সামবেদ সংহিতা
সামবেদ সংহিতার তিনটি প্রধান পাঠভেদ রয়েছে–জৈমিনীয়, রাণায়নীয় এবং কৌথুম। শেষোক্ত পাঠটি গুজরাট ও বাংলায় প্রচলিত ছিল; রাণায়নীয় শাখা, বিশেষত তাদের কল্পসূক্তগুলি, প্রধানত মহারাষ্ট্রে পরিচিত ছিল–অবশ্য এই শাখা কৌথুম শাখার সংহিতা ও ব্রাহ্মণগুলি ব্যবহার করে থাকে। জৈমিনীয় শাখার সমস্ত ভাগই সম্পূর্ণত কর্ণাটকে প্রচলিত।
সামবেদের ছ’টি মূল পাঠ রয়েছে :
- সামবেদ
- আর্চিক
- গ্রাম (গেয়) গান
- অরণ্য (গেয়) গান
- উত্তরাচ্চিক
- ঊহগান
- ঊহ্যগান
- আর্চিক
মূল পাঠের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বৈদিক সাহিত্যে সামবেদের তাৎপর্য সবচেয়ে গৌণ। মোট ১৮১০ টি মন্ত্রের মধ্যে (পুনরাবৃত্তিগুলি গ্রহণ না করলে ১৫৪৯) ১৭৩৫টি মন্ত্র (বা ১৪৭৪) প্রধানত ঋগ্বেদের অষ্টম ও নবম মণ্ডল থেকে অবিকৃত পাঠে সরাসরি নেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৭৫টি মন্ত্রের অধিকাংশ পঙ্ক্তিই যজুর্বেদ বা অথর্ববেদ থেকে অংশত গৃহীত হয়েছে; যজ্ঞানুষ্ঠানবিষয়ক পুস্তক বা লুপ্ত শাখা থেকে কিছু কিছু পঙক্তি নেওয়া হয়েছে। এগুলিকে কৃত্রিমভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে অর্থহীন বিশৃঙ্খল পঙক্তি বিন্যাসে পরিণত করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু মন্ত্র প্রত্যক্ষভাবে ঋগ্বেদ থেকে গ্রহণ করা হলেও সামবেদে তাদের পাঠ ভিন্ন। সংহিতা পাঠের এই পরিবর্তন সম্ভবত পুরোহিতদের ইচ্ছাকৃত পুনর্বিন্যাসের ফলেই হয়েছিল; এই পাঠ প্ৰাচীনতর বলেই ঋগ্বেদের প্রচলিত পাঠ অপেক্ষা বহু পূৰ্ববতী। আবার কোনো সমালোচকের মতে সামবেদ সংহিতা। ঋগ্বেদের পরে সংকলিত হয়েছিল ব’লেই তাতে ভাষাগত বিকাশের পরবর্তী স্তরটি প্রতিফলিত হয়েছে। সামবেদেব পুরোহিত উদগীতা, যজ্ঞে গায়ক ছিলেন ব’লেই সাংগীতিক বা সুরবিন্যাসের প্রয়োজনে মূলপাঠে পরিবর্তন করতে হয়েছিল; অবশ্য কোনো কোনো গবেষকের মতে এই জাতীয় পরিবর্তনে কোনো পারম্পর্য রক্ষিত হয় নি।
সামবেদের পুরোহিতের সহায়ক গ্ৰন্থরূপেই এই নূতন পাঠ সংকলনটি প্রস্তুত হয়েছিল; নবীন গায়কদের প্রশিক্ষণের জন্য এবং সেই সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানে সংগীতের প্রয়োজনে এই পাঠ আদর্শ রূপে গণ্য হত। সামবেদ সংহিতা আর্চিক (বা পূর্বাচিক) এবং উত্তরাার্চিক নামে দুটি ভাগে বিন্যস্ত। আর্চিক অংশে ১৮৫৩টি মন্ত্র রয়েছে যার মধ্যে প্রত্যেকটি প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক সুরে গীত হতে