রজনী।
না আইল শিষ্য, গুরু চলিল আপনি।।
ক্ষেত্র মধ্যে গিয়া ডাক দিল দ্বিজবর।
শিষ্য বলে, শুয়ে আছি বাঁধের উপর।।
বহু যত্ন করিলাম, না রহে বন্ধন।
আপনি শুলাম বাঁধে তাহার কারণ।।
শুনিয়া বলিল গুরু, এস হে উঠিয়া।
শীঘ্র আসি গুরু পায় প্রণমিল গিয়া।।
শিষ্যেরে দেখিয়া গুরু আনন্দিত মন।
সঙ্গে করি নিজ গৃহে করিল গমন।।
আশিস্ করিয়া গুরু করিল কল্যাণ।
চারি বেদ, ষট্ শাস্ত্রে হৌক্ তব জ্ঞান।।
এত বলি বিদায় করিল দ্বিজবর।
প্রণাম করিয়া শিষ্য গেল নিজ ঘর।।
সুধার সমান মহাভারতের কথা।
যে জন শুনে তার নাশয়ে দুঃখ ব্যথা।।
আরুণি শিষ্যের সে অপূর্ব্ব উপাখ্যান।
কাশী কহে শুনিলে জন্ময়ে দিব্য জ্ঞান।।