২০তম অধ্যায়
শাল্বের অনুসরণে কৃষ্ণের যুদ্ধযাত্রা
বাসুদেব কহিলেন, “হে রাজন! শাল্বের প্রস্থানানন্তর আপনার রাজসূয়যজ্ঞাবসানে আমি দ্বারকাবতী প্রত্যাগমন করিয়া দেখিলাম, দ্বারকার সে শোভা নাই; বেদপাঠ্যধ্বনি ও বিষট্কার আর শ্রুতিগোচর হয় না, বরবর্ণিনী কামিনীগণের বেশভূষা বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে এবং তত্ৰত্য উপবন-সকল অদৃষ্টপূর্ব্বের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তখন যৎপরোনাস্তি সন্দিহান হইয়া হৃদিকানন্দনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “হে নরশার্দূলি! বৃষ্ণিবংশীয় নরনারীদিগকে অত্যন্ত অম্বস্থ দেখিতেছি, ইহার কারণ কি, বল?” হার্দ্দিক্য এইরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া শাল্বরাজকর্ত্তৃক দ্বারকার অবরোধ ও বিমোচন পৰ্য্যন্ত সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তর বর্ণন করিলেন। তদনন্তর আমি, রাজা আহুক, আনকদুন্দুভি, সকল বৃষ্ণিপ্রবীর ও পুরবাসী লোকদিগের আশ্বাস প্রদান করিয়া কহিলাম, ‘হে যাদবগণ! তোমরা অপ্ৰমত্তচিত্তে নগরে কালব্যাপন করিও, আমি শাল্বের বিনাশে কৃতনিশ্চয় হইয়া চলিলাম, তাহাকে নিহত না করিয়া কখন দ্বারকায় প্রত্যাগমন করিব না। আমি শাল্বসহ সৌভনগর সমভূমি করিয়া তোমাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিব; তোমরা এক্ষণে এই শত্রুভীষণ মহানিনাদ দুন্দুভিধ্বনি আরম্ভ কর।” হে ভারতীৰ্ষভ! তাহারা সকলে আমার বাক্যে আশ্বাসিত ও হৃষ্টচিত্ত হইয়া আশীর্ব্বাদপূর্ব্বক আমাকে কহিলেন, “তুমি নির্ব্বিঘ্নে গমন কর; অচিরাৎ শত্রু বিনষ্ট করিতে পরিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” আমি সেই পরমহ্লাদিত বীরপুরুষদিগের আশীর্ব্বাদে অভিনন্দিত হইয়া দ্বিজবরগণের নামোল্লেখপূর্ব্বক মহাদেবকে প্ৰণাম করিয়া ধ্বজপতাকা পরিশোভিত সুগ্ৰীবসংযুক্ত রথে অধিরূঢ় হইলাম। তাহার নির্ঘোষে দশদিক প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল এবং আমিও পাঞ্চজন্য শঙ্খ ধ্বনিত করিতে লাগিলাম।
শাল্বের সহিত কৃষ্ণের যুদ্ধ
“অনন্তর নিখিল চতুরঙ্গিণীসেনা-সমভিব্যাহারে যাত্ৰা করিয়া ক্ৰমে ক্ৰমে নানা দেশ, তরুরাজিবিরাজিত ভূধরশ্রেণীসুশোভিত সরোবর ও নদীসকল উত্তীর্ণ হইয়া পরিশেষে মার্ত্তিকাবত-নগরে উপস্থিত হইলাম। তথায় শ্রবণ করিলাম যে, শাল্বরাজ সৌভনগরে আরূঢ় হইয়া সাগরান্তিকে গমন করিতেছে। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। সে প্রথমতঃ মহোদধির কুক্ষিতে যাইয়া পরে সৌভ আশ্রয়পূর্ব্বক সমুদ্রনাভিতে উপস্থিত হইল। সেই দুরাত্মা দূর হইতে আমাকে অবলোকন করিয়া হাসিতে হাসিতে বারংবার যুদ্ধার্থে আহ্বান করিতে লাগিল। আমি যুদ্ধে আহূত হইয়া শাঙ্গে জ্যারোপণপূর্ব্বক মর্ম্মভেদী বাণ-সকল পরিত্যাগ করিলাম, কিন্তু তাহার একটিও পুরপ্রাপ্ত হইল না, তদর্শনে আমার রোষাবেশ পরিবদ্ধিত হইল। তখন সেই দৈত্যাপসদও রোষপরবশ হইয়া আমার উপর অনবরত শরধারা বর্ষণকরত মদীয় সৈনিকপুরুষ, সারথি