পারত। এই সংকলন ছ’টি প্ৰপাঠকে বিভক্ত (অথবা বারোটি অর্ধ বা অর্ধ-প্ৰপাঠকে)। মোটামুটিভাবে প্ৰপাঠকগুলি আবার ৫৯টি দশৎ-এ বিভক্ত। এদের সঙ্গে আরও দশটি অতিরিক্ত একটি দশৎ সংযোজিত হয়েছে। অন্যদিকে উত্তরার্চিকে সংকলনের চারশটি সূক্তে ১২২৫টি মন্ত্র ৯টি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত; এগুলিও আবার ২টি (ভিন্ন একটি গণনায় ৩টি) দশৎ-এ উপবিভক্ত–প্রতিটি ক্ষেত্রে ঋগ্বেদের মন্ত্র সামবেদের স্বরন্যাস অনুযায়ী পরিকল্পিত। পূর্বার্চিকের শ্লোক সংখ্যা ৫৮৫।
আর্চিক সংকলন ভাবী উদগাতা শ্রেণীর গায়ক বা তার কোনো সহায়কের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে প্ৰস্তুত হয়েছিল ব’লে প্রত্যেকটি সূক্তের প্রথম অংশ সুর-সৃষ্টিতে স্মৃতির অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত–উত্তরার্চিকে সংকলিত মন্ত্রসমূহ। কিন্তু স্তোত্ররূপে বিন্যস্ত। মাত্র ৩১টি মন্ত্র ছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত মন্ত্রই ঋগ্বেদে খুঁজে পাওয়া যায়, অর্থাৎ প্রধান শ্ৰীেত যজ্ঞসমূহে যে ক্রম অনুযায়ী সেগুলি গীত হ’ত তা উত্তরার্চিকেই রক্ষিত হয়েছে। মন্ত্রসমূহে প্ৰযুক্ত সুরের কাঠামো ইতোমধ্যে সর্বজনপরিচিত হয়ে গিয়েছিল, এই পূর্বসিদ্ধান্ত থেকেই যেন উত্তরাৰ্চিক যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির পক্ষে প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ সূক্ত সংগ্ৰহরাপে গড়ে উঠেছে। সুতরাং আর্চিক অংশে যেখানে প্রশিক্ষার্থীদের সংগীত বিষয়ে পাঠ দেওয়া হত, উত্তরার্চিক সেই সমস্ত গানের ব্যবহারিক ও যজ্ঞানুষ্ঠানে সহায়ক গ্ৰন্থরূপে সংকলিত ও বিন্যস্ত হয়েছিল। আনুষ্ঠানিক প্রয়োজন অনুযায়ী উত্তরাৰ্চিকের মন্ত্রগুলি বিন্যস্ত। পূর্বাচিকে প্রথম পর্যায়ে তুচগুলি উপস্থাপিত হয়েছে। পূর্বাচিক এবং অরণ্যসংহিতা একত্রে দ্বিবিধগান অর্থাৎ গ্রাম-গেয় এবং অরণ্য-গেয় গানের মূল পাঠ নির্মাণ করেছে; তবে যে গানটি একবার গ্রাম-গেয় গানে উল্লিখিত হয়েছে, তা অরণ্য-গেয় গানে নতুন সুরে গীত হলেও অরণ্য সংহিতায় দ্বিতীয়বার আর বিধৃত হয় নি।
