০১-০৫. ইন্টারকমে অতনুর গলা

কালো বেড়াল, সাদা বেড়াল – রহস্য উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ইন্টারকমে অতনুর গলা পাওয়া গেল, স্যার, একজন পুলিশের লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

মনোজ সেন খুবই অবাক হয়ে বলল, পুলিশের লোক? পুলিশের লোক আমার কাছে কী চায়?

সেটা উনি আপনাকেই বলতে চান।

আজ আমার সময় কোথায়? এখনই ফরেন ডেলিগেটরা এসে পড়বেন। একটু আগে তাজ বেঙ্গল থেকে ওঁরা বেরিয়ে পড়েছেন। মিনিস্টারের সঙ্গে জাস্ট পনেরো মিনিটের অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেরেই চলে আসবেন। আমি কতটা ব্যস্ত বুঝতে পারছ? আই অ্যাম গোয়িং থ্রু দি পেপার্স নাউ। লাস্ট মিনিট চেকিং।

সবই বলেছি স্যার। তবু উনি ইনসিস্ট করছেন।

ওঁকে ফোনটা দাও।

ও-কে স্যার।

 টেলিফোনে একটা মিহি গলা পাওয়া গেল যা মোটেই পুলিশি কর্তৃত্বব্যঞ্জক নয়। বরং খুবই ভদ্র ও বিনয়ী গলা, মিস্টার সেন, আমার প্রয়োজনটা বিশেষ জরুরি।

আপনি আগামী কাল আসুন।

আমি জানি আপনি আজ ফরেন ডেলিগেটদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। আজ তাদের সঙ্গে আপনার লাঞ্চ এবং মিটিং। একটা কন্ট্রাক্টও আজ সই হবে। কিন্তু আমার দরকারটাও গুরুতর।

খুবই মুশকিলে ফেললেন। এনিওয়ে, দু’মিনিটের বেশি সময় নেবেন না। বাই দি বাই, আপনি কি লালবাজারের লোক?

না।

তা হলে কি লোকাল থানা?

না। আমার হেড কোয়ার্টার প্যারিসে।

 বলেন কী? ফরাসি পুলিশ কি বাংলা বলে?

বলে। যদি ইন্টারপোলের লোক হয়। আমি বাঙালি। দুর্ভাগ্যবশত।

 ইন্টারপোল? সে তো সাংঘাতিক ব্যাপার। আসুন মশাই।

তার সেক্রেটারি সোনালি সোম চুক্তিপত্রের কাগজগুলো টেবিলে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিচ্ছিল। মনোজ সেন তার দিকে চেয়ে বলল, ইন্টারপোলের কে একজন দেখা করতে চাইছে।

ঠিক আছে স্যার, আমি পরে আসছি।

কাগজগুলো চটপট ফাইলবন্দি করে সোনালি পাশের সুইংডোর ঠেলে ও ঘরে চলে গেল। যেতে না যেতেই বেয়ারা সামনের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে স্লিপ রাখল টেবিলে।

মনোজ সেন স্লিপটা নিয়ে নামটা দেখল। সুধাকর দত্ত। ইন্টারপোল।

ভিতরে নিয়ে এসো।

যে লোকটা ঘরে ঢুকল তার চেহারাটা বেশ ভাল। তাকতওয়ালা লোক। লম্বাই চওড়াই আছে। নেভি ব্লু সুট পরা। গলায় বো। বয়স ত্রিশের কাছেপিঠে।

নমস্কার।

নমস্কার, বসুন।

আপনি আজ খুবই ব্যস্ত আমি জানি সেনসাহেব। ডিস্টার্ব করলাম বলে ক্ষমা করবেন।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলুন কী করতে পারি।

আমার বক্তব্য খুব সংক্ষেপে বলা যাবে না। ইটস এ লং স্টোরি।

কিন্তু

কিন্তু আজ আপনার হাতে সময় নেই। ইন ফ্যাক্ট আমার হাতেও নেই। সেইজন্য শুধু কাজের কথাটুকু বলে নিই। কেমন?

সেই ভাল।

আমি আসছি এখন পশ্চিম এশিয়া থেকে।

এই যে বললেন প্যারিস?

হ্যাঁ। আমার হেড কোয়ার্টার প্যারিসে। কিন্তু আমি অন ডিউটি একটা অ্যাসাইনমেন্টে আছি।

বুঝেছি। বলুন।

আপনার কোম্পানি একটা বড় কন্ট্রাক্ট পাচ্ছে, তাই না?

হ্যাঁ।

মোট বারোজন ডেলিগেট এসেছেন, সবাই সরকারি প্রতিনিধি?

হ্যাঁ।

আপনি ক’দিন আগে ওখানে গিয়েছিলেন?

মাস আটেক আগে।

এঁদের সবাইকে কি আপনি চেনেন?

না। তবে কারও কারও সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দু’-তিনজনকে চিনি।

এই বারোজনের মধ্যে একজনকে আমার দরকার।

তার মানে?

তিনি একজন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল।

বলেন কী?

ভয় পাবেন না। আমি তাকে অ্যারেস্ট করব না, কোনও ঝঞ্ঝাট ঝামেলাও হবে না। আমি তাকে জাস্ট আইডেন্টিফাই করতে চাইছি।

তার মানে কি আপনি তাকে চেনেন না?

না। তবে এই বারোজনের মধ্যে একজন তিনি।

কিন্তু এরা সবাই সরকারি প্রতিনিধি। প্রত্যেকেই সরকারের দায়িত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। আপনার কি মনে হয় কোনও সরকার একজন ক্রিমিন্যালকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখবেন?

দুটো কারণে রাখতেই পারেন। এক, সরকার সম্ভবত জানে না যে ইনি একজন ক্রিমিন্যাল। দুই, ইনি হয়তো একজন এমন বিশেষজ্ঞ যে, সরকারের পক্ষে এঁকে তাড়ানো সম্ভব নয়। তৃতীয় আর একটা কারণও আছে। ইনি হয়তো সরকারকে ব্ল্যাকমেল করেছেন বা এঁর খুঁটির জোর আছে।

আইডেন্টিফাই করলে কী করবেন?

আমার কাজ আইডেন্টিফাই করা এবং হেড কোয়ার্টারে জানানো।

তারপর?

ডেলিগেটরা এরপর মায়ানমার এবং থাইল্যান্ড যাবেন। তারপর দেশে ফিরবেন। সম্ভবত আমাকেও ওঁদের পিছুপিছু যেতে হবে।

আমাকে কী করতে বলছেন?

আপনার কাছে আমার একটি প্রার্থনা আছে। আমি আজ ডেলিগেটদের কাছাকাছি থাকতে চাই। এ ব্যাপারে আপনিই আমাকে সাহায্য করতে পারেন।

কীভাবে?

আপনি আমাকে আপনার সেক্রেটারি হিসেবে ইন্ট্রোডিউস করবেন। আমি ওঁদের রিসেপশনের চার্জে থাকব।

তা কি হয়? আপনাকে আমি চিনিই না। একজন অচেনা লোকের ওপর এতটা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আপনার ক্রেডেনশিয়ালসও আমি এখনও দেখিনি।

কোটের পকেট থেকে সুধাকর তার কার্ড ও পাসপোর্ট বের করে টেবিলে রেখে বলল, দেখুন। আই অ্যাম নট অ্যান ইমপস্টার।

মনোজ দেখল। জাল বলে মনে হচ্ছে না। পাসপোর্টে বহু দেশের ইমিগ্রেশনের ছাপ আছে। সে আইডেন্টিটি কার্ড আর পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে বলল, কাজটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে।

আপনার পয়েন্টটা আমি বুঝতে পারছি। আমার দিক থেকে যদি ডেলিগেটদের কারও কোনও বিপদ ঘটে তা হলে আপনার এত বড় কন্ট্রাক্ট ভন্ডুল হয়ে যাবে। তাই না?

সেরকম একটা ভয় তো আছেই।

প্রথম কথা, আমার কাছে কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই। আপনি আমাকে সার্চ করে দেখতে পারেন। দ্বিতীয় কথা, আপনি ইচ্ছে করলে লালবাজারে ফোন করে আমার সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে না জানিয়ে আসিনি। আপনার কোনও ভয় নেই। ডেলিগেটরা কিছুই টের পাবেন না। তবে আমি যে ইন্টারপোলের লোক তা অতনুবাবু জানেন এবং আপনার সেক্রেটারি সোনালি সোমও হয়তো জানেন। আপনি সোনালিদেবীকে একটু অ্যালার্ট করে দিলেই হবে।

আপনি সোনালি সোমের নাম জানলেন কী করে?

সিম্পল হোমওয়ার্ক। এবার বলুন, আপনি রাজি?

মনোজ মুশকিলে পড়ল। দ্বিধা, আশঙ্কা দুটোই হচ্ছে। একটু ভেবে সে বলল, কিন্তু আমার কোম্পানির ব্যাপারে এরা আপনাকেও প্রশ্ন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কী হবে?

সে ক্ষেত্রে জবাব দেবেন মিস সোম। আমার কাজ হবে ওঁদের আপ্যায়নের দিকে নজর রাখা। কাছে কাছে থাকা ছাড়া আমার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই।

আপনি লোকটাকে আইডেন্টিফাই করবেন কী করে বুঝতে পারছি না।

ক্রিমিনালদের চোখমুখ অনেক সময়ে বিট্রে করে। কথাবার্তা থেকেও কিছু বেরিয়ে আসতে পারে।

লোকটার নাম জানেন?

আসল নাম রজার ভ্যালন। কিন্তু এদের মধ্যে ও নামে কেউ নেই।

তা হলে?

নামটা বদলে নেওয়া শক্ত কাজ নয়। ক্রিমিন্যালরা এ কাজ প্রায়ই করে থাকে।

এর ক্রাইম কী?

অনেক রকম। ইনি একজন এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট। আপাতত এর বেশি জানার দরকার কী?

ক্রিমিন্যালটির এখানে আসার বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য আছে কি?

আছে। কিন্তু সে কথাও আপাতত থাক।

দাঁড়ান মশাই, লালবাজারে ফোনটা আগে করে নিই।

করুন। এই যে নম্বর…

মনোজ ফোন করল। তারপর বলল, ঠিক আছে। কিন্তু ওয়াচ ইয়োর স্টেপস।

ওসব নিয়ে আপনি ভাববেন না।

মনোজ সোনালিকে ইন্টারকমে ডাকল। সোনালি এলে বলল, ইনিই সেই ইন্টারপোল অপারেটর। বিশেষ কারণে ইনি আজ ডেলিগেটদের সঙ্গে থাকতে চান, অ্যাজ মাই সেক্রেটারি। আপনি সামলে নিতে পারবেন তো?

সোনালি একটু অবাক হল। কিন্তু সেটা প্রকাশ পেল চোখে। গলাটা স্বাভাবিক রেখেই বলল, পারব।

কথাবার্তা–মানে টেকনিক্যাল কোনও প্রসঙ্গ উঠলে আপনি সামলে নেবেন। ইনি শুধু অন্যান্য দিক দেখবেন। এঁর নাম সুধাকর দত্ত।

কেউ কারও দিকে ভাল করে তাকাল না। সোনালি নিজের ঘরে চলে গেল।

সুধাকর দত্ত বলল, আপনার আর কোনও প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।

মনোজ একটু চিন্তিতভাবে সুধাকরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, প্রশ্ন তো অনেক। একজন ক্রিমিন্যাল আমার কোম্পানিতে আসছে কেন? আমার কারখানা তো তেমন গুরুতর কিছু তৈরি করে না। আমরা এক ধরনের অ্যালয় তৈরি করি যা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পোনেন্টস তৈরির কাজে লাগে। প্রোডাকশন বেশি নয়, কারণ অনেক মেটেরিয়াল পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার এখানে গোপনীয় কিছু নেই।

সুধাকর সামান্য একটু ভেবে বলল, লোকটা কেন এ দেশে এসেছে তা আমরা এখনও জানি না। উদ্দেশ্য ধরা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আমরাও অন্ধকারে হাতড়ে মরছি। তবে ওয়াচ করতে পারলে হয়তো কিছু জানা যেতে পারে। আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?

