এম ফর মার্ডার
সোনালী রং-এর ঢেউগুলো সমুদ্রতীরে আছড়ে পড়ছে। দূর পাহাড়ের গা বেয়ে যে সাদা সরু রাস্তাটা চলে গেছে, সেদিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল শেড। সে সমুদ্রতীরের একটা কুঁড়ে ঘরে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
ভাবছিল ঐ পথ ধরেই আড়াই ঘণ্টা পরে ল্যারী আসবে। যদি এখনই সে টেপ করতে শুরু করে তাহলে তা শেষ হতে মাত্র দু ঘণ্টা সময় লাগবে। বাকী থাকবে আধঘণ্টা।
সে একটা চেয়ারে এসে বসল। ঘরটা বেশ গরম, যদিও পাখা চলছে। সামনে একটা টেবিলের উপর একটা টেপ রেকর্ডার রয়েছে, আর পাশেই রয়েছে এক বোতল মদ।
বোতল থেকে সে অনেকখানি মদ গলাধঃকরণ করে নিল। তারপর উঠে দাঁড়াল। ডান হাত দিয়ে মাথার মধ্যে সে বিলি কাটল।
শেড বেশ বলিষ্ঠ যুবক। ওর চোখ দুটো নীল–সমুদ্রের মত। গেঞ্জী পরে বসে আছে। তাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। চেহারাতে বেশ সুপুরুষও বটে। অনিচ্ছাসহকারে সে ঘরের কোণের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
ডিভানটার উপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। তার মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। মেয়েটার মুখ আর কাঁধের অংশ ডিভানের ও পাশে ঝুলে পড়েছিল। মুখখানার কথা ভাবতে গিয়ে শিহরণ জাগল–মুখখানা কালো হয়ে গেছে, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।মুখ থেকে জিভটা লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে।
জোর করে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরালশেড। গাড়ী থেকে নিয়ে আসা ভারী রেঞ্জটা টেবিলের উপর আওতার মধ্যে রাখল সে। একটা সিগারেট ধরাল। ভাবল, এবার তার স্বীকারোক্তি টেপ করা দরকার। ল্যারী আসার আধঘণ্টা আগেই তার রেকর্ড শেষ করা হয়ে যাবে।
কিন্তু সে যতবার রেকর্ড শুরু করতে যায়, ততবারই মেয়েটির বীভৎস মুখ তার সামনে ভেসে ওঠে। নিজেকে গালাগালি দেয়।
তোমার সামনে বিপদ, সে বিপদ থেকে কিভাবে উদ্ধার পাবে তা ভেবেই কাজ করো। যে মারা গেছে, তার চিন্তা করে বিপদ বাড়িয়ো না।
মনে সাহস এনে শেড টেপটা চালিয়ে দিল, ধীর শান্ত গলায় বলল–ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নী মিঃ জন হ্যারিন্টনের অবগতির জন্য এই স্বীকারোক্তি টেপ করছি।
আমি শেড উইন্টার্স, ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লিক সাইডের বাসিন্দা, বেলা দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে এই বয়ানটি টেপ করছি। আজ ত্রিশে সেপ্টেম্বর।
আমি একটা খুনের ঘটনার বয়ান দিতে যাচ্ছি। কিন্তু তাতে আপনি স্পষ্টভাবে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন না। তাই ঘটনাটি কিভাবে ঘটল, কেনই বা ঘটল, এটা কেনই বা খুনে পরিণত হল, আর কেনই বা লেফটেন্যান্ট লোগো সব জেনেও আমাকে গ্রেপ্তার করলেন না–সবই আমি পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে বলছি। ধীরে সুস্থে মন দিয়ে আমার কথা শুনুন, তাহলে স্পষ্ট হয়ে সব কথা আপনার কাছে ধরা দেবে।
একটু থেমে সে আবার বলতে শুরু করল
.
০১.
প্যাসিফিক ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের স্টক ও সিকিউরিটি বিভাগের একজন ক্লার্ক আমি।
অফিসে বসে ব্যবসাপত্র সংক্রান্ত কতকগুলো কথা আমি চিন্তা করছি, সেই সময় ইন্টারকমে ডাক পড়ল।
সংযত স্বরে জবাব দিলাম আমি উইন্টার্স বলছি।
ওপার থেকে জবাব এল–ওঃ মিঃ উইন্টার্স!দয়া করে একবার মিস্টার্নঙডের ঘরে আসবেন! বিশেষ দরকার।
আমি তখন সবেমাত্র লিনস্টেনের কাছ থেকে ধার নেব বলে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। সে একজন অর্থপিশাচ। চড়া সুদে টাকা ধার দেয়। আসলে আমার এখন টাকার খুব দরকার।
আজ সকালবেলা পাঁচটা চিঠি পেয়েছি, চারটি ব্যবসাদারদের কাছ থেকে আর,একটা মেয়েটার কাছ থেকে।
মেয়েটা আমারই জন্য অন্তঃসত্ত্বা। আমি আমার দায় পালন করব কিনা তা জানতে চেয়ে সে চিঠি লিখেছে। মেয়েটির মুখ বুজিয়ে রাখাটা আমার কাছে কোন ব্যাপার নয় কিন্তু ঐ ব্যবসাদাররা আমাকে শাসিয়েছে যে, তাদের ঋণ শোধ করতে না পারলে আমাকে নাকি দেখে নেবে! আমার বসূকে জানাবে, এরকম আরো কত ধরনের কথা লিখে আমাকে শাসিয়েছে।
জানি, ওদের সময়মত টাকা দিতে না পারলে নেকড়ে বাঘের মত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। যেমন করেই হোক টাকার জোগাড় করতে হবে। আর ওদিকে মিঃ স্টার্নউডের তলব। যেখানে বাঘের
মিঃ স্টার্নউড খুব কঠিন লোক। অফিসের কাজ তো কিছুই করি না। বরং সুন্দরী টাইপিস্ট আর রিসেপশনিস্টদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। আমার কাজের ব্যাপারে কেউ তার কাছে রিপোর্ট দিল, না কি কোন পাওনাদার তার কাছে অভিযোগ করেছে।
সাত পাঁচ চিন্তা করতে করতে আমি স্টার্নউডের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। সার বাঁধা টেবিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় কলিগদের চাপা হাসি শুনতে পেলাম। তারা আমাকে দেখে বেশ হিংসে করে তা আমি বুঝতে পারি।
আমি লোকগুলোকে অবশ্য করুণা করি। তাদের আমি জন্তু বলে মনে করি। তাদের কাজে যাওয়া, অফিসে কেরানীগিরি করা,আর বাড়ি ফিরে বউদের পেটিকোটের নীচে কুকুরের বাচ্চাদের মত কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকবার জন্য কেবল ছটফটানি। যাদের এখনো বউ হয়নি, তাদের কেবল দিনরাত বউয়ের খোঁজ।
যাক আমি স্টার্নউডের দরজা নক করে তার ঘরে ঢোকবার জন্য অনুমতি চাইলাম।
মিঃ স্টার্নউড আমাকে বসতে বললেন। হাতের কাগজপত্তরগুলো দেখতে দেখতে তিনি বলেন–আচ্ছা শেড তোমার বয়স কত হল?
–আজ্ঞে বত্রিশ।
দ্যাখো, তুমি আর লিডবেটার একই সঙ্গে এই ব্যাঙ্কে এসেছ। সে আজ অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার, আর তুমি? কোন উন্নতি হল না। কেন বলতে পার?
