০১-৫. পাহাড়ে কী হয়েছিলো

দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড জুল ভার্ন

. পাহাড়ে কী হয়েছিলো

এই গল্পে আমার নিজের সম্বন্ধে যদি আমি কয়েক কাহন ফাদি, তবে তা শুধু এই জন্যেই যে এই গল্পের চমকপ্রদ সব ঘটনার সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলুম, গোটা বিংশ শতাব্দীও এমন বিস্ময়কর ঘটনাবলির মুখোমুখি কখনও পড়বে কি না সন্দেহ। মাঝে-মাঝে আমি নিজেকেই জিগেস করে বসি : এ-সব ঘটনা সত্যি-সত্যি একদিন ঘটেছিলো তো? এ-সব কি আমার স্মৃতির মধ্যে যথার্থই খোদাই-করা আছে, যেমন ঘটেছিলো হুবহু তেমন–নাকি স্মৃতির পটে এই-যে-সব ছবি খোদাই-করা আছে সে সব নিছকই আমার তেতে-ওঠা কল্পনার সৃষ্টি? ওয়াশিংটনে ফেডারেল পুলিশ বিভাগের চীফ-ইন্সপেক্টর হিশেবে–শুধু-যে পুলিশে কাজ করি আমি, তা-ই নয়, আমার ইচ্ছেও করে সব দুর্বোধ্য প্রহেলিকার জট খুলে দেখতে, যা-কিছু রহস্যময় ও কুহেলিঘেরা তাকেই খুঁটিয়ে তন্নতন্ন করে দেখে বোঝবার চেষ্টা করাটা আমার ধাতের মধ্যেই আছে–কিন্তু চীফ-ইপেক্টর হিশেবেই আমি এই তাজ্জব আর অসাধারণ ঘটনাগুলোয় বিশেষভাবেই কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলুম। আর যেহেতু সরকার আগেই আমাকে–যখন আমি নেহাৎই কিশোর, তখনই–বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর রহস্যময় গোপন তদন্তে নিয়োগ করেছিলো, সেইজন্যেই খুব সহজেই, স্বাভাবিকভাবেই, আমার বিভাগের বোকর্তা আমারই ওপর এই তাকলাগানো তদন্তটার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, আর কাজটা হাতে নিয়েই আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন কত-কত দুর্ভেদ্য রহস্যের সঙ্গে সরাসরি এক মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পড়েছি।

আজ যে-কাহিনীটা বলতে বসেছি, তা শুরু করার আগেই এটা বলে নেয়া ভালো যে আমি এখন যা বলবো তা আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে। এটা খুবই জরুরি। কারণ কতগুলো তথ্য এখানে এমন থাকবে, যেগুলোর সম্বন্ধে একমাত্র যা সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলবে, তা শুধু আমারই কথা, আমারই এজাহার–এদের প্রমাণ করবার জন্য অন্য কারু নজিরই আমি হাজির করতে পারবো না। আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করতে না-চান তো সে আপনাদেরই অভিরুচি–এবং আপনাদের সে-সব কথা বিশ্বাস করতেও আমি বলছি না। আমি নিজেই তো এর বেশির ভাগ ঘটনাই এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।

এই অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করেছিলো আমাদের এই বিশাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার পশ্চিমভাগে। সেখানে, মীলগিরি পর্বতমালার একেবারে দুর্ভেদ্যগভীরে উঠেছে এক মস্ত চূড়া–যার নাম গ্রেট আইরি-ঈগলপাখির মস্ত বাসা। তার বিশাল বর্তুল আকৃতিটা কাটাওয়াবা নদীর তীরে ছোট্ট-যে শহর আছে, মরগ্যানটন নাম, সেখান থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে। আরো স্পষ্ট চোখে পড়ে যখন কেউ প্লেজেন্ট গার্ডেন গ্রামটার মধ্য দিয়ে গিয়ে পাহাড়টার দিকে এগিয়ে চলে যায়।

আশপাশের অঞ্চলের লোকে কেন-যে এই পাহাড়চূড়ার নাম দিয়েছিলো গ্রেট আইরি–ঈগলপাখির মস্ত বাসা–তা আমি এখনও জানি না। পাহাড়টা উঠে গেছে পাথুরে, রুগম্ভীর, অগম্য, আর বিশেষ-বিশেষ আবহাওয়ায় তার গায়ে জড়িয়ে থাকে এক গভীর নীল ও অদ্ভুত-সুদূর ভঙ্গি। তবে নামটা শুনে প্রথমেই যে-ভাবনাটা লোকের মাথায় খেলে যাবে, তা হলো নিশ্চয়ই এখানটায় শিকারি পাখিরা এসে বাসা বাঁধে, আস্তানা গাড়ে, তা-ই এই নাম : ঈগল, কণ্ডর, গৃধিনী; অগুনতি পালকখচিত পাখনাওলা জীবের বসতি, মানুষের নাগালের বাইরে এই দূর-চূড়ার উপর ডুকরে ডেকে উঠে পাক খেয়ে যাচ্ছে তারা। অথচ, এদিকে কিন্তু, এই গ্রেট আইরি পাখিদের যে খুব-একটা আকৃষ্ট করে তা অবশ্য মনে হয় না; বরং তার উলটোটাই সত্যি; আশপাশের এলাকার লোকজন মাঝে মাঝে উলটে বরং এই মন্তব্যই করে যে পাখিরা চুড়োটার দিকে যখন উড়ে যায়, তখন আচমকা দ্রুতগতিতে উঠে যায় আরো-উপরে, চক্কর দেয় শিখরটার ওপর, পাক খায়, তারপর ক্ষিপ্রবেগে দূরে উড়ে যায়, আকাশ-বাতাস ছিঁড়ে দেয় তাদের কর্কশ চীৎকারে।

তাহলে কেন শিখরটার নাম গ্রেট আইরি? তার চেয়ে বরং শিখরটার নাম জ্বালামুখ দিলেই মানাতো বেশি, কারণ এই খাড়া সটান-ওঠা বর্তুল দেয়ালগুলোর মধ্যে হয়তো গভীর-কোনো নয়ানজুলিই আছে। হয়তো ঐ দেয়ালগুলো আড়াল করে রেখেছে কোনো মস্ত পাহাড়ি ঝিল, যেমনটা প্রায়ই দেখা যায় আপালাচিয়ার পর্বতব্যবস্থার অন্যান্য অংশে, এমন-এক লেগুন যাকে অনবরত জল খাইয়ে যায় বৃষ্টিবাদল আর শীতের তুষার।

এককথায়, এটা কি তবে কোনো প্রাচীন আগ্নেয়গিরিরই আবাস ছিলো না–যে আগুনের পাহাড় অনেক বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে সত্যি,তবে যার আভ্যন্তর স্তিমিত আগুন আবার যে ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে না, তা-ই বা কে জানে? গ্রেট আইরি কি একদিন আশপাশে সেই বিষম দুর্বিপাকই সৃষ্টি করবে না, যে-দুর্যোগ সৃষ্টি করেছে মাউন্ট ক্রাকাতোয়া কিংবা মাউন্ট পেলে? সত্যি যদি তার মাঝখানে গভীর-কোনো হ্রদ থেকে থাকে, তবে সেই জলের মধ্যে কি সর্বনাশই ওতপ্রোত মিশে নেই, যা একদিন হয়তো পাথুরে স্তরগুলোর ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে গিয়ে পড়বে গভীর-নিচে, আর আগ্নেয়গিরির আগুনের কুণ্ডে পড়ে বাষ্প হয়ে পাক খাবে, আর পাথর ফাটিয়ে বার করে নেবে তাদের বাইরে বেরুবার পথ, ভয়ংকর বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে চারপাশ, গলন্ত লাভার প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ক্যারোলাইনার সুন্দর উপত্যকাঁদেশ, যেমনটা ঘটেছে এই সেদিন, ১৯০২ তে, মার্তিনিক-এ?

সত্যি-বলতে, এই শেষ সম্ভাবনাটা যে মোটেই কোনো অলীক বা অমূলক আশঙ্কা নয়, তার প্রমাণ হিশেবে সম্প্রতি এখানে বিচিত্র-সব চিহ্নলক্ষণ দেখা গেছে যা হয়তো ঘুমন্ত কোনো আগ্নেয়গিরি পুনর্জাগরণেরই ইঙ্গিত-বা পূর্বাভাস। পাহাড়ের ওপর ভেসে থেকেছে ধোঁয়ার কুণ্ডলি, পাঁজা-পাঁজা, আর একবার পথচারী পাহাড়িরা কানে শুনেছে। ভূগর্ভের কোলাহল, দুর্বোধ্য গুমগুমে আওয়াজ, ব্যাখ্যাতীত সব রুষ্ট গর্জন। শিখরের কাছে আকাশ জ্বলজ্বল করে উঠেছে কী-এক অচেনা আভায়, রাতের অন্ধকারে।

হাওয়া যখন ঝেটিয়ে নিয়ে এসেছে সেই ধোঁয়ার মেঘ, পূবদিকে, প্লেজেন্ট গার্ডেনে, কয়েকটি পোড়া-পোড়া টুকরো আর ছাইভস্ম ঝরে পড়েছে সেই মেঘ থেকে। আর, শেষটায়, এক ঝড়ের রাতে বিবর্ণ-সব দাউদাউ শিখা, শিখরের ওপরকার মেঘে প্রতিফলিত হয়ে, নিচের বসতিতে আছড়ে ফেলেছে এক ভয়াল হুঁশিয়ার-করা আলো।

এইসব আশ্চর্য সব উৎপাত দেখে, আশপাশের এলাকার লোকজন যে বেশ শঙ্কিত আর অস্থির হয়ে পড়বে, তাতে অবাক হবার কিছু ছিলো না। আর এই অস্থিরতার সঙ্গে এসে মিশেছিলো পাহাড়ের সত্যিকার হালচাল জেনে-নেবার জন্যে উদগ্র এক আকাঙ্ক্ষা । ক্যারোলাইনার খবরকাগজগুলোয় জ্বলজ্বল করেছিলো শিরোনাম : গ্রেট আইরির গভীর রহস্য! এটাও তারা আতঙ্কিত বাক্যবন্ধে জিগেস করেছিলো এ-রকম কোনো অঞ্চলে বসবাস করা কি বিষম বিপজ্জনক নয়। প্রবন্ধগুলো চেতিয়ে তুলেছিলো আতঙ্ক আর কৌতূহল–আতঙ্ক তাদের মধ্যে যারা, সত্যি যদি বিস্ফোরণ ঘটে, তবে সর্বনাশের মুখোমুখি পড়বে; কৌতূহল তাদের মধ্যে, যাদের নিজেদের কোনো আশু বিপদের সম্ভাবনা নেই, যারা জানতে চাচ্ছিলো প্রকৃতির এই উৎপাতের আড়ালে সত্যি সত্যি সে কোন প্রক্রিয়া কাজ করে যাচ্ছে। যাদের ঘাড়ের ওপর বিপদ প্রায় লাফিয়ে পড়তে চলেছে, তারা হলো মরগ্যানটনের বাসিন্দা, আর তাদের চাইতেও বেশি ভয় ছিলো প্লেজেন্ট গার্ডেন আর তার আশপাশের ছোটো-ছোটো গ্রামগঞ্জের লোকদের।

এটা খুবই পরিতাপের বিষয় যে কোনো পর্বতারোহীই আগে গ্রেট আইরির শিখরে চড়বার চেষ্টা করেনি। শিখরটাকে ঘিরে যে-শৈলশ্রেণী গেছে কেউই আগে তাতে ওঠবার কথা ভাবেনি। সেখানে হয়তো সত্যি এমন-কোনো পথও নেই, যা বেয়ে উঠে সবচেয়ে দুঃসাহসী পর্বতারোহীও ভেতরে গিয়ে পৌঁছুবার কোনো সুযোগ পেতো। অথচ, যদি কোনো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ক্যারোলাইনার সমগ্র পশ্চিমভাগকেই বিপদের মুখোমুখি করে থাকে, তবে এই গিরিমালার সমগ্র অঞ্চলের একটা সরেজমিন তদন্ত করে দেখা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

জ্বালামুখের মধ্যে দিয়ে সত্যি-সত্যি সশরীরে নামবার আগে-নামবার তো কত যে অসুবিধে আছে তার তত হিশেব নেই–একটা উপায় অবশ্য আছে, যার সাহায্যে ভেতরটায় কী আছে তা দেখে-আসা যায়, তার জন্যে পাহাড় বেয়ে শিখরে ওঠবার কোনো দরকার নেই। সেই স্মরণীয় বছরটার সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে, উইলকার নামে এক নামজাদা বেলুনবাজ তার বেলুনটা নিয়ে মরগ্যানটনে এসে হাজির হয়েছিলো। পূব-থেকে-আসা হাওয়ার অপেক্ষায় থেকে, সে সহজেই তার বেলুনে করে আকাশে উঠে গিয়ে গ্রেট আইরি-র দিকে ভেসে যেতে পারতো। সেখানে, নিরাপদ উচ্চতা থেকে, জোরালো দূরবিন চোখে এঁটে নিচের গভীরে তাকিয়ে সে সব খুঁজে দেখতে পারবে। সে তাহলে সহজেই জেনে নিতে পারবে আগ্নেয়গিরিটার কোনো নতুন জ্যান্ত মুখ সেই বিশাল পাথরগুলোর মধ্যে কোথাও বেরিয়েছে কি না। অন্তত সেটাই ছিলো তখন প্রধান প্রশ্ন। এটা যদি একবার নিশ্চিতভাবে জেনে নেয়া যায়, তাহলে আশপাশের অঞ্চলের লোকজন জেনে যাবে অচিরেই আসন্ন কোনো অগ্নদগারের ভয় আছে কি না।

যে-কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছিলো, সেই অনুযায়ীই শুরু হয়েছিলো বেলুনের উত্থান। হাওয়া ছিলো বেশ জোরালোই, কোনো তীব্র ঝাঁকুনি বা দিকবদল ছিলো না; প্রখর সূর্যকিরণে সকালবেলার মেঘগুলো ক্রমেই উধাও হয়ে যাচ্ছিলো; গ্রেট আইরির অভ্যন্তর যদি ধোঁয়ায় ভরা না-থাকে, বেলুনবাজ উইলকার তবে চোখে দুরবিন এঁটে গোটা তল্লাটটাই ছুঁড়ে নিতে পারবে। আর যদি সে দ্যাখে কুণ্ডলি পাকিয়ে বাষ্প উঠে আসছে, তবে তার উৎসটাও সে তখন অনায়াসেই জেনে নিতে পারবে।

যাত্রা শুরু করবার সঙ্গে-সঙ্গেই বেলুনটা তরতর করে তক্ষুনি পনেরোশো ফিট উঁচুতে উঠে গিয়েছিলো, তারপর এক জায়গাতেই অনড়ভাবে দাঁড়িয়েছিলো প্রায় পনেরো মিনিট। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো নিচে যে-পুরবঁইয়া হাওয়াকে জোরালো বলে মনে হচ্ছিলো, অতটা ওপরে তার তেমন বেগ ছিলো না। তারপর, পোড়াকপাল আর কাকে বলে, বেলুনকে তাড়া লাগিয়েছিলো উলটোমুখি এক হাওয়া, আর সে পুবদিকে ভেসে চলে যেতে থাকে। শৈলশ্রেণী থেকে তার দূরত্ব, তার ব্যবধান, ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিলো। বেলুনবাজের যাবতীয় চেষ্টা সত্ত্বেও, মরগ্যানটনের বাসিন্দারা দেখতে পেলে, বেলুনটা ভুল দিগন্তের দিকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। তারা জানতে পেরেছিলো, বেলুনটা গিয়ে নেমেছিলো র‍্যালের আশপাশে, যে-রলে ছিলো নর্থ ক্যারোলাইনার রাজধানী।

এই চেষ্টাটা এইভাবে দূর-মাঠে মারা যাওয়াতে, ঠিক হলো যে, আবহাওয়া যখন আরো-ভালো থাকবে, তখন আরো-একবার চেষ্টা করে দেখা হবে। এদিকে নতুন করে শুরু হয়ে গেলো পাহাড়ের ভেতরকার গুমগুম গর্জন, সঙ্গে এলো ভারি-ভারি ঝোলা মেঘ আর রাতের বেলায় সন্ত্রস্ত ও কম্পিত আলোকশিখা। লোকে এবার প্রায় নিঃসন্দেহই হয়ে গেলো যে গ্রেট আইরির হাবভাব মোটেই সুবিধের ঠেকছে না, বিপদটা যে ভয়াল ও করাল হবে শুধু তা-ই নয়, বিপদটা আসন্ন এবং অবশ্যম্ভাবী। হ্যাঁ, সন্দেহ নেই যে, গোটা তল্লাটটাই হয় কোনো ভয়ানক ভূমিকম্প আর নয়তো কোনো আসন্ন অগ্নদগারের কবলে পড়ে গিয়েছে।

সে-বছরের এপ্রিলমাসের গোড়ার দিকে, এই আশঙ্কাগুলো সত্যিই আতঙ্কে পরিণত হয়েছিলো। জনসাধারণের ভয়ের বহুগুণ প্রতিধ্বনি শোনা গেলো খবরকাগজের সম্পাদকীয় স্তম্ভে। পাহাড় থেকে মরগ্যানটন অব্দি গোটা অঞ্চলটাই এখন জেনে গিয়েছে যে একটি অগ্নদগার অবশ্যম্ভাবী।

চৌঠা এপ্রিলের রাত্তিরবেলায়, প্লেজেন্ট গার্ডেনের বাসিন্দারা এক ভয়ানক কোলাহল শুনেছিলো জেগে উঠলো। প্রথমে তারা ভেবেছিলো গোটা পাহাড়টাই বুঝি তাদের মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে। তারা ছুটে বেরিয়ে এসেছিলো তাদের ঘরবাড়ি থেকে, তক্ষুনি গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার জন্যে তৈরি, এতই শঙ্কাতুর যে ভাবছিলো মাটি বুঝি চারপাশে হা করে আছে, মাইল-মাইল জোড়া খেতখামার গ্রামগঞ্জ গিলে খাবার জন্যে তৈরি।

রাতটা ছিলো ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। উপত্যকার ওপর ঝুলে ছিলো ভারি নিচু মেঘ। রাত না-হয়ে যদি দিনও হতো, তাহলেও ঐ মেঘের জন্যে পাহাড়ের চুড়োটা কারু চোখে পড়তো না।

এই দুর্ভেদ্য ও দুর্নিরীক্ষ্য অন্ধকারের মধ্যে, চারপাশ থেকে যত আর্তনাদ উঠেছিলো, তার কোনো সাড়া মিলছিলো না। ভীতসন্ত্রস্ত আবালবৃদ্ধবনিতা খ্যাপা এক বিশৃঙ্খলার মধ্যে অন্ধকারে হাড়ে-হাড়ে ছুটছিলো–কোথায় যাচ্ছিলো কেউ জানতো না। চারপাশ থেকে শোনা যাচ্ছিলো চীৎকার : ভূমিকম্প! ভূমিকম্প! অগ্নদগার! বিস্ফোরণ! কোথায়? কোথায় অগ্ন্যুৎপাত? কেন! গ্রেট আইরিতে!

মরগ্যানটনে হু-হু করে খবর চলে গেলো পাথর, লাভা, ছাইভস্মের এক প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে।

শহরের নাগরিকদের মধ্যে যাদের মাথা তখনও ঠাণ্ডা ছিলো তারা বললে যে সত্যিই যদি কোনো অগ্নদগার হতো তাহলে গর্জনটা শুধু-যে এখনও শোনা যেতো তা নয়, তার প্রচণ্ডতাও বেড়ে যেতো, আর শিখরটার ওপর দেখা দিতে আগুনের শিখা;-আর শিখা না-দেখা গেলেও শিখার লেলিহান তাণ্ডব নাচ মেঘ ফুঁড়ে চারপাশে প্রতিফলিত হতো। এখন তো এমনকী কোনো শিখারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। আর ভূমিকম্প যদি হতো–আতঙ্কিত মানুষজন দেখতে পেলে যে সেই ভূমিকম্পে আর যা-ই হোক, তাদের বাড়িঘরগুলো এখনও চুরমার হয়ে ভেঙে পড়েনি। খুবই সম্ভব যে বিকট আওয়াজটা কোনো আভালাঁশের গড়িয়ে-পড়া থেকে উঠেছে, হয়তো শিখর থেকে হঠাৎ কোনো বিশাল পাথর গড়িয়ে পড়েছে।

এক ঘণ্টার মধ্যে আর-কোনো নতুন ঘটনাই ঘটলো না। পশ্চিম-থেকে-আসা হাওয়া ঝেটিয়ে যাচ্ছে নীলগিরির বিস্তীর্ণ শৈলশ্রেণী, পাহাড়ের ওপর ঢালগুলোয় পাইনবনে হেমলকের ঝাড়ে বিলাপ উঠেছে হাওয়ার। দেখে মনে হচ্ছে আতঙ্কের আর নতুন কোনো কারণ নেই কোথাও; লোকজন তারপর যে-যার বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। তবু সবাই অধীরভাবে অপেক্ষা করে আছে কখন ভোর হয়, কখন দিন ফোটে।

তারপর, আচমকা, শেষরাতে, তিনটে নাগাদ, আকেবার বিপদের সংকেত। গ্রেট আইরির পাথরের দেয়ালের ওপর লাফিয়ে-লাফিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে আগুনের শিখা! মেঘের গা থেকে প্রতিফলিত হয়ে, তারা অনেক দূর অব্দি আকাশ আর মেঘ আলো করে দিয়েছে। শোনা গেলো চড়চড় শব্দ, যেন একসঙ্গে পুড়ে যাচ্ছে অনেক গাছ, যেন কোথাও দাবানল লেগেছে।

আপনা থেকেই বনে আগুন লেগে গিয়েছে? হঠাৎ এভাবে আগুন-লেগে-যাবার কারণ কী হতে পারে? বিদ্যুৎ নিশ্চয়ই এই দাবানল শুরু করেনি, কারণ একবারও (কাথাও বাজের শব্দ শোনা যায়নি। সত্যি-যে, আগুন ধরে যাবার উপকরণ আছে অনেক; ঐ ওপরে নীলগিরির শৈলশ্রেণী নিবিড় বনে ছাওয়া। কিন্তু এই শিখাগুলো যেন বড্ড-আচমকা একসঙ্গে শুরু হয়ে গেছে–কোনো নৈসর্গিক কারণ যে আছে তা তো মনে হয় না।

অগ্ন্যুদগার! বিস্ফোরণ! অগ্ন্যুৎপাত! আগ্নেয়গিরির ঘুম ভেঙেছে!

