রূপেশ্বর নিউ মডেল হাইস্কুলের সায়েন্স টিচার হচ্ছেন অমর বাবু। (অমর নাথ পাল, বি. এসসি. (অনার্স, গোল্ড মেডেল)।
খুব সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক। স্কুলের স্যারদের আসল নামের বাইরে একটা নকল নাম থাকে। ছাত্র মহলে সেই নামেই তারা পরিচিত হন। অমর বাবু স্কুলে ঘড়ি স্যার নামে পরিচিত। তাঁর বুক পকেটে একটা গোল ঘড়ি আছে। ক্লাসে ঢােকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ামাত্র আবার ঘড়ি বের করে সময় দেখেন। তখন যদি তার ভুরু কুঁচকে যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘণ্টা ঠিকমতো পড়েনি। দুএক মিনিট এদিক-ওদিক হয়েছে।
তার ক্লাসে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। আসা যাবে না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোচা দেয়া চলবে না। খাতায় কাটাকুটি খেলা চলবে না। মনের ভুলেও যদি কেউ হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব চোখে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলবেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেই। সায়েন্স পড়াবার সময় তুমি হেসেছ, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। মহা অন্যায় করেছ। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার পর বাড়ি যাবে না। পাটিগণিতের সাত প্ৰশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
অপরাধী শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার লাঞ্ছনা দেখে অন্য কেউ হয়তো ফিক করে হেসে ফেলল। অমর স্যার থমথমে গলায় বলবেন, ওকি, তুমি হাসছ কেন? হাস্যকর কিছু কি বলেছি? তুমি উঠে দাড়াও। অকারণে হাসার জন্য শাস্তি হিসেবে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে।
অমর বাবু পকেট থেকে ঘড়ি বের করবেন। পাঁচ মিনিট তিনি এক দৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইবেন। ছাত্ররা মূর্তির মতো বসে থাকবে।
অমর বাবুর বয়স পঞ্চাশ। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে—এই নিয়ে তাঁর সংসার। দুটি ছেলেই বড় হয়েছে রূপেশ্বর বাজারে একজনের কাপড়ের ব্যবসা, অন্যজনের ফার্মেসি আছে। ভালো টাকা রোজগার করে। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য মেয়েটির বিয়ের কথা হচ্ছে। এদের কারোর সঙ্গেই তাঁর বনে না। স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের তিনি সহ্য করতে পারেন না। অনেক দিন হল বাড়িতেও থাকেন না। স্কুলের দোতলায় একটা খালি ঘরে বাস করেন। সেখানে বিছানা বালিশ আছে। একটা স্টোভ আছে। গভীর রাতে স্টোভে চা বানিয়ে খান।
রূপেশ্বর স্কুলের হেড স্যার তাকে বলেছিলেন, আপনার ঘর-সংসার থাকতে আপনি স্কুলে থাকেন, এটা কেমন কথা?
অমর বাবু গম্ভীর গলায় বললেন, রাত জেগে পড়াশোনা করি, একা থাকতেই ভালো লাগে। তাছাড়া ওদের সঙ্গে আমার বনে না। তবে স্কুলে রাত্রি যাপন করে যদি আপনাদের অসুবিধার কারণ ঘটিয়ে থাকি তাহলে আমাকে সরাসরি বলুন, আমি ভিন্ন ব্যবস্থা দেখি।
হেড স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আরে না এই কথা হচ্ছে না। আপনার যেখানে ভালো লাগবে আপনি সেখানে থাকবেন।
তিনি অমর বাবুকে ঘাটালেন না। কারণ অমর বাবু অসম্ভব ভালো শিক্ষক। অঙ্কের ডুবোজাহাজ। ডুবোজাহাজ বলার অর্থ তাঁকে দেখে মনে হয় না তিনি অঙ্ক জানেন। ভাবুক ভাবুক ভাব আছে। ক্লাসে কোনো অঙ্ক তাকে করতে দিলে এমন ভাব করেন যেন অঙ্কটা মাথাতেই ঢুকছে না। তারপর পকেট থেকে গোল ঘড়ি বের করে ঘড়ির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, চোখ বন্ধ করে মুখে মুখে অঙ্কটা করে দেন। স্কুলের অনেক ছাত্রের ধারণা এই ঘড়িতে রহস্য আছে। ঘড়ি অঙ্ক করে দেয়। ব্যাপার তা নয়। তাঁর ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটায় গণ্ডগোল আছে। কখনো দ্রুত যায় কখনো আস্তে তবে গড়ে সমান থাকে। এইটাই তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা করেন।
অমর বাবুকে ভালো মানুষ বলা যেতে পারে তবে তিনি অমিশুক, কথাবার্তা প্রায় বলেন না বললেই নয়। কারোর সাতে-পাঁচেও থাকেন না। টিচার্স কমন রুমে জানালার পাশের চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকেন। ঘন্টা পড়লে ক্লাসে রওনা হন। স্কুলের আরবি শিক্ষক মৌলানা ইদরিস আলী তাঁকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা-তামাশা করার চেষ্টা করেন। বিশেষ লাভ হয় না। তিনি ঠাট্টাতামাশা পছন্দ করেন না। কেউ ঠাট্টা করলে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকেন।
আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল। আগামীকাল ছুটি। ছাত্র-শিক্ষক সবার মধ্যেই একটা ছুটি-ছুটি ভাব চলে এসেছে। থার্ড পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। তিনি জানালার কাছের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ইরিস সাহেব তাঁর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তারপর অমর বাবু, আপনার সায়েন্সের কি খবর?