চটপট জবাব দিলাম–লিডবেটার আমার থেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমান।
স্টার্নউড বলে চলেন–না, তোমার কথাটা ঠিক নয়, আসল কথা সে নিষ্ঠাভরে কাজ করে আর তুমি তা তো করই না, বরং তোমার নিজস্ব কাজের কোন খোঁজ রাখনা। তোমার করণীয় কাজটা তুমিকরনা। এভাবে কোন্ ব্যাঙ্কের কাজ কতদিন চলতে পারে?তুমি জান তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে কবে তাকে বরখাস্ত করতাম। কিন্তু তুমি আমার বন্ধুর ছেলে বলে তোমার এই গাফিলতি এতদিন ধরে সহ্য করছি। মিঃ স্টার্নউড একটু থামলেন, একটা সিগারেট ধরালেন।
মিঃ স্টার্নউড আমার বাবার বন্ধু। তার আগ্রহে এই চাকরীতে আমি যোগ দিই। এক যোগ্য ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠার জন্য তিনি সর্বদা আমাকে উৎসাহ দিতেন। এখন তিনি আমার উপর বেশ হতাশ হয়েছেন। এখানে কাজ করবার আগে আমি সৈন্যবাহিনীতে পাঁচ বছর কাটিয়েছিলাম।
আমার চাকরী চলে যাবার ভয়ে থেমে গেলাম।
তোমার মতলবটা কি বলতে শেড? তুমি কি আমাদের ব্যাঙ্কে আর থাকতে চাইছনা? স্টার্নউড জিজ্ঞাসা করল।
তার গলার স্বরে হতাশার ছাপ। মনে হল আমি যেন খুব অন্যায় করে ফেলেছি। সঙ্গে সঙ্গে বললাম না স্যার। আমি ছাড়বার কথা ভাবি নি। আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি। এবার থেকে আমি মন দিয়ে কাজ করব। আমাকে আর একবার সুযোগ দিন।
স্টার্নউড বললেন–ঠিক আছে, আর একবার তোমাকে চান্স দিচ্ছি। তোমাকে এবার যে কাজটা দেব, তা অন্যরকম, তবে বেশ কঠিন। যদি ঠিকভাবে করতে না পারো, ব্যাঙ্কের ভীষণ ক্ষতি হবে। কাজটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে, তুমিও ছাঁটাই হয়ে যাবে। এখন থেকে তুমি এই কাজের জন্য দেড়শ ডলার বেশী পাবে। লিডবেটার তোমাকে কাজটা বুঝিয়ে দেবে।
কাজটা যে কত শক্ত, তা যখন বুঝতে পারলাম ভয়ে হাত–পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। লিডবেটারের মত দক্ষ কর্মীর মাথার চুল পেকে গেছে ছমাসের মধ্যে, আর সেই কাজের দায়িত্ব আমার উপর পড়ল!
মিঃ স্টার্ডড আমাকে জোশশেলী সম্পর্কে কিছু তথ্য দিলেন। তিনি শহরের একজন বিশাল প্রভাবশালী ব্যক্তি। একদিকে তার ট্রাকটরের ব্যবসা অপরদিকে ট্রাঙ্ক তৈরীর ব্যবসা করে কোটি কোটি ডলার রোজগার করেন। উনিশশ সাতচল্লিশ সালে তিনি মারা যান। তার মেয়ের নামেনগদ সাত কোটি ডলার রেখে যান আর সম্পত্তি তো রয়েছেই।
উইলে নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, জমিদারী এবং তার অগাধ বিষয় আশয় সবই প্যাসিফিক ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন দেখাশোনা করবে।
অবশ্য তার মেয়ে যদি আমাদের কাজে অসন্তুষ্ট হয় তবে অন্য ব্যাঙ্কে তাদের অ্যাকাউন্ট স্থানান্তরিত করতে পারবে। এতবড় সম্পত্তির দেখাশোনাকরতে অনেক ব্যাঙ্কইরাজি থাকবে কেননা শেলীর অ্যাকাউন্টের টাকা খাটিয়ে অনেক পরিমাণ ডলার সহজে লাভ করা যায়।
জোশ শেলীর কন্যা ভেন্তাল একেবারে গভীর জলের মাছ। এতদিন বাপের শাসনে সে ঘরের মধ্যে জন্তুর মতই আটকে ছিল, আর বাবা মারা যাবার পর বিশাল সম্পত্তি হাতে পেয়ে একটা রক্তলোভী বুনো দাতাল শুয়োর হয়ে উঠেছে।
নিষ্ঠুর প্রকৃতি ও নীচু মনের মেয়ে এই ভেন্তালের মেজাজও বেশ সাংঘাতিক।
গত ছ বছর ধরে ব্যাঙ্কের পনের জন দক্ষ কর্মচারী শেলীর অ্যাকাউন্টের কাজ করে কেবল বদনামই কুড়িয়েছে। কাউকে শান্তিতে কাজ করতে দেয়নি ভেস্তাল।
শেলীর অ্যাকাউন্টেন্টের কাজ করা মানে স্বেচ্ছায় ফাসীর দড়ি গলায় পরা।
লিডবেটার তার কাজের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে লাফিয়ে উঠল আনন্দে।
শেলী অ্যাকাউন্টের ঘরে এসে আমাকে ফাইল খুলে কাগজপত্র দেখাতে লাগল। আমি তার ব্যস্ততা দেখে তাকে থামিয়ে দিযেবললাম তুমি এসববন্ধকর, এসব জটিলব্যাপার আমার মাথায় ঢুকবে না।
আমি যেন মাতৃহত্যা করে ফেলেছি এমনভাবে লিডবেটার আমার দিকে তাকাল। সে বলল–শেড, তুমি জান না ভেস্তাল কেমন সাংঘাতিক মেয়ে। কেউ সুখে থাকুক, মেয়েটা তা চায় না। কাজে সামান্য খুত হলে, কৈফিয়ৎ চাইবে। আর সে তোমাকে ছিঁড়ে খাবে।
কর্মদক্ষতা না দেখাতে পারলে এই অ্যাকাউন্ট হাতছাড়া হয়ে যাবে। ব্যাঙ্ক তো তোমাকে খাবেই আর মিস শেলীও তোমাকে মরণ কামড় দেবে।
সে সাবধান করে বলল–শেড, তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। সাবধান। তোমার উপর ভীষণ দায়িত্ব, এই ফাইলগুলো ভাল করে বোঝবার চেষ্টা কর।
আমি হাসলাম। তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম–শোন, লিডবেটার মেয়েদের কিভাবে হ্যাঁন্ডেল করতে হয় তা আমার জানা আছে। আর ঐ হিংস্র মেয়েটি এবার বুঝবে, কার সঙ্গে হেঁচড়ামো করছে। তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
.
০২.
