মদনভস্ম
উৎসর্গ-
কল্যাণীয়া করবী গুপ্ত (সীপু)
আশীর্বাদক বাবা
.
এই পুস্তকে বর্ণিত কোনও চরিত্রের সঙ্গে জীবিত বা মৃত কোন চরিত্রের কোন সম্পর্ক নাই এবং কোনও ঘটনা বা স্থানের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক নাই।
-লেখক।
.
০১.
জবানবন্দী দিচ্ছিল সুসীম। বিষণ্ণ ম্লান মুখখানির দিকে তাকালে মনে হবে মাত্র কিছুক্ষণ আগেই বুঝি তার উপর দিয়ে। একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। অসহায় চোখের দৃষ্টি যেন যে-কোন একটা অবলম্বন খুঁজছিল।
অদূরে দাঁড়িয়েছিলেন সুসীমের ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ। আর মুখোমুখিই প্রায় একটা চেয়ারে বসে থানা-অফিসার সাধন দত্ত একটির পর একটি প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন।
কতদিনের পরিচয় ছিল আপনাদের?
অনেক দিনের। মৃদুকণ্ঠে প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে পার্শ্বেই দণ্ডায়মান হরপ্রসাদের দিকে একবার তাকাল সুসীম।
হরপ্রসাদও সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন, হ্যাঁ, অনেক দিনের পরিচয় ওদের।
তবু কত দিনের?
তা ধরুন বারো বছর তো হবেই। কি বল সুসীম! হরপ্রসাদ সুসীমকেই যেন পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, তা হবে।
বারো বছর অনেক দিন বলুন!
হ্যাঁ, অনেক দিনের আলাপ ছিল ওদের পরস্পরের। কতকটা যেন পুনরাবৃত্তির মতই কথাটা বললেন হরপ্রসাদ।
হুঁ।
মনে হলো সাধন দত্ত যেন কি ভাবতে লাগলেন আপন মনেই।
মিঃ দত্ত!
সুসীমের মৃদুকণ্ঠের ডাকে মুখ তুলে তাকালেন সাধন দত্ত।
আমি এবারে বাইরে যেতে পারি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—যাবেন বৈকি, যান না।
সুসীম ঘর থেকে বের হয়ে আসবার জন্য পা বাড়াতেই সাধন দত্ত বললেন, সুসীমবাবু, আপনার স্ত্রীকে যদি এ ঘরে একবার পাঠিয়ে দেন!
সুসীম কিছু বলবার আগেই হরপ্রসাদ বললেন, নিশ্চয়ই, আমি ডেকে আনছি শ্রাবণীকে।
সুসীম আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ঘরে একাকী শ্রাবণী বসেছিল।
পরিধানে বৌভাতের দামী সবুজ বেনারসী শাড়ি। গলায় জড়োয়ার হীরা ও মুক্তা বসানো হার, হাতে হীরা বসানো বালা, কানে হীরার কর্ণাভরণ। লাল শাঁখা, লোহা, রুলিও ছিল হাতে। কপাল জুড়ে সযত্ন-অঙ্কিত চন্দন-তিলক।
রাত্রি শেষ হয়ে আসছে।
খোলা জানালাপথে বাইরের সেই তরল অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল শ্রাবণী।
সুসীমের নববধূ শ্রাবণী।
হরপ্রসাদ এসে ঘরে ঢুকলেন।
হরপ্রসাদের পদশব্দে ফিরে তাকাল শ্রাবণী।
শ্রাবণী, মিঃ দত্ত তোমাকে আর একবার ডাকছেন।
কেন?
তা তো ঠিক জানি না। চল একবার।
জামাইবাবু?
বল?
কিছু জানতে পারা গেল?
কি?
কে—মানে বলছিলাম, কে তাঁকে হত্যা করলো?
না।
এখনো জানতে পারা গেল না?
না।
জানতে নিশ্চয়ই পারা যাবে না—
তা জানতে হবে বৈকি।
কিন্তু-–
কিছু বলছিলে?
না, কিছু না—চলুন।
হরপ্রসাদের পিছনে পিছনে ঘর থেকে বের হয়ে এলো শ্রাবণী।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপরের যে ঘরে সাধন দত্ত বসেছিলেন, হরপ্রসাদের সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় সেই ঘরে এসে ঢুকল শ্রাবণী।
আসুন মিসেস্নাগ। আবার আপনাকে বিরক্ত করতে হলো বলে আমি দুঃখিত। বসুন–
যন্ত্রচালিত একটা পুতুলের মতই যেন শ্রাবণী এগিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট খালি চেয়ারটায় সাধন দত্তর মুখোমুখি বসল।
আচ্ছা মিসেস্ নাগ, সে-সময় একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে মনে ছিল না আমার—
চোখ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল শ্রাবণী সাধন দত্তর মুখের দিকে নিঃশব্দে।
আপনি আপনার জবানবন্দীতে বলেছেন সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে আপনার পূর্বে পরিচয় ছিল–
হ্যাঁ।
কি সূত্রে আপনাদের পরিচয়?
কিছুদিন এক কলেজে পড়েছিলাম—
কিছুদিন মানে কতদিন হবে?
তা তিন বছর হবে।
ঘনিষ্ঠতা ছিল কি আপনাদের মধ্যে?
না। তাকে—তাকে আমার কোনদিনই ভাল লাগে নি।
ভাল লাগে নি! কেন?
তা-তা আমি বলতে পারবো না। তবে—তবে তাকে কখনো আমার ভাল লাগে নি। তবু–তবু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ দত্ত, আমি কখনো চাই নি তার এভাবে মৃত্যু হোক।
হুঁ। আচ্ছা মিসেস, নাগ, আপনাদের বিবাহের পূর্বে আপনার স্বামীর সঙ্গে যে সুনন্দা চ্যাটার্জীর পূর্ব-পরিচয় ছিল, আপনি কি তা জানতেন?
জানতাম।
খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল নাকি ওদের শুনলাম!
আমিও তাই জানতাম।
আর একটা কথা, আপনি ঠিক জানেন—আপনাদের আজকের এই উৎসবে আপনার স্বামী তাকে প্রথমে নিমন্ত্রণ করেন নি?
জানি করে নি—
তারপর যেচে সে যে নিজে থেকে নিমন্ত্রণ নিয়েছিল—এ কথাটা কি আপনি শুনেছিলেন?
শুনেছি। আমার স্বামীই কাল রাত্রে আমাকে বলেছিল।
আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, যেচে হঠাৎ অমন করে কেন সে নিমন্ত্রণ নিতে গেল?
কি করে বলবো!
আজ এখানে আসবার পর আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই তার দেখা হয়েছিল?
হয়েছিল।
কথাবার্তাও হয়েছিল নিশ্চয়ই?
হয়েছিল।
ও সম্পর্কে আপনাদের মধ্যে কোন কথা হয় নি?
না।
আপনি নিশ্চয়ই তার ঐভাবে যেচে নিমন্ত্রণ নিয়ে এখানে আসায় খুশি হতে পারেন নি!
সেটাই তো স্বাভাবিক।
তা বটে। আর একটা কথা—
বলুন।
এ ব্যাপারে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
না।
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।
শ্রাবণী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
দোতলার বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে শ্রাবণী লক্ষ্য করল, তার স্বামী সুসীম রেলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু কি জানি কেন, স্বামীকে যেন দেখেও দেখলোনা শ্রাবণী। নিজের ঘরের দিকেই সে চলে গেল।
সুসীমও শ্রাবণীকে দেখে যেন ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারল না।
চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলো।
.
মৃত্যু মানুষের জীবনে একান্তই স্বাভাবিক ঘটনা নিঃসন্দেহে।
কিন্তু তবু সেই মৃত্যুকেই মনে হয় অস্বাভাবিক, যখন অকস্মাৎ বিনা নোটিশে এসে হাজির হয়। শুধু অস্বাভাবিকই নয়, যেন একেবারে অকস্মাৎ বিমূঢ় করে ফেলে।
সুনন্দা চ্যাটার্জীর আকস্মিক মৃত্যুটাও ঠিক তেমনি করেই বাড়ির মধ্যে অতগুলো লোককে যেন একেবারে অভিভূত, বিমূঢ় করে দিয়েছিল মুহূর্তে। কিছুক্ষণের জন্য সকলে যেন একবারে বোকা বনে গিয়েছিল।
লর্ড বায়রনের সেই বিখ্যাত কবিতার ঘটনা–ভিসন অফ ব্যালসেজারের মতোই সুনন্দার মৃত্যুটা অমোঘ নিষ্ঠুর এক অদৃশ্য হাতে যেন লেখা হয়ে গেল!
সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
ঐ যে বিরাট হলঘরটার এক কোণে দামী সোফাটার উপরে হেলান দিয়ে এখনো বসে আছে সুনন্দা চ্যাটার্জী, শুধু মাথাটা বুকের সামনে ঝুলে পড়েছে করুণ অসহায় এক ভঙ্গিতে—
ঐ সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত। মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বেই অমোঘ নিষ্ঠুর সত্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে–সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
পরিধানে দামী সাদা ইটালীয়ান সিফনের শাড়ি, গায়ে ডি রেড় ভেলভেটের ব্লাউজ, কনুই পর্যন্ত হাতা। চোখেমুখে সূক্ষ্ম একটা প্রসাধনের প্রলেপ। তার জামাকাপড় সর্বাঙ্গ থেকে এখনো ঘরের বাতাসে ভাসছে তার প্রিয় সেন্ট কালিফোর্নিয়ান পপির মৃদু মিগ্ধ সুবাসটা। মাথার খোঁপাটা ভেঙে ঘাড়ের পাশে লুটিয়ে পড়েছে। এক হাত নিরাভরণ, অন্য হাতের সুডৌল মোমের মত মসৃণ মণিবন্ধে দামী সোনার ওমেগা রিওয়াটা এখনো টিটি করে চলছে। সব ঠিক তেমনিই আছে, শুধু সুনন্দার ঐ দেহের মধ্যে প্রাণটুকুই নেই।
সুনন্দা মৃত।
একটু আগেও নাকি বিশাখা হলঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সুনন্দার উচ্ছ্বসিত হাসি শুনেছিল। মৃত সুনন্দা চ্যাটার্জী—তবু এখনো তার সেই যৌবন-ঢলঢল-দেহ ঠিক তেমনিই আছে।
মৃত্যু কখন এসেছিল এবং নিঃশব্দে এসে কখন বাড়িভর্তি এতগুলো আমন্ত্রিত লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সুনন্দার মোমের মতো নরম এবং শঙ্খের মতো ধবল গ্রীবায় সরু সাদা ঐ সিল্ক কর্ডের ফসটি লাগিয়ে যে তাকে চিরতরে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখে গিয়েছে সেটাই কেউ জানতে পারে নি।
শুধু আশ্চর্যই নয়, বিস্ময়কর। তবু সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
একদা প্রথম যৌবনে যাকে ঘিরে কত হতভাগ্য যুবক আশা-আকাঙ্ক্ষা আর কল্পনার জাল বুনেছে এবং তাদের সে আশা-আকাঙ্ক্ষা আর কল্পনাকে নির্মম নিষ্ঠুর ব্যঙ্গোক্তিতে রূঢ় প্রত্যাখ্যান জানালেও মরীচিকার মত যার পিছনে পিছনে তারা ঘুরেছে আর ঘুরেছে—এই সেই সুনন্দা চ্যাটার্জী। শোনা যায় তেত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত কোন পুরুষ তাকে স্পর্শ করা দূরে থাক নির্দিষ্ট একটা ব্যবধান ছাড়া কাছে গিয়ে দাঁড়াবারও সাহস পায় নি। তেত্রিশটি বসন্ত তার রুদ্ধ দ্বারে ব্যর্থ আঘাত হেনে ফিরে গেলেও সুনন্দার দিকে চাইলে মনে হবে-যৌবন বুঝি ওর দেহে অষ্টাদশীর মতোই অটুট। দীর্ঘদিন ধরেই সে দেহচর্চার সঙ্গে লাঠি ছোরা আর যুযুৎসু বিদ্যায়ও পারদর্শিনী হয়ে উঠেছিলো, তাই ছেলেরা বরাবরই বলে এসেছে—ও মেয়ে নয়, আগুনের শিখা।
সেই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে কিনা অমনি করে সরু একটা সিল্ক কর্ডের ফাঁসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে হলো!
এর চাইতে অভাবিত, বিস্ময়কর আর কি ঘটতে পারে?
কিন্তু অভাবিতই হোক আর বিস্ময়করই হোক, সুনন্দা মৃত।
রাতও বেশি নয়—মাত্র সাড়ে এগারটা। তাও গ্রীষ্মের রাত্রি সাড়ে এগারটা। উৎসবের বাড়িতে রাত সাড়ে এগারটা তো রাতই নয়। তখনো আমন্ত্রিতদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পৌঁছায় নি বলেই সুসীম নিচের করিডোরে নিজেই অভ্যর্থনা করবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। উৎসবটা তারই বৌভাতের।
এ-কান ও-কান হতে হতে তার কানে গিয়ে সংবাদটা পৌঁছাতেই দ্রুতপদে সুসীম উপরে উঠে আসে।
এবং হলঘরটার মধ্যে ঐ সময় যারা মূক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদেরই মধ্যে বান্ধবী বিশাখাকে সামনে দেখে তাকেই প্রশ্ন করে, কি–কি ব্যাপার?
বিশাখা ততক্ষণে বোধ হয় নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিল কিছুটা। সে বলে অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠে, যেন একপ্রকার ফিসফিস করেই, সুনন্দা ইজ ডেড!
ডেড!
যেন ভূত দেখার মতই হঠাৎ চমকে ওঠে কথাটা বলে সুসীম।
সি হ্যাজ বিন ব্রুটালি মার্ডারড!
সত্যি-সত্যি–
এবারে বিশাখা চোখের ইঙ্গিতে অদূরে সোফার উপরে উপবিষ্ট ভঙ্গিতে বসা সুনন্দার মৃতদেহটা দেখিয়ে দিল।
সেই দিকে তাকিয়ে যেন মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় সুসীম।
কয়েক মুহূর্ত সেই নিপ্রাণ দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পায়ে সোফাটার সামনে এগিয়ে যন্ত্রণাকাতর রুদ্ধকণ্ঠে বলে, হাউ অ্যাবসার্ড! নো, নো–দ্যাট কান্ট বি–কান্ট বি—
বিরাট হলঘরটি ফুলে আর লতাপাতায় এবং অত্যুজ্জ্বল সব ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ঝলমল করছে। মেঝেতে দামী কার্পেট বিছানো। চারপাশে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ মূক সব সুসজ্জিত আমন্ত্রিত নরনারীর দল।
সুসীম যেন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে চারিদিকে একবার চোখ তুলে তাকালো। সুনন্দা যে তার গৃহে আজ অভ্যাগতা—অতিথি!
বলতে গেলে সবার আগে সেই বিকেলেই এসেছে সুনন্দা!
মাত্র মাসখানেক পূর্বের সেই ব্যাপারের পরও সুনন্দা যে একপ্রকার নিজে থেকে যেচেই নিমন্ত্রণ নিয়ে তার বিবাহের উৎসবে আসবে, সুসীম তা বিশ্বাস কেন—ভাবতেও বুঝি পারে নি।
আর ভাবতে পারে নি বলেই নিজে তো সুনন্দার কাছে যায়ই নি, নিমন্ত্রণের একটা চিঠি পাঠাবার কথাটা পর্যন্ত ভাবতে পারে নি, সাহস পর্যন্ত হয় নি।
কারণ সুসীমের চাইতে কে আর বেশী করে চিনত সুনন্দাকে!
মনশ্চক্ষে যেন সুসীম স্পষ্ট দেখেছিল সেই ধনুকের মতো ভ্রূ ঈষৎ উত্তোলিত করে সামনের উপরের পাটির দাঁত দুটো দিয়ে নীচের ওষ্ঠটা কামড়িয়ে ধরে ক্ষণকাল মুখের দিকে চেয়ে থেকে সুনন্দা জবাব দিচ্ছে তার স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে ও কণ্ঠস্বরে, সুসীম বুঝি ভেবেছিলে দেশাচার আছে বলেই নিমন্ত্রণ করবার অধিকারটাও সকলেরই সকলকে আছে!
আজ সুসীমও ঐ কথার পর সহসা পরমুহূর্তেই কোন জবাব জুগিয়ে উঠতে পারত না নিজের ওষ্ঠে। আর সুনন্দাও তাকে কেবল এটুকু বলেই নিষ্কৃতি দিত না।
পরমুহূর্তেই বলতো, তা এসেছে যখন–সামাজিকতা আমারও করা কর্তব্য, কি বল? আমার ড্রাইভার মহীন তো তোমার বাড়ি চেনে, সেই যাবেখন লৌকিকতাটুকু সেরে আসতে। হ্যাঁ দেখো, ভুলে যেও না যেন আবার ওকে দুটো খাইয়ে দিতে!
তারপর কি আর দাঁড়াতে পারত সীম?
সেদিনকার মতোই হয়তো অসহ্য অপমানে আর হিংস্র একটা আক্রোশে—ঠিক যাকে বলে একেবারে ফেটে পড়তে সে এবং সেদিনকার মতোই ইতর বলে বের হয়ে আসা ছাড়া উপায়ই বা শেষ পর্যন্ত কি আর থাকত তার! তাই তো সে যায় নি। অথচ রীতিমত পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত সকলকেই সুসীম নিমন্ত্রণ করেছিল তার বিবাহহাৎসবে, করেছিল অবিশ্যি দুটো কারণে।
প্রথমতঃ সে পুরুষ। সৌভাগ্যবান্ কৃতী পুরুষ। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। অর্থে, বিদ্যায়, স্বাস্থ্যে, পরিচিতিতে—কিসে নয়?
সব দিক দিয়েই সে যখন প্রতিষ্ঠিত, তখন বয়সটা আটচল্লিশ বছর হয়েছে বলেই যে তার ভাগ্যে মনের মতো এবং দশজনকে দেখাবার মতো বৌ জুটবে না, এ কথাটা যে কত বড় মিথ্যে সেটা প্রমাণিত করার এই একটা মস্ত সুযোগ এবং দ্বিতীয়তঃ সুনন্দাকেও বুঝিয়ে দেওয়া যে সুসীমের মত স্বামী-সৌভাগ্য সুনন্দার ছিল না!
