এ ড্রামা ইন লিভোনিয়া
জুল ভের্ন অমনিবাস (অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)
১. সীমান্তরেখা
আস্ত কালো রাতটায় লোকটি ছিলো একা।
দীর্ঘ শীতকাল ধরে বরফের স্তূপগুলো জমেছে একের পর এক, আর তারই উপর দিয়ে সে দৌড়চ্ছে নেকড়ের মতো মরীয়া ও হন্যে। কনকনে হাওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে সে পরেছে ডবল-পুরু কাপড়ের পাঁৎলুন আর কাফতান আর কানঢাকা টুপি–কিন্তু ছুরির ফলার মতো হিম হাওয়া তবু মাঝে-মাঝে গায়ে বিঁধে যাচ্ছে। তার ঠোঁট আর হাত দুটি নীলবর্ণ হয়ে আছে, আঙুলের ডগাগুলোয় কোনো সাড় নেই। মিশকালো অন্ধকারের মধ্যে তবু সে সারাক্ষণ জোর করেই এগুচ্ছে; মাথার উপরে ঝুলে আছে ভারি নিচু মেঘ, হয়তো এক্ষুনি আবার শুরু হয়ে যাবে তুষারঝুরি। সময়টা এপ্রিলের গোড়ার দিক, কিন্তু জায়গাটা আটান্ন ডিগ্রিতে। কিছুতেই থামবে না–এটাই তার পণ, কারণ পরে হয়তো আর কখনো সে এক পা-ও এগুতে পারবে না।
রাত এগারোটা নাগাদ অবিশ্যি সে থামলো একবার। তার কারণ এই নয় যে তার পা দুটি তাকে আর বহন করতে পারছিলো না, কিংবা তার দম ফুরিয়ে এসেছিলো, অথবা অবসাদে সে প্রায় নেতিয়ে পড়েছিলো। তার বুকের জোর যতটা, শরীরেরও ততটাই। একবার কেবল সে চেঁচিয়ে বললে; শেষকালে সত্যিই সীমান্ত… লিভোনিয়ার সীমান্ত…আমার দেশের সীমান্তরেখা!
তার পায়ের কাছেই পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে আছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর-হাত বাড়িয়ে সে একবার অভিবাদন করে নিলে সেই বিশাল বরফ ঢাকা মাটিকে। তারপর শাদা তুষারঝরা মাটির উপর চাপ দিয়ে দিয়ে সে হাঁটতে লাগলো–যেন এখানে সে চিরকালের উদ্দেশে তার পায়ের ছাপ রেখে যেতে চায়।
অনেক দূর থেকে এসেছে সে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে। সাহসে ভর করে সে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে পথের বিপদের, তুচ্ছ করেছে সে সমস্ত ভয় আর আতঙ্ক, তার সহ্যশক্তি নাড়া খায়নি কিছুতেই। পুরো দু-মাস ধরে সে সূর্যাস্ত লক্ষ্য করে ছুটে আসছে, পেরিয়ে এসেছে অনন্ত স্তেপি, কশাকদের পাহারা এড়াবার জন্যে কতবার যে নানা কষ্টের মধ্যে দিয়ে ঘোরাপথে ছুটতে হয়েছে তাকে, উঁচু পাহাড়ের বন্ধুর ঘোরানো গিরিখাত পেরিয়েছে সে নিভীক ও একাগ্রভাবে, এমনকী রুশ সাম্রাজ্যের একেবারে মাঝখানেও যেতে সে পেছ-পা হয়নি, যদিও জানে যে সেখানে কড়া পাহারা আছে পুলিশের। একবার মুখোমুখি পড়লেই তার প্রাণ যেতো, কিন্তু অবশেষে দৈবের দয়াতেই সে পেরিয়ে এসেছে তাদের, আর তারপর এখন আবেগভরা গলায় শুধু বলে উঠেছে সীমান্ত…লিভোনিয়ার সীমান্ত।
অত বছর পরে, অবশেষে, সে কি তাহলে ফিরে আসছে আতিথ্যেভরা তার দেশের মাটিতে? আর তবে তার কিছু ভয় নেই? তার নিরাপত্তার কোনো বিঘ্ন নেই আর? বন্ধুরা অপেক্ষা করে আছে তার জন্য? স্নেহে দু-হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে নেবে বলে কি অপেক্ষা করে আছে আত্মীয়পরিজন? তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা কি রয়েছে এখানে? উৎকণ্ঠায় ভরে গিয়ে উগ্রীবভাবে প্রতীক্ষা করে আছে তারই ফিরে আসার জন্য? না কি আচমকা হাজির হয়ে পড়ে সব্বাইকে সে তাক লাগিয়ে দিতে চাচ্ছে? কাউকেই হয়তো সে জানায়নি যে সে এত শীগগির ফিরে আসবে?
না। এর কোনোটাই নয়। এটা কেবল তার আরো-দুরে পালাবার পথের রাস্তা। সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দরে গিয়ে পৌঁছুতে চাচ্ছে সে, যেখানে গিয়ে কারু মনে কোনো সন্দেহ না জাগিয়ে সে একটা জাহাজ ধরতে পারবে। লিভোনিয়ার উপকূল পিছনের দিগন্তে মিলিয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত তার শাস্তি নেই, তার নিরাপত্তা নেই।
সীমান্ত! দেখেই সে বলে উঠেছিলো। কিন্তু এ কী ধরনের সীমান্ত? কোনো চিহ্ন নেই, যা দেখে বোঝা যায়। নেই কোনো খুঁটি, জলের ধারা বা গিরিশ্রেণী; এমনকী কোনো জঙ্গলও নেই। তাহলে কি কেবল একট কল্পিত রেখা দিয়েই দেশ দুটি ভাগ করা? কোনো প্রাকৃতিক বিভাজক নেই দু-দেশের মধ্যে?
রুশ সাম্রাজ্য আর তিনটি বলটিক দেশের সীমান্ত এটা। বলটিক দেশ তিনটি হলো এস্তনিয়া, লিভোনিয়া ও কুরল্যাণ্ড। লেক পেইপুসকে উত্তরে দক্ষিণে ভাগ করে গেছে সীমান্ত-শীতকালে তার তল থাকে নিরেট, তুষারজমা; আর গ্রীষ্মকালে তরল, স্রোতোময় জলধারা গর্জায়।
+
বয়েস তার চৌত্রিশ, ঢ্যাঙ, শক্ত গড়ন, বুকের খাঁচা মস্ত, পেশিবহুল, পা ফেলার ভঙ্গিতে ব্যক্তিত্বের ছাপ। কানঢাকা টুপির তলায় ঘন সোনালি দাড়ি দেখা যাচ্ছে–হাওয়ায় যখন টুপির কানা মাঝে-মাঝে সরে যায়, দেখা যায় উজ্জ্বল দুটি জ্বলন্ত চক্ষু–সেই হিম ঝড়েও তাদের দীপ্তি একফোঁটাও কমেনি। চওড়া কোমরবন্ধের আড়ালে গোঁজা একটা ছোট্ট চামড়ার থলি,তাতেই তার যথাসর্বস্ব-কেবল কয়েকটা কাগজের নোট, কয়েকটাই মাত্র রুবল–দূরে কোথাও যাবার খরচ তাতে কিছুতেই কুলোবে না। আর যা জিনিশ আছে তার কাছে, তা হলো একটা ছ-ঘরা রিভলবার, চামড়ার খাপে মোড়া একটা ধারালো ছুরি, একটা থলিতে সামান্য-কিছু খাদ্য, একটা ফ্লাস্ক ভর্তি মদ, একটা শক্ত ছড়ি। খাবারের থলি, ফ্লাস্ক, টাকার থলি–এ-সব তার কাছে অস্ত্রগুলোর মতো তত দামি মনে হয় না। নেকড়েরা কিংবা পুলিশের লোক আক্রমণ করলে এগুলো সে ব্যবহার করবে বলে ঠিক করে আছে। সারাদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকে সে, কেবল রাতেই বেরোয় রাস্তায়: ফিল্যাণ্ড প্রণালী বা বলটিক সাগরের কোনো একটা বন্দরে গিয়ে পৌঁছুতে হবে তাকে, পৌঁছুতে হবে সকলের অগোচরে। কোনো পাসপোর্ট নেই তার, তবু এই বিপজ্জনক দীর্ঘ পথ এ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই পেরিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু তীরের কাছে পৌঁছলে কাজটা এত সহজ হবে বলে মনে হয় না–সেখানে পাহারা আরো কড়া, সেখানে সঙিন উঁচনো লোক দাঁড়িয়ে আছে তারই অপেক্ষায়।
এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে এই ফেরার মানুষটার কথা এতক্ষণে সর্বত্র রটে গিয়েছে–তার নামে হুলিয়া বেরিয়ে গেছে এতক্ষণে, কিন্তু রাজনৈতিক বন্দী না নিছক আইন ভাঙিয়ে হিশেবে তার নামে খোঁজ-খোঁজ রব পড়ে গেছে, তা সে জানে না। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই ঠিক যে পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এতদিন ধরে দৈব তার উপর ছিলো প্রসন্ন, কিন্তু এই লিভভানিয়ার সীমান্তে অদৃষ্ট যদি তাকে ছেড়ে যায়, তাহলে তার সব আশাই বন্দরের জলে ডুবে যাবে।
কিন্তু কে সে? কে এই ফেরারি?
