শুন শুন মহারাজ অপূর্ব্ব কথন।
মালিনী ভবনে বঞ্চে শ্রীবৎস রাজন।।
মালা গাঁথি করে রাজা কালের হরণ।
ফুল ফল জলে রাজা পূজে নারায়ণ।।
কায়মনোবাক্যে রাজা ধর্ম্ম নাহি ত্যজে।
আপনা গোপন করি রহে ধর্ম্মকাজে।।
শুন ধর্ম্ম মহীপাল অপূর্ব্ব ঘটন।
ভদ্রাবতী কন্যার শুনহ বিবরণ।।
ভোজনে বসেছে বাহুদেব মহীপাল।
পরিবেশনে আসে ভদ্রা, হাতে স্বর্ণথাল।।
রাণীজ্ঞান করি রাজা করে হরিহাস।
কান্দিয়া কহিল ভদ্রা জননীর পাশ।।
শুনি রাণী ক্রোধচিত্তে করেন গমন।
ভৎসয়া নৃপতি প্রতি কহিছে বচন।।
শুন মহারাজ তুমি রাজপদে মজি।
সকলি করিলে নষ্ট ধর্ম্মপথ ত্যজি।।
পরকালবন্ধু ধর্ম্ম তাহে করি হেলা।
বিষয়ে হইলে মত্ত, রাজভোগে ভোলা।।
জান না যে মহারাজ আছয়ে শমন।
কি বোল বলিবে কালে না ভাব এখন।।
এমন কুকর্ম্ম রাজা কেহনা আচরে।
আপনার তনয়ারে পরিহাস করে।।
সুপাত্র আনিয়া যদি কন্যা কর দান।
চিরদিন স্বর্গভোগ, বৈকুন্ঠেতে স্থান।।
ইহা না করিয়া তারে কর পরিহাস।
ধিক্ ধিক্ রাজ তব জীবনে কি আশ।।
এমত শুনিয়া রাজা রাণীর বচন।
লজ্জিত হইয়া রাজা কহিছে তখন।।
শুন শুন মহাদেবি আমার বচন।
মিথ্যাভাষে মোরে তুমি করহ লাঞ্ছন।।
এত বড় যোগ্য কণ্যা আছে মম ঘরে।
এক দিন মহাদেবি না কহ আমারে।।
আমি ধর্ম্ম হেলা নাহি করি যে কখন।
জানেন আমার মন সেই নারায়ণ।।
আজি আমি কন্যার কবির স্বয়ন্বর।
এত বলি বাহিরে চলিল নৃপবর।।
ডাকাইয়া পাত্র মন্ত্রী আনিয়া সকল।
সবারে কহিল আমন্ত্রহ ভূমণ্ডল।।
ইচ্ছাবরী হইবেক আমার নন্দিনী।
আনন্দিত হৈল সবে এই কথা শুনি।।
আজ্ঞা পেয়ে নিমন্ত্রণ করিল সবার।
যতদূর পাইলেক মনুষ্য সঞ্চার।।
নিমন্ত্রণ পাইয়া যতেক রাজগণ।
বাহুদেব রাজ্যে সবে করিল গমন।।
নিরবধি আসে রাজা, কত লব নাম।
কলিঙ্গ তৈলঙ্গ আর সৌরাষ্ট্র ভূধাম।।
দ্রাবিড় মগধ মৎস্য কর্ণাট ভূপাল।
গুজরাট মহারাষ্ট্র কাশ্মীর পাঞ্চাল।।
চতুরঙ্গ দলে আসে যত নৃপগণ।
উপযুক্ত গৃহ দিল করি নিরূপণ।।
হর্ষিত হইল সবে পেয়ে রম্যস্থান।
ভক্ষ্য ভোজ্য যত দিল, নাহি পরিমাণ।।
কেবা খায়, কেবা লয়, কেবা দেয় আনি।
খাও খাও, লও লও, এই মাত্র শুনি।।
আড়ে দীর্ঘে দশ ক্রোশ পুরী পরিমাণ।
প্রতি মঞ্চে প্রতি রাজা করে অধিষ্ঠান।।