কিন্তু সত্যিই কি তাই? এ বিয়েতে কি সে মনের মধ্যে সত্যিকারের তৃপ্তি পেয়েছে? নিশ্চয়ই পায় নি। আর যাকেই ফাকি দেওয়া যাক না, নিজের মনকে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না! নইলে শ্রাবণীর মতো মেয়েকে বধূরূপে পাচ্ছে জেনেও বিয়ের আগের রাত্রে কেন নিদ্রাহীন রাত্রি কেটেছিল তার?
বাসরঘরের নির্জনতার মধ্যেও কেন সে শ্রাবণীর মুখের দিকে সহজভাবে তাকাতে পারে নি? নিজের মনকে বার বার কেন বোঝাতে হয়েছে নিজেকে, আমি ঠকি নি—আমি ঠকি নি!
বধূসহ গৃহে প্রত্যাগমন করেও কেন সে ঝিম মেরে ছিল?
কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছিল না!
.
কাল বৌভাতের উৎসব বাড়িতে। আত্মীয়স্বজনে বাড়িটা গমগম করছিল। রাত বোধ করি তখন বারোটা বেজে গিয়েছে। অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছিল সুসীম নিজেকে। শুতে যাবে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো।
ঘরে সে-সময় কেউ ছিল না, নইলে সুসীম নিশ্চয়ই ফোনটা ধরত না। ভাগ্যে কেউ ঐ সময় ঘরে ছিল না!
একান্ত অনিচ্ছায় শিথিল হাতে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়েছিল সে, হ্যালো! সসীম?
সুসীম?
পরিচিত-অত্যন্ত পরিচিত সেই নারী কণ্ঠস্বর সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বইয়ে দেয় সুসীমের শিরায় শিরায়।
সোজা হয়ে বসে সুসীম, কে সুনন্দা?
আশ্চর্য তো, তুমিই ঠিক ফোনটা ধরলে! সুনন্দার সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর পুনরায় শোনা গেল।
হ্যাঁ, আমিই।
খুব ব্যস্ত বুঝি?
না না, ব্যস্ত কি–
আজ তো তোমার কালরাত্রি, তাই না?
কালরাত্রি কথাটা প্রথমটায় ঠিক যেন বুঝতে না পেরে পুনরাবৃত্তি করে সুসীম, কালরাত্রি!
তাই তো বলে আজকের রাতটাকে?
এতক্ষণে কথাটা বুঝতে পেরে সুসীম বলে, ও হ্যাঁ!
বেহুলার স্বামীকে কালনাগিনী দংশেছিল এই রাত্রে, তাই এই রাতটাকে বলে কালরাত্রি। তা কই—আমাকে তো নিমন্ত্রণও করলে না!
তুমি—কথাটা বলতে গিয়েও যেন বলতে পারে না সুসীম।
যাই বা না যাই, চিঠিও তো একটা দিতে পারতে ডাকে—প্রজাপতি-মার্কা! বুকপোস্টে দুপয়সার ডাকটিকিটের বেশী তো কিছু আর খরচ হতো না!
সুসীম চুপ করে থাকে।
অন্য পক্ষ আবার বলে, কি, চুপ করে রইলে যে?
তারপর একটু থেমে আবার সুনন্দা বলে, বুঝতে পেরেছি—
কী?
কেন তুমি আমাকে নিমন্ত্রণ করো নি।
কেন?
আমার উপস্থিতিতে তোমার শ্রাবণী যদি সবার চোখে ছোট হয়ে যায় সেই ভয়ে। কারণ তুমি তো জানই, আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হবে না!
তার মানে?
তুমি যে—
কি?
না, থাক।
কেন, শুনিই না?
সত্যি বল তো সুসীম, তুমি যে শ্রাবণীর জীবনে চতুর্থ পুরুষ, সে কথাটা কি সত্যিই তুমি জান না?
শ্রাবণীর আমার পূর্বে আর কোন স্বামী ছিল বলে তো শুনি নি!
কি একটা কথা বললে বল তো সুসীম! বিয়ে করার পর পুরুষ নাকি বোকা হয়ে যায় শুনেছি, কিন্তু তুমি যে দেখছি বিয়ের পর এক রাত্রি বৌয়ের সঙ্গে বাস করেই বোকা হয়ে গেলে!
তাই মনে হচ্ছে বুঝি?
নিশ্চয়ই। নইলে অন্তত তুমি কি করে ভাবলে আজকের দিনে কোন কুমারী মেয়ের জীবনে তার স্বামীই একমেবাদ্বিতীয় পুরুষ!
ও, এই কথা! কিন্তু যারা আমার বিশেষ পরিচিত তারা যে তোমার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় তাই বা ভাবছো কি করে?
মানে? গলার স্বরটা তীক্ষ্ণ ধারালো শোনালো সুনন্দার।
চমকে উঠলে যেন মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যি-সত্যিই এতে চমকাবার কি আছে? তুমি তো একটু আগেই বললে কোন কুমারী মেয়ের জীবনে, বিশেষ করে তেত্রিশ বছর বয়স পর্যন্তও যারা কুমারী, তাদের যদি কখনো বিয়ে হয়ই, সেই স্বামীই তার জীবনে প্রথম বা একমেবাদ্বিতীয় পুরুষ হতে পারে না!
ও, এই কথা! মৃদু হাসির সঙ্গে সুনন্দার কণ্ঠ থেকে কথাটা উচ্চারিত হয়। যাক, ওসব কথা যেতে দাও। সসীম পরক্ষণেই বলে, কাল আমার বৌভাতের উৎসবে যদি আসো তো সত্যই জেনো খুশী হব।
সত্যি বলছো খুশী হবে?
সত্যি।
সত্যি?
সত্যি, সত্যি, সত্যি। আসবে কিনা বল এখন!
যাবো।
কথা দিলে?
দিলাম।
.
০২.
মাথাটার মধ্যে তখনো যেন কেমন ঝিঁঝিম্ করছিল সুসীমের। এমন সময় সুসীমের ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ সামনে এসে দাঁড়ালেন, সুসীম!
কে? ও আপনি!
পুলিসে ফোন করে এলাম।
পুলিস!
হ্যাঁ। উই মাস্ট ইনফরম দি পুলিস! সর্বাগ্রে পুলিসকেই একটা সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন।
হরপ্রসাদের মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ঘরের চারিদিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো সুসীম, ইতিমধ্যে অত বড় হলঘরটা কখন যেন একেবারে খালি হয়ে গিয়েছে।
ঘরের মধ্যে সে ও হরপ্রসাদ ব্যতীত ঐ মুহূর্তে তৃতীয় আর কোন প্রাণীই নেই। এবং সোফার উপরে উপবিষ্ট ভঙ্গিতে রয়েছে সুনন্দার মৃতদেহটা। সুনন্দা মৃত! নতুন করে যেন আবার মনে পড়লো সুসীমের, সুনন্দা মৃত! সরু সাদা একটা সিল্ক কর্ডের সাহায্যে গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
.
নিকটবর্তী থানা-অফিসার সাধন দত্ত যখন এসে সুসীমের গৃহে পৌঁছলেন সংবাদটা পেয়ে, রাত তখন প্রায় দেড়টা।
সমস্ত বাড়িটা তেমনি সুসজ্জিত। ঘরে ঘরে তেমনি অত্যুজ্জ্বল সব আলো জ্বলছে। প্রায়। দেড়শত আমন্ত্রিত নানা বয়েসী নারী-পুরুষে তখনো বাড়িটা ভর্তি।
শুধু থেমে গিয়েছে সানাই। আর থেমে গিয়েছে অকস্মাৎ কোন যাদুমন্ত্রবলে যেন উৎসবগৃহের সমস্ত কলহাসি, গুঞ্জন। প্রায় দেড়শ নরনারী মূক, যেন একেবারে বোবা হয়ে একতলায়। সব ভিড় করে রয়েছে। দোতলা থেকে সবাই নীচে নেমে এসেছে।
এমন কি সুসীমের সব আত্মীয়স্বজন ও নববধূ শ্রাবণী পর্যন্ত নীচে চলে এসেছে। সকলের চলচ্ছক্তি তো বটেই, জিহ্বাও যেন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আর সুসীম—সে যেন কেমন অসহায়ের মতো নীচের হলঘরের পাশের লাইব্রেরী ঘরটার মধ্যে একাকী একটা সোফার উপরে বসে চোখ বুজে পড়ে আছে।
হরপ্রসাদই করিডোরে থানা-অফিসারের আগমন-প্রতীক্ষ্ণয় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিসের কালো রংয়ের ভ্যানটা এসে করিডোরের সামনে দাঁড়াতেই তিনি এগিয়ে গেলেন।
সাধন দত্ত ভ্যান থেকে নেমে হরপ্রসাদকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তাঁকেই প্রশ্ন করলেন, এটাই তো সুসীম নাগের বাড়ি?
হ্যাঁ, আসুন।
কি ব্যাপার বলুন তো?
