২১তম অধ্যায়
যজ্ঞার্থ দেবস্থানঋষির যুধিষ্ঠির অনুরোধ
দেবস্থান কহিলেন, “মহারাজ! দেবরাজ ইন্দ্র বৃহস্পতির নিকট জ্ঞানোপদেশ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কহিয়াছিলেন যে, সন্তোষ অতি সুখকর পদার্থ, সন্তোষ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পদার্থ আর কিছুই নাই। মনুষ্যের কামসকল কূৰ্ম্মের শুণ্ডাদির [কচ্ছপের মাথার] ন্যায় সঙ্কুচিত হইলেই আত্মজ্যোতিঃ প্রসন্ন হইয়া উঠে। যখন মনুষ্যের মনে ভয়ের লেশমাত্রও থাকে না এবং কাম ও দ্বেষ এককালে পরাজিত হইয়া যায়, তখনই আত্মার সহিত সাক্ষাৎকার হইয়া থাকে। আর যৎকালে প্রাণীগণের অনিষ্টবাঞ্ছা তিরোহিত হয় এবং কিছুতেই আকাঙ্ক্ষা থাকে না, সেই সময়েই ব্রহ্মজ্ঞান জন্মে।
“হে ধৰ্ম্মনন্দন! এইরূপে প্রাণীগণের মধ্যে যিনি যেরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তিনি তদনুরূপ ফললাভ করিয়া থাকেন; অতএব বিবেচনা করিয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়া অবশ্য কর্ত্তব্য। এই জগতে কেহ কেহ সন্ধির ও কেহ কেহ যুদ্ধের প্রশংসা করে এবং কেহ কেহ ঐ উভয়েরই প্রশংসা করে না। কেহ কেহ যজ্ঞ, কেহ কেহ সন্ন্যাসধৰ্ম্ম, কেহ কেহ দান ও কেহ কেহ প্রতিগ্ৰহকে উৎকৃষ্ট জ্ঞান করে। আর কেহ কেহ সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূৰ্ব্বক ধ্যান করিয়া থাকে। কেহ কেহ অরাতিগণের প্রাণ সংহারপূৰ্ব্বক রাজ্যগ্রহণ ও প্রজা প্রতিপালন এবং কেহ কেহ বা নির্জ্জনবাসকেই প্রশংসা করিয়া থাকে। বিদ্বান ব্যক্তিরা এই সমস্ত বিষয় সম্যক আলোচনা করিয়া অহিংসাকেই সাধুসম্মত পরমধর্ম্ম বলিয়া স্থির করিয়াছেন। স্বায়ম্ভুব মনুও অহিংসা, সত্যবাক্য, সম্যক্ রূপে বিভাগ, দয়া, দম, মৃদুতা, লজ্জা, অচঞ্চলতা এবং স্বয়ং স্বীয় পত্নীতে পুত্রোৎপাদন এই সকলকে প্রধান ধর্ম্ম বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। অতএব তুমি যত্নসহকারে এই সমস্ত ধর্ম্ম প্রতিপালন কর। যে রাজনীতিবেত্তা ক্ষত্রিয় জিতেন্দ্রিয় হইয়া স্বীয় রাজ্যমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক যজ্ঞাবশিষ্ট ভোজন, অসাধুগণের নিগ্রহ, সাধুগণের সম্মান ও ধৰ্ম্মানুসারে প্রজা প্রতিপালন করেন এবং বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রের প্রতি রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া বানপ্রস্থধর্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক বন্য ফলমূলদ্বারা জীবিকা নির্বাহে নিরত হয়েন, তিনি উভয় লোকেই কৃতকার্য্য হইয়া থাকেন। হে মহারাজ! আমার মতে মুক্তিপদ লাভ করা নিতান্ত কঠিন। উহাতে নানাপ্রকার বিঘ্ন ঘটিয়া থাকে; অতএব ভূপতিদিগের পক্ষে প্রজাপালনাদিই শ্রেয়ঃ। যাঁহারা সত্য, দান, তপস্যা ও অহিংসাদিগুণসম্পন্ন হইয়া কাম-ক্রোধ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মানুসারে প্রজা প্রতিপালন করেন এবং গো ও ব্রাহ্মণগণের জীবনরক্ষাৰ্থ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েন, তাঁহারা নিশ্চয়ই অতি উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিয়া থাকেন। রুদ্র, বসু, আদিত্য, সাধ্য ও রাজর্ষিগণও ঐ সকল ধৰ্ম্ম আশ্রয় করিয়াই স্বর্গ লাভ করিয়াছেন।”