না। টেনশন হচ্ছে। আপনি আমাকে একটু চিন্তায় ফেলেছেন।

টেলিফোন বাজল। মনোজ টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলল, সেন… আচ্ছা ঠিক আছে।

ফোনটা রেখে বলল, ওঁরা রাইটার্স থেকে রওনা হচ্ছেন। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বেন। ভাল কথা, ওঁরা কিন্তু গুজরাত, মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানাতেও কয়েকটা কারখানা ভিজিট করেছেন।

সেটা আমি জানি। তবে আমরা খবরটা দেরিতে পেয়েছি বলে ওসব জায়গায় ওঁদের ধরতে পারিনি। কলকাতায় ওঁদের শেষ স্টপ ওভারে ধরতে পেরেছি।

ঘড়িটা দেখে নিয়ে মনোজ বলল, আর পনেরো মিনিট পরে আমাদের নীচে যেতে হবে।

সুধাকর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ততক্ষণে আমি আপনার কমপ্লেক্সটা একটু ঘুরে দেখে নিতে চাই। উইথ ইয়োর কাইল্ড পারমিশন।

কোনও বাধা নেই। তবে একা তো পারবেন না। সোনালি বরং আপনাকে নিয়ে যাক।

মনোজ সোনালিকে ডেকে বলল, ওঁকে কারখানাটা চটপট ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিন। হাতে খুব বেশি সময় নেই।

সোনালির ভ্রু সামান্য কুঁচকে ফের সহজ হয়ে গেল। বলল, ঠিক আছে। আসুন মিস্টার দত্ত।

সোনালি মেয়েটাকে মনোজ গত এক বছরেও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি। অত্যন্ত কাজের মেয়ে। চটপটে, স্মার্ট। দেখতেও চমৎকার। কিন্তু মেয়েটার মুখে কখনও হাসি দেখা যায় না। এত গম্ভীর এবং এতই সাংঘাতিক ব্যক্তিত্ব যে মনোজ ওর বস হওয়া সত্ত্বেও মনে মনে ওকে সমীহ করতে বাধ্য হয়। সোনালির অ্যাকাডেমিক রেকর্ড খুবই ভাল। ইংরেজিতে এমএ এবং আরও কয়েকটা ট্রেনিং নেওয়া আছে। কম্পিউটার ভাল জানে। খুব গোছানো এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ। গত এক বছরের মধ্যে একদিনও অফিসে দেরি করে আসেনি। কখনও কাজে কোনও ঢিলেমি দেখা যায়নি। ওর শরীর খারাপ হয় না। কোনও বায়না বা দাবিদাওয়া নেই। সোনালির ওপর চোখ বুজে নির্ভর করা যায়। কিন্তু ওর মধ্যে একটু রোবট রোবট ভাবটা খুব বেশি পছন্দ করতে পারে না মনোজ। এই যে একটু ভ্রু কোঁচকাল এতেই মনোজের অস্বস্তি হচ্ছে। রেগে গেল নাকি সোনালি?

ইন্টারকমে অতনুকে ডেকে মনোজ বলল, ওঁরা রাইটার্স থেকে রওনা হয়েছেন। তোমার রিসেপশন কমিটি ঠিক আছে তো?

সব ঠিক আছে স্যার।

তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। সুধাকর দত্ত নামে যে ভদ্রলোক এসেছেন, আমার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করবেন। বুঝেছ?।

সেক্রেটারি?

হ্যাঁ। অ্যান্ড নো কোশ্চেন।

ওকে স্যার।

আর ইন্টারপোল কথাটা সম্পূর্ণ ভুলে যাও। বুঝেছ।

হ্যাঁ স্যার। উনিও আমাকে সেটা বুঝিয়ে গেছেন।

মনোজ উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। বিশাল দেওয়াল-জোড়া কাঁচের শার্সি। অখণ্ড অভঙ্গুর কাচ। পিছনে গাছপালা, সাজানো বাগান-ঘেরা লন, লনের ওপাশে কয়েকটা লম্বা লম্বা শেড। ওইসব শেড হল তার কারখানা। ইস্টার্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়। বাঁ দিকে কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি, ডানদিকে মেন্টিং শপ। খুব বেশি লোক এখানে কাজ করে না। লোকের তেমন দরকারও নেই। কিন্তু দরকার ভাল বিশেষজ্ঞের। আগে কারখানার আবহাওয়া শান্ত ছিল। এখন একটা ইউনিয়ন হয়েছে। কিছু কিছু অশান্তি দেখা দেয় মাঝে মাঝে। তবে এখনও তা মাত্রা ছাড়ায়নি। আর একটা ঝামেলা হচ্ছে, কিছু পয়সাওলা লোক কারখানাটা কিনে নিতে চায়। তার জন্য চাপও দেয় নানাভাবে। অনেক টাকার অফার।

টেনশন মনোজ সহ্য করতে পারে না। তার নার্ভ শক্ত নয়। কিন্তু তার বউ রোজমারির নার্ভ খুব শক্ত। জার্মানিতে যখন ছিল মনোজ তখন রোজমারির সঙ্গে তার প্রেম এবং বিয়ে। রোজমারিও মনোজের মতোই একজন মেটালার্জিস্ট। তাদের দুজনেরই উঁচু ডিগ্রি আছে। এই কারখানা করার ব্যাপারে রোজমারির অবদানই বেশি। সে-ই একটি জার্মান কোম্পানিকে ধরে একটা কোলাবরেশনের ব্যবস্থা করে। এই কারখানার পিছনে সেই জার্মান কোম্পানির টাকা ও প্রযুক্তি বারো আনাই কাজ করছে।

রোজমারি ছাড়া মনোজ অচল। রোজমারি যেমন কর্মঠ তেমনি বুদ্ধিমতী। ক্ষুরধার তার ধাতু সংক্রান্ত জ্ঞান। এই কারখানায় যে অ্যালয় তৈরি হয় তার যে বাজার একদিন এত ভাল হবে তা রোজমারিই প্রথম বুঝতে পেরেছিল। আজ কারখানা চলছে রমরম করে। বিদেশের বাজার তারা অনেকটাই দখল করতে পেরেছে। যে প্রতিনিধিদল আজ আসছে, তাদের সঙ্গেও প্রথম যোগাযোগ করেছিল রোজমারিই।

বাইরের দিকে চেয়ে সে আনমনে কিছুক্ষণ নানা কথা ভাবল। একটু টেনশন হচ্ছে। কেন হচ্ছে কে জানে। এই সুধাকর দত্তর হঠাৎ উদয় তার একটুও ভাল লাগছে না।

ইন্টারকম বাজল। অতনু।

স্যার, এইমাত্র খবর এল ডেলিগেটদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওঁরা তাজ বেঙ্গলে ফিরে যাচ্ছেন।

কী বলছ? কে অসুস্থ হয়ে পড়ল?

নাম তো বলেনি স্যার। তবে ওঁরা এখন আসতে পারছেন না।

পরে আসবে?

তাও স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

কে ফোন করেছিল?

সুব্রত।

সুব্রত মনোজের পিআরও। ডেলিগেটদের সঙ্গে সঙ্গে আছে। মনোজ বিরক্ত হয়ে বলল, সুব্রত কি আবার কন্ট্রাক্ট করবে?

হ্যাঁ স্যার, হোটেলে পৌঁছে।

আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে।

ঠিক আছে স্যার।

 মনোজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রোজমারি লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে গ্র্যান্ডে রয়েছে। তাকে কি জানানো দরকার? জানানোই ভাল। লাঞ্চটা বোধহয় ক্যানসেল করতে হবে। সে ফোনটা তুলে নিল।

০২.

আজ, তেরোই সেপ্টেম্বর সকালে একগোছা নৈর্ব্যক্তিক রক্তগোলাপ কে পাঠাল তাকে? পার্ক স্ট্রিটের এক ফ্লোরিস্টের নোক এসে দিয়ে গেল। সেলোফেনে যত্ন করে মোড়া, তোড়ার গায়ে একটা ট্যাগ। তাতে টাইপ করা একটি বাক্য: হ্যাপি বার্থ ডে টু রোজমারি। কোনও মানে হয় না ব্যাপারটার। আজ রোজমারির জন্মদিন? তার জন্মদিন পার হয়ে গেছে আরও দশ দিন আগে। ট্যাগে কারও নাম নেই এটা রীতি নয়। রহস্য তার ভাল লাগে না। ঘটনাটা তাকে ভাবিয়ে তুলল।

তাদের বাড়ির কাজের লোক তিনজন। ঘরের কাজ করে তাজু আর লেখা। বাগানের জন্য আছে বনমালী। তাজু আর লেখা বাপ আর মেয়ে। দু’জনেই খুব কাজের। তাজু রাঁধে, বাজারহাট করে, জামাকাপড় মেশিনে কাঁচে ও ইস্তিরি করে, ইলেকট্রিক বা টেলিফোনের বিল মেটায়, জার্মান শেফার্ড কুকুরটার দেখাশুনো করে এবং আরও নানা কাজে সাহায্য করে। লেখা ঘরদোর পরিষ্কার করা, বাসন মাজা, বিছানা করা ও তোলা ইত্যাদি। দু’জনেই খুব পরিশ্রমী। বনমালীও বেশ কর্মঠ। এরা সকলেই সাতশো টাকা করে মাইনে, খাওয়া, থাকার ঘর, কাপড়চোপড় পায়। ডয়েশ মার্কের হিসেবে বেতন এতই কম যে রোজমারি খুবই অবাক হয়। কোনও সভ্য দেশে এই বেতনে দিন-রাতের কাজের মানুষ পাওয়া যায় এরকম সে স্বপ্নেও ভাবেনি। প্রায় ক্রীতদাসের মতোই এরা হুকুম তামিল করে, খুবই ভদ্র এবং অনুগত। মাঝে মাঝে সে ভাবে, এদের কি আমরা এত সস্তায় কিনে নিয়েছি?

গোলাপের তোড়াটা যখন এল তখন দোতলার বারান্দায় সকালের রোদে বসে ছিল রোজমারি। গায়ে হালকা সানট্যান তেল মেখে নিয়ে রোজই সে কিছুক্ষণ সকালের রোদ পোয়ায় এবং চোখ বুজে খুব স্থিরভাবে সারা দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করে নেয়। তার স্বামী মনোজ একটু অগোছালো স্বভাবের এবং হয়তো আত্মবিশ্বাসেরও কিছু অভাব আছে। মনোজের ফাঁকগুলো রোজমারিকেই ভরাট করতে হয়। সকালবেলায় এই রোদ পোয়ানোর সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারা দিনটাকে আগাম সাজিয়ে নেওয়া। ঘড়ি ধরে এবং সঠিক পরম্পরায়।

ঠিক ওই সময়েই গোলাপের তোড়াটা নিয়ে ফুলওয়ালার লোক এল। তোড়াটা ওপরে নিয়ে এল তাজু। মেমসাব, ফুল।

কীসের ফুল?

বার্থ ডে। ফ্লোরিস্টের লোক দিয়ে গেল।

রোজমারি ফুল এবং ট্যাগ দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, আমার বার্থ ডে তো আজ নয়!