চারপাশ থেকে ঝাঁপট মারলো আর্ত চীৎকার! আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত! সত্যি, তাহলে, পাহাড়ের আঁতের মধ্যে লুকিয়েছিলো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ! আর এত বছর পরে, বলতে-কি যুগ-যুগ পরে, অবশেষে আবার তার ঘুম ভেঙেছে! শিখার সঙ্গে যোগ হয়ে এখন কি তবে মুষলধারে বর্ষাবে জ্বলন্ত পাথর, গলানো লাভা আর অবিরাম ছাই? তবে কি লাভা ঢেউ তুলে নেমে আসবে তরল আগুন নিয়ে? আর পথে যা পড়বে সব ধ্বংস করে দেবে–গ্রামনগর, খেতখামার, প্রকৃতির এই সুন্দর লীলাভূমি? এসে ধ্বংস করে দেবে প্লেজেন্ট গার্ডেন আর মরগ্যানটন?

এবার আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা হলো চরম। কোনো আশ্বাস, কোনো প্রবোধ তাকে থামাতে পারতো না। মেয়েরা কোলে শিশু নিয়ে, আতঙ্কে উন্মাদিনী, ছুটেছে পুবদিকে; পুরুষরা, ঘরবাড়ি ছাড়তে-ছাড়তে, ক্ষিপ্রহাতে পুঁটুলিতে বেঁধে নিচ্ছে যা-কিছু ছিলো মূল্যবান, দুর্লভ; তারপর খুলে দিচ্ছে কোর্যাল আস্তাবল গোয়ালের দরজা, যাতে গোরুভেড়া, শুওর-মোষ যে যেদিকে পারে খোলা মাঠে ছুটে যেতে পারে। সেই তমসাচ্ছন্ন রাত্রে মানুষ আর জানোয়ারের সে-কী হন্যে উম্মাদনা, সে-কী বিশৃঙ্খল ছোটাছুটি, বনে-জঙ্গলে, খোলা মাঠে, গ্রাম-শহরের রাস্তায়, জলাভূমির পাশে, অন্ধকারে। জলাশয়গুলোয় ফুলে ফেঁপে অস্থির হয়ে উঠছে জল, পলাতকদের পায়ের তলা থেকে তারা যেন হ্যাঁচকা স্রোতের টানে সরিয়ে নিয়ে যাবে মাটি! কিন্তু যদি উম্মাদ কোনো প্রস্রবণের মতো নেমে আসে তরল আগুন, পাহাড়ের গা বেয়ে, আর যদি সেই জ্বলন্ত লাভার তলায় হারিয়ে যায় পথ?

অবশ্য, সবচেয়ে বড়ো খেতখামার যাদের, যাদের প্রবীণ মগজ তুলনায় বিচক্ষণও, তারা কিন্তু এই উম্মাদ পলায়মান নরনারীর ঠেলাঠেলিতে ভেসে যায়নি, তারা বরং আবারও চেষ্টা করেছে অন্যরা যাতে একটু সংযত হয়। পাহাড়ের মাইল খানেকের মধ্যে এসে, তারা দেখতে পেলে শিখার প্রোজ্জ্বল দাপট অনেকটাই স্তিমিত হয়ে বসেছে। সত্যি বলতে, তাদের মনে হলো এই অঞ্চলে যে আশু-কোনো, কিংবা অন্যকোনো, বিপদের সম্ভাবনা আছে, এমনটা বোধ হচ্ছে না। কোনো পাথরই আছড়ে পড়েনি মহাশূন্যে; ঢালের ওপর কোনো লাভার স্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে না; মাটির তলা থেকে ভেসে আসছে না কোনো রহস্যময় গুমগুম আওয়াজ। চারপাশে এমন-কোনো লক্ষণ নেই যা দেখে মনে হতে পারে ভূমির কম্পনজনিত কোনো দুর্ঘটনা রাজ্যটাকে সর্বনাশে দিতে পারে।

শেষটায়, পলাতকদের উম্মাদ উড়াল এসে থামলো এমন জায়গায় যেখান থেকে, তারা ভাবলে, পাহাড়ের বিপদ অতর্কিতে এসে ছোঁ মেরে তাদের ওপর আর পড়বে না। তখন কয়েকজন ভয়ে-ভয়ে, সন্তর্পণে, একটু-একটু করে আবার ফিরে এলো পাহাড়ের দিকে। পুরোপুরি দিন ফোটবার আগেই কতগুলো খামারবাড়িতে আবার ফিরে এলো লোকজন।

সকালবেলায় গ্রেট আইরির শিখরের ওপর আগের রাতের ধোঁয়ার মেঘের আর কোনো চিহ্নই ছিলো না। আগুন যা জ্বলেছিলো তা নিশ্চয়ই নিজে থেকেই নিভে গিয়েছে; আর কেন-যে অমন দুর্বিপাক আচমকা শুরু হয়েছিলো তার কারণ যদি-বা কেউই বুঝতে পারেনি, সকলেই অন্তত এই আশাটুকু করেছে যে আবার যাতে অচিরেই তার কোনো পুনরাবৃত্তি না-হয়।

এমনও কারু-কারু মনে হলো যে গ্রেট আইরি আসলে হয়তো কোনো আগ্নেয় তোলপাড়ের নাট্যশালাই ছিলো না। পুরো এলাকাটা যে ভূমিকম্প কিংবা অগ্ন্যুৎপাতের দয়ার ওপর নির্ভর করে আছে এমন-কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণও কোথাও নেই।

অথচ তবু পাঁচটা নাগাদ, আবার শৈলশিরার ঠিক নিচেটায়, যেখানকার বনভূমিতে রাত্রি তখনও যাই-যাই করেও পুরোপুরি চলে যায়নি, অদ্ভুত এক আওয়াজ উঠলো আর হাওয়ায় উড়াল দিয়ে দূরে চলে গেলো, আর তার সঙ্গে ছিলো যেন বিশাল-কোনো ডানার ঝাঁপট। আর দিনটা যদি অন্যদিনের মতো স্বচ্ছ ফটফটে পরিষ্কার হতো, চাষীরা হয়তো দেখতে পেতো অতিকায় কোনো শিকারি পাখির তুমুল উড়াল–হয়তো আকাশের কোনো অপদেবতাই গ্রেট আইরির নয়ানজুলি ডেকে ডানা ছড়িয়ে উঠে পড়েছে আকাশে, আর দ্রুত গতিতে উড়ে চলে যাচ্ছে পুবদিগন্তের পানে।

.

. আমি মরগ্যানটনে এসে পৌঁছোলুম

আগের দিন রাত্তিরে ওয়াশিংটন থেকে রওনা হয়ে ২৭ শে এপ্রিল আমি এসে পৌঁছোলম নর্থ ক্যারোলাইনার রাজধানী র্যলেয়।

দু-দিন আগে, ফেডারেল পুলিশের বড়কর্তা আমাকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খানিকটা অধীর হয়েই আমার আপেক্ষা করছিলেন তিনি। জন স্ট্রক, তিনি বলে উঠেছিলেন, তুমি কি এখনও সেই করিৎকর্মা মানুষটি আছে, যে এর আগে অনেকবার শুধু আমার প্রতি তার আনুগত্যই দেখায়নি, তার কাজের প্রতিভাও দেখিয়েছে?

মিস্টার ওয়ার্ড, আমিও উত্তরে নুয়ে পড়ে সেলাম ঠুকে বলেছিলুম, আমি কোনো সাফল্য বা কর্মদক্ষতার প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগ–তবে যদি আনুগত্যের কথা বলেন, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, আমার আনুগত্য শতকরা একশোভাগই আপনার অধীন।

সে নিয়ে আমি কোনো সন্দেহ করিনি, স্ট্রক, বডোকর্তাও সমান সুরে বলেছিলেন, আমি বরং তোমাকে আরো-যথাযথ প্রশ্নটা করি : তুমি কি আগের মতোই প্রহেলিকা নিয়ে মাথা ঘামাও? ধাঁধা বা হেঁয়ালির সমাধান করতে উৎসুক? আগে যেমন করে কোনো রহস্যভেদ করবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে, এখনও কি তুমি তেমনতর কোনো উদগ্রীব আগ্রহ বোধ করো?

করি, মিস্টার ওয়ার্ড।

সাধু, সাধু, শাবাশি দিয়েছেন বডোকর্তা, তাহলে এখন মন দিয়ে শোনো।

মিস্টার ওয়ার্ড, বয়েস তার সম্ভবত পশ্চাশ বৎসর, এত বড়ো পদে উন্নীত হয়েছিলেন শুধু তার ক্ষমতা আর বুদ্ধিবলে; এই পদটার সঙ্গে জড়ানো যাবতীয় গুরুদায়িত্বই তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করে আসছিলেন। আগে অনেকবারই তিনি আমার ওপর নানাবিধ কঠিন কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, আর আমিও সাফল্যের সঙ্গে সে-সব কাজ সম্পন্ন করে-করে ক্রমেই তার গভীর আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলুম। গত কয়েক মাসে অবশ্য আমাকে তিনি কোনো কাজ দেননি, কেননা সে-রকম কোনো দুর্বোধ্য কূট প্রহেলিকার জট ছাড়াবার কাজ আমাদের বিভাগে আসেনি। সেজন্যে তিনি এখন কী বলতে চান সেটা জানবার জন্যেই আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলুম। তার এই প্রশ্ন আর ভনিতা যে আমার কাঁধে আবার কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব চাপিয়ে দেবারই অছিলা মাত্র, এটা বুঝতে আমার একটুও দেরি হয়নি।

সন্দেহ নেই যে তুমি জানো, বড়কর্তা বলেছেন তখন, মরগ্যানটনের কাছে। ব্লরিজ মাউন্টেসে কী-সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে তা নিশ্চয়ই তুমি জানো।

শুনেছি বটে। ওখান থেকে অনবরত যে-সব আশ্চর্য ঘটনার খবর আসছে, তা যে-কারুর কৌতূহল উশকে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।

ঘটনাগুলো কেবল-যে আশ্চর্য তা-ই নয়–এমন-কোনো আশ্চর্য ব্যাপার কেউ কখনও জম্মেও শোনেনি। সে-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ রেখো না, স্ট্রক। কিন্তু তাছাড়াও আরো-কতগুলো জরুরি প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে : গ্রেট আইরিতে যা হচ্ছে, সেখানকার লোকদের পক্ষে তা যদি বিপজ্জনক হয়, তবে কতটা বিপজ্জনক? সে কি। অবিলম্বে ঘটতে চলেছে এমন-কোনো ভয়াবহ সর্বনাশেরই ইঙ্গিত? এমন-এক সর্বনাশ, যা অত্যন্ত রহস্যময়ও, যার সম্বন্ধে কিছুই আমরা জানি না।

দেখে-শুনে ভয়ই হয়, মিস্টার ওয়ার্ড।

কাজেই, স্ট্রক, চট করে আমাদের জেনে নিতে হবে, ঐ পাহাড়ের মাঝখানটায়

কী আছে। যদি প্রকৃতির কোনো বিশাল শক্তির কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতেই হয় আমাদের, তবে লোকজনকে আগে থেকেই এই ভয়াল বিপদটা সম্বন্ধে সচেতন করে দেয়া উচিত।

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, কর্তৃপক্ষকে ব্যাপারটা ভালো করে তদন্ত করে বুঝে নিতে হবে সত্যি-সত্যি ওখানে কী হচ্ছে।

তুমি ঠিক বলছো, স্ট্রক। কিন্তু তাতে আবার বিস্তর ঝামেলা আছে। সকলেই জানিয়েছে যে গ্রেট আইরির চুড়োয় ওঠা একেবারেই অসাধ্য ব্যাপার, সেখানে উঠে তারপর ভেতরের নয়ানজুলিটায় নামাটা তো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু কেউ কি আগে কখনও যাবতীয় বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম নিয়ে সবরকমে তৈরি হয়ে ভালো আবহাওয়ায় ওখানে যাবার চেষ্টা করে দেখেছিলো? আমার অবশ্য এতে একটু সন্দেহ আছে; আমার বিশ্বাস, কোনো সুপরিকল্পিত অভিযান হয়তো সাফল্য এনে দেবে।

কিছুই অসম্ভব নয়, মিস্টার ওয়ার্ড। এখানে, আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো সমস্যাটা হলো ব্যয়নির্বাহের প্রশ্ন-কাজটা সুষ্ঠুভাবে করতে গেলে বিস্তর অর্থব্যয় হবে।

যখন আমরা আস্ত-একটা জনপদের মানুষজনকে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছি, হয়তো বা সর্বনাশের হাত থেকে তাদের বাঁচাতেও চাচ্ছি, তখন খরচের প্রশ্নটা কোনো প্রশ্নই নয়। তোমার কাছে অবশ্য আমার আরেকটা প্রস্তাবও আছে। হয়তো এই গ্রেট আইরি লোকে যতটা ভাবে ততটা অগম্য নয়। হয়তো একদল পাজি দুষ্কৃতকারী গিয়ে সেখানে তাদের গোপন ডেরা বানিয়েছে, হয়তো শুধু তারাই জানে কেমন করে ঐ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতে হয়।

অর্থাৎ? আপনি কি ভাবছেন যে একদল দস্যু–

হয়তো আমার অনুমানটা পুরোপুরি ভুল, স্ট্রক। হয়তো এইসব অদ্ভুত আওয়াজ আর চাক্ষুষ দৃশ্যগুলোর পেছনে স্বাভাবিক কোনো নৈসর্গিক কারণই আছে। কিন্তু দস্যুদল না নিসর্গ-কে যে এ-সবের জন্যে দায়ী সেটা আমাদের সুনিশ্চিতভাবে জেনে নিতে হবে–এবং জেনে নিতে হবে যত শিগগির সম্ভব।

আমার শুধু একটাই প্রশ্ন আছে।

বলে ফ্যালো, স্ট্রক, বলে ফ্যালো। কোনো খটকাই চেপে রেখো না।

ধরুন, আমরা গ্রেট আইরিতে গিয়ে পৌঁছেছি, এ-সব আশ্চর্যের উৎস আর উৎপত্তিস্থলও বার করে ফেলেছি, জেনে গিয়েছি যে সেখানে আগ্নেয়গিরির এক জাগ্রত জ্বালামুখ আছে আর এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ অচিরেই আসন্ন–তখন কি তাকে আমরা ঠেকাতে পারবো?

না, স্ট্রক, না। তবে বিপদের পরিমাণ কতটা হতে পারে, সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারবো। যদি মার্তিনিকে যেমন ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছে, মাউন্ট পেলের উদগিরণ থেকে যদি আস্ত-আস্ত জনপদ যেমনভাবে চাপা পড়ে গিয়েছে, যদি সেইরকমই কোনো অগ্ন্যুৎপাত নর্থ ক্যারোলাইনাকে সমূহ বিপদের মুখোমুখি এনে ফেলে থাকে, তবে আমরা লোকজনকে হুঁশিয়ার করে দিতে পারবো, তাদের জানিয়ে দিতে হবে যে এখানকার পাট উঠিয়ে তাদের এবার অন্য-কোথাও গিয়ে আস্তানা পাততে হবে

আশা করি তেমন-কোনো ভয়াবহ বিপদের সম্ভাবনা নেই।

আমারও তা-ই মনে হয়, স্ট্রক। ব্লরিজ শৈলশ্রেণীতে কোনো জাগ্রত আগ্নেয়গিরি আড়মোড়া ভাঙছে, এটা আমার কাছে বড্ড অবিশ্বাস্য ঠেকছে। আমাদের আপালাচীয় পার্বত্যব্যবস্থা কখনো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পাহাড়ে যা ঘটছে, তার তো কোনো-একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া চাই আমাদের-সে-সব নিশ্চয়ই অকারণেই ঘটছে না। সংক্ষেপেই তোমাকে বলি, স্ট্রক। আমরা ঠিক করেছি, গ্রেট আইরিতে যা হচ্ছে তার একটা সরেজমিন তদন্ত করে দেখা উচিত, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব দেখা দরকার, সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ একজায়গায় জড়ো করা জরুরি–শহরের গ্রামের সবাইকে প্রশ্ন করে-করে জেনে নিতে হবে তারা কী দেখেছে, কী শুনেছে, কী ভেবেছে। আর এইসব কাজ করবার জন্যে আমরা এমন-একজনের কথা ভেবেছি, যার ওপর আমাদের সকলেরই পূর্ণ আস্থা আছে; এবং সেই লোক হচ্ছো তুমি, স্ট্রক।

বেশ। আমি তৈরি আছি, মিস্টার ওয়ার্ড, আমি একটু উত্তেজিত গলাতেই বলে উঠেছি তখন, নিশ্চিন্ত থাকবেন–পুরো খবরটা জোগাড় করতে যা-যা করতে হবে, সব আমি করবো–কোথাও কোনো কাজে অবহেলা করবো না।

তুমি যে কাজে ফাঁকি দেবে না বা অবহেলা করবে না, তা আমি জানি, স্ট্রক। তবে এটাও তোমাকে জানিয়ে দিতে চাই যে আমাদের মনে হয়েছে তুমিই এই কাজের উপযুক্ত লোক। এবার তুমি তোমার ঐ ছটফটে উগ্র কৌতূহলটাকে চরিতার্থ করবার চমৎকার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে।

আপনি তো জানেনই, মিস্টার ওয়ার্ড, যে-কোনো প্রহেলিকাকে নিছক প্রহেলিকা বলে মেনে নিতে আমার বোধবুদ্ধিতে আটকায়।

পরিস্থিতি অনুযায়ী সমস্ত ব্যবস্থাই তুমি নিজে করবে, স্বাধীনভাবে–কেউ তোমাকে বাধা দেবে না। আর খরচের প্রশ্ন, যদি মনে হয় যে পর্বতাভিযানের জন্যে আঁটঘাট বেঁধে ওস্তাদ পর্বতারোহীদের নিয়ে বেরুতে হবে, তাতে অবশ্য বিস্তর খরচ হবে–তবে সেক্ষেত্রে তোমার কাব্লাশ রইলো, ইচ্ছেমতো অর্থব্যয় করতে পারবে তুমি।

যা করলে ভালো হবে বলে মনে হবে, আমি তা-ই করবো, মিস্টার ওয়ার্ড।

একটা বিষয়ে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, ঠুক। খুব হুঁশিয়ার হয়ে, সন্তর্পণে, তোমায় এগুতে হবে। ওখানকার লোকজন এর মধ্যেই উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। তোমার পক্ষে বরং গোপনেই অনুসন্ধান চালানো উচিত হবে। আমি যে-সন্দেহের কথাটা তুলেছি, ঘুণাক্ষরেও কখনো কারু কাছে তার কথা পেছো না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা-অকারণে নতুন-কোনো আতঙ্ক যাতে না-ছড়ায় সে-বিষয়ে তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টাই। সতর্ক থাকতে হবে।

মনে থাকবে, মিস্টার ওয়ার্ড।

মরগ্যানটনের মেয়রের কাছে তোমার পরিচয়পত্র পেশ করতে হবে–তিনিই সবদিক থেকে তোমায় সাহায্য করবেন। আবারও বলে দিচ্ছি, স্ট্রক, সাবধান থেকো, বিচক্ষণ, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি ওখানে যাচ্ছো, ঘুণাক্ষরেও কারু কাছে সে-কথা প্রকাশ কোরো না–যদি একেবারে জরুরি হয়ে পড়ে, না-বললেই চলে না, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। তুমি-এর আগে বহুবার তোমার কূটকৌশল ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। আমি ঠিক জানি তুমি তোমার কাজে সফল হবেই।

আমি তাকে শুধু একটাই কথা জিগেস করেছি, কবে আমাকে রওনা হতে হবে?