গ্রীষ্মকালে লেক পেইপুসে মাঝে মাঝে ভিড় করে জেলেডিঙি আর মালের নৌকো। কিন্তু এই অক্ষরেখায় বসন্ত আসে দেরি করে–হ্রদটা এখন আর নৌচালনার যোগ্য নয়–এখন হ্রদের উপর দিয়ে সদলবলে সাঁজোয়া গাড়িশুক্কু অনায়াসেই এক গোলন্দাজবাহিনী পেরিয়ে যেতে পারে, কারণ দীর্ঘ শীতকালের ঠাণ্ডায় সব জল জমে নিরেট বরফ হয়ে গেছে। কোনো মস্ত সমতলের মতো ধবল-কঠিন পড়ে আছে আস্ত হ্রদটা–আর বরফের চাঙড়গুলো পড়ে আছে । জড়াজড়ি করে, স্তূপের মতো।
ফেরারি চলেছে এই ভীষণ তুষারবনের মধ্য দিয়েই। কোনো অসুবিধেই হচ্ছে না তার, নিশ্চিন্ত ও নিশ্চিত পায়ের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এই তল্লাটটা বুঝি তার চেনা : সকাল হবার আগেই সে হ্রদের পশ্চিম তীরে পৌঁছে যাবে।
এখন রাত দুটো বাজে, মনে-মনে সে হিশেব করছিলো, আরো কয়েক মাইল গেলেই ওখানে কোথাও নিশ্চয়ই জেলেদের ফাঁকা কুঁড়েবাড়ি পাওয়া যাবে–বাকি রাতটুকু সেখানে কাটিয়ে দেয়া যাবে। এর পর থেকে আমাকে আর হুড়মুড় দুদ্দাড় করে যেতে হবে না।
সব অবসাদ সে গা থেকে ঝেড়ে ফেললল। এতক্ষণে তার আস্থাও ফিরে এসেছে। পুলিশ আর তার হদিশ জানে না সম্ভবত। যদি বা দুর্ভাগ্যবশত আবার তারা তার সন্ধান পেয়ে যায়, তাহলে কী করে তাদের চোখে ধুলো দিতে হবে, তা সে জানে।
হ্রদটা পেরুবার আগেই সকাল হয়ে যাবে কিনা, এটাই তার ভয় এখন। সেইজন্যই সে যেন একটা শেষ চেষ্টা করলে। ফ্লাস্ক খুলে ঢকঢক করে মদ ঢেলে দিলে গলায়, বেশ চাঙ্গা লাগলো; মুহূর্তও না-থেমে আরো তাড়াতাড়ি করে সে ছুটতে লাগলো।
অবশেষে চারটে নাগাদ দিগন্তে দেখা গেলো এলোমেলো কতগুলো বেঁটেখাটো গাছ-তুষার পড়ে ডালগুলো শাদা হয়ে আছে।
লেক পেইপুসকে দু-ভাগ করে গেছে লিভোনিয়ার সীমান্ত, কিন্তু কাস্টমসের ঘাঁটিগুলো বসানো সীমান্ত থেকে একটু দূরে। হ্রদের পশ্চিম তীরে গ্রীষ্মকালে যেখানে নৌকোগুলো ঘাটে লাগে, ঘাঁটিগুলো সেখানেই বসানো।
তা সে জানে বলে দূরে কুয়াশা চিরে একটা হলদে আলো জেগে উঠতেই সে মোটেই অবাক হলো না। কেবল একটা মস্ত বরফের স্তূপের আড়ালে থেমে পড়ে সে বোঝবার চেষ্টা করলে আলোটা নড়ছে কি না।
আলোটা যদি নড়েচড়ে বেড়ায়, তাহলে নিশ্চয়ই মশালের আলো হয়তো কাস্টমসের লোকেরা মশাল হাতে রোঁদে বেরিয়েছে। এবং পারতপক্ষে তাদের ধারে-কাছে না-ঘেঁষাই ভালো। স্থির আলো হলে বোঝা যাবে যে কাস্টমসের কোনো ঘাঁটিতে জ্বলছে। কারণ জেলেদের কুঁড়েবাড়িগুলো এখনও ফাঁকাই আছে; এপ্রিলের মাঝামাঝি বরফ গলে গেলেই তারা ফিরে আসবে। কাজেই ওই আলোর কাছে না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে-হয় একটু এ-পাশে সরে যেতে হবে তাকে, নয়তো অন্য পাশ দিয়ে।
বাঁ দিকটাই সে বেছে নিলে। ভোররাতের হাওয়ায় কুয়াশা একটু-একটু করে পাতলা হয়ে যাচ্ছে, আর তারই আড়াল থেকে এ-পাশে দেখা যাচ্ছে গাছপালার ঘন সারি–ডানদিকে অতটা ঘনভাবে গাছপালা গজায়নি। যদি কেউ তার পিছু নেয়, তাহলে চট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে পারবে সে–এমনকী গাছপালার আড়াল দিয়ে পালিয়ে যাওয়াও হয়তো তেমন কঠিন হবে না।
পঞ্চাশ পা গেছে কি না-গেছে, হঠাৎ ডানদিক দিয়ে আওয়াজ উঠলো গম্ভীর ও ভারিক্কি : হুকুমদার!
উচ্চারণের ভঙ্গিটা টিউটনিক, ঠিক যেন আলেমান ত্বের ডা! শোনালো কথাটা, আর তার কানে এই হুকুমদার কথাটা মোটেই মোলায়েম বা মধুর ঠেকলো না। অথচ বালটিক দেশগুলোয় আলেমান কথাই বলে লোকে–ঠিক চাষীরা হয়তো বলে না, কিন্তু শহুরেদের মুখে আলেমান খুব চলে।
সে–ফেরারি–এ কথার কোনো সাড়াই দিলে না। সোজা মুখ থুবড়ে সটান পড়ে গেলো সে বরফের উপর লম্বালম্বি। ভাগ্যিশ সে শুয়ে পড়ছিলো, কারণ তক্ষুনি গুডুম করে আওয়াজ হলো বন্দুকের–আরেকটু হলেই গুলিটা ঠিক তার বুকে গিয়ে লাগতো। কাস্টমসের লোকেরা রোদে বেরুলে পালাতে পারবে কি সে? নিশ্চয়ই তারা তাকে দেখে ফেলেছে, কোনো সন্দেহই নেই তাতে…ঐ হুকুমদার! আর গুলির শব্দই তার প্রমাণ…কিন্তু এই কুয়াশা আর ছায়ার মধ্যে হয়তো তারা এখুনি ভাবতে শুরু করেছে যে সমস্তটাই তাদের চোখের ভুল…
অনুমানটায় বোধকরি ভুল হয়নি। ধাবমান লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে এটাই তার মনে হলো।
লেক পেইপুসের কাস্টমসের ঘাঁটির লোক তারা। বেচারিরা! সবজে রঙের উর্দি নোংরা হয়ে-হয়ে হলদে হয়ে গেছে তাদের; বখশিশের বা উৎকোচের জন্য সারাক্ষণ তারা হাত বাড়িয়েই আছে–এত কম বেতন পায়! সংখ্যায় তারা দুজন, টহল দিয়ে ঘাঁটিতে ফিরে যাচ্ছিলো, এমন সময় মনে হলো বরফের চাঙড়গুলোর মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি নড়ে বেড়াচ্ছে।
ঠিক দেখেছো তো? না কি চোখের ভুল? জিগেশ করলে একজনে।
ঠিকই দেখেছি,অন্যজন বললে, নিশ্চয়ই কোনো স্মাগলার–চোখে ধুলো দিয়ে লিভভানিয়ায় ঢুকে পড়তে চাচ্ছিলো!
এবারকার শীতে ও-ই প্রথম স্মাগলার নয়–এবং শেষজনও নয়–হয়তো এখনও লোকটা প্রাণপণে ছুটছে-না-হলে তার কোনো হদিশই পেলুম না কেন!
তা আর কী করবে? যে গুলি ছুঁড়েছিলো, সে বললে, এই কুয়াশায় ঠিকমতো তাগ করা যায় নাকি! ইশ! ভারি আপশোশ হচ্ছে, লোকটাকে পেড়ে ফেলতে পারলে দিব্যি হতো…স্মাগলারদের ফ্লাস্ক সবসময়েই ভর্তি থাকে…এই ঠাণ্ডায় দিব্যি দুজনে মিলে ফ্লাস্কটা ভাগাভাগি করে নিতে পারতুম!
