ত্যজিয়া কন্যার পাশ, মুনি গেল বনবাস,
পত্নীরে রাখিয়া একাকিনী।
অশ্রুজলপূর্ণ মুখে, করাঘাত হানে বুকে,
ভ্রাতৃস্থানে চলিল নাগিনী।।
ক্রন্দন-করয়ে স্বসা, মুখে না আইসে ভাষা,
দেখিয়া বাসুকি চমকিত।
আশ্বাসিয়া নাগরাজ, স্বসাকে জিজ্ঞাসে কাজ,
কান্দ কেন হইয়া দুঃখিত।।
ভ্রাতার বচন শুনি, কহে গদগদ বাণী,
আপনার যত বিবরণ।
অবধান কর ভাই, কিছু মোর দোষ নাই,
মুনিরাজ ছাড়ি গেল বন।।
নির্ঘাত সদৃশ বাণী, ভগিনীর বাক্য শুনি,
নাগরাজ বিষণ্ণ-বদন।
একেত মায়ের শাপে, সর্ব্বদা শরীর কাঁপে,
তাহে পুন হৈল দুর্ঘটন।।
বলে, ভগ্নীকহ মোরে, জিজ্ঞাসিতে লজ্জা করে,
উপায় করিয়া দিল ধাতা।।
মুনিবীর্য্যে গর্ভ তব, হবে পুত্র সমুদ্ভব,
নাগকুল করিবে যে ত্রাণ।
তাহার কারণে তোরে, চিরদিন রাখি ঘরে,
জরৎকারে করিলাম দান।।
না হইতে বংশধর, ত্যজিলেন মুনিবর,
মাতৃশাপে সদা চিন্তে মন।
হয়েছে কি গর্ভতোর, লজ্জা ত্যজি অগ্রে মোর,
কহ শুনি সত্য বিবরণ।।
জিজ্ঞাসিতে লজ্জা হয়, তবু না পুছিলে নয়,
বড় দায় আমা সবাকার।
সত্য করি কহ মোরে, কহিলে কি মুনিবরে,
যে কারণে বিবাহ তোমার।।
ভ্রাতার বচন শুনি, সলজ্জিতা সুবদনী,
কহিতে লাগিলা অধোমুখে।
যতেক কহিলে তুমি, সব তত্ত্ব জানি আমি,
বিচারিয়া কহিনু মুনিকে।।
মুনি যবে যায় ছাড়ি, চরণ-যুগলে পড়ি,
বংশ হেতু কৈনু নিবেদন।
সদয় হইয়া মুনি, অস্তি অস্তি বলে বাণী,
এই গর্ভে হইবে নন্দন।।
তোমার যতেক ভ্রাতৃ, আমার যতেক পিতৃ,
দুই কুল করিবে উদ্ধার।
এতেক বলিয়া মোরে, মুনি গেল দেশান্তরে,
নিবারিয়া ক্রন্দন আমার।।
ত্যজ ভাই মনস্তাপ, নিস্তারিতে মাতৃশাপ,
কভু নাহি মিথ্যা কহে মুনি।
জরৎকারী ইহা বলে, যেন সুধাবৃষ্টি হলে,
আনন্দেতে নাচে সব ফণী।।
উল্লসিত নাগরাজা, ভগিনীর করে পূজা,
নানা রত্নে করিল ভূষিত।
দিব্য বস্ত্র অলঙ্কার, বহু ভক্ষ্য উপহার,
সেবায় যতেক নিয়োজিত।।
তবে ভুজঙ্গম-পতি, পুছে জরৎকারী প্রতি,
কহ তুমি ইহার কারণ।
কহ সত্য জরৎকারী, কি দোষ তোমার হেরি,
মুনিরাজ ছাড়ি গেল বন।।
আমি তাঁরে ভাল জানি, বড় উগ্র সেই মুনি,
বিনা দোষে ত্যজিয়াছে তোমা।
তথাপি কি দেখি দোষ, করিলেক এত রোষ,
একা গৃহে ছাড়ি গেল রামা।।
জরৎকারী বলে ভাই, শুন তবে বলি তাই,
আজিকার দিন অবসানে।
শির দিয়া মোর উরে, নিদ্রা গেল মুনিবরে,
অস্ত গেল তপন গগনে।।
সন্ধ্যাভঙ্গ হয় মুনি, মনে আমি ভয় গণি,
জাগরণে পাছে ক্রোধ করে।
সন্ধ্যাহীন যেই দ্বিজ, মন্ত্রহীন যেন বীজ,
তে কারণে জাগালাম তাঁরে।।
জাগি রক্তমুখ কোপে, দেখিয়া হৃদয় কাঁপে,
বলে মোরে অবজ্ঞা করিলি।
আমি সন্ধ্যা না করিতে, সন্ধ্যা যাবে কোনমতে,
সন্ধ্যারে ডাকিল ইহা বলি।।
সন্ধ্যা মনে ভয় পাই, বলে আমি যাই নাই,
আছি যে তোমার উপরোধে।
সন্ধ্যার বচন শুনি, ত্যাগ করি গেল মুনি,
এইমত মম অপরাধে।।
মুনির বচন শুনি, বিস্ময় মানিল ফণী,
ভগিনীরে তোষে মৃদুভাষে।
ভাল হৈল গেল দ্বিজ, দুঃখ না ভাবিহ নিজ,
থাক গৃহে পরম সন্তোষে।।
সহস্রেক সহোদর, আর যত অনুচর,
সহস্রেক বধূর সহিত।
সেবিবে তোমার পায়, সর্ব্বদা ঈশ্বরী প্রায়,
মোর গৃহে থাক অচিন্তিত।।
এত বলি ফণিবর, ডাকি সব সহোদর,
নিয়োজিল তাহার সেবনে।
হেনমতে জরৎকারী, সর্ব্বদুঃক পরিহরি,
রহিলেন ভ্রাতার ভবনে।।
গর্ভ বাড়ে অহর্নিশি, শুক্লপক্ষে যেন শশী,
প্রসবিল সময় সংযোগে।
পরম সুন্দর কায়, শিশু পূর্ণশশী প্রায়,
দেখি আনন্দিত সব নাগে।।
রূপে গুণে অনুপাম, আস্তিক থুইল নাম,
গর্ভকালে কহি গেল পিতা।
শৈশব হইতে সুত, সকল গুণেতে যুত,
বেদ বিদ্যা ব্রতে পারগতা।।
আস্তিকের জন্মকথা, অপূর্ব্ব ভারত-গাথা,
শুনিলে অধর্ম্ম হয় নাশ।
কমলাকান্তের সুত, হেতু সুজনের প্রীত,
বিরচিল কাশীরাম দাস।।