কাল।

কাল, আমি ওয়াশিংটন থেকে বেরুবো, আর পরশুদিনই মরগ্যানটনে পৌঁছে। যাবো।

ভবিষ্যৎ যে আমার জন্যে কী-সব মৎলব এঁটে রেখেছিলো, তা যদি তখন আমি স্বপ্নেও টের পেতুম!

তক্ষুনি আমি বাড়ি ফিরে এসে যাবার জন্যে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিলুম। আর পরদিন সন্ধেবেলায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছিলুম র্যলেতে। সেখানে সে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন বিকেলবেলায় আমি মরগ্যানটনের রেলস্টেশনে গিয়ে পৌঁছেলুম।

মরগ্যানটন শহরটা ছোটো, জুরাসিক যুগের ভূস্তরের উপর গড়ে উঠেছে শহরটা–অজস্র কয়লা আছে এখানে। এর যত সমৃদ্ধির পেছনে আছে এর যত কয়লাখাদান। এখানে অবশ্য অনেকরকম ধাতুতে ভরা জলও আছে বিপুল পরিমাণে, তাই গ্রীষ্মকালে সেখানে বাইরে থেকে অজস্র লোক আসে স্বাস্থোদ্ধারে। মরগ্যানটনকে ঘিরে আছে সুজলাসুফলা সব খেতখামার-প্রচুর ভুট্টা আর মকাই গজায় এখানে। জায়গাটা জলাভূমির মাঝখানে, শ্যাওলা আর খাগড়াবনও আছে অনেক। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গেছে চিরহরিৎ গাছের অরণ্য। জায়গাটায় যা নেই তা হলো প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎস, যে-গ্যাস শক্তি জোগায়, আলো আর উত্তাপ দেয়, যার অফুরান উৎস আছে। আলেঘেনি উপত্যকায়। একেবারে পাহাড়ের গায়ের বনজঙ্গলের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। কত-যে গ্রাম আর কত-যে খামার। কাজেই গ্রেট আইরি যদি সত্যি-সত্যি কোনো আধো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি হয়, যদি তার উপদ্রব পৌঁছে যায় প্লেজেন্ট গার্ডেন আর মরগ্যানটনে, তাহলে কত লোক যে বিপন্ন হবে, ধনে-প্রাণে মারা যাবে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

মরগ্যানটনের মেয়র, জনৈক মিস্টার এলিয়াস স্মিথ, মানুষটা দশাসই, কেবল যে লম্বাচওড়া তা-ই নয়, স্বাস্থ্যে আর প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, বয়েস হবে চল্লিশ বৎসর কি তার একটু বেশি, দেখে মনে হয় দুই আমেরিকার সমস্ত চিকিৎসকরাই তাদের ব্যাবসা মাঠে মারা যাবে বলে পাততাড়ি গুটিয়ে পালাবেন। মানুষটা আবার ওস্তাদ শিকারিও, অনেক ভালুক আর প্যান্থর মেরেছেন, আলেঘেনি উপত্যকার গভীর বনে বা বন্য খাতে এখনও যে-সব জন্তুর মস্ত প্রাদুর্ভাব।

মিস্টার স্মিথ নিজেই একজন ধনাঢ্য জমিমালিক, আশপাশে তার অনেকগুলো খেতখামার ছড়িয়ে আছে। এমনকী অনেক দূরে-দূরেও যে-সব রায়ৎ আছে, তাদেরও কাজ-কারবার তিনি বারবার ঘুরে-ফিরে পর্যবেক্ষণ করে দ্যাখেন। সত্যি-বলতে, সরকারি কাজে যখন তার মরগ্যানটনের তথাকথিত প্রাসাদোপম অট্টালিকায় থাকতে হয় না, তখনই তিনি আশপাশের জমিজিরেতে ঘুরে বেড়ান, আর শিকারের উত্তেজনা তাকে টেনে-টেনে নিয়ে যায় বনেজঙ্গলে, নিবিড় অরণ্যদেশে।

মরগ্যানটন পৌঁছেই আমি সরাসরি মিস্টার স্মিথের বাড়ি চলে গেলুম। তিনি জানতেন যে আমি আসবো, টেলিগ্রাম করে আগেই তাকে খবর পাঠানো হয়েছিলো, তাই তখন তিনি আমারই অপেক্ষায় বসে ছিলেন। দরাজভঙ্গিতেই আমায় আপ্যায়ন করলেন এলিয়াস স্মিথ, কোনো ভদ্রতার ভড়ং ছাড়াই, মুখে পাইপ, টেবিলের ওপর ব্র্যান্ডি ভরা গেলাশ। তক্ষুনি একটি ভৃত্য দ্বিতীয় আরেকটি গেলাশ নিয়ে এসে হাজির, আর আমাকে পরস্পরের স্বাস্থ্য কামনা করে তক্ষুনি দু-টেক ব্র্যাডি খেতে হলো, তবেই আমি কথাবার্তা শুরু করতে পারলুম।

মিস্টার ওয়ার্ড আপনাকে পাঠিয়েছেন, সাদর আপ্যায়ন করে আমাকে তিনি বললেন, আসুন, মিস্টার ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য পান করা যাক।

তার গেলাশের সঙ্গে আমার গেলাশ ঠোকাঠুকি করে আমি পুলিশের বড়কর্তার স্বাস্থ্য পান করলুম।

তারপর? এলিয়াস স্মিথ জানতে চাইলেন, এবার বলুন, তার উদ্বেগের কারণ কী?

আমি তখন মরগ্যানটনের মেয়রের কাছে খুলে বললুম কেন আমি হঠাৎ নর্থ ক্যারোলাইনায় এসে হাজির হয়েছি। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে এও বললুম যে আমার বডোকর্তা আমার হাতে পূর্ণ দায়িত্বই শুধু দেননি, গ্রেট আইরির নিদ্রাভঙ্গের দরুন এই অঞ্চলে যে-রহস্য আর উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান করবার জন্যে যা-যা লাগে সবরকম সাহায্য করতেও প্রস্তুত-আর্থিক বা অন্য-যে-কোনোরকম সাহায্যই তার কাছ থেকে সবসময় পাওয়া যাবে।

টু শব্দটি না-করে এলিয়াস স্মিথ প্রথমে আমার সব কথা শুনলেন বটে, তবে মধ্যে-মধ্যে আমার আর তার শূন্য গেলাশগুলি পূর্ণ করে দিতে ভোলেননি। সারাক্ষণ এরই মধ্যে তার পাইপ টেনে চলছিলেন তিনি; তাতে যদি মনে হয় তিনি আমার কথায় মনোযোগ দিচ্ছিলেন না তাহলে কিন্তু ভুল করা হবে–তার বাইরের ভোলটা প্রতারক, আসলে তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গেই আমার প্রতিটি শব্দ শুনছিলেন। মাঝে-মাঝেই তার গণ্ডদেশ আরক্ত হয়ে উঠছিলো, আর তার ঝোঁপের মতো ভুরুর তলায় চোখ দুটি কেবলই ঝকঝক করে উঠছিলো। স্পষ্টই বোঝা গেলো, মরগ্যানটনের চীফ ম্যাজিস্ট্রেটও গ্রেট আইরিকে নিয়ে বিষম অস্বস্তিতে আছেন, কেন-যে পাহাড়ে এতসব অদ্ভুত ও রহস্যময় ঘটনা ঘটছে, তার মূল কারণটা খুঁজে বার করবার জন্যে তিনিও আমার মতোই। আগ্রহী, শুধু আগ্রহী নয়, উৎসুকও।

আমার কাহন শেষ হয়ে যাবার পর এলিয়াস স্মিথ চুপ করে বসে আমাকে খানিকক্ষণ শুধু নিরীক্ষণ করলেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, তাহলে ওয়াশিংটনে কর্তারা জানতে চাচ্ছেন গ্রেট আইরি তার পেটের মধ্যে কী জিনিশ লুকিয়ে রেখেছে?

ঠিক তাই, মিস্টার স্মিথ।

আর আপনিও ঠিক তা-ই জানতে চাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আমি তা জানতে চাই, মিস্টার স্ট্রক।

কৌতূহলে তিনি আর আমি দুজনেই সমান।

আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, পাইপ ঠুকে ছাই ঝাড়তে-ঝাড়তে তিনি বললেন, জমির মালিক হিশেবে গ্রেট আইরির ও-সব তাজ্জব ঘটনায় আমি কতটা উৎকণ্ঠিত হয়ে আছি। আর মেয়র হিশেবে আমার এলাকার লোকজনকে রক্ষা করার একটা দায়িত্বও আমার আছে।

পাহাড়ে যে কী অদ্ভুত রহস্য এসে ঘনিয়েছে, তার কারণ জানবার জন্যে আপনার ডবোল উৎকণ্ঠা থাকাই স্বাভাবিক। আমি তাকে জানালুম, আপনার কাছে পুরো ব্যাপারটাই নিশ্চয়ই দুর্বোধ্য প্রহেলিকা বলে ঠেকেছে–তবে প্রহেলিকাটি নিশ্চয়ই নিরীহ কিছু নয়–আপনার এই এলাকার লোকজনের নিরাপত্তা তার সঙ্গে জড়ানো বলে এর মধ্যে ভয়াবহ বিপত্তিরও সম্ভাবনা আছে।

দুর্বোধ্য যে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, মিস্টার স্ট্রক। তবে আমার কথা যদি বলেন, আমি নিজে কিছুতেই বিশ্বাস করবো না যে গ্রেট আইরি কোনো আগ্নেয়গিরি। আলেঘেনিরা কোথাওই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয়নি। আমি নিজে আশপাশে কোথাও লাভা, গন্ধক বা বিস্ফোরক-চুরমার পাথর দেখতে পাইনি। সেইজন্যেই আমার মনে হয় না যে এ থেকে আচমকা মরগ্যানটনের কোনো বিপদ হতে পারে।

এ থেকে যে বিপদ হতে পারে, তা কি আপনার সত্যি কোনোদিন মনে হয়নি, মিস্টার স্মিথ?

কোনোদিনও না।

কিন্তু এই-যে লোকে বলছে চারপাশে মাটি কেঁপে উঠেছিলো?

হুঁ, মাটি কেঁপে উঠেছিলো! ভূমিকম্প! এলিয়াস স্মিথ মাথা নেড়ে কথাগুলো আওড়ালেন একবার। কিন্তু এটা কি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে সত্যি-সত্যিই মাটি কেঁপে উঠেছিলো? শিখাগুলো তখন লকলক করে আকাশ চাটছিলো, আমি তখন উইলডনে আমার খামারবাড়িতে ছিলুম–গ্রেট আইরি থেকে তার দূরত্ব এক মাইলেরও কম। সত্যি-যে বাতাসে একটা তুমুল আলোড়ন, একটা তুমুল ঝাঁপটা উঠেছিলো, কিন্তু মাটি কেঁপে উঠছে বলে আমি একবারও টের পাইনি।

কিন্তু মিস্টার ওয়ার্ডের কাছে যে-সব প্রতিবেদন গেছে

ও-সব প্রতিবেদন লোকে পাঠিয়েছে আতঙ্কের মুহূর্তে, মরগ্যানটনের মেয়র আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, আমার প্রতিবেদনে তো আমি কোনো ভূকম্পনের কথা উল্লেখ করিনি।

আর, শিখরের ওপরে ঐ-যে দাউদাউ-জ্বলা শিখাগুলো?

হ্যাঁ, শিখাগুলো। সেগুলোর কথা আলাদা, মিস্টার স্ট্রক। আমি তাদের দেখেছি; আমি তাদের স্বচক্ষে দেখেছি, তাছাড়া মেঘের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে তা অনেক মাইল দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিলো। তাছাড়া গ্রেট আইরি-র পেট থেকেও গুমগুম আওয়াজ বেরুচ্ছিলো, না, গুমগুম নয়, হিস-হিস শব্দ, যেন একটা মস্ত বয়লার থেকে বাষ্প বেরিয়ে আসছে।

বিশ্বাসযোগ্য-নির্ভরযোগ্য কোনো সাক্ষী আছে এর?

হ্যাঁ, আমার নিজের কানে শোনা–

আর এই হিস-হিস আওয়াজের মধ্যে, মিস্টার স্মিথ, আপনার কি মনে হয় আপনি । সবচেয়ে তাজ্জব জিনিশটা শুনেছিলেন–মস্ত সব পাখার ঝাঁপট?

আমার তা-ই মনে হয়েছিলো, মিস্টার স্ট্রক। কিন্তু সে-কোন অতিকায় পাখি সেটা–শিখাগুলো নিভে যাবার পর যে ওখান থেকে উড়ে গিয়েছিলো? সে-কোন পাখি সে, যার ডানার ঝাঁপট থেকে অমন প্রচণ্ড আওয়াজ বেরুতে পারে? সেইজন্যেই আমি নিজেকেও সন্দেহ করেছি–সে কি ছিলো আমারই কল্পনার কোনো বেঘোরবিভ্রম? গ্রেট আইরি আকাশের অজানা অপদেবতার আস্তানা! এ-যে নিছকই মতিভ্রম ছাড়া আর-কিছু। নয়। যদি কোনো অতিকায় পাখি ঐ পাথরের মাঝখানে বাসা বেঁধে থাকে, তবে সে কি অনেক আগেই ওখান থেকে উড়ে যেতো না? সে কি ইতিহাসের অগোচর কোনো পাখি নয়? এটাই সবচেয়ে দুর্বোধ্য প্রহেলিকা, মিস্টার স্ট্রক। এর কোনো সদুত্তর আমার জানা নেই।

কিন্তু আমরা এই রহস্যের জট ছাড়াবো, মিস্টার স্মিথ, অবশ্য যদি আপনি আমাকে সাহায্য করেন।

নিশ্চয়ই, মিস্টার স্ট্রক। কাল থেকেই আমরা আমাদের অভিযান শুরু করবো।

তাহলে, কাল। আর এই কথার পরেই মেয়রের কাছ থেকে আমি বিদায় নিয়েছিলুম। সেখান থেকে সোজা আমি চলে গিয়েছি একটা হোটেলে, ঘর ভাড়া করার সময় বলেছি আমাকে যে কতদিন এখানে থাকতে হবে, তা আমি নিজেই জানি না। তারপর লাঞ্চের শেষে মিস্টার ওয়ার্ডকে সব লিখে জানালুম। বিকেলবেলায় আরো একবার মিস্টার স্মিথের সঙ্গে দেখা করেছিলুম আমি । ঠিক হলো, দিন ফোটবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি তাকে নিয়ে মরগ্যানটন ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে।

আমাদের প্রথম কাজ, পাহাড়ে ওঠবার ব্যবস্থা করা–ঠিক হলো সঙ্গে দুজন অভিজ্ঞ গাইড নেয়া হবে, যারা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। এই পর্বতারোহীরা মাউন্ট মিচেল ও ব্লরিজ শৈলশ্রেণীর অন্যান্য শিখরে চড়েছে আগে, তবে কখনোই গ্রেট আইরির শিখরে ওঠবার চেষ্টা করেনি, কেননা কিংবদন্তি এই রকমই যে গ্রেট আইরির চারপাশেই আছে সটান-খাড়া অগম্য সব পাথুরে দেয়াল। তাছাড়া সাম্প্রতিক চমকপ্রদ ব্যাপারস্যাপারের আগে গ্রেট আইরি কখনোই পর্যটকদের তেমন-একটা আকৃষ্ট করেনি। মিস্টার স্মিথ ব্যক্তিগতভাবে গাইড দুজনকে চিনতেন, তারা দুঃসাহসী, দক্ষ আর নির্ভরযোগ্য। কোনো বাধাবিপত্তির কাছেই তারা মাথা নোয়বে না–আর আমরা ঠিক করেছিলুম আমরা সবসময়েই সবকিছুতেই পদে-পদে তাদের অনুসরণ করে চলবো।

তাছাড়া মিস্টার স্মিথ শেষটায় এ-কথা বলেছিলেন হয়তো গ্রেট আইরি এখন আর আগের মতো তেমন দুরারোহও নয়।

শুনে, আমি জিগেস করেছিলুম : কেন?

কারণ সম্প্রতি মস্ত-এক পাথর শিখর থেকে ভেঙে নিচে খসে পড়েছে-আর তাইতে হয়তো ভেতরে যাবার মতো সুগম একটা পথ তৈরি হয়ে গেছে।

সে-হলে তো বলতেই হয় আমাদের কপাল ভালো।

কপাল ভালো কি মন্দ, তা আমরা কালকেই জানতে পারবো, মিস্টার স্ট্রক।

তাহলে, কাল।

.

. গ্রেট আইরি : কোন্ ঈগলের বাসা

পরদিন ভোরবেলায়, এলিয়াস স্মিথ আর আমি মরগ্যানটন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লুম। রাস্তাটা গেছে কাতাওয়াবা নদীর বাম তীর ধরে এঁকেবেঁকে ঘুরে-ঘুরে, সোজা গিয়ে পৌঁছেছে প্লেজেন্ট গার্ডেনে। যে-দুজন গাইড আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, তাদের একজন হ্যারি হর্ন, তিরিশ বছর বয়েস, অন্যজন জেমস ব্রাক, পঁচিশ বছর। তারা দুজনেই স্থানীয় লোক, আর যত পর্যটক এখানে আসে এবং ব্লু রিজ আর কাম্বারল্যাণ্ড পাহাড়ের ওপর উঠতে চায় তাদের কাছে এই দুজনের চাহিদা অসীম।

দুই-ঘোড়ায়-টানা একটা হালকা ওয়াগন জোগাড় করা হয়েছিলো, ব্লু রিজ শৈলশ্রেণীর একেবারে পাদদেশ অব্দি আমাদের নিয়ে যাবে ওয়াগনটা। তাতে তোলা হয়েছিলো দু-তিনদিনের উপযোগী রসদ–আশা ছিলো তার চেয়ে বেশি সময় আমাদের পাহাড়ে-পাহাড়ে কাটাতে হবে না। মিস্টার স্মিথ তো প্রচুর পরিমাণে মদ্য-মাংস সরবরাহ করতে পেরে ভারি খুশি। জলের জন্যে তো কোনো ভাবনা নেই, পাহাড়ি ঝরনা থেকে যত চাই তত টলটলে টাটকা জল পাওয়া যাবে, এখানে বসন্তে এত বর্ষাবদল হতে থাকে যে ঝরনার জল বছরের এই সময়টায় যেন উপচে পড়ে।

যদিও গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে বেরিয়েছেন, মরগ্যানটনের মেয়র কিন্তু কাজের সঙ্গে তার খেয়ালখুশি জড়িয়ে ফেলতে ভোলেননিঃ শিকারি হিশেবে সঙ্গে এনেছেন তার বন্দুক, আর শিকারি কুকুর নিস্কো, সে পরমোৎসাহে আমাদের ওয়াগনের পেছন-পেছন ছুটে আসছে-বাইরে বেরুতে পেরে তার খুশি আর ধরে না। নিস্কোকে অবশ্যি উইলডনের খামারবাড়িতে রেখে যাবার কথা–কারণ সেখান থেকেই আমরা পাহাড়ে চড়তে শুরু করবো। সে নিশ্চয়ই গ্রেট আইরির শিখর অব্দি আমাদের পেছন-পেছন যেতে পারবে না–একে তো ঢালটা খাড়া উঠে গেছে, তার ওপর মাঝে-মাকে পড়বে মস্ত সব ফাটল।

দিনটা চমৎকার ফুটেছিলো, টাটকা হাওয়ায় তখন এপ্রিলের সকালের হালকা ঠাণ্ডা আমেজ। মাথার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে হালকা শাদা মেঘের পাঁজা, দূর অ্যাটলান্টিক থেকে মস্ত উপত্যকা পেরিয়ে যে-হাওয়া আসছে তারাই এই হালকা শাদা মেঘকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সূর্য মাঝে-মাঝেই উঁকি মারছে মেঘের আড়াল থেকে, আলো করে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জের নতুন শ্যামলিমা।

যে-বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি, তাতে যেন অফুরান জীবজন্তুর মেলা বসে গেছে। আমাদের ওয়াগনের চাকার শব্দ শুনে হুড়মুড় ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। কাঠবেড়ালি, মেঠোহঁদুর, ঝলমলে সব পালকে সাজানো প্যারাকীট–তাদের অবিশ্রাম ডাকাডাকিতে কানে যেন তালা ধরে যায়, লাফিয়ে-লাফিয়ে আমাদের পেরিয়ে গেলো ওপোসুমরা, থলের মধ্যে বাচ্চাগুলোকে সাবধানে আগলে রেখে। পিপুল, তাল, রডোডেনড্রনের গুচ্ছ–আর তাদের ঘন পাতার ফাঁকে-ফাঁকে কত ধরনের যে পাখি, তার আর ইয়ত্তা নেই, সবগুলো আমি আবার চিনিও না।

আমরা প্লেজেন্ট গার্ডেনে এসে পৌঁছুলুম সন্ধেবেলায়। সেখানে আমরা বেশ আরামে-গরমেই আশ্রয় পেলুম প্লেজেন্ট গার্ডেনের মেয়রের বাড়িতে, তিনি আবার মিস্টার স্মিথের বিশেষ বন্ধু। প্লেজেন্ট গার্ডেন নেহাৎ অজ পাড়াগাঁ, কিন্তু তার মেয়র তবু উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের, বিশেষভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন আমাদের। কতগুলো বিশাল বীচগাছের ছায়ায় তার চমৎকার বাড়িটা–সেখানে বেশ পরিতোষভরেই রাজসিক আহারবিহার করা গেলো।

স্বভাবতই আলোচনাটা ফিরে-ফিরে এলো আমাদের এই অভিযানের উদ্দেশ্যটায়–আমরা যে গ্রেট আইরির ভেতরটায় গিয়ে তার পেটের কথা টেনে বার করতে চাচ্ছি, সব কথাবার্তা সেখানটাতেই আসতে লাগলো ঘুরে-ফিরে । আপনারা ঠিকই করেছেন, বললেন আমাদের গৃহকর্তা, যতক্ষণ-না আমরা জানতে পারছি গ্রেট আইরির পেটের মধ্যে কী আছে, ততক্ষণ এখানকার বাসিন্দারা ভয়ে-শঙ্কায় অস্থির হয়ে দিন কাটাবে।

গ্রেট আইরির ওপর সেই-যে দাউদাউ শিখা দেখা দিয়েছিলো, আমি জিগেস করলুম, তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত নতুন-কিছু ঘটেনি কি?