পনেরই মে। আজ সকালবেলা মিস শেলীর সঙ্গে দেখা করবার অভিপ্রায়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
তার সম্পর্কে লিডবেটারের কাছ থেকে যা যা জেনেছিলাম, সেই তিনটি বিষয় দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে বলেই আমার মনে হল। ভেস্তালের এই তিনটি দাবী হল
এক–পঁচিশ হাজার ডলার দিয়ে যে ফারের কোটটা তিনি সম্প্রতি কিনেছেন, সেটা ইনকামট্যাক্সের খাতায় গোপন করতে হবে, ন্যায্য খরচের হিসাব দেখাতে হবে।
লিডবেটার তা অবাস্তব বলে নাকচ করেছে। তা না হলে ব্যাঙ্কের বিপদ হবে।
দুই–লোরার ইস্টসাইডে মাইল দুই জুড়ে শেলী ফাউন্ডেশনের যে বিশাল ভাড়া বাড়ী আছে তাতে শতকরা পনের ভাগ ভাড়া বাড়াতে হবে।
তিন–উনিশশো চোদ্দ সালে তার বাবা তিনশ চৌত্রিশ নং ওয়েস্টার্ন অ্যাভিনিউ–এর বিরাট ফ্ল্যাট বাড়িটা কিনেছিলেন তা ব্যাঙ্ককে বিক্রী করে দিতে হবে মিঃ বার্জেসের কাছে। তিনি সেখানে একটা পতিতালয় খুলতে চান।
এই তিনটি প্রস্তাব মানা সম্ভবপর নয়। তাছাড়া দ্বিতীয় দাবীটির প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, ঐ বাড়িটির ভাড়া কিছুদিন আগেই বাড়ান হয়েছে। আর তিননম্বরের বাড়িটা বিক্ৰী করা ব্যাঙ্কের পক্ষে সম্ভবনয়, কারণ ঐ বাড়িটাতে তার বাবার আমলের ভাড়াটেরা রয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঐ তিনটি বিষয়ে আমাকে তৈরী থাকতে হবে।
আমি দশটার সময় একটা ট্যাক্সিতে চড়ে শেলী হাউসে হাজির হলাম। আমার পরনে তখন ছিল লিনেনের স্পোর্টস জ্যাকেট বড় বড় পকেটওয়ালা। ডীপ নীল রং এর ঢোলা গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট, সাদা শার্ট আর কাক লেদারের জুতো। রুমালটা বেশ জংলী টাইপের ছিল।
শেলী হাউসের প্রাইভেট রাস্তা, পাহাড় কেটে তৈরী। অনেকগুলো বাঁক ঘুরে তিন মাইল রাস্তা নশো ফুট ওপরে বিশাল গেটের সামনে পর্যন্ত চলে গেছে। এটা বাড়ি তো নয়, প্রাসাদ বললে ভুল হয় না।
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্ততঃ করতে থাকি আমি, এমন সময় ধর্মযাজকের মত চেহারার একজন লোক দরজা খুলে উদয় হল।
বললাম–মিঃ উইন্টার্স! মিস শেলীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
সে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। পেনসিলভানিয়া সেন্ট্রাল স্টেশনের মতন একটা বিরাট হলঘরে এসে দাঁড়ালাম। বসতে বলে লোকটা চলে গেল। আমি ঘুরে ঘুরে চারিদিক দেখতে লাগলাম।
কত রকমের যুদ্ধাস্ত্রবর্শা, তরোয়াল, বল্লম, কুঠার, অয়েল পেন্টিং ছবি ঘরে ভর্তি। ছুটন্ত ঘোড়ার ছবিই বেশী।
বাড়ির এমন গমগমে পরিবেশে লিডবেটারের গোবেচারা মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমার বেশ ভয় করতে লাগল।
কয়েক মিনিট পরে চাকরটা এসে বলল–আমার সঙ্গে আসুন।
চাকরটার সঙ্গে আমি বিশাল বারান্দা পেরিয়ে ওক কাঠের দরজার সামনে এলাম। চাকরটা ঐ দরজার এক পাল্লা খুলে ভিতরে কারোর উদ্দেশ্যে বলল–প্যাসিফিক ব্যাঙ্কের মিঃ উইন্টার্স।
বুকের ভিতরে কাঁপুনি নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলাম। ঘরটা ছোট হলেও বেশ ভোলামেলা। ও পাশের জানালা দিয়ে বাগান আর সমুদ্রের মনোরম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে ফুলদানী ভর্তি। জানলার পাশে একটা ডেস্ক আর তাতে আসীন একটা মেয়ে। তার মাথা ভর্তি কালো চুল। রিমলেস চশমার ফাঁক দিয়ে তার কৌতূহলী চোখদুটো আমাকে তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করছে।
কয়েকমাস পরে এই মেয়েটিই আমাকে নরকে নামিয়েছিল। তখনই আমার মেয়েটিকে ভাল করে দেখা উচিত ছিল।
আপনিই মিঃ উইন্টার্স? সে প্রশ্ন করল।
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল–আমি মিস ডোলান, মিস শেলীর সেক্রেটারী।
আমাকে তার অনুরোধে বসতে হল। সে জানাল, মিস শেলীর কিছুক্ষণ দেরী হতে পারে। তখনই আমার মনে পড়ে গেল লিডবেটারকেও এরকম ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত, ফিরেও আসতে হত।
আমি ডোলানের উদ্দেশ্যে বললাম–আমি বাগানে আছি। উনি যখন আসবেন, আমাকে দয়া করে ডেকে নেবেন।
বাগানে এসে সিগারেট ধরালাম। পনের মিনিটে তিনখানা সিগারেট শেষ হল। তবুও ডাক পড়ল না।
মিস ডোলানের ঘরে এসে বললাম–উনি কি তৈরী হন নি?
বোধ হয় আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে।
মিস ডোলানের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি তার কাছে একটা কাগজ আর খাম চাইলাম। সেটা দিতেই আমি তার উদ্দেশ্যে বললাম–টাইপরাইটারটা একটু ব্যবহার করছি,বলেই বসে পড়ে একটা চিঠি টাইপ করলাম। প্রিয় মিস শেলী,
পনের মিনিট ধরে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। মিস ডোলানের কাছ থেকে জানতে পারলাম–আপনার আরও দেরী হতে পারে। কিন্তু আমার তো একটা বিবেক আছে। এখানে বসে থাকলে আমার সময় নষ্ট হবে, আর তাতে আপনারই অর্থের ক্ষতি। জানেন তো বিনিয়োগকারী ঘুমিয়ে থাকলেও শেয়ার মার্কেট অপেক্ষা করেনা। তাছাড়া ফার কোটের ব্যাপারটা আপনার স্বার্থেই আলোচনা করা দরকার।
নিজের নাম সই করে চিঠি খামে ভরে একটা চাকরের হাত দিয়ে মিস শেলীর কাছে পাঠালাম।
তারপর জানলার কাছে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। বেশ ভয় লাগছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চাকরটি এসে জানাল–মিস শেলী এখনই আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। স্যার, আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
মিস ডোলানের বিস্ময় ভরা মুখটা আমার চোখে পড়ল। তার চোখে বিস্ময়ের ছাপ কিছুটা প্রশংসারও বটে। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলাম।
চাকরটিকে অনুসরণ করে ভেস্তাল শেলীর ঘরে পৌঁছলাম। বিশাল বিছানার উপর আধশোয়া ভঙ্গিতে যাকে দেখলাম, তাকে বাড়ির চাকরের পর্যায়ে ফেললে বোধহয় ভালই হবে।
হাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কপালের নীচে দুটো কালো গর্তের মধ্যে থেকে চোখ দুটো যেন ঠিকরে বার হয়ে আসতে চাইছে। একমাথা শুকনো হলুদ রং–এর চুল। বাজপাখীর ঠোঁটের মত খাড়া নাক। লাল লিপস্টিক সত্ত্বেও ঠোঁটটা যেন ঢাকা পড়ে গেছে।
পরস্পরের চোখাচোখি হওয়াতে সে হেসে মৃদু সম্ভাষণ জানাল–আপনিই শেড উইন্টার্স? গলার স্বরটা মৃদু ও সুরেলা, যা চেহারার সঙ্গে বেমানান।
–হ্যাঁ, মিঃ স্টার্নউড আমাকে…।
আমার কথা শোনবার দিকে তার কান নেই, মাঝপথে আমাকে থামিয়ে প্রশ্ন করল–এটা আপনি লিখেছেন? চিঠিটা দেখাল।
আজ্ঞে, হ্যাঁ। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাতে আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে, ঐরকম অবস্থায় মিস শেলী বলে–আপনি বেশ সুন্দর দেখতে, মিঃ উইন্টার্স। বোধহয় আমার জন্যই আপনি এই পোষাক পরেছেন?
হ্যাঁ, আমার মনে হল, অন্ততঃ পনেরজন কেরানীর সাদামাটা পোষাক দেখে একঘেয়েমি দূর করবার জন্য আমি অন্য ধরনের পোষাক পরলাম।
আমি আপনাকে আরও কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখতে চাইছিলাম–তীব্র দৃষ্টি হেনে বলল–কিন্তু আপনার ধূর্তামির জন্য আপনি জিতে গেলেন।
আমিও বিজয়ীর হাসি হেসে বললাম আমি সেটা অনুমান করেই আপনাকে চিঠি লিখেছি।
মিস শেলী ইঙ্গিতে বিছানার পায়ের দিকটা দেখিয়ে বলল–আপনি ইচ্ছা হলে এখানে বসতে পারেন।
আমি বসলে সে তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ফার কোট নিয়ে আপনি কি যেন বলছিলেন?
