০১-২. সোফিয়ায় গোলমাল

বার্চবনে ঝড় – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

০১. সোফিয়ায় গোলমাল

সোফিয়ার আমেরিকান স্কুলের বাইরের সিঁড়িতে বসে শেষ চুইংগামটা মুখে ফেলে রীন বললো, তোর কি মনে হয় শহরে খুব গোলমাল হচ্ছে?

ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে নীল বললো, হেডমাষ্টার তো তাই বললেন। ব্রাদার এণ্ডারসন তোদের ক্লাসে যান নি?

না, সিস্টার আলবেনা এসেছিলেন। গোলমালের কথা কিছু বলেন নি। শুধু বললেন আজ দুটোয় স্কুল ছুটি হবে। ছুটির পর কেউ স্কুলে থাকবে না।

বুলগেরিয়ায় এখন পাতাঝরার সময়। অক্টোবর শেষ হতে চলেছে। নভেম্বরের ভেতরই গাছের সব পাতা ঝরে যাবে। বুলেভার্ড রুকিতে মস্ত বড় জায়গা জুড়ে পুরোনো আমলের এক বাড়িতে থাকে নীলরা। ওদের বাবা বুলগেরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, তিন বছর হলো সোফিয়ায় এসেছেন। বাড়ির পেছনের আঙিনায় একশ দেড়শ বছরের পুরোনো বার্চ, চেস্টনাট, ওক, লিন্ডেন আর লাইম গাছ থেকে সারাদিন সারারাত সরসর করে পাতা ঝরে পড়ে। গাছের পাতাঝরার এ সময়টা নীলদের খুব ভালো লাগে। রাস্তার ওপাশে ফ্রিডম পার্কের ভেতর হাঁটতে গেলে শুকনো পাতায় পা ডুবে যায়। গাছের পাতা যে কত বিচিত্র রঙের হতে পারে ইউরোপে না এলে নীলরা জানতে পারতো না। ওক গাছের পাতা হয় অরেঞ্জ আর ব্রোঞ্জ রেড, লাইমের পাতা লেমন ইয়েলো, বার্চের পাতা ব্রাইট গোল্ডেন রঙের আর শেষ নেই।

ওদের আমেরিকান স্কুলটা শহরের একপ্রান্তে, বুলেভার্ড টলবুখিন-এ, ভিতুশা পাহাড়ের ঠিক নিচে। এদিকটা খুব নিরিবিলি, শহরের কোনও কোলাহল এখানে এসে পৌঁছোয় না। নীলদের বাড়ি এখান থেকে কম করে হলেও তিন মাইল হবে।

নীল ঘড়ি দেখে বললো, তোবারক আলীর আসতে আরো এক ঘন্টা।

সামারে ওদের স্কুল ছুটি হয় পাঁচটায়, উইন্টারে চারটায়। উইন্টার মানে অক্টোবর থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত। শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত-সবই এর ভেতর পড়ে। গাড়ির জন্যে কখনো বলতে হয় না। নীল আর রীন জানে ছুটির পর স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে তাকালেই দেখবে বুড়ো ওক গাছটার নিচে বাংলাদেশ দূতাবাসের কালো মার্সেডিম নিয়ে অপেক্ষা করছে ঝকঝকে সাদা ইউনিফর্ম পরা তোবারক আলী। বয়স চব্বিশ পঁচিশ বছর হবে, চেহারা সিনেমার হিরোদের মত, বুলগেরিয়ানরা ওকে টার্কিশ ছবির এক নায়ক ভেবে ভুল করে। সাত বছর ধরে সোফিয়ায় আছে, এত সুন্দর বুলগেরিয়ান বলে যে বোঝার উপায় নেই ওর আদি বাড়ি নোয়াখালির চরে। ইংরেজিও মোটামুটি বলতে পারে, তবে বাংলা বলার সময় নোয়াখালির টান আর গোপন থাকে না। রীন ওকে পাখিপড়ার মত শিখিয়েছে, আমাকে আফা বলবে না, আপা বলবে। একবার দুবার ঠিক মত বলেও আবার আগের মত–আফা আফা করবে, আপনি না বলে বলবে আমনে। ভাইকে বলবে বাই। নীল একদিন বলেছিলো, তোবারক ভাই, তোমার এই দারুণ হ্যাঁণ্ডসাম চেহারা নিয়ে ড্রাইভার হতে গেলে কেন, ঢাকার সিনেমায় নামলে নাম করতে পারতে। তোবারক আলী চটপট উত্তর দিয়েছে, ফাঁইরতাম, কিন্তুক ওই ল্যাঙ্গুয়েজ ফ্রব্লেম। শুনে নীল আর রীন হেসে গড়িয়ে পড়েছে। রীন তো কদিন ওকে মিঃ ল্যাঙ্গুয়েজ ফ্রব্লেম বলে খেপিয়েছিলো, মার বকুনি খেয়ে বন্ধ করেছে। তোবারক আলী অবশ্য ওদের রসিকতায় কিছু মনে করে না। ও জানে এই স্যারের ছেলে মেয়ে দুটো ওকে খুব ভালোবাসে, বেগম সাহেবও নিজের ঘরের লোকের মত ব্যবহার করেন। আগের স্যারের এক বিটকেল ছেলে ছিলো, পড়তো লণ্ডনে, ছুটিতে যখন আসতো তখন খাঁটিয়ে মারতো, কথা বলতো এমনভাবে তোবারক আলী যেন বাড়ির চাকর।

চিবোনো চুইংগামটা ফেলে দিয়ে রীন বললো, শহরে গোলমাল যদি বেশি হয় তোবারক আলী আসবে কিভাবে?

নীল গম্ভীর গলায় বললো, এম্বাসির সিডি কার কেউ আটকাবে না।

আমেরিকান স্কুলে নীলের এটা শেষ বছর, রীনের স্কুলে ছাড়তে আরো দুবছর বাকি। ওদের এ্যানুয়াল পরীক্ষা চলছে, রীনদের বাকি একটা, নীলদের তিনটা। এখানে এসে ওরা খুবই ভালো করছে। এর আগে ছিলো বার্লিনে। ওখানকার চেয়ে এখানকার টিচাররা ভালো, খুব যত্ন করে পড়ান। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের বড় বড় কূটনীতিকদের ছেলেমেয়েরা এ স্কুলে পড়ে। সবাই এখানে পড়তে পারে না, খরচ খুব বেশি। দূতাবাসের সাধারণ ষ্টাফদের ছেলেমেয়েরা লোকাল স্কুলে পড়ে, যেখানে পড়ার কোন খরচই লাগে না। স্কুল পর্যন্ত এখানে সব কিছু ফ্রি। দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি আলম সাহেবের ছেলে আতিক নীলের বয়সী, লোকাল স্কুলে পড়ে, ওদের চেয়ে অনেক ভালো বুলগেরিয়ান বলে। আতিকদের স্কুলে সব কিছু বুলগেরিয়ান ভাষায় পড়ানো হয়।

ব্যাগটা সিঁড়ির ওপর রেখে রীন উঠে দাঁড়ালো। শক্ত পাথরের সিঁড়ির ওপর এতক্ষণ বসে পায়ে ঝিঁঝি ধরেছে। কয়েকবার পা ছুঁড়ে ধুপধাপ করে হেঁটে নীলকে বললো, আরেকবার টেলিফোন করে দেখ না দাদা!

রীনকে একটু নার্ভাস মনে হলো। মৃদু হেসে নীল বললো, তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? বলি নি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কাজ করছে না! গোলমাল ওদের নিজেদের ভেতর, আমাদের কেউ কিছু বলবে না।

রীন আসলেই ভয় পাচ্ছিলো–গন্ডগোলের ভেতর তোবারক আলী যদি আসতে না পারে! ট্রাম বন্ধ হয়ে গেছে। এতক্ষণ বসে আছে, একটা বাসও চোখে পড়ে নি। সামনের রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে ঝড়ের বেগে একটা দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছিলো। নীল ওর ভয় পাওয়াটা টের পেয়েছে দেখে রীন মুখ ভার করে বললো, ভয় আবার কখন পেলাম! সময় মত বাড়ি ফিরে না গেলে মা বুঝি ভাববে না!

তখন তো বললাম স্কুল বাসে যেতে। ভিড় দেখে যেতে চাইলি না। তোবারক আলী না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।

বাসে গেলে লাইব্রেরিতে যেতাম কিভাবে? বই ফেরত দিতে এমনিতে দুদিন দেরি হয়ে গেছে।

এই গোলমালে লাইব্রেরি কি ভোলা থাকবে!