যজ্ঞানুষ্ঠানসমূহ জটিলতর ও দীর্ঘািয়ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্ৰায়োগিক সমস্যাগুলিও বহুগুণ বর্ধিত হয়েছিল; ঐতিহাকে বিশ্বস্তভাবে পরিস্ফুট করার প্রয়োজনে শিক্ষানবীশদের স্পষ্ট প্রশিক্ষণ অনিবাৰ্য হয়ে পড়েছিল। ফলে দুটি আর্চিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারটি গীতিসংকলন তৈরি হল : (১) (গ্রাম) গেয় গান বা প্ৰকৃতি গান (২) অরণ্য (গোয়) গান (৩) ঊহগান এবং (৪) ঊহ্যগান। এদের মধ্যে প্ৰথম দুটি যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সংকলিত গান পূর্বাচিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সাধারণভাবে সোমযাগেই ব্যবহৃত। গ্রামে গুরুগৃহে প্রকাশ্যে যা শেখা যায়, তারই নাম দেওয়া হয়েছে গ্ৰাম গেয় গান, অন্যদিকে অরণ্যের নির্জনতায় যা শেখানো হয়, তাকেই বলে অরণ্য গেয় গান। গ্রামগীতির কিছু কিছু পাঠ ভিন্ন সুরে অরণ্যগীতিতেও পরিবেশিত হয়ে থাকে; কিন্তু নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানবিষয়ক গীতি-সংকলন যে অরণ্য সংহিতা তাতে সে সব পাওয়া যায় না। গ্রামগীতি ও অরণ্যগীতি একত্রে পূর্বগানরূপে পরিচিত। উত্তরার্চিকটি ঊহগান ও ঊহ্যগানের সমন্বয়ে গঠিত। এদের মধ্যে ঊহ্যগান স্পষ্টতই অগ্নিক্টোম অনুষ্ঠান সম্পর্কে সুপরিকল্পিত প্ৰশিক্ষণ-দানের উদ্দেশে রচিত হয়েছিল; উদ্গাতার ব্যহত প্ৰধান গানগুলি এতে পাওয়া যায়-সাধারণত প্রস্তোতা ও প্রতিহর্তা শ্রেণীর পুরোহিতরা এতে উদ্গাতার সহায়ক হয়ে থাকেন। আর্যেয়কল্প গ্রন্থে অগ্নিষ্টোমে ব্যবহৃত ঊহ ও ঊহ্যগান সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ আছে। পূর্বার্চিকে প্ৰযুক্ত উত্তরাৰ্চিকের প্রতিটি ঋক “যোনি” অর্থাৎ উৎস বলে পরিচিত ছিল, কেননা তখনকার যুগে এই বিশ্বাস ছিল যে শব্দ থেকেই সুরের জন্ম হয়। অতএব গানের কথাই গানের “যোনি”। প্রশিক্ষার্থীদের সহায়ক গ্ৰন্থরূপে পূর্বাচিক এই সমস্ত ‘যোনি’কে আনুষঙ্গিক সুরের সঙ্গে উপস্থাপিত করেছে। উত্তরার্চিক যেহেতু আনুষ্ঠানিক প্রয়োগের ক্রম অনুযায়ী এদের বিন্যস্ত করেছে, তাই এই সিদ্ধান্ত অনিবাৰ্য হয়ে উঠেছে যে, প্ৰাণ্ডাক্ত গানসমূহের সঙ্গে পাঠকের পূর্ব-পরিচিতি স্বতঃসিদ্ধ। তবে উত্তরার্চিকের ২৮৭টি তৃচের মধ্যে পূর্বাচিকে কেবলমাত্র ২২৬টিই পাওয়া যায়; অন্য ৬১টি না পাওয়ার কারণ এই যে, এইগুলি গায়ত্রীসুরে সন্নিবিষ্ট হয়ে প্ৰাতঃসবনে প্ৰযুক্ত হত। সম্ভবত এই প্ৰাতঃসবন ছিল মৌলিক ও সংক্ষিপ্ততম সোমন্যাগের প্রথম স্তর, অন্য দুটি সবন পরবর্তীকালে সংযুক্ত হয়। পূর্বোক্ত ২২৬টি তৃচ মাধ্যান্দিন ও সান্ধ্য সবনে ব্যবহৃত হত। অবশ্য গীতি প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বহুলাংশে অনুমাননির্ভর; বহু পরবর্তীকালের পুস্তকসমূহে প্ৰাপ্ত পরস্পরবিচ্ছিন্ন নির্দেশগুলি একত্র করেই আমরা কিছু ধারণা তৈরি করেছি।