কিছুই না, মিস্টার স্ট্রক। প্লেজেন্ট গার্ডেন থেকে আমরা পাহাড়ের পুরো শিখরটাই দেখতে পাই। কোনো সন্দেহজনক আওয়াজ ভেসে আসেনি সেখান থেকে। কোনো ফুলকি ওঠেনি আগুনের। যদি-বা একপাল শয়তান এসে ওখানে আস্তানা গেড়ে থাকে, তবে এতক্ষণে তারা নিশ্চয়ই তাদের নারকীয় রান্নাবান্না শেষ করে ফেলেছে-তারপর ভুরিভোজ সেরে হয়তো অন্য-কোনো আস্তানায় চলে গিয়েছে।

শয়তান! মিস্টার স্মিথ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।আশা করি তাদের কাজকর্মের কোনো নিশানা ফেলে না রেখে তারা তাদের শিবির তোলেনি–দু-একটা পায়ের খুর, মাথার শিং কিংবা ল্যাজের ডগা নিশ্চয়ই ফেলে গেছে তারা। আমরা সে-সব খুঁজে বার করবো।

পরদিন, উনত্রিশে এপ্রিল, আবার আমরা ভোরবেলাতেই রওনা হয়ে পড়লুম। দ্বিতীয় দিনের শেষে-আমরা আশা করেছিলাম–পাহাড়ের পায়ের কাছে উইলডনের খামারবাড়িটায় পৌঁছে যাবো। যে-তরাইটার মধ্য দিয়ে চলেছি, সেটা হুবহু গতকালকার মতোই, তবে ছোট্ট একটা তফাৎও আছে–পথ ক্রমশ ঘুরে-ঘুরে ওপরে উঠে গেছে। একান্তভাবে পথে পড়ছে বনজঙ্গল অথবা জলাভূমি, যদিও জলাশয়গুলোর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে; যত ওপরে উঠছি মনে হচ্ছে রোদ্দুর তাদের গষে-গষে শুষে ফেলেছে। এখানটায় লোকজনের বসতিও তেমন নেই। ছোট-ছোট্ট কয়েকটা হ্যামলেট, বীচগাছের তলায় তারা যেন প্রায় হারিয়েই গেছে, মাঝে-মাঝে চোখে পড়ে নিঃসঙ্গ একেকটা খামারবাড়ি, কত-যে ছোটোছোটো সোঁতা নেমে এসেছে জল নিয়ে, নিচে গিয়ে আছড়ে পড়ছে কাতাওয়াবা নদীর খাতে।

খুদে-খুদে সব পাখি আর ছোটো ছোটো জানোয়ারের সংখ্যা অবশ্য আরো-অনেক বেড়ে গিয়েছে। বড় লোভ হচ্ছে, কন্দুকটা বার করে নিয়ে নিস্কোর সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে যাই, দু-একবার কথাটা পেড়েছেন মিস্টার স্মিথ, আমার জীবনে এইই প্রথম বার আমি এখানটা দিয়ে যাচ্ছি, অথচ কোনো তিতির বা খরগোশ মারছি না। বেচারা জীবজন্তুগুলো পরে হয়তো আমায় চিনতেই পারবে না। তবে আমাদের কাছে যে যথেষ্ট খাবারদাবার আছে তা-ই নয়, পরে আজ আমাদের বড়োকোনোকিছুকে তাড়া করে যেতে হবে। তাড়া করতে হবে রহস্যকে।

আর, আশা করা যাক, আমি ফোড়ন কেটেছি, আমাদের নিরাশ শিকারি হয়ে ফিরে আসতে হবে না।

বিকেলবেলায় ব্লুরিজ-এর পুরো মালাটাই, মাইল ছয়েক দূরে, আমাদের চোখের সামনে দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে গেলো। স্বচ্ছনীল আকাশের পটে শিখরগুলো যেন আরো-গাঢ় নীল রঙে স্পষ্ট করে আঁকা, নিচের দিকে নিবিড় বনানী, যত ওপরে উঠেছে ততই রুক্ষ ফাঁকা পাথুরে ঢাল, শিখর অব্দি তারপর উঠে গেছে কেবল স্থগিতবৃদ্ধি বেঁটে বেঁটে চিরহরিতের ঝোঁপ। শুটকো সিঁড়িঙে সব গাছ, কিম্ভুতভাবে তেড়েবেঁকে-যাওয়া, সেই পাথুরে শিখরকে কি-রকম যেন উদ্ভট আর বিমর্ষ বানিয়ে তুলেছে। এখানে-সেখানে শৈলশিরা উঠে গিয়েছে তীক্ষ্ণ চূড়ায়, আমাদের ডানদিকে আছে কালো গম্বুজ, ব্ল্যাক ডোম, প্রায় সাতহাজার ফিট ওপরে সে তার অতিকায় মাথা তুলেছে, মাঝে-মাঝে তার চুড়া মেঘের ফাঁকে-ফাঁকে ঝকমক করে উঠছে।

আপনি কখনও ঐ গম্বুজটার ওপরে উঠেছেন, মিস্টার স্মিথ? আমি জিগেস করেছি।

না, উত্তর দিয়েছেন এলিয়াস স্মিথ, তবে শুনেছি যে ঐ চূড়ায় ওঠা নাকি দারুণ কঠিন ব্যাপার। কয়েকজন পর্বতারোহী অবশ্য চূড়াটায় উঠেছিলো, তারা জানিয়েছে সেখান থেকে গ্রেট আইরির পেটের মধ্যে নাকি কিছুতেই দেখা যায় না।

ঠিক বলেছে তারা, বলেছে আমাদের গাইড হ্যারি হর্ন, আমি নিজেও দু-একবার চেষ্টা করে দেখেছি।

হয়তো, আমি সান্ত্বনা দিয়েছি, আবহাওয়া মেঘলা ছিলো।

মোটেই না, মিস্টার স্ট্রক, বরং আমি যেদিন উঠেছিলুম, সেদিন আবহাওয়া ছিলো চমৎকার–এত স্বচ্ছ সাধারণত থাকে না। কিন্তু গ্রেট আইরির দেয়াল এত খাড়াভাবে আকাশে উঠে গিয়েছে যে ভেতরটা সম্পূর্ণ লুকিয়ে রেখেছে।

সামনে, সামনে, মিস্টার স্মিথ চেঁচিয়ে উঠেছেন, ফরওয়ার্ড। যেখানে কেউ আগে কখনও পা ফ্যালেনি, কিংবা চাক্ষুষ দ্যাখেনি যে-জায়গা, এমনকী দেবদূতেরাও না, সেখানে গিয়ে প্রথম পা ফেলতে আমার কোনো দুঃখই হবে না!

সত্যিই, এমন-এক চমৎকার দিন ছিলো সেটা যে গ্রেট আইরিকে তখন দেখিয়েছে। ধীরগম্ভীর, প্রশান্ত, তার দিকে তাকিয়ে আমরা কোনো শিখা বা কোনো ধোঁয়ার রেশও দেখতে পাইনি।

বেলা পাঁচটা নাগাদ আমাদের অভিযান এসে থেমেছে উইলডন খামারে, যেখানে ভাড়াটেরা সবাই বেরিয়ে এসে একযোগে অভ্যর্থনা জানিয়েছে তাদের ভূস্বামীকে। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়ে চলেছে গত কয়েকদিনে গ্রেট আইরিতে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনাই ঘটেনি। আমরা সবাই মিলে তারপর একটা মস্ত টেবিলে ভোজে বসেছি, খামারের সবাইও আমাদের সঙ্গে সেখানে খেতে বসেছে, আর সে-রাতে আমাদের ঘুম হয়েছে। গভীর, নিরুপদ্রব, ভবিষ্যতের কোনো অলুক্ষুণে আশঙ্কাই ঘুমের মধ্যেটায় হানা দেয়নি।

পরেরদিন, আলো ফোটবার আগেই, আমরা পাহাড়ে ওঠবার জন্যে বেরিয়ে পড়েছি। গ্রেট আইরির উচ্চতা পাঁচ হাজার ফিটও হবে কি না সন্দেহ। নেহাৎ নাতি উচ্চ শিখর, আলেঘেনির এই অংশে এর চাইতে উঁচু শিখর আছে কতগুলো । আমরা যেহেতু তখন সমুদ্রতল থেকে তিনহাজার ফিট উঁচুতে ছিলুম, পাহাড়ে ওঠবার ক্লান্তি তাই ঘুব একটা বেশি হবার কথা নয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিশ্চয়ই আমরা শিখরের ওপর জ্বালামুখের কাছে গিয়ে পৌঁছুতে পারবো। বাধাবিঘ্ন হয়তো থাকবে কিছু-কিছু, বেয়ে উঠতে হবে খাড়া ঢাল, শৈলশিরা, আর শৈলশ্রেণীর মধ্যেকার ফাটলগুলো হয়তো আমাদের বাধ্য করবে ক্লান্তিকর ও বিপজ্জনক ঘুরপথ দিয়ে যেতে। এই পাকদণ্ডী সম্পূর্ণ অজানা মানুষের, আমাদের প্রচেষ্টার পেছনে তাই একটা অদ্ভুত তাড়াও ছিলো– অজানাকে জয় করে নেবার তাড়া। এখান থেকে যে-উৎরাই শুরু, সেখানটা আমাদের গাইডদেরও অচেনা। আমাকে যেটা উৎকণ্ঠিত করে তুলেছিলো, তা এই তথ্য : এর আগে সবাই বলেছে যে গ্রেট আইরি শুধু দুর্গম নয়, সম্পূর্ণ অগম্য। কিন্তু তা তো আর তর্কাতীতভাবে প্রমাণ হয়নি। তারপর আরেকটা নতুন উৎপাতের কথাও ভুললে চলবে না : কোনো নতুন ধস নেমে হয়তো পাথুরে ঢালটায় মস্ত-একটা ফাঁকা গহ্বর তৈরি করে দিয়ে গেছে।

অবশেষে, দিনে গোটা-কুড়িবার পাইপে তামাক ভরে পাইপ টানেন মিস্টার স্মিথ, এবার তার প্রথমটা ফুঁকতে-যুঁকতে তিনি আমায় বলেছেন, অবশেষে সত্যি অভিযান শুরু হলো আমাদের। উঠতে কত সময় লাগবে, অল্প, না বেশি

আমি বাধা দিয়ে বলেছি, অল্পই লাগুক, আর বেশিই লাগুক, আপনি আর আমি তো প্রতিজ্ঞাই করেছি যে এর শেষ না-দেখে ফিরবো না।

হ্যাঁ, সেটাই তো প্রতিজ্ঞা।

আমার বডোকর্তা আমার কাঁধে দায় চাপিয়ে দিয়েছেন-যে-করেই হোক, গ্রেট আইরির দানবের সমস্ত রহস্য আমায় ভেদ করতে হবে।

দানবের কাছ থেকে গুপ্ত রহস্য আমরা ছিনিয়ে নিয়ে আসবো, তা সে তা পছন্দ করুক, চাই না-করুক। অন্তরীক্ষকে সাক্ষী রেখে শপথ করেছেন মিস্টার স্মিথ, তাতে যদি পাহাড়ের আঁতের মধ্যে গিয়েও খোঁজাখুঁজি করতে হয়, তাও সই।

তার একটা সম্ভাবনা এই হতে পারে যে, আমি বলেছি, আমাদের অভিযান হয়তো আজকের দিনটাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেইজন্যে লটবহর ও রসদের দিকে একবার নজর বুলিয়ে নেয়া ভালো।

আশ্বস্ত হোন, মিস্টার স্ট্রক। আমাদের গাইডদের ন্যাপস্যাকে দু-দিনের উপযোগী খাবারদাবার আছে। তাছাড়া আমরাও তো কিছু খাদ্য বহন করে চলেছি। যদিও আমার বেপরোয়া নিস্কোকে আমি খামারে রেখে এসেছি, তবু সঙ্গে বন্দুকটা আনতে আমি ভুলিনি। বনের মধ্যে কিংবা নয়ানজুলিগুলোয় বিস্তর শিকার মিলবে-আর শিখরে উঠে আমরা হয়তো একটা অগ্নিকুণ্ড দেখতে পাবো, যেখানে দিব্বি ঝলসানো যাবে মাংস, রসুই পাকাতে আমাদের কোনোই ঝামেলা হবে না।

অগ্নিকুণ্ড দেখতে পাবেন, মিস্টার স্মিথ?

কেন নয়, মিস্টার স্ট্রক? ঐ শিখাগুলো! ঐ চমৎকার লকলকে লেলিহান শিখাগুলো! যা দেখে গাঁ-গঞ্জের লোক ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে! সেই আগুন কি বরফহিম নাকি? তাদের ছাইয়ের তলায় কোনোই ফুলকি পাওয়া যাবে না বুঝি? আর, তারপর ধরুন, এটা যদি সত্যি কোনো জ্বালামুখ হয়, আগ্নেয়গিরি কি তবে একেবারেই নিভে গেছে যে জ্বলন্ত একটা অঙ্গারও পাওয়া যাবে না? বাহ্, তাহলে এ আবার কেমনতর আগ্নেয়গিরি-যে একটা ডিম ভাজা যাবে না বা আলু ঝলসে নেয়া যাবে না? চলুন, চলুন, দেখাই যাক কী আছে ঐ পেটে–ঐ পাথরের জঠরে!

তদন্তের এখানটায় এসেও, প্রথমেই কবুল করে নেয়া ভালো, আমি কোনো তত্ত্বই খাড়া করিনি। আমার ওপর হুকুম হয়েছে গ্রেট আইরিকে সরেজমিন খুঁটিয়ে দেখে আসতে হবে। যদি মনে হয় যে সে একেবারেই নিরীহ, নিরুপদ্রব, কোনো উৎপাতেরই আশঙ্কা নেই, তবে তা ঘোষণা করে দেয়াই হবে আমার কাজ, কেননা তাহলে এখানকার লোকজন আশ্বস্ত হতে পারবে, নিশ্চিন্ত হতে পারবে। তবে, এও কবুল করা ভালো, আমার মধ্যে বিষম কৌতূহল হানা দিয়েছিলো। আমার বরং ভালোই লাগবে, নিজের জন্যেও বটে, আমার অভিযানের জন্যেও বটে, যদি গ্রেট আইরির এই চমকপ্রদ কাণ্ডকীর্তির আসল কারণটা আমি বার করতে পারি।

আমাদের পর্বতারোহণ শুরু হলো এইভাবে : গাইড দুজন যাবে আগে-আগে, খুঁজে দেখবে কোন পথ ধরে এগুলে, বা উঠলে, সুবিধে হবে। এলিয়াস স্মিথ আর আমি এগুবো অপেক্ষাকৃত গদাইলস্করি চালে। একটা সংকীর্ণ গিরিসংকট বেয়ে পাথর আর গাছপালার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছি গোড়ায়, খুদে একটা স্রোতস্বিনী সুতোর মতো ঝরে পড়েছে আমার পায়ের তলায়।বর্ষাকালে, কিংবা কখনও কোনো মুষলধারে বর্ষণের পরে, এর জল নিশ্চয়ই পাথর থেকে পাথরে ঝমঝম করে আছড়ে পড়ে নামে। তবে এর খাতকে নিশ্চয়ই বৃষ্টিই জল খাওয়ায়, কারণ এখন তার ধারাটা সুতোর মতো বয়ে চলেছে। গ্রেট আইরির ভেতরকার কোনো মত্ত হ্রদের জল বেরুবার রাস্তা নিশ্চয়ই এটা নয়।

এক ঘণ্টা ধরে ওঠবার পর, পাহাড়ের ঢাল এতটাই খাড়া হয়ে পড়েছিলো যে আমাদের বেঁকে-বেঁকে যেতে হয়েছে, কখনও ডানদিকে, কখনও বামদিকে, আর আমাদের গতিও খুব মন্থর হয়ে এসেছে। একটু পরেই এই সংকীর্ণ গিরিসংকটটি পুরোপুরি অসাধ্য হয়ে উঠলো; এর পাহাড়ি খাড়া ঢালে পা রাখবার মতো কোনো খাঁজ নেই। আমাদের হয় গাছের ডাল থেকে ঝুলে, নয়তো বুকে হেঁটে হামাগুড়ি গিয়ে এগুতে হয়েছে। এই গতিতে এগুলে সূর্যাস্তের আগে কিছুতেই শিখরে পৌঁছুনো যাবে না।

আস্থা, আস্থায় বুক বাঁধুন। হাঁফ ছাড়বার জন্যে একঝলক থেমে মিস্টার স্মিথ বলেছেন। এতক্ষণে বুঝতে পারছি কেন দু-একজন ছাড়া কেউই গ্রেট আইরির ওপরে উঠতে চায়নি–আর তাই আমার অন্তত জ্ঞানত মনে পড়ে না কেউ কখনও এর ওপর উঠেছে কি না।

আসলে, আমি সায় দিয়ে বলেছি, এত পরিশ্রম করে লাভটাই বা কী হতো, বলুন। আমাদের যদি ওপরে ওঠবার জন্যে বিশেষ কোনো তাগিদ না-থাকতো

এর চেয়ে সত্যকথা জীবনে আপনি আর-কিছু বলেননি,হ্যারি হর্ন ঘোষণা করেছে, আমাকে থামিয়ে দিয়ে, আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে কতবারই তো ব্ল্যাক ডোমের ওপরে উঠেছি, কিন্তু পথে কোনোবারই এত বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে হয়নি।

বাধাবিঘ্নই শুধু নয়, এদের অতিক্রম করাও দুঃসাধ্য, জুড়ে দিয়েছে জেমস ব্রাক।

এখন যে-প্রশ্নটা কুট করে আমাদের মগজে কামড়াচ্ছে তা এই : কোন নতুন পথ ধরে এগুবো আমরা, বুঝবো কী করে সেই পথেই ওপরে ওঠা যাবে। বাঁয়ে যাবো, না কি ডানদিকে যাবো? দু-দিকেই উঠেছে গাছপালা ঝোঁপঝাড়ের দুর্ভেদ্য ঘন বুনোট। সত্যি-বলতে, এর চেয়ে সরাসরি শিখরে উঠে-যাওয়াও সহজ হতো। একবার যদি এই নিবিড় বনানী ভেদ করে ওপাশে চলে যেতে পারি তবে হয়তো নিশ্চিততর পদক্ষেপে আমরা অগ্রসর হত পারবো। এখন তো আমরা কেবল এগুতে পারি অন্ধের মতো, হাড়ে-হাড়ে; অন্ধের মতোই আমাদের এই দুজন গাইডের স্বজ্ঞা ও সহজাত বোধের ওপর নির্ভর করতে হবে এখন। জেমস ব্রাকের বোধবুদ্ধিই বেশি কাজে এসেছে তখন, আমার বিশ্বাস, এই দুঃসাহসী তরুণটি হালকা চলাফেরায় বাঁদরদেরও হার মানাতো, আর ক্ষিপ্রতায় ছাগলছানারাও তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারতো না। দুর্ভাগ্যবশত, না এলিয়াস স্মিথ, না আমি শ্রীযুক্ত স্ট্রক, তার সঙ্গে তাল রেখে উঠতে পারি, সে যেখানে উঠতে পারে আমাদের পক্ষে সেখানে পা দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