আচ্ছা দাদা, গোলমালটা কারা করছে বলতো?

বাবা সেদিন বললেন সিটিযেনদের কি একটা কমিটি নাকি হয়েছে, পোল্যাণ্ডের সলিডারিটির মত। ওরা এখানে ইলেকশন চাইছে। হতে পারে ওরাই রাস্তায় নেমেছে।

দাদা, এখানে কি কেউ মিছিল করলে বাংলাদেশের মতো পুলিশ গুলি করে?

পাগল হয়েছিস! ইউরোপ, আমেরিকায় এসব চলে না। ঝিভকভ যদি দেখে বেশির ভাগ মানুষ ওকে চাইছে না, তাহলে ঠিকই দেখবি গদি ছেড়ে দিয়েছে।

মাত্র ষোল বছরে পা দিয়েছে নীল। ওর কথা শুনে মাঝে মাঝে রীন অবাক হয়ে যায়। ঠিক বাবার মত কথা বলে। এম্ব্যাসি থেকে বাবা যেসব ইংরেজি পত্রিকা আনেন নীল সব পড়ে। ক্লাসে বরাবরই ফার্স্ট হয়। বার্লিনে থাকতেও ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিলো ও। নীলের ইচ্ছা বড় হয়ে বাবার মত কূটনীতিক হয়ে নানা দেশ ঘুরবে।

ঘড়িতে যখন সোয়া চারটা বাজলো রীন তখন না বলে পারলো না, দাদা আমার সত্যি ভয় করছে। তোবারক আলী যদি না আসে কি হবে! একটু পরেই তো সন্ধ্যা হবে।

নীল শান্ত গলায় বললো, ভয় কী, আমি আছি তো! আর পনেরো মিনিট অপেক্ষা করবো। তারপর এখানকার পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ওদের হেল্প চাইবো।

ভিতুশা পাহাড় থেকে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস হু হু করে বয়ে গেলো। বৃষ্টির মত ওক আর লাইম গাছের পাতা ঝরে পড়লো, বাতাসে এলোমেলো উড়ে গেলো বহু দূর। ছাই রঙের একটা ম্যাপল পাতা উড়ে এসে রীনের ঘন কালো চুলে প্রজাপতির মত আটকে রইলো। ওরা কেউ দেখতে পেলো না।

ঠিক সাড়ে চারটায় ওরা যখন পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো, তখনই ওদের চোখে পড়লো কালো মার্সেডিটা। অন্য সময় এত স্পীডে গাড়ি চালালে তোবারক আলীকে জরিমানা করা হতো। সেদিন রাস্তায় দেখার মত কেউ ছিলো না। ওকে দেখে খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো। উত্তেজিত গলায় বললো, নেভস্কি স্কয়ার, সেপ্টেম্বর স্কয়ার সব জায়গা জাম হই গেছে। চাইরদিকে খালি মিছিল, আটকা ফড়ি গেছিলাম।

নীল আর রীন উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে তোবারক আলী ঘন্টায় ষাট মাইল বেগে গাড়ি চালালো। রীন বললো, শহরে কি খুব গোলমাল হচ্ছে তোবারক ভাই?

তোবারক আলী বললো, এদেশের মানুষ কোনদিন মিছিল দ্যাখে নাই। খুব ঘাবড়াই গেছে। ফুলিসও বেদিশা হই গেছে।

নীল মৃদু হেসে বললো, মনে হচ্ছে তুমিও ঘাবড়ে গেছে।

তোবারক আলী গলা খুলে হাসলো–আমি ক্যান ঘাবড়ামু নীল বাই? আমারে কে কি কইরবো? আমি চিন্তা কইরছিলাম আমনেগো কথা। আধ ঘন্টা দেরি হইছে, ঘোড়া বহুত ফেরেশান তো হইবেনই।

আমরা মোটেই পেরেশান হই নি।

রীন গম্ভীর হয়ে বললো, তুমি না হতে পারো দাদা, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।

তোবারক আলী নরম গলায় বললো, আর ভয়ের কিছু নাই আফা। এই গাড়ি ছোঁয়ার সাহস কারো নাই।

নীল বললো, তুমি কি আমাদের নামিয়ে দিয়ে বাবাকে আনতে যাবে?

ফাঁকা রাস্তা ধরে তোবারক আলী ঘুরপথে শহরে যাচ্ছিলো। নীলের কথা শুনে ওর মনে হলো স্যারকে আনার সময় হয়ে গেছে। বললো, আমনেগো অসুবিধা না হইলে ঘুরি যাই স্যাররে তুলি লই।

নীল বললো, আমাদের অসুবিধে হবে না। তুমি বাবাকে তুলে নাও।

রীন বললো, এম্বাসিতে গিয়ে মাকে ফোন করতে হবে।

এমন কিছু দেরি ওদের হয় নি। নীলের খেলা থাকলে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। নীল ওদের স্কুলের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন। তবে ফিরতে দেরি হলে মাকে বলে যায়। আজ যে দেরি হবে মাকে বলে নি, বলার কথাও ছিলো না। তাছাড়া শহরের গোলমালের কথা মা নিশ্চয় জানেন। মার জন্যে তাই রীনের খুব ভাবনা হচ্ছিলো।

বাংলাদেশ দূতাবাস ওদের ঠিক পথে পড়ে না। শহরের প্রায় মাঝখানে রাকৌস্কি ট্রিট-এ, গ্রানাইট পাথরের পুরোনো দিনের একটা দোতালা বাড়ি। কূটনীতিক আর সাধারণ ষ্টাফ নিয়ে জনা দশেক মানুষের দফতর। রাষ্ট্রদূত বসেন দোতালায়।

নীলরা দূতাবাসে এলে কখনো সরাসরি বাবার ঘরে যায় না। সুন্দরী, চটপটে এক তরুণী সেক্রেটারী আছে। ওর ঘরেই বসে। ইলিনার মত ফ্যাশন জানা বুলগেরিয়ান মেয়ে রীনের চোখে এখন পর্যন্ত পড়ে নি।

সেক্রেটারির ঘরে ঢুকে নীল বুলগেরিয়ান ভাষায় বললো, শুভ সন্ধ্যা ইলিনা মিরকোভা। আশা করি ভালো আছেন?

শুভ সন্ধ্যা নীল, রীন। হাসিমুখে ইলিনা বললো, এখন পর্যন্ত ভালো আছি। তবে কতদিন ভালো থাকবো বলতে পারছি না।

শহরে গোলমালের কথা শুনেছি। নীল বললো, খুব শিগগিরই এসব মিটে যাবে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। ইলিনা মাথাটা ওপরে নিচে দোলালো।

বুলগেরিয়ায় প্রথম এসে এভাবে মাথা দোলানো দেখে অবাক হয়েছিলো নীলরা। অন্য সব জায়গায় হ্যাঁ বলার সময় যেভাবে মাথা দোলানো হয়, বুলগেরিয়ানরা সেভাবে মাথা দুলিয়ে না বলে। আর হ্যাঁ বলার সময় উল্টোটা করে। আগে এম্বাসির বুলগেরিয়ান ষ্টাফদের এভাবে মাথা দোলানো দেখে ওদের খুব হাসি পেতো। এখন ওরাও বুলগেরিয়ানদের মত মাথা দোলায়।

আপনি কোন দলে ইলিনা মিরকোভা?

রহস্যময় হেসে ইলিনা বললো, তোমাদের কি মনে হয়?

নীল বললো, আপনি সিটিযেন কমিটির সাপোর্টার।

ঠিক ধরেছো। এই বলে ইলিনা বাবাকে ইন্টারকমে ওদের কথা জানালো।

এখনই আসছি ইলিনা। ওরা ইচ্ছে করলে তোমার ওখানে বসে কফি খেতে পারে। জবাব দিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।

ইলিনা বললো, আমি দু মিনিটে তোমাদের চমৎকার কফি বানিয়ে খাওয়াবো।

রীন বললো, ধন্যবাদ ইলিনা মিরকোভা। আশা করি আপনিও সঙ্গী হবেন?

ইলিনা হাসলো–অবশ্যই। আমারও এখন কফির সময়।

ওরা আগেও ইলিনার বানানো কফি খেয়েছে। চমৎকার লাগে খেতে। বাইরের কফি শপের চেয়েও ভালো। কফি শেষ না হতেই বাবা এসে দরজায় উঁকি দিলেন–এই যে বুড়ো বুড়ি, স্কুল থেকে আসতে কোন ঝামেলা হয় নি তো?

