২১তম অধ্যায়
দ্রোণের সহিত সত্যজিতের যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! তখন মহাবীর দ্রোণাচার্য্য যুধিষ্ঠিরকে সমীপে সমাগত দেখিয়া তাহার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাসিংহ গজযুথপতিকে আক্রমণ করিবার উদ্যোগ করিলে করিগণ যে রূপ শব্দ করে, যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণ সেই রূপ কোলাহল করিতে আরম্ভ করিল। সত্যবিক্রম সত্যজিৎ দ্রোণকে অবলোকন করিয়া যুধিষ্ঠিরের রক্ষাৰ্থ আচাৰ্য্যের প্রতি ধাবমান হইলে মহাবীর দ্রোণ ও সত্যজিৎ সৈন্যগণকে বিক্ষোভিত করত বলি ও ইন্দ্রের ন্যায় ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। সত্যবিক্রম সত্যজিৎ নিশিতাস্ত্র সায়ক দ্বারা দ্রোণকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার সারথির উপরে সর্পবিষসদৃশ সাক্ষাৎ কৃতান্তসম পাঁচ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। সারথি সত্যজিতের বাণাঘাতে মূর্চ্ছাপন্ন হইল। অনন্তর মহাবীর সত্যজিৎ দ্রোণের অশ্বগণকে দশ ও উভয় পার্ষ্ণি সারথিকে দশ দশ বাণে বিদ্ধ করিয়া মণ্ডলাকার গমনে বিচরণপূর্ব্বক ক্রুদ্ধ চিত্তে আচার্য্যের ধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
দ্রোণকর্ত্তৃক সত্যজিতের প্রাণ-সংহার
মহাবীর দ্রোণাচার্য্য সমরে সত্যজিতের কাৰ্য্য সন্দর্শনে তাঁহাকে কালপ্রাপ্ত বোধ করিয়া অবিলম্বে তাঁহার সশর শরাসন ছেদন পূর্ব্বক মৰ্ম্মভেদী সুতীক্ষ্ন দশ শরে তাঁহার কলেবর বিদ্ধ করিলেন। মহাপ্রতাপশালী সত্যজিৎ সত্বরে অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া দ্রোণের উপর কঙ্কপত্ৰযুক্ত ত্রিংশৎ শর নিক্ষেপ করিলেন। পাণ্ডবগণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে সত্যজিৎ কর্ত্তৃক আক্রান্ত দেখিয়া হৃষ্ট চিত্তে বীরনাদ ও বসন কম্পন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর বৃক ক্রোধভরে দ্রোণের বক্ষস্থলে ষষ্টিবাণ বিদ্ধ করিলেন। উহা অদ্ভুতের ন্যায় প্রতীয়মান হইল। এই রূপে মহারথ দ্রোণ শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া ক্রোধে নেত্রদ্বয় উদ্বর্ত্তন পূর্ব্বক মহাবেগে সত্যজিৎ ও বৃকের শরাসন ছেদন করিয়া ছয় বাণে সারথি ও অশ্ব সমুদায় সমভিব্যাহারে তাঁহাকে সংহার করিলেন। তখন মহাবীর সত্যজিৎ সত্বরে অন্য শরাসন গ্রহণ পূর্ব্বক দ্রোণাচার্যের এবং তাঁহার অশ্ব সমুদায়, সারথি ও ধ্বজের উপর নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবীর দ্রোণ সমরে সত্যজিতের প্রহার সহ করিতে না পারিয়া তাঁহার বধের নিমিত্ত সত্বরে অশ্ব, ধ্বজ, শরাসনমুষ্টি এবং পার্ঞ্চি সারথিদ্বয়ের উপর শরনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। এই রূপে দ্রোণাচার্য্য বারংবার শরাসন ছেদন করাতে মহাবীর সত্যজিৎ ক্রোধভরে দ্রোণের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। বীর বরাগ্রগণ্য দ্রোণাচার্য্য সংগ্রামে সত্যজিৎকে তাদৃশ প্রভাব সম্পন্ন দেখিয়া ক্রোধভরে অর্দ্ধচন্দ্র বাণে তাঁহার মস্তক ছেদন করিলেন।
শতানীক বধ – যুধিষ্ঠির পলায়ন
