২৫তম অধ্যায়
ব্যাসকর্ত্তৃক দৈবপ্রভাব কীৰ্ত্তন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ঐ সময় রাজা যুধিষ্ঠির ধনঞ্জয়কে কুপিত অবলোকন এবং মহর্ষি বেদব্যাসের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষি! এক্ষণে এই মৰ্ত্তরাজ্য ও অন্যান্য বিবিধ ভোগে আমার কিছুমাত্র অভিলাষ নাই। পতিপুত্রবিহীনা কামিনীগণের বিলাপশ্রবণে আমার চিত্ত শোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়াছে, আমি কিছুতেই শান্তিলাভ করিতে সমর্থ হইতেছি না।”
মহাত্মা ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে যোগবিদ্গণের অগ্রগণ্য বেদবেত্তা বেদব্যাস তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “রাজ। কৰ্ম্মানুষ্ঠান, যজ্ঞানুষ্ঠান বা অন্যান্য কর্ম্মদ্বারা কিছুই লাভ হয় না এবং এক ব্যক্তি আর এক ব্যক্তিকে দান করিতেও পারে না। ভগবান্ বিধাতা যেসময়ে যেবস্তু যাহার প্রাপ্য বলিয়া নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন, সেই সময়ে সে অনায়াসেই তৎসমুদয় লাভ করিতে সমর্থ হয়। নির্দিষ্ট সময় উপস্থত না হইলে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও শাস্ত্রালোচনাদ্বারা কিছুই লাভ করিতে পারে না, আবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইলে নিতান্ত মূর্খেরও ভূরি ভূরি অর্থলাভ হইয়া থাকে। অতএব কাৰ্য্য কালসাপেক্ষ, সন্দেহ নাই। সৌভাগ্যের সময় উপস্থিত না হইলে কি শিল্প, কি যন্ত্র, কি ওষধি, কিছুতেই ফলোদয় হয় না; কিন্তু সময় সমুস্থিত হইলে সমস্তই সুসিদ্ধ ও পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। কালসহকারে বায়ু প্রচণ্ডবেগে প্রবাহিত, জলদগণ সলিলসমাযুক্ত, বনস্থিত পাদপগণ পুষ্পপরিশোভিত, সলিলসমুদয় পদ্মপত্রসমাকীর্ণ, রজনী জ্যোৎস্না বা অন্ধকারে সমাবৃত এবং চন্দ্র ষোড়শ-কলাপরিপূর্ণ হয়। উপযুক্ত কাল উপস্থিত না হইলে কখনই পাদপাবলীর ফুলপুষ্পেগম, নদীসমূহের প্রবলবেগ, পশু, পক্ষী ও পন্নগগণের মত্ততা, কামিনীগণের গর্ভ, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শিশির প্রভৃতি ঋতুর সমাগম, জীবগণের জন্ম-মৃত্যু, বালকদিগের মধুর বাঙ্-নিস্পত্তি[বাক্যস্ফূর্ত্তি], নরগণের যৌবনপ্রাপ্তি, যত্নসমারোপিত [যত্নসহকারে রোপিত] বীজের অঙ্কুরোদগম, ভগবান ভাস্করের উদয় ও অস্তাচলে সমাগম এবং ভগবান চন্দ্রমা ও তরঙ্গ – মালাসঙ্কুল সমুদ্রের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না।
সুখদুঃখপ্রসঙ্গে শ্যেনজিৎত্রাজার উপাখ্যান
“হে কৌন্তেয়! এই বিষয়ে শ্যেনজিৎরাজার পুরাতন ইতিবৃত্ত কহিতেছি, শ্রবণ কর। ঐ রাজা দুঃখাৰ্ত্ত হইয়া কহিয়াছিলেন যে, দুর্নিবার কালের গতি অতিক্রম করিবার ক্ষমতা কাহারও নাই। কালক্রমে সকল ভূপতিকেই শমনসদনে গমন করিতে হইবে, একজন অন্য ব্যক্তিকে, অপরাপর ব্যক্তিগণ তাহাকে বিনাশ করে, ইহা কেবল কথামাত্র; বস্তুতঃ কেহ কাহাকে বিনাশ করে না, প্রাণীগণের স্বভাবতঃই জন্ম-মৃত্যু নিরূপিত রহিয়াছে। মূঢ় ব্যক্তিরাই ধন নষ্ট বা পুত্ৰকলত্র নিহত হইলে হায় কি হইল! হায় কি হইল!” এই অনুধ্যান করিয়া