২১তম অধ্যায়
সন্ধির অনুকূল প্রস্তাবাৰ্থ সঞ্জয়প্রেরণ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! শুনিয়াছি, পাণ্ডুতনয়েরা বিরাটরাজ্যে সমুপস্থিত হইয়াছেন এবং ভাগ্যক্রমে তুমিও সন্নদ্ধ [যথোপযুক্তভাবে প্রস্তুত] হইয়া উপযুক্ত সময়ে আগমন করিয়াছ, অতএব এক্ষণে শীঘ্র বিরাটনগরে গমনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের অনুসন্ধান করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরকে অর্চ্চনাপূর্ব্বক সকলকেই আমাদিগের কুশলবার্ত্তা কহিবে। পাণ্ডবেরা পরোপকারী, অকপট ও সাধু; তাঁহারা অজ্ঞাতবাসে দুঃসহ ক্লেশপরম্পরা সহ্য করিয়াও আমাদিগের প্রতি কিছুমাত্র ক্রুদ্ধ হন নাই। আমি কদাপি পাণ্ডবদিগের মিথ্যাব্যববহার অবলোকন করি নাই, তাঁহারা স্বীয়বীর্য্যার্জিত সমুদয় সম্পত্তি আমাকে প্রদান করিয়াছেন। আমি নিরন্তর অনুসন্ধান করিয়াও তাঁহাদিগের কিছুমাত্র দোষ দেখিতে পাই নাই; অতএব কি বলিয়া পাণ্ডবদিগের নিন্দা করিব? তাঁহারা সর্ব্বদা ধমার্থের অবিরোধে কর্ম্ম করিয়া থাকেন। আপনাদিগের সুখ, প্রিয় বা অভীষ্ট সাধনের অনুরোধে করেন না। তাঁহারা ধৈৰ্য্য ও প্রজ্ঞাবলে শীত, গ্ৰীষ্ম, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিন্দা, ক্ৰোধ, হর্ষ ও প্রমাদ এইসকল অভিভূত করিয়া ধর্ম্মার্থের নিমিত্ত যত্ন করিয়াছেন, তাঁহারা প্রয়োজনসময়ে মিত্ৰগণকে ধনদান করিয়া থাকেন এবং দীর্ঘকাল একত্র বাস করিলেও তাঁহাদিগের বন্ধুত্বের কিছুমাত্র হ্রাস হয় না; সেই ধার্মিকেরা যিনি যেমন ব্যক্তি, তাঁহার তদনুরূপ সম্মান রক্ষা করেন এবং যথাযোগ্য অর্থচিন্তাও করিয়া থাকেন।
“পাপাত্মা মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধন ও ক্ষুদ্রাশয় কর্ণ ব্যতিরেকে অস্মৎপক্ষীয় আর কোন ব্যক্তিই পাণ্ডবগণের বিদ্বেষ করেন না। কেবল ইহারা দুইজনে সেই সুখাভিলাষবিহীন মহাত্মাদিগের ক্ৰোধ বৰ্দ্ধিত করিতেছে। দুৰ্য্যোধন আরম্ভসময়ে বলবীৰ্য্য প্রকাশ করিতে পারে, কিন্তু কাৰ্য্যকালে তাহার কিছুমাত্র ক্ষমতা থাকে না। সে অতিশয় সুখাভিলাষী ও বালক, স্বীয় অবিমুষ্যকারিতা [হঠকারিতা-বিবেচনারাহিত্য]প্রযুক্ত পাণ্ডবগণের সমক্ষে তাহাদের অংশ অপহরণ করা অনায়াসসাধ্য মনে করিতেছে। অর্জ্জুন, কেশব, বৃকোদর, সাত্যকি, নকুল, সহদেব ও সৃঞ্জয় যাহার অনুগামী, যুদ্ধের পূর্ব্বেই তাঁহাকে ভাগ প্ৰদান করা কর্ত্তব্য। জয়শীল সব্যসাচী একাকী পৃথিবী পরিচালিত করিতে পারেন এবং কেশবও সকলের দুরধিগম্য [অচিন্ত্যচরিত-যাঁহার চরিত সাধারণের বোধগম্য নহে] ও ত্ৰৈলোক্যের অধিপতি। যিনি সর্ব্বলোকের শ্রেষ্ঠ ও অদ্বিতীয়, কোন ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখীন হইতে পারে? মহাবীর অর্জ্জুন একরথে অধিরূঢ় হইয়া জলদ্গম্ভীরনির্ঘোস পতঙ্গসঙ্ঘের ন্যায় দ্রুতগামী শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক উত্তরদিক ও হিমালয়প্রদেশবাসী উত্তর-কুরুদিগকে পরাজয়পূর্ব্বক তাহাদের ধনসম্পত্তি হরণ করিয়াছেন, দ্রাবিড়দেশীয় লোকদিগকে স্বীয় সৈনিকদলের অন্তর্গত করিয়াছেন এবং ইন্দ্ৰপ্ৰমুখ নিখিল দেবগণকে পরাজিত করিয়া অখণ্ড খাণ্ডবারণ্য হুতাশনমুখে উপহারপ্রদানপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের যশোবিস্তার ও মানবৰ্দ্ধন করিয়াছেন।
