০১-০২. বিশাল হলঘরের মাঝখানে

রিটিন

রিটিন ঘুরে তাকাল, প্রায় তার বয়সী একটা মেয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করেছে। মেয়েটির মুখ ভাবলেশহীন, অন্তত সে নিজে এরকম একটা ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে। রিটিন অবশ্যি এই ভাবলেশহীন মুখের পেছনে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের উত্তেজনা লক্ষ করল। রিটিন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?”

০১.

বিশাল হলঘরের মাঝখানে একটা গ্রানাইটের টেবিল। টেবিলের অন্যপাশে সোনালি চুলের মাঝবয়সী একজন মহিলা বসে তীক্ষ্ণ চোখে রিটিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিটিন খুব মনোযোগ দিয়ে তার হাতের নখগুলো পরীক্ষা করছে, তাকে দেখলে মনে হবে এই মুহূর্তে তার হাতের নখগুলো দেখা খুবই জরুরি।

সোনালি চুলের মহিলা জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি কী করতে চাও?”

রিটিন বলল, “আমি তোমাকে বলেছি। আমি লেখাপড়া করতে চাই। লেখাপড়া করে গবেষণা করতে চাই।”

সোনালি চুলের মহিলা বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কেন আমাকে এটা বলছ! তুমি খুব ভালো করে জান কে কী করবে সেটি পূর্ব নির্ধারিত। গত একশ বছর থেকে মানুষকে জেনেটিক উপায়ে ডিজাইন করা হয়। যারা লেখাপড়া করবে তাদের সেভাবে ডিজাইন করতে হয়। তোমাকে করা হয়নি।”

রিটিন তার হাতের আঙুল থেকে চোখ সরিয়ে সোনালি চুলের মহিলাটির দিকে তাকাল, বলল, “সেটা আমার দোষ নয়। আমাকে আমি ডিজাইন করিনি।”

“তোমার বাবা-মায়ের দায়িত্ব ছিল তোমাকে জেনেটিক ডিজাইন করা। তোমাকে করা হয়নি, তুমি ক্যাটাগরি সি মানুষ। ক্যাটাগরি সি মানুষ লেখাপড়া করে না, গবেষণা করে না। তারা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে”

রিটিন সোনালি চুলের মহিলাকে বাধা দিয়ে বলল, “আমি এসব জানি। যদি আমার লেখাপড়ার সুযোগ থাকত আমি সায়েন্স ইনস্টিটিউটে গিয়ে ভর্তি হয়ে যেতাম। তার নিয়ম নেই, তারা আমাকে সেখানে ঢুকতেই দেবে না। তাই আমি তোমার কাছে এসেছি। যেখানে নিয়ম থাকে সেখানেই নিয়ম পরিবর্তনের উপায় থাকে।”

মহিলাটি এবারে হাসির মতো শব্দ করল, বলল, “তুমি কোথা থেকে এসব তথ্য পেয়েছ আমি জানি না। নিয়ম ভাঙার জন্যে নিয়ম করা হয় না–”

“নিয়ম ভাঙা আর নিয়ম পরিবর্তন করা এক জিনিস নয়। আমি নিয়ম ভাঙতে চাইছি না একটুখানি পরিবর্তন করতে চাইছি।”

“একটুখানি?”

রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ একটুখানি। আমাকে পরীক্ষা করে দেখা হোক আমি লেখাপড়া করার উপযুক্ত কি না। দেখা হোক আমি ক্যাটাগরি এ মানুষের সমান পর্যায়ের কি না। তার পরে সুযোগ দেয়া হোক!”

সোনালি চুলের মহিলা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “তুমি যে পরীক্ষা করার কথা বলছ সেটা করা হয়ে গেছে। সেই পরীক্ষাটার ফল অনুযায়ী তুমি ক্যাটাগরি সি–”

রিটিন হঠাৎ একটু ঝুঁকে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি মানুষ না রোবট?”

মহিলাটি হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কী বললে?”

“আমি জানতে চাইছি তুমি মানুষ নাকি রোবট।”

সোনালি চুলের মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, “আমরা যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি তার সাথে তোমার এই প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক নেই।”

“আছে। সম্পর্ক আছে। তুমি যদি রোবট না হয়ে মানুষ হতে তাহলে তুমি সম্পর্কটা ধরতে পারতে। যেহেতু ধরতে পারছ না তার অর্থ তুমি রোবট। আমি শুধু শুধু একটা রোবটের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করলাম।”

মহিলাটি কেমন যেন রাগী রাগী চেহারায় বলল, “রোবট আর মানুষের মাঝে পার্থক্য কতোটুকু তুমি জান?”

রিটিন বলল, “আমার জানার প্রয়োজন নেই। ইচ্ছাও নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে টেবিলের ঐ পাশে তুমি কি আসলেই আছ নাকি এটাও একটা হলোগ্রাফিক ছবি। আমি কি তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে পারি?”

মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, “না, তুমি ছুঁয়ে দেখতে পার না। এটি শালীনতার মাঝে পড়ে না।”

রিটিন হাহা করে হাসল, বলল, “একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে জাপটে ধরে, কেউ একবারও শালীনতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর একটা হলোগ্রাফিক ছবিকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে শালীনতা নষ্ট হয়?”

“আমি প্রক্রিয়াটির কথা বলছি না, প্রক্রিয়াটি করার পেছনের মানসিকতাটির কথা বলছি!”

রিটিন তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, বলল, “যখন একটা রোবট মানুষকে মানসিকতার উপর লেকচার দেয় তখন বুঝতে হবে কোথাও খুব বড় গোলমাল আছে। তবে–”

“তবে কী?”