দুঃখের প্রতিকার করিয়া থাকে। তুমি কি নিমিত্ত সেই মূঢ়দিগের ন্যায় শোকার্ত্ত হইয়া অনুতাপ করিতেছ? দেখ, দুঃখ করিলেই দুঃখ এবং ভয় করিলেই ভয় পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। এই সসাগরা পৃথিবী আপনার, আবার আপনার আত্মাও আপনার নহে। পণ্ডিত ব্যক্তিরা এইরূপ বিবেচনা করিয়া কখনই মুগ্ধ হয়েন না। এই ভূমণ্ডলে শোকের বিষয় সহস্র সহস্র ও হর্ষের বিষয় শত শত বিদ্যমান রহিয়াছে; মূঢ় ব্যক্তিরাই সতত তৎসমুদয়ে অভিভূত হয়; কিন্তু বিদ্বান্ ব্যক্তিরা কখনই উহাতে আক্রান্ত হয়েন না। প্রথমতঃ যে বস্তু প্রিয় থাকে, কালক্রমে তাহাই আবার দুঃখজনক হয় এবং যাহা প্রথমে অপ্রিয় থাকে, কালক্রমে তাহাই আবার সুখকর হইয়া উঠে। জীবমণ্ডলে সুখদুঃখ এইরূপে পরিভ্রমণ করিতেছে। ইহলোকে প্রকৃত সুখ নাই, কেবল দুঃখই আছে। এই নিমিত্ত মনুষ্যকে সতত দুঃখ ভোগ করিতে হয়। দুঃখের অভাবই সুখ নামে অভিহিত হইয়া থাকে।
“লোকের আশা পূর্ণ না হইলেই দুঃখ উপস্থিত হয়! ইহলোকে সকলেই সুখের পর দুঃখ ও দুঃখের পর সুখ ভোগ করিয়া থাকে; কেহই নিয়ত দুঃখ বা নিয়ত সুখ ভোগ করে না, অতএব যে ব্যক্তি শাশ্বতসুখলাভে অভিলাষ করেন, তাঁহার লৌকিক সুখ ও দুঃখ উভয়কেই জয় করিতে হয়। যাহার নিমিত্ত শোক, তাপ ও আয়াস সমুপস্থিত হয়, তাহা সর্পদষ্ট [সর্পকর্ত্তৃক দংশিত] অঙ্গুলির ন্যায় অবশ্য পরিত্যজ্য। সুখ বা দুঃখ, প্রিয় বা অপ্রিয় যাহা উপস্থিত হউক না কেন, অনাকুলিতচিত্তে তাহা অনুভব করাই সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। পুত্ৰকলত্রগণের অল্পমাত্র প্রিয়কার্য্য সম্পাদন না করিলেই জানিতে পারা যায় যে, উহাদের মধ্যে কে কি নিমিত্ত আত্মীয় হইয়াছে। যাহা হউক, ইহলোকে যাহারা অত্যন্ত মূঢ় এবং যাহারা তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, তাহারাই সুখসম্ভোগ করিয়া থাকে; মধ্যবিত্ত লোকদিগকে নিতান্ত ক্লেশে কালাতিপাত করিতে হয়। সুখদুঃখবেত্তা মহাত্মা শ্যেনজিৎ এই সকল কথা কহিয়া গিয়াছেন।
“আর দেখ, যে ব্যক্তি অন্যের দুঃখদর্শনে দুঃখ বোধ করে, সে কদাচ সুখী হইতে পারে না। কোন কালেই লোকের দুঃখের অন্ত নাই। সকলেরই পৰ্য্যায়ক্রমে সুখ-দুঃখ, লাভালাভ, বিপদ-সম্পদ ও জন্ম-মৃত্যু ঘটিয়া থাকে। এই জন্য বিদ্বান্ ব্যক্তিরা কিছুতেই আহ্লাদিত বা শোকার্ত্ত হয়েন না। নরপতিদিগের যুদ্ধই যাগস্বরূপ, দণ্ডনীতির আলোচনাই যোগস্বরূপ, আর যজ্ঞে দক্ষিণাদানই সন্ন্যাসস্বরূপ। রাজা নিরহঙ্কৃত ও যজ্ঞশীল হইয়া নীতিমার্গানুসারে বুদ্ধিপূৰ্ব্বক রাজ্যরক্ষা, ধৰ্ম্মানুসারে সকলের প্রতি সমান দৃষ্টিপাত, সংগ্রামে জয়লাভ, যজ্ঞে সোমরসপান, প্রজাপরিবর্দ্ধন, যুক্তি অনুসারে দণ্ডবিধান, সম্যকরূপে বেদ ও শাস্ত্রাধ্যয়ন এবং চারিবর্ণের প্রজাগণকে স্ব স্ব ধৰ্ম্মে সংস্থাপন করিয়া পরিশেষে সমরশয্যায় শয়ন করিতে পারিলেই পবিত্রতা লাভ ও চরমে দেবলোকে বাস করিতে সমর্থ হয়েন। মহারাজ! যে রাজা পরলোক প্রাপ্ত হইলে পুরবাসী প্রজা ও অমাত্যগণ তাঁহার গুণকীর্ত্তন করে, তিনিই রাজশ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য হইয়া থাকেন।”