শৌনকাদি মুনি বলে সূতের নন্দন।
শুনিনু গরুড় কথা অদ্ভুত কথন।।
কদ্রুর হইল এক সহস্র কুমার।
কোন্ কর্ম্ম কৈল কিবা নাম সবাকার।।
সৌতি বলে, কতেক কহিব মুনিগণ।
কিছু নাম কহি, শ্রেষ্ঠ ফণী যত জন।।
শেষ জ্যেষ্ঠ সহোদর দ্বিতীয় বাসুকি।
ঐরাবত তক্ষক কর্কট সিংহ-আঁখি।।
বামন কালিয় এলাপত্র মহোদর।
কুণ্ডল অনীল নীল বৃত্ত অকর্কর।।
মণিনাগ আপূরণ আর্য্যক উগ্রক।
সুরামুক দধিমুখ কলশ পোতক।।
কৌরব্য কুটর আপ্ত কম্বল তিত্তিরি।
হেনমত নাগ সব কত নাম করি।।
সর্ব্ব হৈতে শ্রেষ্ঠ জ্যেষ্ঠ শেষ বিষধর।
জিতেন্দ্রিয় সুপণ্ডিত ধর্ম্মেতে তৎপর।।
ভাই সব দুরাচর দেখি নাগরাজ।
বিশেষে মায়ের শাপ ভাবে হৃদিমাঝ।।
ত্যজিয়া সকল গেল তপ করিবারে।
নানা-তীর্থ করি শেষ ভ্রময়ে সংসারে।।
হিমালয়ে আশ্রম করিল নাগবর।
অত্যন্ত কঠোর তপ করে নিরন্তর।।
তার তপ দেখি তুষ্ট হৈল প্রজাপতি।
ব্রহ্মা বলে তপ কেন কর ফণিপতি।।
স্ববাঞ্ছিত বর মাগি করহ গ্রহণ।
করযোড়ে শেষ তবে কৈল নিবেদন।।
আমি কি কহিব সব তোমার গোচর।
দুষ্ট দুরাচার মোর যত সহোদর।।
গরুড় আমার ভাই বিনতা-নন্দন।
তার সহ কলহ করয়ে অনুক্ষণ।।
বলেতে সমর্থ কেহ নহে সম তার।
নিষেধ না শুনে কেহ করে অহঙ্কার।।
সদাই কপট কর্ম্ম, লোকের হিংসন।
অহঙ্কারী কুপথী যতেক ভ্রাতৃগণ।।
সেই হেতু সকলের সংসর্গ ছাড়িয়া।
শরীর ছাড়িব আমি তপস্যা করিয়া।।
পুনঃ যেন সংসর্গ না হয় সবা সনে।
মরিব তপস্যা করি তাহার কারণে।।
বিরিঞ্চি বলেন, শেষ না ভাব এমন।
দুষ্টের সংসর্গ তব হইবে মোচন।।
ধর্ম্মেতে তৎপর তুমি বলে মহাবল।
আপনার তেজে ধর পৃথিবীমণ্ডল।।
ব্রহ্মার বচনে শেষ পৃথিবী ধরিল।
গরুড় সহিত ব্রহ্মা মৈত্রী করাইল।।
ব্রহ্মার আজ্ঞায় গিয়া পাতাল-ভিতর।
তথা থাকি পৃথিবী ধরিল বিষধর।।
তুষ্ট হৈয়া ব্রহ্মা তারে কৈল নাগরাজা।
নাগলোকে দেবলোকে সবে করে পূজা।।
হেনমতে শেষ সব ত্যজি ভ্রাতৃগণে।
একাকী রহিল তেঁই ব্রহ্মার বচনে।।
শেষ যদি গেল তবে বাসুকি চিন্তিত।
মায়ের শাপেতে হয় অত্যন্ত দুঃখিত।।
সব ভ্রাতৃগণ লৈয়া করেন যুকতি।
মায়ের শাপেতে ভাই না দেখি নিষ্কৃতি।।
জনকের শাপেতে আছয়ে প্রতিকার।
জননীর শাপে নাহি দেখি যে উদ্ধার।।
ক্রোধ করি জননী যখন শাপ দিল।
পিতৃ-পিতামহ সবে স্বীকার করিল।।
জন্মেজয় যজ্ঞে হবে অবশ্য সংহার।
এখন তাহার ভাই কর প্রতিকার।।
এতেক বচন যদি বাসুকি বলিল।
যার যেই যুক্তি আসে কহিতে লাগিল।।
এক নাগ বলে, আমি ব্রাহ্মণ হইব।
জন্মেজয় যজ্ঞে আমি ভিক্ষা মাগি লব।।
আর নাগ বলে, আমি রাজমন্ত্রী হৈয়া।
না দিব করিতে যজ্ঞ মন্ত্রণা করিয়া।।
আর নাগ বলে, কোন্ বিচিত্র সে কথা।
কেমনে করিবে যজ্ঞ খাব যজ্ঞ-হোতা।।
নহিলে খাইব সব ব্রাহ্মণে ধরিয়া।
দ্বিজ বিনা যজ্ঞ হবে কেমন করিয়া।।
অন্যে বলে, আরে ভাই এ নহে বিচার।
