সৌতি বলে, এইরূপে গেল বহুকাল।
পাণ্ডুবংশে হৈল পরীক্ষিত মহীপাল।।
মহাপুণ্যবান রাজা প্রতাপে মিহির।
কৃপাচার্য্য শিক্ষায় সকল শাস্ত্রে ধীর।।
সর্ব্বগুণযুত রাজা সদা সত্যব্রত।
মৃগয়াতে প্রিয়, বনে ভ্রমে অবিরত।।
দৈবে একদিন রাজা বিন্ধিলা হরিণে।
পলায় হরিণ, পাছু ধাইল আপনে।।
পরিক্ষীত-বাণে জীয়ে কাহার জীবন।
পলাইয়া গেল মৃগ দৈব-নিবন্ধন।।
বহুদূর অরণ্যে পশিল নরবর।
দেখিতে না পায় মৃগ অরণ্য-ভিতর।।
তৃষ্ণায় আকুল বড় হয়ে পরীক্ষিত।
গো-চারণ স্থানে এক হৈল উপনীত।।
উপনীত হয়ে তথা দেখিবারে পান।
বৎসগণ করিতেছে গাভী-দুগ্ধ পান।।
তাহাদর মুখসৃত যত ফেণারাশি।
বসিয়া করেন পান মৌনে এক ঋষি।।
ঋষিবরে দেখি নৃপ করি সম্বোধন।
ক্ষুধায়-কাতর হয়ে কহেন বচন।।
আমি পরীক্ষিত রাজা শুন তপোধন।
মম বিদ্ধ মৃগ এক কৈল পলায়ন।।
কোন্ পথে গেল মৃগ বলে দেও মোরে।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়েছি অন্তরে।।
মৌনব্রতধারী মুনি না কহে বচন।
ভূপতি জিজ্ঞাসা কিন্তু করে পুনঃ পুনঃ।।
মৌনব্রতে আছে মুনি রাজা নাহি জানে।
উত্তর না পেয়ে রাজা ক্রুদ্ধ হৈল মনে।।
একে ত রাজ্যের রাজা, দ্বিতীয়ে অতিথি।
উত্তর না দিল, দুষ্ট ইহার প্রকৃতি।।
এত ভাবি নৃপতি কুপিত হৈল মনে।
মৃতসর্প ছিল দৈবে তার সন্নিধনে।।
ধনুহুলে তুলি সর্প গলে জড়াইল।
অশ্ব-আরোহণে রাজা হস্তিনাতে গেল।।
ব্রাহ্মণের পুত্র মুনি শৃঙ্গী নাম ধরে।
কৃশনামে তার সখা বলিল তাহারে।।
কিবা গর্ব্ব কর আপনারে না জানিয়া।
তব বাপে রাজা দণ্ডে, ঘরে দেখ গিয়া।।
এত শুনি গেল শৃঙ্গী দেখিবারে বাপ।
গলায় দেখিল বেড়ি আছে মৃত সাপ।।
ক্রুদ্ধ হৈল শৃঙ্গী যেন জ্বলন্ত অনল।
রাজাকে দিলেক শাপ হাতে করি জল।।
আজি হৈতে সপ্তদিনে পরীক্ষিত নৃপে।
তক্ষকে দংশিবে তারে মম এই শাপে।।
এত বলি পরীক্ষিতে দিল ব্রহ্মশাপ।
পুত্রের শুনিয়া শাপ দ্বিজে হৈল তাপ।।
মৌনভঙ্গে দ্বিজবর করয়ে বিলাপ।
অজ্ঞান সন্তান তুমি কৈলে মনস্তাপ।।
অবোধ সন্তান তুমি করিলে কি কর্ম্ম।
ক্রোধে তপ নষ্ট হয় প্রবল অধর্ম্ম।।
রাজারে দিবার শাপ উচিত না হয়।
রাজার প্রতাপে সব রাজ্য রক্ষা পায়।।
রাজার আশ্রয়ে যজ্ঞ করে দ্বিজগণ।
যজ্ঞ কৈলে বৃষ্টি হয় জন্মে শস্য-ধন।।
দুষ্ট-দৈত্য-চোর-ভয় রাজার বিহনে।
রাজ্য-রক্ষা হেতু ধাতা সৃজিল রাজনে।।