রিটিন হাসি হাসি মুখে সোনালি চুলের মহিলাটির দিকে তাকাল, “লল, “তোমাকে একটা কবিতা শোনাই, সংখ্যার কবিতা, নয় আট আট এক আট তিন চার সাত নয় সাত সাত পাঁচ তিন পাঁচ–”

মহিলাটি আর্ত চিৎকার করে বলল, “না! না! মেটাকোড–”

রিটিন মহিলাটির কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বলে যেতে থাকে, “ছয় ছয় তিন ছয় নয় আট শূন্য–”

মহিলাটি তীক্ষ্ণ একটি যন্ত্রণার শব্দ করল, তারপর থরথর করে কাঁপতে থাকলে। কপালের ভেতর থেকে একটা আলো জ্বলতে শুরু করে, শরীরে কেমন জানি খিচুনি হতে থাকে। রিটিন বিকল হতে শুরু করা রোবটটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল, “সাত চার দুই ছয় পাঁচ চার দুই পাঁচ–”

ইচ্ছা করলে সে আরো বলতে পারত কিন্তু আর প্রয়োজন নেই। রোবটটি পুরোপুরি বিকল হয়ে গেছে! সংখ্যা বলা থামিয়ে রিটিন হেঁটে যেতে থাকে। বিশাল হলঘরের শেষ মাথায় দরজা। রিটিন জানে আসলে এটা বিশাল হলঘর নয়, এটা ছোট একটা খুপরি। আলো অন্ধকারের খেলা দিয়ে বিশাল হলঘরের একটা অনুভূতি দেয়া হয়েছে। এই যে সে দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছে, তার মনে হচ্ছে অনেক দূরে হলঘরের শেষ মাথায় দরজা, আসলে দরজাটি একেবারে হাতের কাছে, পায়ের নিচে মেঝেটুকু সরে যাচ্ছে তাই পৌঁছাতে সময় লাগছে। সবকিছুই আসলে এক ধরনের প্রতারণা। সত্যি বিষয়গুলো কখনোই কাউকে জানানো হয় না, সবসময়েই প্রতারণা করা হয়। এটাকে কেউ অবশ্যি আর প্রতারণা মনে করে না। সবাই এটাকেই জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছে।

হলঘরের দরজা খুলে বের হয়ে রিটিন একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার জীবনের একটাই স্বপ্ন ছিল সে লেখাপড়া করবে, গবেষণা করবে। ক্যাটাগরি সি মানুষের সেই সুযোগ নেই এটাও সে জানে। কিন্তু তার ধারণা ছিল তাকে কথা বলার সুযোগ দিলে সে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে পারবে। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে সে কথা বলার সুযোগটা তৈরি করেছিল কিন্তু সে একবারও ভাবেনি পুরো বিষয়টা হবে একধরনের প্রতারণা, চতুর্থ শ্রেণির একটা রোবটকে মাঝবয়সী একটা মহিলা সাজিয়ে বসিয়ে রাখবে–যে রোবটটাকে সে একেবারে হাস্যকর ছেলেমানুষি একটা মেটাকোড দিয়ে অচল করে দিতে পারবে।

রিটিন রাস্তায় নেমে আসে। ব্যস্ত শহর, উঁচু দালানের নিচে সরু রাস্তা ধরে মানুষ যাচ্ছে এবং আসছে। তাদের ভেতর কতজন সত্যিকারের মানুষ কে জানে! রোবটগুলোকে কেন দেখতে মানুষের মতো হতে হবে? মাথার উপর দিয়ে ছোট ছোট বাই ভার্বাল উড়ে যাচ্ছে। মাটির নিচ দিয়ে একটু পরপর পাতাল ট্রেন ছুটে যাচ্ছে, রিটিন তার কম্পন অনুভব করে। হাঁটতে হাঁটতে রিটিন আনমনা হয়ে যায়, একজন মানুষের জীবন কেন এরকম অর্থহীন হতে হবে? কেন তাকে একজন শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে হবে? কেন সপ্তাহ শেষে কিছু ইউনিটের জন্যে অর্থহীন পরিশ্রম করতে হবে? কেন সে তার পছন্দের একটা জীবন বেছে নিতে পারবে না? কেন তার বাবা-মা তাকে অন্যদের মতো জেনেটিক ডিজাইন করে ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে জন্ম দিল না?

রিটিনের ভেতরে তার মা-বাবার বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভের জন্ম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে নিজের ভেতরে কোনো ক্ষোভ অনুভব করল না। রিটিন তার ছেলেমানুষ খামখেয়ালি বাবা-মায়ের জন্যে গভীর এক ধরনের মমতা অনুভব করে। তার মা-বাবা জেনেটিক ডিজাইন করে ক্যাটাগরি এ শিশু জন্ম দেয়া বিশ্বাস করতো না। তারা সাধারণ মানুষ হিসেবে সাদামাটা একটা জীবনে বিশ্বাস করত—তাদের সন্তানকে নিয়ে তারা একটা পর্বতের পাদদেশে জীবন কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু পর্বতের হিমবাহ প্রবাহে তার বাবা-মা হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। সে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। সে যদি ক্যাটাগরি এ শিশু হতো তাহলে তাকে অনাথ আশ্রমে বড় হতে হতো না, তাহলে সে সত্যিকারের একটা পরিবারের সাথে বড় হতে পারত। কিন্তু ক্যাটাগরি সি মানুষ হিসেবে তাকে কোনো পরিবার পালকপুত্র হিসেবে বেছে নেয়নি। তাই তাকে অনাথ আশ্রমে অন্য ক্যাটাগরি সি শিশুদের সাথে বড় হতে হয়েছে। জন্মের মুহূর্তে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। রিটিন বুঝতে পারে না কেন তাকে এখন জন্ম নিতে হলো, কেন সে আরো কয়েক শ বছর আগে জন্ম নিতে পারল না!

