২৫তম অধ্যায়
ভীম-দুম্মর্ষণ যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! পাণ্ডবগণ সমর ক্ষেত্রে গমন করিয়া দ্রোণাচাৰ্য্যকে মেঘাচ্ছাদিত দিবাকরের ন্যায় সমাচ্ছন্ন করিলে আমাদের পক্ষে মহা শঙ্কট সমুপস্থিত হইল। পাণ্ডব সৈন্য সমুত্থিত ধুলিপটল প্রভাবে কৌরব পক্ষগণ আবৃত হওয়াতে আমরা দ্রোণকে অবলোকন না করিয়া মৃত বলিয়া স্থির করিলাম। ঐ সময় মহারাজ দুৰ্য্যোধন পাণ্ডব সৈন্যগণকে দুষ্কর ক্রূর কর্মে প্রবৃত্ত দেখিয়া আপনার সৈন্যগণকে সংগ্রামে প্রেরণ পূর্ব্বক কহিলেন, হে সেনাগণ! তোমরা মহোৎসাহ সহকারে সাধ্যানুসারে পাণ্ডব সৈন্যগণকে নিবারিত কর। তখন আপনার তনয় মহাবীর দুর্শর্ষণ দূর হইতে ভীমসেনকে দেখিয়া দ্রোণের জীবন রক্ষা মানসে ভীমের উপর অসংখ্য বাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। সাক্ষাৎ মৃত্যু তুল্য ক্রোধান্বিত মহাবীর দুর্ম্মর্ষণ যেমন ভীমের উপর বাণ নিক্ষেপ করিলেন, মহাবীর বৃকোদরও তদ্রূপ দুর্ম্মর্ষণের উপর শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহাদের দুই জনের ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল।
উভয়পক্ষীয় বীরগণের তুমুল যুদ্ধ
এ দিকে অন্যান্য রণপ্রাজ্ঞ মহাবীরগণ আপনাদের প্রভুকর্ত্তৃক সমাদিষ্ট হইয়া রাজ্য ও মৃত্যুভয় পরিত্যাগ পূর্ব্বক শত্রুগণকে আক্রমণ করিতে আরম্ভ করিল। সমরোন্মোত্ত মহাবীর কৃতবর্ম্মা মত্ত বারণ বিক্ৰান্ত সাত্যকিকে, সিন্ধুরাজ ক্ষত্রবৰ্ম্মাকে ও উগ্রপন্বা মহেষ্বাসকে শরনিকর দ্বারা দ্রোণাভিমুখ হইতে নিবারিত করিলেন। ক্ষত্ৰবৰ্ম্মা সিন্ধুপতির ধ্বজ ও কার্ম্মুক ছেদ করিয়া ক্রোধভরে দশ নারাচ দ্বারা তাহার সমুদায় মৰ্ম্ম স্থান তাড়িত করিতে লাগিলেন। তখন সিন্ধুরাজ সত্বরে অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া লৌহময় শর দ্বারা ক্ষত্র বৰ্ম্মাকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর সুবাহু, পাণ্ডবগণের হিতার্থ সংগ্রামে যতমান স্বীয় ভ্রাতা মহারথ যুযুৎসুকে দ্রোণাচার্যের নিকট হইতে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর যুযুৎসু সুশাণিত ক্ষুরপ্রদ্বয়ে সুবাহুর ধনুর্ব্বাণ সুশোভিত বাহুযুগল ছেদন করিলেন। বেলা যেমন সমুদ্রের বেগ প্রতিরোধ করে, তদ্রূপ মদ্ররাজ পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। ধৰ্ম্মরাজ মদ্ররাজের উপর অসংখ্য মর্ম্মভেদী বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মদ্ৰাধিপতি ধৰ্ম্মরাজকে চতুঃষষ্টি শরে বিদ্ধ করিয়া উচ্চ স্বরে চীৎকার করিতে লাগিলেন। ধৰ্ম্মরাজ মদ্ররাজের চীৎকার শ্রবণে যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া দুই ক্ষুর দ্বারা তাঁহার ধ্বজ ও শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহারাজ বাহ্লিক অসংখ্য সেনা সমবেত হইয়া মহতী সেনা পরিবৃত মহারাজ দ্রুপদকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মদস্রাবী মহাযূথাধিপতি মাতঙ্গ যুগলের ন্যায় অসংখ্য সৈন্য পরিবৃত উক্ত বৃদ্ধ ভূপতি দ্য়ের ঘোরর সংগ্রাম হইল। পূর্ব্বে ইন্দ্র ও অগ্নি যেমন বলিকে বাণবিদ্ধ করিয়াছিলেন; তদ্রূপ অবন্তি দেশীয় বিন্দ ও অবিন্দ মৎস্যাধিপতি বিরাটকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মৎস্য ও কৈকয়গণের যুদ্ধ সুরাসুর সংগ্রামের ন্যায় অতি ভীষণ হইয়া উঠিল।