রীন হেসে বললো, না বাবা।

ওদের এত সুন্দর ডাকনাম থাকা সত্ত্বেও বাবা ওদের বুড়ো বুড়ি ডাকবেন। মা ঠিকই নীল আর রীন বলেন। অবশ্য বাবার মুখে বুড়ো বুড়ি শুনতে মজাই লাগে।

বাবা ইলিনাকে বললেন, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো। শুনেছো নিশ্চয় বিকেলের পর থেকে বাস বন্ধ হয়ে গেছে।

ইলিনা বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললো, কিভাবে বাড়ি যাবো ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলাম।

ইলিনার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন বাবা। বুলগেরিয়ান ভাষা বাবা ভালো জানেন । বরং মা ভালো শিখেছেন। বাড়িতে যে কাজের লোক এসেছে, এক বছরে একা একা বাজার করে সেও ভালো বুলগেরিয়ান শিখে গেছে।

ইলিনাকে নামিয়ে দিয়ে ওদের বাড়ি ফিরতে সাড়ে ছটা বাজলো। রীন ভাগ্যিস মনে করে ফোন করেছিলো। নইলে মা এতক্ষণে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিতেন।

নীলদের গাড়ি যখন বাড়ির বড় গেট-এর ভেতর ঢুকলো তখন ওরা দেখলো মা গাড়ি বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। মাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো। তোবারক গাড়ি থামাতেই মা শুকনো হেসে নীলদের বললেন, ফোন করলে কি আর ভাবনা দূর হয়। তারপর বাবাকে বললেন, আজ হঠাৎ কী হলো বলো তো!

বাবা বললেন, কী আর হবে! ইস্ট ইউরোপের সব দেশে যা শুরু হয়েছে তাই।

তোবারক আলী একটু ইতস্তত করে বাবাকে বললো, স্যার রাতে যদি কোন প্রোগ্রাম না থাকে, আমি চলে যাই?

মা বললেন, তুমি কি ক্ষেপেছো তোবারক? এই গণ্ডগোলের ভেতর কোথায় যাবে? রাতে এখানে থেকে যাও।

তোবারক আলী থাকে শহরের বাইরে, এম্ব্যাসির এক স্টাফের সঙ্গে। বাসে যাওয়া আসা করে। ও খুব চিন্তিত ছিলো এই শীতের রাতে এতটা পথ হেঁটে যেতে হবে ভেবে। বেগম সাহেবের কথা শুনে কৃতজ্ঞতায় ওর বুকটা ভরে গেলো।

মা বললেন, তোবারক, ছাদে গিয়ে টিভির এন্টেনাটা একটু ঠিক করে দাও। ঠিকমত ছবি আসছে না।

নীল বললো, টিভি ষ্টেশনে হামলা করে নি তো?

বাবা হাসলেন–বুড়ো একটু বেশি বেশি ভাবিস। টিভি ষ্টেশনে কেন হামলা করবে? সরকার বদলের জন্য এসব দেশে ও ধরনের আন্দোলন হয় না।

কথাটা নীলের মনঃপুত হলো না। ও কদিন আগে ভিসিআর-এ ডেঞ্জারাস লাইফ ছবিটা দেখেছে। ফিলিপাইনে মার্কোসকে গদি থেকে নামানোর জন্য কী সাংঘাতিক সব ঘটনা ঘটেছে দেখিয়েছে সাত ঘন্টার ওই ছবিতে। একবার দেখতে বসলে টিভির সামনে থেকে নড়া যায় না। ছবিটা দেখে ঢাকায় বড়কাকার ছেলে রবিনকে চিঠিতে লিখেছিলো। রবিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স-এ অনার্স পড়ে। এখন ওর সেকেণ্ড ইয়ার চলছে। নীলের চিঠির জবাবে রবিন লিখেছিলো–ছবিটা আমিও দেখেছি। তুই নিশ্চয় জানিস আমাদের দেশেও ওরকম একটা মার্কোস রয়েছে। ওকে ফেলার জন্য আমরাও সেরকম কিছু করতে যাচ্ছি।

নিজের ঘরে এসে ব্যাগ থেকে একটা ইশতেহার বের করলো নীল। টিফিনের সময় এসে গোপনে ওর বুলগেরিয়ান বন্ধু রিস্টো ওটা দিয়েছে। ওদের স্কুল থেকে খুব কাছে রিস্টোদের স্কুল। রিস্টোর বাবা ইঞ্জিনিয়ার, সিটিযেন কমিটির একজন নেতা। ইশতেহারটা ভাঁজ করে ওর হাতে গুঁজে দিয়ে চাপা গলায় রিষ্টো বলেছে, বাড়ি গিয়ে পড়বি। তোর বাবাকেও পড়তে দিবি। এরপর রিস্টো আর দাঁড়ায় নি। আড়চোখে এদিক ওদিক দেখে চলে গেছে। নীল তখন খুব অবাক হয়েছিলো। রিস্টোর কাছে ও সিটিযেন কমিটির নাম একবার শুনেছিলো বটে। এই ইশতেহার আর শহরের গোলমালের কথা না শুনলে সিটিযেন কমিটির ব্যাপারটা ভুলে যেতে বসেছিলো নীল। রিস্টোর সঙ্গে প্রায় একমাস পর দেখা হলো। তারপর এই গোলমাল।

বুলগেরিয়ান ভাষায় লেখা রিস্টোর ইশতেহার পড়তে গিয়ে দুবার হোঁচট খেলো নীল। তবু বুঝতে অসুবিধে হলো না। প্রেসিডেন্ট ঝিভকভ, তার ছেলে আর মন্ত্রীদের দুর্নীতির বিবরণ দিয়েছে। গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর নির্বাচনের দাবি করেছে। মোটামুটি এতটুকু বুঝতে পারলো নীল।

ইশতেহার পড়তে গিয়ে চা খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলো সে। রীন এসে ডাকলো, দাদা, মা চা নিয়ে অপেক্ষা করছে, তুই ঘরে বসে আছিস কেন? ড্রেসও চেঞ্জ করিস নি!

নীল একটু অপ্রস্তুত হলো–ঠিক আছে, তুই যা, আমি এক্ষুণি আসছি।

পাঁচ মিনিটের ভেতর মুখহাত ধুয়ে পোষাক পাল্টে নিচে ডাইনিং রুমে এলো নীল। মা, বাবা আর তোবারক আলী বসে চা খাচ্ছে। রীন লিভিং রুমে টেলিভিশন দেখছে।

এক টুকরো কেক ভেঙে মুখে দিয়ে নীল বললো, বাবা তুমি এদের সিটিযেন কমিটির খবর কিছু জানো?

কিছু খবর তো রাখতেই হয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাবা বললেন, ওদের খবর জানতে চাইছিস কেন? নিজের এই বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটির সঙ্গে বন্ধুর মত কথা বলেন রাষ্ট্রদূত ইকবাল আহমেদ খান।

আজকের গোলমাল সম্পর্কে কোন লিফলেট পেয়েছো?

তো? কেন? এটা দেখো। এই বলে ইশতেহারটা বাবার দিকে বাড়িয়ে দিলো নীল।

ইশতেহার হাতে নিয়ে বাবা চশমা পরলেন। এক নজর চোখ বুলিয়ে বললেন, এ তো বুলগেরিয়ান ভাষায় লেখা। তোবারক, পড়ে বলো তো কী লিখেছে?

নীলের চেয়ে তোবারক অনেক ভালো বুলগেরিয়ান জানে। বাংলাদেশ দূতাবাসে কোন বাঙালি ওর মত এ ভাষাটি রপ্ত করতে পারে নি। মাঝে মাঝে ও দোভাষীর কাজও করে। কোন রকম হোঁচট না খেয়ে গড়গড় করে ইশতেহারটা পড়ে কিছু কিছু শব্দ নোয়াখালির বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে অর্থ বলে দিলো সে। নীল খুব উপভোগ করলো যখন ও অত্যাচারীকে হার্মাদ, দূবৃত্তকে একবার নটোরিয়াস, আরেকবার বিডাল–এমনি সব শব্দ বললো।

বাবা সবটুকু শুনে বললেন, এটা কি আমার কাছে রাখতে পারি বুড়ো?

নীল হাসলো–নিশ্চয়ই পারো। আমার পড়া হলে ওটা তোমাকে দিতে বলেছে রিস্টো।

মা একটু চিন্তিত গলায় বললেন, মনে হচ্ছে গোলমাল বেশ কিছুদিন চলবে। এ সময় রবিনের আসাটা কি ঠিক হবে? বলে তো দিলাম আসতে!

বাবা বললেন, আসুক না, অসুবিধে হবে না।

নীল অবাক হয়ে জানতে চাইলো–কখন আসবে রবিনদা?

