পূর্ব্বেতে কশ্যপ-মুনি যজ্ঞ আরম্ভিল।
দেব-ঋষি গন্ধর্ব্বাদি যত কেহ ছিল।।
যজ্ঞের সাহায্য দানে করিয়া মমন।
যজ্ঞকাষ্ঠ আনিবারে প্রবেশিল বন।।
ভাঙ্গিয়া লইল কাষ্ঠ মাথার উপর।
পর্ব্বত-প্রমাণ বোঝা নিল পুরন্দর।।
শীঘ্র কাষ্ঠ ফেলিয়া আইল সুরমণি।
পথেতে দেখিল যত বালখিল্য মুনি।।
পলাশের পত্র লয়ে মাথার উপরে।
অঙ্গুষ্ঠ-প্রমাণ সবে যায় ধীরে ধীরে।।
পথে যেতে সবে এক গোক্ষুর দেখিয়া।
পার হৈতে নাহি পারে আছে দাণ্ডাইয়া।।
তাহা দেখি হাসিতে লাগিল দেবরাজ।
দেখিয়া করিল ক্রোধ মুনির সমাজ।।
উপহাস করিলি করিয়া অহঙ্কার।
ব্রাহ্মণেরে নাহি চিন মত্ত দুরাচার।।
বালখিল্য-মুনিগণ এতেক ভাবিল।
অন্য ইন্দ্র করিবারে যজ্ঞ আরম্ভিল।।
ইন্দ্র হৈতে শতগুণ বলিষ্ঠ হইবে।
কামরূপী মহাকায় ত্রৈলোক্য জিনিবে।।
হেনমতে যজ্ঞ করে যত মুনিগণ।
শুনিয়া কশ্যপে ইন্দ্র করে নিবেদন।।
শীঘ্রগতি গেল তেঁই যজ্ঞের সদন।
মুনিগণ-প্রতি তবে বলিল বচন।।
দেবরাজ পুরন্দর ব্রহ্মারে সেবিল।
দেবের ঈশ্বর করি ব্রহ্মা নিয়োজিল।।
অন্য ইন্দ্র-হেতু যজ্ঞ কর কি কারণ।
ব্রহ্মার বচন চাহ করিতে লঙ্ঘন।।
ব্রহ্মার বচন রাখ, হও সবে প্রীত।
আজ্ঞা কর মুনিগণ য হয় উচিত।।
বালখিল্য বলে, যজ্ঞে পাই বহু কষ্ট।
রাখিতে তোমার বাক্য সব হৈল ভ্রষ্ট।।
কশ্যপ বলিল, নষ্ট হবে কি কারণ।
হউক পক্ষীন্দ্র যে জিনিবে ত্রিভুবন।।
মুনিগণে সান্ত্বাইয়া বলে সুররাজে।
উপহাস কভু আর নাহি কর দ্বিজে।।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া নাহি কর অহঙ্কার।
ব্রাহ্মণের ক্রোধে কারো নাহিক নিস্তার।।
এত বলি দেবরাজে করেন মেলানি।
বিনতারে বলেন কশ্যপ মহামুনি।।
সফল করিলা ব্রত শুন গুণবতি।
তোমার গর্ভেতে হবে খগেন্দ্র উপত্তি।।
এত শুনি বিনতার আনন্দ বিস্তর।
হেনমতে পক্ষী হৈল কশ্যপ-কোঙর।।
তবে ত গরুড় বীর গেল সুরালয়।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখি সবে পায় ভয়।।
যে দেবের হাতে ছিল যেই প্রহরণ।
চতুর্দ্দিকে করিতে লাগিল বরিষণ।।
শেল শূল জাঠা শক্তি ভূষণ্ডি তোমর।
পরিঘ পরশু চক্র মুষল মুদগর।।
প্রলয়ের মেঘ যেন করে বরিষণ।
ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্রবৃষ্টি করে করে দেবগণ।।
কামরূপী পক্ষিরাজ নির্ভয় শরীর।
দেবের চরিত্র দেখি হাসে মহাবীর।।
জ্বলন্ত অনল যেন ঘৃত দিলে বাড়ে।
গরুড়ের তেজ বাড়ে, যত অস্ত্র পড়ে।।
জিনিয়া মেঘের শব্দ গরুড়-গর্জ্জন।
দেবের চরিত্র দেখি ভাবে মনে মন।।
ইন্দ্র আদি দেবগণ সবাই অবোধ।
না জানিয়া আমা সঙ্গে বাড়ায় বিরোধ।।