সুসীম আমার শ্যালক, আজ তার বৌভাতের উৎসব ছিল এই বাড়িতে। তার এক পরিচিতা মহিলা সুনন্দা চ্যাটার্জী আজ এখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। তিনিই নিহত হয়েছেন।
ডেড বডি কোথায়?
উপরের হলঘরে—চলুন।
হরপ্রসাদই সাধন দত্তকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলার পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন আগে আগে। সাধন দত্ত তার পিছনে পিছনে সিঁড়ি অতিক্রম করে চললেন।
তা নিহত হয়েছে বলছেন?
হ্যাঁ, গলায় সরু একটা সিল্ক কর্ডের ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে ভদ্রমহিলাকে হত্যা করা হয়েছে।
বলেন কি? ফাঁস!
হ্যাঁ।
কোন ডাক্তারকে ডেকেছিলেন?
ডাক্তার একজন এখানে উপস্থিত আছেন।
দুজন এসে উপরের হলঘরে ঢুকলেন।
মৃতদেহ পরীক্ষা করে সাধন দত্ত অস্ফুট কণ্ঠে কেবল বললেন, হাউ হরি? সত্যিই যে ফাঁস লাগিয়েই মারা হয়েছে দেখছি! কিন্তু বাড়ি-ভর্তি এত লোকের মাঝখানে এঁকে এমনি ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হলো, আর কেউ আপনারা ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না?
তাই তো দেখছি—অসহায় ভঙ্গিতে যেন আমতা আমতা করে কথাটা বললেন হরপ্রসাদ।
নট ওনলি মিস্টিরিয়াস—আবিলিভে টু! কিন্ত কে প্রথমে ব্যাপারটা আবিষ্কার করলেন?
তা—তা তো ঠিক জানি না। এখানে আজ যারা উপস্থিত, সম্ভবতঃ তাদেরই মধ্যে কেউ।
আজকের উৎসবে আপনাদের এ বাড়িতে এসেছিলেন হয়তো বহু লোক এবং তাদের মধ্যে সকলে নিশ্চয়ই নেই?
প্রশ্নটা করে সাধন দত্ত হরপ্রসাদের মুখের দিকে তাকালেন।
না। কারণ যাঁদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই চলে গিয়েছেন। যারা এখনো আছেন তারা এক-চতুর্থাংশ হবেন—
অনেকেরই তাহলে এখনো খাওয়া-দাওয়া হয় নি?
না। এই ব্যাপারের পর—
হুঁ স্বাভাবিক। তাহলে বলতে পারছেন না—কে প্রথম ব্যাপারটা আবিষ্কার করেন?
না।
তা আপনার শ্যালক—এ বাড়ির মালিক সুসীমবাবু কোথায়?
নীচে আছে। বেচারা এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে—
হবারই তো কথা। তাকে একবারটি এ ঘরে ডেকে আনবেন?
নিশ্চয়ই। আমি এখুনি ডেকে নিয়ে আসছি।
হরপ্রসাদ কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
.
সাধন দত্ত হরপ্রসাদের অনুপস্থিতিতে ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন।
হলঘরের যেদিকটায় সোফার উপরে মৃতদেহ ছিল, সেদিকটায় চারটে প্রমাণ-সাইজের স্টীলের গডরেজের আলমারি সামান্য সামান্য ব্যবধানে পাশাপাশি দাঁড় করানো ছিল। এবং সেই আলমারিগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই আরো একটা ব্যাপার সাধন দত্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। আলমারির পিছনেই একটি সংলগ্ন বাথরুম এবং বাথরুমের দরজাটা তখনো খোলাই রয়েছে। বাথরুমটা কিন্তু অন্ধকার।
মুহূর্তকাল যেন সাধন দত্ত কি ভাবলেন, তারপরই পকেট থেকে টর্চ বের করে বাথরুমের মধ্যে প্রবেশ করতে যেতেই দরজার পাশে দেওয়ালে বাথরুমের আলোর সুইচটা তার নজরে পড়লো। হাত বাড়িয়ে সুইচটা টিপলেন, কিন্তু খুট করে একটা শব্দ হলো মাত্র, আলোটা জুললো না বাথরুমের।
হাতের টর্চটা জ্বেলেই সাধন দত্ত তখন বাথরুমের ভিতরটা দেখতে লাগলেন। ঝঝকে তক্তকে বড়লোকের বাড়ির বাথরুম। দুটো দরজা বাথরুমের, একটা ঐ হলঘরের সংলগ্ন—যে। দরজাপথে এইমাত্র সাধন দত্ত প্রবেশ করেছেন, আর দ্বিতীয় দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। হাত ধোবার বেসিন, মিরার, দেওয়ালের গায়ে ইউরিন্যাল, কমোড সবই আছে। এমন কি সোপকেসে সাবান ও টাওয়েলও আছে।
কিন্তু বাথরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই খুব মৃদু হলেও একটা কেমন মিষ্টি বিজাতীয় গন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল সাধন দত্তর। নাক দিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে টেনে টেনে গন্ধটা কিসের অনুভব করবার চেষ্টা করতে করতে আলো ফেলে ফেলে এদিক ওদিক ভাল করে তাকাতে তাকাতে অকস্মাৎ কমোডটার পাশেই সাদা মতো কি একটা সাধন দত্তর নজরে পড়লো।
কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে নীচু জিনিসটা তুলে নিতেই বুঝলেন সেটা একটা রুমাল। রুমালটা হাতে তুলে নিতেই বুঝতে পারলেন ঐ রুমালটা থেকেই সেই গন্ধটা আসছিল। মিষ্টি গন্ধ—গন্ধটা এবারে কিসের বুঝতে দেরী হলো না.সাধন দত্তর। ক্লোরোফরমের মিষ্টি গন্ধ।
রুমালটা পকেটে ঢুকিয়ে আরো কিছুক্ষণ বাথরুমটার চারিদিক ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেন সাধন দত্ত।
হলঘরে পুনরায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ওদিককার দরজাপথে হরপ্রসাদের সঙ্গে সুসীম এসে ঘরে ঢুকলো।
আপনিই এ বাড়ির মালিক সসীম নাগ? প্রশ্ন করেন সাধন দত্ত।
হ্যাঁ।
আপনারই বৌভাতের উৎসব আজ এ বাড়িতে ছিল?
হ্যাঁ।
কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন!
সুসীম বসলো।
সাধন দত্ত আবার প্রশ্ন শুরু করলেন।
উনি অর্থাৎ যিনি নিহত হয়েছেন তিনিও শুনলাম, হরপ্রসাদবাবুর কাছে, আজকের আমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ছিলেন!
হ্যাঁ।
ওঁর নাম শুনলাম সুনন্দা চ্যাটার্জী, তাই না?
হ্যাঁ।
কোথায় থাকেন উনি? এই কলকাতায়ই কি?
হ্যাঁ। তিলজলায় থাকে।
বিবাহিতা না অবিবাহিতা?
কুমারী?
হ্যাঁ।
কি করতেন উনি?
ক্যালকাটা গার্লস কলেজের ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপিকা ছিলেন।
আচ্ছা উনি যে মারা গিয়েছেন, সেটা সর্বপ্রথম কে টের পায়?
প্রথমে—প্রথমে বোধ হয় জানতে পারে মৃণাল—
মৃণাল!
আমার বন্ধু। সেও আজ এখানে উপস্থিত আছে।
হরপ্রসাদবাবু, মৃণালবাবুকে একটিবার এ ঘরে ডেকে আনতে পারেন?
মৃণাল আমাদের সঙ্গেই এসেছিল, বাইরে সে দাঁড়িয়ে আছে।
ও, তাই নাকি! হরপ্রসাদবাবু, তাঁকে ডাকুন তো ঘরে।
হরপ্রসাদ বললেন, ডাকছি। কথাটা বলেই হরপ্রসাদ ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং একটু পরেই মৃণালকে নিয়ে হরপ্রসাদ পুনরায় ঐ ঘরে ঢুকলেন।
ডাঃ মৃণাল সেন।
লম্বা-চওড়া রীতিমত বলিষ্ঠ চেহারা মৃণাল সেনের। এবং গায়ের রং শ্যাম হলেও চেহারায় ও চোখে-মুখে অপূর্ব একটা শ্ৰী আছে। পরিধানে শান্তিপুরী ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি। চোখে কালোমোটা সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
আপনার নাম মৃণাল সেন?
হ্যাঁ।
কি করেন আপনি?
ও ডাক্তার। জবাবটা দিল সুধীমই।
ডাক্তার! ভ্রূ-দুটো যেন মুহূর্তের জন্য কুঞ্চিত হলে সাধন দত্তর।
আপনি শুনলাম ডাক্তার সেন সুসীমবাবুর বন্ধু!
হ্যাঁ, অনেকদিনের বন্ধু আমরা। স্পষ্ট সহজ কণ্ঠে জবাব দেয় মৃণাল।
সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনারও পরিচয় ছিল, ডাক্তার সেন?
ছিল।
শুনলাম আপনিই নাকি প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারেন?
আমি! কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মৃণাল বলে, হ্যাঁ, আমিই–
ব্যাপারটা আমাকে ডিটেইলস্ বলবেন, ডাক্তার সেন?