নকুল কর্ত্তৃক ভূতকর্ম্মার প্রাণসংহার
নকুলনন্দন শতানীক শরনিকর নিক্ষেপ করত দ্রোণাভিমুখে গমন করিতেছিলেন; সভাপতি ভূতকৰ্ম্মা তাঁহাকে নিবারণ করিলেন। তখন নকুলনন্দন ক্রোধভরে তিন সুশাণিত ভল্ল পরিত্যাগ করিয়া ভূতকর্ম্মার বাহু যুগল ও মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর বিবিংশতি দ্রোণাভিমুখে ধাবমান বল বিক্রমশালী সুতসোমকে নিবারণ করিলেন। তখন সুতসোম ক্রোধভরে অজিহ্মগ শরনিকর দ্বারা স্বীয় পিতৃব্য বিবিংশতিকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমরথ সুনিশিত লৌহময় শর নিকর বর্ষণ করিয়া শাল্ব এবং তাঁহার সারথি ও অশ্বগণকে সংহার করিলেন মহাবীর চিত্রসেনের পুত্র, ময়ূর সদৃশ অশ্ব সংযুক্ত রথারূঢ় সমরাঙ্গণে ধাবমান মহাবাহু শ্রুতকৰ্ম্মাকে নিবারণ করিলেন। হে মহারাজ! আপনার উক্ত পৌত্রদ্বয় স্ব স্ব পিতৃকুলের হিত সাধনার্থ পরস্পর নিধন বাসনায় ঘোৱতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। সিংহলাঙ্গূলধ্বজ মহাবাহু অশ্বত্থামা পিতার নাম রক্ষাৰ্থ বিবিধ শর নিক্ষেপ পূর্ব্বক সমরাঙ্গনস্থ প্রতিবিন্ধ্যকে নিবারণ করিলে মহাবীর প্রতিবিন্ধ্য ক্রোধভরে তাঁহাকে বাণবিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন, কৃষক যেমন বীজকালে ক্ষেত্রে বীজ বপন করে, তদ্রূপ দ্রৌপদীতনয়গণ অশ্বত্থামার উপর শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুনকুমার শ্রুতকীর্ত্তি যুদ্ধার্থ দ্রোণাভিমুখে গমন করিতেছিলেন দেখিয়া দুঃশাসনতনয় তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুন সদৃশ বলবিক্রমশালী অর্জ্জুন তনয় সুশাণিত তিন ভল্ল দ্বারা দুঃশাসননন্দনের শরাসন, ধ্বজ ও সারথির মস্তক ছেদন করিয়া দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! উভয় পক্ষীয় সৈন্যগণই যাহাকে বীর প্রধান বলিয়া গণনা করে, মহাবীর লক্ষ্মণ সেই পটচ্চরনিহন্তাকে নিবারণ করিলেন। পটচ্চরনিহন্তা ক্রোধভরে লক্ষণের শরাসন ও ধ্বজ ছেদন করিয়া তাঁহার উপর শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিল। মহাপ্রাজ্ঞ যুবা বিকর্ণ সমরে ধাবমান যজ্ঞসেনতনয় শিখণ্ডীকে নিবারণ করিলে তিনি বিকর্ণের উপর, বাণ বৃষ্টি করিতে লাগিলেন। মহাবীর বিকর্ণ অনায়াসে শিখণ্ডী নিক্ষিপ্ত শর সমুদায় নিরাকৃত করিলেন। মহাবাহু উত্তমৌজা দ্রোণের প্রতি ধাবমান হইয়াছিলেন; মহাবীর অঙ্গদ শরনিকর নিক্ষেপ করত তাঁহাকে নিবারণ করিলেন। উক্ত বীর দ্বয়ের সংগ্রাম ক্ৰমে তুমুল হইয়া উঠিল; তদ্দর্শনে সমুদায় সৈন্যগণের আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না।
কর্ণপ্রমুখ কুরুবীরগণের দ্রোণ সাহায্য