সবারে মারিতে পারি চক্ষুর নিমিষে।
সাধিব আপন কার্য্য কি কাজ বিনাশে।।
এত চিন্তি ততক্ষণে বিনতা-নন্দন।
পাখসাটে পূরাইল ধূলায় গগন।।
ইন্দ্রের অমরাবতী নানা রত্নময়।
ভাঙ্গিল যে পাখসাটেতে সে সমুদয়।।
অনিমিত্র-নেত্রে ভয় পায় দেবগণ।
ধূলায় পূরিল, ভঙ্গ দিল সর্ব্বজন।।
পবনেরে আজ্ঞা দিল দেব পুরন্দর।
ধূলা উড়াইয়া তুমি ফেলাও সত্বর।।
ইন্দ্রের আজ্ঞায় ধূলা উড়ায় পবন।
পুনঃ আসি গরুড়ে বেড়িল সর্ব্বজন।।
চতুর্দ্দিকে নানা অস্ত্র করে বরিষণ।
দেখিয়া রুষিল বীর বিনতা-নন্দন।।
পাখসাট মারে কারে, বিদারয়ে নখে।
ঠোঁটেতে চিরিয়া ফেলে, যে পড়ে সম্মুখে।।
সবার শরীর হৈল রক্তে পরিপূর্ণ।
ভাঙ্গিল মস্তক কারো, অস্থি হৈল চূর্ণ।।
পাখসাটে উড়াইয়া ফেলে চারিদিকে।
দক্ষিণে পলায় কেহ কেহ পূর্ব্ব-ভাগে।।
পশ্চিমে দ্বাদশ রবি পলাইল ডরে।
অশ্বিনী-কুমার দোঁহে পলায় উত্তরে।।
পুনঃ পুনঃ আসি যুদ্ধ করে দেবগণ।
প্রাণপণ করি সবে সুধার কারণ।।
কামরূপী বিহঙ্গম বলে মহাবল।
অতিক্রোধে হৈল যেন জ্বলন্ত অনল।।
প্রলয়-অনল যেন দহে সর্ব্বজনে।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল দেবগণে।।
দেবতা তেত্রিশ কোটি জিনিয়া সমরে।
চন্দ্রলোকে উত্তরিল নিমেষ ভিতরে।।
চন্দ্রের নিকটে গিয়া দেখে মহাবল।
চতুর্দ্দিকে বেড়িয়াছে জ্বলন্ত অনল।।
অগ্নি দেখি উপায় করিল খগেশ্বর।
সুবর্ণের অঙ্গ হৈয়া প্রবেশে ভিতর।।
অগ্নি পার হৈয়া তবে দেখে খগেশ্বর।
তীক্ষ্ম-ক্ষুর-ধার চক্র ভ্রমে নিরন্তর।।
মক্ষিকা পড়িলে তাতে হয় শতখান।
হেন চক্র গরুড় দেখিল বিদ্যমান।।
সূচিকা-প্রমাণ রন্ধ্র ছিল চক্রমাঝ।
ততোধিক সূক্ষ্ম তথা হৈল পক্ষিরাজ।।
চক্র পার হৈয়া তবে বিনতা-নন্দন।
দেখে ভয়ঙ্কর সর্প চন্দ্রের রক্ষণ।।
দৃষ্টিমাত্র ভস্ম করে সেই দুই ফণী।
দেখিয়া চিন্তিত-চিত্ত হৈল খগমণি।।
অতি ক্রোধে পাখসাট গরুড় মারিল।
পক্ষের ধূলিতে ফণি-নয়ন পূরিল।।
ধূলায় পূরিল চক্ষু, হৈল অধোমুখ।
ফণিমুণ্ডে চড়ে বীর পরম-কৌতুক।।
চন্দ্রমা ধরিলা বীর বিনতা-নন্দন।
অমৃত গ্রহণ কৈল আনন্দিত মন।।
ঢাকিয়া লইল সুধা পাখার ভিতরে।
অতিবেগে তথা হৈতে চলিল সত্বরে।।
কামরূপী মহাকায় বিনতা-নন্দন।
সেরূপে যাইতে ইচ্ছা করিল তখন।।
চক্র-অগ্নি লঙ্ঘিয়া আইসে খগবর।
এ-সব কৌতুক দেখি ক্রোধে চক্রধর।।
অন্তরীক্ষে আইল যথা বিনতা-নন্দন।
দুই জনে যুদ্ধ হৈল না যায় কথন।।
চর্তুভুজে চারি অস্ত্রে যুঝে নারায়ণ।
পাখসাটে পক্ষিবর করে নিবারণ।।
আঁচড় কামড় আর মারে পাখসাট।
ক্ষুব্ধ হয় গোবিন্দের হৃদয়-কপাট।।