সবাকারে বিধিমতে পূজিল রাজন।
আনন্দ সাগর নীরে ভাসে রাজগণ।।
নানা কথা আলাপনে বসে সর্ব্বজন।
অধিবাস হেতু রাজা করিল গমন।।
কন্যা অধিবাস করি ষষ্ঠ্যাদি অর্চ্চন।
ঘোড়শ মাতৃকা পূজা গন্ধাধিবাসন।।
অগ্নি পূজি গেল রাজা সভায় তখন।
মালিনীর মুখে শুনে শ্রীবৎস রাজন।।
শুনিয়া দেখিব বলি বাঞ্ছা কৈল চিত্তে।
রাজকন্যা ইচ্ছাবরী হয় কোন পাত্রে।।
যতেক নৃপতিগণ সভায় আসিল।
কদম্ব তরুর মূলে শ্রীবৎস বসিল।।
মনোযোগ কর রাজা ধর্ম্মের নন্দন।
বিধির নির্ব্বন্ধ কর্ম্ম কে করে খণ্ডন।।
হাতে চন্দনের পাত্র মালার সহিত।
সভামধ্যে ভদ্রাবতী হৈল উপনীত।।
ভদ্রার রূপের কথা বর্ণন না যায়।
তিলোত্তমা শচীদেবী তার তুল্য নয়।।
লক্ষ্মী-অংশে জন্মি ভদ্রা আইলা অবনী।
রাজার ঋণেতে মুক্তি বাঞ্ছি নারায়ণী।।
সভামধ্যে আসি ভদ্রা করে নিবেদন।
এ সভাতে দেব দ্বিজ আছ যত জন।।
সকলে জানিবে যে আমার নমস্কার।
আজ্ঞা কর, আমি পাই পতি আপনার।।
এত বলি চতুর্দ্দিকে করে নিরীক্ষণ।
হেনকালে শূন্যবাণী হইল তখন।।
কদম্ব-তরুর তলে তোমার ঈশ্বর।
যার লাগি কৈলে তপ দ্বাদশ বৎসর।।
শুনি স্মিতমুখী ভদ্রা করিল গমন।
যথায় বসিয়া আছে শ্রীবৎস্য রাজন।।
নিকটেতে গিয়া ভদ্রা প্রদক্ষিণ করে।
দিলেক চন্দন মাল্য চরণ উপরে।।
দণ্ডবৎ করি ভদ্রা রহে দাণ্ডাইয়া।
যতেক সভার লোক উঠিল হাসিয়া।।
ছি ছি করি দুষ্ট রাজা নিন্দিল অপার।
শিষ্টজন কহে এই কর্ম্ম বিধাতার।।
কাহার ইচ্ছায় কিবা হইবারে পারে।
বিধির নির্ব্বন্ধ কেহ খণ্ডাইতে নারে।।
কায়ার সহিত যেন ছায়ার গমন।
কর্ম্মের নির্ব্বন্ধ এই জানিবে তেমন।।
এইরূপে কথার আলাপে সর্ব্বজন।
যার যেই দেশে যাত্রা কৈল রাজগণ।।
বাহুদেব রাজা চিত্তে অনুতাপ করি।
শীঘ্রগতি উঠি যান নিজ অন্তঃপুরী।।
কহেন কান্দিয়া রাজা মহাদেবী স্থান।
ভদ্রার কপালে হেন কৈল ভগবান।।
এত রাজগণ ছিল, না বরিল কায়।
অন্টত্যজ দেখিয়া চিত্ত মজাইল তায়।।
পুরুষে পুরুষে মোর রহিল অখ্যাতি।
হেন ইচ্ছা হয় মোর, গলে দিই কাতি।।
রাণী কহে, মহারাজ করহ শ্রবণ।
তব চিন্তা মম চিন্তা সব অকারণ।।
হইবে যখন যাহা ঈশ্বরের ইচ্ছা।
তুমি আমি যত চিন্তি, এ সকল মিছা।।
হেলায় সৃজন যার, হেলায় সংহার।