এখন তো জঠরের মধ্যেটা গরম করে নেবার কোনো সুযোগই নেই, ভাগ্যের বিরুদ্ধে নালিশ করলে অন্যজনে।
খোঁজাখুঁজি ছাড়লে তারা। বিশেষ করে দু-এক টোক স্নাপ বা ভোদকা মিলতে পারে, এই লোভেই তারা তল্লাশি চালিয়ে গেলোস্মাগলারটি সম্বন্ধে কোনো মাথাব্যথাই নেই তাদের। কিন্তু খোঁজাখুঁজিই সার হলো–কোথাও কারু কোনো হদিশ নেই।
কাস্টমসের পাহারাওলারা দূরে সরে গেছে বলে যেই মনে হলো, অমনি ফেরারি বরফের উপর থেকে উঠে দাঁড়ালে। সকালের আগেই একটা পরিত্যক্ত ও ফাঁকা পোড়ো বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলে সে-কুঁড়েবাড়িটা কাস্টমসের ঘাঁটি থেকে অন্তত দু-মাইল দক্ষিণে হবে।
অন্য সময় হলে সে নিশ্চয়ই খুব সাবধানে সারাদিন ধরে নজর রাখতে সন্দেহজনক কেউ এসে এখানে হাজির হয় কিনা-যাতে কাস্টমসের লোকেরা তল্লাশিতে বেরুলে, কুঁড়েবাড়ির কাছে হাজির হলে চটপট চম্পট দেয়া যায়। কিন্তু অবসাদে তার সর্বাঙ্গ যেন ভেঙে পড়ছিলো; সহ্যশক্তি তার যতই বিপুল হোক না কেন, এখন আর সে কিছুতেই ঘুমকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে না। এক কোনায় লম্বালম্বি শুয়ে পড়লো সে কাফতান মুড়ি দিয়ে; সেই গভীর ঘুম যখন তার ভাঙলো, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বেলা বাজে তিনটে। ভাগ্যিশ কাস্টমসের লোকেরা আর ঘাঁটি ছেড়ে বেরোয়নি–রাত্তিরে একটা গুলি চালিয়েই তারা বেশ সহজেই জেনে নিয়েছে যে পুরোটাই ছিলো কুয়াশার মধ্যে চোখের ভুল। দেশের মাটিতে পা দেবা মাত্রই প্রথম বিপদ–কিন্তু সেটাকে কাটাতে পেরেছে বলে সে নিজেকেই অভিনন্দন দিয়ে ফেললে।
ঘুমিয়ে উঠে বেশ ঝরঝরে আর চাঙ্গা লাগছে। এখন একটু খাবার-দাবার চাই। তার থলিতে খাদ্য যা অবশিষ্ট আছে, তাতে দু-একবার মাত্র চলবে কিন্তু পরবর্তী কোথাও আশ্রয় নেবার আগেই তাকে কিছু খাবার জোগাড় করে নিতে হবে। চাই ফ্লাস্ক ভর্তি করে স্নাপ–কারণ শেষ ফোঁটা অবধি সে কাল রাত্তিরে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিয়েছিলো।
অন্তত চাষীরা আমাকে কখনো ফেরায়নি, নিজেকে সে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করলে, আর লিভোনিয়ার চাষীরা কি তাদের মতোই কোনো স্লাভকে বিমুখ করবে? নিশ্চয়ই না।
ঠিকই ধরেছিলো সে। যদি কোনো আলেমান চাষীর পাল্লায় না-পড়ে, তাহলে তার আর কোনো চিন্তা নেই, স্লাভরা তাকে কিছুতেই ফেরাবে না। তবে আলেমান চাষীর সংখ্যাও এ তল্লাটে নেহাৎ কম নেই। কোনো রুশকে তারা নিশ্চয়ই স্বাগতম জানাবে না।
তবে সে তো আর দান চাইবে না–এখনো তার কাছে কয়েক রুবল অবশিষ্ট আছে। ঐ রুবলগুলো দিয়েই শেষ পর্যন্ত চলে যেতে পারবে সে–অন্তত লিভোনিয়া পর্যন্ত তো যেতে পারবে। এটা ঠিক যে কোনো-একটা জাহাজে গিয়ে উঠতে হবে তাকে। কিন্তু জাহাজে চড়বে সে কী করে?…সে কথা না হয় পরেই ভাবা যাবে। সবচেয়ে জরুরি এবং প্রাথমিক কাজ হলো কিছুতেই ধরা না-পড়া ও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে উপকূলের কোনো-একটা বন্দরে গিয়ে পৌঁছনো। এই দিকে লক্ষ্য রেখেই এখন তাকে সব চেষ্টা করতে হবে।
সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ যখন বেশ অন্ধকার হয়েছে বলে মনে হলো, তখন সেই ফেরারি প্রথমে তার রিভলবারটায় গুলি ভরা আছে কি না দেখে নিয়ে বেরিয়ে– পড়লো। সারাদিন ধরে বাতাস বয়েছে দক্ষিণমুখো, তাপমাত্রা ছিলো প্রায় বরফ-জমানো, হিমাঙ্কর একটু উপরে; বরফের মধ্যে ছোটো-ছোটো কালো ফুটকিগুলো দেখে বোঝা গেলো যে তুষার গলা শুরু হলো বলো।
ভূদৃশ্য কিন্তু একটুও পালটায়নি; এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর কোনো পথিকের কাছেই বাধার সৃষ্টি করবে না–যদি-না বরফ গলে গিয়ে পা রাখাই বিষম বিপজ্জনক হয়ে ওঠে–আর কেবল সেই ভয়টাই এখন প্রবল হয়ে উঠেছে। কাজেই বন্দরে গিয়ে পৌঁছনোই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ এখন; বরফ যদি হঠাৎ অসময়েই গলে যায় তাহলে একদিক থেকে ভালোই-নৌ-চলাচল সম্ভব হবে তাহলে।
হ্রদ আর এক্স শহরের মধ্যে দূরত্ব হবে প্রায় আট মাইল। সকাল ছটা নাগাদ ফেরারি গিয়ে এক্স-এ পৌঁছুলো । কিন্তু তখনো সে একটুও অসাবধান হয়নি। শহরে ঢোকবার চেষ্টা সে তখন করলেই না। ঢুকতে গেলেই পুলিশ তার কাছে কাগজপত্তর দেখতে চাইবে–আর মস্ত ঝামেলা শুরু হবে। শহর থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে একটা ফাঁকা কুঁড়েবাড়িতেই সে সারাদিন কাটিয়ে দিলে।
সন্ধে ছটা নাগাদ সে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ধরে চলতে শুরু করে দিলে; প্রায় সাত মাইল হেঁটে আসার পর পৌঁছলো এমবাখ নদীর তীরে–হ্রদের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে হ্রদের সঙ্গে মিশেছে নদীটা। এখানে এসে হ্রদের তীরে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা তার নিরাপদ মনে হলো না–বরং হ্রদের উপর দিয়ে এগুনোই ভালো, বিশেষত হ্রদের জল যখন এখনো জমাট বেঁধে নিরেট ও কঠিন হয়ে আছে।
বৃষ্টি পড়েছিলো মুষলধারে, আর তাতেই বরফ গলার সাহায্য হচ্ছিলো–চারপাশেই বরফ গলার সব লক্ষণ বিদ্যমান। শিগগিরই হয়তো বরফের মধ্যে দেখা দেবে একের পর এক ফাটল আর জলের ধারা।
সকালের আগেই হ্রদের শেষ মাথায় গিয়ে পৌঁছনো চাই–ফেরারি দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। যেতে হবে তাকে পনেরো মাইল–কোনো ক্লান্ত। লোকের পক্ষে সেটা আরো অবসাদজনক–তার উপর এই টানা রাস্তাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো। কাল যে দশ ঘন্টা সময় সে বিশ্রাম নেবে, সেটা সে সত্যিই অর্জন করবে, বলা যায়।
কপাল মন্দ, না-হলে কি বৃষ্টিবাদল শুরু হয়ে যায় হঠাৎ! শুকনো ঠাণ্ডা হলে আরো তাড়াতাড়ি যেতে পারতো সে। এটা ঠিক যে মাটির চেয়ে নিরেট বরফের উপরেই পা ফেলতে পারবে সে অনায়াসে, মাটির উপরে নিশ্চয়ই বরফ-গলা জলে কাদা হয়ে গেছে, আর পা পিছলে যাবারও সম্ভাবনা। কিন্তু চড়চড় করে শব্দ হচ্ছে বরফের উপর, বোঝা যাচ্ছে যে বরফ ফাটতে শুরু করেছে, এর পরেই জলের উপর আলাদা-আলাদা অসংলগ্ন বরফের চাঙড় ভাসতে থাকবে। তাতে আবার আরেক মুশকিল দেখা দেবে-নদী পেরুতে হবে তাকে, কোনো উপায় বার করতে না-পারলে হয়তো সাঁৎরে পেরুতে হবে ঐ ঠাণ্ডা জল। আর তাতে সব জায়গাতেই তার অনেকক্ষণ করে দেরি হয়ে যাবে।
ব্যাপারটা বোঝামাত্র লোকটা যেন অতিমানুষিক শক্তি পেলো তার শরীরে। আঁটো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে সে কাফতান, জলের ছাঁটের হাত থেকে সেটাই তাকে রক্ষা করবে। জুতোজোড়াও বেশ মজবুত আছে–ভাগ্যিশ কয়েকদিন আগেই জুতোজোড়া সে এক মুচিকে দিয়ে সারাই করে নিয়েছিলো, না-হলে এই পিছল বরফে পা ফেলতো কী করে? তাছাড়া অন্ধকার সত্ত্বেও রাস্তা খুঁজে হাড়ে মরার ভয় নেই–কারণ এমবাতাকে সরাসরি তার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।
রাত তিনটে নাগাদ সে প্রায় বারো মাইল রাস্তা পেরিয়ে এলো। আর দু-ঘন্টার মধ্যে গিয়েই পৌঁছুতে পারবে গোপন আশ্রয়ে। এবারও কোনো গাঁয়ে ঢুকে পড়ে সরাইখানায় গিয়ে আশ্রয় নেবার ঝুঁকি না নেয়াই ভালো, কী দরকার। ঐ ঝামেলা পুইয়ে, সঙ্গে যা খাবার আছে তাতে আরো একটা দিন কাটিয়ে দেয়া যাবে। কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিলো, তাতে কিছুই এসে-যায় না;সন্ধে অব্দি কোনোরকমে নিরাপদ থাকাটাই হচ্ছে আসল কথা। হ্রদের উত্তরধারে যেসব বন আছে, সেখানে শিকারীদের কুঁড়েবাড়ি মিলবে নিশ্চয়ই–কেবল শীতকালেই ও-সব বাড়িতে লোকে আশ্রয় নেয়। ভিতরে থাকবে কয়লার স্তূপ, গাছপালার শুকনো ডালপালাও থাকবে নিশ্চয়ই ভিতরে–দিব্যি একটা আগুন জ্বালানো যাবে–তার আঁচেই শরীর মন সেঁকে নেয়া যাবে। এই মস্ত ফাঁকা জায়গায় ঐ অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়া উঠলেও ভয় নেই–কে আর আসবে এখানে তার খোঁজে!
বড্ড ঠাণ্ডা পড়েছিলো এবার শীতে; কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডায় বিষম কষ্ট পেলেও পালাবার পক্ষে শীতকাল তাকে বেশ সাহায্যই করেছে।
হঠাৎ এমবাচ্-এর বামতীর থেকে একটা চাপা রাগি গর্জন রাত ছুঁড়ে বেরিয়ে এলো! কোনো সন্দেহই নেই–কয়েক শো গজ দূরেই কোনো বুনো জানোয়ার রয়েছে ওৎ পেতে। ওৎ পেতে আছে, না এদিকে এগুচ্ছে! বড্ড অন্ধকার–কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
লোকটা থমকে দাঁড়িয়ে উৎকৰ্ণ হয়ে শোনবার চেষ্টা করলে। সাবধানে থাকতে হবে তাকে, খেয়াল রাখতে হবে চারপাশে; জন্তুটা যাতে আচমকা তার উপর ঝাপাতে না পারে, সেদিকটায় নজর রাখতে হবে তাকে।
কালো রাতটাকে ছিঁড়ে-ছিড়ে আরো-কয়েকবার উঠলো সেই বিষম রাগি গর্জন! ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে শব্দটা! আর তার ডাকে সাড়া দিয়েই আরো-সব জন্তুদের বিলম্বিত ডাক উঠছে অন্ধকারে! হয়তো মানুষের গন্ধ পেয়েছে তারা অন্ধকারে রক্তের নেশায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
তার পরেই সেই বুকের রক্ত ঠাণ্ডা করে-দেয়া ঐকতান উঠলো এত জোরে ও এত কাছে যে তার মনে হলো বুঝি-বা তার উপরে ঝাঁপিয়েই পড়ে জন্তুগুলো!