জানি মেমসাব।

ঠিক পঁয়ত্রিশটা ফুল। রোজমারির বয়স এখন পয়ত্রিশই। কিন্তু কে এই ভুল দিনে ফুল পাঠাল সেটা বুঝতে পারল না সে। ফুল সে খুবই ভালবাসে। ভালবাসে কাজ। ভালবাসে সাফল্য। ভালবাসে লড়াই। ভালবাসে হেলথ ফুড। ভালবাসে আরও অনেক কিছু।

রোজমারি তাজুকে বলল, লিভিং রুমে সাজিয়ে রেখে দাও।

তাই রাখল তাজু। মধ্যবয়স্ক তাজু একটু কম কথার মানুষ। সে লম্বা ও রোগা এবং মধ্যবয়স্ক। তার মেয়ে লেখার বয়স কুড়ি হতে পারে। একটু লাজুক। বাবাকে খুব ভয় পায়। এই বাবা আর মেয়েকে খুব লক্ষ করে রোজমারি। এমন অদ্ভুত আনুগত্য ও শ্রদ্ধার ভাব সে কদাচ দেখেনি। এদের মধ্যে সবসময়ে যেন কৃতজ্ঞতার ভাব ফুটে থাকে। মনোজ বলেছিল, এ দেশে ঝি-চাকরের মাইনে নাকি অনেক কম। এরা বেশি মাইনে পায় বলেই অমন কৃতার্থ। রোজমারির বিস্ময় এখানেই। সাতশো টাকাও কি খুব খুব খুব কম টাকা নয়? মাত্র সাতশো টাকায় একটা মানুষ!

ব্রেকফাস্ট করতে যখন লিভিং রুম পেরিয়ে ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছিল রোজমারি তখন বুককেসের ওপর কাট গ্লাসের ফুলদানিটা চোখে পড়ল।

পঁয়ত্রিশটা গোলাপের কুঁড়ি। সেলোফেন ছিঁড়ে তাজু সাজিয়ে রেখেছে। রোজমারি কাছে গিয়ে ফুলগুলো দেখল। টাটকা এবং সুন্দর গন্ধ। একটা গোলাপকে সে একটু স্পর্শও করল।

কে পাঠাল? ভুল দিনে কেন? সে কি তার জন্মদিন জানে না?

ব্রেকফাস্ট খুব সামান্যই খায় রোজমারি। এ দেশের দুধ তার সহ্য হয় না, মুখেও রোচে না। তার বদলে সে বিদেশ থেকে আনানো একটা বিভারেজ খায়। সঙ্গে দুটো মাখন ছাড়া টোস্ট, একটা কলা। সকাল ঠিক নটায়। আর এই সময়েই তার দু’জন সেক্রেটারি এসে হাজির হয়। একজন শুভ, অন্যজন মৈত্রেয়ী। দু’জনেরই বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। খুব চটপটে এবং বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিমতী। শুভ ডিকটেশন নেয় এবং কাগজপত্তর গুছিয়ে রাখে। মৈত্রেয়ী রাখে বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এরা খানিকটা রোজমারির সঙ্গীও।

দু’জন লিভিং রুমে অপেক্ষা করছিল। রোজমারি তার ব্রেকফাস্ট সেরে এসে ঢুকতেই তারা উঠে দাঁড়াল।

রোজমারি বলল, একটা মজার ঘটনা দেখবে? আজ আমার বার্থ ডে বলে কে একজন ফুল পাঠিয়েছে। ওই দেখো।

দু’জনে দেখল। মৈত্রেয়ী বলল, কিন্তু আপনার বার্থ ডে তো

সেইটেই তো মজা। কে পাঠাতে পারে বলে তো!

শুভ বলল, কোনও অন্যমনস্ক লোকই হবে।

শুভ গিয়ে ট্যাগটা দেখল। তারপর হঠাৎ বলল, ম্যাডাম, ট্যাগের উলটো পিঠে কিছু লেখা আছে।

কী লেখা আছে?

আর আই পি।

রোজমারি খুব অবাক হয়ে বলল, এটা কীরকম ইয়ারকি? আর আই পি?

হ্যাঁ ম্যাডাম, তাই লেখা।

রোজমারি একটু রেগে গেল। বলল, আর আই পি মানে তো রেস্ট ইন পিস। কবরের ওপর লেখা থাকে। শুভ, ফ্লোরিস্টের নাম আর ঠিকানা ট্যাগে ছাপা আছে। এখনই খোঁজ নাও তো।

নিচ্ছি ম্যাডাম। বলে শুভ ফোন তুলে নিল।

রোজমারি দোতলায় উঠে তার মুখটা আয়নায় দেখে চুলটুল ঠিক করে নিল। আজ বিদেশের ডেলিগেটরা আসবে। তার অনেক কাজ। অফিস থেকে তাকে দুপুরের আগেই চলে যেতে হবে গ্র্যান্ডে। মাননীয় অতিথিবৃন্দকে আপ্যায়িত করতে হবে মধ্যাহ্নভোজে।

যখন নীচে নেমে এল তখন শুভ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে।

ম্যাডাম, ওরা বলছে আর আই পি হল একজনের নাম। রজার আইভ্যান পোলক। ফুলটা সে-ই পাঠিয়েছে।

রোজমারি অবাক হয়ে বলল, কিন্তু লোকটা কে? এ নামে তো আমি কাউকে চিনি না।

ওরাও বলতে পারল না। ওদের অর্ডার বুকে এই নাম লেখা আছে। ওদের বলা ছিল যেন কার্ডের পিছনে আর আই পি প্রিন্ট করা হয়।

রোজমারি অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মিস্টার পোলক বেঁচে থাকুন, কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারছি না। আমাদের আর সময় নেই। চলো।

তারা বেরিয়ে পড়ল। মনোজ আজ একটু আগেই বেরিয়ে গেছে অফিসের রিসেপশন ঠিক করতে। আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ।

রোজমারি কোনও ব্যাপার নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তা করে না। সে কাজের মানুষ। কিন্তু গোলাপের তোড়াটা তাকে ভাবাচ্ছে।

আগে নিজের গাড়ি নিজেই চালাত রোজমারি। কিন্তু কলকাতার রাস্তার ভিড় আর উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে সে গাড়ি চালানো ছেড়েছে। তার গাড়ি চালায় শিউশরণ। শিউশরণ খুবই ভাল ড্রাইভার। তাকে দু’হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। এ টাকাটাও যাচ্ছেতাই রকমের কম। ভারতবর্ষের অর্থনীতির ধাঁচটা রোজমারি আজও বুঝে উঠতে পারল না।

নতুন বড় মারুতির সামনের বাকেট সিটে রোজমারি, পিছনে শুভ আর মৈত্রেয়ী। গাড়ির কাঁচ বন্ধ, এয়ার কন্ডিশনার চলছে।

রোজমারি কর্মচারীদের সঙ্গে বাংলা এবং ভাঙা হিন্দিতেই কথা বলে। কারণ তার মাতৃভাষা জার্মান কেউ বুঝবে না। আর ইংরেজি এখনও রোজমারি ভাল রপ্ত করতে পারেনি। মনোজের সঙ্গে আগে সে জার্মান ভাষায় কথা বলত। আজকাল বাংলায় বলে। তাতে ভাষাটা শিখতে তার সুবিধে হয়। এখন সে বাংলা হরফ শেখার পর বই পড়ার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে শুভ আর মৈত্রেয়ী তাকে খুব উৎসাহের সঙ্গে সাহায্য করে।

লাল গোলাপের ঘটনাটা মন থেকে তাড়ানোর জন্য রোজমারি শুভকে বলল, এবার তুমি আমাকে কোন বইটা পড়তে দেবে শুভ?

পথের পাঁচালী পড়বেন ম্যাডাম?

ও বইটার কথা তুমি আর মৈত্রেয়ী অনেকবার বলেছ।

 হ্যাঁ, খুব ভাল বই।

শক্ত নয় তো! শক্ত হলে আমি পারব না। জানো তো রাতে শোওয়ার আগে মাত্র কিছুক্ষণ আমি পড়ার সময় পাই।

জানি ম্যাডাম। এটা শক্ত বই নয়। তবে ঘটনাবহুল নয়।

দিয়ো। তুমি যে মহাভারতটা দিয়েছ সেটা কিন্তু খুব কঠিন। আমি অর্ধেক কথাই বুঝতে পারছি না।

ঠিক আছে ম্যাডাম, আপনাকে একটা সহজ অনুবাদ এনে দেব।

অফিসে নিজের চেম্বারে বসে রোজমারি দ্রুত কয়েকটা কাজ সারল। কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে গিয়ে চারদিকে চরকিবাজি করল। সব ঠিক আছে। ছায়ার মতো তার পিছনে সবসময়ে মৈত্রেয়ী আর শুভ। ওরা তাকে খুব পছন্দ করে, এটা টের পায় রোজমারি। সেও এ দুটিকে বেশ ভালবাসে।

মনোজের সঙ্গে টেলিফোনে তার কিছু কথা হল।

 মনোজ, আমি তা হলে গ্র্যান্ডে যাচ্ছি।

যাও।

তুমি একা সব দিকে চোখ রাখতে পারবে তো।

পারব। সব ঠিকই আছে।

ডেলিগেটদের লিডার একজন বাতিকগ্রস্ত লোক। খুব খুঁতখুঁতে। শকুনের মতো চোখ। ইনফ্রাস্ট্রাকচার পছন্দ না হলে কন্ট্রাক্ট দেবে না।

জানি। আমরা তো সাধ্যমতো করছি।

রোজমারি তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হোটেলে রোজমারির কাজ হল স্যুইটটা ঠিকঠাক গোছানো আছে কি না তা দেখা। সে নিজেও খুঁতখুঁতে। লাঞ্চের মেনু এবং ড্রিঙ্কস সে নিজে অনেক ভাবনাচিন্তা করে ঠিক করেছে। ডেলিগেটদের তেল দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। এমনিতেই তার রুচি একটু নিখুঁত ঘেঁষা। এ দেশের লোকরা বেশির ভাগই একটু অলস এবং অসতর্ক। এদের ওপর নির্ভয়ে ভরসা করা যায় না। তাই রোজমারি সব ব্যাপারেই তদারকিকে গুরুত্ব দেয়।

টেবিলে সাদা টেবিল ক্লথ পাতা। ফুলদানিতে টাটকা ফুল। এবং এখানেও রক্তগোলাপ।

রোজমারি ভ্রু কোঁচকাল, শুভ, মৈত্রেয়ী, দেখতে পাচ্ছ?

মৈত্রেয়ী বলল, কী ম্যাডাম?

এখানেও লাল গোলাপ!

হ্যাঁ। তাই তো!

আমি রজনীগন্ধার কথা বলেছিলাম। একটু খোঁজ নাও তো লাল গোলাপ কেন রেখেছে।

 মৈত্রেয়ী গেল এবং একটু বাদেই একজন এসে দুঃখপ্রকাশ করে বলল, ম্যাডাম, আপনার ফ্লোরিস্ট লাল গোলাপই পাঠিয়েছে।

কেন, আমার তো বলা ছিল রজনীগন্ধা। শুভ, খোঁজ নাও।

শুভ টেলিফোন করতে ছুটল এবং ফিরে এসে বলল, ওরা বলছে আপনি নাকি ফোন করে আগের অর্ডার ক্যানসেল করে লাল গোলাপ দিতে বলেছেন!

কখনওই নয়।

রোজমারির ফরসা রং হঠাৎ টকটকে লাল হয়ে গেল। সে বলল, কেউ একজন আমার সঙ্গে আজ রসিকতা করছে। আমি এটা পছন্দ করছি না।

শুভ এবং মৈত্রেয়ী পরস্পরের দিকে চেয়ে খুব গম্ভীর হয়ে গেল। শুভ মৃদু স্বরে বলল, আমি ওদের বলে দিয়েছি রজনীগন্ধা পাঠাতে। এখনই এসে যাবে।

রোজমারি শুভর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কিন্তু কে এরকম করছে বলতে পারো?

না ম্যাডাম। আমাদেরও একটু অবাক লাগছে।

ট্যাগের পিছনে আর আই পি লেখাটাও আমার ভাল লাগছে না।

আপনি কি রজার আইভ্যান পোলক নামে কাউকে মনে করতে পারছেন?