রিটিন একটা উঁচু বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়েছিল, তার সামনে দিয়ে অসংখ্য মানুষ এবং রোবটেরা হেঁটে যাচ্ছে। যন্ত্রে তার কোনো আগ্রহ নেই কিন্তু মানুষ দেখতে তার খুব ভালো লাগে। সে পথের ধারে কোনো একটা বেঞ্চে বসে বসে সারাদিন সারারাত মানুষ দেখতে পারবে। মানুষের মুখে কত বিচিত্র অনুভূতির ছাপ, সেই অনুভূতির পরিবর্তনগুলো কত সূক্ষ্ম! মানুষ শুধুমাত্র আনন্দ দুঃখ হাসি কান্না এরকম অল্প কয়টি মোটা দাগের অনুভূতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে অথচ এর বাইরেও আরো কত সূক্ষ্ম অনুভূতি রয়েছে। রিটিনের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সে এই অনুভূতিগুলোর একটি একটি করে নাম দেবে। যেমন ধরা যাক প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে গিয়ে চোখে পানি এসে যাচ্ছে কিন্তু তাকে চোখের পানি দেখতে দেবে না বলে ফিক করে হেসে দিল, চোখে পানি কিন্তু মুখে হাসি এই অনুভূতিটির কী নাম দেয়া যায়?

রিটিন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ মনে হলো কেউ তার কাঁধে স্পর্শ করেছে।

রিটিন ঘুরে তাকাল, প্রায় তার বয়সী একটা মেয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করেছে। মেয়েটির মুখ ভাবলেশহীন, অন্তত সে নিজে এরকম একটা ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে। রিটিন অবশ্যি এই ভাবলেশহীন মুখের পেছনে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের উত্তেজনা লক্ষ করল। রিটিন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ।” মেয়েটি মাথা নাড়ল, “বলব। তুমি কী করেছ? তোমার ট্রাকিওশান থেকে অ্যালার্ট সিগন্যাল বের হচ্ছে।”

রিটিন অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কী বললে?”

মেয়েটি বলল, “তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি। কেউ যখন অপরাধ করে তখন তার ট্র্যাকিওশান থেকে এই সিগন্যাল বের হয়। তুমি কী করেছ? খুন? ড্রাগ? ডাকাতি? ভায়োলেন্স?”

“আমি কিছু করি নাই।”

মেয়েটা হাসল। বলল, “পুলিশকে সেটা বোঝাতে পারবে? চিন্তা করে দেখো; নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছ।”

“আমি আমি–” রিটিন হঠাৎ থেমে গেল, ভ্রূ কুঁচকে বলল, “একটু আগে মেটাকোড দিয়ে একটা রোবটকে ক্র্যাশ করিয়েছি। খুবই নির্বোধ রোবট–পাইয়ের একটা সিকোয়েন্স দিয়ে ক্র্যাশ করানো যায়!”

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, “হ্যাঁ, এটাও অপরাধ! এই অপরাধের জন্যে তোমার ট্র্যাকিওশানকে ট্রিগার করতে পারে।”

“কিন্তু আমি এটা পেয়েছি একটা বাথরুমের দেয়ালের লেখা থেকে–”

মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “বাথরুমের দেয়ালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের কথা লেখা থাকে। আমি অনেক কিছু শিখেছি। যাই হোক তোমাকে জানিয়ে রাখলাম তোমার ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করেছে। যেকোনো সময় পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে! গুডলাক–” বলে মেয়েটা পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করে।

রিটিন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে মেয়েটার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করল। গলা উঁচিয়ে মেয়েটাকে ডেকে বলল, “এই যে তুমি শোনো–”

মেয়েটা দাঁড়াল, মাথা ঘুরিয়ে বলল, “কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ। দুটো জিনিস জানতে চাই, তুমি কেমন করে বুঝলে আমার ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করেছে? আর ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করলে কী করতে হয়?”

“তোমার ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করেছে আমি সেটা জানি কারণ আমার কাছে ট্রাকিওশান ট্র্যাকার আছে।”

রিটিন ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোমার কাছে কেন ট্র্যাকিওশান ট্র্যাকার আছে? তুমি কি পুলিশ?”

“না, আমি পুলিশ না! আমার যাদের সাথে সময় কাটাতে হয়। তাদের ট্র্যাকিওশান সবসময়েই ট্রিগার করে–আমার সেটা জানা দরকার হয়, তাই আমার সাথে এই ট্র্যাকারটা থাকে।”

রিটিন বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু তারপরও বোঝার ভান করল। মেয়েটা বলল, “আর তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর কেউ জানে না। ট্রাকিওশান ট্রিগার করলে কী করা বুদ্ধিমানের কাজ সেটা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তবে—”

“তবে কী?”

“কারো ট্র্যাকিওশান একবার ট্রিগার করলে তার কপালে কী আছে সেটা নিয়ে কোনো মতভেদ নেই।”

“তার কপালে কী আছে?”

“বড় ক্রিমিনাল হওয়ার সৌভাগ্য।”

রিটিন চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললে?”

“তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি। তোমার ট্র্যাকিওশান যেহেতু ট্রিগার করেছে তাই আগে হোক পরে হোক তোমাকে পুলিশ ধরবে। তোমার ট্র্যাকিওশানকে তখন অ্যালার্ট মোডে রাখবে–যার অর্থ ছোট থেকে ছোট অপরাধ করলেও পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তখন–”

“তখন কী?”