মা বললেন, দুপুরে তোর বড় কাকা ফোন করেছিলেন। থাই এয়ার থেকে উনি যে টিকেটটা এবার পাবেন সেটা রবিনকে দেবেন। ও রোম হয়ে সামনের ছ তারিখে সোফিয়া পৌঁছবে।

বড়কাকার ট্রাভেল এজেন্সির অফিস আছে ঢাকায়। বিভিন্ন এয়ার লাইন্স থেকে তিনি ফ্রি টিকেট পান। বেশির ভাগই দিয়ে দেন গরিব আত্মীয় স্বজন বা পরিচিতদের ছেলেমেয়েদের, যারা টাকার অভাবে বাইরে পড়াশোনা বা চিকিৎসার জন্য যেতে পারছে না। নীল বহুবার রবিনকে লিখেছে বড়কাকার এত ফ্রি টিকেট, একবার বেড়াতে আসো না কেন! রবিন জবাব দিয়েছে, যখন বাবা দেয়ার মত কাউকে পাবেন না তখন। চেষ্টা করবো। মার কথা শুনে নীল বললো, এবার বুঝি বড় কাকা টিকেট দান করার মত কাউকে পান নি!

মা মৃদু হাসলেন–রোমে কেউ পড়তেও যায় না, ট্রিটমেন্টের জন্যও যায় না।

রবিনদা এলে খুব মজা হবে মা। ওকে নিয়ে সারা বুলগেরিয়া ঘুরে বেড়াবো।

নীলের উচ্ছ্বাস দেখে বাবা মৃদু হাসলেন–বুখারেষ্টে হাশিম ভাই আছেন। ইচ্ছে করলে বুখারেস্ট থেকেও ঘুরে আসতে পারিস।

তাহলে তো আরও মজা হবে বাবা। হাশিম চাচার ওখানে গেলে যা করেন না!

রুমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হাশিম সাহেব বয়সে বড় হলেও নীলের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওঁদের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। নীলরা দুবার বেড়াতে গিয়েছিলো। হাশিম চাচা আর মঞ্জু চাচী নীল আর রীনকে নিজের ছেলেমেয়ের মত ভালোবাসেন।

রীন লিভিং রুম থেকে চেঁচিয়ে বললো, মা, বাবা, আজকের খবর শুনে যাও। কাল থেকে সব স্কুল কলেজে উইন্টার ভ্যাকেশন।

খবর শোনার জন্য ওরা সবাই লিভিং রুমে এলো। শহরে এত যে গোলমাল তার কোনও খবরই নেই। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শীতের ছুটির কথা বললো।

রীন খুব খুশি। বললো, বাবা আমাদের পরীক্ষার কী হবে?

বাবা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, কী আর হবে। যে সাবজেক্ট বাকি আছে, সেমিষ্টারের নাম্বার এ্যাভারেজ করে রেজাল্ট দেবে।

নীল বললো, আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা। যখন স্কুল খুলবে বাকিগুলো তখন দিতে হবে।

রাতের খাবার সেরে ওপরে নিজের ঘরে আসার সময় নীল ড্রইংরুম থেকে টাইম আর নিউজউইক পত্রিকা দুটো নিয়ে এলো। আজই বাবা অফিস থেকে এনেছেন পড়ার জন্য। দুদিন পর আবার ওগুলো অফিসে নিয়ে যাবেন।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিদেশী পত্রিকাগুলো পূর্ব ইউরোপের ঘটনা ফলাও করে ছাপছে। নীল ভাবলো সোফিয়ায় আজকের মিটিং মিছিলের খবরও এতক্ষণে নিশ্চয় চলে গেছে। ঘড়িতে দেখলো রাত দশটা বাজে। ঠিক তখনই দরজায় টোকা দিয়ে রীন গলা বাড়িয়ে বললো, দাদা তোর টেলিফোন।

টেলিফোন বাজার শব্দ নীলও শুনেছিলো। এত রাতে ওকে কে টেলিফোন করলো! অবাক হয়ে রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই রিস্টোর গলা শুনলো। ও ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে যে জিনিসটা দিয়েছিলাম ওটা তোমার বাবাকে দিয়েছো?

রিস্টো ওর সঙ্গে সাধারণত ইংরেজিতে কথা বলে না। নীলের মনে হলো সম্ভবত টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সবাই ইংরেজি জানে না, সেটা ভেবে রিস্টো ইংরেজি বলছে। নীল এক শব্দে জবাব দিলো, দিয়েছি।

কাল কি তুমি স্কুলে আসবে? জানতে চাইলো রিস্টো?

স্কুলে কেন যাবো? স্কুল কলেজ সব বন্ধ–শোনন নি?

এক মুহূর্ত চুপ থেকে কী যেন ভাবলো রিস্টো। তারপর বললো, চার তারিখে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে?

আমাদের বাসায় আসবে, নাকি আমি যাবো তোমাদের বাসায়?

না বাসায় নয়। অন্য কোথাও বলো।

তানিয়াকে নিয়ে যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে হতে পারে।

তানিয়া রিস্টোর বন্ধু। গত মাসে ও আর রীন ওদের দুজনের সঙ্গে ভিতুশা পর্বতের চূড়ায় গিয়েছিলো বেড়াতে। নীলের কথা শুনে রিস্টো একটু ভাবলো। তারপর বললো, ঠিক আছে। পাঁচ তারিখ বিকেল চারটায়। তুমি একা আসবে।

খুট করে লাইন কেটে গেলো। নীল বুঝতে পারলো না রিস্টো কাটলো, না এক্সচেঞ্জ থেকে কাটলো। চিন্তিত হলো–একা ওর সঙ্গে এমন কী গোপন কথা বলতে চায় রিস্টো? বিছানায় শুয়ে একবার রিস্টোর কথা ভাবলো। আরেকবার রবিনদার কথা ভাবলো। তারপর একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো নীল। বাইরে তখন ঝির ঝির করে বার্চ, ওক আর চেস্টনাটের পাতা ঝরছে।

.

০২. সোফিয়ার পথে রবিন

বহুদিন ধরে রবিনের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার পর বাবার সঙ্গে নেপাল গিয়েছিলো, তারপর আর কোথাও যাওয়া হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছে। চীন রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র আছে কি নেই এ নিয়ে ওদের পাঠচক্রে তুমুল আলোচনা হয়। পোল্যাণ্ডে সলিডারিটির কাছে কমিউনিস্টরা হেরে যাওয়াতে ওর খুব মন খারাপ হয়েছিলো। নিখিলদা অবশ্য বলেছেন, পোলিশরা নামেই কমিউনিস্ট। এত বছর পরও যদি পার্টি মেম্বাররা গির্জায় গিয়ে উপাসনা করে, ওদের কি কমিউনিস্ট বলা যায়!

রবিনের তখন মনে হয়েছিলো ওসব দেশে একবার গিয়ে যদি দেখে আসতে পারতো কী হচ্ছে, তাহলে ওর বুঝতে সুবিধে হতো। বাড়িতে এ নিয়ে কিছুই বলে নি, তবু ওর মনের খবর বাবা ঠিকই জেনেছেন। সকালে নাশতার টেবিলে খেতে খেতে বললেন, কাল সোফিয়ায় তোমার মেজচাচীর সঙ্গে কথা বলেছি। রোমে আমার বন্ধু নাফিসার সঙ্গেও কথা বলেছি। তুমি রোম হয়ে সোফিয়া ঘুরে এসো। কানেকটিং ফ্লাইট দিতে পারতাম, নাফিসা বললো তোমাকে দুতিন দিন রোমে বেড়িয়ে যেতে।

রবিন উত্তেজিত হয়ে বললো, সত্যি বলছো বাবা? কবে যাবো?

মৃদু হেসে বাবা বললেন, নভেম্বরের দুতারিখে ফ্লাইট। কালই ইটালিয়ান আর বুলগেরিয়ান এ্যাম্বাসিতে গিয়ে ভিসা নিয়ে এসো। তোমার কাকা ওদের বলে দেবেন।

টেবিলে ওরা মাত্র দুজন। রবিনের কোন ভাইবোন নেই। খুব ছোটবেলায় মা মারা গেছেন। বাবা ওকে কখনো মার অভাব বুঝতে দেন নি। বাবার কথা শুনে রবিন অবাক হলো, খুশিও হলো। বললো, তুমিও চলো না বাবা। সেই কবে নেপাল গিয়েছিলাম!