“ভীম গদাযুদ্ধের ন্যায় হস্তী-অশ্ব-আরোহণেও অদ্বিতীয়। তিনি রথারোহণে অর্জ্জুন অপেক্ষা হীনবল নহেন এবং বাহুবলে অযুতনাগসদৃশ। মহাবলপরাক্রান্ত সুশিক্ষিত ভীমসেনের সহিত শত্ৰুতাচরণপূর্ব্বক তাহারা ক্রোধানল প্ৰজ্বলিত করিলে ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা [ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ] ভক্ষ্মীভূত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। সাক্ষাৎ ইন্দ্রও অমর্ষপূৰ্ণ [ক্ৰোধ] ভীমসেনকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয়েন না। যেমন শ্যেন অন্য পক্ষিসমূহকে বিনষ্ট করে, সেইরূপ সুশিক্ষিত লঘুহস্ত [ক্ষিপ্ৰহস্ত] মাদ্রীতনয়যুগল আরাতিকুল অনায়াসে নির্ম্মূল করিতে পারেন।
“ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি মহাবল বীরপুরুষেরা আমাদিগের সম্পূর্ণ সহায়তা করিবেন যথার্থ বটে; কিন্তু পাণ্ডবগণের সহিত তুলনা করিলে ইহাদিগকে অতি সামান্য বোধ হয়। সোমকশ্রেষ্ঠ মহাবল ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবগণের পরম হিতৈষী। শুনিয়াছি, তিনি ভৃত্য, অমাত্য ও আত্মসমর্পণ করিয়াও পাণ্ডবগণের উপকার করিবেন। বিশেষতঃ বৃষ্ণিসিংহ [বৃষ্ণিবংশের শ্রেষ্ঠ] কৃষ্ণ যাঁহাদিগের সহায়, তাঁহাদিগের প্রতাপ সহ্য করা কাহার সাধ্য?
“মৎস্যাধিপতি বিরাট পাণ্ডবগণের সহিত একত্রবাসে যথেষ্ট উপকৃত হইয়াছেন; এ নিমিত্ত তাঁহারা পিতাপুত্রে যুধিষ্ঠিরকে সাতিশয় ভক্তি করিয়া থাকেন এবং কার্য্যকালে পাণ্ডবদিগের অর্থসিদ্ধির নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করিবেন, সন্দেহ নাই। মহাবলপরাক্রান্ত কেকয়েরা পঞ্চভ্রাতা পূর্ব্বে আমাদিগের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু তাঁহারা কেকয়দেশ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া অবধি যুদ্ধদ্বারা রাজ্যপ্ৰাপ্তিকামনায় পাণ্ডবপক্ষ আশ্রয় করিয়াছেন। পাণ্ডবদিগের সাহায্যাৰ্থ নানাদেশ হইতে মহাবীর ভূপতিগণ সমানীত হইয়াছেন। তাঁহারা ধর্ম্মরাজের প্রতি দৃঢ়তর ভক্তি ও অকপট প্রীতি প্রকাশ করিয়া থাকেন। পৃথিবীস্থ সমস্ত সুপ্ৰসিদ্ধ বৃদ্ধসমূহ, পার্ব্বতীয় ও দুৰ্গনিবাসী যোদ্ধারা এবং নানায়ুধধারী বলবান ম্লেচ্ছগণ পাণ্ডবার্থ আনীত হইয়া সৈন্যমধ্যে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। আলোকসামান্য বীৰ্য্যসম্পন্ন ইন্দ্ৰকল্প মহাত্মা পাণ্ড্য পাণ্ডবগণের হিতাৰ্থ সৈন্যসামন্তসমভিব্যাহারে সমরে সমাগত হইয়াছেন। যিনি দ্রোণ, কৃপ, বাসুদেব, অর্জ্জুন ও ভীষ্মের নিকট অস্ত্ৰশিক্ষা করিয়াছেন, লোকে যাঁহাকে প্ৰদ্যুম্নসদৃশ বলিয়া বোধ করিয়া থাকে, সেই সাত্যকি পাণ্ডবগণের অর্থসিদ্ধির নিমিত্ত যুদ্ধে ব্ৰতী হইয়াছেন।