“তখন তুমি অতিষ্ঠ হয়ে সত্যি সত্যি একটা বড় অপরাধ করবে।”

“সেটি কী?”

“তোমার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান বের করে নেবে।”

রিটিন কোনো কথা না বলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা বলল, “ক্যাটাগরি সি মানুষের এটাই হচ্ছে ভবিষ্যৎ।”

রিটিন এবারেও কোনো কথা বলল না, মেয়েটা হাসার ভঙ্গি করে বলল, “পার্কের কাছে ক্রস রোডে উত্তেজক পানীয়ের একটা জয়েন্ট আছে, নাম ক্রিমিজিম। ওখানে ঘাঘু ক্রিমিনালরা আড্ডা দেয়, যদি তুমি কখনো ঠিক করো ক্রিমিনাল হয়ে যাবে তখন ক্রিমিজিমে এসো।”

মেয়েটা হাত নেড়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ।”

মেয়েটা না থেমেই বলল, “ক্রিমিজিমে।”

ঠিক কী কারণ জানা নেই রিটিনের মনে হলো মেয়েটি এই উত্তরটাই দেবে।

.

রাত বারোটার সময় রিটিনের বাসায় পুলিশ এল। রিটিন তখন মাত্র বিছানায় শুয়েছে, হঠাৎ ঘরের ভেতর ভিডি স্ক্রিন চালু হয়ে ঘরটা উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল। রিটিন ভিডি স্ক্রিনে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, “সি পি ছয় ছয় নয় শূন্য তিন ক্যাটাগরি সি রিটি রিটিন?”

রিটিন বিছানায় উঠে বসল, বলল, “কথা বলছি।”

“আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেট্রল বাহিনী, তোমার সাথে। দেখা করতে চাই।”

রিটিন শুকনো গলায় বলল, “অবশ্যই। অবশ্যই। তোমরা কি ভেতরে আসবে, নাকি আমি বের হব?”

“আমরা ভেতরে আসছি।”

রিটিন উঠে দরজা খুলবে কি না বুঝতে পারছিল না। কিন্তু কিছু করার আগেই খুট করে একটা শব্দ হলো এবং দরজা খুলে ভেতরে কালো পোশাক পরা কয়েকজন মানুষ এসে ঢুকল। তাদের সারা শরীর থেকে ভয়াবহ নানারকম অস্ত্র ঝুলছে।

মানুষগুলো ঘরের চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে তার দিকে এগিয়ে এল। মাঝবয়সী একজন মানুষ ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি রিটি রিটিন?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি বেআইনি মেটাকোড ব্যবহার কর?”

রিটিন কী বলবে বুঝতে না পেরে ইতস্তত করে বলল, “একবার মাত্র করেছি। আসলে হয়েছে কী–”

“এটি সাত মাত্রার অপরাধ। যদি দ্বিতীয়বার কর তখন এটা হবে ছয় মাত্রার। ছয় মাত্রার অপরাধ করলে বিচারপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বিচার প্রক্রিয়ার তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপে…”

মানুষটি টানা কথা বলে যেতে থাকে এবং রিটিন বুঝতে পারে আইনশৃঙ্খলার এই মানুষগুলো আসলে নিচু শ্রেণির রোবট। মেটাকোড ব্যবহার করে রোবটকে বিকল করা কোনো গুরুতর অপরাধ নয়, তাই তাকে সাবধান করার জন্য এই নিচু শ্রেণির রোবট পাঠিয়েছে। তাকে এখন ধৈর্য ধরে এই নির্বোধ রোবটগুলোর বক্তৃতা শুনতে হবে। রোবটকে অচল করার আরেকটা মেটাকোড সে জানে, এগুলোর উপর চেষ্টা করে দেখবে কি না এরকম একটা চিন্তা তার মাথার মাঝে একবার খেলে গেল কিন্তু সে চিন্তাটাকে দূর করে দিয়ে নিঃশব্দে বসে রইল। একঘেয়ে কথা শুনতে শুনতে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে শুনতে পেল তাকে রোবটগুলো কিছু একটা প্রশ্ন করছে, রিটিন প্রশ্নটা শোনার চেষ্টা করল, রোবট পুলিশটি তাকে জিজ্ঞেস করছে, “তুমি ক্যাটাগরি সি মানুষ হয়ে কেন লেখাপড়া করতে চাও?”

একটা নিচু শ্রেণির রোবটের কাছে এরকম একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে রিটিন একটু অপমানিত বোধ করছিল, কিন্তু কিছু একটা বলতে হবে, তা না হলে রোবটগুলো তাকে বিরক্ত করে যাবে। রিটিন বলল, “আমি মনে করি সব মানুষেরই নতুন জিনিস জানার অধিকার আছে।”

পুলিশের পোশাক পরা রোবটটা বলল, “কিন্তু নতুন জিনিস জানার জন্যে মস্তিষ্কের বিশেষ গঠন থাকতে হয়। তোমার মতো ক্যাটাগরি সি মানুষের মস্তিষ্কের সেই গঠন নেই।”

এই রোবটটার সাথে তর্ক করার কোনো অর্থ হয় না, তাই রিটিন রোবটটার কথা মেনে নিয়ে বলল, “আমার মনে হয় তুমি ঠিকই। বলেছ। আমার লেখাপড়া করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা সঠিক হয়নি।”

রোবটটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি এই কথাটা আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে বলেছ। কথাটি তুমি বিশ্বাস করো না। কেন তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছ?”