অমর বাবু কিছু বললেন না তবে চোখ তুলে তাকালেন। মনে মনে রসিকতার জন্য প্রস্তুত হলেন। বিজ্ঞান নিয়ে এই লোকটি কঠিন রসিকতা করে যা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।
ইরিস সাহেব পানের কৌটা থেকে পান বের করতে করতে বললেন, অনেকদিন থেকে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে। রোজই ভাবি আপনাকে জিজ্ঞেস করব।
জিজ্ঞেস করলেই পারেন।
ভরসা হয় না। আপনি তো আবার প্রশ্ন করলে রেগে যান।
বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা করলে রাগি। এমনিতে রাগি না—আপনার প্রশ্নটা কি?
ইদরিস সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, পৃথিবী যে ঘুরছে এই নিয়ে প্রশ্ন। পৃথিবী তো ঘুরছে, তাই না?
জি। পৃথিবীর দুরকম গতি-নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে, আবার সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।
বাঁই বাঁই করে ঘুরছে?
জ্বি?
তাই যদি হয় তাহলে আমাদের মাথা কেন ঘুরে না? মাথা ঘোরা উচিত ছিল না? এমনিতে তো মাঠে দুটো চক্কর দিলে মাথা ঘুরতে থাকে। ওকি, এরকম করে তাকাচ্ছেন কেন? রাগ করছেন না-কি?
বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা আমি পছন্দ করি না।
রসিকতা কি করলাম?
অমর বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ঘন্টা পড়বার আগেই ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই তার নিয়ম। পৃথিবী কোনো কারণে হঠাৎ উল্টে গেলেও নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না।
আজ পড়ার বিষয়বস্তু হল আলো। আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ। বড় চমকার বিষয়। আলো হচ্ছে একই সঙ্গে তরঙ্গ ও বস্তু। কী অসাধারণ ব্যাপার। ক্লাস টেনের ছেলেগুলি অবশ্যি এসব বুঝবে না। তবে বড় হয়ে যখন পড়বে তখন চমৎকৃত হবে।
অমর বাবু ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আলোর গতিবেগ কতকে বলতে পার? সাতজন ছেলে হাত তুলল। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল সবাই হাত তুলবে। ছেলেগুলি কি সায়েন্সে মজা পাচ্ছে না? তা কি করে হয়?
পৃথিবীতে মজার বিষয় তো একটাই। সায়েন্স।
তুমি বল, আলোর গতিবেগ কত?
প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।
ভেরি গুড। এখন তুমি বল, আলোর গতি কি এর চেয়ে বেশি হতে পারে?
জ্বিনা স্যার।
কেন পারে না।
এটাই স্যার নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম।
ভেরি গুড। ভেরি ভেরি গুড। প্রকৃতির কিছু নিয়ম আছে যে নিয়মের কখনো ব্যতিক্রম হবে না। হতে পারে না। যেমন মাধ্যাকর্ষণ। একটা আম যদি গাছ থেকে। পড়ে তাহলে তা মাটিতেই পড়বে, আকাশে উড়ে যাবে না। ইজ ইট ক্লিয়ার?
জি-স্যার।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জনক কে?