তবে যখন সত্যিই কোনোকিছু করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়ে, আমি অবশ্য সহজে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নই-কারু থেকেই পেছিয়ে থাকতে আমার ইচ্ছে করে না; ধাতের মধ্যেই একগুয়েমি আর জেদ আছে আমার, আর আমার জীবিকাটাই এমন যে শরীরটাকে সবসময় সামলেসুমলে সক্ষম রাখতে হয়, জেমস ব্রাক যেখানে যেতে পারে, আমিও সেখানে যেতে পারবো–এতে যদি কয়েকবার বিষম আছাড় খেয়ে পড়তে হয়, তাতেও কুছ পরোয়া নেই। তবে মরগ্যানটনের চীফ ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে ব্যাপারটা তেমন সহজ ছিলো না; একে তো তিনি আর মোটেই তরুণ নন, তেমন চটপটে বা ক্ষিপ্রও নন আর, দশাসই শরীর, ভারি, আর একটু ধকলেই কাবু হয়ে পড়েন। যথাসাধ্য করেছেন এলিয়াস স্মিথ, যাতে আমাদের অগ্রগতিতে কোনো বাধা না-পড়ে, কিন্তু সারাক্ষণ ডাঙার ওপর সীল মাছের মতো খাবি খেয়েছেন তিনি–শেষে, একটু পরেই, আমাকে জোর দিয়ে বলতে হয়েছে বিশ্রাম নেবার জন্যে আমাদের একটু থামা উচিত।

অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছিলো যে আমরা যতটা আন্দাজ করেছিলুম, তার চেয়েও অনেক বেশি সময় লেগে যাবে গ্রেট আইরির ঈগলের বাসায় উঠতে হলে। আমরা ভেবে রেখেছিলুম এগারোটার মধ্যেই আমরা পাথুরে দেয়ালটার পায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছে যাবো, কিন্তু এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি মধ্যদিনের সূর্যও আমাদের তার থেকে কয়েকশো ফিট নিচে দেখতে পাবে।

দশটা নাগাদ, যখন বার-বার অপেক্ষাকৃত সহজ কোনো রাস্তা খোঁজবার ব্যর্থ চেষ্টা করে আমরা হন্যে হয়ে উঠেছি, কতবার মোড় ঘুরেছি, কতবার পাকদণ্ডী আমাদের ফিরিয়ে এনেছে একই জায়গায়, তখন গাইডদের একজন সংকেত করে আমাদের থামতে বললে। অবশেষে আমরা নিজেদের আবিষ্কার করলুম ঐ নিবিড় বনের ওপরকার স্তরে। গাছগুলো এবার আর তেমন গায়ে-পড়া নয়, গায়ে-গায়ে জড়িয়ে নেই ঘননিবিড়, ফলে তাদের ফাঁক দিয়ে আমরা দেখতে পেলুম সেই পাথুরে দেয়ালের তলদেশ যেখান থেকে ওপরে উঠে গিয়েছে সত্যিকার গ্রেট আইরি।

উঃফ! একটা মস্ত পাইনগাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মিস্টার স্মিথ হাঁফ ছাড়লেন। একটু জিরিয়ে নেয়া যাক। সেই সঙ্গে একটু না হলে দারুন জমে যাবে।

আমি বললাম, এখানে আমরা এক ঘণ্টা জিরিয়ে নেবো।

হ্যাঁ-হ্যাঁ; ফুশফুশ আর পাগুলোকে এতক্ষণ ধরে খাঁটিয়ে নেবার পর আমাদের জঠরগুলোকেও এবার একটু খাটানো যাক।

এই একটা ব্যাপারে কারুরই কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হলো না। একটু বিশ্রাম সবাইকেই আবার চাঙা করে তুলবে। আমাদের অস্বস্তির শুধু একটাই কারণ : পাহাড়ের ঢালটা দেখে মোটেই মনোরম বলে মনে হচ্ছেন না। যে-জায়গাগুলোয় কোনো গাছপালা গজায় না স্থানীয় লোকেরা তাকে বলে সরসরি-মসৃণপিছল ঢাল। মাটিও সেখানে একটু আলগা, মাঝে-মাঝে চোখাচোখা পাথর বেরিয়ে আছে, আর হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে-বেরুনো পাথরের মধ্যে কোনো রাস্তাই নেই।

হ্যারি হর্ন তার সহকর্মীকে বললে, কাজটা খুব সহজ হবে না।

অসম্ভবই হবে, হয়তো, ব্রাক সায় দিয়ে বললে।

তাদের এই মন্তব্য আমার গোপন অস্বস্তিটাকে আরো চাগিয়ে দিলে। পাহাড়ের চূড়ায় না-উঠেই যদি আমাকে ফিরে যেতে হয়, আমার অভিযান তাহলে সমূহ ব্যর্থ হবে–আর কৌতূহল চরিতার্থ করতে না-পারার দরুন কী-যে কষ্ট পাবো, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন। আর তারপর যখন মিস্টার ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, পরাস্ত ও লজ্জিত, আমাকে দেখে তখন রাস্তার অচেনা লোকেরও সহানুভূতি উথলে উঠবে।

ন্যাপস্যাকগুলো খুলে আমরা রুটি আর ঠাণ্ডা মাংস দিয়েই মোটামুটিভাবে ভোজ সারলুম। খাওয়া শেষ হতেই, আধঘণ্টার মধ্যেই, মিস্টার স্মিথ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, সতেজ ও উৎসুক, আবারও এগিয়ে-যাওয়া যাক। জেমস ব্রাক চললো সকলের আগে আগে; আমরা শুধু যতটা ভালোভাবে পারি তাকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করলুম।

আমাদের চলা হলো ধীরমন্থর। আমাদের গাইডরা তাদের দ্বিধা ও সন্দেহ চাপবার কোনো চেষ্টাই করছে না। একটু পরেই হ্যারি হর্ন আমাদের ছেড়ে একাই এগিয়ে গেলো–কোন রাস্তায় গেলে সবচেয়ে সুবিধে হবে, সেটাই আন্দাজ করে নিতে।

কুড়ি মিনিট পরেই সে ফিরে এলো, আমাদের নিয়ে চললো উত্তরপশ্চিমে। এই দিকটাতেই তিন-চার মাইল দূরে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ব্ল্যাক ডোম। আমাদের পথ এখনও কঠিন, কষ্টকর, আলগা পাথরের ওপর দিয়ে গেছে পথ, কখনও পাথরগুলো আটকে আছে নেহাৎই বরাৎজোরে, কোনো ঝোঁপের গায়ে। অবশেষে, বিস্তর ধকলের পর, একেবারে নাজেহাল, আমরা আরো দুশো ফিট ওপরে উঠতে পারলুম, তারপরেই দেখলুম কাটা ঘায়ের মতো মস্ত হা করে আছে একটা গহুর, সেখান থেকে কবে যেন মাটি ধসে পড়েছে নিচে। এখানে-সেখানে দেখা গেলো সদ্য-উৎপাটিত গাছের শেকড়, ভাঙা-ভাঙা ডালপালা, গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে-যাওয়া মস্ত-সব পাথরের চাই, যেন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সদ্য-সদ্য একটা ধস নেমে গিয়েছে, আভালাঁশ।

এটাই নিশ্চয়ই গ্রেট আইরির ওপর থেকে মস্ত পাথরটা ধসে পড়বার চিহ্ন, মন্তব্য করলে জেমস ব্রাক।

নিশ্চয়ই তাই, মিস্টার স্মিথ সব দেখেশুনে সায় দিলেন, আমার মনে হয় আমরা বরং আমাদের জন্যে তৈরি-করা এই পথটা দিয়ে এগুলেই ভালো করবো।– এই পাহাড়চেরা গহ্বরের পাশটাকেই হ্যারি হর্ন পাহাড়ে চড়ার জন্যে বেছে নিয়েছে। রাক্ষুসে পাথরটা গড়িয়ে পড়বার সময় দেয়ালের যে-অংশটা ভেঙে না-পড়ে ঠেকিয়েছিলো, সেখানকার শক্ত জমির ওপরই আমাদের পা নির্ভর করতে পারলে। আমাদের পথচলা তাই অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে উঠলো এখানে, এখন আমরা প্রায় একটা সরল রেখার মতোই সোজা ওপরে উঠছি, আর তার ফলেই সাড়ে-এগারোটা নাগাদ আমরা ঐ সরসরি-র ওপরকার সীমারেখায় গিয়ে পৌঁছুলুম।

আমাদের সামনে, একশো ফিটও দূরে হবে কি না সন্দেহ, কিন্তু মিনারের মতো সোজা খাড়া হয়ে ওপরে, শূন্যে উঠে গেছে একশো ফিট, দাঁড়িয়ে আছে সেই শিলাময় দেয়াল, যেটা এর আসল শিখর, গ্রেট আইরির শেষ প্রতিরোধব্যবস্থা।

এদিক থেকে চূড়ার দেয়ালকে দেখাচ্ছিলো উদ্ভট-খামখয়ালিতে-ভরা বন্ধুর পাথরের মতো, কখনও উগ্র রুক্ষ গম্বুজের মতো উঠেছে ওপরে, কখনও-বা উবড়োখেবড়ো দেখালো ঠিক যেন এক অতিকায় ঈগল আকাশের পটে ছায়ার মতো আঁকা, উড়াল দেবার জন্যে দু-দিক ছড়ানো তার দুই ডানা । এদিক থেকে, অন্তত, সেই চূড়ায় ওঠা অসম্ভব।

এক মিনিট সবুর করুন, বললেন, মিস্টার স্মিথ, আমাদের এবার খতিয়ে দেখতে হবে এই পাথরটার বুনিয়াদটার পাশ দিয়ে ওদিকে গিয়ে ওঠা যায় কি না।

এটা মনে হয়, হ্যারি হর্ন জানালে, ঐ মস্ত ধসটা নিশ্চয়ই চূড়ার এদিকটা থেকেই গড়িয়ে নেমে এসেছিলো–অথচ ভেতরে ঢোকবার মতো কোনো রাস্তা সে রেখে যায়নি।

তাঁদের দুজনের পর্যবেক্ষণই নির্ভুল। অন্য-কোথাও গিয়ে আমাদের ওঠবার পথ খুঁজে বার করে নিতে হবে। দশ মিনিট জিরিয়ে নেবার পর, আমরা কোনোরকমে পায়ে পায়ে দেয়ালটার ঠিক পাদদেশে গিয়ে দাঁড়ালুম, তারপর তাকে ঘিরে চক্কর দেবার মতো ঘুরতে লাগলুম-যদি কোনো পথ পাওয়া যায়।

বলতে-কি, গ্রেট আইরি ততক্ষণে আমার চোখে রীতিমতো আশ্চর্য বলে ঠেকছে–আশ্চর্য আর অবিশ্বাস্য। তার শিখরে যেন আছে যত ড্রাগন, রাক্ষুসে জীব, অতিকায় দানব। যেন কোনো অনল-ওগরানো দানব, পুরাণ থেকে উঠে এসেছে, মাথাটা সিংহের, ল্যাজটা মহানাগের, আর শরীরটা ছাগলের; যেন কোনো গ্রিফিন, যার মাথাটা ঈগলের, পাখাগুলো ঈগলের, কিন্তু শরীরটা সিংহের; পুরাণের যত অলৌকিক জীব এসে যদি তাকে পাহারা দিতো, তাহলেও হয়তো আমি অবাক হতুম না।

অত্যন্ত সাবধানে, বিপদ মাথায় করে, আমরা পাথরটার বেড় ঘিরে ঘুরতে লাগলুম। মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন মানুষেরই মতো মিস্ত্রির কাজ করে গেছে এখানে, যেন খুব সচেতন সুঠাম নীলনকশামাফিক কাজ করেছে প্রকৃতি। এই দুর্গের দেয়ালের মতো পাথরে কোথাও একটা খাঁজ নেই; পাথরের আস্তরে একটা আঁচড় পর্যন্ত পড়েনি, যেখানে পা রেখে কেউ বেয়ে উঠতে পারে ওপরে। সবখানেই শুধু এই পাথুরে দেয়াল, এই ঢাল, সবখানেই সে একশো ফিট উঁচু!

দেড়ঘণ্টা-জোড়া এই কঠিন পরিশ্রম ও চংক্রমণের পর, আমরা আবার ফিরে এলুম সেখানেই, যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলুম। আমি আর আমার হতাশা চেপে রাখতে পারিনি, আর মিস্টার স্মিথও আমার চেয়ে কম বিচলিত হয়ে পড়েননি।

হাজার শয়তানের বাসা! খেঁকিয়ে উঠলেন মিস্টার স্মিথ, এই হতচ্ছাড়া গ্রেট আইরিটার ভেতরে যে কী আছে, তাই আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না–যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম। এটা কোনো আগ্নেগিরির জ্বালামুখ কি না, তা শুঙ্কু জানি না।

আগুনের পাহাড় হোক বা না-হোক, আমি বললুম, এখন কিন্তু কোনো সন্দেহজনক শব্দ শোনা যাচ্ছে না; ধোঁয়া কিংবা শিখাও নেই চূড়ার ওপর; এমনকিছু চোখে পড়েনি যা দেখে মনে হয় অগ্নদগারের কোনো সম্ভাবনা আছে।

মিথ্যে বলিনি কথাটা । গভীর-এক স্তব্ধতা বিরাজ করছে আমাদের ঘিরে; মাথার ওপর ঝলসাচ্ছে নিখুঁত-স্বচ্ছ নীল আকাশ। সমুদ্রতল থেকে অনেক উপরে উঠে এলে যে গভীর-গম্ভীর প্রশান্তি অনুভব করা যায়, আমরা এখন তাকেই চাখছিলম।

এখানে বলে রাখা ভালো ঐ বিশাল পাথরটার বেড় ছিলো বারোশো থেকে পনেরোশো ফিট। ভেতরে যে-জায়গাটা সে সুরক্ষিত রেখেছে, সে-যে কী হতে পারে, দেয়ালের প্রস্থ না-জেনে, দেয়ালটা কতটা পুরু না-জেনে, সে-সম্বন্ধে কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছিলো না। পুরো জায়গাটাই যেন ফাঁকা, পরিত্যক্ত, প্রাণহীন।হয়তো কোনোদিনই কোনো জ্যান্তপ্রাণী এত উঁচুতে ওঠেনি-বড়ো-বড়ো শিকারি পাখিরা চূড়ার ওপরেই আকাশে উড়াল দিয়েছে যেন চিরকাল।

আমাদের ঘড়িতে তখন ঘণ্টার কাটা তিনটের ঘরে। মিস্টার স্মিথ প্রায় বিরক্ত হয়েই বলে উঠলেন, সারাদিন ধরে এখানে বসে থেকে আর কী লাভ? আর কিছুই আমরা এখানে বসে থেকে জানতে পারবো না। যদি আজ রাত্তিরেই প্লেজেন্ট গার্ডেনে ফিরে যেতে হয়, মিস্টার স্ট্রক, আমাদের তবে এক্ষুনি রওনা হয়ে পড়তে হবে।

আমি এ-কথার কোনো উত্তর দিইনি। যেখানে বসে ছিলুম, সেখান থেকেও নড়িনি। কাজেই মিস্টার স্মিথ ফের একটু অধীরভাবেই বললেন, আরে, আসুন, মিস্টার স্ট্রক, কিছু-একটা তো বলবেন!

সত্যি-বলতে, বিফল হয়ে, মাঝপথেই অভিযানটায় ইস্তফা দিতে আমার নিদারুণ গাজ্বালা করছিলো : আরদ্ধ কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই আবার ঐ হতচ্ছাড়া পথ ধরে নিচে নেমে যাবো! ভেতরে-ভেতরে নাছোড় একটা তাগিদ অনুভব করছিলুম-কিছুতেই হঠবো না, লেগেই থাকবো; আমার কৌতূহল এখন দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু কীই বা এখন আর করতে পারি? এই নিঃসাড় নির্বোধ দেয়ালটাকে দু-হাত দিয়ে টেনে ফেড়ে দেবো? লাফিয়ে উঠবো অতিকায় শিখরটায়? গ্রেট আইরির দিকে শেষবারের মতো রুষ্টভাবে তাকিয়ে আমি আমার সাথীদের অনুসরণ করলাম।

ফেরার পথে কিন্তু বিশেষ-কোনো বেগ পেতে হয়নি। এবার শুধু সরসর করে নেমে আসা, আগে যেখানে এত কষ্ট করে বেয়ে-বেয়ে উঠেছিলুম। পাঁচটার আগেই আমরা পাহাড়ের শেষ ঢাল বেয়ে নেমে আসতে পেরেছি। আর উইলডন খামারের গোমস্তা আমাদের অভ্যর্থনা করেছে সাগ্রহ ভূরিভোজে ।

জিগেস করেছে : তাহলে আপনারা ভেতরে যাননি?

না, উত্তরে জানিয়েছেন মিস্টার স্মিথ, তবে আমার মনে হয় ঐ ভেতরটা আছে। কেবল এখানকার গাঁয়ের লোকের কুসংস্কারেভরা কল্পনায়।

সাড়ে-আটটার সময় আমাদের ঘোড়ায়-টানা গাড়ি এসে থেমেছে প্রেজেন্ট গার্ডেনের মেয়রের বাড়ির সামনে-সেখানেই আমরা রাতটা কাটিয়েছি তারপর। ঘুমিয়ে পড়বার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করতে-করতে আমি বারেবারে নিজেকে জিগেস করেছি আমার পক্ষে কী করা উচিত হবে–থেকে যাবো এই গ্রামে, আবার নতুন দলবল নিয়ে পাহাড়ে ওঠবার আরেকটা চেষ্টা করে দেখবো? কিন্তু প্রথম বারের বদলে এই দ্বিতীয় চেষ্টাটাই যে সফল হবে, তার কি কোনো পার্থিব কারণ আছে? নিশ্চয়ই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে সরাসরি ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে মিস্টার ওয়ার্ডের মুখোমুখি বসে পুরো ব্যাপারটাকে কাটা-চেরা করে বিশ্লেষণ করে দেখা।

কাজেই, পরদিন, আমাদের গাইড দুজনকে বখশিশ দিয়ে, আমি মরগ্যানটনের মিস্টার স্মিথের কাছে থেকে বিদায় নিয়েছি, আর সেইদিনই সন্ধেবেলার ট্রেনে করে রওনা হয়ে পড়েছি ওয়াশিংটনের উদ্দেশে।

.

. স্বতশ্চল সংঘের অধিবেশন

তবে কি গ্রেট আইরির এই রহস্যের সমাধান হবে একদিন, দৈবাৎ, এমনই আচমকা যে আমরা যা কল্পনাও করতে পারছি না? কিন্তু তা তো ভবিষ্যৎই জানে। তবে এটাও জরুরি প্রশ্ন : সমাধানটা কি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? তাতে অবশ্যি কোনো সন্দেহ নেই, যেহেতু তার সঙ্গে এত লোকের জীবনমরণের প্রশ্ন জড়ানো আছে-পশ্চিম ক্যারোলাইনার মানুষজনের নিরাপত্তার প্রশ্নটা তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত।

অথচ তবু ওয়াশিংটনে ফিরে-আসবার পনেরোদিন পরেই লোকের কৌতূহল এই সমস্যাটাকে ঠেলে সরিয়ে রেখে অন্য-একটা, একেবারেই অন্যরকম একটা, সমস্যায় চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হয়ে গেলো–আর এই নতুন রহস্যটাও কম চমকপ্রদ নয়।

মে মাসের মাঝামাঝি পেনসিলভ্যানিয়ার খবরকাগজগুলো জানালে যে পেনসিল ভ্যানিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে নাকি এমন-সব ঘটনা ঘটে চলেছে, বুদ্ধিতে যার কোনো ব্যাখ্যা চলে না। রাজধানী ফিলাডেলফিয়া থেকে যে-সব রাস্তা অন্যান্য অঞ্চলের দিকে গেছে, সে-সব রাস্তায় না কি আশ্চর্য একটা শকট দেখা যাচ্ছে, কেউই স্পষ্ট করে যার চেহারাটার বর্ণনা দিতে পারছে না–তার আকৃতি, প্রকৃতি, এমনকী শকটের মাপটা পর্যন্ত কারু জানা নেই, এতই দ্রুতবেগে সেটা পাশ দিয়ে ঝড়ের মতো চলে যায়। এটা যে একটা স্বতশ্চল শকট, অটোমোবাইল,-এ-বিষয়ে সকলেই একমত। কিন্তু সে-যে কোন মোটর তাকে চালিয়ে নিয়ে যায়, তা কেবল কল্পনাই জানে; আর যখন জনতার কল্পনা তেতে ওঠে, উসকে ওঠে, তখন জল্পনার কি আর-কোনো সীমা থাকে?