রিটিন উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না, একটু চিন্তা করে বলল, “এই মুহূর্তে হয়তো কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করি না কিন্তু যেহেতু কথাটার মাঝে যুক্তি আছে আমাকে আগে হোক পরে হোক মেনে নিতে হবে।”

“তুমি গবেষণা করার কথা বলেছ। তুমি কী নিয়ে গবেষণা করতে চাও?”

রিটিন বলল, “আমি এখনো বিশেষ কিছু জানি না। তাই কী নিয়ে গবেষণা করতে চাই সেটা পরিষ্কারভাবে বলা সম্ভব নয়।”

পুলিশটি বলল, “কিছু একটার কথা বলো। তুমি সবসময়ই নতুন তথ্য সংগ্রহ করছ।”

কী বললে রোবটটা কী বুঝবে সেটা নিয়ে রিটিন একটু দুর্ভাবনার মাঝে ছিল, তারপরও সে অনিশ্চিতের মতো বলল, “সময় পরিভ্রমণের বিষয়টা আমাকে খুবই কৌতূহলী করে–”

কথাটা শেষ করার আগেই এবারে পুলিশগুলো চিৎকার করে রিটিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছু বোঝার আগেই রিটিন আবিষ্কার করল সে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পুলিশগুলো তার হাত দুটো পেছনে নিয়ে সেখানে হ্যাঁন্ডকাফ লাগাচ্ছে। রিটিন বলার চেষ্টা করল, “কী হয়েছে?”

তার আগেই সে ঘাড়ের কাছে একটা খোঁচা অনুভব করল, সাথে সাথে পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যায়।

.

০২.

অনেক মানুষের কথা শুনতে শুনতে রিটিনের জ্ঞান ফিরে এল। মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে বুঝি কথাগুলো ভেসে আসছে, ঢেউয়ের মতো কখনো কথাগুলো কাছে আসে আবার দূরে চলে যায়। রিটিন একসময় চোখ খুলে তাকাল, সে নোংরা একটা শক্ত মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। রিটিন সাবধানে মাথা তুলে তাকাল, সাথে সাথে মনে হলো মাথার ভেতর কিছু একটা যেন ছিঁড়ে গেল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবার মেঝেতে মাথা রেখে রিটিন কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। শুয়ে থেকেই রিটিন চোখ খুলে পিট পিট করে দেখার চেষ্টা করল। ঘরটাতে সে একা নয়, অনেক মানুষ। কেউ কেউ তার মতো নোংরা মেঝেতে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। কেউ কেউ মাথা নিচু করে বসে আছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলো নিজেদের মাঝে নিচু স্বরে কথা বলছে। রিটিন ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করল, তখন শুনতে পেল কেউ একজন বলল, “এই যে আরেকজনের জ্ঞান ফিরেছে।”

কথাটা রিটিনকেই বলেছে কি না বোঝা গেল না, রিটিন তার মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই মাথার ভেতরে কোথায় জানি চিন চিন করে ব্যথা করে উঠল। রিটিন তাই আর চেষ্টা করল না, হাঁটুতে মাথা রেখে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। আগের মানুষটা আবার বলল, “বসে থাকলে হবে না, উঠে দাঁড়াও। হাঁটো।”

রিটিন কোনোমতে মাথা ঘুরিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে বলছ?”

মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লাল চোখ, এলোমেলো চুলের একজন মানুষ একটা বেঞ্চে পিঠ সোজা করে বসে আছে, সে মাথা নেড়ে বলল, “আর কাকে বলব? তোমাকেই বলছি।”

রিটিন জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?”

রিটিনের কথা শুনে মানুষটা হাহা করে হেসে উঠল, আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে বলল, “জিজ্ঞেস করছে সে কোথায়? এখনো জানে না সে কোথায়।”

মোটামুটি একই চেহারার কিন্তু গায়ের রং মৃত মানুষের মতো ধবধবে সাদা একজন বলল, “তুমি কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে। কেউ যখন কোনো অপরাধ করে তখন তাকে এখানে আনে।”

রিটিন বলল, “আমি কোনো অপরাধ করিনি।”

তার কথাটা শুনে এবারে মনে হলো আরো অনেকে খুব মজা পেল। তারা আনন্দে হাহা করে হাসতে থাকে। একজন হাসি থামিয়ে বলল, “যখন কেউ এখানে আসে তখন সে সবসময় বলে সে কোনো অপরাধ করেনি।”

রিটিন বলল, “আমি শুধু মেটাকোড বলে একটা রোবটকে অচল করেছিলাম।”

মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মানুষটা বলল, “আর কিছু করনি? একটা দুইটা মার্ডার?”

রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না। মার্ডার করিনি।”

“ড্রাগস? সাইড বিজনেস? ব্ল্যাক মার্কেট খুব ভালো ভিচুরিয়াস এসেছে।”

রিটিন বলল, “না আমি ড্রাগস বিজনেস করিনি।”

“করেছ। নিশ্চয়ই করেছ। তা না হলে তোমাকে এখানে আনবে কেন? তোমার নিশ্চয়ই এখন মনে নেই।”

রিটিন আর তর্ক করল না। ধবধবে সাদা মানুষটা বলল, “চেক আপের সময় সব বের হয়ে আসবে।”

“চেক আপ? কিসের চেক আপ?”

“এখনো জান না চেক আপ কী?”

রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, জানি না।”

একজন বলল, “প্রথমবার এসেছে তো তাই কিছু জানে না।”

আরেকজন বলল, “আস্তে আস্তে জেনে যাবে। প্রথমবার একটু ঝামেলা হয়, তারপর অভ্যাস হয়ে যায়।”

রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তোমরা আগে এখানে এসেছ?”