নেকড়ে…নেকড়ের পাল!ফিশফিশ করে দাঁতে দাঁত চেপে সে বললে, বড্ড কাছ থেকে ডাক উঠছে–নিশ্চয়ই খুব দুরে নেই।
ভীষণ বিপদের সম্ভাবনায় তার হাত-পা যেন পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে চাইলো। কর্কশ ও কঠিন শীতকাল কেটেছে অনাহারে-জন্তুগুলো যে হন্যে হয়ে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। নেকড়ে যদি একটা হতো, তাহলে সে এতটা ভয় পেতো না। গায়ে যদি জোর থাকে, মাথা যদি ঠাণ্ডা থাকে, আর হাতে যদি থাকে লাঠি-তাহলে একটা নেকড়ে তার কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু এ-রকম ছ-সাতটা জন্তু একসঙ্গে চড়াও হলে সে কী করবে–কী করে সে এদের তাড়াবে; এমনকী রিভলবারই বা কোন্ কাজে লাগবে? যদি একটাও তাগ না ফশকায়, তাহলে অবশ্যি–
আর আশ্রয়? এদের ক্ষুধার্ত কামড় থেকে রক্ষা পাবার উপযোগী আশ্রয়? পাগল! তা সে পাবে কোথায় এখানে। এমবাখ-এর তীর বেশ ঢালু ও নিচু–আর একেবারেই ফাঁকা। কোথাও গিয়ে যে কোনো গাছের ডাল বেয়ে উঠে পড়বে, সে-রকম কোনো গাছই নেই কোথাও! কোন্খান দিয়ে আসছে নেকড়েরা? বরফের উপর দিয়ে? না কি স্তেপি পেরিয়ে? এটা ঠিক যে আর পঞ্চাশ গজ দূরে নেই তারা!
যত জোরে পারে, তাকে ছুটতে হবে–এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই! দৌড়ের পাল্লায় যে জন্তুগুলোর সঙ্গে পারা যাবে তারও কোনো ভরশা নেই। কিন্তু শেষ চেষ্টা করে দেখুক একবার–তারপর না-হয় তাদের মুখোমুখি দাঁড়াবে। তাই সে করলে। কিন্তু ছোটবার সঙ্গে-সঙ্গেই পিছনে একটা হন্যে চিৎকার উঠলোবোধহয় কুড়ি পাও দূরে নেই নেকড়েগুলো। থামতেই তাকিয়ে দ্যাখে অন্ধকারের মধ্যে ঝকঝকে চুল্লির মতো সারি-সারি জ্বলন্ত চোখ!
নেকড়ের চোখ–ক্ষুধায় আর লোভে জ্বলন্ত। দীর্ঘ উপবাসের পর সামনেই শিকার–চোখা হলদে দাঁতের পার্টির কাছেই। ক্রুদ্ধ গর্জন উঠলো রোগা চিমশে ক্ষুধার্ত নেকড়েগুলোর।
এক হাতে তার লাঠি, আরেক হাতে রিভলবার–সে মুখোমুখি দাঁড়ালে নেকড়েগুলোর। লাঠির ঘায়েই যদি কাজে হয়, তবে আর রিভলবার ছুড়বে না–রিভলবারের গুলিতে ওদিকে আবার পুলিশ আর পাহারা সজাগ হয়ে উঠবে!
কাফতানের ভাঁজ থেকে হাত বার করে এনে সোজা সে দাঁড়ালে স্থির পায়ে। বনবন করে ঘুরলো তার হাতের মস্ত লাঠি-ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে নেকড়েগুলো থমকে গেলো। তবু একটা নেকড়ে তার ঘাড় তাগ করে লাফ দিয়েছিলো, লাঠির ঘায়ে সে ছিটকে পড়লো মাটিতে।
কিন্তু নেকড়েরা সংখ্যায় আধ ডজন-কজনকে সে ভয় দেখাবে? রিভলবার ছুঁড়ে একটা-একটা করে সবগুলোকে খতম না-করলে আর চলবে না। আরেকটা নেকড়ের মাথায় সে ঘা মারলে প্রাণপণে-নেকড়ের মাথার খুলিটা ফেটে গেলো, কিন্তু তার হাতের লাঠিটা ভেঙেও দু-টুকরো!
আবার সে প্রাণপণে ছুটলো। নেকড়েগুলো মৃত সঙ্গীদের চেটেপুটে খেলে সেখানে, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই হাড়গোড় ছাড়া বরফের উপর কিছু রইলো না। আবার তারা তার পিছনে ধেয়ে এলো। থামলো সে আবার, ফিরে দাঁড়িয়ে পর-পর গুলি ছুঁড়লো চারবার।
দুটি নেকড়ে ছিটকে পড়লো বরফে, মারাত্মক জখম হয়েছে তারা, রক্ত ঝরছে গলগল করে। কিন্তু শেষ গুলি দুটো ফশকালোবাকি নেকড়ে দুটো লাফিয়ে সরে গেলো একপাশে, আর তারপরেই ধেয়ে এলো তার দিকে। রিভলবারে গুলি ভরারও আর সময় নেই। দুশো গজ ছুটে যেতে না যেতেই একটা নেকড়ে কামড়ে ধরলে তার কাফতান–হ্যাঁচকা টানে চামড়াটা গেলো ছিঁড়ে, খপ করে সেই চামড়ার টুকরোই গিলে ফেললে নেকড়েটা।
নেকড়ে দুটোর তপ্ত ফোঁশফোঁশ গায়ে লাগছে তার। একবার যদি গলন্ত বরফে পা হড়কে যায়, তাহলেই সব শেষ–আর তাকে উঠে দাঁড়াতে হবে না, মুহূর্তের মধ্যেই হিংস্র নখগুলো তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।
তাহলে এই তার জীবনের শেষ ঘণ্টা! এত কষ্ট, এত বিপদ, এত অবসাদ-সব সহ্য করে সে ফিরে আসতে চাচ্ছে নিজের দেশে–কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের দেশের মাটিতেও সে মরতে পাবে না!
প্রথম ঊষার রশ্মি জেগে উঠলো দিগন্তে, আর তারই সঙ্গে দেখা গেলো হ্রদের শেষ মাথা। এখন আর বৃষ্টি পনছে না। হালকা কুয়াশায় মুড়ি দিয়ে চুপচাপ পড়ে আছে চারপাশ। নেকড়েগুলো লাফিয়ে পড়লো শিকারের উপর। শেষ দুটো গুলি স্তব্ধতাকে ফেঁড়ে দিয়ে বেজে উঠলো গুড়ুম! গুড়ুম! রিভলবারের বাঁট দিয়ে সে পাগলের মতো মারছে নেকড়েগুলোকে দাঁতের আর নখের আঁচড় তাকেও রক্তাক্ত করে দিয়েছে!
হঠাৎ লোকটা গিয়ে একটা মইয়ের গায়ে ধাক্কা খেলো!…কোথায় উঠে গেছে এই মই?…কী এসে যায়? একবার উঠে গেলে নিশ্চিন্ত, নেকড়েগুলো মই বেয়ে উঠতে পারবে না পিছন-পিছন–অন্তত একটুক্ষণের জন্য তো নিরাপদ।
হেলানো মইটা কিন্তু মাটি অব্দি নামেনি। আশ্চর্য, যেন ঝুলে আছে উপর থেকে। উপরে কী আছে কুয়াশায় তা দেখা যাচ্ছে না।
শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সে মই। নেকড়েরা যেই তাকে লক্ষ্য করে ঝাঁপাবে, নিচের ধাপে সে পা দিলে। হুড়মুড় করে উঠতে গিয়ে টের পেলে জুতোর সুখতলাই কামড়ে ছিঁড়ে নিলে নেকড়েগুলো।
মইটা তার ভারে মড়মড় করছে দুলছে শূন্যে অনবরত। ভেঙে পড়বে না কি? …তাহলে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে তাকে নেকড়েগুলো–আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে নেবারও তর সইবে না…
বেশ শক্ত মইটা। একেবারে শেষ ধাপে গিয়ে পৌঁছলো সে হুড়মুড় করে। একটা থাম বেরিয়ে আছে, পুরু একটা অক্ষদণ্ডর মতো–তারই উপর সে বসলো পা ঝুলিয়ে।
যাক! নেকড়েদের নাগালের বাইরে তো পৌঁছনো গেলো।
জানোয়ার দুটো তখনও ভীষণ গরজাচ্ছে, ফেঁশফোঁশ করছে রাগে আর লাফিয়ে লাফিয়ে মইটাকে পাকড়ে ধরার চেষ্টা করছে।
.
২. একজনের জন্যে আরেকজন
এবার সে নিরাপদ–আপাতত। নেকড়েরা তো তার ভলুকদের মতো মই বেয়ে উঠতে পারে না কিন্তু যতক্ষণ না কেড়ে দুটো পালিয়ে যায় ততক্ষণ অবদি তার পক্ষেও আর নিচে নামা সম্ভব হবে না, আর নেকড়েরা যে দিনের আলো না ফুটলে পালাবে না, সে সম্বন্ধেও কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু এই মইটা এখানে করছে আর কীসের সঙ্গেই বা মইটা ঠেশ দিয়ে রাখা? কীসের থেকে মইটা ঝুলছে?
একটা চাকার অক্ষর উপর সে বসে আছে–সে দেখতে পেলে। চাকাটা থেকে আরো তিনটে ওরকম মই ঝুলছে টিলার উপরে যে হাওয়াক বানানো হয়, তারই চারটে পাখনা নিশ্চয়ই। ভাগ্যিশ! না-হলে ওই পাখনা বেয়ে যখন সে উঠেছিলো, তখন ঐ হাওয়াকল চললেই হয়েছিলো আর কী–তাকে শুষ্টু বনবন করে ঘুরতে শুরু করে দিতে, নাগরদোলার মতো!