সবচেয়ে উন্নত স্বতশ্চল শকটগুলোও তখন–যাতেই তারা চলুক না কেন, বাষ্পে, গ্যাসোলিনে, বিদ্যুতে–ঘণ্টায় ষাট মাইলের বেশি বেগে যেতে পারতো না–এই গতিও ইওরোপ-আমেরিকার সেরা-সব রেলপথে, সবচেয়ে দ্রুতগামী এক্সপ্রেসও, তখনও অব্দি পেরিয়ে যেতে পারেনি। এখন, এই অভিনব স্বতশ্চল শকট কি না এর প্রায় দ্বিগুণ বেগে ছুটে চলে যায়–তাজ্জব করে যায় সবাইকে, এমনকী কল্পনাকেও যেন ভির্মি খাইয়ে দেয়।

এটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না যে এমন দুর্বার গতি রাজপথগুলোও প্রচণ্ড দুর্বিপাকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে–অন্য গাড়িগুলোর বিপদ যতটা, পথচারীদের বিপদও ততটাই, কিংবা তারও বেশি। এই দ্রুত-ধাবমান বস্তুটি–বজ্রের মতো এগিয়ে আসে সে–আসবার আগে শোনা যায় দুর্ধর্ষ এক গুমগুম গর্জন, চারপাশে সৃষ্টি করে দেয় ঘূর্ণিবায়ু, তা এমনকী আশপাশের গাছপালা থেকেও ডালপালা ছিঁড়ে-ছিড়ে ফ্যালে, আশপাশের মাঠে যে-সব গোরুভেড়া চরে বেড়ায় আঁৎকে দেয় তাদের, পাখিরা যারা ভয় পেয়ে উড়ে যায় তারা তো উদ্ধার পেলো কিন্তু অন্যরা মারা পড়ে তার তলায়, তার চলার পথে যে তীব্র শোষক হাওয়া ছড়ায় কিছুতেই তার টান এড়াতে পারে না, দুমদাম করে এসে আছড়ে পড়ে তার গায়ে, প্রচণ্ড গতিতে।

আর একটা কিম্ভুত অনুপুঙ্খ, খবরকাগজগুলো যার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো তা এই : এই স্বতশ্চল শকটের চাকা নাকি আদৌ ছোঁয় না রাস্তাকে, পথের ওপর তার চাকার নাকি কোনো আঁচড়ই পড়ে না, ভারি-ভারি সব গাড়ি পেছনে যে সব আবর্জনা ফেলে যায় তাও নাকি সে পেছনে ফেলে রেখে যায় না। খুব-বেশি হলে হালকা একটু পরশ, শুধু ধুলোর ওপর যেন বুলিয়ে যায় বুরুশ। তার এই প্রচণ্ড দুর্বার গতিই তার চলার পথে পেছনে ফেলে রেখে যায় ধূলির অমন ঘূর্ণিহাওয়া।

সম্ভব যে, নিউইয়র্ক হেরাল্ড মন্তব্য করেছিলো, এই দুর্বার গতিই তার ভারকে উধাও করে দেয়।

স্বভাবতই চারপাশ থেকে তুলকালাম প্রতিবাদ উঠেছিলো। এ-রকম উম্মাদ গতিকে এতটা বেপরোয়াভাবে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেয়া যায় না : পথের পাশে যা-ই পড়বে, জিনিশপত্র, গোরুভেড়া, মানুষজন–তাকেই সে-যে ধ্বংস করে যাবে, এ কেমন কথা? কিন্তু একে ঠেকানোই বা যায় কীভাবে? এই দুর্দান্ত শকটটার মালিক কে, কারুরই তা জানা নেই; এও জানা নেই সে কোত্থেকে আচমকা এসে উদয় হয়, আর কোথায়ই বা মিলিয়ে যায়। এটা ঠিক যে এক চর্মচক্ষে দেখা গেছে, কিন্তু ঝলকের জন্যে, যেন কোনো বন্দুকের গুলি দুম করে ছুটে গিয়েছে পলকপাতের আগেই। কার সাধ্য হওয়ার মধ্যে গিয়ে লোফে কামানের গোলা, যখন সে তুলকালাম বেরিয়ে আসে আগুনওগরানো। নল থেকে?

আবারও জানিয়ে রাখি : এই দুর্বারগতি শকটের আকৃতিপ্রকৃতি যে কী, সে-সম্বন্ধে কারু কাছেই কোনো তথ্য নেই। পেছনে সে ফেলে রেখে যায় না ধোঁয়ার কুণ্ডলি, বাষ্পের শাদা ভাপ, পেট্রলের কোনো পোড়া গন্ধ-কিংবা অন্য-কোনো তেলেরও গন্ধ পাওয়া যায় না সে চলে যাবার পর। তাতে মনে হয় এই স্বতশ্চল শকট সম্ভবত বিদ্যুতের শক্তিতে চলে না। তার শক্তির উৎস যে-সব কোষে জমানো থাকে, তা নিশ্চয়ই অজ্ঞাত কোনো কোষভাণ্ডার, সম্ভবত ব্যবহার করে কোনো অজ্ঞাত তরল পদার্থ।

লোকের কল্পনা, উত্তেজিত, প্রায় হুলুস্থুল বাধিয়ে বসেছে : এই রহস্যময় স্বতশ্চল শকট সম্বন্ধে যে-কোনো গুজবই লোকে চোষক কাগজে কালির মতো শুষে নিচ্ছে। কেউ বলে, এ হলো ভুতুড়ে গাড়ি, অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক । তাকে নাকি চালিয়ে নিয়ে যায় কোনো প্রেত, নরকের কোনো-এক শোফেয়ার-গাড়িচালক, অন্য পৃথিবীর কোনো নষ্ট জীব–কোনো অপদেবতা, পুরাণের কোনো পশুশালা থেকেই হয়তো বেরিয়ে এসেছে কোনো দানব, হয়তো-বা স্বয়ং শয়তানই, পিছে 666 খোদাই-করা, যে সমস্ত মানুষী বাধাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে, যেহেতু তার দখলে আছে অদৃশ্য ও সীমাহী শয়তানি ক্ষমতা।

কিন্তু বিশেষ কোনো পারমিট, কোনো অনুমতিপত্র ছাড়া, স্বয়ং শয়তানেরও কোনো হক নেই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে-ঘাটে এমন দুর্বার গতিতে তার গাড়ি চালায়। তার গাড়ির কোনো লাইসেন্স প্লেট নেই, কোনো নম্বর নেই, এমনকী কোথাও এই গাড়িটার কথা নথিভুক্ত করা নেই। আর এও ঠিক যে কোনো পুরসভাই তাকে ঘণ্টায় দুশো মাইল বেগে হুলুস্থুল কাণ্ড করে চলবার কোনো অনুমতি দেয়নি। জননিরাপত্তার স্বার্থেই এক্ষুনি এমন-কোনো উপায় বার করা চাই, যার সাহায্যে এই ভয়াল শোফেয়ারের সব গুপ্তরহস্য এক্ষুনি প্রকাশ করা যায় ।

তাছাড়া, এই অদ্ভুত দুর্বার গতিনাট্যের নাট্যমঞ্চ তো শুধু পেনসিলভ্যানিয়াই নয় আর। পুলিশ জানালে যে অন্যান্য রাজ্যেও তাকে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাতে দেখা গেছে–তাকে দেখা গেছে, বিদ্যুৎঝলকের মতে, কেনটাকি রাজ্যে, ফ্রাংকফোর্টের কাছে; তাকে দেখা গেছে ওহায়োতে, কলম্বাসের রাস্তায়; তাকে দেখা গেছে টেনোসিতে, ন্যাশভিলে; মিসুরিতে, জেফারসনে; আর সবশেষে দেখা গেছে ইলিনয় রাজ্যে, শিকাগোের আশপাশে।

বিপদসংকেত বেজে উঠলো ঢং ঢং ঢং। কর্তৃপক্ষের এখন প্রথম ও প্রধান কাজ এই বিপজ্জনক শকটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া। এহেন দুর্বার গতিতে যে ছায়াশকট (না কি মায়াশকট?) ছুটে বেড়ায়, তাকে থামিয়ে, চালকটিকে গ্রেফতার করার কোনো কথাই ওঠে না। সবচেয়ে ভালো হয় বড়ো-বড়ো রাস্তার মাঝখানে, যদি বিশাল সব গেটওয়ে তৈরি করা যায়, যা বন্ধ থাকবে, সবসময়, আর কখনও-না-কখনও সেই দুর্বার গতি শকট এসে তার গায়ে আছড়ে পড়ে হাজার টুকরো হয়ে চারপাশে ভেঙে পড়ে। থাকবে।

যত আজগুবি। ঘোষণা করলে, যারা অবিশ্বাসী। এই উম্মাদ নিশ্চয়ই ঠিক জেনে ফেলবে কী করে এইসব বাধা এড়িয়ে যেতে হয়–হয়তো ঘুরপথেই যাবে!

আর যদি দরকার হয়, জুড়ে দিলে অন্যরা, ঐ ভুতুড়ে গাড়ি নিশ্চয়ই লাফিয়ে উঠে ও-সব বাধা টপকে চলে যাবে?

আর সে যদি সত্যি খোদ শয়তানই হয়, তবে, প্রাক্তন দেবদূত হিশেবে, সে নিশ্চয়ই তার পাখাজোড়ার দেখভাল করে–দরকার হলে সে উড়াল দিয়েই চলে যাবে।

তবে এই শেষ মন্তব্যটা এসেছিলো বোকাহাবা বুড়োহাবড়াদের কাছে, যারা সব একেকজন কুসংস্কারের একেকটা ডিপো, তারা এ-ব্যাপার নিয়ে আদপেই কখনও মাথা ঘামায়নি। কারণ হেডেসের রাজার যদি সত্যি-সত্যি একজোড়া পাখা থেকেই থাকে, সে কেন তবে খামকা ও-রকম একগুয়ের মতো পৃথিবীর পথে-ঘাটে তার আদরের প্রজাদের পিষে মেরে দুর্বার গতিতে ছুটে যাবে, যখন সে অনায়াসেই মহাশূন্য থেকে উড়াল দিয়েই যেতে পারতো তার কাজে-অকাজে, মেটাতে পারতো তার যত কিম্ভুত খামখেয়াল। স্বাধীন-কোনো অতিকায় পাখির মতো। তার কি তবে ডানাজোড়া কাটা গেছে?

এই ছিলো যখন হালচাল, তখন মে মাসের শেষ হপ্তায়, এমন-একটা নতুন ঘটনা ঘটলো, যা থেকে বোঝা গেলো যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন অসহায়ভাবে কোনো অজানা দানবের হাতে খাবি খাচ্ছে। আর নতুন জগতের সমূহ বারোটা বাজিয়ে দিয়ে, সে কি তারপর পুরোনো জগতের দিকে তার নজর দেবে না? এই স্বতশ্চল শকটের বেপরোয়া উন্মাদ কি তারপর ইওরোপকে ছেড়ে কথা কইবে?

নিন্মোক্ত ঘটনাটির কথা মার্কিন দেশের সবগুলো কাগজেই একযোগে বেরুলো, আর তার সঙ্গে কী-যে তুলকালাম মন্তব্য আর হুলুস্থুল হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেলো, তা আর বিশদ করে খুঁটিয়ে বলবার দরকার পড়ে না।

উইসকনসিনের স্বতশ্চল সংঘ একটা মোটররেসের আয়োজন করেছিলো–এমন সব রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটবে যা একসময়ে এসে পৌঁছুবে ঐ রাজ্যের রাজধানী ম্যাডিসন এ। যে-রুটটা ঠিক করা হয়েছিলো মোটররেসের পক্ষে তা ছিলো চমৎকার রাস্তা–দুশো মাইল মতো লম্বা, পশ্চিম সীমান্তের প্ৰেয়ারি দু শিয়েন-এ তার শুরু, ম্যাডিসনের পাশ কাটিয়ে, যা এসে শেষ হবে মিশিগান হ্রদের কাছে মিলাউঁকির একটু ওপরে। শুধু যে অংশটা জাপানি রাস্তা, নিক্কো থেকে নামোদে অব্দি, যে-রাস্তার দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতিকায় সব সাইপ্রেস, সেই অংশটা বাদ দিলে উইসকনসিনের এই রেসকোর্সের মতো চমৎকার রেসকোর্স পৃথিবীতে আর নেই। সোজা নাক-বরাবর গেছে রাস্তা, তীরের গতিপথের মতো সমান, কোথাও-কোথাও একটানা পঞ্চাশ মাইল অব্দি। এই প্রতিযোগিতার জন্যে বিস্তর শকট নাম লিখিয়েছিলো–তাদের মধ্যে কত-যে বিখ্যাত যন্ত্র। ছিলো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সব ধরনের মোটর গাড়িকেই রেসে নাম লেখাবার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো, এমনকী মোটর সাইকেলদেরও, অটোমোবাইলগুলো তো আছেই। নানা দেশে তৈরি সে-সব যন্ত্র, নানান তাদের গড়ন। বিভিন্ন পুরস্কারের অঙ্ক যোগ করলে দাঁড়ায় পঞ্চাশ হাজার ডলার, নেহাৎ ফ্যালনা টাকা নয়, তাই প্রতিযোগিতা খুবই জমে যাবে, কেননা সবাই তাতে মরীয়ার মতো যুঝে যাবে। নতুন-সব রেকর্ড যে তৈরি হবে, তাতে কারুরই কোনো সন্দেহ ছিলো না।

এ-পর্যন্ত বিভিন্ন রেসে সবচেয়ে বেশি গতি যা উঠেছিলো, সম্ভবত ঘণ্টায় আশি মাইল, সেটা মাথায় রেখে এটা আন্দাজ করা হয়েছিলো এই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অন্তত তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। আর, সমস্ত বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে, উইসকনসিনের কর্তৃপক্ষ প্ৰেয়ারি দু শিয়েন থেকে মিলাউঁকি তিরিশের মে-র সকালবেলায় সেদিন তিনঘণ্টার জন্যে সমস্ত যানবাহনের চলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ এর পরেও যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে তারাই চোটজখম পাবে যারা নিজেরাই সাধ করে এই প্রতিযোগিতায় এসে নাম লিখিয়েছে, আর কারু ঘাড়েই তারা কোনো দোষ চাপাতে পারবে না।

জমায়েৎ হয়েছিলো কাতারে-কাতারে লোক, বিশাল ভিড়। শুধু-যে আস্ত উইসকনসিন ঝেটিয়েই লোক এসেছে তা নয়, লোক এসেছে আশপাশের রাজ্য থেকেও–এসেছে ইলিনয়, মিশিগান, আইওয়া, এমনকী নিউইয়র্ক থেকেও। যে-সব চালাক নাম লিখিয়েছিলো, তাদের মধ্যে ছিলো বিস্তর বিদেশী-ইংরেজ, ফরাশি, আলেমান, অস্ট্রিয়ান–প্রত্যেক দেশের লোকই যে-যার দেশের শোফেয়ারদের সমর্থন করছে। তার ওপর, এটা যেহেতু খোদ মার্কিন মুলুক, পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত (মতান্তরে কুখ্যাত) জুয়াড়িদের দেশ, কত ধরনের যে বাজি ধরা হলো তার ঠিক নেই-টাকার অঙ্কও কখনও কখনও এমন যে শুনেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

রেসের সূচনা হবে ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় আটটায়, সকালবেলায়; আর ভিড়ভাট্টা ও দুর্ঘটনা এড়াবার জন্যে ঠিক হয়েছিলো একেকটা গাড়ি বোঁ করে বেরুবে ঠিক দু মিনিট অন্তর-রাস্তার দুপাশে থাকবে কাতারে-কাতারে দর্শক।

প্রথম তিনজন প্রতিযোগী, লটারি করে একেকজনকে একেকটা নম্বর দেয়া হয়েছিলো, বেরিয়ে পড়লো আটটা থেকে আটটা বিশ মিনিটের ভেতর। রাস্তায় যদি কোনো গাড়ি ডিগবাজি না-খায়, অথবা একটা আরেকটাকে ধাক্কা না-মারে, তবে এগারোটার মধ্যে এদের কোনো-কোনো গাড়ি লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। অন্যরা এই একই শৃঙ্খলা ও সূচি ধরে রচনা হবে।

দেড় ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। প্রেয়ারি দু শিয়েনের রাস্তায় তখন একজন প্রতিযোগীই ঝড়ের বেগে ছুটেছে, টেলিফোন মারফৎ প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর সর্বত্র খবর পৌঁছে যাচ্ছে কোন গাড়ি আগে, কোন গাড়িগুলো তার পেছনে, পর-পর। ম্যাডিসন আর মিলাউঁকির মাঝখানে সকলের আগে-আগে রয়েছে রেনোভাইদের চার সিলিণ্ডারের কুড়ি

অশ্বশক্তির গাড়িটা, টায়ারগুলো মিশেলিনের। তার গায়ে প্রায় নাকটা ঠেকিয়ে আসছে। হার্ভার্ড ওয়াটসন গাড়ি, আর দিওন-বুতো। এরই মধ্যে কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, অন্য গাড়িগুলো হু-ই কোথায় পেছনে পড়ে আছে। জনা-বারো প্রতিযোগীই শেষ পর্যন্ত প্রথম স্থানের জন্যে লড়ে যাবে। কয়েকজন চালক এর মধ্যেই জখম হয়েছে, তবে কারু চোট-আঘাতই তেমন সাংঘাতিক নয়। তাদের কেউ-কেউ যদি দুর্ঘটনায় মরেও যেতো, মানুষের মৃত্যু তখন হতো কতগুলো অনুপুঙ্খ মাত্র, পরিসংখ্যানের হিমশীতল অঙ্ক : তাজ্জব মুলুক আমেরিকায় মানুষের মৃত্যুকে কেউই খুব-একটা গুরুত্ব দেয় না।

স্বভাবতই উত্তেজনা আর হৈ-হৈ একেবারে চরমে এসে পৌঁছেছে, যেখানটায় মিলাউঁকির কাছে এই দৌড়বাজির শেষ। সেখানে এসে জড়ো হয়েছে সবচেয়ে যারা কৌতূহলী আর সবচেয়ে যারা আগ্রহী, সেখানে মুহূর্তের রাগ-অনুরাগ দপদপ করে জ্বলছে-কে কাকে শান্ত করবে। দশটা নাগাদ এটা বোঝা গিয়েছে যে প্রথম পুরস্কার, কুড়ি হাজার ডলার, সাকুল্যে পাঁচটা গাড়ির আয়ত্তের মধ্যে–এ ওর মধ্যে ব্যবধান এই কমছে, এই বাড়ছে, আর এই পাঁচজনের মধ্যে আছে দুজন মার্কিন, দুজন ফরাশি আর একজন ইংরেজ। কাজেই কল্পনা করে নেয়া যায় জাতীয় গৌরবের অছিলায় কেমন খ্যাপার মতো একেকজনে বাজি ধরছে। বুকিরা, যাদের মারফৎ বাজি ধরা হয়, তারা আর এই উত্তেজনার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না–এত লোকে এসে বাজি ধরতে চাচ্ছে। মুখ থেকে মুখেই ছড়িয়ে পড়ছে টাকার অঙ্ক, যেন জ্বরের ঘোরে সবাই হন্যে হয়ে গিয়েছে। হার্ভার্ড-ওয়াটসনের ওপর দর এখন একে-তিন! দিওন-বুতোর ওপর দর একে-দুই।রেনোর ওপর সমান-সমান। টেলিফোনে একবার করে খবর আসে, আর দর্শকদের কাছে ঢেউয়ের মতো এই নতুন দর ছড়িয়ে যায়।

হঠাৎ, প্রেয়ারি দু শিয়েন-এর পুরসভার ঘড়িতে যখন সাড়ে-নটা বেজেছে, শহর থেকে দু-মাইল দূরে শোনা গেলো প্রচণ্ড এক দ্রুতধাবমান আওয়াজ আর কোনো কিছুর গড়িয়ে-আসার শব্দ-যে-আওয়াজ বেরিয়ে আসছিলো ধুলোয়-ধুলোয় ধুল পরিমাণ মেঘের মধ্য থেকে, আর সঙ্গে-সঙ্গে শোনা গেলো তীক্ষ্ণ সিটির শব্দ, যেমন ভোঁ শোনা যায় ধাবমান জাহাজ থেকে, কুয়াশার মধ্যে।

আঁৎকে উঠে, ভিড় একদিকে সরে যাবার আগেই, মেঘ প্রায় হারিকেন তুফানের মতো সে-জায়গাটা ঝেটিয়ে গেলো : আতঙ্কিত হয়ে হঠে না-গেলে তখন যে তাণ্ডব হতো তার বলি হতো অন্তত কয়েকশো দর্শক। এমন জোরে চোখের সামনে দিয়ে কী-যে ছুটে গিয়েছে, লোকে তা চোখেই দেখতে পারেনি, কিছু বুঝবে যে, সে-তো দূরের কথা। কিছু-একটা যে এখান দিয়ে গেছে, এইমাত্র, বলতে-না-বলতে, শুধু সেটাই সবাই টের পেয়েছে। কোনো অত্যুক্তিই হতো না যদি কেউ তখন ঠাণ্ডা মাথায় হিশেব কযে বলতো যে তার গতি ছিলো ঘণ্টায় দেড়শো মাইল।

ছায়াশকট এসেছে, আর গেছে, দূরে মিলিয়ে গেছে পলকের মধ্যে, পেছনে ফেলে রেখে গেছে শাদা ধুলোর দীর্ঘ রেশ, যেমন কোনো এক্সপ্রেস ট্রেন পেছনে ফেলে রেখে যায় অপস্রিয়মাণ ধোঁয়ার পুচ্ছ। এটা যে কোনো স্বতশ্চল শকট তাতে কোনো সন্দেহ নেই, আর তার মোটরটাও দুর্দান্ত, অসাধারণ, বাড়িতে লিখে জানাবার মতো। এটা যদি তার এই তীরের বেগে ধাওয়া বজায় রাখে, এ তবে প্রতিযোগীদের একেবারে সামনে গিয়ে পৌঁছুবে–শুধু-যে পৌঁছুবে তা-ই নয়, তাদের পেরিয়েও যাবে–তাদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গাড়ির যা বেগ, এর গতি তার দুননা তো বটেই–অর্থাৎ এই ছায়াশকট সবার আগে গিয়ে পৌঁছুবে লক্ষ্যে, রেসের শেষ সীমায়।

আর তারপর, হকচকিয়ে-যাওয়া ভাবটা কেটে যেতেই, সবখান থেকে উঠলো প্রচণ্ড হট্টগোল–বিশেষ করে দর্শকরা যখন টের পেলে যে বিপদটা আপাতত কেটে গিয়েছে।

এ সেই জাহান্নামের গাড়িটা!