না শুভ, আমার স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল। মানুষের নাম আমার মনে থাকে। ওরকম নামের কাউকে আমি চিনি না। নামটা শুনিওনি কখনও।

শুভ বলল, তা হলে ভাবনার কথা।

মৈত্রেয়ী বলল, এটা প্র্যাকটিক্যাল জোক হতে পারে।

রোজমারি বলল, সেটা হতে পারে, কিন্তু রসিকতাটা করবে কে? আমার তেমন বন্ধু বান্ধবী তো এখানে কেউ নেই। শুভ, আমার তেষ্টা পেয়েছে। ফ্রুট ককটেল দিতে বলল তো আমাদের।

যতক্ষণ পানীয় না এল ততক্ষণ রোজমারি চুপ করে সোফায় বসে রইল। তার দু’পাশে দু’জন ছায়াসঙ্গী, শুভ আর মৈত্রেয়ী।

বেয়ারা পানীয় দিয়ে যাওয়ার পর মৈত্রেয়ী বলল, ম্যাডাম, আপনি অত ভাববেন না। ব্যাপারটা হয়তো সিরিয়াস নয়।

রোজমারি গেলাসে চুমুক দিয়ে বলল, কোনও ডিসকর্ড ঘটলে আমি অস্বস্তি বোধ করি। ঘটনাটা স্বাভাবিক নয়।

এগারোটা নাগাদ মনোজের ফোন এল।

রোজি, একটা ঘটনা ঘটেছে।

কী ঘটনা?

ডেলিগেটরা আসতে পারছেন না। ওঁদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওঁরা হোটেলে ফিরে গেছেন।

সে কী?

রাইটার্স থেকে ফেরার পথে ঘটনাটা ঘটেছে। সুব্রত ওঁদের সঙ্গে আছে। সে ফোন করলে ঘটনাটা জানতে পারব।

আর লাঞ্চের কী হবে?

 মনে হচ্ছে লাঞ্চ ক্যানসেল করতে হবে।

 আমি কি তাজ বেঙ্গলে যাব? বা কাউকে পাঠাব?

 দরকার নেই। সুব্রত ফোন করুক, তারপর দেখা যাবে।

আমি ওয়েট করছি।

শোনো, আর-একটা ঘটনা ঘটেছে।

কী ঘটনা?

হঠাৎ ইন্টারপোলের একজন অপারেটর এসে হাজির।

ইন্টারপোল! সে কী?

সে বলছে, ডেলিগেটদের মধ্যে একজন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল আছে। সে তাকে আইডেন্টিফাই করতে চায়। অপারেটরটি বাঙালি। তার নাম সুধাকর দত্ত।

এসব কী হচ্ছে বলো তো! অপারেটরটি কোথায়?

সে কমপ্লেক্স ঘুরে দেখতে গেছে। সঙ্গে সোনালি।

ডেলিগেটদের মধ্যে ক্রিমিন্যাল ঢুকবে কী করে? ওরা তো বেশির ভাগই সরকারি লোক। তিনজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আছেন, তারা সরকারি লোক না হলেও অনারেবল।

সব বলেছি। সুধাকর দত্ত বলছে, ক্রিমিন্যালটি সাধারণ নয়। সে একজন বিশেষজ্ঞ এবং নিজের নাম ব্যবহার করছে না।

তা হলে আমরা এখন কী করব?

বুঝতে পারছি না। কিন্তু তোমাকে নার্ভাস মনে হচ্ছে কেন? তুমি তো ঠান্ডা মাথার মেয়ে।

মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছি না। এ দিকেও কিছু ঘটনা ঘটছে।

কী হল রোজি?

দেখা হলে বলব। আমি নার্ভাস নই, বিরক্ত।

বুঝতে পেরেছি।

সুব্রত ফোন করার পরই আমাকে জানাবে।

ঠিক আছে।

ফোন ধরার সময় তার ছায়াসঙ্গী দু’জন সঙ্গে থাকে না। তারা জানে ফোনে এমন অনেক কথা হয় যা তাদের শোনা উচিত নয়।

রোজমারি ঘরে ফিরে এসে দু’জনকে বলল, তোমরা জানো আমাদের অফিসে আজ ইন্টারপোলের এজেন্ট এসেছে?

দু’জনেই অবাক হয়ে বলল, সে কী?

আজকের দিনটাই বড্ড গোলমেলে। ওদিকে ডেলিগেটদের একজন অসুস্থ। ওঁরা আসবেন কি না বোঝা যাচ্ছে না।

শুভ বলল, কীরকম অসুস্থ?

তা জানি না। সবকিছু ধাঁধার মতো লাগছে।

পানীয়টা ঢকঢক করে শেষ করল রোজমারি। তারপর চুপ করে বসে রইল চোখ বুজে।

অনেকক্ষণ বাদে শুভ বলল, আপনি যখন ফোনে কথা বলছিলেন তখন ফ্লোরিস্টের লোক এসে ফুল বদলে দিয়ে গেছে।

রোজমারি চোখ খুলে দেখল, একগোছা রজনীগন্ধা যেন হেসে উঠল।

ফুল সে খুব ভালবাসে। বিশেষ করে সাদা ফুল। মনটা হঠাৎ যেন এত খারাপের মধ্যেও ভাল হয়ে গেল। সে উঠে গিয়ে ফুলগুলোকে হাত দিয়ে একটু আদর করল। তারপর হঠাৎ শুভর দিকে চেয়ে বলল, শুভ, কেউ কি আমাকে খুন করতে চায়?

০৩.

লোকটাকে একটুও ভাল লাগছে না সোনালির। মনে হচ্ছে, লোকটা ধূর্ত ও কুট। কারখানা দেখার নাম করে লোকটা একটা নোটবই বের করে কী সব যেন টুকে নিচ্ছিল।

মেল্টিং শপ দেখে শুধু প্রশ্ন করল, আপনারা কোল গ্যাস ব্যবহার করেন বুঝি?

সোনালি বলল, হ্যাঁ।

চারদিকে ঘুরেটুরে দেখে বলল, প্রোডাকশন তো বোধহয় তেমন বেশি নয়।

না। এই অ্যালয় একটু রেয়ার টাইপের।

সবচেয়ে বেশি সময় নিল কেমিক্যাল ল্যাবে। ল্যাবের ইনচার্জ ড. ইউ প্রসাদ একজন মস্ত ডিগ্রিধারী মানুষ। দীর্ঘকাল আমেরিকায় কাজ করেছেন। বয়স্ক লোক, কাজে ডুবে থাকতে ভালবাসেন। সুধাকর অনেকক্ষণ চাপা গলায় কথা বলল প্রসাদের সঙ্গে। কী কথা হচ্ছে তা চার-পাঁচ ফুট দূরত্বে বসেও সোনালি বুঝতে পারছিল না। কথা বলতে বলতে টেবিলের তলায় আড়ালে নোট করা অব্যাহত ছিল।

ল্যাব থেকে বেরিয়ে বাগান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুধাকর জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম আপনি ক’দিন এখানে কাজ করছেন?

এক বছর।

তা হলে তো অনেক কিছুই জানেন।

কী জানব?

এই এখানকার টেকনিক্যাল ব্যাপারস্যাপার।

না। আমি সায়েন্টিস্ট নই। আমার কাজ অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে।

তা হলেও কিছু নিশ্চয়ই জানেন। কোন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডার পান আপনারা?

তার কোনও ঠিক নেই।

ইন্ডাস্ট্রি অনেক রকমের আছে। আপনাদের অ্যালয়টা ঠিক কোন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজে লাগে বলতে পারেন?

না। আমার জানা নেই।

হয়তো আপনি বলতে চাইছেন না।

এ ব্যাপারে আপনি মনোজবাবুর সঙ্গেই কথা বলতে পারেন।

সুধাকর দত্ত একটা ছোট্ট ক্যামেরা বের করে চটপটে হাতে কারখানার কয়েকটা ছবি তুলে নিল বাগানে দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা ভাল লাগল না সোনালির। সে অবশ্য প্রতিবাদও করল না। ইন্টারপোলের এজেন্টদের হয়তো এসব স্বাধীনতা আছে।

লোকটা ক্যান্টিনের কাছ বরাবর এসে নাক তুলে একটু গন্ধ শুকে বলল, মাদ্রাজি খাবারের গন্ধ পাচ্ছি। আপনাদের ক্যান্টিন কি কোনও সাউথ ইন্ডিয়ান চালায়?

না। তবে সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশ তৈরি হয়।

মিস সোম, আপনি কি বিবাহিতা?

সোনালি একটু অবাক ও বিরক্ত হয়ে বলল, কেন?

এমনি।

আমি ডিভোর্সি।

মুখে একটু আপশোসের চুক চুক করে সুধাকর দত্ত বলল, আজকাল ডিভোর্স খুব বেড়ে গেছে, না?

হবে হয়তো। সোনালি নিস্পৃহ জবাব দিল।

সুধাকর দত্ত হঠাৎ ফের জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জানেন রোজমারির এটাই প্রথম বিয়ে কি না!

বিরক্ত সোনালি বলল, তা আমি কী করে বলব?

আহা, মেয়েরা তো অনেক কিছু টের পায়। ইন্সটিংক্ট।

না। ওসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

সুধাকর দত্ত যেন বেড়াতে এসেছে, এরকমই হাবভাব। নিশ্চিন্ত মনে বাগানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বলল, বাগানখানা বেশ সুন্দর, না?

সত্যিই সুন্দর। কারখানার ভিতরে এই বাগান এবং দুর্লভ নানারকম গাছগাছালি লাগানোর শখ রোজমারির। প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে, অনেক পরিশ্রম গেছে তার। বনবিভাগের সহযোগিতায় অবশেষে হয়েছে এই বাগান। সোনালি অবশ্য অত কথায় গেল না। শুধু বলল, হ্যাঁ, বেশ সুন্দর।

সুধাকর হঠাৎ তার দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা মনোজবাবু কি খুব এফিশিয়েন্ট লোক?

 তার মানে?

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই কারখানার আইডিয়া, একজিকিউশন, এসবের পিছনে আছেন রোজমারি। তাই না?

দেখুন, আমি এত সব জানি না। আপনি যা খুশি ডিডাকশন করতে পারেন, আমার মতামত চাইবেন না।

আপনি একটু শর্ট টেম্পার্ড। আচ্ছা ঠিক আছে। শুধু এটুকু তো বলতে পারেন, আমি যা বললাম তা ভুল না ঠিক!

না, তাও পারি না। আমাদের কিন্তু হাতে সময় নেই। ডেলিগেটরা এসে পড়বেন।

সুধাকর দত্ত অবাক হয়ে বলল, কারা আসবে?

ফরেন ডেলিগেটরা।

তাই নাকি?

কেন, আপনি জানেন না?

জানি। কিন্তু তারা যে আসবেনই এমন গ্যারান্টি নেই।

কী যা তা বলছেন?

ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, দেয়ার আর মেনি এ স্লিপস, বিটউইন দি কাপ অ্যান্ড দি লিপস!

তা আছে। কিন্তু আমাদের সত্যিই সময় নেই।

ব্যস্ত হবেন না। ডেলিগেটদের আসার সময় হলে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিক টের পাবে।

সোনালি হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। আপনি বরং একা একাই কমপ্লেক্সটা ঘুরে দেখুন, আমি অফিসে যাচ্ছি।

সেটা কি উচিত হবে? এখনও সবাই তো আমাকে চেনে না। একজন ইনট্রিউডার হিসেবে ট্রিট করতে পারে। তা ছাড়া আপনার কাছ থেকে আমার আরও কিছু জানার আছে।

বরং তা হলে সেটাই জানুন।

হ্যাঁ। আসুন, ওখানে একটা চমৎকার পাথরে বাঁধানো বসার জায়গা দেখতে পাচ্ছি। ছায়া আছে। একটু বসি?

একটা ঝুপসি সুন্দর গাছের নিবিড় ছায়ায় গাছটাকে ঘিরে সুন্দর শ্বেতপাথরের স্ল্যাব বসানো। সামনেই একটা ফোয়ারা রয়েছে। একটা ছোট্ট সরু পাথরে বাঁধানো জলপথ চলে গেছে এঁকেবেঁকে। সেই জলধারার ওপর ধনুকের মতো বাঁকা পাথরের সাঁকো। ভারী সুন্দর রুচির পরিচয় দিয়েছেন রোজমারি।

বসবার পর সুধাকর তার কাঁধের ব্যাগটার মুখ খুলে ভিতরে যেন কিছু খুঁজল। তারপর হাতখানা ভিতরে রেখেই বলল, খুবই সাধারণ প্রশ্ন। জবাব দেবেন?