সামবেদীয় গায়কদের প্রধান কর্তব্যই ছিল ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলিকে সংগীতের প্রয়োজনে পুনর্বিন্যস্ত করা। এই উদ্দেশ্যে তার নিম্নোক্ত ছটি পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিলেন-(১) বিকার (একক শব্দগুলির পরিবর্তিত উচ্চারণ) (২) বিশ্লেষণ (শব্দসমূহের বিভাজন।) (৩) বিকর্ষণ (কোন শব্দের বিশ্লিষ্ট অক্ষরসমূহের মধ্যে দীর্ঘায়িত স্বরবর্ণের সন্নিবেশ।) (৪) অভ্যাস (পুনরুক্তি) (৫) বিরাম (পরবর্তী শব্দের বিভাজন করে তার প্রথম অক্ষরকে পূর্ববতী শব্দসমূহের প্রথম অক্ষরের সঙ্গে সংযোগ–তবে শব্দসমূহের মধ্যে বিরাম চিহ্নদানের পূর্বে তা করণীয়।) (৬) স্তোভ (ঋগ্বেদীয় পাঠে অনুপস্থিত অক্ষরসমূহের সন্নিবেশ)। এই স্তোভগুলি কেন এবং কখন সামগানগুলির সঙ্গে সংযোজিত হয়েছিল—তা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত; কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় উৎস সুদূর অতীতে। তখন এইসব অর্থহীন অক্ষরগুলির মধ্যে উদগাতার প্রধান গান ও যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রতি সমগ্ৰ সমাজের আনন্দিত, গভীর ও উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া বা সম্মতি বা সক্রিয় অংশগ্ৰহণ পরিস্ফুট হ’ত–হয়ত বা কোনো ধরনের ঐন্দ্ৰজালিক ফললাভের প্রত্যাশাও তাতে অভিব্যক্ত হত।
অরণ্যগেয় গান ছ’টি প্ৰপাঠকে বিভক্ত। অরণ্যগেয় গানের নামকরণেই গ্রামগেয় গানের সঙ্গে তার মূলগত পার্থক্য স্পষ্ট-এই গূঢ়াৰ্থপূর্ণ সংকলন নির্জনে শিক্ষাদান ও অভ্যাস করানো হ’ত; সম্ভবত এইসব গানের রহস্যময় সম্ভাবনা ও বিপজ্জনক শক্তি আৰ্যদের কল্পনায় উদ্বোধিত হত। উত্তরটিকের সঙ্গেও ঊহগান ও ঊহ্যগান সংযোজিত হয়েছিল। উত্তরার্চিকে প্রাপ্ত ঋকবিন্যাস রীতি অনুসরণ ক’রে ঊহগান ২৩টি প্রপাঠকে বিন্যস্ত হয়েছিল; অন্যদিকে উহ্যগানে ছিল মাত্র ৬টি প্রপাঠক।
ঐতিহ্য অনুযায়ী সামবেদের ১০০০টি শাখা ছিল; সম্ভবত এতে এই প্রতীকী বক্তব্যই পরিস্ফুট হয়েছে যে, সুরসৃষ্টি করতে গিয়ে এবং পরবর্তী কালে গানের উপস্থাপনায় সংগীত রচয়িতারা ঐতিহ্যগত পাঠ ব্যবহার গীতস্রষ্টার স্বাধীনতার পরিচয় রেখেছেন। যাই হােক, আমাদের কাছে মাত্র ৩টি শাখা উপস্থিত হয়েছে–জৈমিনীয় (কেরল, তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে প্রচলিত) কৌথুম (গুজরাট প্রচলিত–বর্তমানে অবশ্য বাংলা এবং উত্তরপ্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চলেও পাওয়া যায়) ও রাণায়নীয় (মহারাষ্ট্রে প্রচলিত, বর্তমানে মথুরাতেও লভ্য)। সামবেদের ভাষ্যকারদের মধ্যে অধিক খ্যাতি অর্জন করেছেন মাধব (দ্বাদশ শতাব্দী), ভারতস্বামী (চতুর্দশ শতাব্দী) এবং শোভাকর ভট্ট (পঞ্চদশ শতাব্দী)।