হ্যাঁ, এ সেই গাড়ি পুলিশ যার ল্যাজের ডগাটাও ছুঁতে পারে না!

কিন্তু গত পনেরো দিনে এর কথা কোখাও শোনা যায়নি।

কে-যে বলেছিলো এটা নাকি উলটে পড়ে চুরমার হয়ে গিয়েছে–চিরকালের মতো খতম!

এ হলো গিয়ে খোদ শয়তানের গাড়ি, নরকের আগুনে চলে, আর শয়তান স্বয়ং এটাকে চালায়।

সত্যি-বলতে, এর শোফেয়ার যদি খোদ শয়তান না-হয়, তাহলে কোন মহাজন? এই অবিশ্বাস্য গতিতে ধেয়ে এলো, তার এই রহস্যময় গাড়িতে–এই মাস্তানটি তবে কে-হে? অন্তত এটায় কোনোই সন্দেহ নেই যে এই গাড়িটা সেই রহস্যময় গাড়িই যাকে ঘিরে এই ক-দিন ধরে এত চেল্লাচিল্লি হয়েছে-মুখে, ও লেখায়; পুলিশ যদি ভেবে থাকে

যে তারা তাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে, চিরকালের মতো একে মুলুক ছাড়া করে। দিয়েছে, পগাড় পার, তবে পুলিশ বিষম ভুল করেছে–আর অন্যদেশেও যেমন, মার্কিন মুলুকেও তেমনি, পুলিশ আখছার ভুলের পর ভুল করেই চলেছে।

বিস্ময়ের প্রথম স্তম্ভিত দশাটা কেটে যেতেই অনেকেই ছুটে গেলো টেলিফোনের কিওস্কগুলোয়-পরে যারা আছে আগে থেকেই তাদের সাবধান করে দেবে বলে। এই উম্মাদ শকট শুধু পথের পাশের দর্শকদেরই মারাত্মক বিপদ নয়, পথের ওপর কত যে গাড়ি যে উলটে দেবে, চুরমার করে দেবে, তার ঠিক কী। এই ভয়াল উম্মাদ যখন পাহাড়ের ধস নামার মতো এসে আর্বিভূত হবে, অন্য গাড়িগুলো তো চিড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবে, গুঁড়ো-গুড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে, সর্বনাশ হয়ে যাবে তাদের!

আর অন্য গাড়ির সঙ্গে পর-পর ঠোকাঠুকি লাগলে, সংঘর্ষ হলে, এই শোাফেয়ারই কি নিজে তার গাড়ি থেকে নিরাপদে বহাল তবিয়তে বেরুতে পারবে? হয়তো সে পাকা শোাফেয়ার, ওস্তাদের ওস্তাদ, শোাফেয়ারদের রাজা, কিন্তু তার যন্ত্রটি তাকে এমন নিখুঁতভাবে চালনা করতে হবে, হাতে-আর-চোখে এমন অটুট সম্বন্ধ থাকতে হবে তার, যে, সে হয়তো ভেবে বসে আছে, সে নিজে হ্যাঁসবরকম পরিস্থিতিতেই নিজেকে বাঁচাতে পারবে। একটাই বাঁচোয়া, যে, উইসকনসিনের কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই স্থির করে নিয়েছিলেন, রাস্তায় শুধু প্রতিযোগী গাড়িগুলো ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। কিন্তু তাদের মধ্যে তাকে এমন হৈ-হৈ কাণ্ড ফেলে দেবার অনুমতি কে দিয়েছে? এখানে থাকবার কোন হক আছে তার?

আর প্রতিযোগীরাও বা নিজেরা কী বলছে, টেলিফোনে এই-যে আগেভাগে তাদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে, ওহে, সরে থাকো, গ্র্যাণ্ড প্রাইজের লোভে পিতৃদত্ত প্রাণটা খুইয়ো না, তাদেরই বা এ-বিষয়ে কী বক্তব্য? তাদের হিশেব অনুযায়ী এই আশ্চর্য শকটটা নাকি ঘণ্টায় একশো তিরিশ মাইল বেগে যাচ্ছিলো। তাদের নিজেদের গাড়িরও গতি সাধারণ গাড়ির চাইতে অনেক বেশি, তবু তাদের দিকে এই গাড়ি এমন প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে এসেছিলো এবং হয়তো প্রচণ্ডতর গতিতে বন্দুকের গুলির মতো পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিলো যে তারা স্পষ্ট করে শকটটাকে খেয়াল পর্যন্ত করতে পারেনি, যেন একটা টেনে-লম্বা-করা টাকু, তবু হয়তো তিরিশ ফিটের চাইতে বেশি লম্বা নয়, তার চাকাগুলো এমন বিদ্যুৎক্ষিপ্র গতিতে ঘুরছিলো যে প্রায় চোখেই পড়ছিলো না। আর যখন পাশ কাটিয়ে চলে গেলো এই তাজ্জব লম্বা গাড়ি পেছনে না-রেখে গেলো কোনো ধোঁয়া না বা কোনো গন্ধ।

আর তার চালক? সে ছিলো তার যন্ত্রের ভেতটায়, দৃষ্টির অগোচর। দেশের নানা রাস্তায় প্রথম যখন হৈ-চৈ তুলে হাজির হয়েছিলো, তখন-যেমন, এখনও-তেমনি অজ্ঞাতই থেকে গিয়েছে সে।

মিলাউঁকিকে তো তক্ষুনি জানিয়ে দেয়া হয়েছে এই উড়ে-এসে-রেসে-নাম লেখানো অদ্ভুত প্রতিযোগীর কথা। খবরটা যে কেমন হুলুস্থুলু বাধিয়ে বসেছিলো তা নিশ্চয়ই খানিকটা আন্দাজ করা যায়। তক্ষুনি প্রস্তাব নেয়া হলো যে এই চলন্ত তুবড়িটাকে যে-করেই হোক থামাতে হবে রাস্তার মবখানে এমন-একটা বাধা তৈরি করতে হবে যার গায়ে আছাড় খেয়ে সে যাতে হাজার টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে-রকম কোনো প্রতিরোধের প্রাচীর গড়বার সময় কই? যে-কোনো মুহূর্তেই তো উল্কার বেগে সেই শকট এসে হাজির হবে! তবে প্রতিরোধ গড়বার গরজটাই বা কী? রাস্তা কি সটান, সরাসরি, লেক মিশিগানের পাড়ে এসে শেষ হয়নি?হয় গাড়িটা নিজের গরজেই সেখানে দুম করে থেমে যাবে, আর নয়তো তার অতিপ্রাকৃত চালকটি হয়তো ডাঙায় যেমন তেমনি জলেও তার যানটাকে উল্কার গতিতে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে।

এখানেও, দৌড়বাজির সারা রাস্তাটা ধরে যেমন হয়েছে, যত রাজ্যের আজগুবি প্রস্তাব উঠলো। এমনকী যারা এটা মানবে না যে এই রহস্যময় চালক খোদ শয়তান যদি নাও হয় তারই কোনো-এক দোসর, তার পর্যন্ত তা-না-না-না করে বললে এ হয়তো প্রলয়কালেরই কোনো অপার্থিব জীব, সংবর্তের বর্ণনা থেকে সরাসরি উঠে এসেছে, জ্যান্ত ও কিস্তৃত। আর তার ওপর এখন আর এক মুহূর্তও সময় নেই ভেবে-ভেবে নষ্ট করার। যে-কোনো মুহূর্তেই এখন এসে উদয় হবে সেই ছায়াশকট মায়াশকট ।

তখনও এগারোটা বাজেনি, হঠাৎ রঞ্জির দূর প্রান্ত থেকে একটা গুমগুমগুম শব্দ উঠলো, আর ঘূর্ণি তুলে খ্যাপার মতো বয়ে গেলো ধুলোর ঝড়। রূঢ় কর্কশতীক্ষ শিসের শব্দ ভেসে এলো হাওয়ায়, প্রবল এক হুঁশিয়ারি, পথ ছাড়ো, পথ ছাড়ো, রাস্তা খোলা রাখো ।

শেষ মুহূর্তেও, সমাপ্তিরেখায় এসেও, সে তার গতি শ্লথ করেনি। সমাপ্তিরেখা থেকে মিশিগান আধমাইল দূরে হবে কি না সন্দেহ। শকটটা নিশ্চয়ই মিশিগান হ্রদের জলে গিয়ে আছড়ে পড়বে। তাহলে কি যন্ত্রটা আর তার চালকের নিয়ন্ত্রণে নেই?

নেই বলেই তো মনে হয়। কক্ষচ্যুত উল্কার মতো, যানটা মিলাউঁকি দিয়ে ঝলক তুলে চলে গেলো। যখন শহরটা পেরিয়ে যাবে, তখন কি নিজের বিনাশ ডেকে আনবে, আছড়ে পড়বে লেক মিশিগানের জলে–যেটা হবে তার সলিল সমাধি?

যা হবে, সে-তো পরে হবে। কিন্তু যখন যানটা একটা মোড় ঘুরে উধাও হয়ে গেলো, এই মাটিতে-চলা-ধূমকেতুটার চলার পথে তার চলে-যাওয়ার কোনো চিহ্নই কিন্তু পড়ে রইলো না।

.

. নিউইংল্যাণ্ডের তীর ঘেঁসে

খবরকাগজগুলোয় যখন এই অদ্ভুত রেসের খবর ছাড়া আর-কোনো খবর নেই, আমি তখন আবারও ওয়াশিংটনে এসে হাজির হয়েছি। ফিরে এসেই আমি আমার বডোকর্তার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর দফতরে গিয়েছি, কিন্তু তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি তখন। পারিবারিক ঝামেলায় হঠাৎ তাকে চলে যেতে হয়েছে ওয়াশিংটন ছেড়ে, কয়েক সপ্তাহ অনুপস্থিত থাকবেন। মিস্টার ওয়ার্ড অবশ্য জানেন যে আমার অভিযান বিফল হয়েছে। খবরকাগজরা, বিশেষ করে নর্থক্যারোলাইনার খবরকাগজেরা, গ্রেট আইরিতে ওঠবার চেষ্টা করে আমরা যে সফল হতে পারেনি, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছে।

স্বভাবতই, অপ্রত্যাশিত এই বাধার দরুন, আমার অস্থির কৌতূহল আরো-অস্থির হয়ে উঠেছিলো। এর পরে যে কী করবো, তার কোনো পরিকল্পনাই আমি মিস্টার ওয়ার্ডের সঙ্গে পরামর্শ না-করে করতে পারছিলুম না। তাহলে কি গ্রেট আইরির রহস্যটা ভেদ করার সমস্ত আশাতেই জলাঞ্জলি দিতে হবে? না, বারেবারে বিফল হই তাও সই, তবু আমি বারেবারে ঐ পাহাড়ে ফিরে যাবো, নতুন উদ্যমে চেষ্টা করবো পাহাড়ে চড়তে।

তবে, এটা ঠিক যে, ঐ দেয়াল বেয়ে চূড়ায় গিয়ে পৌঁছুনো মানুষের সাধ্যাতীত। পাহাড়ের চূড়া অব্দি একটা ভারা বানানো যায় যদি? কিংবা যদি তার দেয়াল ছুঁড়ে খোঁড়া যায় একটা সুড়ঙ্গ? আমাদের এনজিনিয়াররা তো প্রতিদিনই এর চেয়েও কঠিন সমস্ত সমস্যার সমাধান করে ফ্যালে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্য খরচের কথাটাও ভেবে দেখা উচিত–গ্রেট আইরির ভেতরে গিয়ে হয়তো দেখা যাবে কোথাও কিছু নেই, সব ভো ভা, তখন এত হাজার ডলার নিছকই বাজে খরচ হবে। সুড়ঙ্গটা অনেক হাজার ডলার খরচ করে বানানো যায়–কিন্তু তাতে আমার এই বেদম কৌতূহল চরিতার্থ করা ছাড়া আর কোন উপকার হবে লোকের?

আমার নিজের হাতে যা-টাকা আছে তা দিয়ে এই কাজে হাত দেয়া যায় না। সরকারি টাকার দায়িত্ব মিস্টার ওয়ার্ডের ওপর–তিনি তো আপাতত এখানে নেই। একবার ভেবেছিলুম এতসব লক্ষপতি ধনকুবেরদের কোনো-একজনকে বাজিয়ে দেখলে হয় না? হায়রে, যদি আমি তাদের কাউকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারতুম যে ঐ পাহাড়ে সোনারুপোর খনি আছে! কিন্তু এমন কথা শুনে পাগলেও হাসবে। প্রশান্ত সাগরের কূলে যে-সব পাহাড় আছে, ট্রান্সভালে বা অস্ট্রেলিয়ায়, সেখানে হয়তো জমি খুঁড়লে সোনা পাওয়া গেলে যেতেও পারে, কিন্তু আপালাচিয়ার শৈলশ্রেণী তত সোনার খনি পেটে পুরে রাখে না।

পনেরোই জুনের আগে মিস্টার ওয়ার্ড তার কাজে ফেরেননি। আমার ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমাকে কিন্তু তিনি বেশ সমাদরই করেছেন। এই-যে, স্ট্রক! বেচারা! হেসে আমায় স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। বেচারা স্ট্রক, যে কি না একটা তুচ্ছ পাহাড়ের কাছে হেরে এসেছে।

আপনি যদি আমায় চাঁদের পিঠে কী আছে দেখে আসতে বলতেন তাহলে যতটাই হার মেনে আসতুম, তার চাইতে বেশি হার স্বীকার করতে হয়নি কিন্তু, আমিও হেসেই উত্তর দিয়েছি। আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলো নৈসর্গিক বাধা, তখন আমাদের হাতে যা-ক্ষমতা ছিলো তাতে ঐ বাধা অতিক্রম করা অসাধ্য ছিলো।

তাতে আমার সন্দেহ নেই, স্ট্রক, তাতে আমার একফোঁটাও সন্দেহ নেই। তবু, তথ্যটা কিন্তু থেকেই যায়। যে, গ্রেট আইরির ভেতরে কী তোলপাড় হচ্ছে, কী। ওলোটপালোটকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে, তার কিছুই তুমি আবিষ্কার করতে পারোনি।

কিছুই পারিনি, মিস্টার ওয়ার্ড।

আগুনের কোনো চিহ্ন বা লক্ষণ দ্যাখোনি?

কিছুমাত্র না।

আর সন্দেহজনক কোনো গুমগুম আওয়াজও শোনোনি?

না।

না। তাহলে এখনও আমরা ঠিকঠাক জানি না ওখানে কোনো আগ্নেয়গিরি আছে কি না?

এখনও জানি না, মিস্টার ওয়ার্ড। তবে যদি থেকে থাকে, সে-যে এখন গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে তাতে আমাদের সন্দেহ নেই।

তবু, মিস্টার ওয়ার্ড বলেছেন, এটাও তো জানা নেই সে শিগগিরই কোনোদিন কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে কি না। স্ট্রক, কোনো আগ্নেয়গিরি যে ঘুমিয়ে আছে, এটা কোনো বড়ো কথা নয়–আমাদের চেষ্টা করতে হবে তাকে সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলতে। যদি-না, অবশ্য, অত-সব গুজবের জন্ম হয়ে থাকে ক্যারোলাইনার লোকদের তেতে ওঠা কল্পনায়।

সে কিন্তু সম্ভব নয়, সার, আমি বলেছি, মরগ্যানটনের মেয়র মিস্টার স্মিথ, এবং তার বন্ধু, প্লেজেন্ট গার্ডেনের মেয়র-দুজনেই বিস্তর কাণ্ডজ্ঞান ধরেন, চোখকান খোলা রাখেন। দুজনেই তারা নির্ভরযোগ্য মানুষ। আর তারা এ-বিষয়ে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে সব খুলে বলেছেন। গ্রেট আইরির ওপরে যে শিখা দেখা গিয়েছিলো, সে-তথ্য মিথ্যে নয়। অদ্ভুত সব আওয়াজও উঠেছিলো ওখানে। অন্তত এই দুই বিষয়ে সন্দেহ করবার মতো কোনো কারণ নেই।

মানলাম, ঘোষণা করেছেন মিস্টার ওয়ার্ড, মানলাম যে এই দুটি বিষয় কারু বিকৃত মস্তিষ্কের অলীক বিভ্রম নয়। তাহলে তা থেকে একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো যায় : গ্রেট আইরি এখনও তার ভেতরকার রহস্য কিছুই ফাঁস করে দেয়নি।

আমরা যদি তা একান্তই জানতে চাই, মিস্টার ওয়ার্ড, তবে সমাধানটা আসতে পারে কেবল অকাতরে অর্থ ব্যয় করলেই। খন্ত, কোদাল আর ডায়নামাইট অনায়াসেই ঐ নিরেট দেয়ালগুলো উড়িয়ে দিতে পারবে।

তাতে কোন সন্দেহ নেই, বড়োকর্তা উত্তরে জানিয়েছেন, কিন্তু পাহাড় এখন যখন ঘুমিয়ে আছে, নিরীহ ও নিরুপদ্রব, তখন এত-বড়ো একটা কাজে হাত দেবার কোনো মানে হয় না। আমরা বরং কিছুদিন চুপচাপ বসে-বসে দেখি, যদি পাহাড় নিজেই কোনো-একদিন তার রহস্য ফাঁস করে দেয়।

মিস্টার ওয়ার্ড, বিশ্বাস করুন, আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি, তবু আপনি আমার কাঁধে যে-দায়িত্ব দিয়ছিলেন, তা পালন করতে পারিনি বলে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।

বাজে কথা বোলো না, স্ট্রক! মিথ্যে নিজেকে এ নিয়ে অস্থির কোরো না। তোমার এই হারটাকে তুমি বরং দার্শনিকদের ভঙ্গিতেই নাও। আমরা তো আর সবসময় কৃতকার্য হতে পারি না, পুলিশের চাকরি করলেও না। কত পাজি লোকই তো আমাদের হাত এড়িয়ে চলে যায়! সত্যি-বলতে, অপরাধীরা যদি একটু চালাক আর হুঁশিয়ার হতো, তবে হয়তো তাদের কাউকেই আমরা পাকড়াতে পারতাম না। সবসময়েই তারা নিজেরাই হাঁদার মতো এমন-কিছু করেছে যে আমরা তাদের পাকড়াতে পেরেছি। কোনো দুষ্কর্ম–চুরি বা খুন-হিশেব করে প্ল্যানমাফিক করার মধ্যে বাহাদুরি কিছু নেই, কেননা সে সব কাজ করা ভারি সহজ;কঠিন ও কারু সন্দেহ না-জাগিয়ে সেগুলো হাসিল করা, আরো-কঠিন পেছনে কোনো সূত্র ফেলে না-রাখা–যে-সব সূত্র ধরে যে-কেউ পুরো ব্যাপারটা ধরে ফেলতে পারে।বুঝেছে, ঈক, আমি মাস্টারি করে অপরাধীদের সবকিছু শিখিয়ে দিতে চাই না–আমি বরং চাই তার যেমন হাঁদা আছে, তেমনি আকাট বোকা থাকুক। তবু, এ-কথাও ঠিক, এমন অনেক অপরাধী আছে পুলিশ কখনও যাদের চুলের ডগাটিও ছুঁতে পারবে না-পারেনি।

এই বিষয়ে অবশ্য আমার বড়েকর্তার সঙ্গে আমিও সম্পূর্ণ একমত। পাজির পাঝাড়া বদমায়েশগুলোর মধ্যেই সবচেয়ে বেশিহাবা লোক দেখা যায়। শুধু এই কারণেই আমি ভারি তাজ্জব হয়ে গেছি প্রকাশ্য দিবালোকে ঐ রাক্ষুসে যানটা সকলের নাকের ডগা দিয়ে চলে গেলো, অথচ কর্তৃপক্ষ এখনও তাতে কোনো আলোকসম্পাত করতে পারলো না! এবং যখন মিস্টার ওয়ার্ড এই প্রসঙ্গটা তুলেছেন, তখন আমি কিছুতেই আমার বিস্ময় প্রকাশ না-করে পারিনি।