এই রূপে মহারথ সত্যজিৎ নিহত হইলে মহারাজ যুধিষ্ঠির দ্রোণের ভয়ে ভীত হইয়া মহাবেগে পলায়ন করিতে লাগিলেন। পাঞ্চাল, কেকয়, মৎস্য, চেদি, করূষ ও কোশলগণ যুধিষ্ঠিরের রক্ষাৰ্থ দ্রোণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। হুতাশন যেমন তুলারাশি দহন করে, তদ্রূপ মহাবীর দ্রোণচার্য্য যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিবার বাসনায় সেই সমাগত সৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। তখন মৎস্যরাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহাবীর শতানীক দ্রোণকে বারংবার সৈন্য সংহার করিতে নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার সমীপে আগমন পূর্ব্বক দুষ্কর কর্ম্ম সম্পাদনের বাসনায় কৰ্ম্মার পরিমার্জিত, সূৰ্য্যরশ্মি সমপ্রভ ছয় বাণে তাঁহাকে, তাঁহার সারথিকে ও অশ্বসমুদায়কে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করত পুনরায় দ্রোণের উপর শরবর্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য সত্বরে ক্ষুর নিক্ষেপ করিয়া সতানিকের কুণ্ডল সুশোভিত মস্তক ছেদন করিলেন। মৎস্যগণ তদ্দর্শনে ভীত হইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।
মহাবীর দ্রোণাচার্য্য এইরূপে মৎস্যগণকে পরাজয় করিয়া চেদী, কারূষ, কৈকয় পাঞ্চাল, সৃঞ্জয় ও পাণ্ডব সৈন্যগণকে বারংবার পরাজয় করিতে লাগিলেন। সৃঞ্জয়গণ ক্রোধান্বিত মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্যকে হুতাশনের বনদহনের ন্যায় সৈন্যগণকে সংহার করিতে দেখিয়া সত্বরে সুসজ্জিত হইতে লাগিল। অমিত্র নিহন্তা মহাবীর দ্রোণাচার্য্যের শরাসন নিস্বন চতুর্দ্দিকে শ্রুত হইল। তাঁহার হস্ত বিনিক্ষিপ্ত সায়ক সমুদায় অসংখ্য অশ্ব, হস্তি, রথ ও পদাতিগণকে সংহার করিল। গ্রীষ্ম কালে প্রবল বায়ুবেগ সঞ্চালিত জলধর পটল যেমন শিলা বৃষ্টি করে তদ্রূপ মহাধনুর্দ্ধর, মহাবাহু, মিত্রগণের অভয়প্ৰদ, মহাবীর দ্রোণ শর বর্ষণ পূর্ব্বক ইতস্তত ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার হেমমণ্ডিত শরাসন অভ্রমধ্যস্থিত বিদ্যুতের ন্যায় চতুর্দ্দিকে দৃষ্ট হইতে লাগিল। তাঁহার ধ্বজস্থিত বেদী হিমবানের শৃঙ্গের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। সুরাসুর নমস্কৃত মহা প্রভাবশালী বিষ্ণু যেমন দানবদল দলন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাবীর দ্রোণাচার্য্য পাণ্ডব সেনাগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। মহাপ্রাজ্ঞ, সত্যপরাক্রম দ্রোণাচার্য্যের অস্ত্র প্রভাবে রণস্থলে অসংখ্য শৃগাল, কুক্কুর, ক্ৰব্যাদ ও পিশিতাশনগণে সংঙ্কীর্ণা, মানব-কূলাপহারিণী, ভীরুজন
ভয়প্রদা শমন সদন গামিনী নদী প্রবাহিত হইল; কবচ সমুদায় তরঙ্গ স্বরূপ, ধ্বজ সমুদায় আবৰ্ত্ত স্বরূপ, গজ ও বাজি সমুদায় গ্রাহস্বরূপ, অসি সকল মীন স্বরূপ, বীরগণের অস্থি সকল কর্কর স্বরূপ ভেরী ও মুরজ সমুদায় কচ্ছপ স্বরূপ, চর্ম্ম ও বৰ্ম্ম সকল প্লব স্বরূপ, কেশকলাপ শৈবাল ও সাদ্বল স্বরূপ, শর সমুদায় বেগ স্বরূপ, শরাশন সকল স্রোত স্বরূপ, বাহু সমুদায় পল্লব স্বরূপ, নিহত নরগণের মস্তক সকল শিলা স্বরূপ, উরু সকল মীন স্বরূপ, গদা সকল উড়ুপ স্বরূপ, উষ্ণীষ নিচয় ফেন স্বরূপ, অস্ত্র সমুদায় সরীসৃপ স্বরূপ, মাংস ও শোণিতরাশি কর্দ্দম স্বরূপ, কেতু সকল বৃক্ষ স্বরূপ ও সাদিগণ তাহার নক্র স্বরূপ হইয়া শোভা পাইতে লাগিল।
