২৬তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরাদির বকঋষির উপদেশলাভ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, পাণ্ডবগণ দ্বৈতবনে বাস করিলে সেই মহারণ্য ব্রাহ্মণগণে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। তাঁহাদের উচ্চারিত ব্ৰহ্মসঙ্গীতে ঐ কানন ব্ৰহ্মলোকের ন্যায় পবিত্ৰ হইয়া উঠিল। একদিকে শ্রুতিসুখাবহ মনোহর ব্রাহ্মণগণোচ্চারিত ঋকযজুঃসামধ্বনি, অন্যদিকে নরেন্দ্ৰনন্দনগণের শরাসনবিনিঃসৃত অতি ভীষণ জ্যানির্ঘোষ প্ৰতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ফলতঃ ক্ষত্ৰতেজ ব্ৰহ্মতেজের সহিত সংসৃষ্ট হইয়া এক অনির্ব্বচনীয় শোভা সম্পাদনা করিল।
একদা রাজা যুধিষ্ঠির ঋষিগণে পরিবৃত হইয়া সায়ন্তনবিধি [সায়ংকালের সন্ধ্যাবন্দনাদি]র অনুষ্ঠান করিতেছেন, এমন সময়ে দালভ্যবংশীয় বক-নামক মুনি তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে কৌন্তেয় দ্বৈতবনবাসী তপস্বীদিগের হোমবেলা সমুপস্থিত; দেখুন, হোমহুতাশন প্রজ্বলিত হইয়া উঠিতেছে; আপনার রক্ষিত ভৃণ্ড, অঙ্গিরাঃ, বশিষ্ঠ, কশ্যপ, অগস্ত্য ও অত্ৰিবংশীয় ব্রতধারী তপস্বিগণ এবং ব্রাহ্মণপুঙ্গবেরা আপনার সহিত মিলিত হইয়া এই পরমপবিত্র দ্বৈতবনে ধর্ম্মাচরণ করিতেছেন। এই অবসরে আমি আপনাদিগকে কিঞ্চিৎ সদুপদেশ প্রদান করি, শ্রবণ করুন। যেমন হুতাশন সমীরণসহকৃত হইয়া অরণ্যানী দগ্ধ করে, সেইরূপ ব্ৰহ্মতেজ ও ক্ষত্ৰতেজ পরস্পর মিলিত হইলে উগ্রতর হইয়া অরাতিগণকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলে। কেহই ব্ৰাহ্মণকে পরিত্যাগ করিয়া এই লোক বা পরলোক জয় করিতে পারে না; যিনি ধর্ম্মার্থবিষয়ে সুশিক্ষিত হইয়া মোহজাল ছেদন করিয়াছেন, রাজারা সেই দ্বিজকে লাভ করিয়াই সপত্নীগণের সংহারসাধন করেন। বলি রাজা প্ৰজা পালন নিবন্ধন মোক্ষধর্ম্ম আচরণ করিবার জন্য ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য তীর্থের সেবা করেন নাই। তাঁহার কামনা পরিপূর্ণ ও রাজলক্ষ্মী অক্ষয় হইয়াছে। তিনি ব্রাহ্মণপ্ৰসাদে সসাগরা ধরার একাধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু পরিশেষে তিনি ব্রাহ্মণগণের প্রতি সদোষব্যবহার করিয়াই একেবারে বিনষ্ট হইয়া গেলেন। ঐশ্বৰ্য্যশালিনী পৃথিবী দ্বিজসেবা-পরাঙ্মুখ ব্যক্তিকে ভজনা করে না; ব্রাহ্মণ যাঁহাকে নীতিশিক্ষায় সুশিক্ষিত করেন, সসাগরা পৃথিবী তাঁহারই নিকট নত হইয়া থাকে। অঙ্কুশাহত কুঞ্জর যেমন হীনবল হয়, সেইরূপ সংগ্রামসময়ে ব্রাহ্মণবিহীন ক্ষত্ৰিয়েরা ক্ষীণবল হইয়া থাকে। অনুপম ব্রাহ্মণের কৃপাবলোকন ও অপ্রতিম ক্ষাত্ৰবল একত্র মিলিত হইলে সংসারে সুখস্বচ্ছন্দতার বৃদ্ধি হয়। যেমন অনলরাশি অনিলসাহায্যে দাহ্য বস্তু দগ্ধ করে, সেইরূপ রাজমণ্ডল ব্রাহ্মণের সহিত মিলিত হইলে অরতিকুল নির্মূল করিয়া ফেলে। মেধাবী ব্যক্তি অলব্ধ বিষয়ের লাভ ও লব্ধ বিষয়ের পরিবদ্ধনজন্য ব্রাহ্মণগণের নিকট যথার্থ হিতকর ও জ্ঞানজনক উপদেশ গ্রহণ করিবে। অতএব আপনিও অপ্রাপ্তবিষয়ের প্রাপ্তি, প্রাপ্তবিষয়ের উন্নতি ও যথাযোগ্য-পাত্রে দানের নিমিত্ত যশস্বী, বেদবিৎ, শাস্ত্ৰজ্ঞ ব্রাহ্মণকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করুন। হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! আপনি সতত ব্ৰাহ্মণগণের প্রতি সদ্ব্যবহার করিয়া থাকেন, এই জন্য আপনার যশোরাশি সর্ব্বলোকে প্রথিত ও দীপ্যমান হইয়া রহিয়াছে।”
অনন্তর ব্রাহ্মণগণ দাল্ভ্যবংশীয় বকমুনিকে পূজা করিলেন এবং তিনি রাজা যুধিষ্ঠিরকে স্তব করিয়াছেন বলিয়া তাঁহারা সকলে অধিকতর প্রীতমনাঃ হইলেন। যেমন ঋষিগণ পুরন্দরের অৰ্চনা করেন, সেইরূপ দ্বৈপায়ন, নারদ, জামদগ্ন্য, পৃথুশ্রবাঃ, ইন্দ্ৰদ্যুম্ন, ভালুকি, কৃতিচেতাঃ, সহস্রপাদ, কৰ্ণশ্রবাঃ, মুঞ্জ লবণাশ্ব, কাশ্যপ, হারীত, স্থূলকৰ্ণ, অগ্নিবেশ্য, শৌনক, কৃতবাক, সুবাক, বৃহদশ্ব, বিভাবসু, ঊর্দ্ধরেতাঃ, বৃষামিত্র, সুহোত্র, হোত্রবাহন প্রভৃতি মুনিগণ ও অনেকানেক ব্রাতধারী ব্রাহ্মণগণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের যথাযোগ্য সৎকার করিলেন।