আমি চলনসই একটা জবাব ভেবেই রেখেছিলাম। বললাম–দেখুন! আমি কয়েকটা প্রস্তাব রাখব কিন্তু আপনার অপছন্দ হলে যদি দয়া করে ভুলে যান সেটাই ভাল হবে।
আগ্রহ সহকারে মিস শেলী প্রশ্ন করল–ঠিক আছে, আপনি বলুন।
মিস শেলী, আমি বুঝতে পারছি আপনি ব্যাঙ্কের কাজে সন্তুষ্ট নন। নদীর এপার–ওপারের মতই ব্যবধান। আমি সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই।
এরপর ভূমিকা সাঙ্গ করে বললাম–কোট কেনার খরচটাআপনি নিজের খরচের হিসাবের মধ্যে দেখাতে চাইছে। কিন্তু সেটা ব্যাঙ্কের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। ব্যাঙ্ক যে কাজ করে প্রত্যেকটার রসিদ থাকে। যদিও ইনকাম ট্যাক্সের অফিসাররা রসিদ আদৌ দেখেনা। তারা ব্যাঙ্কের কথাই মেনে নেয়।
মিস শেলী বললেন, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।
তার দিকে তাকিয়ে বললাম ব্যাপারটা জালিয়াতি করা। এক্ষেত্রে ছদ্মকেশ পরাতে হবে। এক অর্থে বলে কর ফাঁকি দেওয়া। যার জন্য জেল বা জরিমানা দুটোই হতে পারে।
ফাঁকিটা কি ধরা পড়ে যেতে পারে?
তার কথা শুনে বুঝলাম জালিয়াতির নাম শুনে সে ভয় পেয়ে যায় নি। তার অর্থ এই ধরনের মেয়েকে সহজেই কায়দা করতে পারা যাবে। আমি নরম গলায় বললাম–আমি যেভাবে কাজটা করব, তাতে ধরা পড়বার আশঙ্কা নেই।
কিভাবে করবেন? সেটা বুঝিয়ে বলুন!
উনিশশ ছত্রিশ সালে আপনার বাবা গোটা তিনেক কারখানায় মেরামতির কাজ করেছিলেন এবং সেইমত ইনকামট্যাক্স দপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে তিরিশ হাজার ডলার নিজের খরচের মধ্যে দেখিয়েছিলেন। এক্ষেত্রেইনকামট্যাক্সের লোকেরা রসিদনা দেখেই ব্যাঙ্কের বয়ান জেনে নিয়েছিল। সেই রসিদগুলো আমি পাল্টে নতুন করে নিয়েছি। আমার স্থির বিশ্বাস ইনকাম ট্যাক্স সেগুলো দেখতে চাইবে না, ব্যাঙ্কের বয়ানও মেনে নেবে।
আমি রসিদগুলোর তারিখ পাল্টে দেব। কাজেই দেখুন, আপনার ফার কোটের চেয়ে বেশী টাকা, তিরিশ হাজার ডলার আপনার খরচের হিসাবে বেরিয়ে এল কি? এবার বলুন আপনি খুশী তো?
মিস শেলী বলল–মিঃ উইন্টার্স, আপনি বেশ বুদ্ধিমান। আমাদের দুজনের বোঝাপড়ায় ব্যবসাপত্তর এখন থেকে আমার মনের মতই চলবে।
তিনি মনের খুশীতে বেল বাজিয়ে চাকরকে দিয়ে একবোতল শ্যাম্পেন অর্ডার দিলেন।
আমি বিজয়ের উত্তেজনা মনের মধ্যে কোনরকমে চেপে রাখলাম। এখন কেবলমাত্র সাবধানে, ধীর, শান্ত মাথায় কাজ করতে হবে।
শ্যাম্পেন রুপোর পাত্রের মধ্যে বসিয়ে আনা হল। তার মধ্যে বরফের কুচি। বেশ কায়দা করে বোতলের ঢাকনাটা খুলল চাকরটা। তারপর সে দু গ্লাস মদ মিস শেলী আর আমার হাতে তুলে দিল।
একটু মুখে দিতেই মুখটা খারাপ হয়ে গেল। শ্যাম্পেনটা বাজে। বুঝলাম চাকরটা মজা করেছে।
যাকগে সে দিকে গুরুত্ব দিলাম না। মিস ভেস্তাল বাড়িভাড়ার ব্যাপারটা জানতে চাইল।
সঙ্গে সঙ্গে তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দিলাম–ওঃ বাড়িভাড়া! তাও হয়ে যাবে।
মিস শেলী জানতে চাইল উপায়টা।
বললাম–যে সংস্থা এখন ভাড়া আদায় করছে, তাদের পাল্টাতে হবে।
মিস শেলী অবাক হয়ে বলল–সেকি! ওরা তো গত চল্লিশ বছর ধরে কাজ করছে।
ভৃত্য যদি অকর্মণ্য হয়,বয়স্ক হয়, তাকে তো পাল্টাতেই হবে। পুরোনোবলে তো রেখে দেওয়া যায় না। আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম।
–দেখবেন, বাড়ির ব্যাপারে যেন এসব প্রশ্ন না ওঠে।
না, না, এসব ব্যাপারে আপনাকে চিন্তা করতে হবেনা। আমি নিজেকে আপনার চাকর বলে মনে করি না। আপনার চাকর অর্গিস নিজেকে চাকর বলে ভেবে খারাপ শ্যাম্পেন দিতে পারে, কিন্তু আমিও তাকে একদিন দেখে নেব। .
না, না, অত চটে যাবেন না অর্গিসকে আমি বলব।
ঠিক আছে। আমি বললাম।
–তাহলে যাবার সময় হ্যারিসন কোটের চিঠিটা লিখে দেব। আপনি সই করে রাখবেন।
মিস শেলী উত্তর দিল না। চিত হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানাতে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম–তার বুক বলতে কোন পদার্থ নেই। একেবারেই লেপাপোছা। একটা ছোট খাট পুতুলের মতই তাকে দেখাচ্ছে। সেউঠেবসে বলল–মিঃ উইন্টার্স আমাদের দুজনের সমঝোতা ভাল হবে বলেই মনে হচ্ছে। কি বলেন? তার খাড়া নাকটা কাঁপছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম–আপনি তিনশ চৌত্রিশ নং ওয়েস্টার্ন অ্যাভিনিউ–এর বাড়িটা মিঃ বার্জেসকে বিক্রী করে দিতে ইচ্ছুক?
মিস শেলী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল–আপনি কি একদিনেই সব কাজ সেরে নিতে চাইছেন? এটার কি বন্দোবস্ত করলেন?
আমি শ্লেষের সঙ্গে বললাম–আপনি যদি আপনার বাবার স্মৃতিটাকে একটা বেশ্যালয়ের রূপ দান করতে চান, তাই করবেন। কেবলমাত্র আপনার অনুমতির অপেক্ষায়।
আমার এই নগ্ন কথাগুলো মিস শেলীর মনে বেশ দাগ কাটল বলেই মনে হল। কিন্তু বুদ্ধির জোরে আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বলল–ভাড়াটাদের নিয়ে একটা সমস্যা রয়েছে যা মিঃ লিডবেটার সমাধান করতে পারছে না।
ওসব নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
তীক্ষ কটাক্ষ হেনেমিস শেলীবলল–ঠিক আছে,বাড়িটা বিক্ৰীকরবার চেষ্টা করুন। আপনার বুদ্ধির দৌড়টা একবার দেখি কথাগুলো যেন সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
মিস শেলীর উদ্দেশ্যে সঙ্গে সঙ্গে বললাম–আমি বার্জেসের সঙ্গে দেখা করতে চাই। এবং সেটা আজই।
কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল–আপনি যে একরকম আগুনে–বোমা।
তার প্রশংসা শুনে আমি বেশ উত্তেজিত হলাম।
এমন সময় মিস শেলী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত দিল, এখনিই সে বেরোবে।
আমি বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ালাম। আমার সঙ্গে করমর্দন করে মিস শেলী বলল–আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে বেশ ভাল লাগল। আপনার কথা আমি মিঃ স্টার্নউডকে জানাব।
সুযোগ বুঝে আমি একটা দাও মারলাম–আপনি যদি আমার জন্য একটা গাড়ি আর একটা নিরাপদ অফিস ঘরের ব্যবস্থা করে দেন।
মুখে বিরল ভাব এনে মিস শেলী বলল–আপনাকে গাড়ি তো ব্যাঙ্কই দেবে।
আমি তার কথা বুঝতে পেরে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে বললাম–সব কাজ তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলতে পারব।
আর আপনার এসকল গোপনীয় কাজ করব, তা সকলে দেখে ফেললে তাতে আপনারই ক্ষতি। গোপনীয়তা রক্ষা করবার জন্য একটা নিরাপদ ঘরের দরকার। ব্যাপারটা আপনিই ভেবে দেখুন।
থেমে বললাম–এসব গূঢ় কথা আমি ব্যাঙ্ককে জানাতে চাইছি না।
সে আমার দিকে কটমট করে তাকাল। মনে হল আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের রাগকে সামলে নিয়ে সেবলল–আপনার স্নায়ুগুলো বেশ সতেজ দেখছি। মিঃ উইন্টার্স, আমি বাজি রেখে বলতে পারি মিঃ স্টার্নউড বা অন্যান্য কলিগরা আপনাকে চিনতে পারে নি। তাই এতদিন ধরে অন্যান্য কর্মচারীরা আমার অ্যাকাউন্টের ভার নিয়েছিল। ঠিক আছে, মিঃ স্টার্নউডকে বলে আমি আপনার জন্য একটা আলাদা অফিস ঘরের বন্দোবস্ত করে রাখব।
আর আমার ছটা গাড়ির মধ্যে একটা আপনি নিতে পারেন, অবশ্য সেটা দু–একদিনের জন্য।
আমি নিশ্চিত হলাম। যে দুনিয়া আমার কাছে স্বপ্ন মনে হয়েছিল, এখন তা আমার হতের মুঠোয়।
মিঃ অ্যাটর্নী দেখলেন কিভাবে তার গাড়ি, অফিসঘর সব আমার নিজের হয়ে গেল। এবার শুরু হল আমার আসল খেল।
মিঃ বার্জেসের কাছে গেলাম। বেঁটেখাটো মানুষ, রোগা চেহারা। মাথায় একটা টুপী। হকের মতই তার নাকটা বাঁকান। ব্যাঙের পেটের মত তার গায়ের রং ফ্যাকাশে।
একটা ঝরঝরে পুরোনো বড় টেবিলের এক পাশে বসে আছে একটা নেভা চুরুট ফোকলা দাঁতে চেপে।
তার টেবিলের মাঝখানে বসে আছে একটা মেয়ে। তার বুক দুটো কামানের মত উঁচু হয়ে রয়েছে। আর পাছা! যাকে বলে দেড়মণি নিতম্বা একটা আঙুলে টাইপ করে চলেছে।
কি চাই? যেন একটা খালি কৌটায় পয়সা পড়ল, এমন ঠংঠং আওয়াজ হল।
আমি আঙুল দিয়ে মিঃ বার্জেন্সকে দেখিয়ে বললাম–তোমার নিতম্বটা সামলে বসো খুকি। এটা তো সেই জায়গা নয়! বলে তার পাশ দিয়ে মিঃ বার্জেসের কাছে গেলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে দিলাম। তিনি আমার পোষাক দেখে বললেন–আপনি তো সাদামাটা কেরানী নন, বরং সিনেমা স্টার বলেই মনে হচ্ছে।
তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে আলোচনা সেরে ফেলতে চাইলাম।
তার সঙ্গে দরকারী সব কথা সারা হল। শর্ত থাকল এরকম, উনি বাড়িটা হাতে পেলেই বাড়ির ভাড়াটেগুলোকে উচ্ছেদ করে দেবেন।
কথা শেষ করে তার কাছ থেকে পারিশ্রমিক চাইলাম।
সে বলে–আপনি তো বেশ চালু ছেলে!
আমি তার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বললাম–আপনি আমার পাঁচশো ডলার মিটিয়ে দিলে বাড়িটা আপনার হয়ে যেতে পারে। না পোষালে বলে দিতে পারেন।
বার্জেস কিছুটা হতাশ হলেও পকেট থেকে মোটা মানিব্যাগটা বার করে গুনে গুনে পাঁচশ ডলার আমার হাতে দিল।
আমি টাকাটা হাতে নিয়ে নিজেকেই গালাগালি দিলাম। ভাবলাম, আরও একটু বেশি চাইলেই বোধহয় ভাল হত। বুড়োটাকে শুষে নিতে পারলে ভালই হত।
বার্জেস এবার আমার চোখে চোখ রেখে বললবাড়িটা চালু হলে একবার দেখতে আসবেন মেয়েগুলোকে চেখে দেখবেন। আশা করি আপনার এ বিষয়ে রস আছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম ঠিক আছে, কাল এক সময় এসে সই করাব আপনাকে দিয়ে। বাড়িটা আপনারই হয়ে গেল ভেবে নিন।
তাকে বিদায় জানিয়ে রাস্তায় চলে এলাম। দিনটা বেশ ভাল যাচ্ছে বলেই আমার মনে হল।
লিটল ইডেন এলাকায় পাঁচ ছটা সম্পত্তি তদারক সংস্থা আছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সংস্থাটি হল স্টেইনবেক অ্যান্ড হোরে। ভাবলাম, এদেরকে ভার দিলে প্রাণপণ চেষ্টা করে এরা শেলীর ব্যবসা দেখাশোনা করবে।
বুলেভার্ড ফ্লোরাল দিয়ে গাড়ি চালিয়ে তাদের অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। রিসেপশনিস্টের কাছে গিয়ে বললাম আমি প্যাসিফিক ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন থেকে আসছি।
মেয়েটি আমাকে বের্নি হোরের কাছে নিয়ে গেল। লোকটা মাঝবয়সী। ফুটবলের মত নীরেট গোল তার চেহারা।
আমি ঢুকতেই এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়াল–আনন্দিত হলাম মিঃ উইন্টার্স বসুন
আমি বসতে বসতে নিজের পরিচয় দিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম–শেলী ফাউন্ডেশনের ভাগ আদায়ের কাজটা কি আপনারা করতে রাজি আছেন?
বের্নি হোরের মুখভাবের কোন পরিবর্তন ঘটল না। নাকটা চুলকে বলল–হ্যারিসন অ্যান্ড কোর্ট কি কাজটা ছেড়ে দিয়েছে?
উত্তরে বললাম–মিস শেলীই তাদেরকে ছাড়িয়ে দিতে চান। গত মাসের ভাড়ার রসিদের একটা বান্ডিল বার করে বের্নির হাতে দিয়ে বললাম–এর উপর বাড়তি পনের পার্সেন্ট ভাড়া আদায় করতে হবে।
অবশ্যই পারব, আপনি আমার উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিন।
আমি বললাম–জানেন তো? দেশজুড়ে মিস শেলীর সম্পত্তি ছড়িয়ে রয়েছে। দায়িত্ব দিলে সব চালাতে পারবেন তো?
কেন পারব না? এটাই তো আমার কাজ। কিন্তু কথায় তেমন আগ্রহ দেখা গেল না।
আমি লোভ বাড়িয়ে দেবার জন্য বললাম–অবশ্য তিনি যে রাজি হবেন, এমন কোনও কথা নেই, তবে কিনা আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
বের্নি ছুরির ফলার মত দৃষ্টি চালিয়ে একবার দেখে নিল, তারপর বলল–ভারটা আপনি একবার দিয়েই দেখুন না। সিদ্ধান্ত আপনিই নেবেন।
বুঝলাম সে আমার মনোভাবটা বুঝেও বুঝতে পারছে না। সোজা ভাবেই কথাটা বলা উচিত ভেবে আমি হাসতে হাসতে বললাম–মিঃ বের্নি আমার মনে হয় ঘোড়র উপর বসে কথা বলার চেয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে সামনাসামনি কথা বলাটা বোধহয় ভালই হবে।
শহরে আপনাদের মত সংস্থা আছে এবং সকলেই এই বিশাল শেলী সম্পত্তি তদারকির ভার পেলে ধন্য হবে। তাই না? আর সেই কাজটা আমি আপনাদের কাছে নিয়ে এসেছি, কোন স্বার্থে বলুন তো?