সামবেদ যে ঋগ্বেদের চূড়ান্ত পর্যায়ের রচনা থেকে কোনো ঋণ গ্ৰহণ করে নি তা খুবই তাৎপৰ্যপূর্ণ। সামগানগুলি মুখ্যত দু’ধরনের; প্রথম গুচ্ছ পরিমান সোমের উদ্দেশে নিবেদিত–অন্যান্য মণ্ডল থেকে কিছু কিছু গৃহীত হলেও প্রধানত ঋগ্বেদের নবম মণ্ডল থেকেই এইগুলি সংকলিত হয়েছে। দ্বিতীয় গুচ্ছটি নিবেদিত হয়েছে। সেই সব দেবতার প্রতি যাঁরা তিনটি সবনে সোমের আহ্বতি গ্ৰহণ করেন। বস্তুত গ্ৰন্থবিচারে ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের সঙ্গে সামবেদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। আর্থিক বিশ্লেষণ করে আমরা দেখি যে কয়েকটি মাত্র বিশিষ্ট দেবতার উদ্দেশে মন্ত্রগুলি নিবেদিত; অগ্নির প্রতি ৩৫২টি (আগ্নেয় কাণ্ড), ইন্দ্রের প্রতি ১১৯টি (ঐন্দ্ৰ), পবমান সোমের প্রতি ১০টি। প্ৰজাপতি (মহানামী আর্চিক) ও অন্যান্য দেবতার প্রতি বিবিধবিষয়ক অরণ্য কাণ্ডে যে ৫৫টি মাত্র রয়েছে তাতে উদ্দিষ্ট দেবতাদের মধ্যে রয়েছেন ইন্দ্ৰ, বরুশ, পবমান সোম, বিশ্বেদেবাঃ ও অন্ন। উত্তরাটিকে যে ২১টি অধ্যায় রয়েছে, তাতে শেষতম অধ্যায় ছাড়া সর্বত্রই অগ্নি, পবিমান সোম ও ইন্দ্ৰকে আহ্বান করা হয়েছে। তাছাড়া, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ঊষা এবং অশ্বীদের পাওয়া যায়। মিত্ৰাবরুণকে পাওয়া যায় প্রথম তিনটি ও দ্বাদশ অধ্যায়ে। দশম অধ্যায়ের পর থেকে অন্যান্য দেবতাদের পাওয়া যাচ্ছে :–পবমান সোম (দশম), আদিত্য, আত্মা বা সূর্য (একাদশ), সরস্বত, সরস্বতী, সবিতা, ব্ৰহ্মণস্পতি, দ্যাবাপৃথিবী বা হবীংষি, সূর্য (ত্ৰয়োদশ), বিশ্বেদেবাঃ, অগ্নি পবমান (চতুর্দশ), ইন্দ্রাগ্নী বরুণ, বিশ্বকর্মা, পূষা, মরুৎ, ইন্দ্ৰাণী (যোড়শ), বিষ্ণু, বায়ু, ইন্দ্ৰাবায়ু (সপ্তদশ), বিষ্ণু বা দেব, ইন্দ্ৰায়ী (অষ্টাদশ), ঊষা ও অশ্বীরা (উনবিংশ), মরুদগণ, সূৰ্য বা আপঃ, বায়ুবাত (বিংশ), মরুদগণ, বৃহস্পতি, আপ্বদেবী, ইষবঃ, সংগ্ৰামাশিষঃ, ব্ৰহ্মণস্পতি ও অদিতি (একবিংশ)। সমগ্ৰ পঞ্চদশ অধ্যায়টি অগ্নির প্রতি উদ্দিষ্ট।
