২০তম অধ্যায়
সন্ধিপ্রস্তাবে ভীষ্মের সাগ্রহ উত্তর
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! প্রজ্ঞাসম্পন্ন ভীষ্ম ব্রাহ্মণমুখে এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে যথোচিত উপচারে অর্চ্চনা করিয়া কহিলেন, “হে ভগবন! ভাগ্যবলে পাণ্ডবগণ ও মধুসূদন কুশলে কালযাপন করিতেছেন, ভাগ্যবলে তাঁহারা সহায়সম্পন্ন হইয়া ধর্ম্মপথে একান্ত নিরত রহিয়াছেন এবং ভাগ্যবলেই তাঁহারা বান্ধবগণের সহিত সংগ্রামাভিলাষ পরিহার করিয়া সন্ধিপ্রার্থনা করিতেছেন। হে ব্ৰহ্মন! আপনি যাহা কহিলেন, তাহার যথার্থ্য-বিষয়ে আমার অনুমাত্ৰও সন্দেহ নাই, কিন্তু আপনার ব্ৰহ্মতেজঃ-প্রভাবে আপাতত উহা অতি কঠোর বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। পাণ্ডবেরা বনবাসক্লেশে নিতান্ত ক্লিষ্ট হইয়া এক্ষণে ধর্ম্মানুসারে সমস্ত পৈত্রিক ধনের উত্তরাধিকারী হইয়াছেন, সন্দেহ নাই। মহারথ কিরিটী অলৌকিকবলশালী, এই ত্ৰিলোকমধ্যে রণস্থলে কোন ব্যক্তি তাঁহার ভুজবীৰ্য্য সহ্য করিতে পারে? অন্য ধনুৰ্দ্ধারীর কথা দূরে থাকুক, সাক্ষাৎ দেবরাজও তাঁহার সহিত সংগ্ৰাম করিতে সমর্থ হয়েন না।”
সন্ধি সম্বন্ধে কর্ণের সগৰ্বোক্তি
মহাবীর কর্ণ ক্ৰোধাভরে অহঙ্কারপূর্ব্বক ভীষ্মদেবের বাক্যে অনাদর প্রদর্শন করিয়া মহারাজ দুর্য্যোধনের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করিয়া ব্রাহ্মণকে কহিতে লাগিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! পূর্ব্বে শকুনি রাজা দুর্য্যোধনের বাক্যানুসারে দ্যূতক্রীড়া করিয়া যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করেন; রাজা যুধিষ্ঠিরও প্রতিজ্ঞানুসারে বনে প্রস্থান করিয়াছিলেন। ত্ৰিলোকে এ কথা কাহারও অবিদিত নাই, সুতরাং আমরা আর সে বিষয়ের উল্লেখ করিব না। এক্ষণে তিনি মুর্খের ন্যায় সেই প্রতিজ্ঞা উল্লঙঘন ও পাঞ্চলদিগের সাহায্যে সমস্ত পৈত্রিক রাজ্য অধিকার করিবার চেষ্টা করিতেছেন। রাজা দুৰ্য্যোধন ধর্ম্মানুসারে শক্রকে সমস্ত পৃথিবী দান করিতে পারেন; কিন্তু ভয়প্রদর্শন করিলে একপদ ভূমিও প্রদান করিবেন না; অতএব যদি তাঁহারা পুনরায় পৈতৃক রাজ্যলাভের অভিলাষ করেন, তাহা হইলে অরণ্যবাস আশ্রয় করিয়া প্রতিজ্ঞাকাল অতিবাহিত করুন; পরে মহারাজ দুৰ্য্যোধনের অঙ্কে নিঃশঙ্কে অবস্থান করিতে সমর্থ হইবেন। মূর্খতাবশতঃ যেন কদাচ অধাৰ্মিকী বুদ্ধি অবলম্বন না করেন। আর তাঁহারা যদি ধর্ম্মমার্গ পরিত্যাগ করিয়া নিতান্তই যুদ্ধের বাসনা করিয়া থাকেন, তাহা হইলে রণস্থলে কৌরবগণের সহিত সাক্ষাৎকারলাভ করিয়া আমার বাক্য স্মরণপূর্ব্বক অনুতাপ করিতে হইবে, সন্দেহ নাই।”
ধৃতরাষ্ট্রের কর্ণ-তিরস্কার
ভীষ্ম কহিলেন, “হে কর্ণ তুমি বাক্যে সাতিশয় অহঙ্কার প্রকাশ করিতেছ বটে, কিন্তু অর্জ্জুন একাকী রণস্থলে ছয় রথীকে পরাজয় করিয়াছেন, তাহা একবার তোমার স্মরণ করা উচিত। ব্রাহ্মণ যাহা কহিলেন, যদি আমরা সেইরূপ অনুষ্ঠান না করি, তাহা হইলে অর্জ্জুনকর্ত্তৃক নিহত হইয়া নিশ্চয়ই আমাদিগকে সমরাঙ্গণের পাংশুজাল [ধুলিরাশি] ভক্ষণ করিতে হইবে।” অনন্তর রাজা ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্মকে প্রসন্ন ও তাঁহার বাক্যে অনুমোদন করিয়া কৰ্ণকে ভৎসনা করিয়া কহিলেন, “হে কৰ্ণ শান্তনুনন্দন ভীষ্ম যাহা কহিলেন, তাহা আমাদিগের শুভকর, পাণ্ডবগণের হিতকর, সমস্ত জগতের শ্রেয়স্কর হইতেছে বিবেচনা করিয়া আমি পাণ্ডবগণের নিকট সঞ্জয়কে প্রেরণ করিব। তিনি অদ্যই তাঁহাদিগের নিকট গমন করুন।” এই বলিয়া রাজা ধৃতরাষ্ট্র বিরাটপুরোহিতকে সৎকারপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সমীপে প্রেরণ করিলেন এবং সভামধ্যে সঞ্জয়কে আহ্বান করিয়া কহিতে লাগিলেন।