অতঃপর মৃণাল যা বললো তা হচ্ছে?
নিমন্ত্রিতদের লাস্ট ব্যাচ তখন তেতলার ছাদে খেতে বসেছে। পাতে লুচি তরকারি পড়েছে, কিন্তু তখনও কেউ খেতে শুরু করে নি। কারণ যারা যারা সেই ব্যাচে বসবে, তাদের মধ্যে সকলে এসে পৌঁছায় নি আসরে।
মৃণালও ঐ লাস্ট ব্যাচে বসবে বলে ছাতে উঠে এসেছিল। এবং সুসীমই ঠেলেঠুলে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তুই হ্যাঁ, বসে পড় মৃণাল, আমি একবার নীচে যাই। সুসীম বলেছিল।
কেন, তুইও চল না—এই সঙ্গে বসে যাবি!
না রে, এখনো দেখছি কেউ কেউ আসেন নি—
তুইও যেমন! রাত কত হয়েছে জানিস? আর কেউ আসবে না, চল!
না। তুই হ্যাঁ, আমি আরো আধঘণ্টা দেখি।
মৃণাল অতঃপর উপরে চলে যায়। এবং ছাতে যেখানে খাওয়ার জায়গা হয়েছিল সেখানে পৌঁছে হঠাৎ এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুনন্দার কথা মনে পড়ে।
সুনন্দা তো কই তখনো খায় নি!
মৃণাল নীচে নেমে আসে সুনন্দাকে খোঁজবার জন্য। কারণ মৃণালকে সুনন্দা বলেছিল ফিরবার পথে যেন সুনন্দাকে সে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। কারণ সুনন্দার নিজের গাড়িটা সেদিন কারখানায় দেওয়ায় তাকে নাকি ট্যাক্সিতে আসতে হয়েছিল।
মনে পড়ে সুনন্দাকে সে ঘণ্টাখানেক আগে হলঘরের আলমারিগুলোর সামনে একটা সোফার উপরে বসে থাকতে দেখে শুধিয়েছিল, কি ব্যাপার, এখানে যে এভাবে দল ছেড়ে চুপচাপ বসে!
সুনন্দা জবাব দিয়েছিল, এমনি।
মনটা কেমন করছে বুঝি?
কেন?
মৃদু হেসে মৃণাল বলেছিল, না এমনিই বলছি—
আশ্চর্য তোমরা মৃণাল পুরুষরা, সত্যি—
কি রকম?
নিজেদের তোমরা এমন একটা উঁচু আসনে বসাতে অভ্যস্ত–
না না—আজকে ঝগড়া নয়, খালি পিস্-সন্ধি—
সুনন্দা হেসে ফেলে।
চল, ওঠো।
কোথায়?
চল বর্মা থেকে আমাদের এক কমন ফ্রেণ্ড এসেছে, নীচে তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
না তুমি যাও, অন্য এক সময় বরং আলাপ করা যাবে। তাছাড়া—
তাছাড়া আবার কি?
আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি।
বিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করে মৃণাল, অপেক্ষা করছে! কার জন্য?
কাল বলবো, আজ নয়।
বেশ। কালই তবে শুনবো।
মৃণাল আর দাঁড়ায় নি।
কিন্তু খাওয়ার পর ছাত থেকে হলঘরে এসে যখন সে ঢুকলো তখন হলঘর একেবারে খালি, কেবল সেই সোফাটার উপরে তেমনি তখনো একাকী বসে আছে সুনন্দা।
রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারটা।
সুনন্দা!বলে ডেকে কাছে এগিয়ে গিয়েই কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে যায় মৃণাল।
অস্বাভাবিক—অস্বাভাবিক মনে হয় সুনন্দাকে। আর একটু কাছে গিয়েই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে দেরি হয় না মৃণালের। এবং তারপর গায়ে হাত দিতেই সে সুনন্দার মৃত্যু সম্পর্কে স্থিরনিশ্চিত হয়।
তারপর? সাধন দত্ত শুধালেন।
ঠিক সেই সময় বিশাখা এসে হলঘরে ঢোকে।
বিশাখা তখনো ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি।
সে তাই কৌতুক করতে করতে এগিয়ে আসে, কি ব্যাপার, নিভৃতে দুজনে মুখোমুখি!
ফিরে তাকায় মৃণাল বিশাখার মুখের দিকে। মৃণালের সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে রক্তশূন্য। চোখের দৃষ্টি অসহায় বিহূল।
চমকে ওঠে বিশাখা, বলে, কি ব্যাপার, মৃণাল?
মৃণাল কোন কথা না বলে নিঃশব্দে শুধু ইঙ্গিতে সুনন্দাকে দেখায়।
বিশাখা সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বোকার মতোই তখনো ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে পুনরায় প্রশ্ন করে, কি হয়েছে সুনন্দার?
সি ইজ ডেড!
ডেড?
একটা আর্ত অস্ফুট চীৎকার যেন বের হয়ে আসে বিশাখার কণ্ঠ থেকে।
তারপরই বিশাখা ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এবং ব্যাপারটা মুহূর্তের মধ্যে সকলের গোচরীভূত হয়ে যায়।
.
০৩.
অতঃপর সাধন দত্ত নিমন্ত্রিতদের মধ্যে যাঁরা ঐ সময় সুসীমের গৃহে উপস্থিত ছিলেন একে একে তাদের সকলকেই ডেকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে আর কেউ কিছু জানেন কিনা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।
কিন্তু কারো কাছ থেকেই বিশেষ কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, কেউই বড় একটা সুনন্দাকে লক্ষ্য করেন নি।
মাত্র দুজন ছাড়া।
বিষ্ণু দে আর বিশাখা চৌধুরী।
বিষ্ণু দে ওদের মানে সুসীমদেরই এক বন্ধু। তিনিও সুনন্দাকে চিনতেন। আর বিশাখা চৌধুরী শ্রাবণী, সুসীম ও মৃণালের বান্ধবী। বিশাখাও চিনতো সুনন্দাকে তবে কোন ঘনিষ্ঠ পরিচয় তার সুনন্দার সঙ্গে ছিল না নাকি।
প্রশ্ন করে জানা গেল, বিশাখা চৌধুরী নাকি দুর্ঘটনা জানাজানি হবার প্রায় আধ ঘণ্টাটাক আগে ঐ হলঘরে কাকে ডাকতে এসে সুনন্দাকে ঐ সোফায় বসে থাকতে দেখেছিল এবং সে তখন একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল।
আরো একটা ব্যাপার জানা গেল ঐ সঙ্গে যে ঠিক ঐ সময়টাতেই নাকি আমন্ত্রিতদের মধ্যে কে একজন ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে উপস্থিত নরনারীদের নানা ধরনের চমৎকার তাসের খেলা দেখিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন।
পাশেই বসেছিল সুসীম ও মৃণাল। সুসীমই হঠাৎ প্রশ্ন করে, তাসের খেলা!
হ্যাঁ।
কে আবার আজ দেখাচ্ছিলেন তাসের খেলা?
বিশাখা জবাব দেয়, তা তো জানি না। তাকে চিনিও না, কখনো আগে দেখি নি। ভদ্রলোককে।
মৃণাল এবারে শুধায়, কেমন দেখতে ভদ্রলোক ছিলেন মনে আছে তোমার?
মনে আছে বৈকি। বিশাখা জবাব দেয়, ভদ্রলোককে দেখতে অনেকটা ঠিক তোমারই মতো। আমার মতো?
মৃণাল যেন বিশাখার কথায় বিস্ময়ে কেমন একপ্রকার অভিভূত হয়েই তার মুখের দিকে তাকায়।
বিশাখার কথা তখনো শেষ হয়নি। এবং মৃণাল ও উপস্থিত সকলের বিস্ময়ের আরো কিছু বাকী ছিল।
বিশাখা বলল, শুধু অনেকটা সেই ভদ্রলোক তোমার মতোই বা দেখতে বলছি কেন, তার গলার স্বরটাও মনে পড়ছে এখন যেন তোমারই মতো শুনেছিলাম।
সত্যি বলছো বিশাখা! কেমন যেন প্রায় নিশ্চুপ কণ্ঠে প্রশ্নটা করলো মৃণাল।
সত্যিই বলছি, বিশ্বাস কর। তবে পার্থক্যও কিছু ছিল বৈকি। বেশভূষাটা পর্যন্ত তোমারই মতো হলেও, তাঁর ছিল ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও চোখে কালো কাচের চশমা।
বিশাখার জবানবন্দীটা যেন সকলকে সত্যিই কেমন বিমূঢ় করে দেয়। ম্যাজিক দেখানোর কথাটা আরো দশ-বারোজন নিমন্ত্রিতও সমর্থন করলেন। কিন্তু সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য যে সুসীম ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও জানে না। কারণ ও-ধরনের চেহারার কোন লোকই তার নিমন্ত্রিতদের লিস্টে নাকি আজ ছিল না।
মৃণালও তাই বললে।
আর বিষ্ণু দে—তিনি বললেন, দুর্ঘটনাটা আবিষ্কৃত হবার বোধ হয় মাত্র মিনিট দশ-পনের আগে কি একটা কাজে ঐ হলঘরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তিনি নাকি ঠিক ঐখানে ঐ সোফার উপরে সুনন্দাকে বসে থাকতে দেখেছিলেন অন্য এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। এবং সেই ভদ্রলোকের চেহারা নাকি বিশাখা বর্ণিত সেই ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোকের মতোই ছিল।
অর্থাৎ যতদূর জানা যাচ্ছে ঐ বিষ্ণু দে ভদ্রলোকই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে শেষ জীবিত দেখেন যে সময় সুনন্দা তার পার্শ্বে উপবিষ্ট একই সোফায় অনেকটা যাকে প্রায় সেই ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোকের মতই দেখতে তারই সঙ্গে কথা বলছিল।
সাধন দত্ত প্রশ্ন করলেন, ভদ্রলোকের চেহারাটা আপনার ঠিক মনে পড়ছে, মিঃ দে?