নিউটন।
নামটা তুমি এইভাবে বললে যেন নিউটন হলেন একজন রাম-শ্যাম, যদুমধু, রহিম-করিম। নাম উচ্চারণে কোনো শ্ৰদ্ধা নাই—বল মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।
ছাত্রটা কাঁচুমাচু মুখে বলল, মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।
একজন অত্যন্ত শ্ৰদ্ধেয় বিজ্ঞানীর নাম অশ্রদ্ধার সঙ্গে বলার জন্যে তোমার শাস্তি হবে। ক্লাস শেষ হলে বাড়ি যাবে না, পাটিগণিতের বার নম্বর প্রশ্নমালার একুশ আর বাইশ এই দুটি অঙ্ক করে তারপর যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
ছেলেটির মুখ আরো শুকিয়ে গেল।
অমর বাবুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ছেলেগুলি তাঁর মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞান অবহেলা করছে। অশ্রদ্ধার সঙ্গে পড়ছে। খুবই দুঃখের কথা।
সন্ধ্যার পর তিনি স্কুল লাইব্রেরিতে খানিকক্ষণ পড়াশোনা করলেন। বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনকথা। মনের অশান্ত ভাব একটু কমল। তিনি স্কুলের দোতলায় নিজের ঘরে ফিরে এলেন। তাঁর ছোট ছেলে রতন টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছে। মুখ কাচুমাচু করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বাবাকে স্কুলের ছাত্রদের চেয়েও বেশি ভয় করে।
রতন কিছু বলবি?
মা বলছিলেন, অনেকদিন আপনি বাড়িতে যান না।
তাতে অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না।
মার শরীরটা ভালো না। জ্বর।
ডাক্তার ডেকে নিয়ে যা। আমাকে বলছিস কেন? আমি কি ডাক্তার।
রতন মাথা নিচু করে চলে গেল। অমর বাবুর মনে হল আরেকটু ভালো ব্যবহার করলেই হত। এতটা কঠিন হবার প্রয়োজন ছিল না। কঠিন না হয়েই বা কি করবেন—গাধা ছেলে-মেট্রিকটা তিনবারেও পাস করতে পারেনি। জগতের আনন্দময় বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি কিছুই জানল না—আলো কি সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আলো কি জিজ্ঞেস করলে নিৰ্ঘাৎ বলবে—এক ধরনের তরকারি, ভর্তা করেও খাওয়া যায়। ছিঃ ছিঃ।
ঘড়ি ধরে ঠিক নটায় তিনি রাতের খাবার শেষ করলেন। খাওয়া শেষ করতেই কেঁপে বৃষ্টি নামল। খোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া আসতে লাগল। মেঘ ডাকতে লাগল। অমর বাবু দরজা-জানালা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলেন। তাঁর ঘুমুতে যাবার সময় বাধা আছে রাত দশটা কুড়ি। এখনো অনেক বাকি আছে। এই সময়টা তিনি চুপচাপ বসে নানা বিষয় ভাবেন। ভাবতে ভালো লাগে। আগে পড়াশোনা করতেন। এখন চোখের কারণে হারিকেনের আলোয় বেশিক্ষণ পড়তে পারেন না। মাথায় যন্ত্রণা হয়। ঢাকায় গিয়ে ভালো ডাক্তার দিয়ে চোখ দেখানো দরকার।
তিনি বিছানায় পা তুলে উঠে বসলেন। শীত-শীত লাগছিল, গায়ে একটা চাদর জড়াবেন কি-না যখন ভাবছেন তখন হঠাৎ শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি খানিকটা নড়ে উঠলেন। আর তখন অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার হল—তিনি লক্ষ করলেন বিছানা ছেড়ে তিনি উপরে উঠে যাচ্ছেন। প্রায় হাত তিনেক উঠে গেলেন এবং সেখানেই স্থির হয়ে গেলেন। চোখের ভুল? অবশ্যই চোখের ভুল। মহাবিজ্ঞানী নিউটনের সূত্র অনুযায়ী এটা হতে পারে না। হতে পারে না। হতে পারে না। নিতান্তই অসম্ভব। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠা যেমন অসম্ভব, এটাও তেমনি অসম্ভব। এ হতেই পারে না।
কিন্তু হয়েছে। তিনি খাট থেকে তিন হাত উপরে স্থির হয়ে আছেন। ঘরের সবকিছু আগের মতো আছে, শুধু তিনি শূন্যে ভাসছেন। অমর বাবু চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললেন, হে ঈশ্বর, দয়া কর। দয়া কর। শরীরে কেমন যেন অনুভূতি হল। হয়তো এবার নিচে নেমেছেন। তিনি চোখ খুললেন, না আগের জায়গাতেই আছেন। এটা কি করে হয়?