বুঝিবে তাঁহার মায়া, হেন শক্তি কার।।
ভদ্রা তনয়ার বুদ্ধি দিয়াছেন তিনি।
চিন্তা করি কি করিব এবে তুমি আমি।।
রাণীর প্রবোধ বাক্য শুনিয়া রাজন।
মন্ত্রীকে করিল আজ্ঞা শুন সর্ব্বজন।।
বাহিরে আবাস করি দেহত ভদ্রার।
ভক্ষ্য ভোজ্য দেহ শীঘ্র যাহা চাহি তার।।
পুরীর ভিতর আর নাহি প্রয়োজন।
হয়েছে সভার মধ্যে মস্তক মুণ্ডণ।।
ভদ্রা কন্যা মুখ আমি না দেখিব আর।
বিধাতা করিল মোরে অন্তঃপুরী সার।।
এত কাল ভগবতী করি আরাধন।
কুজাতি কুরূপ বরে বরিল এখন।।
এ সব ভাবিয়া নাহি রুচে অন্নজল।
ইচ্ছা করি আজি মরি প্রবেশি অনল।।
লোক মাঝে মুখ দেখাইব কোন লাজে।
এ ছার জীবন মোর থাকে কোন কাজে।।
হায় হায় বিধি কেন কৈল হেন রূপ।
ভদ্রা কন্যা লিাগি এল কত শত ভূপ।।
কারে না বরিয়া কৈল দরিদ্রে বরণ।
এমত ভাবিয়া রাজা কান্দয়ে তখন।।
রাণী বলে, মহারাজ হলে হতজ্ঞান।
কারণ করণ কর্ত্তা সেই ভগবান।।
হেলায় সৃজন যাঁর, হেলায় সংহার।
কে বুঝিতে পারে চিত্ত চরিত্র তাঁহার।।
তুমি আমি কর্ম্মপাশে আছি যে বন্ধনে।
মায়ার কারণ এত চিন্তা করি মনে।।
কেবা কার ভাই বন্ধ, কেবা কার পিতা।
অনর্থের হেতু মাত্র বিষয়কামিতা।।
মায়া মোহ ত্যজ রাজা, ধর্ম্ম কর সার।
যাহা হতে সংসার সমুদ্র হবে পার।।
এইমত বুঝাইয়া মহিষী রাজনে।
বাহির উদ্যানে গেলা ভদ্রা সন্নিধানে।।
দেখিল আছয়ে ভদ্রা স্বামী বিদ্যমানে।
ইষ্টলাভে মুগ্ধা, নাহি চাহে কারো পানে।।
দেখিয়া রাণীর অতিশয় দুঃখ হৈল।
কোলে নিয়া নিজ বস্ত্রে মুখ মুছাইল।।
জামাতা কন্যাকে নিয়া বাহির আবাসে।
রাখিয়া মধুর ভাষে দোঁহাকারে তোষে।।
এক গৃহে থাক ভদ্রা না ভাবিহ দুঃখ।
দিন কত হৈলে গত পাবে বড় সুখ।।
গৌরী আরাধনা ফল মিথ্যা না হইবে।
কতদিন পরে ভদ্রা রাজরাণী হবে।।
এইরূপে নন্দিনীকে তুষি মহারাণী।
ভিতর মহলে যান যথা নৃপমণি।।
রাজা বলে, মোর ভদ্রা গেল কোথাকারে।
রাণী বলে, রেখে এনু বাহির আগারে।।
ভক্ষ্য ভোজ্য নিয়োজিত করি দিল লোকে।
নিত্য নিত্য পুরী হৈতে নিয়া দিবে তাকে।।
এই মত দুই জন রহিল বাহিরে।
দেখ যুধিষ্ঠির রাজা দৈবে কি না করে।।
বনপর্ব্বে অপূর্ব্ব শ্রীবৎস উপাখ্যান।
কাশী কহে, শুনিলে জন্ময়ে দিব্যজ্ঞান।।