হ্যাঁ, বললাম তো, বিশাখা দেবী এইমাত্র যে চেহারার কথা বললেন সেই ভদ্রলোকের চেহারাটাও ঠিক তেমনি ছিল।
বিস্ময়ের ব্যাপার সন্দেহ নেই।
বিভিন্ন ব্যক্তির জবানবন্দী থেকে যা দাঁড়াচ্ছে তাতে করে এইটুকু অন্ততঃ বোঝা যাচ্ছে যে, বিশাখা দেবী ও অন্যান্য অনেকেরই বিবৃত চেহারার কোন এক ভদ্রলোক ঐ দিন ঐ উৎসবে সুসীমের গৃহে উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু কে সে ভদ্রলোক?
সুসীমবাবু বলছেন, অমন চেহারার কেউই তাঁর গৃহে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন না।
তবে ভদ্রলোকটি কোথা থেকে এলেন আর কোথায়ই বা গেলেন?
তবে কি সে-ই সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যাকারী?
সত্যি সত্যি সে হত্যাকারী হলেও, ব্যাপারটা যেন কেমন দুর্বোধ্য। কারণ সেই লোকই যদি সুনন্দাকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে থাকে তো সুসীমের অপরিচিত হয়েও কোন্ দুঃসাহসে সে এখানে প্রবেশ করেছিল আজ রাত্রে?
আর কেমন করেই বা এত লোকের মাঝখানে, বলতে গেলে এতগুলো লোকের এক রকম চোখের উপরেই সুনন্দাকে হত্যা করে গেল লোকটা?
ইতিমধ্যে রাত্রি শেষ হয়ে এসেছিল। নিমন্ত্রিতরা সকলেই যে যার গৃহে ফিরে গিয়েছেন। সাধন দত্তও মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে আপাততঃ সুসীমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে
উঠে আবার বসে পড়ে প্রশ্ন শুরু করলেন।
.
০৪.
সবাই চলে গিয়েছে।
কেবল সুসীম, শ্রাবণী, ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ, সুসীমের বোন সুধা উপরের লাইব্রেরী-ঘরে যেন তখনো বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে বসে ছিল।
এ কি অপূর্ব, অকল্পিত বিভ্রাট! হরপ্রসাদ লোকটি যেমন স্থির ধীর, তেমনি তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন এবং রীতিমত রসিক প্রকৃতির। সুদীর্ঘকাল দুই পুরুষ ধরে ওঁদের পরিবার পাটনা শহরে আছে। হরপ্রসাদ পাটনা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসাবে প্র্যাকটিস্ করেন এবং একজন নামকরা ব্যারিস্টার। বয়সে দুএক বছরের বড়ই হবেন হরপ্রসাদ সুসীম থেকে। কিন্তু তা হলেও উভয়ের মধ্যে অর্থাৎ হরপ্রসাদ ও সুসীমের মধ্যে একটা রসের এবং মধুর প্রীতির সম্পর্ক বরাবরই ছিল। সুনন্দা যে একসময় দীর্ঘদিন ধরে শ্যালক সুসীমের মনোহারিণী ছিল, ব্যাপারটা হরপ্রসাদের বা তার স্ত্রী সুধার অজানা ছিল না।
তাই মধ্যে মধ্যে সুসীমকে একটু রসিকতার সুরেই বলতেন হরপ্রসাদ, দেখ ভায়া, তোমার বান্ধবীটি যখন তোমার মন হরণ করেছেন তখন যে তিনি সত্যি সত্যিই মনোহারিণী সন্দেহ নেই, কিন্তু কি জান ভায়া—
কি?
ঐ মন হারানো ও মন পাওয়া পর্বের মধ্যে একটা মাধুর্য আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তুমি ব্যাপারটা যেভাবে টেনে টেনে দীর্ঘস্থায়ী করে তুলছে তাতে করে তোমার ওপরে তাঁর আস্থাটা শেষ পর্যন্ত যদি মিইয়েই যায় তাতে করে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে সুসীম, না, সে ভয় নেই।
নেই তো?
না।
একটু বেশী স্যাংগুইন-ই যেন তুমি বলে মনে হচ্ছে ভায়া!
তা একটু বৈকি। পুনরায় হাসির সঙ্গেই জবাব দিয়েছে সুসীম তার ভগ্নীপতিকে। কিন্তু তারপর হঠাৎ যখন তাঁর বিবাহের আট বছর বাদে হরপ্রসাদ শ্যালকের কাছ থেকে চিঠি পেলেন, সুসীমের বিবাহের দিন স্থির, তিনি যেন অবিলম্বে সুধাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন—তখনো কিন্তু হরপ্রসাদ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি যে পাত্রী সুনন্দা চ্যাটার্জী নয়, শ্রাবণী চৌধুরী।
যাই হোক, স্ত্রী-সহ হরপ্রসাদ অবিলম্বে মানে বিয়ের সাতদিন আগেই কলকাতায় এসে পৌঁছালেন এবং গাড়ি থেকে নেমেই শ্যালককে কৌতুক করে জিজ্ঞাসা করলেন, মন-জানাজানির পর্ব তাহলে এতদিনে শেষ হলো ভায়া!
যদিও আলাপ ছিল, তবুও সেভাবে জানবার বা বুঝবার চেষ্টাই করি নি কখনো। আর সময় পেলাম কোথায়?
মানে?
মানে পনের দিন আগে পর্যন্তও তো ব্যাপারটা ভাবতে পারি নি।
ভাবতে পারো নি—সময় পেলে না মানে? বারোটা বছর যে একটা যুগ হে–তোমাদের উভয়ের জানাজানি–
ও, তুমি সুনন্দার কথা বলছে বুঝি? কিন্তু সে তো নয়! হরপ্রসাদকে থামিয়ে দিয়েই কথাটা বলে সুসীম।
বিস্ময়ের যেন সত্যিই অবধি থাকে না হরপ্রসাদের। বলেন, সে কি হে? তুমি কি তবে সুনন্দাকে বিয়ে করছো না?
না।
সত্যি বলছো?
সত্যিই।
হরপ্রসাদ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। এবারে সোফাটায় বসে পড়ে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও-তুমি যে ভায়া সত্যি-সত্যিই আমাকে বোকা বানিয়ে দিচ্ছ! রসিকতা করছে না তো?
রসিকতা কেন হবে! হাসতে হাসতে সুসীম বলে, বিয়ে করছি আমি অন্য একটি মেয়েকে-শ্রাবণী চৌধুরী তার নাম।
ও। তা–তাহলে সুনন্দা–
পূর্ববৎ হাসতে হাসতেই সুসীম বলেছিল, সুনন্দা নামটা শুনেই তো বোঝা উচিত ছিল হরপ্রসাদ—সে হচ্ছে দশের নন্দিতা! কোন ব্যক্তিবিশেষের নন্দিতা হতে সে রাজী হবে কেন?
বল কি!
তাই।
কিন্তু–
না হে, তা ছাড়া—
তা ছাড়া?
প্রেম আর বিয়ে ও দুটো বস্তু তো এক নয় হে। একটা হচ্ছে সযতনে ব্যবহার করবার মতো পোশাকী দামী সিফন শাড়ী, অন্যটা আটপৌরে শাড়ি—একান্ত সাংসারিক ঘরোয়া ব্যাপার।
কিন্তু তাহলে তোমার ও সুনন্দার মধ্যে এতদিনকার সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে! একেবারে ছাড়াছাড়ি নয় তো?
ছাড়াছাড়ি হবে কেন?
তাই তো ভায়া, ব্যাপারটা যেন কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছে!
গোলমেলে কেন হতে যাবে?
হ্যাঁ, গোলমালের বৈকি—
না, গোলমেলে কিছু নেই।
বলছো?
হুঁ।
কিন্তু শ্রাবণীকে কি ব্যাপারটা বলেছো?
বলবার প্রয়োজন হয় নি–
প্রয়োজন হয় নি!
না। সে জানে।
জানে মানে?
একটু আগেই তো বললাম, সেও অপরিচিতা ছিল না। সুনন্দার কথা সে সবই জানত।
.