প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ধপ করে নিচে পড়লেন। খানিকটা ব্যথাও পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে দিলেন। কি ঘটেছে তা নিয়ে তিনি আর ভাবতে চান না। ঘুমুতে চান। ঘুম ভেঙে যাবার পর হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
রাতে তাঁর ভালো ঘুম হল। শেষ রাতের দিকে তিনি একবার জেগে উঠে বাথরুমে যান। আজ তাও গেলেন না, এক ঘুমে রাত পার করে দিলেন। যখন ঘুম ভাঙল—তখন চারদিকে দিনের কড়া আলো, রোদ উঠে গেছে। তাঁর দীর্ঘ জীবনে এই প্রথম সূর্য উঠার পর ঘুম ভাঙল। রাতে কি ঘটেছিল তা মনে করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দুঃস্বপ্ন। বদহজম হয়েছিল। বদহজমের কারণে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এরকম হয়। মানুষ খুব ক্লান্ত থাকলে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখেছেন। দীর্ঘ স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল হয় খুব কম। হয়তো এক সেকেন্ডের একটা স্বপ্ন দেখেছেন। এই হবে-এছাড়া আর কি? স্বপ্ন, অবশ্যই স্বপ্ন। অমর বাবুর মন একটু হালকা হল।
পরের দিনের কথা। প্রথম পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। টিচার্স কমন রুমে চুপচাপ বসে আছেন। ইরিস সাহেব যথারীতি তার পাশে এসে বসলেন। পানের কৌটা বের করতে করতে বললেন, অমর বাবুর শরীর খারাপ না-কি?
জ্বি-না।
দেখে কেমন কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে অসুস্থ। গায়ে কি জ্বর আছে?
জ্বি-না।
রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?
হুঁ, তবে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
কী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?
অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, দেখলাম শূন্যে ভাসছি।
আরে ভাই এটা কি দুঃস্বপ্ন? শূন্যে ভাসা, আকাশে উড়ে যাওয়া—এইসব স্বপ্ন তো আমি রোজই দেখি। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি অনেক উঁচু থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেছি…খুব টেনশানের স্বপ্ন।
অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, ঠিক স্বপ্ন না, মনে হয় জাগ্রত অবস্থায় দেখেছি।
কী বললেন? জাগ্রত অবস্থায়? জেগে জেগে দেখলেন আপনি শূন্যে ভাসছেন?
জ্বি।
জাগ্রত অবস্থায় দেখলেন শূন্যে ভাসছেন?
অমর বাবু জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। ইদরিস সাহেব বললেন, রাত-দিন সায়েন্স সায়েন্স করে আপনার মাথা ইয়ে হয়ে গেছে। বিশ্রাম দরকার। আপনি এক কাজ করুন ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। আজ ক্লাস নেয়ার দরকার নেই। আমি হেড স্যারকে বলে আসি?
না না, আমার শরীর ঠিকই আছে।
অমর বাবু যথারীতি ক্লাসে গেলেন। তাঁর পড়াবার কথা আলোর ধর্ম। তিনি শুরু করলেন মাধ্যাকর্ষণ।
দুটি বস্তু আছে। একটির ভর m1 অন্যটির ভর m2, তাদের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে r তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণ হবে–
mlm2 / r²
এটি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। স্যার আইজাক নিউটনের বিখ্যাত সূত্র। এর কোনো নড়াচড় হবে না। হতে পারে না। বাবারা বুঝতে পারছ?
ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। আজ পড়াবার কথা আলোর ধর্ম, প্রতিফলন, প্রতিসরণ; স্যার মাধ্যাকর্ষণ পড়াচ্ছেন কেন?
বাবারা কি বলছি বুঝতে পারছ?
ছাত্ররা জবাব দিল না।
যদি কেউ বুঝতে না পার হাত তোল।
কেউ হাত তুলল না। এক সময় ঘণ্টা পড়ে গেল। কোনোদিনও যা হয় না। তাই হল। অমর বাবু ঘণ্টা পড়ার পরেও চুপচাপ বসে রইলেন। পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন না বা উঠে গেলেন না। চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো বসে রইলেন। ছাত্রদের বিস্ময়ের কোনো সীমা রইল না।