চেষ্টা করতে পারি।

সাক্কি ইনকরপোরেটেড নামে একটা কোম্পানির নাম শুনেছেন?

না।

ভাল করে ভেবে বলুন।

ভাববার কিছু নেই। শুনিনি।

নামটা বিদেশি। উচ্চারণে সবসময়ে ধরা যায় না। আপনারা হয়তো সাক্কিকে শচি বা সাচি বলে উল্লেখ করেন।

সোনালি একটু থমকাল। শচি ইনকরপোরেটেডের সঙ্গে এই কোম্পানির ট্রানজ্যাকশন আছে। কিন্তু লোকটাকে সেকথা কি বলা উচিত হবে? সে একটু ভেবে বলল, রেকর্ড না দেখে বলা যাবে না।

আপনি একটু ফল্টার করলেন। আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে নামটা আপনার অচেনা নয়।

সোনালি মাথা নেড়ে বলল, অনেক কোম্পানির সঙ্গে এঁদের ট্রেড আছে। সব কোম্পানির নাম কি মনে রাখা সম্ভব?

ফর দি টাইম বিয়িং আপনার যুক্তি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু তর্ক বা জেরা করতে আমি এতদূর আসিনি। ধরেই নিচ্ছি সাক্কির সঙ্গে আপনাদের ব্যাবসা আছে।

আপনি অনেক কিছুই ধরে নিতে পারেন। কিন্তু আমাদের আর সত্যিই সময় নেই। ওঁরা হয়তো এসেই পড়েছেন।

সুধাকর মৃদু একটু হেসে বলল, ওঁরা আসছেন না। এলে সবার আগে আমি টের পাব।

কী করে টের পাবেন?

এ যুগটা উন্নত প্রযুক্তির যুগ। আমার পকেটে এই যে কলমের মতো জিনিসটা দেখছেন এটা আসলে একটা বিপার। ওঁরা এদিকে রওনা হলেই এই বিপার আওয়াজ দেবে। কারণ আমার একজন কলিগ ওঁদের অনুসরণ করছেন।

ও, তা হলে—

চিন্তা করবেন না। উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। এখন ফের আমরা সাক্কির প্রসঙ্গে আসি।

বললাম তো, আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি মনোজবাবুর সঙ্গেই তো কথা বলতে পারেন।

পারি। কিন্তু আপনার কাছ থেকে জেনে নিতে পারলে আমার অ্যাডভান্টেজ বেশি থাকবে।

অ্যাডভান্টেজ! কীসের অ্যাডভান্টেজ?

আছে একটা কিছু।

দেখুন, আমার আর এসব কথা ভাল লাগছে না।

আমার প্রশ্নগুলো তো একটুও অস্বস্তিকর নয় মিস সোম। তবে বিরক্ত হচ্ছেন কেন?

যা আমি জানি না আপনি তাই নিয়ে কেন বারবার প্রশ্ন করছেন?

শুধু বলুন সাক্কি ইনকরপোরেটেডের ব্যাবসাটা কী?

বললাম তো জানি না। সোনালি ভীষণ রেগে যাচ্ছিল। হয়তো অভদ্রের মতো উঠে যেত। কিন্তু ঠিক এই সময়ে সুধাকরের বিপার থেকে একটা ক্ষীণ বংশীধ্বনির মতো আওয়াজ হল। সঙ্গে সঙ্গে সুধাকর ব্যাগ থেকে একটা খুদে সেলুলার ফোন বা ওয়াকিটকি গোছের কিছু একটা বের করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সুধাকর। ফোনটা যথাস্থানে রেখে একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, যাক, ওঁরা এখানে আসছেন না।

আসছেন না?

না।

কেন?

সুধাকর একটু হেসে বলল, অজুহাত একটা আছে। ওঁদের একজন একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এনিওয়ে, অল ফর দি গুড। এখন আমরা পুরনো কথায় ফিরে আসতে পারি কি? রিগার্ডিং ইনকরপোরেটেড?।

বললাম তো জানি না।

আপনার জানা নেই, বলছেন? আপনি গত এক বছর ধরে মনোজবাবুর একান্ত সচিব। অনেক ট্রেড সিক্রেট আপনার জানা।

আপনি যা খুশি মনে করতে পারেন। কিন্তু আমি কিছু কমিট করছি না।

আপনাকে কমিট করতে হবে না। ভিতরকার কথা হয়তো আপনি জানেন না। কিন্তু ট্রেডের ব্যাপারটা তো গোপন থাকতে পারে না আপনার কাছে। বিশেষ করে আপনি কন্ট্রাক্টগুলো হ্যান্ডেল করেন, করেসপন্ডেস করেন।

 হ্যাঁ, আমি তো বলেইছি, এঁদের ব্যাবসা বেশ বড়। অনেক কোম্পানি এঁদের অ্যালয় কেনেন। সব কোম্পানিকে মনে রাখা সম্ভব নয়।

ছেড়ে দিন। লেট আস ফরগেট সাক্কি ইনকরপোরেটেড। এখন বরং আপনার কথা বলুন।

সোনালি অবাক হয়ে বলল, আমার কথা! আমার কথা কেন আপনাকে বলতে যাব?

আরে না, তা নয়। আপনার পারসোনাল লাইফ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে চাইছি না। দয়া করে বলবেন কি আপনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল আ্যালয়ে চাকরিটা কী করে পেলেন?

সোনালি একটু অপমান বোধ করে বলল, কেন, তাই বা কেন বলতে যাব আপনাকে?

থ্রু প্রপার চ্যানেল?

তা ছাড়া আর কী হতে পারে?

এনি রেফারেন্স?

এখানে আমার মতো আরও অনেকেই চাকরি করে। আপনি কি সকলকে এরকম প্রশ্ন করতে পারেন?

না। আর কারও সম্পর্কে আমার কৌতূহল নেই। কারণ তারা কেউ গোপীনাথ বসুর এক্স-ওয়াইফ নয়।

সোনালি একটু শিউরে উঠল নামটা শুনে। গোপীনাথ বসু তার প্রাক্তন স্বামী।

আপনি তাকে চেনেন?

মুখোমুখি পরিচয় নেই। তবে জানি। হি ইজ এ স্মার্ট গাই।

ও। কিন্তু আমি তার এক্স-ওয়াইফ বলে কোনও অপরাধ করিনি তো?

আরে না। মাইন্ড করবেন না। গোপীনাথকে বিয়ে বা ডিভোর্স যাই করে থাকুন আমাদের কিছু যায় আসে না। তবে উই আর ইন্টারেস্টেড ইন হিম।

সোনালি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ও।

সুধাকর ফের একটু হেসে বলল, আপনার সঙ্গে তার বিয়েটা কতদিন টিকে ছিল বলবেন?

প্রায় দু’বছর।

বনিবনা হল না, না?

না।

গোপীনাথের অ্যাকটিভিটি সম্পর্কে আপনি কতখানি জানেন?

ও একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কনসালট্যান্ট।

হ্যাঁ, সেসব আমরা জানি। উনি উচ্চশিক্ষিত এবং হাইলি সাকসেসফুল।

 হ্যাঁ। আমি এটুকুই জানি।

আপনার সঙ্গে আফটার ডিভোর্স গোপীনাথের কোনও সম্পর্ক আছে কি?

সোনালি সামান্য রেগে গিয়ে বলল, না। কেন থাকবে?

আহা, আজকাল তো ডিভোর্সের পরও অনেক এক্স হাজব্যান্ড এবং ওয়াইফ পরস্পরের বন্ধু হিসেবে থাকে।

না। আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।

 গোপীনাথ বসু যে এখন বিদেশে চাকরি করে তা কি আপনি জানেন?

সেইরকমই শুনেছিলাম।

কোথায় এবং কোন কোম্পানিতে চাকরি করে তা কি জানেন?

না। জানার কথাও নয়।

ঠিক আছে। এবার চলুন, যাওয়া যাক। আমার বেশ খিদে পেয়েছে।

সোনালি আগে, লোকটা দু’পা পিছনে। তারা এসে অফিসের রিসেপশনে ঢুকল। মনোজ রিসেপশনেই দাঁড়িয়ে ফোন করছিল কাকে যেন। হাতের ইশারায় তাদের অপেক্ষা করতে বলে কথা শেষ করে ফোন রেখে বলল, হ্যাঁ, মিস্টার দত্ত, একটা কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে।

সুধাকর বলল, ডেলিগেটদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে তো! শুনেছি, স্যাড কেস।

সুতরাং আপনার তো এখানে নিশ্চয়ই আর দরকার নেই।

 ইউ ওয়ান্ট মি আউট অফ ইয়োর হেয়ার, তাই না? বলে সুধাকর বেশ উঁচু গলায় হাসল।

মনোজ একটু অপ্রতিভ হয়ে হেসে বলল, মানে তা ঠিক নয়। আপনাকে এখন বোধহয় ওঁদের হোটেলেই যেতে হবে। তাই বলছিলাম–

ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। বাই দি বাই, আপনার কমপ্লেক্সটা কিন্তু খুব সুন্দর।

থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি কমপ্লিমেন্টস।

সোনালিদেবীও খুব কো-অপারেট করেছেন।

শুনে খুশি হলাম।

সুধাকর সোনালির দিকে চেয়ে একটু হাসল। বলল, বাই। সুধাকর বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর মনোজ সোনালিকে জজ্ঞেস করল, কী চাইছিল লোকটা বলুন তো!

ঠিক জানি না।

বেফাঁস কিছু জিজ্ঞেস করেনি তো?

না।

তা হলে তো ঠিকই আছে। আমি একটু টেনশনে ছিলাম। সোনালি দোতলায় উঠে তার ঘরে ঢুকে চুপ করে কম্পিউটার মনিটরের সামনে বসে রইল। মনোজের টেনশন কমলেও তার কমেনি। তার টেনশন শুরু হল।

প্রথম কথা, ‘সাক্কি ইনকরপোরেটেড’ তাদের মস্ত বড় ক্লায়েন্ট। দ্বিতীয় কথা, তার ভূতপূর্ব স্বামী গোপীনাথ বসু সাক্কির সঙ্গে খুব গম্ভীরভাবে যুক্ত। লোকটা হয়তো সব জানে। কিন্তু সোনালি বুঝতে পারছে না সাক্কি বা উচ্চারণভেদে শচি ইনকরপোরেটেডকে নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে। সাক্কি নানারকম অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ তৈরি করে বলে সে জানে। পৃথিবীর অনেক দেশে তাদের কারখানা আছে।

সোনালি চিন্তা করতে লাগল। গম্ভীরভাবে।

৪.

প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলির একটি অনভিজাত পাড়ায় দোতলার একটি ছোট ফ্ল্যাটে মধ্যরাত্রে টেলিফোন বেজে যাচ্ছিল। একজন ক্লান্ত মানুষ গভীর ঘুম থেকে ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ উঠে বসে টেলিফোন তুলে নিয়ে চোস্ত ফরাসিতে বলল, আমি বোস বলছি।

সুপ্রভাত মঁসিয়ে বোস।

আপনি কে?

 আমার নাম পল বা জন বা লিওনার্দো যা খুশি হতে পারে। আপনি আমাকে পল বলেই ডাকবেন। অবশ্য ডাকবার দরকারও হয়তো আর হবে না।

এসব কীরকম হেঁয়ালি?

মঁসিয়ে বোস, কাল বিকেলে শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে পুবদিকে একটি বিমান ছেড়ে যাবে। তাতে আপনার একটি সিট বুক করা আছে। তাই না?

হ্যাঁ। তাতে কী?