হাওয়া এলে সকালবেলাতেই এটা হয়তো ঘুরপাক খেতে থাকবে–এই সম্ভাবনাটা কিছুতেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর, তখন, এর ঘুরতে-থাকা অক্ষর উপর বসে-থাকা তার পক্ষে বিষম কঠিন হয়ে উঠবে। তাছাড়া কলওলা যখন পাখনা ছড়িয়ে কল চালিয়ে দিতে আসবে, তখন তাকে দেখতে পাবে বসে আছে এই অক্ষদণ্ডে। কিন্তু নিচে নামবে সে কোন্ সাহসে? নেকড়েগুলো এখনো নিচে ঘুরছে, লাফাচ্ছে আর গরজাচ্ছে–হয়তো তাদের হন্যে ডাক শুনে আশপাশের বাড়িঘরের লোকেরাই ঘুম ভেঙে ছুটে আসবে!
এখন তাহলে একটা কাজই সে করতে পারে। ঐ মিল-এর মধ্যেই ঢুকে পড়া তার পক্ষে সমীচীন; সেখানে সারাদিন কাটাতে হবে লুকিয়ে–অবিশ্যি সবই নির্ভর করছে কলওলা এখানে থাকে কিনা তার উপর; দেখে-শুনে মনে হচ্ছে কলওলা সম্ভবত এখানে থাকে না; সেক্ষেত্রে সারাদিন এখানে গা-ঢাকা দিয়ে থেকে রাত্তিরে আবার রওনা হয়ে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
এই ভেবে সে অতি সাবধানে ছাদের দিকে চলে গেলো-তারপর গিয়ে পৌঁছলো জানলার কাছে। জানলা খুঁড়েই উঠেছে পিছনের লম্বা খুঁটিটা, একেবারে মাটিতেই পোঁতা বোধহয়।
ওই তল্লাটে এ-রকম হাওয়াকল অনেক আছে। বাঁকানো একটা কীলকের টুপি পরানো হাওয়াকল, দেখে মনে হয় যেন একটা শিরস্ত্রাণ। এই ছাদটা ঘর্ষণ-ঘোরকের উপর ভর দিয়ে চলে, আর চাকাগুলো হাওয়ার তোড়ে পাক খায়। এই কাঠের বাড়ির প্রধান অংশটা কিন্তু কোনো কেন্দ্রীয় হাওয়ালের উপর বসানো নয়, মাটির সঙ্গেই আটকানো–পরস্পরের মুখোমুখি দুটি দরজা আছে তাই দিয়েই সেখানে পৌঁছনো যায়।
জানলার কাছে পৌঁছেই ফেরারি সেই সরু ফোকরটা দিয়ে সহজেই কোনো শব্দ না করে নেমে এলো। ফোকরটা দিয়ে এসে পৌঁছনো যায় হাওয়ালের মতো এক জায়গায়, হাওয়ালের চাকা দিয়ে সেটা আড়াল করা। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, স্তব্ধতাও যেন তেমনি নিরেট। অন্তত এখন যে নিচে কেউ নেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একটা বন্ধুর সিঁড়ি নিচের তলা অব্দি নেমে গেছে–মেঝেটা নোংরায় ভর্তি।
কিন্তু চিলেকোঠা ছেড়ে নিচে নেমে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। প্রথমে চাই কিছু খাদ্য, ওদিকে এতক্ষণে ঘুমেও দু-চোখের পাতা জড়িয়ে আসছে : ক্ষুধা আর ঘুমকে সে এখন ঠেকাবে কী করে? এদিকে শেষ সঞ্চয়টুকু দিয়েই সে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছিলো, ভেবেছিলো পরে কোথাও গিয়ে কিছু খাবার জোগাড় করে নেবে। কিন্তু কোত্থেকে সে খাবার জোটাবে এখন–আর কেমন করেই বা জোটাবে? মাথা ঠাণ্ডা করে এখন সে-বিষয়টা ভেবে নেয়া উচিত।
সাড়ে-সাতটায় যখন কুয়াশা সরে গেলো, হাওয়াকলের আশপাশটা ভালো করে নজরে পড়লো; হাওয়াকলের ডানদিকেই রয়েছে মস্ত সমভূমি, মাঝে মাঝে বরফের স্তূপ, আর তারই পাশ দিয়ে গেছে এক অন্তহীন পথ, পশ্চিমদিকে, গাছপালার তলা দিয়ে, একটা জলাভূমির পাশে মোচড় মেরে। বাঁদিকে ছড়িয়ে আছে হ্রদ, সেখানটায় এমবাখ নদী এসে মিশেছে, সেই মোহনার কাছটা ছাড়া হ্রদটা এখনো তুষারধবল ও নিরেট পড়ে আছে। মাঝে মাঝে ইতস্তত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দেবদারু, তাদের ডালপালা কালো পাতার ঝাড় যেন পাতাঝরা কঙ্কালসার মেপল আর এলডার গাছগুলোরই প্রতিতুলনা। সে আরো তাকিয়ে দেখলে যে নেকড়েদেরও আর-কোনো পাত্তা নেই কিছুক্ষণ ধরে সত্যিই অবশ্য তাদের গর্জন আর কানে আসছিলো না।
ভালোই হলো, ভাবলে সে মনে মনে, কিন্তু কাস্টমসের লোক আর পুলিশ হলো ঐ নেকড়েগুলোর চেয়েও ভয়ানক!…উপকূলের যত কাছে গিয়ে পৌঁছুবো, ততই তাদের চোখে ধুলো দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে… ঘুমে দু-চোখের পাতা একেবারে জড়িয়ে যাচ্ছে… ঘুমের ঘোরে পড়ে না যাই নিচে। কিন্তু নিচে নামবার আগে একবার চারপাশ ভালো করে দেখে নেয়া যাক–হঠাৎ কেউ এসে চড়াও হলে কোথায় পালাবো, সেটা অন্তত ঠিক করে রাখি।
বৃষ্টি ধরে গিয়েছে। হাওয়া বইছে পশ্চিমমুখো। তাপমাত্রাও একটু উঠে এসেছে। কিন্তু হাওয়ার জোর দেখে কলওলা এসে তার কলটা চালিয়ে দিতে চাইবে নাকি এখন?
জানলা দিয়ে তাকালে প্রায় আজ মাইল দূরে এলোমেলো ছড়ানো কতগুলো বাড়ি চোখে পড়ে। বাড়িগুলোর চালে শাদা তুষার জমে আছে, চিমনিগুলো দিয়ে উঠছে সকালবেলার আড়মোড়া-ভাঙা অলস ধোঁয়ার কুণ্ডলী। কলওলা নিশ্চয়ই ওই বাড়িগুলোর একটাতেই থাকে।
মই বেয়ে সে প্রধান অংশটায় নেমে পড়লো। সার-সার পড়ে আছে। কতগুলো গমের বস্তা। কলটা তাহলে রোজই চালানো হয়–হাওয়া উঠলেই আজকে চালানো হবে: কক্লওলা কি তাহলে শিগগিরই এসে হাজির হবে না–পাখাগুলোকে হাওয়ার মুখে ঘুরিয়ে দেবার জন্যে?
তাহলে এই একতলায় থাকা আর বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং চিলেকোঠাতে গিয়েই ঘণ্টা কয়েক ঘুমিয়ে নেয়া যাক। আচমকা ধরা পড়ে যাবার ভয় অবিশ্যি রয়েইছে। মিলের দরজায় কেবল সাধারণ হুড়কো লাগানো; বৃষ্টি যদি আবার আসে, আশপাশের লোকেরা এসে আশ্রয় নেবে নির্ঘাত। ওদিকে হাওয়ার জোরও বেড়ে যাচ্ছে; কলওলা নিশ্চয়ই এক্ষুনি এসে উদিত হবে!
আবার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সে উঠে পড়লো-ওঠবার আগে শেষবার জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো চারদিক। চিলেকোঠায় পৌঁছেই সে ধপ করে পড়ে গেলো লম্বালম্বি; অবসাদে সারা শরীর ভেঙে পড়ছে; শোবামাত্রই গভীর ঘুম।
জেগে যখন উঠলো, তখন ক-টা বাজে?–চারটে হবে বোধহয়; তখনও স্পষ্ট দিনের আলো আছে। অথচ আশ্চর্য, হাওয়াকল মোটেই চলছে না!
আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে সে দেখলে যে তার হাতে-পায়ে কোনো সাড় নেই। নড়তেই পারলো না সে। আর নড়তে পারলো না বলেই এক মস্ত বিপদ থেকে বেঁচে গেলো।
নিচের তলায় কারা যেন কথা বলছে–বেশ উত্তেজিতভাবেই কথা বলছে লোকগুলো। তারা যে কখন এসে পৌঁছেছে, ঘুমের ঘোরে তা সে একেবারেই টের পায়নি। চিলেকোঠায় এসে তাকে দেখে গেছে নাকি!