“পূর্ব্বে রাজসূয় যজ্ঞে চেদিরাজ ও করূষকপ্রভৃতি যেসমস্ত ভূপাল সর্ব্বপ্রকার উদ্যোগবিশিষ্ট হইয়া বহুসংখ্যকবীরপুরুষসমভিব্যাহারে একত্র সমবেত হইয়াছিলেন, তন্মধ্যে চেদিরাজতনয় সূৰ্য্যের ন্যায় প্রতাপশালী, শ্রেষ্ঠ ধনুৰ্দ্ধর ও যুদ্ধে অজেয়। ভগবান কৃষ্ণ ক্ষণকালমধ্যে তাঁহাকে পরাজয় করিয়া ক্ষত্ৰিয়গণের উৎসাহ ভগ্ন করিয়াছেন এবং করুষরাজপ্রমুখ নরেন্দ্ৰবৰ্গ যে শিশুপালের সম্মানবৰ্দ্ধন করিয়াছেন, তাঁহারা সিংহস্বরূপ কৃষ্ণকে রথারূঢ় নিরীক্ষণ করিয়া চেদিপতিকে পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্ষুদ্র মৃগের ন্যায় পলায়ন করিলে, তিনি তখন অবলীলাক্রমে শিশুপালের প্রাণসংহারপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের যশ ও মান বৰ্দ্ধন করিলেন।
“সেই কৃষ্ণ এক্ষণে পাণ্ডবপক্ষ রক্ষা করিতেছেন, কোন শক্ৰ বিজয়াভিলাষী হইয়া দ্বৈরথযুদ্ধে তাঁহার সম্মুখীন হইবে? হে সঞ্জয়! কৃষ্ণ পাণ্ডবার্থ যেরূপ পরাক্রম প্রকাশ করেন, তাহা আমি শ্রবণ করিয়াছি। তাঁহার কাৰ্য্য অনুক্ষণ স্মরণ করিয়া আমি শান্তিলাভে বঞ্চিত হইয়াছি; কৃষ্ণ যাঁহাদিগের অগ্রণী, কোন ব্যক্তি তাঁহাদিগের প্রতাপ সহ্য করিতে সমর্থ হইবে? কৃষ্ণ অর্জ্জুনের সারথ্য স্বীকার করিয়াছেন শুনিয়া ভয়ে আমার হৃদয় কম্পিত হইতেছে। আমার পুত্ৰ দুর্বুদ্ধিপরতন্ত্র; এক্ষণে যদি সে তাঁহাদিগের সহিত যুদ্ধ না করে, তাহা হইলেই মঙ্গল; নতুবা যেমন ইন্দ্র ও বিষ্ণু সমুদয় দৈত্যসেনা নিহত করিয়াছিলেন, সেইরূপ তাহারাও কুরুকুল নির্ম্মূল করিবেন সন্দেহ নাই। অর্জ্জুন, বাসুদেব ও ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির একমাত্র দুৰ্য্যোধনের অপরাধে ক্রুদ্ধ হইয়া যদি সমুদয় ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে প্রহার না করেন, তাহা হইলে আমি তাঁহাদিগকে সাক্ষাৎ ধর্ম্ম ও দয়াস্বরূপ বোধ করিব।
“হে সঞ্জয়! রাজা যুধিষ্ঠিরের ক্রোধানল প্ৰদীপ্ত হইলে আমার অন্তঃকরণে যেমন ভয়সঞ্চার হয়, বাসুদেব, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব হইতে তাদৃশ ভয় হয় না। যুধিষ্ঠির মহাতপাঃ ও ব্ৰহ্মচৰ্য্যসম্পন্ন, তাঁহার সঙ্কল্প অবশ্যই সিদ্ধ হইয়া থাকে। হে সঞ্জয়! তাঁহার এই ক্ৰোধ ন্যায়ানুগত বিবেচনা করিয়া আমি সাতিশয় ভীত হইতেছি। তুমি শীঘ্র রথারোহণপূর্ব্বক পাঞ্চালরাজ্যের সেনানিবেশে গমন করিয়া প্রীতিপ্ৰসন্ন বাক্যে পুনঃ পুনঃ যুধিষ্ঠিরকে কুশল জিজ্ঞাসা করিবে এবং কৃষ্ণের নিকট গমন করিয়া অনাময়প্রশ্নপূর্ব্বক কহিবে, রাজা ধৃতরাষ্ট্র সর্ব্বদাই পাণ্ডবগণের শান্তি বাসনা করিতেছেন। কৃষ্ণ পাণ্ডবগণের প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তম ও সতত তাঁহাদিগের কাৰ্য্যে নিযুক্ত আছেন। অতএব তিনি যাহা কহিবেন, ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির তাহার কিছুমাত্র অন্যথা করিবেন না। অনন্তর অন্যান্য পাণ্ডব, সৃঞ্জয়, বিরাট ও দ্ৰৌপদেয়দিগকে কহিবে, রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাদিগের কুশল জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। হে সঞ্জয়! যাহাতে যুদ্ধানল প্রজ্বলিত না হয় এবং ভারতগণের হিতলাভ হইতে পারে, তুমি উপযুক্ত অবসর বিবেচনা করিয়া রাজগণমধ্যে সেইরূপ বাক্য প্রয়োগ করিবে।”