মঁসিয়ে বোস, আপনি কি টোকিওতে মরতে চান? নাকি ব্যাঙ্ককে? সিঙ্গাপুর, না মেলবোর্নে? আপনি যে-কোনও জায়গা বেছে নিতে পারেন। কোথায় মরতে আপনি পছন্দ করবেন প্রিয় মঁসিয়ে বোস?

ঘুম-ভাঙা লোকটির বুক কাঁপছিল, ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে এই রসিকতা তার ভাল লাগছিল না। অবশ্য রসিকতা নাও হতে পারে। উগ্রবাদের এই যুগে কিছুই

অবিশ্বাস্য নয়। সে গলাটা স্বাভাবিক রেখে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, একটু বুঝিয়ে বলুন।

আমি শুধু সরল একটা প্রশ্ন করছি। আপনি কোথায় মারা যেতে পছন্দ করবেন?

মারা যেতে আমি পছন্দ করি না।

 কিন্তু প্রিয় মঁসিয়ে বোস, আমরা যে আপনার ওপর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছি। মরতে যে আপনাকে হবেই।

তা হলে আমি কোথায় মরতে চাই জিজ্ঞেস করছেন কেন? মরতে যদি হয়ই তা হলে প্যারিসই বা দোষ করল কী? প্যারিসে তো হাজার গন্ডা উগ্রবাদী ঢুকে বসে আছে।

 পল একটু হেসে বলল, আপনি রসিক ব্যক্তি। কোনও রসিক ব্যক্তিকে মারা আমি পছন্দ করি না। পৃথিবীতে রসিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যাই হোক, আমরা আপনাকে জানাতে চাইছি, আমাদের সংগঠন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমাদের হাত থেকে আপনার পালানোর কোনও পথ নেই। পৃথিবীর যে-কোনও জায়গাতেই আপনাকে হত্যা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব।

শুনে খুশি হলাম। কিন্তু আমি পালাতে চাইছি, একথা আপনাকে কে বলল?

হয়তো আমাদের শর্ত শুনলে চাইবেন।

 নাও চাইতে পারি। আমি মরতে পছন্দ করি না বটে, কিন্তু আমার মৃত্যুভয় নেই।

 মঁসিয়ে বোস, আপনি কি নিজেকে খুব সাহসী লোক বলে মনে করেন?

না। বরং আমি বেশ ভিতুই।

 তা হলে মরতে ভয় পান না বলছেন কেন?

বলছি, কারণ সত্যিই আমার মৃত্যুভয় নেই।

শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণাকেও কি ভয় পান না?

বোস নামক লোকটি একটু হাসির শব্দ করে বলল, যথেষ্ট নাটক হয়েছে। আপনি আসল কথাটা বলার আগে জমি তৈরি করতে চাইছেন। ওসব আমি জানি। কাজের কথায় আসুন।

এই কারণেই বুদ্ধিমানদের সঙ্গে কাজ করে সুখ আছে।

সে তো বটেই। কিন্তু এখন রাত দুটো বাজে এবং আমি সত্যিই ক্লান্ত। দয়া করে কথাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেললে আমি আরও ঘণ্টা পাঁচেক ঘুমিয়ে নিতে পারি। ঘুমটা আমার সত্যিই দরকার।

মঁসিয়ে বোস, আমরা আপনার কাছ থেকে একটা জিনিস চাই।

কী জিনিস?

এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি-র একটা বিস্তারিত কম্পিউটার প্রিন্ট আউট।

 বোস হঠাৎ একটু শক্ত হয়ে গেল। তারপর সহজ এবং তরল গলায় বলল, সেটা আবার কী?

মঁসিয়ে বোস, আপনি নিজেই বলছিলেন আপনি ক্লান্ত এবং আপনার ঘুম দরকার। তা হলে কথা বাড়াচ্ছেন কেন? এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি কাকে বলে তা আপনি না জানলে আর কে জানবে? ওটি তো আপনারই মস্তিষ্কপ্রসূত।

বোস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না মঁসিয়ে পল, আমার একার মাথায় কাজটা হয়নি। বিজ্ঞানের এটা সে যুগ নয় যে, একজন বৈজ্ঞানিক হঠাৎ করে একটা কিছু যুগান্তকারী জিনিস আবিষ্কার করে ফেলবে। এখন হচ্ছে দলগত কাজ, দীর্ঘ গবেষণা, অন্তহীন চেষ্টা এবং কঠোর পরিশ্রমের যুগ। অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাবনিকাশ, নিখুঁত এবং পর্যায়ক্রমে এগোনো। এখন একটা আবিষ্কার যে কত জটিল ও কঠিন পদ্ধতিতে হয় এবং তার পিছনে জলের মতো যে কত টাকা খরচ হয় তা কি আপনি জানেন মঁসিয়ে পল?

 জানি মঁসিয়ে বোস। আমি নিজেও একজন ছোট মাপের বিজ্ঞানকর্মী। আপনার মতো বড় ডিগ্রি এবং ধুরন্ধর প্রতিভা আমার নেই বটে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানকর্মের কিছু খোঁজখবর আমি রাখি।

ধন্যবাদ মঁসিয়ে পল। কিন্তু এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি সম্পর্কে আপনার তথ্য ঠিক নয়। আমরা একটা জিনিস তৈরি করার চেষ্টা করছি মাত্র। সেই গবেষণা এখনও শেষ হয়নি। হলেও তা যে সাফল্যমণ্ডিত হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। অনেক সময়েই এইসব গবেষণায় প্রচুর ব্যয় হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। কিন্তু এ সম্পর্কে আপনার এত উৎসাহ কেন?

মঁসিয়ে বোস, আপনি একজন প্রতিভাবান মিথ্যেবাদী। এত সুন্দর সাজিয়েগুছিয়ে মিথ্যে কথাগুলো বললেন যে আমার সেগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে হলেও উপায় নেই মঁসিয়ে বোস। আপনার মতো মানুষকে বিশ্বাস করা মানে প্রচণ্ড বোকামি।

বিশ্বাস করা বা না-করা আপনার অভিরুচি। কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই।

মঁসিয়ে বোস, আপনি চতুর এবং সাহসী। কিন্তু সাহসও মাঝে মাঝে বোকামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আপনি তো জানেন এ যুগটা ব্যক্তিগত সাহস, শিভালরি বা তথাকথিত সততার যুগ নয়। কুট বুদ্ধি এবং অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াই এ যুগের ধর্ম। তা ছাড়া আমি একটি বিশাল সংগঠনের সামান্য একজন অপারেটর মাত্র। আমাকে প্রত্যাখ্যান করা মানে সেই সংগঠনটিকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করা। আশা করি বুঝবেন, আমি রাত দুটোয় আপনার সঙ্গে রসিকতা করছি না।

আপনারা আসলে কারা তা কি জানতে পারি মঁসিয়ে পল?

পারেন মঁসিয়ে বোস। আমরা হচ্ছি ভিকিজ মব।

বোস একটু শিহরিত হল। আজকের লে মদ কাগজেও দুটি নৃশংস ও নিপুণ হত্যাকাণ্ডের খবর ছিল। ফরাসি পুলিশ অনুমান করছে, এটি কুখ্যাত ভিকিজ মব-এর কাজ। গলাটা তবু স্বাভাবিক রেখে এবং একটু বিস্ময় প্রকাশ করে বোস বলল, ভিকিজ মব? ও হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম একটা নাম যেন আজকের খবরের কাগজেও দেখেছি।

আপনি একজন চমৎকার অভিনেতাও মঁসিয়ে বোস। আমি টুপি খুলে ফেলেছি। আর আপনার রক্তও বেশ ঠান্ডা।

আপনি বৃথাই আমার প্রশংসা করছেন। আমি নিজের কাজ নিয়ে উদয়াস্ত ব্যস্ত থাকি। বাইরের জগতের তেমন খোঁজখবর রাখি না। ভিকিজ মব কি খুবই বিখ্যাত সংগঠন?

বিখ্যাত নয়, কুখ্যাত। মঁসিয়ে বোস, আপনার স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল এবং আপনি মোটেই খুব আপনভোলা লোক নন। আপনার যাবতীয় খোঁজখবর এবং তথ্যাদি আমাদের ডাটা ব্যাঙ্কে মজুত রয়েছে। আপনি সাক্কি ইনকরপোরেটেডের গবেষণা শাখার প্রধান ব্যক্তি। সাক্কি আপনাকে বছরে কয়েক লক্ষ ডলার বেতন দেয়। দু’বছর আগে আপনি একমি করপোরেশনের গবেষণাগারে ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়ুলে সেই চাকরি করার সময় আপনি একমি করপোরেশনের প্রায় একশো মিলিয়ন ডলারের একটি গবেষণাকর্ম ভেস্তে দিয়েছিলেন। আপনি ইয়ুল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় পালিয়ে যান। আপনি প্যারিসে এসেছেন একটি মাইক্রো কম্পিউটার কোম্পানির কাজকর্ম দেখে একটি চুক্তি করতে। আপনার কোম্পানি যে বহনযোগ্য ছোট ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে এটা তার শেষ ধাপ। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি আফ্রিকার কোনও একটি দেশ থেকে চূড়ান্ত সতর্কতার ঘেরাটোপে হাতেকলমে পরীক্ষা করা হবে। আপনাদের টার্গেট প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও জনমানবহীন দ্বীপ অথবা দক্ষিণ মেরুর কোনও নির্জন জায়গা।

দাঁড়ান মঁসিয়ে পল, দাঁড়ান। রাত দুটোর সময় আপনি যে আমাকে রূপকথার গল্প শোনাতে বসলেন। বহনযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কথাটা কি স্ববিরোধী নয়? আপনি নিজে বিজ্ঞানের লোক হয়ে এরকম অবৈজ্ঞানিক কথা বলছেন কী করে?

মঁসিয়ে বোস, আপনার ওপর নজরদারি করার জন্য আমাদেরও বছরে কয়েক লক্ষ ডলার খরচ হয়। কথাটা কবুল করলাম, যাতে আপনাকে আর অভিনয় করার কষ্টটা স্বীকার করতে না হয়।

আপনি সবজান্তা হলেও আমি নাচার। আমার কাছে আপনার এইসব কথা পুরো ধাঁধার মতো লাগছে। একটা বহনযোগ্য ছোট ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে কতখানি জ্বালানি ভরা যাবে মঁসিয়ে পল, যাতে তা হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করতে পারবে?

সেটা আমার জানার কথা নয়। আপনার জানার কথা। আর আমরা আপনার কাছ থেকেই জানতে চাই।

ভিকিজ মব কি বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করে মঁসিয়ে পল?

আজ্ঞে না। আমরা আর একজনের হয়ে কাজ করছি মাত্র।

সেই আর একজন কে?

আপনার পক্ষে সেটা জানা অস্বাস্থ্যকর হতে পারে।

আপনি আমার স্বাস্থ্য নিয়ে খুবই চিন্তিত দেখছি।

আজ্ঞে হ্যাঁ, খুবই চিন্তিত। কারণ আপনার সহকারী এক গবেষক ইতিমধ্যেই খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন কলকাতার এক বড় ক্লিনিকে শয্যাশায়ী। নাও বাঁচতে পারেন।

সচকিত হয়ে বোস এই প্রথম উত্তেজিত গলায় বলল, কে? কার কথা বলছেন?

আপনার প্রিয় আদ্রেঁ।

আদ্রেঁ! তার কী হয়েছে?

উনি সকালে কফির সঙ্গে সামান্য একটু বিলম্বিত ক্রিয়ায় বিষ পান করেছেন।

সর্বনাশ!

সেইজন্যই আপনার স্বাস্থ্য বিষয়েও আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন মঁসিয়ে বোস।

বোস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলাল। তারপর শান্ত গলায় বলল, আদ্রেঁকে কি আপনারা খুন করলেন?

ওভাবে বললে আমরা একটু বিব্রত বোধ করি। তবে স্বীকার করতে বাধা নেই, কাজটায় আমাদের একজন এজেন্টের হাত ছিল।

আদ্রেঁর অপরাধ কী?