“অনেকবার।”

“কী করে এখানে?”

“ধোলাই। ধোলাই করে তোমাকে সিধে করে দেবে।”

খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “কেন শুধু শুধু ছেলেটাকে ভয় দেখাচ্ছ?”

“কে বলেছে ভয় দেখাচ্ছি, মোটেও ভয় দেখাচ্ছি না। সত্যি কথা বলে প্রস্তুত থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

ঠিক তখন একটা দরজা খুলে গেল এবং ধূসর পোশাক পরা একটা রোবট ঢুকে হাতের ট্র্যাকারটা উঁচু করে মানুষগুলোর দিকে তাক করে সুইচ টিপে দিল। সাথে সাথে একজন লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়, সবাই দেখল তার পুরো শরীরটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। মানুষটা কোনোভাবে নিজের কাঁপুনিটা থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, “আসছি! আসছি!”

মানুষটা দরজার দিকে প্রায় ছুটে গেল। রোবটটা তার ট্র্যাকারটা নামিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে হাঁটতে থাকল, মানুষটাও তার পাশে পাশে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে যেতে থাকে।

কাঁপতে থাকা মানুষটা বের হওয়ার সাথে সাথে খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “খুবই অপমানজনক ব্যাপার।”

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কোনটা অপমানজনক?”

“এই যে একটা রোবট ট্র্যাকার দিয়ে ট্র্যাকিওশান অনুরণিত করে একজন একজন করে ধরে নিয়ে যায়। আমরা তো আর রোবট না, হাজার হলেও আমরা মানুষ, আমাদের নাম ধরে ডাকতে পারে। আমাদের সবার একটা করে নাম আছে।”

রিটিন খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “রোবটটা ঐ মানুষটাকে ধরে নিয়ে গেল কেন?”

“চেক আপ করে দেখবে অপরাধী কি না।”

“কীভাবে দেখবে।”

“তাদের উপায় আছে। নিখুঁত উপায়।”

“যদি অপরাধী হয় তাহলে কী করবে?”

খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “আগে হলে মেরে টেরে ফেলত। এখন মনে হয় স্মৃতি ধ্বংস করে নতুন স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়।”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন বলল, “স্মৃতি ধ্বংস করার থেকে মেরে ফেলাই ভালো ছিল।”

ধবধবে ফর্সা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “স্মৃতি ধ্বংস করা আর মেরে ফেলার মাঝে কোনো পার্থক্য নাই।”

“আছে।” অন্যজন কঠোর গলায় বলল, “মেরে ফেললে শেষ। কিন্তু স্মৃতি ধ্বংস করলে আমার শরীরটা থেকে যায়, সেখানে অন্য একজন মানুষ বেঁচে থাকে। অন্য একজন মানুষ কেন আমার শরীরে বেঁচে থাকবে? আমার শরীরে আমি যদি বেঁচে থাকতে না পারি তাহলে আর কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না।”

“কেন বেঁচে থাকতে পারবে না? এটা কোন ধরনের কথা?”

রিটিন দেখল মানুষগুলোর গলায় স্বর উঁচু হতে থাকে। তারা 1ৎকার করতে থাকে, হই হল্লা করতে থাকে। রিটিন তখন একটু সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করল।

রিটিন অপেক্ষা করতে করতে লক্ষ করে নির্দিষ্ট সময় পরপর ধূসর পোশাক পরা একটি রোবট এসে ট্র্যাকিওশান ট্র্যাকার দিয়ে লক করে একজন একজন করে মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যাকে ধরে নিতে যাচ্ছে তার ট্র্যাকিওশানে সিগন্যাল পাঠিয়ে মানুষটির স্নায়ুতে এক ধরনের কম্পন তৈরি করে। সেই কম্পনে একেকজনের প্রতিক্রিয়া হয় একেকরকম। কেউ কাঁপতে থাকে, কেউ ছটফট করতে থাকে, কেউ যন্ত্রণার কাতর শব্দ করতে থাকে। খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটি ঠিকই বলেছিল, এখানে মানুষগুলোকে ঠিক মানুষের সম্মান দেয়া হয় না।

বসে থাকতে থাকতে রিটিনের মনে হয় একটু ঝিমুনির মতো এসেছিল, হঠাৎ সে শরীরের ভেতর ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ঝাঁকুনি অনুভব করল। সাথে সাথে সে বুঝে গেল ধূসর রোবটটা তাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। রিটিন চোখ খুলে তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তখন সে আবার নিজের ভেতর একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে, এবারে সেটি আগের থেকে তীব্র এবং যন্ত্রণাময়। রিটিন হাত তুলে বলল, “আসছি। আমি আসছি।”

রোবটটি তারপরও ট্র্যাকারটা তার দিকে ধরে রাখল এবং রিটিন নিজের শরীরের ভেতর তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করতে থাকল। রিটিন কোনোভাবে পা ফেলে দরজার দিকে ছুটে যেতে থাকে। ছুটে যেতে যেতে শুনতে পেল খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা উচ্চ স্বরে তাকে লক্ষ করে বলছে “ভয় পাবার কিছু নাই ছেলে, দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকো।”

কোথায় দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকতে হবে সে বুঝতে পারল, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা বোঝারও চেষ্টা করল না। দ্রুত রোবটের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। শরীরের ভেতর ঝাঁকুনিটা তখন একটু কমে গেল কিন্তু পুরোপুরি চলে গেল না।

রোবটটার পাশে পাশে হেঁটে সে ছোট খুপরির মতো একটা ঘরের সামনে এসে থেমে গেল, কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সে বুঝতে পারল এই ঘরটিতেই তার স্ক্যানিং হবে।