নড়াচড়া না-করে নিঃসাড়ে সে পড়ে রইলো লম্বালম্বি–কেবল উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলো নিচে কী বলাবলি হচ্ছে।
দু-একটা কথা শুনেই আগন্তুকদের পরিচয় সে জেনে ফেললে, আর তক্ষুনি বুঝতে পারলে যে কোনো ভীষণ বিপদের হাত থেকে সে এইমাত্র বেঁচে গেলো! বেঁচে অবিশ্যি ঠিক যায়নি; কলওলার সঙ্গে যে তিনটি লোক তর্কাতর্কি করছে তাদের চোখে ধুলো দিয়ে তাদের আগে বা পরে চম্পট দিতে পারলেই সে বেঁচে যাবে।
লোক তিনটে আর কেউ নয়, পুলিশ: একজন সারজেন্ট, আর অন্য দুজন তার সহকারী।
+
সেই সময়ে বলটিক দেশগুলোর কর্মচারীদের রুশীকরণ মাত্র শুরু হয়েছে–আলেমানদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে নিয়োগ করা হচ্ছে স্লাভদের। তখনও পুলিশের অনেক লোকই ছিল আসলে আলেমান, আর তাদের মধ্যে সারজেন্ট য়েক ছিলো সবচেয়ে নামজাদা। সারজেন্ট য়েক ছিলো খুবই একচোখা ও সাম্প্রদায়িক–লিভেনিয়ার রুশীরা কোনো দুষ্কর্ম করলে সে কিছুতেই ছেড়ে কথা কইতো না, কিন্তু সেই একই কুকর্মের জন্য আলেমানদের সে অনেক সময় মাফ করে দিতো।
এমনিতে ভারি কাজের লোক, গম্ভীর ও ভারিক্কি; ওপরওলারা তার উপরে ছিলো খুবই সন্তুষ্ট। একবার কোনো দুষ্কর্মের কথা তার কানে এলেই হলো, একেবারে নাছোড়বান্দার মতো তার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সে লেগে থাকতো। সব কাজেই তার সাফল্য ছিলো অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী–কোনো মামলা-মোকদ্দমাতেই একবারও পরাস্ত হয়নি বলে ভারি অহংকার ছিলো তার। কোনো জরুরি তদন্ত হাতে এলে চিনে জোঁকের মতো লেগে থাকে; অবসাদ বলে কোনো কথা তার অভিধানে নেই, ভীষণ চালাকচতুর। লিভোনিয়ার এক স্লাভ সাইবেরিয়া থেকে পালিয়েছে, তাকে পাকড়াতে হবে–এ-কথা শুনেই সে উঠে-পড়ে লেগে গিয়েছে।
ফেরারি যখন ঘুমিয়েছিলো, কলওলা তখনই এসে পৌঁছেছিলো তার মিলে। নটা নাগাদ হাওয়ার গতি ছিলো বেশ প্রসন্ন; তখন যদি সে কলটা চালিয়ে দিতো, তাহলে হাওয়ালের পাখার কাঁচকোঁচ শব্দে ফেরারির ঘুম ভেঙে যেতো নিশ্চয়ই। কিন্তু হঠাৎ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে থাকে, তক্ষুনি হাওয়া পড়ে যায়, কাজেই কলওলা অলসভাবে দাঁড়িয়েছিল চৌকাঠের কাছেই। এমন সময়েই সারজেন্ট য়েক সদলবলে এসে হাজির-কলওলাকে নিয়েই য়েক তার মিলের মধ্যে ঢুকে পড়লো।
দ্যাখোনি তুমি লোকটাকে? জেরা করছিলো য়েক, বয়েস হবে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ–হ্রদের ঠিক মুখটায় তাকে দেখা গিয়েছিলো!
কই, কাউকেই তো দেখিনি, কলওলা বললে, এই ঠাণ্ডায় দিনে দুটি লোকও গ্রামে এসে হাজির হয় কি না সন্দেহ।… লোকটা কি বিদেশী?
বিদেশী?…না, রুশী…বলটিক এলাকার রুশী। বদমায়েশের ধাড়ি! লোকটাকে গ্রেফতার করতে পারলে বেশ নামজাদা হয়ে যাবো।
পুলিশের লোকের কাছে ফেরারি মাত্রেই বদমায়েশের ধাড়ি–তা সে রাজনৈতিক বন্দীই হোক, কি খুনে বাঁটপাড়ই হোক!
আপনি তার পিছু নিয়েছেন? খুঁজছেন তাকে? কলওলা জিগেশ করলে।
চব্বিশ ঘণ্টা আগে তাকে একবার সীমান্তের কাছে দেখা গিয়েছিলো।
কোথায় যাচ্ছিলো সে? কেউ জানে সেইকথা? কলওলা বেশ অনুসন্ধিৎসু মানুষ।
অনুমান করা যায়, য়েক তাকে বললে, বরফ গলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই জাহাজে ওঠা যায় এমন জায়গায় যেতে চাচ্ছে নিশ্চয়ই–রিগার বদলে রেফেল-এর দিকেই যাচ্ছে নিশ্চয়ই লোকটা।
সারজেন্ট য়েখ ভুল করেনি। কারণ রেফেল বেশ বড়োশড়ো ব্যাবসার কেন্দ্র, আর বন্দরও আছে। কিন্তু হাওয়াকল থেকে রেফেল-এর দূরত্ব অন্তত আশি মাইলসেখানে পৌঁছুতে হলে কম করে চারটে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।
রেফেল কেন?…পেরনাউ গেলেই তো তার সুবিধে হবে,বললে কলওলা।
পেরনাউ সত্যিই অপেক্ষাকৃত কাছে-ষাট মাইল দূরে। কিন্তু রিগা, সে প্রায় ডবল দূরে… কাজেই রিগার রাস্তায় অতটা কড়া তল্লাশি হবে না নিশ্চয়ই।
বলাই বাহুল্য, ফেরারি তখন চিলেকোঠার মেঝেয় দম বন্ধ করে শুয়ে উৎকর্ণভাবে প্রতিটি কথা শোনবার চেষ্টা করছে। সব কথা ঠিকমতো শুনতে পেলে তার সুবিধেই হবে শেষকালে।
হ্যাঁ, সারজেন্ট বললে, পেরনাউ-এর কথা অবিশ্যি মনে রাখতে হবে। ফাললেন-এর ঘাঁটিগুলোয় খবর দেয়া হয়েছে, যাতে পেরনাউ-এর রাস্তায় কড়া নজর রাখে। কিন্তু সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে লোকটা সম্ভবত রেফেলই যেতে চাচ্ছে–রেফেল-এ তার পক্ষে জাহাজে ওঠা অনেক সহজ হবে।
এটা আসলে মেজর ফেরডের-এর অনুমান। কর্ণেল রাগেনোফ-এর ডান। হাত এই মেজর ফেরডের-লিভোনিয়ার পুলিশের বড়ো কর্তা। তিনিই য়েককে রেফেল-এর রাস্তায় কড়া নজর রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।
কর্নেল রাগেনোফ নিজে স্লভ আর মেজর ফেরডের হলেন আলেমান–কাজেই দুজনের দ্বেষ ও ভালোবাসা, সহানুভূতি ও অনীহা সমান নয়। কিন্তু সারজেন্ট মেক-এর মনোভাব বেশ ভালো করেই জানেন মেজর ফেরডের। এটা ঠিক যে তার এত কড়াক্কড়কে মোলায়েম করবার জন্য আছেন জেনারেল গোরকো-বালটিক দেশগুলোর রাজ্যপাল, বেশ উঁচুতলার মানুষ- তিনিই প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় রুশীদের চাকরি দেবার পক্ষপাতী।
আরও কয়েক মিনিট চললো কথাবার্তা। পুলিশের কাছে যে বিজ্ঞপ্তি পৌঁছেছিল, সেই অনুযায়ী-ফেরারির চেহারার একটা বর্ণনা দিলে সারজেন্ট য়েক : প্রমাণ মাপের চেয়ে একটু লম্বা লোকটা, বেশ সবল গড়ন, বয়েস পঁয়ত্রিশ, ঘন দাড়ি মুখে-লালচে রঙের, গায়ে একটা বাদামি রঙের কাফতান–অন্তত সীমান্ত পেরুবার সময় এই তার পরনে ছিলো।
আচ্ছা, আবার বলুন তো, কলওলা জিগেশ করলে, লোকটা…রুশী, তাই তো বললেন আপনি?
হ্যাঁ, রুশী।
হুম! না, আমাদের গ্রামে তাকে কোথাও দেখা যায়নি–কোনো বাড়িতেই তার কোনো হদিশ পাবেন না!
জানো তো, সারজেন্ট তাকে মনে করিয়ে দিলে, যে তাকে আশ্রয় দেবে, তারও গ্রেফতার হবার সম্ভাবনা আছে–তাকে ঐ ফেরারির শাগরেদ বলেই গণ্য করা হবে।
ভগবান রক্ষে করুন! আমি বাপু ও সব ঝক্কিঝামেলায় নেই!
ঠিকই ভেবেছো তুমি, য়েক যোগ করলে, মেজর ফেরডের-এর সঙ্গে ঝগড়া বাধালে ফল খুব একটা ভালো হয় না।
নিশ্চয়ই। মেজর ফেরডের যাতে আমার উপর চটে না-যান, সেদিকে লক্ষ রাখবো বৈকি!
য়েক বিদায় নেবার জন্যে তৈরি হলো। পেরনাউ থেকে রেফেল–এক টুকরো জমিও সে বাদ দেবে না, সব তন্নতন্ন করে খুঁজবে;–যাবার আগে আবার সে শাসিয়ে গেলো, সব জায়গার পুলিশকেই খবর জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সবাই সারাক্ষণ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।
আমরা কথা বলছি, এই ফাঁকে হাওয়ার জোর দেখছি আবার বেড়ে উঠলো–বেশ জোরে বইতে শুরু করে দিয়েছে হাওয়া, কলওলা বললে, আপনার লোকদের বলবেন একটু সাহায্য করতে? পাল খাটাববা… তাহলে আর আমাকে গ্রামে ফিরে যেতে হয় না–সারা রাতটাই এখানে কাটিয়ে দিতে পারি। বলবেন ওদের একটু হাত লাগাতে?