উনি একজনকে চিনতে পেরেছিলেন। এর বেশি আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

আদ্রেঁ কি বেঁচে আছে?

মস্তিষ্কের মৃত্যু বলে ডাক্তারি শাস্ত্রের একটা কথা আছে না?

আছে।

 প্রিয় মঁসিয়ে বোস, আদ্রেঁ বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই।

আপনারা খুবই ভয়ংকর লোক।

পল একটু হাসল। বলল, আমাদের মৃত্যু-শিল্পীও বলতে পারেন। আমরা মোটা দাগের উগ্রবাদীদের মতো দুমদাম বোমা-বন্দুক ব্যবহার করি না, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে। অপ্রয়োজনে নিরীহ মানুষকেও মারি না। আমরা শিল্পসম্মত এবং অনাটকীয়ভাবে কাজ করতে ভালবাসি।

কিন্তু আপনারা কি জানেন যে আদ্রেঁ মারা গেলে আমাদের গবেষণা আটকে যাবে এবং এই শেষ পর্যায়ের কাজ আরও বহুদিন পিছিয়ে যাবে?

না মঁসিয়ে বোস, আমার তা জানার কথা নয়। তবে আরে না মরে কোনও উপায় ছিল। অপারগ না হলে আমরা কাউকে মারি না।

আপনারা পিশাচ।

যা ঘটে গেছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না মঁসিয়ে রোস। ওটা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়।

দুঃখিত মঁসিয়ে পল, আপনার প্রস্তাব আমি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলাম। ভিকিজ মব যা খুশি করতে পারে, আমি পরোয়া করি না। শুভ রাত্রি।

বলেই বোস ফোনটা রেখে দিল। এবং পরমুহূর্তেই তুলে কলকাতার একটা নম্বর ডায়াল করল। অনেকক্ষণ রিং বেজে যাওয়ার পর একটা ঘুমকাতর পুরুষের গলা বলে উঠল, হ্যালো।

সুব্রত, আমি গোপীদা বলছি, প্যারিস থেকে।

আরে বলুন গোপীদা, কী খবর?

খবর তুমিই দেবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের ব্যাপারে যে দলটা গিয়েছিল তাতে একজন ছিল আদ্রেঁ। তার খবর কী?

স্যাড কেস গোপীদা, উনি খুব অসুস্থ।

বেঁচে আছে?

কাল রাত বারোটা অবধি উডল্যান্ডসে ছিলাম। তখন অবস্থা ভাল ছিল না। এখন সকাল সাড়ে সাতটা। একটা ফোন করে দেখব?

দেখো। কিংবা আমাকে নম্বরটা দাও। আমি ফোন করছি।

 নম্বরটা টুকে নিয়ে ফের ডায়াল করল গোপীনাথ বসু। যা খবর পেল তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। আদ্রেঁর বাঁচার কোনও আশাই নেই।

ফোন রেখে গোপীনাথ ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে রইল। কাকে চিনতে পেরেছিল আদ্রেঁ?

বাকি রাতটা আর ঘুম হবে না তার। মাথাটা গরম, আর বুকটা অন্ধকার। আদ্রেঁ তরুণ যুবা নয়, পঞ্চান্ন বছরের মধ্যবয়সি মানুষ। বুদ্ধিমান, সংযতবাক, খুবই কর্মঠ মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করেছে। অভিজ্ঞতাও অনেক। সাক্কি ইনকরপোরেটেডে তাকে নিয়ে এসেছিল গোপীনাথ নিজেই। আদ্রেঁর মৃত্যুর জন্য কি সে-ই দায়ী থাকবে?

গোপীনাথ ঘরের এক কোণে একটা চেয়ারে বসে ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতেই টেলিফোন ডিরেক্টরি খুলে একটা দৈনিক কাগজের অফিসে ফোন করল।

আপনারা কি আমাকে ভিকিজ মব সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেন?

আপনি একটু লাইনটা ধরুন। একজন মহিলার কণ্ঠ বলল।

কিছুক্ষণ পর ফোনে মহিলা বললেন, ভিকি একজন দক্ষিণ আমেরিকার লোক। বেস ছিল ব্রাজিলে। দশ বছর আগে তার একবার জেল হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সে পালায়, ভিকি পেশাদার অপরাধী। সারা পৃথিবীতে তার অপারেটররা কাজ করে। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রী দেশগুলির হয়ে সে অনেক কিছু করেছে। এক সময়ে তার প্রধান কাজ ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে যেসব মগজওলা লোক পালিয়ে যায়, যেমন বৈজ্ঞানিক, গবেষক, লেখক, গায়ক বা শিল্পী, তাদের ধরে আনা বা খতম করা। এ কাজে সে মোটা টাকা নিত।

এখন সে কোথায় থাকে?

সে এক জায়গায় থাকে না।

ধন্যবাদ। প্যারিসে তার এজেন্ট কে আছে জানেন?

দাতা।

দাতা? পুরো নাম কী?

এস দাতা।

তার সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে হতে পারে।

 তা জানি না। আন্ডারওয়ার্ল্ড জানে। প্যারিসের গুন্ডা বদমাশরা জানবে।

এরকম কারও খোঁজ দিতে পারেন। আমার প্রয়োজনটা জরুরি।

লাইনটা ধরুন, দেখছি।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি বলল, দুঃখিত। আমাদের যে রিপোর্টার এসব জানে সে এখন নেই।

ধন্যবাদ।

টেলিফোনটা রেখে দিল গোপীনাথ। কিন্তু রাখতেই টেলিফোনটা তারস্বরে বেজে উঠল।

গোপীনাথ ফোনটা তুলে নিল।

০৫.  

খুব ভোরবেলা রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে বলে রোজমারি এ সময়টায় নিজেই গাড়ি চালায়। গাড়ি চালিয়ে সে আসে ময়দানে। ভোরের ময়দানের মতো সুন্দর জায়গা কলকাতায় নেই। রোজমারির পরনে থাকে শর্টস, গায়ে কখনও কামিজ, কখনও টি-শার্ট, পায়ে দৌড়োনোর জুতো। সকালে খানিকটা দৌড় এবং খানিকটা জগিং করার পর সে কয়েকটা বেন্ডিং করে। তারপর বাড়ি ফেরে। এই সময়টায় সে কোনও সঙ্গী পায় না। তার স্বামীর শরীরবোধ কম, ব্যায়ামট্যায়ামের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই। সকালে ঘুম থেকে তাকে তোলাই মুশকিল। রোজমারিকে তাই একাই আসতে হয়।

আজও রোজমারি একা। ভোর সাড়ে চারটের আবছা আলোয় প্রেতপুরীর মতো ফাঁকা কলকাতার পথ। রোজমারির একটু অস্বস্তি হচ্ছে। গতকাল অনেকগুলো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেছে। তাকে কেউ ভুল করে বা ইচ্ছে করে লাল গোলাপ পাঠিয়েছে। না, ভুল করে নয় মোটেই। ইচ্ছে করেই। কারণ, ফ্লোরিস্টকে ফোন করে লাঞ্চ টেবিলের জন্য রজনীগন্ধার বদলে লাল গোলাপ পাঠাতে বলাটা তো আর ভুল করে করা নয়। তার ওপর ডেলিগেটদের একজনের অসুস্থ হওয়া এবং ইন্টারপোলের এক এজেন্টের আগমন, সবটাই একটা জিগস পাজলের মতো।

ময়দানে রোজমারি একা নয়। এখানে তার এক বান্ধবী জুটেছে। ডোরিন। ডোরিন জার্মান মেয়ে, বিয়ে করেছে মার্কিন কনসুলেটের এক অফিসারকে। সেই সুবাদে ডোরিন কলকাতায় থাকে এবং রোজ সকালে জগিং করতে ময়দানে আসে। ভিক্টোরিয়ার মূল ফটকের উলটো দিকে তাদের গাড়ি পার্ক করা হয়। দু’জনে একসঙ্গে হয়ে দৌড়োয়।

গাড়িটা পার্ক করল রোজমারি। ডোরিনের গাড়ি এখনও আসেনি। রোজমারি চুপ করে গাড়িতে বসে রইল। চারদিকে কুয়াশার আস্তরণ। একটু আবছা পথঘাট। লোকজন বেড়াতে বেরিয়েছে। কয়েকজন দৌড়োচ্ছেও। এত ভোরেও জায়গাটা নির্জন নয়। কলকাতার মতো ভিড়াক্রান্ত শহর রোজমারি দেখেনি। এত ভিড় তার ভাল লাগে না। কিন্তু আজ এই ভোরে চারদিকে লোকজন দেখে, কেন কে জানে, রোজমারির বেশ ভাল লাগছিল।

রোজমারি ঘড়ি দেখল। ডোরিন আজ একটু বেশি দেরি করছে কি? এ সময়ে তো রোজই এসে যায়।

গাড়ির সব কাঁচ তোলা থাকে রোজমারির। ভিতরে এয়ার কন্ডিশনার চলে। কলকাতার দূষিত বায়ুকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে সে। হঠাৎ ডানধারের কাঁচে টুক টুক করে দুটো টোকা পড়তেই রোজমারি একটু চমকে উঠল। চেয়ে দেখল, একজন বেশ লম্বাচওড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে সাদা স্পোর্টস গেঞ্জি এবং পরনে শর্টস।

রোজমারি কাচটা নামিয়ে প্রশ্নভরা চোখে তাকাতেই লোকটা পরিষ্কার জার্মান ভাষায় বলল, সুপ্রভাত।

সুপ্রভাত। কী চাই?

লোকটা জার্মান নয়, চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। লম্বাচওড়া হলেও লোকটাকে তার বাঙালি বলেই মনেই হল। তবে জার্মানটা মাতৃভাষার মতোই বলতে পারে।

লোকটা বলল, আপনার কি আর একটু সতর্ক হওয়া উচিত নয়?

রোজমারি অবাক হয়ে বলল, আপনি কে?

আমার নাম সুধাকর দত্ত।

ও, আপনি সেই ইন্টারপোলের এজেন্ট?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এখানে কী করছেন?

 আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

আমার জন্য? কেন বলুন তো!

 আপনার নিরাপত্তার জন্য।

আমার নিরাপত্তার অভাব ঘটেছে নাকি?

লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তা জানি না। তবে সাবধান হওয়া ভাল।

আপনি আমার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বাংলাতেও কথা বলতে পারেন।

আপনি যে বাংলা ভালই জানেন সে খবর আমি রাখি। তবু জার্মান ভাষায় কথা বলাটাই এখন নিরাপদ। হয়তো বাতাসেরও কান আছে। আপনার সঙ্গে আমার দু’-একটা কথা ছিল।

কথা তো অফিসেও বলতে পারতেন।

সুধাকর মৃদু হেসে বলল, কেন ময়দান জায়গাটাই বা মন্দ কী? এত সুন্দর সকাল, এমন খোলা মাঠ।

রোজমারি ঠোঁট উলটে বলল, কী এমন কথা?

কথাটা আপনার অতীত নিয়ে।

আমার অতীত? সে আবার কী?

জোসেফ ক্লাইন নামটা কি আপনার চেনা ঠেকছে?

জো ক্লাইন আমার প্রাক্তন স্বামী। কেন?

মুশকিল কী জানেন? আমার এই মিশনটাই যেন প্রাক্তন স্বামীদের নিয়ে। কালকেও আর একজনের প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে নাড়াঘাটা করতে হল। জো ক্লাইন সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন ফ্রাউ ঘোষ?

অনেক কিছুই জানি। আমরা এখনও বেশ বন্ধু।

জো ক্লাইনের সঙ্গে আপনার শেষ যোগাযোগ কবে হয়েছে?

যোগাযোগ? না, গত এক বছরের মধ্যে নয়।

তার মানে আপনি তার গতিবিধির খবর রাখেন না?

না।

 গত জুলাই মাসে প্যারিসে একজন পুলিশের গোয়েন্দা খুন হন।

রোজমারি চেয়ে ছিল। বলল, এ খবরটায় আমার কী হবে?