বের্নি হোরে এবার বুঝতে পারল, প্রশ্ন করল–আপনি কত চান। মিঃ উইন্টার্স?
মিঃ বের্নি আমাকে হাজার ডলার দিতেই হবে। আর পরিবর্তে মিস শেলীর সব সম্পত্তি দেখা শোনার ভার আপনি পাবেন।
ঠিক আছে, মিস শেলীর সই করা চিঠি আপনি আনলেই একেবারে নগদে হাজার ডলার পেয়ে যাবেন।
ঠিক আছে, বলে আমি তার অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। জানিয়ে দিলাম আগামীকাল দুপুরবেলায় আসব।
.
০৩.
অফিসের টেবিলে আমার নামে একটি চিরকূট পড়ে রয়েছে।মিঃ ঊনউডের কোন পাওনাদার এল, নাকি স্বয়ং বের্নি বা বার্জেস মিঃ স্টার্নউডকে গোপন তথ্যগুলো ফাঁস করে দিতে এল। ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
মিঃ স্টার্নউডের দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকলাম। তার হাসিমাখা মুখ দেখে আমার ভুল ভাঙল।
তিনি সহাস্যে আমাকে বসতে বললেন–তারপর আমার উদ্দেশ্যে বললেন–তুমি যাদু টাদু করলে নাকি? মিস শেলী তোমাকে পেয়ে দারুন খুশী। তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে তোমার প্রশংসা করলেন। কি ব্যাপার বলতো? তোমার জন্য আলাদা অফিস ঘর করে দিতে বললেন।
তোমার অফিস ঘর এতক্ষণে বোধহয় তৈরী হয়ে গেছে। উপযুক্ত ভাবে সাজাতে বলেছি। আর মিস গুডচাই তোমার স্টেনো হয়ে কাজ করবে।
আমি মৃদু হেসে বললাম–স্যার, অত উল্লসিত হবেন না। বড় লোকের খেয়াল তো!
তা যাকগে, এখন তুমি কিভাবে তিনটে সমস্যার সমাধান করলে সেটাই বলতো?–প্রশ্ন করলেন মিঃ স্টার্নউড।
আমি জানতাম এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। উত্তরের একটা ছক আমি তৈরী করে নিয়েছিলাম। একটু চিন্তিত ভাব এনে বললাম–আমি মিস শেলীকে ফার কোটের ব্যাপারে বলেছি এটাতে কর ফাঁকি দিতে হবে, সেক্ষেত্রে ধরা পড়লে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।
বেশ বুদ্ধির কাজ করেছ–স্টানডড বললেন–আমরা এরকম ভাবে কোনদিন বোঝাতে পারি নি।
বাকি দুটোর কি করলে তাই বল।
এবারেও প্রথমে আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললাম–মাপ করবেন স্যার। এছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। তিনিই যে মালকিন, এটা প্রমাণ করবার জন্য বাড়িটা মিঃ বার্জেসকে বিক্রী করবার বন্দোবস্ত করেছি এবং শেলীফাউন্ডেশানের হয়ে বাড়তি শতকরা পনের ভাগআদায় করবার দায়িত্ব অর্পণ করলাম স্টেইনবেক অ্যান্ড হোরেকে।
মিঃ স্টার্নউডের চোখদুটো বিস্ফারিত হল। তিনি বললেন–বের্নি এক ধরনের অর্থ পিশাচ আর নির্দয়। জোচ্চোরও বটে।
আমিও তাকে এ ধরনের কথা বলেছি, কিন্তু তিনি আমাকে দাবড়ি দিয়ে উঠলেন–আপনারা আপনাদের চরকায় তেল দিন। বের্নি সব লুটেপুটে খাবে। স্যার, আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমার প্রভাবটুকু খাটিয়ে ওর রাশটুকু ধরে রাখতে পারি।
কিন্তু কিভাবে তুমি ওর ওপর প্রভাব বিস্তার করবে? বের্নিকে সামলান সোজা কাজ নয়। আর মক্কেলের ক্ষতি হোক এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। আমি এখনি মিস শেলীকে ফোন করছি বলে তিনি ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন।
আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। মিস শেলী তো এইসব ব্যাপারে কিছুই জানেনা।এখনি আমার দফার শেষ হয়ে যাবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বললাম–উনি সাবধান করে দিয়েছেন, আমরা যদি ঐব্যাপারে কথা বলতে যাই তাহলে উনি আমাদের ব্যাঙ্ক থেকে সমস্ত অ্যাকাউন্ট তুলে নেবেন। স্যার, আপনি খবরদার ফোন করবেন না। এতে আমাদেরই ক্ষতি হবে।
মিঃ স্টার্নউড আঁতকে উঠে হাত সরালেন ফোনের উপর থেকে।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম–কিছু ভাববেননা স্যার। ভাড়া সংক্রান্তরসিদগুলো চেক করে আমি বেনিকে সোজা করে রাখব।
মিঃ স্টার্নউডের গলায় আশঙ্কার সুর শুনে আমি তাকে আশ্বাস দিলাম–নিশ্চয় আমি পারব স্যার।
তাকে প্রবোধ দিয়ে বললাম–একান্তই না পারলে তখন আপনি মিস শেলীর সঙ্গে কথা বলবেন।
এবারে আশ্বস্ত হলেন মিঃ স্টার্নউড; বেশ, তুমি যা করবার কর। তারপর হেসে বললেন–অন্ততঃ ফারকোটের ব্যাপারটা ভালভাবেই মিটিয়েছ তুমি। এ দুটোও পারবে।
এরপর আমি ধন্যবাদ জানিয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
.
০৪.
পরদিন প্রাতে যথারীতি আমি অফিস ঘরে এসে পৌঁছলাম। এতদিনে আমি বুঝতে পারলাম মিস শেলীর নাম ভাঙ্গিয়ে, তার জমান টাকা ভাঙ্গিয়ে বেশ কিছু ডলার আয় করা যাবে।
মনে মনে ভাবলাম, বার্জেসের কাছে আমি ঠকে গেছি কিন্তু বের্নি হোরের কাছ থেকে হাজার তিনেক ডলার আদায় না করে আমি ছাড়ব না। পরিকল্পনা মত একটা চিঠি তৈরী করলাম। কেবলমাত্র নাম সই করবার অপেক্ষায়। শেলীর অ্যাকাউন্টের খাতা পত্র খুলে দেখতে লাগলাম। মিস শেলীর অ্যাকাউন্ট সবই সরকারী বন্ড আর স্টকে কেনা। একেবারেই পাকা কাজ।
মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সোজা ওয়েস্ট সিটি স্ট্রীটের একটা বিশাল বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে সোজাছতলায় উঠে গেলাম। এই বাড়ির খোপে অনেকগুলো অফিস। এখানে রায়ান ব্ল্যাকস্টেনের অফিস।
আমার পূর্ব পরিচিত সেই বন্ধুটির কাছে যেতেই সে আনন্দিত হল। বসতে বলল।
আমি বসতে বসতে বললাম–বিশাল শেলী অ্যাকাউন্ট থেকে কিছুটা খুঁটে তুলে নিলে হয় না?
সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল–ওতে আমার কোন লাভ হবে না।
আমি রায়ানকে বললামধরো না, যদি আড়াই লাখ ডলার শেয়ার বাজারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই জিনিসের দাম বাড়বে না?
ঠিকমত লাগাতে পারলে অবশ্যই বাড়বে। যেমন ধর, কোনওয়ে সিমেন্ট। গত কদিনে পাঁচ পয়েন্ট দাম বেড়েছে। তবে জানই তো, এসব ব্যাপারে ঝক্কি একটা থাকেই।
আমি তাকে হাজার ডলার শৈয়ারে লাগিয়ে দিতে বললাম। লোকসান হলে বড়জোর হাজার খানেক হবে। তার বেশী তো নয়?