খুপরির মতো ঘরের ভেতর থেকে কোনো একজন বলল, “চলে এসো।”

রিটিন ঘরের ভেতর ঢুকল। ঘরের মাঝামাঝি একটা চেয়ার, চেয়ারের চারপাশে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। কাছেই একটা ডেস্কের পেছনে একজন মাঝবয়সী মানুষ নিরাসক্ত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল।

রিটিন বলল, “নিশ্চয়ই কিছু ভুল হয়েছে। আমি আসলে কিছু করিনি, একটা রোবটকে মেটাকোড দিয়ে অচল করে দিয়েছিলাম, খুবই নির্বুদ্ধিতা হয়েছিল কাজটি, কিন্তু সেটা তো বড় অপরাধ নয়। নির্বুদ্ধিতা তো অপরাধ হতে পারে না”

মানুষটি কোনো কথা না বলে যেভাবে তার দিকে তাকিয়েছিল সেভাবেই তাকিয়ে রইল। তার কোনো কথা শুনেছে কি না বোঝা গেল না। রিটিন আবার শুরু করল, “আমাকে মনে হয় তোমরা চলে যেতে দিতে পার–”

“বসো।” মানুষটি চেয়ারটা দেখিয়ে তাকে বসতে বলল।

রিটিন বলল, “তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না আমি-”

মানুষটা আবার বলল, “বসো।”

রিটিন বলল, “বসার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমি তোমাকে বলছি আমি কোনো অপরাধ করিনি, বিশ্বাস করো। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি–”

মানুষটি একই ভঙ্গিতে নিরাসক্তভাবে বলল, “চেয়ারটাতে বসো।”

রিটিন তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারটাতে বসল। বসে বলল, “ঠিক আছে বসছি। কিন্তু তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে।”

“মাথাটা হেলান দাও।”

রির্টিন মাথাটা হেলান দিল এবং তখন হঠাৎ দুই পাশ থেকে দুটো সিলিন্ডারের মতো কিছু এসে তার মাথাটাকে আটকে ফেলল। রিটিন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী করছ? কী করছ তুমি?”

মানুষটা কোনো উত্তর দিল না, সামনে রাখা একটা প্যানেলে যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করতে লাগল। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি রোবট?”

মানুষটা এবারেও তার কথার উত্তর দিল না। রিটিন বলল, “রোবট হলে তোমাকে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু মানুষ হলে আমি জানতে চাই তুমি ঠিক কী করতে যাচ্ছ?”

মানুষটা বলল, “আমি তোমার মস্তিষ্কের ভেতর দেখতে চাই।”

“মস্তিষ্কের ভেতরে?”

“হ্যাঁ। তুমি কী কর, কী চিন্তা কর, কী করেছ, কী করতে চাও। সবকিছু আমি দেখতে পাব। কাজেই চুপচাপ বসে থাকো।”

“কীভাবে দেখবে? মাথার ভেতরে ফুটো করে কিছু ঢোকাবে না তো?”

“না।”

“তাহলে?”

“কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকো। নিজেই দেখবে।”

হঠাৎ করে রিটিনের চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়, সে চোখ খুলে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু দেখছে না। ভয়ে আতঙ্কে সে চিৎকার করে উঠতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই সে বিচিত্র কিছু রং দেখতে পায়, রংগুলো স্থির নয়, কুণ্ডলী পাকিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধীরে ধীরে নড়ছে। রিটিন অবাক হয়ে বুঝতে পারল, সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে কিন্তু সে চোখ দিয়ে দেখছে না। দেখার অনুভূতিটি আসছে অন্য কোনোভাবে। মাথার কাছে যন্ত্রপাতির একটা ভোঁতা শব্দ হচ্ছিল, হঠাৎ করে সেই শব্দ ছাপিয়ে সে অন্য এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। এত বিচিত্র শব্দ সে তার জীবনে আগে কখনো শোনেনি, শব্দগুলো ঢেউয়ের মতো আসছে এবং যাচ্ছে।

চারপাশে কী হচ্ছিল প্রথম প্রথম রিটিন সেটা অনুভব করতে পারছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অনুভূতি চলে যেতে থাকে। রিটিন বুঝতে পারে তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। সে তার আঙুলটাও আর নাড়াতে পারছে না। তার ভেতরে একটা আতঙ্ক হওয়ায় কথা ছিল কিন্তু কোনো একটা কারণে এই মুহূর্তে ভয়ভীতি আতঙ্ক বা অন্য কোনো অনুভূতিই তার মাঝে নেই। তার মনে হতে থাকে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।

রিটিন হঠাৎ শীত শীত অনুভব করতে থাকে, মুখের ভেতর তীব্র একটা লোনা ভাব, সাথে সাথে বিচিত্র একটা গন্ধ। সেই অস্বাভাবিক গন্ধে তার সারা শরীর কুঞ্চিত হয়ে যায়। শীত শীত ভাবটা সরে গিয়ে হঠাৎ করে সে উষ্ণতা অনুভব করতে থাকে, হঠাৎ করে মনে হয় শরীরের চামড়া খুলে যেতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের জন্য তীব্র যন্ত্রণা, হঠাৎ করে সেই যন্ত্রণা সরে গিয়ে সমস্ত শরীর অনুভূতিহীন হয়ে যায়, মুখের ভেতর বিস্বাদ এক ধরনের মিষ্টি অনুভূতি, নাকে কটু গন্ধ। রিটিনের মনে হতে থাকে অনেক দূর থেকে একটা শিশু তাকে ডাকছে–সেই ডাকটি শুনে নিজের ভেতরে সীমাহীন এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকে। রিটিনের মনে হয় সে বেঁচে নেই, মনে হয় বেঁচে থাকা কিংবা না থাকার কোনো অর্থ নেই, কোনো গুরুত্ব নেই।