দত্ত মাথা নেড়ে বলল, কিছু না, কিছু না। খবরটা আপনি উপেক্ষা করতে পারেন।

তবে বললেন কেন?

এই গোয়েন্দাটি একটি বিশেষ তদন্তে কাজ করছিল।

 তাতে আমার কী?

সাক্কি ইনকরপোরেটেডের ব্যাপারে।

ও। কিন্তু তাতেই বা আমার কী যায়-আসে। সাক্কির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা নিতান্তই ব্যবসায়িক।

কিন্তু এই গোয়েন্দা খুনের ব্যাপারে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের নামের একটা তালিকা আমি দেখেছি।

বেশ তো।

তালিকাটায় অন্তত পাঁচজনের নাম আছে। একদিন সন্ধেবেলা প্যারিসের এক কুখ্যাত গলির মধ্যে খুনটা হয়। অত্যন্ত পেশাদার কাজ। খুনিরা কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি।

এসব কথা কেন আমাকে বলছেন হের দত্ত?

সুধাকর যেন খানিকটা লজ্জিত হয়ে বলল, তাই তো! কেন যে বলছি।

রোজমারি ঘড়ি দেখে আপনমনে বলল, ডোরিন যে কেন আসছে না।

সুধাকর দত্ত অত্যন্ত নিরীহভাবে বলল, আসতে একটু দেরি হবে। ফ্ল্যাট টায়ার পালটাতে একটু সময় তো লাগবেই।

ফ্ল্যাট টায়ার? সেটা আপনি জানলেন কী করে?

আমাকে অনেক কিছুই জানতে হয়।

রোজমারি একটু বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে সুধাকরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তাই নাকি হের দত্ত? কিন্তু আমি জানতে চাই দুনিয়ায় এত লোক থাকতে আপনি কেন আমাদের পিছনে লেগেছেন? আমি এবং আমার স্বামী একটা ছোট কারখানা চালাই, কোনও বিপজ্জনক কাজ করি না, আমরা এ দেশে কিছু বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগও করিয়েছি এবং আমরা বিদেশি মুদ্রা আয়ও করি। তবু কেন আপনি বা আপনারা আমাদের বিরক্ত করছেন?

সুধাকর সামান্য অপ্রতিভ মুখ করে বলল, আপনাদের বিরক্ত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিল না। অবস্থা এবং পরিস্থিতি আমাদের কিছু অসুবিধের মধ্যে ফেলেছে বলেই

ডোরিনের গাড়ির চাকা কীভাবে পাংচার হল হের দত্ত? আর আপনিই বা তা কী করে জানলেন দয়া করে বলবেন কি?

সুধাকর খুবই লজ্জিত মুখ করে বলল, সামান্য একটু হাতের কাজ। ওটাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন না ফ্রাউ ঘোষ। তার চেয়ে চলুন, আজ আপনার সঙ্গে আমিও খানিকক্ষণ জগিং করি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

এটা অনুরোধ না আদেশ? নাকি প্রচ্ছন্ন হুমকি?

ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন! আপনার সঙ্গে জগিং করতে পারাটা আমি সৌভাগ্য বলেই বিবেচনা করব।

ক্ষতি কী? বলে রোজমারি নামল। গাড়ি লক করে বলল, চলুন হের দত্ত। আমি প্রস্তুত।

দু’জনে পাশাপাশি ধীরগতিতে দৌড়োতে লাগল। ঘাসে শিশির পড়েছে। শিশিরের জল ছিটকে উঠে তাদের মোজা ভিজিয়ে দিচ্ছিল।

রোজমারি বলল, আপনি কি জানেন গতকাল আমাকে কে এক গোছা রক্তগোলাপ পাঠিয়েছিল?

রক্তগোলাপ?

হ্যাঁ, হ্যাপি বার্থ ডে জানিয়ে। কিন্তু গতকাল আমার জন্মদিন ছিল না।

কেউ ভুল করে পাঠিয়েছিল বলছেন?

মোটেই না। কার্ডের অন্য পিঠে লেখা ছিল আর আই পি। তার একটা ব্যাখ্যা ফ্লোরিস্ট দিয়েছে। জনৈক রজার আইভ্যান পোলক নাকি ফুল পাঠিয়েছে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ বাজে কথা। আর আই পি মানে রেস্ট ইন পিস। আমাকে কেউ হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

সুধাকরের ছোটার গতি কমল না। সে একটু বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।

আমি জানতে চাই কে কী কারণে আমাকে খুন করতে চায়? আমি তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি হের দত্ত।

না, জ্ঞানত করেননি। তবু কারও কায়েমি স্বার্থে হয়তো না জেনে আঘাত করেছেন। আমি অনেক ভেবেও সেরকম কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। আপনিই বলুন, আমি কার কায়েমি স্বার্থে আঘাত করতে পারি?

সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।

আপনার রহস্যময় আগমনটাও আমার ভালো লাগছেনা হেরদত্ত। আপনার ক্রেডেনশিয়ালস হয়তো সবই ঠিকঠাক আছে, কিন্তু আমি জানি পাসপোর্ট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড সবই নকল করা যায়। আপনি আসল না নকল তা কে বলবে?

ফ্রাউ ঘোষ, আপনার সন্দেহ অমূলক নয়।

তা হলে কি আমার অনুমান নির্ভুল?

তাও বলছি না। তবে আপনি যে পরিস্থিতিতে আছেন তাতে এরকম সন্দেহ হতেই পারে।

আদ্রেঁর অসুস্থ হয়ে পড়াটাও মোটেই স্বাভাবিক ব্যাপার নয় হের দত্ত।

মানছি। উনি অসুস্থ হননি।

তা হলে?

ওঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে।

সে কী?

বলে থমকে দাঁড়ায় রোজমারি।

দাঁড়াবেন না ফ্রাউ। দয়া করে দৌড়োতে থাকুন। এবং দয়া করে পিছনে তাকাবেন না।

কেন হের দত্ত?

সুধাকর একটু চাপা জরুরি গলায় বলল, প্রশ্ন করবেন না ফ্রাউ। শুধু স্বাভাবিক গতিতে দৌড়াতে থাকুন। ভয় পাবেন না।

কিন্তু রোজমারি ভয় পাচ্ছিল। বেশি দৌড়োয়নি সে, তবু হাঁফ ধরে যাচ্ছিল তার। বুকটাও দুরুদুরু করছে। সে হাঁফসানো গলায় বলল, কেউ কি আমাদের পিছু নিয়েছে?

হা ফ্রাউ। পিছু ফিরে না তাকালে আপাতত ভয় নেই।

রোজমারির পা ইতিমধ্যেই ভারী হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে সে এবার পড়ে যাবে। শুধু মনের জোরে দৌড়োতে দৌড়োতে সে বলল, ওরা কারা?

আমি সবজান্তা নই ফ্রাউ। তবে আমরা এক বিপজ্জনক পৃথিবীতে বাস করি।

আচমকাই পিছনে একটা শব্দ হল। চাপা শিস দেওয়ার মতো শব্দ। মানুষের শিস নয়, ধাতব শিস। যেন কোনও উচ্চশক্তিসম্পন্ন রাইফেল বা পিস্তলের সাইলেন্সর লাগানো শব্দ। তারপরই একটা আর্তনাদ।

পিছনে তাকাবেন না। দৌড়োন।

কেউ কি কাউকে গুলি করল?

পৃথিবীতে কত ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে, সবটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী আমাদের? আমাদের সামনে এখন একটাই কাজ। দৌড়োনো এবং স্বাস্থ্যরক্ষা।

হের দত্ত, আপনি এত নির্বিকার কেন? ঘটনাটায় কি আপনার কোনও হাত নেই?

 আমি নিমিত্ত মাত্র।

 আমি গীতা পড়েছি। কথাটা গীতা থেকে বললেন?

আপনি যে মহাভারত পড়ছেন তাও আমি জানি।

কী সর্বনাশ। আপনি আমার সম্পর্কে আর কী জানেন?

একটা মানুষ সম্পর্কে জানার কি শেষ আছে?

সেটা ঠিক কথা। কিন্তু আমি এমনই একজন সাধারণ মানুষ যার সম্পর্কে জানাটাও বাহুল্য মাত্র। আমার সম্পর্কে জেনে কী হবে হের দত্ত?

আপনি একজন ছোট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বলে বলছেন?

ঠিক তাই। আমি একটা প্রোজেক্ট দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি মাত্র।

কিন্তু আপনি যতটা নিরীহ নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করেন বলে মনে হয়, আসল ঘটনা হয়তো তা নয়।

আপনি যে কী বলছেন হের দত্ত, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

ফ্রাই, আপনাকে তা হলে সোজাসুজি একটা প্রশ্ন করি। দয়া করে বলবেন কি যে আপনি জেনেশুনে জো ক্লাইনের মতো একজন খুনিকে কেন বিয়ে করেছিলেন?

রোজমারি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, জো ক্লাইন কি খুনি?

আপনি তা ভালই জানেন। ভিয়েনার এক হোটেলে আপনার সামনেই সে গডার্ড নামে একজন ইংলিশ এজেন্টকে খুন করেছিল। আপনি তখন তার সঙ্গে ছিলেন।

ঘটনাটা ওভাবে ঘটেনি।

কীভাবে ঘটেছিল?

আমরা একটা কনসার্টের পর ঘরে ঢুকে দেখি, একটা লোক আমাদের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। জো তাকে চ্যালেঞ্জ করতেই লোকটা একটা পিস্তল বের করেছিল। তখন জো তাকে গুলি করে।

সুধাকর একটু হাসল, বেশ বললেন। লোকটা পিস্তল বের করার পর জো ক্লাইনও তার পিস্তল বের করল এবং গুলি করল এবং লোকটা ততক্ষণ পিস্তল নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল? এরকমও হয় নাকি?

আমি ঘটনাটা দেখিনি। লোকটার হাতে পিস্তল দেখে ভয়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। চোখ খুলে দেখলাম, লোকটা পড়ে আছে।

ঠিক আছে ফ্রাউ। মেনে নিচ্ছি। আপনি কি জানতেন না জো কার বা কাদের হয়ে কাজ করে?

না। সে চাকরি করত জানি! আর কিছু জানি না। তার ওই ঘটনার পরই জো-র সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। একজন অনধিকার প্রবেশকারীকে মেরেছিল বলে জো বিচারে ছাড়া পেয়ে যায় বটে, কিন্তু আমি ওকে অপছন্দ করতে শুরু করি। আমি ভায়োলেন্স পছন্দ করি না।

প্যারিসে একজন পুলিশ অফিসারকে মারার ব্যাপারে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের তালিকায় জো-র নাম আছে।

তা হতে পারে।

ফ্রাউ, জো-কে আপনি ত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু সে হয়তো আপনার জীবনে আবার ফিরে আসবে। তবে অন্য ভূমিকায়।

রোজমারি অবাক হয়ে বলল, কেন?

 ধৈর্য ধরুন। জানতে পারবেন।

এবার কি পিছন ফিরে তাকাতে পারি?

না। পিছনে একজন আহত বা নিহত মানুষ পড়ে আছে। পুলিশ আসবে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের খোঁজ করবে। আমি বা আপনি কেউই প্রত্যক্ষদর্শী হতে চাই না, তাই না?

কে কাকে মারল?

সেটা জেনেও আপনার লাভ নেই।

কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি জানেন। তাই না?

হ্যাঁ। জানাটা যে কত বড় অভিশাপ তা যদি জানতেন।

আপনি কে বলুন তো! সত্যিই কে?

প্যারিসে আমাকে অনেকে দাতা বলে ডাকে। এস দাতা। সেখানে আমার বেশ খ্যাতি বা অখ্যাতি আছে।

দাতা?

হ্যাঁ। দত্তকে ওরা দাতা করে নিয়েছে।

আদ্রেঁকে কে বিষ দিয়েছে হের দত্ত?

কী করে বলব বলুন তো!

হের দাতা, আমি আপনাকে পছন্দ করতে পারছি না।