বাবা আগের মতো হেসে বললেন, তুমি তো জানো আমার অফিসের অবস্থা আগের মতো নয়। আগামী দু-তিন বছর মনে হয় না বাইরে যেতে পারবো। থাই এয়ার একটা টিকেট দিয়েছে, তুমি একাই ঘুরে এসো। একা যেতে নিশ্চয় অসুবিধে হবে না?

রবিন একটু লজ্জা পেলো আমার কোনও অসুবিধে হবে না। আমি তোমার কথা ভাবছি বাবা। তুমি একা হয়ে যাবে।

তুমি কি চিরদিনের জন্যে যাচ্ছো? বেশি হলে দিন পনেরো থাকবে। আমার অসুবিধে হবে না। বাবুর্চি আছে, সোলেমানের মা আছে–তুমি আমার কথা ভেবো না।

রবিন বাবার মুখের দিকে তাকালো। চশমার ভেতর দিয়ে দুটো স্নেহঝরা চোখ ওকে দেখছে। বাবার বয়স এখন পঞ্চাশ। এখনো কী সুন্দর দেখতে! স্বাস্থ্যও চমৎকার। রবিনের বন্ধুরা রসিকতা করে বলে, ওদের দেখে নাকি দুই ভাইয়ের মত মনে হয়। বাবার এক বছরের ছোট মেজকাকা, দেখে মনে হয় বাবার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড়।

রবিন বুলগেরিয়া যাচ্ছে শুনে ওর বন্ধুরা ভীষণ উত্তেজিত হলো। নিখিলদা পই পই করে বললেন, কাকা এ্যাম্বাসাডর বলে অতিথির মত বাড়িতে বসে থেকো না। সব ঘুরে দেখবে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশবে। চোখ কান খোলা রাখবে। পারলে কাকাকে বলে পার্টির কোন নেতার সঙ্গে যদি কথা বলতে পারো ভালো হয়।

ওর ফ্লাইট ছিলো রাতে। বাবার সঙ্গে ওর দুই বন্ধু এলো এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে। গত কয়েক দিন যাওয়ার প্রস্তুতি আর উত্তেজনায় সময় কিভাবে কেটেছে টের পায় নি। এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে ট্রাভেল ট্যাক্স, এম্বাকেশন ফি ইত্যাদি জমা দিয়ে, চেক ইন করে বোর্ডিং পাস নিয়ে যখন কাস্টমস-এর জন্য ভেতর ঢুকবে, তখন কাঁচের দরজার বাইরে নজর পড়তে থমকে দাঁড়ালো। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন পাথরের মূর্তির মত, চশমার ভেতর চোখ দুটো ছলছল করছে। ওকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে ম্লান হেসে হাত নাড়লেন। রবিনের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। হঠাৎ মনে হলো, বাবাকে ফেলে এই প্রথমবার একা কোথাও যাচ্ছে।

রোমগামী যাত্রীদের ইমিগ্রেশনের জন্য যাওয়ার ডাক এলো। হাত নেড়ে বাবাকে বিদায় জানালো রবিন। কান্না চেপে ভেতরে ঢুকলো। ও জানলো না প্লেন ছাড়তে যে দুঘন্টা দেরি হয়েছিলো সেই সময়টুকু বাবা এয়ারপোর্টেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিলো, হঠাৎ যদি রবিনের কোনও কিছুর দরকার হয়, যদি কোন বিপদ হয়! এই প্রথম তিনি অনুভব করলেন, রবিন ছাড়া এ পৃথিবীতে তাঁর আর কেউ নেই।

রবিনের প্লেন টেক অফ করে আকাশে উড়লো। ওটা দৃষ্টিসীমার বাইরে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার পরও যতক্ষণ শব্দ শোনা গেলো তিনি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে রইলেন।

রবিনের বন্ধুরা চলে গেছে। একা তিনি নিজের ছোট গাড়িটায় উঠলেন। নির্জন এয়ারপোর্ট রোড ধরে শহরে আসার সময় রোমে তাঁর পুরোনো বন্ধু নাফিসার কথা ভাবলেন। জাতিসংঘের এক দফতরের বড় ধরনের আমলা। বলেছে, এয়ারপোর্টে নিজে এসে রবিনকে নিয়ে যাবে। রোমে ওর কোনও অসুবিধে হবে না।

প্লেনের ভেতর রবিনের বসার জায়গা ছিলো সামনের দিকে, তবে জানালার ধারে আসন পায় নি। ওর বাঁ দিকে দুজন যাত্রী, তারপর জানালা। পাশে বসেছেন এক বুড়ো ইউরোপিয়ান। কিছুক্ষণ পর পরই উঠে–এক্সকিউজ মি, বলে পেছনে যাচ্ছিলেন। বুড়োদের অনেকে অবশ্য ঘন ঘন বাথরুমে যায়, কিন্তু সামনের বাথরুম কাছে থাকতে ইনি কেন পেছনের বাথরুমে যাচ্ছেন রবিন বুঝতে পারলো না। একবার বলেই ফেললো, আপনার অসুবিধে হলে আমার জায়গায় বসতে পারেন। বুড়ো রাজী হলেন না–না বাছা, এ সিটটা আমি বেছে নিয়েছি। এখানেই আমি আরামে থাকবো।এই বলে বুড়ো রবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন–তোতামাকে দেখে মনে হচ্ছে ধূমপানের অভ্যাস নেই। থাকলে তুমিও আমার সঙ্গী হতে।

রবিনদের আসন ছিলো ধূমপানমুক্ত এলাকায়। বুড়ো ধূমপান করেন অথচ এখানে বসেছেন দেখে ও অবাক হলো। বললো, আপনি যখন ধূমপান করেন, তখন পেছনে বসলেই তো পারতেন?

বুড়ো একগাল হাসলেন–ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করুন। পেছনে গিয়ে তো দেখো নি! ধূমপায়ীদের ধোঁয়ায় পেছনটা নরক হয়ে আছে। চোখ পিট পিট করে ওর দিকে তাকিয়ে তিনি ধূর্ত গলায় বললেন, শোন, তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই। যদি কখনো সিগারেট ধরো, প্লেনে উঠে ভুলেও স্মোকিং সিট-এ বসবে না। নন-স্মোকিং সিটে বসে আরামে যাবে পলিউশন মুক্ত হয়ে। সিগারেট টানতে ইচ্ছে করলে স্মোকিং যোন-এ গিয়ে টেনে আসবে, যেমনটি আমি করছি। হা, হা, হা। বুড়োর ভাবখানা দেখে মনে হলো মহামূল্যবান একখানা গোপন কথা ওর কাছে ফাঁস করলেন।

বুড়োর হাসিটুকু শিশুর মত সরল। চোখ দুটো নিষ্পাপ, কৌতুকে ভরা। কথার ধরন দেখে বুড়োকে ভালো লেগে গেলো রবিনের। হেসে বললো, তাই বলুন। আমি ভাবছিলাম সামনে এত কাছে বাথরুম থাকতে আপনি বার বার পেছনের বাথরুমে কেন যাচ্ছেন।

তুমি বুঝি তাই ভেবেছিলে? হা, হা, হা। না বাছা, আমার সুগার ঠিকই আছে। ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়ার দরকার হয় না।

বুড়োর হাসির শব্দে তাঁর পাশের মাঝবয়সী আরবটার ঘুম ভেঙে গেলো। ভুরু কুঁচকে বুড়োর দিকে তাকালো। সেদিকে বুড়োর কোন খেয়ালই নেই। রবিনকে বললেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? রোমে?

রোম থেকে সোফিয়া যাবো বেড়াতে।

সোফিয়া যাবে? একটু অবাক হয়ে বুড়ো বললেন, এ রুটে ভাড়া বেশি পড়ে নি? ইস্ট ইউরোপের প্যাসেঞ্জাররা তো ওদিক থেকে এ্যারোফ্লোটে আসে, ভায়া মস্কো। টিকেট অনেক সস্তা।

আমারটা কমপ্লিমেন্টারি টিকেট। তাছাড়া রোমেও দুদিন বেড়াবো। আপনি কোথায় যাচ্ছেন? পাল্টা প্রশ্ন করলো রবিন।

আমি–মানে আমিও রোমে যাবো।

আপনি কি ইটালিয়ান?

না না। আমাকে দেখে কি ফুটবল পাগল ইটালিয়ান মনে হয়? আমার নাম বরিস। লণ্ডনে থাকি। অক্সফোর্ডে এ্যানথ্রপলজি পড়াই। তুমি নিশ্চয়ই ভারতীয়?