আহুত দেবতাদের পরিচয় অনুযায়ী সামবেদের বিষয়বস্তুকে বর্গীকরণ করে আমরা দেখি যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র সর্বােগ্রগণ্য কেননা দুটি আর্চিক মিলিয়ে তার উদ্দেশে ৩৭৫টি মন্ত্র নিবেদিত। শুরুত্ব অনুযায়ী এরপর আমরা যথাক্রমে পবমান সোম (১৪০), অগ্নি (১৩৪), প্ৰজাপতি (১০) ও মিত্রাবরুণ (৬) এর নাম করতে পারি। বৈদিক দেবগোষ্ঠীর মধ্যে ইন্দ্রের সর্বাধিক গুরুত্ব ছিল ব’লেই ঋগ্বেদের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি মন্ত্রে তার স্তুতি করা হয়েছে; সামবেদেও যে এই গুরুত্ব অক্ষুন্ন ছিল, তা মোটেই বিস্ময়ের ব্যাপার নয়; কেননা সামবেদ ঋগ্বেদের প্রাচীনতর অংশকেই বিশেষভাবে অনুসূরণ করেছে। দ্বিতীয়তঃ, সোমযাগের সঙ্গেই তার প্রাথমিক সম্পর্ক এবং ইন্দ্ৰ সোমপায়ীদের মধ্যে প্ৰধান। পবমান সোম এবং অগ্নি যে শুরুত্বের দিক দিয়ে ইন্দ্রের নিকটতম অনুগামী তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ যেহেতু সোমযাগে পবিমান সোম প্রধান দেবতা আর অগ্নি স্বাভাবিকভাবেই যে কোনও যজ্ঞে প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। লক্ষণীয় যে, ঋগ্বেদের কিছু কিছু প্ৰধান সে তা যেমন ঊষা, অশ্বীরা, সূর্য, পূষা ও সরস্বতী সামবেদে তাদের শুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছেন এবং অদিতি, সবিতা, ভগ, অংশ, দক্ষ অর্যামা, মার্তণ্ড, ইলা, ভারতী, পর্জন্য, রুদ্র, বাতাঃ যম ও বৃহস্পতি একেবারেই বর্জিত। আবহ-মণ্ডলের দেবতা এবং অধিকাংশ সৌরদেবতাই অনুপস্থিত। এই তথ্যটি সম্ভবত চরিত্রগতভাবে সোমযাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেহেতু সোম এবং অগ্নি—এই উভয়েই ভূস্থান বা পৃথিবীনিবাসী দেবতা। অনুমান করা যায় যে, কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুকাল পরেও একান্তভাবে পুরোহিতের পদ বংশগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তারা প্ৰাচীনতর সংক্ষিপ্ত সোমচর্যাকে বিস্তুত করে ব্যাপকতর ও জটিলতর অনুষ্ঠানের সৃষ্টি করেন। তিনটি প্রধান যজ্ঞরীতি অর্থাৎ পশু, সোম ও ইষ্টির মধ্যে শুধু সোম ও ইষ্টিযাগে সাম-গান করা হত; পশুযাগে সামগানের কোনো রীতি ছিল না। যেহেতু পশুপালক জনগোষ্ঠীর পক্ষে পশুযাগই স্বাভাবিক, মনে হয় যে, এটাই ছিল যজ্ঞের প্রাচীনতম রীতি। সেই সঙ্গে এ-ও প্রতীয়মান হয় যে সামবেদের মধ্যে যেহেতু ঋগ্বেদের দ্বিতীয় থেকে নবম মণ্ডল পর্যন্ত অংশের অস্তিত্ব প্রমাণিত, পরবর্তী দুই যজ্ঞ-রীতি যাতে সামগান গাওয়া হ’ত–তার প্রয়োজন অনুসারে সামবেদ সংকলিত হয়েছিল। ইষ্টিযাগ এরই কাছাকাছি সময়ে প্রাথমিকভাবে কৃষিজীবী জনসাধারণের নিজস্ব অনুষ্ঠান রূপে আবিষ্কৃত হয়েছিল। সোমযাগের সঙ্গে সামবেদের সম্পর্ক