রায়ান সেকথায় গুরুত্বনা দিয়ে বলল—এভাবে টাকা খাটাবার অধিকার তুমি কিভাবে পেয়েছ?
নরম গলায় জবাব দিলামব্যাঙ্কের কাছ থেকে নয়, স্বয়ং মিস শেলীর কাছ থেকে। তিনি হাজার খানেক ডলার লোকসানটাও মেনে নেবেন।
রায়ান লিখিত অনুমতি চাইল, সে সোজাভাবে রাজি হবে না বুঝতে পেরে তাকে বললাম–দেখ রায়ান, শেলীর অ্যাকাউন্ট নিয়ে কাজ করার অর্থ সহজেই বাজারে চড়চড় করে দর বেড়ে যাওয়া। তোমারও এতে লাভ হবে–আমারও লাভ হবে।
রায়ান বিস্ময়ের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল–তার মানে? ব্যাঙ্কে কাজ করে এসব কথা তুমি বলতে পার নাকি?
–ঠিক আছে। তুমি যখন রাজি হবে না, তখন আমি লোরেন অ্যান্ড ফ্র্যাঙ্কের কোম্পানীতে যাই। এরকম দাও ওরা হাতছাড়া করবে বলে মনে হয় না।
রায়ান তাড়াতাড়ি বলে উঠল–ঠিক আছে। আশা করি তুমি যা করছ, বুঝে শুনেই করছ। এখন তুমি কত চাও বল?
বেশী নয়! ফিফটি ব্রাদার–জবাব দিলাম।
আঁতকে উঠল রায়ান–একেবারে ডাকাতি। যাক্ তাহলে কোনওয়ে সিমেন্টের উপর লাগাবো তো? চিঠিটা সই করে দাও।
আমি চিঠিটাতে সই করে বললাম–স্টক কেনো আড়াই লক্ষ ডলারের। দুই বা তিন পয়েন্ট বাড়লে ঝেড়ে দাও। আজই।
রায়ান বললাম যদি বাড়তে থাকে তাহলে ধরে থাকবো তো?
না, আজই সম্ভব হলে ছেড়ে দেবে।মিস শেলীএকজন অর্থ পিশাচ। চটপট কিছু লাভ দেখাতে পারলে আমার উপর খুব খুশী হবেন।
আরও কিছু বক্তব্য রায়ানের মাথায় ঢুকিয়ে চলে এলাম ওয়েস্টার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাঙ্কে। সেখানে বার্জেসের কাছ থেকে পাওয়া একশ ডলার দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুললাম। তারপর লাঞ্চ সারবার জন্য ক্লোরিয়ান রেস্তোরাঁতে ঢুকলাম ভাল খাবার জন্য।
ভাবছিলাম কদিন আগে পাওনাদারদের তাড়ায় আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। আর আজ পনের শ ডলার হাতের মুঠোয়। আরও কত টাকা আসবে।
লাঞ্চ সেরে সোজা অফিসে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে নিয়ে বললাম–হালোকে?
দূরভাষে ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল–আমি মিস ডোলান বলছি। আপনি কি মিঃ উইন্টার্স।
হ্যাঁ। আমি বলছি।
তার কাছ থেকে জানতে পারলাম–মিঃ হোরে এখনি এখানে এসেছিলেন। মিস শেলী আমার উপর রেগে রয়েছে।
আমি তাকে জানালাম এখনি যাচ্ছি। এদিকে ইভ ডোলানের কাছে সংবাদ পেয়ে আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। এক সূত্ৰতেই আমার সব আশা, স্বপ্ন ধূলিসাৎহয়ে গেল বোধহয়। আমি ভাবতে পারিনি বজ্জাত হারামজাদা বের্নি খোদ মালিকের কাছে হাজির হবে।
অফিস, গাড়ি, সুন্দরী স্টেননা, বেনির হাজার ডলার, রায়ানের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ডলার, সবার উপর চাকরী। সব হাতছাড়া হয়ে যাবে আমার।
অফিস থেকে বেরিয়ে তিনটে ডবল পেগ হুইস্কি গলাধঃকরণ করে মিস শেলীর দেওয়া ক্যাডিলাক গাড়িটা বাতাসের থেকে দ্রুতবেগে চালিয়ে সাত মিনিটের মধ্যে তার বাড়িতে চলে, এলাম।
অর্গিস এগিয়ে এসে বলল–মিস শেলী অপেক্ষা করছেন ঐ লনে।
আমি তার সামনা সামনি পড়ে গেলাম। ব্যাঙ্গের স্বরে মিস শেলী আমার দিকে ছুঁড়ে দিল–এই যে, চতুর চুড়ামণি মিঃ উইন্টার্স!
কি বলুন–শান্ত স্বরেই তাকে শুধোলাম।
এবার কিভাবে নিজেকে বাঁচাবেন? এরই মধ্যে হাজার ডলার ঘুষ পকেটস্থ করলেন!
আমি বললাম কি বলছেন আপনি? আমি তো
মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে মিস শেলী বিদ্রুপের স্বরে বলল–আপনি মিঃ হোরেকে চেনেন না?
হ্যাঁ, চিনি। অতবড় উকিল। আপনার ফাউন্ডেশনের ভাড়া আদায়ের এর চেয়ে যোগ্য লোক অন্য কেউ নেই।
কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া বের্নিকে ভাড়া আদায়ের জন্য কে অধিকার দিল, আর হাজার ডলার ঘুষ নিতে আপনার লজ্জা করে নি?
আমি সঙ্গে সঙ্গে মেজাজের সঙ্গে উত্তর দিলাম–মিস শেলী, এটাকে ঘুষ বলবেন না। এটা কমিশন আদায় করছি ভাবুন।
মিস শেলি এবার ভীষণ রেগে গেলো–চোপরাও বদমাশ, জোচ্চোর কোথাকার। তুমি আমার নাম করে পকেট ভরাচ্ছ।
আমি বলে উঠলাম–বীর কুৎসিত মেয়েগুলোর মত চেঁচাবেন না।
ইভ ডোলান আমাকে এই পরামর্শ দিয়েছিল যে, মিস শেলী রেগে গেলে তাকে ঠাণ্ডা করার একমাত্র উপায় হল কোন অজুহাত না দেখিয়ে, ক্ষমা না চেয়ে, উল্টে ধমক দেওয়া। তাকে আমি চিনি, তার ভেতরে যত রাগ, বাইরে ততই ভীতু।
ওষুধে কাজ হল। মিস শেলীর কুৎসিত মুখখানা বেলুনের মত চুপসে গেল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল দাঁড়াও হারামজাদা, তোমাকে ব্যাঙ্ক থেকে তো তাড়াব, এই শহরে যাতে থাকতে না পার সে ব্যবস্থা আমি করছি।
আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম–ওরে ভয় দেখানোতে মিঃ উইন্টার্স ঘাবড়ায়না। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমি তেড়ে গেলাম। কি ভেবেছেন আপনি নিজেকে।
শয়তান এখনি তুমি মজা টের পাবে।বলেই ফোন করতে উদ্যত হল।
আমি ছুটে গিয়ে তার হাতটা চেপে ধরলাম।
সঙ্গে সঙ্গে আমার গালে সজোরে এক আঘাত করল। ভয়ে আমি চোখ বুজিয়ে ফেলেছিলাম, বুঝতে পারলাম–তার নখে আমার চামড়া চিরে গেছে। জ্বালা করছে।