এ কথাটাও পরে শুনেছিলেন হরপ্রসাদ, সুসীম শেষ পর্যন্ত সুনন্দাকে তার বিবাহে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করে নি।
তাই সেই সুনন্দা যখন বৌভাতের দিন সেজেগুজে এসে হাজির হলো উৎসব-বাড়িতে, হরপ্রসাদ একটু অবাকই হয়েছিলেন। তারপর সুসীম সুনন্দাকে যেভাবে রিসিভ করেছিল— যেন বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়েই সে এসেছে, ব্যাপারটা হরপ্রসাদকে যেন আরো একটু বেশী অবাক করে।
।আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে হরপ্রসাদ কথাটা সুসীমকে না শুধিয়ে পারেন নি, তবে যে বলেছিলে ভায়া সুনন্দাকে তুমি নিমন্ত্রণ জানাও মি!
মৃদু হেসে সুসীম বলেছিল, কাল রাত্রে নিমন্ত্রণ করেছিলাম–
সত্যি?
সত্যি।
হরপ্রসাদ অতঃপর চুপ করেই গিয়েছিলেন।
কিন্তু সুসীমের বোন সুধা সুনন্দাকে আসতে দেখে খুশী হয় নি। আসলে একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে সুনন্দার প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতাটা কোনদিনই প্রীতির চোখে দেখে নি সুধা। কি জানি কেন, সুনন্দাকে আদপেই যেন তার ভাল লাগতো না কোনদিন। সুনন্দার চালচলন বেশভূষা প্রসাধন কথাবার্তা কোনটাই সুধার কোনদিন ভাল লাগে নি।
সুনন্দার সঙ্গে সুধারও আলাপ-পরিচয় ছিল, যেহেতু সুধাও একসময় সুনন্দার সহপাঠিনী ছিল। এবং অতীতে সেই সূত্রেই সুসীমদের বাড়িতে সুনন্দার যাতায়াত শুরু হয়েছিল। সেই সময়ই সুসীমের আলাপ প্রথম সুনন্দার সঙ্গে। এবং ক্রমশ শ্রাবণী, বিশাখা চৌধুরী প্রভৃতির সঙ্গেও তখনই আলাপ হয়।
সুধার তারপর অবিশ্যি বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়া বন্ধ হয়ে যায়। সে স্বামীর ঘর করতে চলে যায় পাটনা।
প্রথম যেদিন সুধা লক্ষ্য করেছিল, সুনন্দা তাদের গৃহে তার কাছে এলেও তার আকর্ষণটার মূল হচ্ছে সুসীম এবং সুধাদের বাড়িতে এলে বেশীর ভাগ সময় সে সুসীমের ঘরে তার বন্ধুদের সঙ্গেই কাটায়, তখন থেকেই সুধার যেন কেমন ব্যাপারটা ভাল লাগত না।
মুখে কিছু না বললেও, সেই থেকেই সে সুনন্দাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এবং ক্রমশ তার মনে যেন সুনন্দার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জমে উঠতে থাকে।
তবে কোনদিনই সে সুনন্দা সম্পর্কে কোন অসন্তোষ প্রকাশ করে নি। কারণ সে জানতো সুসীমের সঙ্গে সুনন্দার একটা প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা আছে।
বিয়ের ব্যাপারে তাই সে আসতেও চায় নি প্রথমটায়। কিন্তু হরপ্রসাদ বলেছিলেন স্ত্রীকে, ছিঃ সুধা, এ সময় তোমার মনে যাই থাক না কেন, না যাওয়াটা হবে একটা অমার্জনীয় অপরাধ। তা ছাড়া সে যখন পছন্দ করে বিয়ে করছে, তখন তোমার আমার কি বলবার থাকতে পারে!
একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই আসতে হয়েছিল সুধাকে। কিন্তু এসে যখন শুনলে সুনন্দা নয়—অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সুসীমের বিয়ে হচ্ছে, তখন সুধা সত্যিই খুশী হয়েছিল। ভারী মনটা তার হালকা হয়ে গিয়েছিল। নতুন উৎসাহে সে বিয়ের ব্যাপারে কোমর বেঁধেছিল।
কিন্তু বৌভাতের উৎসবে সুনন্দাকে আসতে দেখে আবার সুধা যেন একটু ক্ষুন্নই হয়েছিল, যদিও সে জানতো না শেষ পর্যন্ত কেন সুসীম সুনন্দাকে না বিয়ে করে শ্রাবণীকে বিয়ে করলো!
সুনন্দা নিহত হওয়ায় হরপ্রসাদ ও সুধা এই কথাগুলি ভাবছিল।
হরপ্রসাদ ও সুধা দুজনের মনের মধ্যেই নানা প্রশ্ন উদিত হতে থাকে, কিন্তু কেউই সুসীমকে মুখ ফুটে কোন প্রশ্ন করতে পারে না।
সুধা কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকতে পারে না, ঘরের পাষাণ-স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কতকটা যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করবার মতো কথাটা উচ্চারণ করে, কিন্তু কে হত্যা করলো ওকে অমন করে?
সুধার কণ্ঠ হতে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সহসা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলে চম্কে সুধার মুখের দিকে তাকালো।
কে!
সুধার কণ্ঠ হতে উচ্চারিত কথাগুলোর মধ্যে কে নিষ্ঠুর এই শব্দটা যেন একটা বিষাক্ত ছুঁচের মতো সকলের চেতনাকে বিদ্ধ করে।
সুসীম ভাবে কে, হরপ্রসাদ ভাবে কে, সুধা ভাবছে কে, শ্রাবণীও ভাবে কে?
কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত অতিবাহিত হবার পর হরপ্রসাদ কথা বলেন, তার চাইতেও বড় কথা, এই বাড়িতেই বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটলো!
সুধা অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে, কিন্তু তার জন্য কি আমরা দায়ী?
দায়ী—আমরা দায়ী কেমন করে? অসহায় কণ্ঠে কথাটা বলে সুসীম সকলের মুখের দিকে তাকায়।
মনে হলো সত্যিই যেন সুসীম একটা অবলম্বন খুঁজছে।
দায়ী আমরা নিশ্চয়ই হয়তো নয়—হরপ্রসাদ বলেন।
হয়তো মানে! কি কি আপনি বলতে চান হরপ্রসাদবাবু? শ্রাবণী প্রশ্নটা করে।
ণা না—তাই তো বলছিলাম। আমরা—আমরা দায়ী হবো কেন? কিন্তু পুলিস—
হরপ্রসাদের কথাটা শেষ হলো না, সুধা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, পুলিস কি?
এ বাড়িতে ব্যাপারটা যখন ঘটেছে, তখন আমাদের তারা—মানে ঐ পুলিস খুব সহজে নিষ্কৃতি দেবে কি?
নিষ্কৃতি দেবে না মানে! এ কি জুলুম নাকি? সুধা যেন তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে।
জুলুমের কথা নয় সুধা, কথাটা হচ্ছে আইনের। অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠে যেন কথাটার প্রত্যুত্তর দিলেন হরপ্রসাদ।
আইন!
হ্যাঁ, আইন, আইনই জুলুম করবে।
রেখে দাও তোমার আইন, জুলুম করলেই অমনি হলো! প্রতিবাদ জানায় সুধা পুনরায় তীক্ষ্ণকণ্ঠে।
এবারে আর হরপ্রসাদ কোন জবাব দিলেন না। মৃদু হাসলেন মাত্র।
.
০৫.
সুনন্দা চ্যাটার্জীর নিহত হওয়ার ব্যাপারটা আর যার মনেই যেটুকু রেখাপাত করুক বা না করুক—স্বামী-স্ত্রী সুসীম ও শ্রাবণীর মনের মধ্যে কিন্তু কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম চিড় ধরিয়ে দিয়ে গেল।
আনন্দের আকাশে কোথায় যেন একটা কালির বিন্দুর মত মেঘ দেখা দিল। বিবাহের পূর্বে শ্রাবণীর সঙ্গে সুসীমের যে পরিচয়টা ছিল, তার মধ্যে আর যাই হোক ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় সেরকম সত্যই কিছু ছিল না সুসীমের দিক থেকে।
কিন্তু সুসীম যেটা কোনদিনই বুঝতে পারে নি বা বুঝবার কোন অবকাশ পায় নি সেটা হচ্ছে শ্রাবণীর একটা দুর্বলতা ছিল তার প্রতি।
আর শ্রাবণীও সেটা কোনদিন সুসীমকে বুঝতে দেয় নি।
কারণ সুনন্দার প্রতি সুসীমের মনোভাবটা শ্রাবণীর অজ্ঞাত ছিল না।
সেদিন মাত্র দিন-পনের আগে হঠাৎ যখন সুসীম গিয়ে শ্রাবণীর কাছে বিবাহের প্রস্তাব করেছিল, তখন শ্রাবণী একটু যেন বিস্মিতই হয়েছিল। কয়েকটা মুহূর্ত সে জবাব দিতেও পারে নি।
আমি বুঝতে পারছি প্রস্তাবটা তোমার কাছে খুবই আকস্মিক মনে হচ্ছে শ্রাবণী, তাই এখুনি এই মুহূর্তেই কোন জবাব তোমার কাছে আমি চাই না। তুমি বরং ভেবে দেখো—কালপরশু না-হয় আবার আমি আসব!
যাবার জন্য সুসীম পা বাড়ায়।
শোন!