ব্রাহ্মণ-হিংসিলে ভাই নাহিক নিস্তার।।
বিপদে পড়িলে লোক বিপ্রে দান করে।
বিপ্র তুষ্ট হলে ভাই সর্ব্বারিষ্ট হরে।।
আর নাগ বলে, আমি জলধর হৈয়া।
নিবারিব যজ্ঞ-অগ্নি বারি বরষিয়া।।
আর নাগ বলে আমি বিপ্ররূপ ধরি।
যতেক যজ্ঞের শস্য লব চুরি করি।।
কেহ বলে, মোরা সবে একত্র হইয়া।
অনিবার যজ্ঞাগার থাকিব বেড়িয়া।।
যাহারে দেখিব তারে করিব ভক্ষণ।
ভয়েতে করিবে রাজা যজ্ঞ-নিবারণ।।
এতেক বলিলা যদি সব নাগগণে।
বাসুকি বলিল, নাহি রুচে মম মনে।।
আমা সবা মারিবারে দৈব-শক্তি ধরে।
কাহার ক্ষমতা ভাই তাহারে নিবারে।।
ইহার উপায় কিছু নাহি দেখি আর।
অবশ্য সর্পের কুল হইব সংহার।।
এলাপত্র নমে সর্প ছিল একজন।
বাসুকির বাক্য শুনি কহিল তখন।।
মায়ের বচন কভু না হবে লঙ্ঘন।
যত যুক্তি কৈল সবে সব অকারণ।।
মায়ের বচন আর দৈবের লিখন।
অবশ্য হইবে যজ্ঞ না যায় খণ্ডন।।
পাণ্ডুবংশে জন্মেজয় হইবে উৎপত্তি।
তাঁর যজ্ঞ হিংসিবেক কাহার শকতি।।
আছয়ে উপায় এক শুন সর্ব্বজন।
সাবধানে শুন সবে ব্রহ্মার বচন।।
পুত্রগণে যখন জননী শাপ দিল।
দেবগণ তখনি ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসিল।।
হেন শাপ কেহ দেয় আপন নন্দনে।
আর কোন্ জন হেন আছয়ে ভুবনে।।
ব্রহ্মা বলে অবধান কর সুরগণ।
পরের অহিতকারী সদা সর্পগণ।।
বিনষ্ট হইলে তারা রহিবে সংসার।
নতুবা সর্পের বিষে হৈবে ছারখার।।
তবে ধর্ম্মে অনুগত যেই নাগ হবে।
জন্মেজয়-যজ্ঞে মাত্র সেই রক্ষা পাবে।।
শুন সবে আছে এক উপায় তাহার।
যাযাবর-বংশে জন্ম লবে জরৎকার।।
তাঁহার বিবাহ হবে জরৎকারী-সনে।
বাসুকির ভগ্নী সেই বিখ্যাত ভুবনে।।
তার গর্ভে জন্মিবেন আস্তিক কুমার।
সেই পুত্র নাগকুল করিবে নিস্তার।।
এইরূপে ব্রহ্মা আজ্ঞা কৈল দেবগণে।
এ সকল কথা আমি শুনেছি শ্রবণে।।
আর কোন উপায় করহ ভাইগণ।
না হইবে সাধ্য কিছু সব অকারণ।।
সেই জরৎকারে যেই ভগিনী সবার।
জরৎকারে বিভা দিলে হইবে নিস্তার।।
এতেক বলিল এলাপত্র বিষধর।
সাধু সাধু করি সবে করিল উত্তর।।
তবে দেবাসুরে মিলি সমুদ্র মথিল।
তাহার মথন দড়ি বাসুকি হইল।।
তুষ্ট হয়ে দেবগণ ব্রহ্মারে বলিল।
বাসুকি হইতে সিন্ধু মথন হইল।।
মাতৃশাপে বাসুকির দহে কলেবর।
আজ্ঞা কর পিতামহ খণ্ডে যেন ডর।।
ব্রহ্মা বলে জরৎকারী ভগিনী তাহার।
তার পুত্র করিবেক নাগের নিস্তার।।
বাসুকি শুনিয়া হৈল আনন্দিত মন।
জরৎকারু জন্য চর কৈল নিয়োজন।।
চরগণে বলেন থাকিবে অলক্ষ্যেতে।
জরৎকারু দেখা হৈলে কহিবে ত্বরিতে।।
যাহা জিজ্ঞাসিলে সৌতি বলে মুনিগণে।
বাসুকি দিলেন ভগ্নী তাহার কারণে।।
মহাভারতের কথা অমতৃ-লহরী।
ভক্তিভরে বর্ণন করিব যত পারি।।
ইহার শ্রবণে যত সুখী হবে নরে।
তাদৃশ নাহিক সুখ ত্রৈলোক্য।।
কাশীরাম দাসের সদাই এই মন।
নিরবধি বাঞ্ছে সদা ভারত-শ্রবণ।।