আমাদের পূর্বপুরুষরা এক কালে ছিলেন। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। এই বলে রবিন নিজের পরিচয় দিলো। বাংলাদেশের নামটা বরিসের অচেনা নয়। আহ বাংলাদেশ! আমি একবার গিয়েছিলাম। খুব সুন্দর দেশ। তবে অনেক গরিব মানুষ দেখেছিলাম।

নিজেদের দেশের বাইরে কেউ বাংলাদেশ সম্পর্কে খারাপ কথা বললে রবিনের রাগ হয়। বললো, কতগুলো পাজি বদমাশ দেশটাকে শাসন করতে গিয়ে লুটেপুটে খাচ্ছে বলে আমরা গরিব। তাই বলে আমরা চিরকাল গরিব ছিলাম না। আপনি নিশ্চয় জানেন দুশ বছর ধরে আপনার পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশ আর ইণ্ডিয়াকে কিভাবে শোষণ করেছিলো? কথাটা বলে ওর মনে হলো একটু বেশি বলা হয়ে গেছে।

ওর কথা শুনে প্রফেসরের মুখে হাসি মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি লণ্ডনে থাকি বটে, তাই বলে জন্মসূত্রে আমি বৃটিশ নই। একটু থেমে বুড়ো বললেন, সোফিয়ায় কি কারো আমন্ত্রণে যাচ্ছো?

রবিন বললো, আমার কাকা সোফিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। তাঁর কাছেই বেড়াতে যাচ্ছি।

কথাটা শুনে প্রফেসরের কপালে সামান্য ভাজ পড়লো। সেটা রবিনের চোখেও পড়লো। আর কোন কথা না বলে বুড়ো প্রফেসর কম্বলটা গায়ে টেনে চোখ বুজলেন।

শেষ রাতে প্লেন আলো ঝলমলে দুবাই এয়ারপোর্টে থামলো। ঘন্টা দেড়েক থামবে এখানে। সবাই হুড়মুড় করে নামলো এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে জিনিস কেনার জন্য। এখানে সব কিছু নাকি দারুণ সস্তা। রবিনের হঠাৎ খেয়াল হলো, বাবা মেজকাকা, চাচী আর নীল রীনের জন্য জিনিসপত্র কিনে দিয়েছেন বটে, নাফিসা আন্টির জন্য কিছু কেনেন নি। তবে ওকে হাত খরচের জন্য তিনশ ডলার দিয়েছিলেন। রবিন ডিউটি ফ্রি শপে অনেকক্ষণ ঘুরে চমৎকার গিফট বক্সে ভরা একটা পারফিউম কিনলো, ষাট ডলার দিয়ে। ভাবলো বাবা নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিলেন, শুনলে খুশিই হবেন।

রোমের লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে রবিনদের প্লেন যখন নামলো তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বিরাট এয়ারপোর্ট। রবিন ভেতরে ঢুকে দেখলো অনেকগুলো কনভেয়ার বেল্ট। কত নম্বরে ওর লাগেজ আসবে একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে ছুটলো সেদিকে। অনেকক্ষণ লাগলো ওর স্যামসনাইট সুটকেসটা খুঁজে বের করতে। ট্রলিতে করে গেটের দিকে যেতে যেতে ভয় হলো, যদি নাফিসা আন্টি কোন কারণে এয়ারপোর্ট না আসতে পারেন তাহলে বিপদেই পড়বে। বাবা ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়েছেন ঠিকই, তবে এও বলে দিয়েছেন–রোমে অনেক চোর, বাটপার আছে। বাগে পেলে টাকা পয়সা জিনিসপত্র সব নিয়ে নেবে।

আস্তে আস্তে ট্রলি ঠেলে এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে সামনে এগোচ্ছিলো রবিন। হঠাৎ চোখে পড়লো সাগর নীল জর্জেটের শাড়ি পরনে শ্যামলা রঙের হালকা পাতলা গড়নের একজন স্মার্ট ভদ্রমহিলা ওর দিকে এগিয়ে আসছেন। হাঁটার ভঙ্গিটা রাজকীয় এবং চেহারাও চোখে পড়ার মত। কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিস্কার বাংলায় বললেন, তুমি নিশ্চয় রবিন?

হেসে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ওঁর সঙ্গে হাত মেলালো রবিন। বললো, আরো তো অনেক বাঙালি ছিলো, চিনলেন কিভাবে?

অপূর্ব এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে নাফিসা বললেন, ছিলো, তবে তুমি ছাড়া আর কেউ তোমার বাবার মত দেখতে নয়। পথে কোনও অসুবিধে হয় নি তো?

না আন্টি। দুবাই ছাড়ার পর লম্বা এক ঘুম দিয়েছি। আপনি কখন এসেছেন?

ঘন্টা খানেক হবে। তোমার ফ্লাইট আসতে পঁয়ত্রিশ মিনিট দেরি করেছে। চলো, বেরুনো যাক।

রবিনকে নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে নাফিসা বললেন, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।

রোমের আবহাওয়া ঢাকার মতই মনে হলো। বিকেলের নরম সোনালী রোদে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সব ঝকঝক করছে। নাফিসার ধবধবে সাদা বিএমডব্লিউ গাড়িটা প্রায় নিঃশব্দে এসে রবিনের পাশে দাঁড়ালো। সুটকেসটা আর হাতব্যাগটা পেছনের সিটে রেখে ও সামনে বসলো। ঘন্টায় ষাট মাইল বেগে তিনি গাড়ি চালালেন শহরের দিকে। রবিন জানতে চাইলো, এয়ারপোর্ট থেকে আপনার বাড়ি কতদূরে?

মাইল ছয়েক হবে। সামনের দিকে চোখ রেখে নাফিসা বললেন, আমার এ্যাপার্টমেন্টটা শহর আর এয়ারপোর্টের মাঝামাঝি জায়গায়।

ভিয়া লরেনটিনায় তার চমৎকার সাজানো তিন রুমের এ্যাপার্টমেন্ট দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো রবিন। বড় ড্রইং কাম ডাইনিংরুম, একটা বড় বেডরুম আর গেস্টরুম। কিচেন আলাদা বাথরুম দুটো। ড্রইং রুমের পাশে আর বেডরুমের পাশে বড় বারান্দা রয়েছে। এ্যাপার্টমেন্টটা পনেরো তলার ওপর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রবিন রোমের আকাশসীমা দেখলো। এদিকটায় বাড়িঘর বেশ ফাঁকা। নাফিসা বললেন, এ জায়গাটা নতুন শহরের এক মাথায়। পুরোনো শহরে গেলে দেখবে ঢাকার শাঁখারি বাজারের মতো রাস্তাও আছে।

বারান্দার চারপাশে অনেকগুলো ফুলগাছের টব। থোকা থোকা লাল, সাদা, জেরানিয়াম আর বেগোনিয়া ফুটে সারা বারান্দা আলো হয়ে আছে। রবিন বললো, জেরানিয়াম সাদা হয়–আমি জানতাম না।

তোমার বাগানের সখ আছে বুঝি? মৃদু হেসে নাফিসা বললেন, তোমার বাবাও বাগান ভালোবাসেন।

মোটাসোটা মাঝবয়সী একজন ইটালিয়ান মহিলা এসে রবিন আর নাফিসাকে দুকাপ চা দিয়ে গেলেন। বারান্দায় রাখা চামড়ার গদি মোড়া চেয়ারে বসে রবিন বললো, বাবাকে আপনি কত দিন ধরে চেনেন?

নাফিসা রবিনের মুখের দিকে তাকালেন। দেখলেন নিষ্পাপ কৌতূহল ছাড়া ওর চোখে আর কিছুই নেই। মৃদু গলায় বললেন, তোমার বাবা যখন ইউনির্ভাসিটিতে পড়তেন তখন থেকে, আমি তার দু বছরের জুনিয়র ছিলাম।

রবিন অবাক হয়ে বললো, আপনাকে দেখে মনে হয় আপনার বয়স চল্লিশেরও কম। বেশি হলে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ।

কোন কথা না বলে নাফিসা নিঃশব্দে হাসলেন। রবিন আবার বললো, আপনারা খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।

ঘাড় সামান্য কাত করে নাফিসা বললেন, তুমি কিভাবে জানো?