মাথায় আগুন উঠে গেল, তার দু কাঁধে থাবা মেরে চেয়ারে জোর করে বসিয়ে দিলাম। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তা লক্ষ্য করলাম। দেহটা কাঁপছে। আমি কোন কিছু গ্রাহ্য না করে বললাম–শুনুন, আমার কথাগুলো। আপনার ফার কোটের ব্যাপারটা মীমাংসা করে আপনাকে ত্রিশ হাজার ডলার পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছি। বাজেকে বাড়িটা বিক্রি করবার ব্যবস্থা আমিই করেছি আর বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারটাও একদিনে সমাধান করে দিয়েছি। পাঁচঘর ভাড়াটের হাত থেকে আপনাকে রেহাই দিয়েছি, যা ঐ লিডবেটার মাসের পর মাস করে দিতে পারে নি। আপনার জন্য এতগুলো ডলার রোজগারের ব্যবস্থা করে দিলাম আর রক্তচোষা শয়তানদের কাছ থেকে নিজের জন্য নূন্যতম ছিটেফোঁটা কমিশন আদায় করেছি, তাতেই আপনার গায়ে জ্বালা ধরছে? আমি তো আপনার টাকা চুরি করিনি! আপনি আমার চাকরিটা খোয়াতে চান? ঠিক আছে। তবে আপনি মনে রাখবেন, আমার সাহায্য ছাড়া ঐ তিরিশ হাজার ডলার পাবার স্বপ্নও ঘুচে যাবে, উল্টে কর ফাঁকি দেবার অভিযোগে আশ্রয় পাবেন সোজা জেলখানায়। আপনার সুনামে সারা দেশ করতালি দেবে। এবার ফোন করুন। করুন ফোন কথাগুলো এক ঝটকায় বলে বাইরের লনে চলে এলাম।
যেন একটা যুদ্ধ করে এলাম। সিগারেট টানছি। এমন সময় অনুভব করলাম মিস শেলীদাঁড়িয়ে রয়েছে আমার পাশে। বেশ একটা আদুরে অভিযোগের সুরে বলে উঠল–আমাকে ব্যথা দিয়েছে, কাদালেন আমাকে।
আর আপনি আমার কি হাল করেছেন দেখুন। গালের ক্ষতটা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। রুমালটা ক্ষতস্থানে চেপে ধরে বললাম–আপনার ভাগ্য ভাল যে আপনার ঘাড় মটকাই নি।
সে ধপ করে আমার পাশে বসল, আপনি শুধু নিজের চিন্তাতেই ব্যস্ত। আমার জন্য না হয় একটু করলেন। তার কদাকার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম মনে ব্যথা পেয়েছে।
মিস শেলী শ্যাম্পেনের অর্ডার দিল। অর্গিসকে ধমকের সুরে বলে দিলাম, সবচেয়ে ভাল জাতের শ্যাম্পেনটা চাই, না হলে বোতলটা তোমার মাথায় ভাঙব।
সে যেন একেবারে আমাকে ভস্ম করে দেবে–এরকম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
যাক, যুদ্ধে আমি জিতে গেছি। সাফল্য আমার হাতের মুঠোয়। আমি রিসিভারটা তুলে ব্ল্যাকস্টেনকে ফোন করলাম। সে জানাল–এইমাত্র সে শেয়ার বিক্রী করেছে। মোটামুটি পঁয়ত্রিশ হাজার ডলার লাভ হয়েছে। আমার কমিশন হিসাবে পাব নশো ডলার।
সেখান থেকেই একবার মিস শেলীর দিকে তাকালাম। শুকনো ডিগডিগে চেহারা নিয়ে চেয়ারের ওপর বেঁকে বসে আছে। বুক বলতে কোন পদার্থ নেই। সৌন্দর্যের স্পর্শমাত্র নেই।
মিস শেলীর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রায়ানকে বললাম–মিস শেলীর চেকটা আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
রায়ান ইতস্ততঃ করছে বুঝতে পেরে আমি বললাম তুমি আমার হয়ে কাজ করছ, মিস শেলীর হয়ে নয়।
রিসিভার নামিয়ে রেখে ভাবতে ভাবতে এলাম–আমাকে চড় মারার খেসারৎ দিতে হবে তোমাকে পনের হাজার ডলার, আর তুমি পাবে কুড়ি হাজার ডলার। এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তোমাকে।
আমাকে দেখে মিস শেলী জামার চেনটা টেনে দিয়ে মৃদু হেসে লজ্জিত কণ্ঠস্বরে বলল–আপনি বুঝি উঁকি মেরে দেখছিলেন! ছিঃ, কুমারী মেয়েদের খোলা বুক ঐরকম ভাবে দেখতে নেই। কথাটা বলে মাথা নীচু করল।
আমি তার কথা বুঝতে পারলামনা। বলে কি? মিঃ শেড উইন্টার্স তাকাবে এই সুটকীর দিকে, যার একটা ডাক শুনে দশটা সুন্দরী এখানে হাজির হবে! যা আমি ঠোঁটে লজ্জিত হাসি এনে বললাম–লজ্জা দেবেন না, এইমাত্র আপনার বিশ হাজার ডলার আয়ের বন্দোবস্ত করে এলাম। সে জন্য অবশ্য আপনার আড়াই লক্ষ ডলার খাটাতে হয়েছে।
মিস শেলী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল,আমার অনুমতি না নিয়ে আমার টাকা ব্যবহার করেছেন?
জবাব দিলাম–টাকা নয়, আপনার সুনামের সদ্ব্যবহার করেছি মাত্র।
মিস শেলীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম–যে কোন জিনিসের উপর আড়াই লক্ষ ডলার দাম হলে স্টকের দাম বাড়তে বাধ্য। এক্ষেত্রে চার পয়েন্ট বেড়েছে।
আমার চোখে চোখ রেখে মিস শেলী বলল–মিঃ উইন্টার্স, আপনি কাজের লোক বটে তবে ভীষণ ধুর্ত ও চালাক।
আমি বললাম–ডাকাত, জোচ্চোর বলুন। মিস শেলী যেন লজ্জা পেয়ে গেল। ক্ষমা চেয়ে বলল–তখন আমি রেগে গিয়েছিলাম আর আপনারও ক্ষমা চাওয়া উচিত। কেননা আপনি আমাকে আঘাত করেছেন।
ঠিক আছে, আমি ক্ষমা চাইছি কিন্তু আমি যে এত কাজ করলাম এবং সব কথা আপনাকে খোলাখুলি ভাবে বললাম, এতে কি আপনার খুশী হওয়া উচিত নয়?
এমন সময় অর্গিস বরফের উপর বসানো মদের বোতল ট্রেতে করে নিয়ে এল। এক গ্লাস ভর্তি করে আমার হাতে ও আরেকটা মিস শেলীর হাতে তুলে দিল। আমি এক চুমুক খেয়ে বললাম–অনেকটা ভাল। এবার আমি মিস শেলীর কাছে জানতে চাইলাম মিঃ হোরের সঙ্গে কি কথা হয়েছিল।
তখন আমার মেজাজটা ভাল ছিল না, পরে দেখা করতে বলেছি।
–ভালই করেছেন, আপনার ভাড়াটেদের কাছ থেকে বাড়তি পনের পার্সেন্ট ভাড়া আদায় করবার ক্ষেত্রে সে একজন যোগ্য ব্যক্তি। আর তার রাশ টেনে রাখবার জন্য আমার প্রয়োজন।
মিস শেলী আমার কথা শুনে মুগ্ধ হল। বলল–আপনি যে আমার পাশে পাশে আছেন, এটা ভেবেই আমি আনন্দিত। এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
বললাম–আমি যে আপনার মঙ্গলাকাঙ্খী তার প্রমাণ কি আপনি পান নি?
মিস শেলী খুশির উচ্ছ্বাসে ঐ দিন রাত্রে তার সঙ্গে ডিনার খাবার আমন্ত্রণ জানাল।
আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম–আজ রাতে যে পার্কসাইড স্টেডিয়ামে লড়াই দেখতে যাব। আপনার কথা না রাখতে পারার জন্য দুঃখিত।
মিস শেলীর লড়াই দেখতে খুব ভাল লাগে জানিয়ে আমার সঙ্গে যাবার আবদার করল।
আমি এরকমই কিছু চাইছিলাম। মিস শেলীর পাশে পাশে হাঁটা, একসঙ্গে ডিনার খাওয়াতে সমাজে আমার দর হুহু করে বেড়ে যাবে। আমি ভেবে নিলাম–আজকে যে সুন্দরী মেয়েটিকে আসতে বলেছি তাকে ফুটিয়ে দেব।
মিস শেলীকে ঠিক সাতটার সময় নিতে আসব বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।