তখন পাণ্ডুনন্দনগণ অন্যান্য বীরগণ সমভিব্যাহারে দ্রোণ কৃতান্তের ন্যায় সৈন্যগণকে সংহার করিতেছেন নিরীক্ষণপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক হইতে তাহার অভিমুখীন হইয়া সেই ভুবন তপন দিনকর সদৃশ প্রতাপশালী মহাবীরকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। কৌরব পক্ষ রাজা ও রাজপুত্রগণ তদ্দর্শনে সকলে সমবেত হইয়া দ্রোণের রক্ষাৰ্থ তাঁহার চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর শিখণ্ডী পাঁচ, ক্ষত্রবর্ম্মা বিংশতি, বসুদান পাঁচ, উত্তমৌজা তিন, ক্ষত্রদেব পাঁচ সাত্যকি শত, যুধামন্যু আট, যুধিষ্ঠির, দ্বাদশ, ধৃষ্টদ্যুম্ন দশ ও চেকিতান তিন বাণে দ্রোণকে বিদ্ধ করিলেন।
দ্রোণকর্ত্তৃক দৃঢ়সেন প্রমুখ বীরগণের বিনাশ
মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য বীরগণের বাণাঘাতে মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া রথ সৈন্য অতিক্রমন পূর্ব্বক দৃঢ়সেনকে নিপাতিত করিলেন। পরে সহসা ভূপতি ক্ষেমের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে নয় শরে বিদ্ধ করাতে তিনি তৎক্ষণাৎ নিহত হইয়া রথ হইতে ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন অন্যের অরক্ষণীয় মহাবীর দ্রোণ চতুর্দ্দিক বিচরণ পূর্ব্বক সৈন্যগণের মধ্যস্থলে সমুপস্থিত অন্যান্য বীরগণকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। ঐ মহাবীর শিখণ্ডীকে দ্বাদশ, উত্তমৌজাকে বিংশতি শরে বিদ্ধ করিয়া ভল্ল দ্বারা বদানকে সংহার করিলেন অনন্তর অশীতিশরে ক্ষেমবর্ম্মাকে ও ষড়বিংশতি শরে সুদক্ষিণকে বিদ্ধ এবং ভল্ল দ্বারা ক্ষত্রদেবকে রথ হইতে নিপাতিত করিয়া যুধামন্যুর উপর চতুঃষষ্টি ও সাত্যকির উপর ত্রিশ বাণ নিঃক্ষেপ পূর্ব্বক সত্বরে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহারাজ ধর্ম্মনন্দন সত্বরে বেগবান্ অশ্ব সমুদায় সঞ্চালন পূর্ব্বক দ্রোণের সমীপ হইতে প্রস্থান করিলেন।
ঐ সময় মহাবীর পাঞ্চাল তনয় দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলে মহাবাহু দ্রোণ তাঁহাকে শরাসন, অশ্বগণ ও সারথির সহিত অবিলম্বে শমন সদনে প্রেরণ করিলেন। মহাবীর পাঞ্চালনন্দন দ্রোণের শরে নিহত হইয়া আকাশ মণ্ডল হইতে পতিত জ্যোতির ন্যায় রথ হইতে নিপতিত হইলেন। এই রূপে সেই পাঞ্চালতনয় নিহত হইলে চতুর্দ্দিকে দ্রোণকে সংহার কর, দ্রোণকে সংহার কর বলিয়া শব্দ হইতে লাগিল। তখন মহাবল পরাক্রান্ত দ্রোণ সাতিশয় ক্রুদ্ধ পাঞ্চাল, মৎস্য কৈকয়, সৃঞ্জয় ও পাণ্ডবগণকে বিক্ষোভিত করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎকালে সাত্যকি, চেকিতান, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, বার্দ্ধক্ষেমি চৈত্রসেনি, সেনাবিন্দু ও সুবৰ্চ্চা এবং অন্যান্য বহু সংখ্যক বীরগণ কৌরবগণ সমবেত দ্রোণের নিকট পরাজিত হইলেন। হে মহারাজ! এই রূপে কৌরবগণ জয় লাভ করিয়া পলায়মান পাণ্ডব সৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিল। যেমন দানবগণ ইন্দ্রের নিকট পরাজিত হইয়া কম্পিত হইয়াছিল, তদ্রূপ পাঞ্চাল মৎস্য ও কৈকয়গণ দ্রোণের নিকট পরাভূত হইয়া কম্পিত হইল।