হঠাৎ সেই সময় শ্রাবণী ডাকে।
একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না—
কি?
আমার কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি, কিন্তু কারোরই তো এতদিন জানতে বাকী ছিল না যে তুমি সুনন্দাকেই বিয়ে করবে!
প্রত্যুত্তরে হাসে সুসীম।
হাসছো যে?
কথাটা এতদিন লোকে জানত বটে, মিথ্যাও তুমি বল নি, কিন্তু—
থামলে কেন, বল?
ভুল বোঝা বলে মানুষের একটা ব্যাপারও তো থাকতে পারে!
ভুল?
হ্যাঁ, সবটাই হয়তো একটা ভুলের ওপরই এতদিন দাঁড়িয়ে ছিল—
এই বারো বছর ধরে ভুল?
সারাজীবনেও তো মানুষের কোন কোন ভুল শোধরায় না–তা এ তো বারোটা বছর!
তবু একটু বেশী সময়ই নয় কি?
তাই তো তোমাকে সময় দিয়ে যাচ্ছি। জবাব তো আজই এই মুহূর্তেই আমি চাইছি না।
শ্রাবণী অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কোন কথাই বলে না। সুসীমও চুপ করেই থাকে।
তারপর শ্রাবণী এক সময় বলে, এ রকমটা যে একদিন হবে আমি তা জানতাম।
তুমি জানতে! বিস্ময়ে তাকায় সুসীম শ্রাবণীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, জানতাম। আর তুমি চোখ বুজে না থাকলে এতদিনে সেটা জানতে পারতে।
কি কি জানতে পারতাম?
জানতে পারতে সে তোমাকে সত্যিই ভালবাসে না। শুধু তোমাকেই বা বলি কেন, কোন পুরুষকে ভালবাসার মতো নারীমনই ওর নেই।
শ্রাবণী!
হ্যাঁ, নারীর যে মন পুরুষকে ভালবাসে, সে মনই যে ওর নারী হয়েও নেই। যাক সে কথা, আমার কথা আমি বলছি না, তুমি বরং আরো কিছুদিন ভেবে দেখ।
ভেবেই আমি তোমার কাছে আজ এসেছিলাম শ্রাবণী।
সত্যি বলছো?
হ্যাঁ।
বেশ, তাহলে তুমি ব্যবস্থা করতে পারো।
আনন্দে সুসীম শ্রাবণীর একটা হাত ধরে ফেলে বলে, সত্যি–সত্যি শ্রাবণী!
সত্যি।
আঃ! তুমি-তুমি আমাকে বাঁচালে। কি নিশ্চিন্ত যে তুমি আমাকে করলে। কিন্তু একটা কথা শ্রাবণী–
বল?
আজ-কালের মধ্যেই কিন্তু চাকরিতে তোমাকে তাহলে ইস্তফা দিতে হবে—
না।
সে কি! বিয়ের পরেও চাকরি করবে?
না, বিয়ের পরে আর করবো না। তবে রেজিগনেশান দেবো বিয়ের পর–এখন নয়।
কি ভেবে এবারে সুসীম বলে, বেশ।
আর একটা কথা—
কি?
বিয়েটা কিন্তু আমাদের রেজিস্ট্রী করে হবে, রাজী তো?
বেশ। আমার আপত্তি নেই।
.
ঘটনাচক্রে মধুরাত্রি ওদের যাপন করা হয়ই নি।
তাই সুধা পরের দিন রাত্রে নতুন উৎসাহে আবার ঘর সাজিয়েছিল। এবং স্বামীকে বলে এক রাত্রির জন্য এমন কি সানাইয়ের পর্যন্ত ব্যবস্থা করেছিল। সুসীম অনেক বাধা দিয়েছিল, কিন্তু কান দেয় নি তার কথায় সুধা। রাত্রে নিজের হাতে শ্রাবণীকে সাজিয়ে পাঠিয়েছিল সেই ঘরে।
সুসীম ঘরের কোণে একটা ইজিচেয়ারের উপর বসে ছিল। শ্রাবণী এসে ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু শ্রাবণী স্বামীর সঙ্গে কোন কথাই বললো না। ঘরের সংলগ্ন যে ব্যালকনি ছিল সেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।
সারাদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দেখাও হয় নি—কথাও হয় নি।
শ্রাবণী ঘরে ঢুকেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতে সুসীম যেন কেমন একটু থতমত খেয়ে যায়। অতঃপর কিছুক্ষণ সে ঘরের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর কি ভেবে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ব্যালকনির দিকেই অগ্রসর হয়।
অন্ধকারে শ্রাবণী ব্যালকনির রেলিং ধরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
বাইরে সানাই তখনো বাজছে।
সুসীম এসে পিছনে দাঁড়াতেও কিন্তু শ্রাবণী ফিরে তাকাল না বা কোন কথা বললো না। তবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সুসীম। কিন্তু শ্রাবণী যখন সাড়া দিলই না, তখন মৃদুকণ্ঠে ডাকে, শ্রাবণী!
শ্রাবণী নিরুত্তর।
সুসীম আবার ডাকল, শ্রাবণী!
তথাপি শ্রাবণী কোন সাড়া দেয় না।
সাড়া দিচ্ছ না কেন শ্রাবণী? তুমি কি কথা বলবে না?
আমি কিছুদিনের জন্য শিলং যেতে চাই—এবং কালই যেতে চাই।
মৃদুকণ্ঠে শ্রাবণী এবারে কথাগুলো বলে।
শিলং!
হ্যাঁ।
ও। তা কালই তুমি যেতে চাও!
হ্যাঁ, এখানে—এ বাড়িতে যেন এক মুহূর্তও আর আমি টিকতে পারছি না।
বেশ। কিন্তু সেখানে—
সেখানে ছোট মাসী আছে আমার, কিছুদিন সেখানে গিয়ে আমি থাকবো।
বেশ। তবে আমি ভাবছিলাম, আমাদের কথা হয়েছিল বিয়ের পর মাসখানেক আমরা মুসৌরী গিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপন করবো–
না না–ওসব এখন থাক!
বেশ তাই হবে, কিন্তু একটা কথা—
কি?
সত্যিই যদি আমাকে কিছু তোমার বলবার থাকে তো বলতে পার।
বলবার! তোমাকে?
হ্যাঁ।
মুহূর্তকাল নিঃশব্দে অন্ধকারে যেন স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে রইলো শ্রাবণী।
তারপর বললো, কিছু বলবার নেই আজ আর তোমাকে–কিছু বলবার আর নেই—
শ্রাবণী!
হ্যাঁ, বলবার যা সেদিনই তো আমি বলেছিলাম তোমাকে, যেদিন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে গিয়ে তুমি দাঁড়িয়েছিলে। কিন্তু কেন—কেন সেদিন সত্য কথাটা গোপন করেছিলে বলতে পার?
সত্য কথা গোপন করেছি!
করো নি? সুনন্দাকে যে তুমি ভুলতে পারো নি, কোনদিন পারো না—কথাটা কেন গোপন করেছিলে আমার কাছে সেদিন?
শ্রাবণী, শোন—
কি আর শুনবো—কি আর তুমি বলবে? কিন্তু কেন এমনটা করলে তুমি আমার সঙ্গে? আমি তো কোনদিন তোমার কোন ক্ষতি করি নি, তবে তুমি আমার এতবড় ক্ষতিটা কেন করলে?
শ্রাবণী, বিশ্বাস করো, কোন ক্ষতি তোমার আমি করি নি—
এখনো তাই বলবে?
সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো—
বিশ্বাস! আচ্ছা বলতে পারো, সুনন্দাকে যে শেষ পর্যন্ত নিমন্ত্রণ করেছিলে—কথাটা কেন আমার কাছে গোপন করেছিলে?
বলতাম নিশ্চয়ই, কিন্তু বলবার সময় পেলাম কোথায়?
বলবার সময় পাও নি, না? কিন্তু পরশু রাত্রে সুনন্দার সঙ্গে ফোনে কথা বলবার পর যখন সুধার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল তাকেও তো কথাটা বলো নি! জামাইবাবুকেও বলল নি! ইচ্ছা করেই তুমি বলো নি! কিন্তু–
কি বল, থামলে কেন?
না থাক, ভুল যখন আমারই, সে ভুলের প্রায়শ্চিত্তও করতে তো হবে আমাকেই। তুমি শুধু কাল আমার শিলং যাবার ব্যবস্থা করে দাও।
কিন্তু ভেবে দেখ একটু শ্রাবণী, কালই যদি তুমি শিলং চলে যাও, ব্যাপারটা কি সকলের চোখেই বিশ্রী ঠেকবে না?
বিশ্রী ঠেকুক আর না-ই ঠেকুক, আমি যাবোই।
যেও তুমি, আমি বাধা দেব না। তবে জামাইবাবু আর সুধা চলে যাক, তারপর যেও। শুধু আমার এই অনুরোধটুকু তুমি রাখো শ্রাবণী। এখন শোবে চল
না, তুমি যাও।
শুতে যাবে না?
না।
সুসীম আর অনুরোধ জানাল না। ঘরের মধ্যে চলে গেল।
আর শ্রাবণী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইলো অন্ধকারে।