ও অশ্ব-সকল শরজালে আকীর্ণ করিল। তথাপি আমরা কিঞ্চিম্মাত্ৰও চিন্তিত না হইয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলাম। পরে শাল্বের পদানুগ বীরপুরুষেরা আনতপর্ব্ব শতসহস্র শীর যুগপৎ আমার উপর নিক্ষেপ করিল। তাহাদিগের মর্ম্মভেদী শরজালে আমার অশ্ব, রথ এবং দারুক প্রভৃতি সমুদয়ই আচ্ছাদিত ও এককালে অদৃশ্য হইল; ফলতঃ অশ্ব, রথ, সারথি ও সৈনিকেরা যে কে কোথায় রহিল, কিছুই জানিতে পারিলাম না এবং আমিও দৃষ্টির বহির্ভূত হইলাম। অনন্তর দিব্যশরাসনে মন্ত্রপূত অযুত শরসন্ধানপূর্ব্বক যথাবিধি নিক্ষেপ করিতে লাগিলাম। হে ভারত, সৌভনগর প্রায় একক্রোশ উৰ্দ্ধে অবস্থিত ছিল, সুতরাং তথায় আমার সৈন্যদিগের গমন কিরূপে সম্ভাবিতে পারে? রঙ্গভূমির সম্মুখস্থ লোকেরা সিংহনাদ সদৃশ গভীরস্বরে আমাকে আহ্লাদিত করিতে লাগিল। আমার করাগ্ৰ-বিনির্ম্মুক্ত শরসমূহ দানবদলের অঙ্গে শলাভের [সূচীমুখ পতঙ্গ—যাহাদের মুখে ছুঁচের ন্যায় হুল থাকে তাদৃশ] ন্যায় প্রবিষ্ট হইল। তীক্ষ্নধারবিশিখবিদ্ধ দানবসৈন্যের হলহলশব্দে সৌভনগর প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল এবং ছিন্ন-ভুজষ্কন্ধ কবন্ধাকৃতি দানবেরা ভয়ঙ্কর শব্দ করিয়া সমুদ্রে নিপতিত হইবামাত্র জলচর জন্তুগণ তাহাদিগকে ভক্ষণ করিতে লাগিল।
“অনন্তর আমি কুন্দেন্দুসমাপ্রভ [কুন্দপুষ্প ও চন্দ্রের ন্যায় ধবল] পাঞ্চজন্য শঙ্খধ্বনি করিলাম। সৌভপতি স্বীয় সৈনিক পুরুষদিগকে নিপতিত দেখিয়া মায়াযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। সেই যুদ্ধে অনবরত গদা, হল, প্রাস, শূল, শক্তি, পরশু, অসি, কুলিশ, পাশ, শর, পট্টিশ ও ভুষুণ্ডী প্রভৃতি অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ নিপতিত হইতে লাগিল। আমি মায়াবলে শীঘ্ৰ সেই দানবীমায়ার নিরাকরণ করিলে, সে গিরিশৃঙ্গদ্বারা যুদ্ধ করিতে উদ্যত হইল। অনন্তর সে কখনও সমুদয় জগৎ গাঢ় তিমিরে আবৃত, কখনও বা উজ্জ্বল আলোকে প্ৰদীপ্ত, কখনও দুর্দ্দিন [দুৰ্য্যোগ—যেদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে], কখনও সুদিন, কখনও শীতল, কখনও বা উষ্ণ, কখনও অঙ্গার, কখনও বা পাংশুময় করিয়া শস্ত্ৰসকল বর্ষণ করিতে লাগিল। মহারাজ! এইরূপ মায়াবল আশ্রয় করিয়া সে আমার সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিল। আমি সবিশেষ পরিজ্ঞাত হইয়া মায়াবলেই তৎসমুদয় নিরাকৃত করিলাম এবং সময়ানুসারে ঘোরতর বাণযুদ্ধদ্বারা চতুর্দ্দিক প্ৰতিধ্বনিত করিতে লাগিলাম। হে মহারাজ! অনন্তর আকাশমণ্ডলে শতসূৰ্য্য সমুদিত হইল ও সহস্রাযুত তারকাপরিবৃত শত-নিশোকর দীপ্তি পাইতে লাগিল। দিবারাত্র বা দিক্সকল নির্ণীত হইল না। ইহাতে আমি মোহিত হইয়া শরাসনে প্রজ্ঞাস্ত্ৰ যোজনা করিলাম। হে কৌন্তেয়! অনিলপ্রভাবে যেমন কার্পাস উড্ডীন হয়, তদ্রূপ সেই অস্ত্ৰজাত মহাবেগে সঞ্চারিত হইলে সেই যুদ্ধ তুমুল ও লোমহর্ষণ হইয়া উঠিল। হে রাজেন্দ্ৰ! আলোক পাইয়া পুনর্ব্বার আমি শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলাম।