২৪তম অধ্যায়
ব্যাসপ্রদত্ত রাজ্যপালনবিষয়ক উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর মহর্ষি বেদব্যাস রাজা যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক পুনরায় কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তোমার ভ্রাতৃগণ অরণ্যবাসকালে যেরূপ অভিলাষ করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা সফল হউক। তুমি নহুষতনয় যযাতির ন্যায় পৃথিবী পালন কর। তোমার ভ্রাতৃগণ বনমধ্যে অতিক্লেশে কালযাপন করিয়াছিলেন, এক্ষণে উহারা দুঃখাবসানে সুখানুভব করুন। তুমি কিয়ৎকাল ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে পর্য্যায়ক্রমে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামের পর্য্যালোচনা করিয়া পশ্চাৎ অরণ্যে প্রস্থান করিবে। তুমি অগ্রে তিথি, পিতৃগণ ও দেবগণের ঋণজাল হইতে বিমুক্ত হও, পশ্চাৎ যেরূপ অভিলাষ হয়, করিও। অগ্রে সৰ্ব্বমেধ ও অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া পশ্চাৎ আরণ্যকধৰ্ম্ম অবলম্বন করাই তোমার শ্রেয়। তুমি ভ্রাতৃগণকে ভূরিদক্ষিণ যজ্ঞে প্রবর্ত্তিত করিলেই তোমার মহীয়সী কীৰ্ত্তি লাভ হইবে।
“এক্ষণে আমি তোমাকে আরও কয়েকটি ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মবিষয়ক উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। সেই উপদেশানুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করিলে তোমাকে কদাচ ধর্ম্মভ্রষ্ট হইতে হইবে না। পরস্পাপহারী দস্যুর সমকক্ষ ব্যক্তিরাই ভূপালকে যুদ্ধাদি কাৰ্য্যে প্রবর্ত্তিত করিয়া থাকে। যে রাজা দেশকাল প্রতীক্ষা করিয়া দস্যুকে বিনাশ করিতে পরাঙ্মুখ হয়েন, তাঁহাকে কদাচ হিংসাজনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয় না। যে রাজা ষষ্ঠাংশ কর গ্রহণপূৰ্ব্বক রাজ্য রক্ষা করেন, তাঁহাকে প্রজাদিগের পাপের চতুর্থাংশে লিপ্ত হইতে হয়।
“রাজা ধৰ্ম্মশাস্ত্র উল্লঙ্ঘন করিলে অধর্ম্মে লিপ্ত ও ধর্ম্মশাস্ত্রানুসারে কাৰ্য্য করিলে নির্ভীক হইতে পারেন, সন্দেহ নাই। যে রাজা কাম ও ক্রোধকে পরাজয় করিয়া শাস্ত্রানুসারে প্রজাবর্গের প্রতি সমভাবে দৃষ্টিপাত করেন, তাঁহাকে কদাচ পাপপঙ্কে লিপ্ত হইতে হয় না। রাজা যদি দৈবের প্রতিকূলতাবশতঃ কোন কাৰ্য্য সংসাধন করিতে না পারেন, তাহা হইলে তদ্বিষয়ে তাঁহাকে দোষী বলা যাইতে পারে না। বলদ্বারাই হউক বা বুদ্ধিকৌশলেই হউক, শত্রুনিগ্রহে যত্নবান হওয়া রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজ্যে পাপসঞ্চার করা উচিত নহে; প্রত্যুত যাহাতে পুণ্যস্রোত প্রবাহিত হয়, তদ্বিষয়ে যত্ন করা বিধেয়। বীর ও সাধুলোকের সম্মান এবং বেদবিৎ ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যদিগকে প্রতিপালন করা ভূপতির অবশ্য কৰ্ত্তব্য। প্রকৃষ্ট ও জ্ঞানসম্পন্ন বহুশ্রুত ব্যক্তিকেই ধৰ্ম্মকার্য্যে নিযুক্ত করিবে। বহুগুণসম্পন্ন হইলেও এক ব্যক্তির সহিত পরামর্শ করিয়া কাৰ্য্য করা বিচক্ষণের কৰ্ত্তব্য নহে। যে রাজা প্রজাপালনে অক্ষম, অসূয়াপরবশ, অভিমানপরতন্ত্র ও মান্য ব্যক্তির সম্মান-রক্ষায় পরাঙ্মুখ, তাঁহাকে পাপগ্রস্ত ও জনসমাজে দুর্দান্ত বলিয়া বিখ্যাত হইতে হয়। যদি প্রজারা সুপ্রণালীক্রমে রক্ষিত না হইয়া দৈবের প্রতিকূলতাবশতঃ নিতান্ত দুরবস্থাপন্ন ও তস্করদিগের উপদ্রবে একান্ত ভীত হইয়া ওঠে, তাহা হইলে রাজাকে যারপরনাই পাপভাগী হইতে হয়। সুমন্ত্রণা ও সুনীতি অনুসারে পুরুষকার প্রদর্শন করিলে তাহাতে কিছুমাত্র অধৰ্ম্ম নাই। পুরুষকারপ্রদর্শনপূৰ্ব্বক কোন কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিলে যদি দৈবপ্রভাবে সিদ্ধ না হয়, তাহা হইলে তদ্বিষয়ে রাজাকে পাপভাগী হইতে হয় না।
নৃপতি হয়গ্ৰীবের গৃহধৰ্ম্মনিষ্ঠা
“হে ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে পূর্ধ্বতন রাজর্ষি হয়গ্রীবের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ঐ রাজা শত্রুনিগ্রহ ও প্রজাপালনপূর্ব্বক মহীয়সী কীৰ্ত্তি লাভ করিয়া গিয়াছেন। তিনি একাকী অশ্বচতুষ্টয়সম্পন্ন রথে আরোহণ করিয়া ক্রোধভরে শরাসন আকর্ষণ ও অনবরত শরনিকরবর্ষণপূৰ্ব্বক শত্রুসংহার করিয়া পরিশেষে স্বয়ং সংগ্রামে নিহত হয়েন। তিনি নিরহঙ্কার হইয়া বুদ্ধিবলে ও নীতিকৌশলে রাজ্য রক্ষা করিয়া বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক অতুল খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। তিনি সকল কার্য্যে অসাধারণ উৎসাহপ্রদর্শনপূৰ্ব্বক অভিমানশূন্য হইয়া দৈব ও মানুষ কাৰ্য্যসমুদয়ের অনুষ্ঠান এবং দণ্ডনীতির সাহায্যে রাজ্যশাসন করিতেন। তিনি বিদ্বান, শ্রদ্ধাবান, ত্যাগশীল ও কৃতজ্ঞ ছিলেন। ঐ মহীপাল বিবিধ সৎকার্য্যের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক এই জীবলোক পরিত্যাগ করিয়া মেধাবী, বিচক্ষণ ও সাধুসম্মত ব্যক্তিদিগের লোক লাভ করিয়াছেন। তিনি বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্র অধ্যয়নপূৰ্ব্বক এই চতুৰ্ব্বর্ণাত্মক লোকসমুদয়কে স্বধৰ্ম্মে সংস্থাপন করিয়াছিলেন। তিনি যজ্ঞে সোমরস পান, ব্রাহ্মণগণের তৃপ্তিসাধন ও প্রজাবর্গের প্রতি অপরাধানুসারে দণ্ড বিধান করিতেন। ঐ মহাত্মার চরিত্র অতি বিচিত্র ও শ্লাঘনীয়। বিদ্বান্ সাধুলোকেরা সতত তাঁহার প্রশংসা করিয়া থাকেন। হে যুধিষ্ঠির! এক্ষণে সেই পুণ্যবান মহাত্মা অপূৰ্ব্ব সিদ্ধিলাভ করিয়া বীরজনসমুচিত লোকসমুদয় অধিকার করিয়াছেন।”