কিছুটা বিস্ময়কর। ইরানীয় ‘হওম’ অনুষ্ঠানের সাক্ষ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে সোমযাগের সুদীর্ঘ ইতিহাসের উৎস সুদূর অতীতে ইন্দো-ইরানীয় অধ্যায় অর্থাৎ অন্ততপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব চতুৰ্দশ শতাব্দীতে। তবে যতদিন পর্যন্ত আর্যগণ যাযাবর গোষ্ঠীজীবন যাপন করতেন। ততদিন যজ্ঞ নিশ্চয়ই অত্যন্ত সরল, অসংস্কৃত, আদিম পর্যায়েই রয়ে গিয়েছিল। খুব সম্ভবত প্রত্নভারতীয় আর্যরা এমন সমস্ত অঞ্চল অতিক্রম করছিলেন সোম যেখানে খুবই পরিচিত ও সহজলভ্য ছিল। উত্তেজক, নেশাপ্রদ ও বিভ্ৰমউৎপাদক বৈশিষ্ট্যের জন্যই সম্ভবত এই পানীয় যুদ্ধরত আর্যদের নিকট খুবই প্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই সোমের সঙ্গে যে ভীতি ও সম্ভ্রমের মনােভােব জড়িত রয়েছে, নিঃসন্দেহে এর মধ্যে নিহিত উন্মাদনা সৃষ্টির ক্ষমতাই এ জন্য দায়ী। কালক্রমে আর্যরা মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করায় সেই পার্বত্য ভূমি থেকে অনেক দূরে তারা উপস্থিত হলেন সোম যেখানে স্বাভাবিকভাবেই উৎপন্ন হত। আনুষ্ঠানিকভাবে একজন শূদ্ৰকে যজ্ঞের প্রয়োজনে সোম সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করা হত; এতে মনে হয়, দুর্লভতর ফলে সোম অতিরিক্ত মর্যাদা লাভ করেছিল। পরবর্তী কালে সোম যে ‘অতিথি’ বিশেষণটি লাভ করে তাতেও এই তথ্য প্রচ্ছন্ন যে তৎকালীন আৰ্যাবর্তে সোম স্বাভাবিকভাবে উৎপন্ন হত না। বহুদূর থেকে নিয়ে আসতে হত ব’লেই সোম ‘অতিথি’ ও ‘রাজা’ বিশেষণে ভূষিত হয়। সোমপানজনিত আনন্দের প্রেরণায় সোমযাগ ক্রমশ প্ৰলম্বিত ও জটিলতর হয়ে শেষপর্যন্ত দ্বাদশবর্ষব্যাপী সত্রে পরিণত হয়। নির্দিষ্ট কিছু কিছু পুরোহিত পরিবার সোমযাগে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন; অনুক্ৰমণী গ্ৰন্থ-সমুহের মতে কশ্যপ পরিবারভুক্ত ঋষিরা সর্বাধিকসংখ্যক সূক্ত সোমদেবের উদ্দেশে রচনা করেছিলেন। এছাড়া আমরা অঙ্গিরা (২৩টি সূক্ত), ভূণ্ড (১২) এবং কণ্ব-বংশীয় পুরোহিতদের কথাও রচয়িতার তালিকায় উল্লেখ করতে পারি। আরও অনুমান করা যায় যে কিছু কিছু পুরোহিত পরিবার বিশেষ কয়েকটি সুরে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন বলে সামগানের বিশেষ নামকরণ হয়েছে। যেমন বৃহৎ, রথন্তর, বৈরাজ, বৈরূপ, বৈখানস, প্ৰজাপতের্হৃদয়, শ্লোক, অনুশ্লোক, ভদ্র, রাজা, অর্কৎ, ইলান্দ, শ্বেত, নৌধস, রৌরব, যৌধজয়, অগ্নিষ্টোমীয়, ভাস, বিকৰ্ণ প্রভৃতি।