রিটিন কতক্ষণ এভাবে ছিল সে জানে না, হঠাৎ করে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সে পুরোপুরি জেগে উঠল। সামনে একটা ডেস্ক সেখানে মানুষটি যন্ত্রপাতির প্যানেলটির দিকে তাকিয়ে আছে। যন্ত্রপাতির ভোঁতা শব্দটি সে আবার শুনতে পেল, দেখল তার সারা শরীর কুলকুল করে ঘামছে।

মাথাকে শক্ত করে আটকে রাখা সিলিন্ডার দুটো আস্তে আস্তে সরে গেল, রিটিন মাথাটা মুক্ত করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল।

যন্ত্রপাতির প্যানেলের সামনে বসে থাকা মানুষটা রিটিনের দিকে তাকিয়েই বলল, “রিটিন, তুমি চেয়ার থেকে নেমে আসতে পার।”

রিটিন চেয়ার থেকে নামল। মানুষটি বলল, “তুমি চলে যেতে পার। বাইরে পি-টু তোমাকে বের হওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেবে।”

রিটিন ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু–”

মানুষটি নিরাসক্ত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন বলল, “স্ক্যানিং করে তুমি কী দেখলে?”

“দেখলাম ক্যাটাগরি সি এর মানুষ হিসেবে তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটু বেশি। তুমি তোমার জন্যে ঠিক করে রাখা প্রোগ্রামের বাইরে লেখাপড়া করতে চাও।”

“সেটা কি অপরাধ?”

“না, সেটা অপরাধ না, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। এই রকম মানুষেরা বিপজ্জনক হতে পারে।”

“আমি কি বিপজ্জনক?”

“এখনো হওনি। তোমার পক্ষে একটা ভালো যুক্তি আছে। শহরকেন্দ্রে একটা মেয়ে তোমাকে ক্রিমিজিমের নাম বলেছে, তারপরও তুমি সেখানে যাওনি। তোমার ভেতরে অপরাধপ্রবণতা নেই।”

“আর কিছু?”

“সময় পরিভ্রমণ নিয়ে লেখাপড়া করার চিন্তা মাথা থেকে দূর করো। এ সম্পর্কে তোমার চিন্তাভাবনা হাস্যকর। তুমি কখনো সেই সুযোগ পাবে না।”

“আর কিছু?”

“হিমবাহ প্রবাহে তোমার বাবা-মা আর তুমি ভেসে গিয়েছিলে, তোমার মা তোমাকে বাঁচানোর জন্যে মারা গিয়েছে, তোমার বাবা তোমার মাকে বাঁচানোর জন্যে মারা গিয়েছে, তোমার সেরকম একটা স্মৃতি আছে।”

রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আছে।” শৈশবের সেই স্মৃতি রিটিনের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়, মায়ের সেই শেষ দৃষ্টিটি এখনো তাকে অস্থির করে তুলল। ২৮

মানুষটি বলল, “সেই স্মৃতিটি সত্যি নয়। তোমার মস্তিষ্ক সেই স্মৃতিটি তৈরি করেছে। সেরকম কিছু ঘটেনি।”

রিটিন বলল, “কী বলছ তুমি, আমার স্পষ্ট মনে আছে”

“আমি জানি, তোমার স্পষ্ট মনে আছে। মস্তিষ্ক এরকম স্পষ্ট মনে থাকা স্মৃতি তৈরি করে।”

“কিন্তু–”

“আর কিন্তু নয়। তুমি এখন যাও।”

রিটিন তবু ইতস্তত করতে থাকে, “আমার কি কিছু করতে হবে?”

“না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি যদি তোমার বাড়াবাড়ি এবং অযৌক্তিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দূর করে তোমার জন্য নির্ধারিত স্বাভাবিক একটা জীবনে ফিরে যাও তোমার কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”

“আমার ট্র্যাকিওশানে একটা অ্যালার্ট সিগন্যাল ছিল।”

“আমি সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি এখন স্বাভাবিক একজন মানুষ। তোমাকে কোনো রোবট জ্বালাতন করবে না।”

“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

মানুষটি প্রথম তার দিকে তাকাল, নরম গলায় বলল, “যাও। বাড়ি যাও। ঠান্ডা পানিতে গোসল করে একটা ঘুম দাও। আর শোনো”

রিটিন দাঁড়াল। মানুষটি এই প্রথম হাসি হাসি মুখে বলল, “এভোকাডো ফলটা খারাপ না। খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে।”

রিটিন অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। সে দুই চোখে এভোকাডো নামক ফলটি দেখতে পারে না, মানুষটি সেটাও জানে! এই মানুষটির কাছে তার জীবনের গোপন কিছু নেই।

ঘরের বাইরে পি-টু রোবটটি অপেক্ষা করছিল, লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসে।

রিটিন বলল, “খবরদার, বেশি কাছে আসবে না। দূরে দূরে থাকো। রোবট নিয়ে আমার অ্যালার্জি আছে।”

পি-টু বলল, “পি-টু রোবটটি পুরোপুরি জৈব নিষ্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। অ্যালার্জি হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। মানবশরীরের অ্যালার্জিবিষয়ক প্রতিক্রিয়াটি গত শতকে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, এখন এটি একটা একাডেমিক বিষয় ছাড়া কিছু নয়। সাম্প্রতিক একটি বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে-”

রিটিন ধমক দিয়ে বলল, “চুপ করবে তুমি।”

পি-টু চুপ করে গেল।