২১তম অধ্যায়
শাল্বমায়ায় কৃষ্ণের সম্মোহ
বাসুদেব কহিলেন, “হে রাজন! মহারিপু শাল্বরাজ আমার সহিত এইরূপ ঘোরতর সংগ্ৰাম করিয়া পরিশেষে আকাশমার্গে প্রস্থান করিল। সেই বিজিগীষু মন্দবুদ্ধি রোষপরবশ হইয়া গদা, শূল, অসি প্রভৃতি অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰসকল আমার প্রতি নিক্ষেপ করিবামাত্র আমি তৎক্ষণাৎ সমুদয় আকাশগামী অস্ত্রে নির্য্যাকরণপূর্ব্বক অন্তরীক্ষেই খণ্ড খণ্ড করিলাম, তাহাতে নভোমণ্ডল মহানিনাদে পরিপূর্ণ হইতে লাগিল। অনন্তর সৌভেশ্বর নতপর্ব্ব শতসহস্র শরদ্বারা আমার অশ্ব, রথ ও সারথিকে আকীর্ণ করাতে দারুক ভয়বিহ্বল হইয়া আমাকে কহিল, “হে বীর! শাল্বের বাণে যৎপরোনাস্তি নিপীড়িত হইয়াছি, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসকল অবসন্ন হইতেছে, আর অবস্থিতি করিতে পারি না, তবে কেবল রাণত্যাগ করিয়া প্ৰস্থান করিতে নাই বলিয়াই রহিয়াছি।” সারথির এবংবিধ কাতরোক্তি-শ্রবণে তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলাম যে, দারুকের আপাদমস্তক সমস্ত শরীর বাণে বিদ্ধ রহিয়াছে। সে দুর্ব্বিষহ বাণপীড়ায় নিতান্ত পীড়িত হইয়া রশ্মিধারণপূর্ব্বক অনবরত রক্ত বমন করিতেছে। তাহার সর্ব্বাঙ্গ শোণিতসিক্ত হওয়াতে যেন বৃষ্টিধারাবিগলিত-গৈরিক-ধাতুনিঃস্রব-সংযুক্ত পর্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতেছে। হে মহারাজ! সারথিকে তদাবস্থ নিরীক্ষণ করিয়া আমি সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলাম।
“অনন্তর দ্বারকাবাসী একজন আহুকপরিচারক রথারোহণপূর্ব্বক বিষণ্নভাবে সত্বর আসিয়া সুহৃদের ন্যায় গদগদম্বরে আমাকে কহিতে লাগিল, “হে মহাবীর কেশব! পিতৃসখা দ্বারকাধিপতি আহুক আপনাকে যাহা কহিয়াছেন, শ্রবণ করুন। হে বৃষ্ণিনন্দন! অদ্য আপনার অনুপস্থিতিরূপ অবকাশে, শাল্বরাজ দ্বারকায় উপনীত হইয়া বলপূর্ব্বক শূরসুতকে নিহত করিয়াছে; অতএব যুদ্ধে আর প্রয়োজন নাই, আপনি ক্ষান্ত হউন, এক্ষণে দ্বারকা রক্ষা করাই আপনার প্রধান কাৰ্য্য।”
“আমি আগন্তুকের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া সাতিশয় দুৰ্ম্মনা হইয়া কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্যের নিশ্চয় করিতে পারিলাম না। সেই মহৎ অপ্রিয় বাক্য শুনিয়া সাত্যকি, বলদেব ও মহারথ প্ৰদ্যুম্নকে মনে মনে কতই নিন্দা করিতে লাগিলাম; যেহেতু আমি তাহাদিগের প্রতি দ্বারকা ও পিতার রক্ষণাবেক্ষণের ভারার্পণ করিয়া সৌভনিপাতনে নিৰ্গত হইয়াছিলাম। এক্ষণে মহাবল বলদেব, সাত্যকি, রৌক্সিণেয়, চারুদেষ্ণ ও শাম্ব প্রভৃতি বীরপুরুষেরা জীবিত আছেন কি না, এই ভাবনায় আমার অন্তঃকরণ একান্ত উদভ্ৰান্ত হইল। তাঁহারা সকলে জীবিত থাকিতে স্বয়ং বজ্রধারীও শূরসূতকে নিহত করিতে সমর্থ হয়েন না। অতএব এখন নিশ্চয় বুঝিলাম যে, শূরসূত পঞ্চোত্বপ্রাপ্ত হইয়াছেন এবং বলদেব-প্রমুখ সকলেই সমরে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন। মহারাজ! অনুক্ষণ সেই অতর্কিতচর [অভাবনীয়] সর্ব্বনাশ চিন্তা করিয়া আমি নিতান্ত বিহ্বল হইয়া পুনরায় শাল্বসহ সমরসাগরে অবগাহন করিতেছি, ইত্যবসরে দেখিলাম, ক্ষীণপুণ্য যযাতি যেমন স্বৰ্গচ্যুত হইয়া মহীতলে পতিত হইয়াছিলেন, তদ্রূপ সৌভ হইতে শূরসূত নিপতিত হইতেছেন। তাহার উষ্ণীষ মলীমস [মলিন], পরিধেয় বস্ত্ৰ শিথিল ও মুৰ্দ্ধজসকল [কেশ] ইতস্ততঃ বিকীর্ণ হইয়াছে। পতনকালে তদীয় বাহুযুগল ও পাদদ্বয় প্রসারিত হওয়াতে তাঁহার রূপ শকুনির রূপের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল; তদর্শনে আমার করতল হইতে শার্ঙ্গ স্বলিত হইল ও আমি মুর্চ্ছাপন্ন হইয়া রথোপন্থে উপবেশন করিলাম। আমাকে মৃতকল্প দেখিয়া সৈন্যেরা হাহাকার করিতে লাগিল। হে মহাবাহো! শূলপট্টিশধারী শত্রুপক্ষীয় লোকেরা পিতাকে অত্যন্ত আঘাত করাতে আমার চৈতন্যলোপ হইয়া গেল।
“ক্রমে মূর্চ্ছার অপনয়ন হইলে চতুর্দ্দিক অবলোকন করিলাম, কিন্তু কোথায় বা সৌভনগর, কোথায় বা সেই দুর্জ্জয় শত্রু শাল্ব ও কোথায় বা বৃদ্ধপিতা শূরসূত, সকলই স্বপ্নের ন্যায় জ্ঞান হইতে লাগিল। তখন নিশ্চয় জানিলাম যে, ইহা কেবল মায়ামাত্র। এইরূপে লব্ধসংজ্ঞা হইয়া পুনরায় বাণ-বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলাম।”