২৫তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের সদুপদেশপূৰ্ণ সন্ধি স্বীকার
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি ত’ তোমার নিকট যুদ্ধাভিলাষ প্রকাশ করি নাই; তবে তুমি কি নিমিত্ত সংগ্রামবিষয়ে ভীত হইতেছ? হে বৎস! যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হওয়া অপেক্ষা উহাকে উপেক্ষা করাই শ্রেয়স্কর; অতএব যদি সহজে অর্থ সিদ্ধ হয়, তবে কোন্ ব্যক্তি সমরে প্রবৃত্ত হয়? দেখ, মনুষ্যের মনোরথসমুদয় যদি কর্ম্ম না করিয়াও সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে সে কখনই কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হয় না। যাহা হউক, আমার মতে যুদ্ধ না করিয়া যদি অতি অল্পমাত্র লাভ হয়, তাহাও শ্রেয়স্কর। কোন ব্যক্তি সহজে বা দৈবদুর্ব্বিপাকবশতঃ যুদ্ধাভিলাষ করিয়া থাকে? পাণ্ডুতনয়গণ সুখাভিলাষে ধর্ম্মানুগত লোকহিতকর অতি দুষ্কর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। হে সঞ্জয়! যাহার স্বীয় সুখসাধন ও দুঃখনিবারণ করাই একমাত্র উদ্দেশ্য, সে নিতান্ত ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র। বিষয়বাসনা কেবল স্বীয় পরিতাপের হেতু, যে ব্যক্তি উহা পরিত্যাগ করিতে পারে, সে দুঃখ হইতে বিমুক্ত হয়। যেমন অগ্নিতে ইন্ধন প্রদান করিলে তাহার তেজোবৃদ্ধি হয়, তদ্রূপ কাম্যবস্তুর উপভোগে কামের প্রাদুর্ভাবই হইয়া থাকে। দেখ, ধৃতরাষ্ট্র পুত্ৰশতসমভিব্যাহারে প্রভূত ঐশ্বৰ্য্যভোগ করিয়াও পরিতৃপ্ত হইতেছে না।
“ভাগ্যহীন ব্যক্তি কদাচ বিগ্রহের সমর্থ হয় না এবং গীত শ্রবণ বা মাল্য, গন্ধ ও অনুলেপন প্রভৃতি সামগ্ৰী উপভোগ কিংবা উত্তমোত্তম বসন পরিধান করিতে বঞ্চিত হইয়া থাকে। আমরা নিতান্ত হতভাগ্য, নচেৎ কি নিমিত্ত কুরুদেশ হইতে দূরীকৃত হইব? অজ্ঞ ব্যক্তির অভিলাষ প্রায়ই তাহার হৃদয় ও দেহ দাহ করে। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র স্বয়ং অসমর্থ হইয়া যে পরের সামর্থে নির্ভর করেন, ইহা নিতান্ত অযৌক্তিক; কারণ, তিনি স্বয়ং যেরূপ অক্ষম, পরকেও তদ্রুপ জ্ঞান করা কর্ত্তব্য। যেমন কোন ব্যক্তি আত্মবিনাশের নিমিত্ত গ্ৰীষ্মকালে বহুতৃণসম্পন্ন বনে অগ্নি দান করিয়া পরিশেষে সেই অগ্নি প্রবৃদ্ধ হইতেছে অবলোকনপূর্ব্বক অনুতাপ করিয়া থাকে, সেইরূপ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অতুল ঐশ্বৰ্য্যের অধিপতি হইয়াও দুর্ম্মতি কুটিলস্বভাব হতভাগ্য পুত্রকে স্বাধীনতা প্ৰদানপূর্ব্বক অনুতাপ করিতেছেন। বিদুর কুরুকুলের পরম হিতকারী; কিন্তু দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন অহিতকারী বোধে। সতত তাঁহার বাক্যে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়া থাকে। রাজা ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের হিতবাসনায় জ্ঞাতসারেই অধর্ম্মাচরণ করিতেছেন, মেধাবী কুরুকুলহিতৈষী শ্রুতিশীল বাগ্মী বিদুরের বাক্যে কিছুমাত্র মনোযোগ করিতেছেন না। তিনি কেবল মাননাশক, ঈৰ্ষাপরায়ণ, ক্রুদ্ধস্বভাব, ধর্ম্মার্থবর্জিত, কটুভাষী, কামুক, মিত্রদ্রোহী ও নিতান্ত পাপবুদ্ধি দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের প্রীতিসাধনমানসে ধর্ম্মকামে জলাঞ্জলি প্ৰদান করিতেছেন। হে সঞ্জয়! যে সময়ে আমার দ্যূতে অভিলাষ হইয়াছিল, সেই সময়েই কুরুগণের বিনাশকাল সমুপস্থিত হইয়াছে। তখন বুদ্ধিমান বিদুর হিতবাক্য বলিয়াও ধৃতরাষ্ট্রের নিকট প্রশংসাভাজন হয়েন নাই। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ বিদুরের বুদ্ধির অনুবর্ত্তী না হইয়াই বিপদগ্ৰস্ত হইয়াছে, কিন্তু তাহারা যতদিন পর্য্যন্ত তাঁহার মতানুসারে কার্য্য করিয়াছিল, ততদিন তাঁহাদের রাজ্যবৃদ্ধি হইয়াছিল। হে সঞ্জয়! অর্থলুব্ধ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের কি দুর্বুদ্ধি উপস্থিত হইয়াছে দেখ, সে বিমোহিত হইয়া পাপপরায়ণ দুঃশাসন, শকুনি ও কর্ণকে মন্ত্রিপদে নিযুক্ত করিয়াছে; অতএব আমি তাঁহাদিগের শ্রেয়োলাভের কোন সম্ভাবনা দেখিতেছি না। দূরদর্শী বিদুর প্রব্রজিত [দুৰ্য্যোধনের দূর্ব্যবহারে হস্তিনাত্যাগী] হইলে সপুত্ৰ রাজা ধৃতরাষ্ট্র পরের অতুল ঐশ্বর্য্য আত্মসাত করিয়া মহারাজ্য নিষ্কণ্টক বিবেচনা করিতেছেন। কিন্তু তিনি যখন মদীয় অর্থজাত আপনার বলিয়া জ্ঞান করিতেছেন, তখন তাঁহার শান্তি কোথায়?
“সূতপুত্ৰ কৰ্ণ সংগ্রামে অর্জ্জুনকে পরাজয় করিবে বলিয়া মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছে; কিন্তু পূর্ব্বে যেসকল সুমহৎ যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহাতে সে একবারও জয়লাভ করিতে সমর্থ হয় নাই; বিশেষতঃ কৰ্ণ, দুৰ্য্যোধন, পিতামহ ও অন্যান্য কৌরবগণ-ইহারা সকলেই সেই সংগ্রামস্থলে উপস্থিত ছিলেন; অতএব বিশেষরূপে জানিতে পারিয়াছেন যে, অর্জ্জুনের সমান ধনুৰ্দ্ধর আর কেহই নাই। অরতিকুলনিপাতন [শক্রসমূহবিনাশী] ধনঞ্জয় বিদ্যমান থাকিতেও আমাদের রাজ্য যেরূপে দুৰ্য্যোধনের হস্তগত হইয়াছে, তাহাও কোনো ভূপতির অবিদিত নাই। এক্ষণে দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন সেই মহাবলপরাক্রান্ত অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রাম করিয়া পাণ্ডবগণের বিভব হরণ করিতে বাসনা করিতেছে। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ যতক্ষণ পর্য্যন্ত অর্জ্জুনের গাণ্ডীবনির্ঘোষ শ্রবণ না করিবে, তাবৎকাল জীবনধারণে সমর্থ হইবে এবং যতদিন পৰ্য্যন্ত ক্রুদ্ধ ভীমসেনকে অবলোকন না করিবে, ততদিন পর্য্যন্ত অর্থসিদ্ধির অভিলাষ করিতে পরিবে। ফলতঃ মহাবীর ভীমসেন, ধনঞ্জয় ও মাদ্রীনন্দনদ্বয় জীবিত থাকিতে ইন্দ্রও আমাদিগের রাজ্যহরণ করিতে পরিবেন না। যদ্যপি বৃদ্ধ রাজা সেই আত্মজের বুদ্ধির অনুগামী হয়েন, তাহা হইলে তাঁহার পুত্ৰগণ অবশ্যই সমরে পাণ্ডবকোপানলে দগ্ধ হইবে। সঞ্জয়! আমরা যেরূপ ক্লেশ সহ্য করিয়াছি, পূর্ব্বে কৌরবদিগের সহিত আমাদের যে ঘটনা হইয়াছে এবং আমরা দুৰ্য্যোধনের সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছি, তাহা ত’ তোমার কিছুই অবিদিত নাই। আমি তোমাকে সৎকার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বলিতেছি, এখনও যদি দুৰ্য্যোধন আমাদের সহিত সদ্ব্যবহার করিয়া আমাদিগকে ইন্দ্রপ্রস্থ প্রদান করে, তাহা হইলে আমি শান্তিপক্ষ অবলম্বন করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।”