দ্বিরুক্তি না-করেই সাগ্রহে রাজি হলো য়েক। উলটো দিকের দরজা দিয়ে তার অনুচর দুজন বেরিয়ে গেলো, তারপর হাওয়ালের চাকাগুলো ঘুরিয়ে হাওয়ার মুখে এনে হাজির করে দিলো। পালে হাওয়া লাগলো, শুরু হলো চাকার শব্দ : ক্যাঁচ-কোচ, ক্যাঁচ-কোঁচ! তারপরেই সারজেন্ট য়েক সদলবলে উত্তর-পশ্চিমমুখো রওনা হয়ে পড়লো।
+
সব কথাই সে যেন গোগ্রাসে গিলছিলো। যতটুকু শোনা গেলো, তাতেই বোঝা গেলো, বুঝি তীরে এসে তরী ডোবে-তার যাত্রার শেষটায় মস্ত বিপদ ওঁৎ পেতে আছে! সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে তার পালাবার খবর। পুলিশ চারপাশ একেবারে চষে ফেলছে…বিভিন্ন পুলিশের ঘাঁটি একই কাজের জন্য হাত মিলিয়েছে…রেফেল যাবার চেষ্টা করা কি ঠিক হবে তার? না, তক্ষুনি সে মনস্থির করে ফেললো। বরং পেরনাই যাওয়াই ভালো–অন্তত তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছুতে পারবে। তাপমাত্রা যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে বরফ গলা শুরু হয়ে গেলো বলে।
যেমনি ভাবা অমনি কাজ : অন্ধকার হবার সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে মিল ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
কিন্তু লক্ষ রাখতে হবে যাতে কওলার চোখে না পড়ে। পাখাগুলো দিব্যি ঘুরছে, রাত্রে সম্ভবত আর হাওয়া পড়ে যাবে না, লোকটা তো রাতের নাম করেই আশ্রয় নিয়েছে এখানে। নিচের তলায় নেমে গিয়ে সোজাসুজি দরজা খুলে বেরুবার কথা ভাবাই চলে না আর–আবার ওই ফোকরটা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরুবে না কি? খুঁটি বেয়ে নেমে যাবে তারপরে মাটিতে?
যদিও পাখনার অক্ষদণ্ডটা এখন পাক খাচ্ছে আর চাকার দাঁতে জড়িয়ে যাবার ভয়ও রয়েছে, তবু কোনো শক্তসমর্থ ক্ষিপ্র লোকের পক্ষে ব্যাপারটা মোটেই অসম্ভব নয়। একবার বেশামাল হলেই একেবারে পিষে যাবে–কিন্তু ঝুঁকিটা তো তাকে নিতেই হবে।
অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। যদি তার আগে কোনো কাজে কলওলা চিলেকোঠায় এসে হাজির হয়, তাহলেই সব ফাঁস হয়ে যাবে… তাকে দেখে ফেললেই সর্বনাশ! যদি দিনের আলো থাকে, তাহলে দেখে তো ফেলবেই! আর যদি রাতই হয়, তখন তার হাতে তো মশাল বা লণ্ঠন একটা-কিছু থাকবেই!
হুম! কলওলা এসে যদি তাকে চিলেকোঠায় লুকিয়ে থাকতে দ্যাখে, তাহলে সোজা সে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে, একদম পেড়ে ফেলবে তাকে, বেঁধে রেখে দেবে। কলওলা যদি বাধা দিতে চায়, যদি আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টা করে, যদি চেল্লাচিল্লি করে চারপাশে শোর তুলে দেয়, তাহলে আর দেখতে হবে না, তার ছুরিটা তার সব চ্যাঁচামেচিকে স্তব্ধ করে দেবে। এত বিপদ পেরিয়ে, এত ঝুঁকি সামলে সে এত দূরে আবার গ্রেফতার হতে আসেনি–মুক্তির জন্য সে সবকিছু করতে পারে–এমনকী খুন করতেও কোনো দ্বিধা করবে না।
কিন্তু তবু–তবু হয়তো এখনো রক্তপাতের কোনো প্রয়োজনই হবে না, হয়তো এখনো ও রকম চূড়ান্ত কিছু করবার দরকার হবে না তার… আর তাছাড়া ওই কলওলা খামকা এখন এই চিলেকোঠাতেই বা হানা দেবে কেন?…তার তো এখন হাওয়াকলের তদারকি করার কথা, পাখা ঘুরছে বন-বন, তার সঙ্গে সঙ্গে গম-পেষাইয়ের জাঁতাগুলো কেমন ঘুরছে, সেদিকেই তো সে নজর রাখবে এখন।
অক্ষদণ্ডর শব্দ হচ্ছে ক্যাঁচ-কোঁচ, পাখা ঘুরে যাচ্ছে একটানা, চাকার শব্দ, বাতাসের শোঁ-শোঁ, গম-পেষার শব্দ, জাতা ঘুরছে; আর এরই মধ্যে কেটে গেলো এক ঘণ্টা সময়। এ-রকম উঁচু অক্ষরেখায় সন্ধ্যা থাকে অনেকক্ষণ। আস্তে-আস্তে ছায়া করে এলো চারপাশে। চিলেকোঠার ভিতরটায় অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে গিয়েছে। এবার তাকে ধীরেসুস্থে রওনা দিতে হবে। রাতে ভারি কষ্ট হবে যেতে–আরো চব্বিশ মাইল না-গেলে কোনো আশ্রয়ই মিলবে না; আর দেরি করা উচিত নয় তার, সম্ভব হলে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়া উচিত।
খাপের মধ্যে ছুরিটা সহজে ও মসৃণভাবে নড়াচড়া করে কি না, সেটা সে একবার দেখে নিলে; রিভলবারে পুরে নিলে ছটা গুলি।
এবার সেই মস্ত ঝক্কিটা; সরু ফোকরের মধ্যে শরীরটা গলিয়ে দিতে হবে এবার, লক্ষ রাখতে হবে সেই ঘূর্ণমান অক্ষদণ্ড যাতে ছুঁয়ে না-ফ্যালে। একবার যদি অক্ষদণ্ডটা না ছুঁয়েই ফোকরের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, তাহলে নিচে নামতে আর কতক্ষণই বা!
নিঃশব্দে ধীরে-সুস্থে সে যেই ফোকরের দিকে এগোবে, এমন সময় হাওয়াকলের কাঁচ কোচ ছাপিয়ে আরেকটা আওয়াজ তার কানে এলো। ভারি জুতোর মশমশে আওয়াজ, কাঠের সিঁড়ির উপরে জুতোর শব্দ। লণ্ঠন হাতে কলওলা শেষকালে চিলেকোঠাতেই উঠে আসছে।
কলওলা যখন দেখা দিলে, ফেরারি তখন তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে তৈরি–ধনুকের মধ্যে ছিলার মতো সে টান হয়ে আছে। কিন্তু চিলেকোঠার মেঝে বরাবর যখন কলাওলার শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখা গেলো, তখুনি কলওলা ফিসফিশ করে বললে, ছোটো বাবা*, এবার যাবার সময় হলো…আর দেরি কোরো না… নিচে নেমে এসো …দরজা খোলাই আছে।
স্তম্ভিত হয়ে গেলো ফেরারি, কোনো কথাই হাড়ে পেলে না সে। তাহলে কলওলা জানতো যে সে এখানে আছে…তাকে এই চিলেকোঠায় আশ্রয় নিতে সে আগেই দেখেছিলো?… হ্যাঁ, যখন সে ঘুমিয়েছিলো, তখনই নিশ্চয়ই কলওলা চিলেকাঠায় এসে হাজির হয়েছিলো; তাকে ঘুমন্ত দেখে নিশ্চই আর জাগাবার চেষ্টা করেনি। কারণ সেও তো তারই মতো স্লাভ একজন।…একবার দেখেই একজন স্লাভ অন্য স্লাভকে চিনে নিতে পারে।… লিভোনিয়ার পুলিশ যে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই কলওলা বুঝতে পেরেছিলো।…কেন তাড়া করছে, তা সে জানতে চায়নি, কিন্তু তাই বলে সারজেন্ট য়েক আর তার দলবলের হাতেও তাকে তুলে দিতে চায়নি সে।
নেমে এসো নিচে, চাপা গলায় বললে কলওলা।
বুকের মধ্যে তার যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। আবেগে তার সারা গা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। চুপচাপ সে নেমে এলো নিচে। নিচের তলার একদিকের দরজা খোলা।
এই রইলো কিছু খাবার, তার থলির মধ্যে কিছু শুকনো মাংস আর রুটি ভরে দিলে কলওলা। থলিটায় কিছু নেই, আগেই দেখেছিলুম।…ফ্লাস্কটাও তো ফাঁকা…ওটাও ভরে নাও, তারপর কেটে পড়ো…
কিন্তু…পুলিশ যদি জানতে পারে…
চেষ্টা কোররা তাদের এড়িয়ে চলতে। আর আমার কথা? ও নিয়ে কিছু ভেবো না…আমি জানতেও চাই না তুমি কে…আমি শুধু জানি যে তুমি একজন স্লাভ, আর একজন স্লাভকে কি আরেকজন কখনো আলেমান পুলিশের হাতে তুলে দেয়!
ধন্যবাদ…ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতায় ফেরারির গলা বুজে এলো।
তাহলে তুমি এসো, ছোটো বাবা। ভগবানই যেন তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান…তিনিই তোমাকে ক্ষমা করবেন, অবিশ্যি যদি তুমি ক্ষমা চাওয়ার মতো কোনো অপকর্ম করে থাকো!