মিস্টার ওয়ার্ড বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করেছেন যে ঐ রাক্ষুসে যানটার পেছন নেয়া একেবারেই সম্ভব ছিলো না; আগে যতবারই সে দেখা দিয়েছে, টেলিফোনে কাউকে কোনো খবর দেবার আগেই সে উধাও হয়ে গেছে। সারা দেশে কত-যে পুলিশকে শুধু এরই ওপর নজর রাখবার জন্যে নিয়োগ করা হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই–অথচ তবু কেউ এই দুবৃত্তের মুখোমুখি পড়েনি। সে তার এই তাজ্জব-করা ক্ষিপ্র গতি সত্ত্বেও অবিশ্রাম এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় যায় না–বরং কোথাও সে এক পলকের জন্যে দেখা দেয়, তারপরেই যেন হাওয়ায় উবে যায়। সত্যি-যে, অবশেষে তাকে প্রেয়ারি দু শিয়েন থেকে মিলাউঁকি অব্দি মোটররেসের পুরো রাস্তাটাতেই দেখা গেছে, আর এতটা রাস্তা সে গেছে দেড় ঘণ্টারও কম সময়ে, আর রেসট্র্যাকটা তো কম করেও দুশো মাইল হবে।

কিন্তু তারপর থেকেই ঐ অদ্ভুত স্বতশ্চল শকটের আর-কোনো পাত্তাই নেই। সে রেসট্র্যাকের একেবারে শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে, নিজেরই চলার তাড়ায় তারপরও ছুটেছে, কিছুতেই থামতে পারেনি; তবে কি সত্যি সে আছড়ে পড়েছে লেক মিশিগানের জলে, আর একেবারে তলিয়ে গেছে? আমাদের কি তবে ধরে নিতে হবে যে এই যান আর তার চালক দুজনেই ধ্বংস হয়ে গেছে? তবে কি আর এদের কার কাছ থেকে আর-কোনো বিপদআপদের আশঙ্কাই নেই আমাদের? জনসাধারণের একটা বড়ো অংশই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে অস্বীকার করছে। তাদের মতে, আবারও হঠাৎ কোনোখান থেকে ঐ অলৌকিক গাড়ি এসে হুলুস্থুল বাধাবে।

মিস্টার ওয়ার্ড তো খোলাখুলি স্বীকারই করে বসলেন যে পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে অসাধারণ ও চমকপ্রদ বলে ঠেকছে; আর তার এই মতের সঙ্গে আমারও কোনো বিরোধ ছিলো না। যদি এই নারকীয় শোফেয়ার আবার এসে উদয় না-হয়, তার ছায়ামূর্তি (কেননা কেউই তাকে চোখে দ্যাখেনি একবারও) নিশ্চয়ই তবে বুদ্ধিতে-যার-ব্যাখ্যা-চলে না এমনি-কোনো অতিমানুষিক রহস্যের অংশ বলে ধরে নিতে হবে।

বড়োকর্তা আর আমি অনেকক্ষণ ধরে, সবদিক তলিয়ে দেখে, ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছিলুম। তারপর যখন ভাবছি আমাদের কথাবার্তা শেষ হয়ে গেছে, তখন। হঠাৎ, মিস্টার ওয়ার্ড ঘরটার মধ্যে বার-কয়েক পায়চারি করে আচমকা বলে উঠেছেন : হা, সত্যি, মিলাউঁকিতে সেদিন যা ঘটে গেলো, তা ভারি আশ্চর্য। কিন্তু আমার হাতে আরো-একটা রহস্য আছে, আর তাকেও মোটেই কম আশ্চর্য বলা যাবে না।

এই কথা বলে আমার হাতে বস্টন-থেকে-পাওয়া একটা প্রতিবেদন তুলে দিয়েছেন–এমন-একটা বিষয় সম্বন্ধে সেই প্রতিবেদন যা নিয়ে সান্ধ্য কাগজগুলি সদ্য তাদের পাঠকদের অবহিত করতে শুরু করেছে। আমি যখন প্রতিবেদনটা পড়ছি, তখন হঠাৎ ব্যস্তসমস্তভাবে মিস্টার ওয়ার্ডকে অন্যকোথাও ডেকে নিয়ে-যাওয়া হলো। আমি জানলার পাশে জমিয়ে বসে প্রতিবেদনটায় মনোনিবেশ করলুম।

গত কিছুদিন ধরে মাইন, কানেটিকাট আর ম্যাসাচুসেটসের উপকূল ধরে সাগরজলে এমন-একটা কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউই যাকে সঠিক বর্ণনা করতে পারেনি। চলন্ত একটা-কিছু এসে হঠাৎ দেখা দেবে জলের ওপর, তীর থেকে দু-তিন মাইল দূরে, জলের ওপর, আর তার ভীষণ চাকা চালিয়ে জলে হুলুস্থুল তুলবে, ঢেউয়ের মধ্যে সেটা ঝিলিক দেবে ক-বার, এদিক-ওদিক, তারপর ফের তীর বেগে দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে।

জিনিশটা এতই বিদ্যুৎবেগে চলাফেরা করে যে সবচেয়ে সেরা জাতের টেলিস্কোপ দিয়েও তার ওপর নজর রাখা যায় না-দৈর্ঘ্যে সে তিরিশ ফিটের বেশি হবে না, অনেকটা একটা লম্বা চুরুটের মতো দেখতে, রংটা সবুজেমতো, আর সেইজন্যেই সমুদ্রের জল থেকে তাকে সহজে আলাদা করে চেনবার উপায় থাকে না। তাকে সবচেয়ে বেশিবার দেখা গেছে কেপ কড থেকে নোভাস্কোশিয়ার জলে। প্রভাইডেন্স, বস্টন, পোর্টসমাউথ, আর পোর্টল্যাণ্ড থেকে মোটরহোট আর স্টীমলঞ্চেরা তাকে দেখে বারেবারে এই চলন্ত বস্তুটির কাছে যাবার চেষ্টা করেছে–এমনকী তার পেছনে ধাওয়া করে যাবারও চেষ্টা। করেছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও তারা তার ধারে-কাছে ঘেঁসতে পারেনি। শুধু-যে অসাধ্যই মনে হয়েছে, তা নয়, পশ্চাদ্ধাবন মনে হয়েছে অর্থহীন। প্রত্যেকবারই সে ধনুক-থেকে-ছোঁড়া তীরের মতো দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছে।

স্বভাবতই, বস্তুটি যে কী, কী তার প্রকৃতি, সে-সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত; আর তা ব্যাপারটাকে আরো জট পাকিয়ে তুলেছে। কিন্তু সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়-করানো কোনো অনুমানই এ-পর্যন্ত কেউ করতে পারেনি। এমনকী ওস্তাদ খালাশিরা পর্যন্ত এটাকে নিয়ে কেবলই মাথা চুলকোচ্ছে, কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। গোড়ায় নাবিকরা ভেবেছিলো এ বুঝি কোনো বৃহদাকার মৎস্য, হয়তো তিমি বা তিমিজিল। কিন্তু এটাও, তো ভালো করেই জানা যে এ-সব জীব জলের ওপর ভেসে ওঠে একটা নির্দিষ্ট সময়। অন্তর, নিশ্বাস নিতে, আর ফোয়ারার মতো ছিটিয়ে দেয়-আকাশে-জলের আর হাওয়ার ধারা। অথচ এই আশ্চর্য জীবটি–যদি সে কোনো জলচর প্রাণীই হয়–ককখনো ফোয়ারা ছেটায়নি; যেমন বলে নাবিকেরা। ককখনো সে শ্বাসপ্রশ্বাস নেবার ফেস-ফেস আওয়াজও করেনি। অথচ এ যদি কোনো অতিকায় সামুদ্রিক জীব না-হয়, এই অজ্ঞাত জলরাক্ষসকে তবে কোন শ্রেণীতে ফেলা হবে? সে কি তবে পুরাণ-কিংবদন্তির জলচর জীব, গভীর জলে যারা ঘুরে বেড়ায়, ক্রাকেন, অক্টোপাস, লেভিয়াথান, কিংবা সেই বহুশ্রুত মহানাগ?

সে যা-ই হোক, এই জলদানব, সত্যিকারই হোক বা পুরাণের জীবই হোক, বারে বারে দেখা দিয়েছে নিউ-ইংল্যাণ্ডের তীর ঘেঁসে, আর ছোট্ট মোটরবোট, জেলেডিঙি বা প্রমোদতরীগুলো ওখানকার জলে আর ঘুরে বেড়াবার সাহসই পায় না। যখনই সে দেখা দিয়েছে, নৌকোগুলো আতঙ্কিত হয়ে চম্পট দিয়ে ফিরে এসেছে সবচেয়ে কাছে যে-বন্দর থাকে, সেখানে সাবধানের অন্তত মার নেই। জন্তুটি যদি হিংস্র হয়ে থাকে, তবে কারু প্রাণেই তার মুখোমুখি গিয়ে পড়ার দুঃসাহস বা গূঢ় বাসনা নেই।

আর বড়ো-বড়ো জাহাজ এবং উপকূলের মস্ত স্টীমারগুলো? তাদের তো কোনো জলদানবের কাছ থেকে ভয় পাবার কিছু নেই–তা সে তিমিই হোক, বা তিমিজিলই হোক। কয়েক মাইল দূর থেকে এ-রকম কয়েকটি জলপোত তাকে দেখতে পেয়েছে। কিন্তু যখন তারা তার কাছে যাবার চেষ্টা করেছে, সে দ্রুতবেগে অন্যদিকে চলে গিয়েছে। একদিন, এমনকী, মার্কিনরাষ্ট্রের এক দ্রুতগামী গোলন্দাজ রণতরী বস্টন থেকে বেরিয়েছিলো, জলদানবের পেছন নেবার উদ্দেশ্য যদি নাও তার থেকে থাকতো, ইচ্ছে ছিলো তাকে লক্ষ্য করে অন্তত কয়েকবার কামান ছোঁড়ে। কিন্তু দূর থেকে তাকে দেখবামাত্র চক্ষের পলকে এই জলের জীব উধাও হয়ে যায়, পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যায়, তবে এটা ঠিক এ-যাবৎ এই জলদানব নৌকো বা মানুষ কাউকেই আক্রমণ করার কোনো উৎসাহ দেখায়নি।

এ-পর্যন্ত পড়তে-না-পড়তেই মিস্টার ওয়ার্ড আবার তার খাশকামরায় ফিরে এলেন, আর আমি প্রতিবেদনটার ওপর থেকে চোখ তুলে পড়া থামিয়ে জিগেস করেছি, এখনও অব্দি তো এই সিন্ধুনাগকে নিয়ে অভিযোগ তোলার মতো কোনো কারণ ঘটেনি। বড়ো জাহাজ দেখতে পেলেই সে পালিয়ে যায়। ছোটো জাহাজগুলোকে সে কখনোই তাড়া করে না। আবেগ-অনুভূতি বা বুদ্ধিশুদ্ধির বড়াই করতে পারে এমন মাছ আর ক-টাই। বা আছে?

ভুল বললে, স্ট্রক। মাছেরও আবেগ-অনুভূতি আছে, আর যদি কখনও খেপে যায়–

কিন্তু, মিস্টার ওয়ার্ড, এখনও তো এই জীবটিকে খুব-একটা বিপজ্জনক বলে বোধ হচ্ছে না। দুটোর একটা জিনিশ নিশ্চয়ই শিগগিরই ঘটবে। হয় সে এখানকার উপকূল ছেড়ে পাততাড়ি গোটাবে, আর নয়তো কেউ-না-কেউ একদিন তাকে পাকড়াবে-কোনো ধীবরের জালে ধরা পড়বার পর তাকে বেশ রয়ে-সয়ে স্টাডি করে দেখা যাবে ওয়াশিংটনের এই মিউজিয়ামে আরো-একটা আশ্চর্য জীবের আমদানি হবে।

আর এটা যদি সত্যি-কোনো সামুদ্রিক জীব না-হয়? মিস্টার ওয়ার্ড তখন জিগেস করেছেন।

আমি অবাক হয়ে প্রতিবাদ তুলেছি, তাছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে?

আগে পড়েই নাও পুরোটা, মিস্টার ওয়ার্ড আমাকে তাতিয়ে দিয়েছেন।

এবং তারপর আমি গভীর মনোযোগ দিয়েই বাকি অংশটা পড়েছি। এবং লক্ষ করেছি যে প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশটায় আমার বোকর্তা কতগুলো অনুচ্ছেদের তলায় লাল পেনসিল দিয়ে দাগিয়ে রেখেছেন।

বেশ কিছুকাল ধরেই, এ-যে কোনো সমুদ্রের জীব, এ নিয়ে লোকের মনে কোনো সন্দেহ ছিলো না। আর এও সবাই ধরে নিয়েছিলো যে, যদি দল বেঁধে প্রাণপণে এটাকে তাড়া করা যায়, তবে আর-কিছু না-হোক, একে আমাদের এই উপকূলভাগ থেকে ভাগিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু তারপরেই লোকে মত বদল করেছে। লোকে জিগেস করতে শুরু করেছে, মাছ না-হয়ে, এ যদি হয় কোনো অভিনব ও দারুণ শক্তিশালী কোনো নৌকো?

সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তার দুর্দান্ত এনজিনটার ক্ষমতা অপরিসীম। হয়তো উদ্ভাবনকর্তা তার এই উদ্ভাবনের মূল সূত্রগুলো বিক্রি করে দেবার আগে, এভাবেই যন্ত্রটা সম্বন্ধে লোকের কৌতূহল চাগিয়ে তুলতে চাচ্ছে, চাচ্ছে যে লোকে যাতে এই স্টীমবোট সম্বন্ধে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে–আর গোটা নৌজগৎকে তাক লাগিয়ে দেয়াই বোধকরি তার উদ্দেশ্য : বাহবা পেতে কার না ইচ্ছে থাকে? তার এই স্টীমবোটের চলায় এমন একটা নিশ্চিন্ত দৃঢ়তা, তার প্রত্যেকটি নড়াচড়ায় এমন-একটা সুন্দর ছন্দ, এমন সহজ অনায়াসভঙ্গিতে সে তীরের বেগে পেছন-নেয়া নৌকোর হাত এড়িয়ে যায়–নিশ্চয়ই এত-সব আশ্চর্য গুণের জন্যে তার এই স্টীমবোট জগৎ-জোড়া এক প্রচণ্ড আগ্রহ ও কৌতূহল জাগিয়ে তুলবে।

গত কয়েক বছরে জাহাজের এনজিন বানাবার বিদ্যা দারুণ উন্নতি করেছে। অতিকায় সব অ্যাটলান্টিক পাড়ি দেয়া স্টীমার পাঁচদিনের মধ্যে এ-মহাদেশ থেকে ও মহাদেশে যাওয়া সম্ভব করে তুলেছে। আর এনজিনিয়াররা এখনও তাদের শেষ কথা বলেননি। জগতের নৌশক্তিগুলোও খুব-একটা পেছিয়ে পড়ে নেই। ক্রুজার, টর্পেডোবোট, টর্পেডো-বিধ্বংসী জাহাজ-খুব সহজেই অ্যাটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগরের দ্রুততম জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, ভারত মহাসাগরে যারা বাণিজ্যের ছলে ঘুরে বেড়ায় তাদেরও এরা আদপেই রেয়াৎ করে না।

এ যদি, সত্যি, কোনো নতুন নকশা অনুযায়ী তৈরি-করা স্টীমবোট হয়, এ পর্যন্ত তার চেহারাটা, আদলটা, খুঁটিয়ে দেখবার কোনো সুযোগ পাওয়া যায়নি। আর কোন এনজিন : যে তাকে এমন দ্রুতবেগে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায় তার শক্তির উৎস নিশ্চয়ই এখনও কারু জানা নেই। কোন শক্তি মারফৎ তার কলকজা চলে, সেটাই হয়তো প্রধান প্রশ্ন। যেহেতু এই নৌকোটার কোন পাল নেই, এ নিশ্চয়ই হাওয়ার তোড়ে ছোটে না; আর যেহেতু তার কোনো নল দিয়ে ধোঁয়া ওঠে না কুণ্ডলি পাকিয়ে, এ নিশ্চয়ই বাষ্পের জোরেও চলে না।

প্রতিবেদনটার এখানটায় পৌঁছে, আমি আবার পড়া থামিয়ে আমরা প্রশ্নটা উত্থাপন করবো কি না ভাবছি, এমন সময় আমার দ্বিধা লক্ষ করে মিস্টার ওয়ার্ড জানতে চেয়েছেন : কোথায় তোমার ধাঁধা লাগছে, স্ট্রক?

এখানটায়, মিস্টার ওয়ার্ড। এই তথাকথিত জলযানটির চালকশক্তি যে কী, তা কারু জানা নেই, শুধু এটা জানা যে এর গতি প্রচণ্ড, আশ্চর্য দ্রুতবেগে সে চলতে পারে। এর সঙ্গে আমাদের ঐ তাজ্জব মোটর গাড়িটার কী আশ্চর্য মিল–

তাহলে এতক্ষণে তুমি এই সিদ্ধান্তেই এসে পৌঁছেছে?

হ্যাঁ, মিস্টার ওয়ার্ড।

সত্যি, একটাই শুধু সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো যায়। যদি সেই রহস্যময় শোফেয়ার উধাও হয়ে গিয়ে থাকে, যদি সে তার শকট নিয়ে লেক মিশিগানে সলিল সমাধি লাভ করে থাকে, তবে এখন তেমনি জরুরি হয়ে উঠেছে এই রহস্যময় নৌচালকের গুপ্ত রহস্যটি জানা। আর, সে সমুদ্রের তলায় চিরকালের মতো হারিয়ে যাবার আগেই, সেটা জেনে নেয়া জরুরি। কিন্তু এ কেমনধারা বৈজ্ঞানিক? কোথায় এমন অত বৈজ্ঞানিক আছে। যে তার উদ্ভাবনের কথা কাউকেই জানাতে চায় না? মার্কিন সরকার–আর বলতে-কি অন্য যে-কোনো সরকারই–সে যা দাম চায় তা-ই দিতে নিশ্চয়ই রাজি হবে–তার যন্ত্রটা এমনই আশ্চর্য।

অথচ, অবাক কাণ্ড!, দুর্ভাগ্যবশতই বলা যায়, ডাঙার ওপরকার যানটির আবিষ্কর্তা তার গোপন রহস্য বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে জলে ডুবে মরেছে! এই জলে-ভাসা যানটির আবিষ্কর্তাও কি তেমনিভাবে নিজের আবিষ্কারের রহস্য নিয়ে হারিয়ে যাবে? প্রথম যানটি যদি–ধরে নেয়া যাক, যদি–এখনও টিকে থাকে কোথাও, এর কথা আজকাল আর কোথাও শোনা যাচ্ছে না; দ্বিতীয়টাও কি, সেই একইভাবে, নিজের বাহাদুরি দেখিয়ে সকলের শাবাশি পেয়ে, শেষটায়, কোনো চিহ্ন না-রেখেই, বেমালুম হারিয়ে যাবে?

এই সম্ভাবনাটাকে যে আদৌ উড়িয়ে দেয়া যায় না, তার পক্ষে যে যুক্তি আছে, সেটা এই : চব্বিশ ঘণ্টা আগে ওয়াশিংটনে এই প্রতিবেদন এসে পৌঁছুবার পর এই আশ্চর্য জলযানটির কোনো হদিশই কোনোখান থেকে পাওয়া যায়নি–কেউ আর তাকে কোথাও চোখে দ্যাখেনি। আদৌ তাকে আর-কখনও দেখা যাবে কি না, দেখা গেলেও–কবে এবং কোথায়, এই কূট প্রশ্নের উত্তর কেউ-বা জানে?

আমার চোখে অবশ্য আরো-একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ধরা পড়েছে। ঠিক যখন আমি কথাটা পাড়বো কি না ভাবছি, ঠিক তখনই মিস্টার ওয়ার্ড প্রসঙ্গটা তুলেছেন। এ এক অদ্ভুত কাকতাল। তথ্যটা এই : ঐ আশ্চর্য স্থলযানটি বেমালুম উধাও হয়ে যাবার পরেই এই আশ্চর্য নৌযানটি সকলের চোখে পড়েছে। দুটোরই এনজিনে আছে অজ্ঞাত শক্তি–যার ক্ষমতা প্রচণ্ড। যদি জলে-ডাঙায় একযোগে এই দুই যান তীব্রবেগে ছুটে চলে, তবে মানবজাতির সমূহ বিপদ-জলে-ডাঙায়, নৌকোয়-গাড়িতে, পদব্রজে–কিছুতেই এর খপ্পর থেকে পালানো যাবে না। সেইজন্যে, জলসাধারণের চলাফেরার নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্যে এক্ষুনি পুলিশকে কোনোভাবে আসরে নেমে পড়তে হবে।

মিস্টার ওয়ার্ড কথাটা বিশদ করে বলবামাত্র আমাদের কাজ কী হবে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । কিন্তু কী করে আমরা পাকড়াবো এই আবিষ্কর্তাকে? কিছুক্ষণ আলোচনা করে আমি যাবার জন্যে যেই উঠে দাঁড়িয়েছি, মিস্টার ওয়ার্ড তার ভাবনাটা ভেঙে বলেছেন : এই নৌকো আর ঐ গাড়ি–এই দুয়ের চমকপ্রদ মিলটা খেয়াল করেছে কি, স্ট্রক?

আমিও তা-ই ভাবছিলুম।

আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে দুটোই আসলে এক–এটা একটা উভচর যান।