রাজা দশ শোত্রিয় সমান বেদে বলে।
হেন নৃপে শাপ দিয়া কুকর্ম্ম করিলে।।
অন্য হেন রাজা নহে রাজা পরীক্ষিত।
পিতামহ-সম রাজা স্বধর্ম্মে পণ্ডিত।।
ব্রতধারী বলি মোরে রাজা নাহি জানে।
ক্ষুধার্ত্ত অহিল রাজা আমার সদনে।।
না কৈলে গৃহধর্ম্ম দিলা তবু শাপ।
ক্ষমা কর পুত্র তার খণ্ড মনস্তাপ।।
এত শুনি বলে শৃঙ্গী বাপের গোচরে।
যে কথা বলিলা পিতা নারি খণ্ডিবারে।।
সহজে বচন মম খণ্ডন না হয়।
যে শাপ দিলাম ইহা খণ্ডিবার নয়।।
এত শুনি মুনিবর হইল চিন্তিত।
নিশ্চয় জানিল শাপ না হবে খণ্ডিত।।
গৌরমুখ নামে শিষ্যে আনিল ডাকিয়া।
পাঠাইল নৃপ-স্থানে সকল কহিয়া।।
আজ্ঞা পেয়ে গেল শিষ্যে হস্তিনা -নগর।
প্রবেশ করিল গিয়া যথা নৃপবর।।
ব্রাহ্মণে দেখিয়া রাজা পাদ্য-অর্ঘ্য দিল।
কোথা হৈতে আগমন বলি জিজ্ঞাসিল।।
ব্রাহ্মণ বলিল, রাজা শুন সাবধানে।
মৃগয়া-কারণ তুমি গিয়াছিলা বনে।।
যে দ্বিজের গলে জড়াইলে মৃত-সাপ।
অজ্ঞান তাহার পুত্র ক্রোধে দিল শাপ।।
পুত্র শাপ দিল তাহা পিতা নাহি জানে।
সে কারণ আমা পাঠাইল তব স্থানে।।
বহু বহু প্রীতিবাক্য পুত্রেরে কহিল।
তথাপি শাপান্ত তারে করিতে নারিল।।
সাত দিনে করিবেক তক্ষক দংশন।
জানিয়া উপায় শীঘ্র করহ রাজন।।
বজ্রাঘাত হৈল শুনি ব্রাহ্মণ-বচন।
আপনারে নিন্দা করি বলয়ে রাজন।।
করিলাম কোন্ কর্ম্ম দুষ্ট কদাচার।
ব্রাহ্মণে হিংসিনু আমি না করি বিচার।।
আপন মরণ রাজা নাহি চিন্তে মনে।
ব্রাহ্মণের তাপ হেতু নিন্দয়ে আপনে।।
ধ্যানেতে ছিলেন মুনি আগে নাহি জানি।
যে দণ্ড হইল মম সত্য করি মানি।।
মুনিরাজে জানাইও আমার বিনয়।
দৈবে যাহা করে তাহা খণ্ডন না হয়।।
এত বলি ব্রাহ্মাণেরে করিয়া মেলানি।
মন্ত্রণা করয়ে যত মন্ত্রিগণ আনি।।
তক্ষকে দংশিবে সপ্ত দিবস ভিতরে।
কি করি উপায় শীঘ্র জানাও আমারে।।
মন্ত্রিগণ বলে রাজা কর অবধান।
মঞ্চ এক উচ্চতর করহ নির্ম্মাণ।।
উচ্চ এক স্তম্ভে মঞ্চ করিল বচন।
চতুর্দ্দিকে জাগিয়া রহিল গুণিগণ।।
সর্পের যতেক গদ-ঔষধি সংসারে।
চতুর্দ্দিকে রাখিলেক যোজন বিস্তারে।।
বেদবিজ্ঞ বিপ্র যত সিদ্ধ বাক্য যার।
শত শত চতুর্দ্দিকে রহিল বাজার।।
তাহে বসি দান-ধ্যান করে নৃপবর।
হরিগুণ শুনে রাজা ধর্ম্মেতে তৎপর।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।