সামবেদের কিছু কিছু ঋষির নাম বিশেষ তাৎপৰ্যপূর্ণ : মেধাতিথি, দেবাতিথি, উপস্তুত, বৃহদুকথ, ত্রিমতি, সুক্তি, প্রগাথ, প্রিয়মেধ, নৃমেধ, প্রমেধ, সুমেধ, শোক, সশোক, ত্ৰিশোক প্রভৃতি। এই নামগুলির অধিকাংশই সোমের সঙ্গে সম্পর্কিত বুদ্ধিমত্তা, প্ৰশংসা ও প্রতিভাদীপ্ত–এই বিশেষণগুলি অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। প্রাচীনতম পরিবারিক মণ্ডলগুলির সঙ্গে সম্পূক্ত কাণ্ব, গৌতম, মধুচ্ছন্দা, বামদেব, অত্রি ও ভরদ্বাজ প্রমুখ পরিচিত ঋষিদের নাম যেমন পাওয়া যায় তেমনি কিছু কিছু নাম স্পষ্টতই আর্যবৃত্তবহির্ভূত–ইরিমিরি, ইরিঞ্চি, ইরিমি, মিরি ও রিণু। সম্ভবত কোনো কোনো ঋষি পরিবার স্বতন্ত্রভাবে সংগীত রচনায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে সেই সব গানও সামবেদে সংকলিত হয়েছিল। এঁদের রচনার ইতিহাস যাই হােক, অন্তত একটি ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে, যজ্ঞানুষ্ঠানগুলি যখন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে উঠছিল, তখন পুরোহিতদের ভিন্ন ভিন্ন কার্যকলাপের অংশগুলি বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছিল এবং তার ফলে পুরোহিতদের প্রত্যেকটি শাখাই যথোপযুক্তভাবে বিশেষজ্ঞতা অর্জনের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। প্রতিশ্যাখ্য গ্রন্থসমূহ এবং ব্যাকরণের স্বরন্যাসবিষয়ক অধ্যায়গুলি এই তথ্য জানায় যে হােতা ও তার তিন সহকারী পুরোহিত স্বরবিন্যস্ত আবৃত্তির পদ্ধতি যত্নের সঙ্গে শিক্ষা গ্ৰহণ করে। পরবর্তী প্রজন্মকেও একই ভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন। অনুরূপভাবে উদগাতা এবং তার তিন সহগায়ক–প্রস্তোতা, প্রতিহর্তা এবং সুব্রহ্মাণ্য–আনুষ্ঠানিক সংগীতের ঐতিহ্য নির্মান করে তাকে সতর্কভাবে লালন করতেন। শুধু শিল্পকলার প্রয়োজনেই যত্ন ও দক্ষতা প্ৰদৰ্শিত হয় নি; জীবিকার প্রয়োজনে পৃষ্ঠপোষকদের প্রশংসা অর্জনের জনাও গায়কগণ পরস্পরের মধ্যে চারুতা ও দক্ষতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। যেহেতু কিছু কিছু প্ৰধান ঋগ্বেদীয় দেবতার শুরুত্ব খর্ব হয়েছিল এবং কেউ কেউ সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গিয়েছিলেন—বিষয়বস্তুরূপে দেবতাদের পূর্বগুরুত্ব আর বজায় ছিল না; তার পরিবর্তে গায়ক পরিবারগুলি দ্বারা আবিষ্কৃত, অভ্যন্ত, পরিশীলিত, পরিবর্ধিত, বিশেষীকৃত এবং পরবর্তী প্ৰজন্মগুলিতে সঞ্চারিত রীতিমূৰ্ছনার গ্রহণ ও বর্জনই মুখ্য গুরুত্ব লাভ করল।