+
আবার অন্ধকারে ঢাকা রাত্রি। উঁচু ঢিবিটার তলা দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে রাস্তা-ফাঁকা রাস্তা–কেউ কোথাও নেই। ফেরারি কলওলার দিকে পিছন ফিরে শেষবার হাত নেড়ে বিদায় নিলে, তারপর হনহন করে চলতে শুরু করে দিলে।
এই যে নতুন রাস্তাটা সে বেছে নিয়েছে, তাতে তাকে আজ রাত্তিরের মধ্যে ফাললেন পৌঁছুতে হবে; পৌঁছে সেখানে দিনটা কাটিয়ে দেবার মতো একটা গোপন ও নিরাপদ আশ্রয়ও খুঁজে বার করতে হবে। চব্বিশ মাইল… মনে মনে সে হিশেব করলে: চব্বিশ মাইল পেরুতে হবে তাকে আজ রাত্তিরে। তারপরে আর মাত্র ছত্রিশ মাইল বাকি থাকবে পেরনাউ-এর। আরো দুটো রাত; যদি দুমকরে হঠাৎ সব পরিকল্পনা ভেস্তে না যায়, তাহলে ১১ই এপ্রিল মাঝরাত্তির নাগাদ গিয়ে পৌঁছুতে পারবে পেরনাউ-এ। সেখানে তারপর লুকিয়ে থাকতে হবে তাকে যতদিন না কোনো জাহাজে গিয়ে ওঠবার সুযোগ আসে, ততদিন তাকে সেখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। বরফ গলে গেলেই অবিশ্যি বলটিকের জলে একের পর এক জাহাজ ছাড়বে–তার যে কোনো একটায় জায়গা সে পাবেই।
হনহন করে এগুচ্ছে সে, এইভাবে এগুতে পারলে ভাবনা নেই। এই পথে পড়ছে ফাঁকা সমভূমি, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, আবার হঠাৎ কালো বনের ছায়ায় পথ গেছে এঁকেবেঁকে। কখনো-বা ছোটো টিলার তলা দিয়ে ঘুরে যেতে হচ্ছে, সাবধানে কাটাতে হচ্ছে সংকীর্ণ একেকটা খাদ, কখনো বা পেরিয়ে যাচ্ছে। গ্র্যানাইট পাথরের ধার ঘেঁষে বয়ে চলা জমাট নদী, গাছপালার তলায় নদীর স্রোতকে কে যেন তিষ্ঠ বলে আঙুল তুলে থামিয়ে দিয়েছে, ঠাণ্ডায় জমিয়ে দিয়েছে। লেক পেইপুসের কাছে, পায়ের তলার বরফ ছিলো নিরেট, শুকনো, জমাট বাঁধা–এখানে মাঝে মাঝে পা পিছলে যাচ্ছে–বরফ গলা শুরু হয়েছে বলে। মাঝে মাঝে, অনেকক্ষণ পরে-পরে, দেখা দিচ্ছে ঘুমন্ত গ্রাম, আশপাশের বরফ-ঢাকা মাঠ।
তাপমাত্রা বেশ বেড়ে যাচ্ছে। আদ্ধেক-গলা বরফ প্রায় যেন কাদাজল হয়ে গেছে। এ-বছর বরফ গলবে খুব তাড়াতাড়ি।
ফাললেন-এ পৌঁছুবার আগেই, ভোর রাতে, পাঁচটা নাগাদ ফেরারি এসে পৌঁছলো একটা ফাঁকা ও পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপের ধারে। এখানেই তো সে লুকিয়ে থাকতে পারে। কলওলা যে রুটি-মাংস দিয়েছিলো তাতেই দিব্যি চাঙ্গা হয়ে নেয়া যাবে–একটু ঘুমিয়ে নিলে তো কথাই নেই, বেশ ঝরঝরে ও হালকা লাগবে।
সারাদিন ঘুমিয়ে কাটালো সে, গভীর ক্লান্তিহরণ ঘুম। তারপর সন্ধে ছটা নাগাদ আবার সে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। পেরনাউ আরো ছত্রিশ মাইল। দূরে–আজ ৯ই এপ্রিল রাত্তিরে যদি আদ্ধেকটা পথ পেরিয়ে যেতে পারে, তাহলে আর মাত্র একটা রাত লাগবে–তার পরেই…
তাই হলো। সকালবেলায় তাকে থামতে হলো আবার, কিন্তু এবার তেমন সুবিধের কিছু পেলো না বলেই আশ্রয় নিতে হলো রাস্তার ধারের পাইন গাছের বনে। কোনো সরাইখানা বা খামারবাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম ও খাদ্য চাইবার চেয়ে এটা অনেক ভালো–অনেক ঝক্কি কম। ওই কলওলার মতো সদয় গৃহস্বামী তো আর সুলভ নয় সবখানে।
বিকেলবেলায় সে বসে আছে ঝোঁপের মধ্যে গুঁড়ি মেরে, হঠাৎ দেখতে পেলে একদল পুলিশ পেরনাউ-এর রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। পাইন বনের কাছে এসে পুলিশবাহিনী একটু থমকে দাঁড়ালে–আস্ত পাইন বনটাই তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবে কিনা, হয়তো সেই কথাই ভাবলে একবার। কিন্তু তারপর, একটু বিশ্রাম করে, তারা আবার রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলো।
সন্ধেবেলায় ছটা নাগাদ ফেরারি আবার রাস্তায় নেমে পড়লো। নির্মেঘ আকাশ, ভরা চাঁদ উঠেছে আকাশে, হাসছে যেন তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি। রাত তিনটে নাগাদ পেরনোভ নদীর বাম তীরে এসে পৌঁছুলো সে–পেরনাউ আরো তিন মাইল উজানে। এগুতে গিয়েই এসে পৌঁছুলো শহরতলিতে। ছোটখাটো একটা সরাইখানায় গিয়ে দিন কাটালে কেমন হয়, সে ভাবলে একবার।
পেরনোভা নদীর বরফ গলে যাচ্ছে, বড়ো-বড়ো বরফের চাঙড় স্রোতে ভেসে চলে যাচ্ছে উপসাগরের দিকে-দেখে তার ভারি ভালো লাগলো। আর কয়েকটা দিন কেবল, তার পরেই শেষ হবে তার এই অন্তহীন কুচকাওয়াজ, এই লম্বা পথ হাঁটা, তার পরেই শেষ হবে সব বিপদ-আপদ, সব অবসাদ।
অন্তত এই কথাই সে ভেবেছিলো।
হঠাৎ উঠেছিলো চিৎকারটা। ঠিক লেক পেইপুসের ধারে সে যে সম্ভাষণ শুনেছিলো ঠিক তেমনি একটা মুচমুচে টিউটনিক চিৎকার হ্বের ডা? হুকুমদার! কিন্তু এবার সম্ভাষণটা কোনো কাস্টমসের লোকের মুখ থেকে বেরোয়নি।
একদল পুলিশ নিয়ে যেন মাটি খুঁড়ে এসে হাজির হয়েছে সারজেন্ট য়েক, এই রাস্তায় তারা টহল দিচ্ছিলো।
ফেরারি কেবল থমকে দাঁড়িয়েছিলো এক মুহূর্ত, তারপরেই লাফিয়ে নেমে গেলো টিলা থেকে।
ঐ যে—ঐ লোকটা, চেঁচিয়ে বললে একজন।
জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো সব-চোখের আড়ালে যাবে কী করে এই চাঁদের আলোয়! য়েক আর তার শাগরেদরা তাড়া করে ধেয়ে এলো পিছন-পিছন। কিন্তু এখন, এতদিন পরে, অবসাদে তার হাঁটুর জোড় যেন খুলে যেতে চাচ্ছে—কিছুতেই সে জোরে ছুটতে পারছিলো না। এই পুলিশদের হাত থেকে ছুটে সে পালাবে কী করে? তারা তো আর তার মতো রাতের পর রাত মাইলের পর মাইল পথ হাঁটেনি।
মরবো, কিন্তু ধরা দেবো না—কিছুতেই না! সে ঠিক করে ফেললে।
নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলো একটা মস্ত বরফের চাঁই—তীর থেকে পাঁচ-ছ গজ দিয়ে। মস্ত লাফ দিলে সে, প্রকাণ্ড; লাফিয়ে গিয়ে পড়লো সে তার উপর!
গুলি চালাও! গুলি! য়েক চেঁচিয়ে উঠলো।
গুড়ুম! গুড়ুম? গর্জে উঠলো চারটে রিভলবার-ভাঙন-ধরা বরফের উপর গিয়ে পড়লো গুলিগুলো।
ফেরারি গিয়ে উপরে পড়তেই বরফের মস্ত চাঙড়টা জলের উপর এক পাক ঘুরে গেলো, তার পরেই স্রোতে ভেসে চলে গেলো দূরে। বরফ গলার সময় পেরনোভার জলে স্রোত থাকে দারুণ।
য়েক আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা নদীর তীর ধরে তাড়া করে এলো— বেশ অসুবিধেই হচ্ছিলো ছুটতে, চলন্ত বরফের চাঙড় লক্ষ করে ঠিকমত তাগ করাও যাচ্ছিলো না। বরং যাকে তারা ধাওয়া করছে তারই মতো লাফিয়ে-লাফিয়ে বরফের চাঙড়গুলোর উপর দিয়ে যেতে পারতো তারা।
চেষ্টা করতে তারা ছাড়লে। য়েক লাফিয়ে এলো সব আগে, পিছন-পিছন অন্যরা। হঠাৎ এমন সময় দারুণ একটা হুলুস্থুল উঠলো। নদী যেখানে সরু হয়ে গিয়ে ডানদিকে বাঁক ফিরেছে, সেখানে কয়েকটা ভাসমান বরফের চাঙড়ের সঙ্গে ফেরারিসমেত বরফের চাঙড়টার লাগলো এক বিষম ধাক্কা। চাঙড়টা তক্ষুনি এ-কাৎ হলো, ও-কাৎ হলো, পাক খেলা, আবার চাপা পড়ে মিলিয়ে গেলো। নদীর সরু বাঁকে অনেকগুলো মস্ত বরফের চাঙড় এসে আটকে পড়ে বাঁধের সৃষ্টি করেছিলো।
বরফের চাঙড়টা আটকে যেতেই পুলিশেরা এদিক-ওদিক দিয়ে ছুটে এলো। এক ঘণ্টা ধরে তন্নতন্ন করে তাকে খুঁজলো তারা। কেউ কোথাও নেই—শুধু শাদা তুষারমরু পড়ে আছে খাঁ খাঁ। ধাক্কা লেগে বরফের চাঙড়টা যখন উলটে পড়েছিলো, তখনই নিশ্চয়ই সে মারা গেছে।
জ্যান্ত ধরতে পারলে হতো লোকটাকে… প্যানপ্যান করলে একটি পুলিশ।
জ্যান্ত ধরতে পরলে তো হতোই, বললে সারজেন্ট য়েক, কিন্তু জ্যান্ত যখন তাকে পাকড়ানো গেলো না, তখন মৃতদেহটা পেলেও চলবে—তারই চেষ্টা করতে হবে আমাদের।
———
* ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার সাধারণ লোকেরা সাধারণতঃ পরস্পরকে ছোটো বাবা বলেই সম্বোধন করতে, আর স্ত্রীলোক হলে বলতো ছোটো মা।