বাবা বলেছেন। জবাব দিলো রবিন–বাবার এ্যালবামে আপনার ছবি আছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নাফিসা বললেন, তোমার মা যখন মারা যান আমি তখন প্যারিসে ছিলাম। শেষবার ঢাকা গেলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরে। তোমাকে দু তিন বছরের বাচ্চা দেখেছিলাম। তোমার অযত্ন হতে পারে বলে তোমার বাবা আর বিয়ে করলেন না।

নাফিসা আন্টিকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিলো রবিনের। বাবার জন্য তার মমতা দেখে আরো ভালো লাগলো। বাবা তার অনেক কথাই রবিনকে বলেছেন। শুধু বলেন নি তিনি এখনো কেন বিয়ে করেন নি। একবার ভাবলো জিজ্ঞেস করে পরে মনে হলো এতটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা ওর উচিৎ হবে না।

রবিনকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে নাফিসা নরম গলায় জানতে চাইলেন, চুপ করে আছো কেন? বাবার কথা ভাবছো?

রবিন মৃদু হেসে বললো, বাবার কথাও ভাবছি, আপনার কথাও ভাবছি।

আমার কথা ভাববার কী আছে?

এরকম একা থাকতে আপনার খারাপ লাগে না? লোনলি ফিল করেন না?

সময় কোথায় ওসব ফিল করার! অফিস থেকে ফিরতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। কখনো পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে যাই, কখনো ওরা আসে। সময় পেলে বই পড়ি, ছবি দেখি। ওসব কথা থাক। চলো পুরোনো শহর থেকে তোমাকে ঘুরিয়ে আনি। নাকি বিশ্রাম নেবে কিছুক্ষণ?

প্লেনে যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে। আপনার খারাপ না লাগলে আমি বরং খুশিই হবো।

তোমার সঙ্গে ঘুরতে আমারও ভালো লাগবে। খুব আস্তে কথাটা বললেন নাফিসা।

রবিন উঠে দাঁড়ালো–আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর তৈরি হচ্ছি। এই বলে ওর ঘরে গেলো। চমৎকার সাজানো গেষ্টরুমে ওর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলে ড্রইংরুমে এসে দেখলো নাফিসাও শাড়ি পাল্টেছেন। সাদা মুগাসুতোর কাজ করা একটা সাদা জর্জেটে তাঁকে দারুণ সুন্দর লাগছিলো। রবিনের চোখে মুগ্ধতা দেখে নাফিসা হাসলেন। বললেন, নীল জ্যাকেটটা তোমাকে খুব মানিয়েছে।

আপনাকে পরির মতো লাগছে আন্টি। হাসি চেপে নাফিসা বললেন, তুমি পরি দেখে নি। পরিরা আমার মতো কলো হয় না।

কে বললো আপনি কালো?

ঠিক আছে বাবা, এগুলো তর্কের বিষয় হতে পারে না। চলো বেরোই। রবিনকে থামিয়ে দিয়ে নাফিসা কাজের মহিলাকে ইটালিয়ান ভাষায় কী যেন বললেন। তারপর রবিনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দুহাজার বছরের পুরোনো রোমের দিকে।

গাড়িতে যেতে যেতে যতগুলো পুরোনো নিদর্শন দেখা যাচ্ছিলো রবিনকে বুঝিয়ে বলছিলেন নাফিসা অভিজ্ঞ গাইডের মত। বইয়ের আর ভিউকার্ডের ছবিতে অনেক দেখা কলোসিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রোমাঞ্চিত হলো রবিন। নাফিসা বললেন, কাল দিনে এসে ভেতরে গিয়ে দেখো।

রাতের রোম দেখে ঘরে ফিরতে ওদের নটা বাজলো। নাফিসা বললেন, নিশ্চয় তোমার খুব খিদে পেয়েছে।

রবিন হেসে বললো, খুব নয়, আরেকটু পরে খাবো।

তাহলে একটা টমাটো জুস নাও। খিদে পাবে। এই বলে নাফিসা ফ্রিজ থেকে কাগজের প্যাকেট বের করে ওকে লম্বা গ্লাসে টকটকে লাল ঘন টমাটো জুস ঢেলে দিলেন। নিজে নিলেন ছোট গ্লাসে।

হঠাৎ মনে পড়াতে রবিন–এক্ষুনি আসছি, বলে ঘরে গেলো। হাত ব্যাগ থেকে দুবাই থেকে কেনা পারফিউমটা বের করে এনে নাফিসাকে দিলোএটা আপনার জন্য।

নাফিসা অবাক হয়ে পারফিউমটা নিলেন। দেখলেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আস্তে আস্তে বললেন, তোমার বাবা দিয়েছেন?

রবিনের মনে হলো বাবার কথা বললে নাফিসা আন্টি বেশি খুশি হবেন। বললো, হ্যাঁ, বাবা দিয়েছেন।

ওঁর ঠোঁটের ফাঁকে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বললেন, আমি খুব অবাক হয়েছি রবিন।

কেন, অবাক হওয়ার কি আছে?

তোমার বাবা এখনো মনে রেখেছেন আমি ওপিয়াম ভালোবাসি।

রবিন পারফিউম ব্যবহার করে না। ওটার নাম যে ওপিয়াম আগে খেয়াল করে নি। দেখতে ভালো লেগেছিলো আর দাম দেখে মনে হয়েছিলো জিনিষটা খারাপ হবে না, তাই কিনেছিলো। ওর ভাবতে ভালো লাগলো পারফিউমটা নাফিসা আন্টির ভালো লেগেছে।

টেবিলে খাবার সাজিয়ে নাফিসা ওকে ডাকলেন। ইটালিয়ান মহিলাটি রান্না সেরে সাতটায় চলে যান। রবিন অবাক হয়ে দেখলো টেবিলে সব দেশী খাবার ভাত, ডাল, নিরামিষ, রুই মাছ রান্না আর মুরগি। বললো, আমি তো ভেবেছিলাম ইটালিয়ান খাবার খাবো।

একটু অপ্রস্তুত হয়ে নাফিসা বললেন, কাল করতে বলবো। আমিও মাছ, ভাত সব সময় খাই না। মেহমান এলে করতে বলি। বাঙালিরা সব সময় বাইরে গিয়ে দেশী খাবার খোঁজে কিনা–

রবিন বললো, ইংরেজিতে প্রবাদই তো আছে রোমে গেলে রোমানদের মত হও।

নাফিসা হেসে বললেন, ঠিক আছে, কাল থেকে তোমাকে রোমান বানিয়ে দেবো।

খাওয়া সেরে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখলো রবিন। খবর হচ্ছিলো ইটালিয়ান ভাষায়। নাফিসা বাংলায় বলে দিচ্ছিলেন। বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া আর হাঙ্গেরিতে রাজনৈতিক বিক্ষোভ। পূর্ব জার্মানী থেকে দলে দলে মানুষ বর্ডার পেরিয়ে অস্ট্রিয়া হয়ে পশ্চিম জার্মানীতে যাচ্ছে। নাফিসা বললেন, বুলগেরিয়ায় বেড়ানোর জন্য তুমি ভালো সময়ই বেছে নিয়েছে। এই গণ্ডগোলের ভেতর না গিয়ে বরং ইটালীতে বেড়িয়ে যাও। তুমি চাইলে স্পেন থেকেও ঘুরিয়ে আনতে পারি।

রবিন একটু গম্ভীর হয়ে বললো, আমি এই গণ্ডগোলটা কাছে থেকে দেখতে চাই আন্টি। বুঝতে চাই কেন এসব হচ্ছে।

কেন হচ্ছে এরা তো বলছেই। শুনলে না, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মুক্ত জীবন–এসবের জন্য তারা একটা চেঞ্জ চাইছে।

এদের মুখ থেকে নয়–সুযোগ যখন পেয়েছি নিজে গিয়ে দেখবো।

নাফিসার মনে হলো, রবিনের চেহারা দেখে যে রকম ছেলেমানুষ মনে হয় আসলে ও তা নয়। ঠিক ওর বাবার মত। খবর শেষ হওয়ার পর হাতে রোমের গাইড বুক ধরিয়ে দিয়ে ওকে ঘুমোতে পাঠালেন তিনি। নিজে অন্ধকারে একা বারান্দায় বসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সেই দিনগুলোর কথা ভাবলেন। কি চমৎকার ভাবনাহীন আনন্দময় দিন ছিলো সে সব!