অনেক হইল যুদ্ধ লিখনে না যায়।
তুষ্ট হয়ে গরুড়ে বলেন দেবরায়।।
তোমার বিক্রমে তুষ্ট হইনু খেচর।
মনোমত মাগ তুমি দিব আমি বর।।
গরুড় বলিল, যদি তুমি দিবা বর।
তোমা হৈতে উচ্চেতে বসিব নিরন্তর।।
অজর অমর হব অজিত সংসারে।
বিষ্ণু কন, যাহা ইচ্ছা দিলাম তোমারে।।
বর পেয়ে হৃষ্টচিত্তে বলে খগেশ্বর।
আরি বর দিব তুমি মাগ গদাধর।।
গোবিন্দ বলেন, যদি দিবা তুমি বর।
আমার বাহন তুমি হও খগেশ্বর।।
গরুড় বলিল, মম সত্য অঙ্গীকার।
নিশ্চয় বাহন আমি হইব তোমার।।
উচ্চস্থল দিলে যে আমারে দিলা বর।
শ্রীহরি বলেন, বৈস রথের উপর।।
এইমত দোঁহাকারে দোঁহে বর দিয়া।
তথা হৈতে চলে বীর অমৃত লইয়া।।
পবন অধিক হয় গরুড়ের গতি।
দৃষ্টিমাত্রে সুরলোকে গেল মহামতি।।
আছিল পরম ক্রোধে দেব পুরন্দর।
মহাক্রোধে মারে বজ্র গরুড়-উপর।।
হাসিয়া গরুড় বলে শুন দেবরাজ।
বজ্র-অস্ত্র ব্যর্থ হৈলে পাবে বড় লাজ।।
মুনি-অস্থি-জাত অস্ত্র অব্যর্থ সংসারে।
শত বজ্র হলে মোর কি করিতে পারে।।
তথাপি মুনির বাক্য করিতে পালন।
একগুটি পর্ণ দিব তোমার কারণ।।
এত বলি এক পাখা ঠোঁটে উপাড়িয়া।
ইন্দ্র মারে বজ্র তাতে দিল ফেলাইয়া।।
দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন দেব পুরন্দর।
সবিনয়ে বলে তবে শুন খগেশ্বর।।
তোমার চরিত্র দেখি হইলাম প্রীত।
সখ্য করিবারে চাহি তোমার সহিত।।
গরুড় বলিল, যদি ইচ্ছা কর তুমি।
আজি হৈতে হইলাম তব সখা আমি।।
ইন্দ্র বলে, সখা এক করি নিবেদন।
তোমার তেজের কথা না যায় কথন।।
কত বল ধর তুমি কহ সত্য করি।
তোমার বিক্রম দেখি তিনলোকে ডরি।।
ইন্দ্রের বচন শুনি বলে পক্ষিরাজ।
আপনি আপন গুণ কহিবারে লাজ।।
তুমি সখা জিজ্ঞাসিলে কহিতে যুয়ায়।
আমার বলের কথা শুন দেবরায়।।
সাগর সহিত ক্ষিতি এক পক্ষে করি।
আর পক্ষে তোমা সহ অমর-নগরী।।
দুই পক্ষে লইয়া উড়িব বায়ুভরে।
শ্রম না হইবে মম সহস্র বৎসরে।।
শুনিয়া হইল স্তব্ধ দেব পুরন্দর।
ইন্দ্র বলে, ইহা সত্য মানি খগেশ্বর।।
যতেক বলিলা সব সম্ভবে তোমারে।
এক নিবেদন সখা কহি আরবারে।।
অমৃত লইয়া যাও কিসের কারণ।
ফিরে দেহ আমা সবে করি আকিঞ্চন।।
সুপর্ণ কহিল, শুন দেব বজ্রপাণি।
দাসীপণে বদ্ধ আছে আমার জনন।।
সুধা লয়ে দিতে যদি পারি সর্পগণে।
তবে ত জননী মুক্ত হবে দাসীপণে।।
এই হেতু সুধা লয়ে যাই নাগলোকে।
যথায় জননী কাল হরেন অসুখে।।
ইন্দ্র বলে, হেন কথা যুক্তিযুক্ত নয়।
মহাদুষ্ট নাগগণ সৃষ্টি করে ক্ষয়।।
তোমার যে শত্রু হয় সে শত্রু আমার।
শত্রুকে অমৃত দিতে না হয় বিচার।।
হেন জনে সুধা দিবে কিসের কারণ।