মহাধনুর্দ্ধর দুর্ম্মুখ দ্রোণাভিমুখে ধাবমান মহাবীর পুরুজিৎকে বৎসদন্ত দ্বারা নিবারণ করিলেন। মহাবাহু পুরুজিৎ ক্রোধভরে দুর্ম্মুখের ভ্রুদ্বয়ের মধ্যে নারাচ নিক্ষেপ করিলে দুর্ম্মুখের মুখমণ্ডল সুনালপঙ্কজের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। মহাবীর কর্ণ দ্রোণাভিমুখে ধাবমান লোহিত ধ্বজ কৈকয় দেশীয় পঞ্চ ভ্রাতাকে শরনিকর দ্বারা নিবারণ করিলেন। তাঁহারা কর্ণের শরাঘাতে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া তাহার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। কর্ণ তাঁহাদিগকে বারংবার শরজালে সমাচ্ছাদিত করিলেন। তৎকালে কর্ণ ও কেকয়দেশীয় পঞ্চ ভ্রাতা পরস্পরের শরজালে পরম্পর অশ্ব, সারথি ও ধ্বজের সহিত অদৃশ্য হইলেন। হে মহারাজ! আপনার তিন পুত্র দুর্জ্জয়, জয় ও বিজয়, নীল, কাশ্য ও জয়সেন এই তিন বীরকে নিবারণ করিলেন। সিংহ, ব্র্যাঘ্র ও তরক্ষুর সহিত ভল্লুক, মহিষ ও বৃষভের যেমন সংগ্রাম হয়, তদ্রূপ আপনার তিন পুত্রের সহিত উক্ত বীরত্রয়ের ঘোরতর যুদ্ধ দেখিয়া দর্শকগণের আনন্দের পরিসীমা রহিল না। ক্ষেমধূৰ্ত্তি ও বৃহন্ত দুই ভ্রাতা দ্রোণাভিমুখে ধাবমান সাত্বতকে তীক্ষ্ণ শরনিকরে ক্ষত বিক্ষত করিলেন। অরণ্যে সিংহের সহিত মত্ত মাতঙ্গদ্বয়ের যেরূপ সংগ্রাম হয়, সাত্বতের সহিত উক্ত ভ্রাতৃদ্বয়ের তদ্রূপ অদ্ভুত যুদ্ধ হইতে লাগিল। ক্রোধপরায়ণ চেদিরাজ অসংখ্য শর নিক্ষেপ করিয়া যুদ্ধাভিনন্দী অম্বষ্ঠরাজকে দ্রোণের নিকট হইতে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন মহারাজ অম্বষ্ঠ অস্থিভেদিনী শলকা দ্বারা চেদিরাজকে বিদ্ধ করিলে চেদিরাজ অম্বষ্ঠের দারুণ প্রহারে একান্ত ব্যথিত হইয়া সশর শাসন পরিত্যাগ পূর্ব্বক রথ হইতে ধরাতলে নিপতিত হইলেন। শারদ্বত কৃপ ক্ষুদ্রক সমুদায় দ্বারা ক্রোধ পরবশ বার্দ্ধক্ষেমিকে নিবারিত করিলেন। হে মহারাজ! চিত্রযোধী রণমদমত্ত কৃপ ও বার্দ্ধক্ষেমিকে যে যে ব্যক্তি নিরীক্ষণ করিতেছিল, তাহারা সকলেই যুদ্ধাসক্তচিত্ত ও অনন্যমতি হইয়া কাৰ্যান্তরবিমূঢ় হইয়া উঠিল। মহাবীর সোমদত্তি দ্রোণের যশোবর্দ্ধন পূর্ব্বক মহারাজ মণিমানকে নিবারিত করত সত্বরে তাঁহার শরাসন, ধ্বজ, পতকা, ছত্র ও সারথিকে রথ হইতে পাতিত করিলেন। তখন অরাতিনিপাতন যূপকেতু মণিমান্ সত্বরে রথ হইতে লম্ফ প্ৰদান করিয়া খড়্গ দ্বারা সোমদত্তির অশ্ব, ধ্বজ, রথ ও সারথিকে ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং সত্বরে আপনার রথে আরোহণ পূর্ব্বক অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া স্বয়ং অশ্ব চালন করত পাণ্ডবপক্ষ সেনাগণকে প্রহার করিতে লাগিলেন। মহাবীর বৃষসেন অসুর বধার্থ ধাবমান সুররাজ পুরন্দর সদৃশ পাণ্ড্যকে শরনিকর দ্বারা নিবারণ করিলেন।
মহাবীর ঘটোৎকচ গদা, পরিঘ, খড়্গ, পট্টিস, আয়োধন, প্লব, মুষল, মুগ্দার, চক্র, ভিন্দিপাল, পরশু, পাংশু, বায়ু, অগ্নি, সলিল, ভস্ম, লোষ্ট্র, তৃণ ও বৃক্ষ সমুদায় দ্বারা সেনাগণকে রুগ্ন, ভগ্ন, বিনষ্ট, বিদ্রাবিত, বিক্ষিপ্তও ভীষিত করিয়া দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন রাক্ষসাগ্রগণ্য অলম্বুষ ক্রুদ্ধ চিত্তে নানা অস্ত্র শস্ত্র নিক্ষেপ ও নানাবিধ যুদ্ধ প্রদর্শন করিয়া হিড়িম্বাতনয়কে প্রহার করিতে লাগিলেন। পূর্ব্বে সম্বর ও ইন্দ্রের যে রূপ সংগ্রাম হইয়াছিল; এক্ষণে উক্ত রাক্ষসদ্বয়ের তোপ সংগ্রাম হইতে লাগিল।
হে মহারাজ! এই রূপে শত শত রথী, গজারোহী, অশ্বারোহী ও পদাতিগণ ঘোরতর সংগ্রাম করিতে আরম্ভ করিল। ফলত দ্রোণবধের নিমিত্ত তৎকালে যাদৃশ যুদ্ধ হইয়াছিল, সে রূপ সংগ্রাম পূর্ব্বে আর কখন দৃষ্ট হয় নাই। ঐ সময় চতুর্দ্দিকে কেবল নানাবিধ ঘোরতর বিচিত্র অতিভীষণ সংগ্রাম দৃষ্ট হইতে লাগিল।