পরদিন সকালে রবিন একাই ঘুরতে বেরুলো। যদিও নাফিসা বার বার বলছিলেন, আমার অসুবিধে হবে না। টেলিফোনে অফিসে বলে দিচ্ছি আজ যাবো না। রবিন রাজী হয় নি। বলেছে, কোথাও গিয়ে একা ঘুরতে আমার ভালো লাগে আন্টি। কাল যে বইটা দিলেন ওতে রোমের গাইড ম্যাপ আছে, দেখার মত জায়গাগুলোতে কোত্থেকে কিভাবে যেতে হবে, কিভাবে দেখতে হবে সবই বলা আছে। আমি তো বাচ্চা ছেলে নই। নাফিসা খুশি হয়েছেন রবিনের আত্মবিশ্বাস দেখে। জোর করে ওর পকেটে পঞ্চাশ হাজার লিরা গুঁজে দিলেন। ওকে বুঝিয়ে দিলেন বাস আর পাতাল রেলের টিকেট কিভাবে কাটতে হয়। শুনে একটু অবাক হলো রবিন। বাসের টিকেট বাসে উঠে কেনা যায় না, স্টেশনারি দোকান থেকে কিনতে হয়।

রোমের ভেতর ভ্যাটিকান সিটি। পাতাল রেলে আধ ঘন্টার ভেতর সেখানে চলে গেলো রবিন। ভ্যাটিকান থেকেই শুরু করলো রোম দেখা। দুপুর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে চার্চের ভেতরের ছবি দেখলো, যার অনেকগুলো মাইকেলেঞ্জেলোর আঁকা। নাফিসা ওর ঝোলা ব্যাগে স্যাণ্ডউইচ, আপেল আর বড় এক বোতল মিনারেল ওয়াটার দিয়েছিলেন। ভ্যাটিকানের পাথর বাঁধানো সিঁড়ির ওপর বসে তাই খেলো। গাইড বুকে দেখে ওর আগ্রহ জন্মেছিলো পালাতিনো দেখার জন্য। আড়াই হাজার বছর আগে যেখানে রোমান সম্রাটরা থাকতেন। কলোসিয়ামের কাছেই। ঠিক করলো আজ পালাতিনো দেখবে, কাল দেখবে কলোসিয়াম।

একটা স্যাণ্ডউইচ শেষ করে আপেলে কামড় দিয়েছে এমন সময় ওর বয়সী, সোনালী চুল আর নীল চোখের চমৎকার এক মেয়ে পরনে বু জিনস-এর প্যান্ট আর জ্যাকেট, কাছে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, কলোসিয়াম কিভাবে যাবো বলতে পারো?

রবিন মৃদু হেসে বললো, আমি মাত্র কাল এসেছি রোমে। কিছুই চিনি না। তবে গাইডবুক দেখে বলতে পারি, বসো।

মেয়েটা আগ্রহ নিয়ে রবিনের পাশে বসে বললো, আমার নাম পলা, ফ্রান্সের লিতে থাকি। আমিও কাল এসেছি রোমে।

রবিন ওর পরিচয় দিয়ে বললো, আমি পালাতিনো যাবো। কলোসিয়ামের পরের স্টেশন। তুমি ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে যেতে পারো।

পলা হেসে বললো, আমি খুব খুশি হবো। মনে মনে একজন সঙ্গী খুঁজছিলাম। ভালোই হলো তোমাকে পেয়ে।

রবিন ব্যাগ থেকে একটা আপেল বের করে ওকে দিলো। পলা হেসে ধন্যবাদ জানালো। দেখেই মনে হয় ছাত্রী, হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। কাল রাতে নাফিসা ওকে বলছিলেন, এ সময় সারা ইউরোপ থেকে প্রচুর টুরিস্ট আসে, বেশির ভাগই কম বয়সী ছাত্র, নয়তো বুড়োবুড়ি। বুড়োদের অনেক টাকা পয়সা থাকলেও ছাত্ররা পার্কে কিম্বা স্টেশনে ঘুমোয়। অনেকে খাওয়ার পয়সা জোগাড়ের জন্য নানারকম কাজও করে।

পলাকে নিয়ে ও পাতাল রেলে চাপলো। ওর কাছে বাড়তি টিকেট ছিলো, পলাকে কাটতে দিলো না। টারমিনিতে রেল বদল করে কলোসিয়ামের রেলে চাপলো। দুপুরের দিকে কামরাগুলো একেবারে ফাঁকা থাকে। পলা বললো, তুমি কলোসিয়াম দেখেছো?

রবিন বললো, আগামীকাল দেখবো।

পলা একটু ইতস্তত করে বললো, আমি যদি আজ তোমার সঙ্গে পালাতিনো দেখে কাল কলোসিয়াম দেখি তোমার কি অসুবিধে হবে?

অসুবিধে কেন হবে! দুদিনের জন্য তোমার বন্ধু হতে ভালোই লাগবে।

বন্ধু যদি হবে, দুদিনের জন্য কেন? ফ্রান্সে বেড়াতে এসো। তোমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবো।

ধন্যবাদ, কখনো যদি যাওয়ার সুযোগ হয় তোমাকে জানাবো।

ওরা ঠিকানা বিনিময় করলো। পলা ওর বাড়ির কথা বললো। রবিন বললো ঢাকার কথা। আধঘন্টা পর ওরা যখন পালাতিনোর প্রবেশ পথের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো-মনে হলো দুজন অনেকদিনের পুরোনো বন্ধু।

পালাতিনো দেখতে টিকেট কাটতে হয়। টিকেটের দাম শুনে পলা ঘাবড়ে গেলো। পাঁচ হাজার লিরা! শুকনো হেসে বললো, রবিন, আমি বরং কলোসিয়াম দেখে তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করবো! তুমি তো বললে তোমার এখানে তিন ঘন্টা লাগবে।

রবিন মৃদু হেসে বললো, তুমি বলেছো আমার সঙ্গে কলোসিয়াম দেখবে। আজ তুমি আমার অতিথি। পালাতিনো আমি তোমাকে দেখাবো। গাইডের কাজও কিছুটা করতে পারব।

পলা রবিনের হাত চেপে ধরে কৃতজ্ঞ গলায় বললো, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে এত লিরা নেই যে, পাঁচ হাজার দিয়ে টিকেট কাটবো।

তুমি তো বলেছে ফ্রান্সে গেলে আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে।

নিশ্চয় রবিন। লিয়ঁতে তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে আমার অতিথি হয়ে।

টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলো ওরা। অনেকখানি জায়গা জুড়ে উঁচু নিচু পাহাড়ের মত। মাঝে মাঝে ভাঙা প্রাচীর, উঁচু থাম, ফটক–এইসব। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে সামনে তাকিয়ে রবিন বললো, ওই ফাঁকা জায়গাটা দেখেছো পলা? ওখানে চ্যারিয়ট রেস হতো, বেনহুর ছবিতে যেমন দেখিয়েছে। রোমান অভিজাতরা এখানে বসে চ্যারিয়ট রেস দেখতেন।

পলা বললো, তোমার দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আমি জুলিয়াস সিজারকে দেখছি।

আমি কেন সিজার হতে যাবোয় রবিন গম্ভীর হয়ে প্রতিবাদ করলো সিজারের মাথাভরা টাক। আমি মোটেই সিজার হতে রাজী নই।

রবিনের কথা বলার ধরণ দেখে পলা খিল খিল করে হাসলো। যেন জলতরঙ্গ বেজে উঠলো। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন দুই খুনখুনে বুড়ি। বিরক্ত হয়ে তাকালেন ওদের দিকে। পলা চাপা গলায় বললো, ক্লিওপেট্রা বেঁচে থাকলে এদের মতই দেখতে হতো।

রবিনও গলার স্বর নামিয়ে বললো, ভাগ্যিস আমি সিজার হতে চাই নি। যদি হতাম তাহলে তোমার কথা শোনার পর আমার হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেতো। তার চেয়ে–বলতে গিয়ে থেমে গেলো সে। ওদের ডান দিকে বেশ কিছু দূরে বিমানে ওর সহযাত্রী ছিলেন–সেই বুড়ো প্রফেসর বরিস। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে কি যেন দেখছেন। সঙ্গে আরেকজন বুড়ো।

রবিন বললো, চলো ওদিকে যাই। আমার পরিচিত এক এ্যানথ্রপলজির অধ্যাপকের সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই।

প্রফেসরের কাছে গিয়ে রবিন বললল, আপনি কেমন আছেন স্যার?

প্রফেসর চমকে ওঠে রবিনের দিকে তাকালেন। যথেষ্ট নার্ভাস মনে হলো তাকে। গম্ভীর গলায় বললেন, মাপ করবেন, আপনাকে আমি চিনি বলে মনে হচ্ছে না।

কাল রোমে আসার সময় প্লেনে আপনি আমার সহযাত্রী ছিলেন।

আমি দুঃখিত। আপনাকে আমি চিনি না। রূঢ় গলায় কথাটা বলে সঙ্গী বুড়োর হাত ধরে প্রফেসর নিচের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল বেশ তাড়া আছে ওর।

প্রফেসরের অদ্ভুত আচরণ ভীষণ রহস্যময় হনে হলো রবিনের।