অপর উপায়ে মায়ে করহ মোচন।।
জগতের প্রাণ রাখ আমার বচন।
সদয় হইয়া সুধা কর প্রত্যর্পণ।।
গরুড় বলিল, সখা এ নহে বিচার।
মায়ের অগ্রেতে করিয়াছি অঙ্গীকার।।
এখনি আনিব সুধা বলিয়াছি বাণী।
কেমনে অমৃত ছাড়ি যাই বজ্রপাণি।।
তবে এক যুক্তি সখা করহ শ্রবণ।
তব বাক্য রবে, হবে মায়ের মোচন।।
সুধা লয়ে দিব আমি যত সর্পদলে।
সুযোগ বুঝিয়া তুমি হরিবে কৌশলে।।
পেয়ে সুধা নাহি পাবে দুষ্ট নাগগণ।
লাভে হৈতে জননীর দাসীত্ব-মোচন।।
এই যুক্তি মনে লয় সখা সুরপতি।
শুনি দেবরাজ হৈল আনন্দিত অতি।।
ইন্দ্র বলে, তুষ্ট হৈল আনন্দিত অতি।।
বর ইচ্ছা থাকে যদি মাগ মম স্থানে।
গরুড় বলিল, আমি কি মাগিব বর।
আমার অসাধ্য কিবা ত্রৈলোক্য-ভিতর।।
তথাপি করিব রক্ষা সখা তব বাক্য।
বর দেহ ফণী যেন হয় মম ভক্ষ্য।।
কপটেতে দুষ্টগণ মায় দুঃখ দিল।
তথাস্তু বলিয়া ইন্দ্র তারে বর দিল।।
বর পেয়ে তথা হৈতে চল খগেশ্বর।
ছায়ারূপে সঙ্গে চলিলেন পুরন্দর।।
পথে যেতে ইন্দ্র জিজ্ঞাসেন ক্ষণে ক্ষণ।
এখন সুদৃঢ় করি বলহ বচন।।
যথায় রাখিবে সুধা যবে লব আমি।
মোর সহ দ্বন্দ্ব পাছে পুনঃ কর তুমি।।
হাসিয়া গরুড় ইন্দ্রের করিল নির্ভয়।
তথাপি ইন্দ্রের চিত্তে প্রত্যয় না হয়।।
তথা হৈতে চলে বীর তারা যেন খসে।
নাগলোকে গেল বীর চক্ষুর নিমিষে।।
ডাক দিয়া আনিল যতেক নাগগণে।
হের সুধা আনিলাম দেখ সর্ব্বজনে।।
দাসীত্বে মোচন হৌক আমার জননী।
এত শুনি আনন্দিত হৈল সব ফণী।।
ফণিগণ বলিলেক, আর নাহি দায়।
দাসীত্বে মোচন করিলাম তব মায়।।
এত শুনি হৃষ্টচিত্তে বিনতা-নন্দন।
নাগগণে ডাকি তবে বলিল বচন।।
স্নান করি শুচি হৈয়া এস সর্ব্বজন।
আনন্দিত হয়ে সুধা করহ ভক্ষণ।।
এই দেখ সুধা রাখি কুশের উপর।
এত বলি সুধা লয়ে ঘেল খগেশ্বর।।
গরুড়ের বাক্যে সবে করে স্নান দান।
হেথা সুধা লয়ে ইন্দ্র হইল অন্তর্দ্ধান।।
শুচি হৈয়া আসিল যতেক নাগগণ।
অমৃত না দেখি হৈল বিরস বদন।।
জানিল হরিয়া সুধ দেবরাজ নিল।
সবে মিলি সেই কুশ চাটিতে লাগিল।।
তীক্ষ্মধারে সকলের জিহ্বা হৈল চির।
সেই হৈতে দুই জিহ্বা হইল ফণীর।।
পবিত্র হইল কুশ সুধা-পরশনে।
নিষ্ফল সকল কর্ম্ম কুশের বিহনে।।
গরুড়-বিক্রম আর বিনতা-মোচন।
নাগের নৈরাশ্য আর অমৃত-হরণ।।
এ সব রহস্য কথা শুনে যেই জনে।
আয়ু যশ বৃদ্ধি তার হয় দিনে দিনে।।
পুত্রার্থীর পুত্র হয় ধনার্থীর ধন।
তার প্রতি সুপ্রসন্ন বিনতা-নন্দন।।
আদিপর্ব্ব ভারতে গরুড়-জন্মকথা।
অপূর্ব্ব পয়ার ছন্দে পাঁচালিতে গাঁথা।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।