সন্ন্যাসীর গীতি১
উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,
হিমাদ্রিশিখরে উঠিল যে গান—
গভীর অরণ্যে পর্বত-প্রদেশে
সংসারের তাপ যথা নাহি পশে,
যে সঙ্গীত-ধ্বনি-প্রশান্ত-লহরী
সংসারের রোল উঠে ভেদ করি;
কাঞ্চন কি কাম কিম্বা যশ-আশ
যাইতে না পারে কভু যার পাশ;
যথা সত্য-জ্ঞান-আনন্দ-ত্রিবেণী
—সাধু যায় স্নান করে ধন্য মানি,
উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,
গাও গাও গাও, গাও সেই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১
ভেঙে ফেল শীঘ্র চরণ-শৃঙ্খল—
সোনার নির্মিত হলে কি দুর্বল,
হে ধীমান্, তারা তোমার বন্ধনে?
ভাঙ শীঘ্র তাই ভাঙ প্রাণপণে।
ভালবাসা-ঘৃণা, ভাল-মন্দ-দ্বন্দ্ব,
ত্যজহ উভয়ে, উভয়েই মন্দ।
আদর’ দাসেরে, কশাঘাত কর,
দাসত্ব-তিলক ভালের উপর;
স্বাধীনতা-বস্তু কখনও জানে না,
স্বাধীন আনন্দ কভু তো বুঝে না।
তাই বলি, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
দূর কর দুয়ে অতীব সত্বর;
কর কর গান, কর নিরন্তর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ২
যাক অন্ধকার, যাক সেই তমঃ,
আলেয়ার মত বুদ্ধির বিভ্রম
ঘটায়ে আঁধার হইতে আঁধারে
লয়ে যায় এই ভ্রান্ত জীবাত্মারে।
জীবনের এই তৃষা চিরতরে
মিটাও জ্ঞানের বারি পান করে।
এই তম-রজ্জু জীবাত্মা-পশুরে
জন্মমৃত্যু-মাঝে আকর্ষণ করে।
সে-ই সব জিনে—নিজে জিনে যেই,
ফাঁদে পা দিও না—জেনে তত্ত্ব এই।
বলহ সন্ন্যাসি, বল বীর্যবান্—
করহ আনন্দে কর এই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৩
‘কৃত কর্মফল ভুঞ্জিতে হইবে’
বলে লোকে, ‘হেতু কার্য প্রসবিবে,
শুভ কর্মে—শুভ, মন্দে—মন্দ ফল,
এ নিয়ম রোধে নাহি কারও বল।
এ মর-জগতে সাকার যে জন,
শৃঙ্খল তাহার অঙ্গের ভূষণ।’
সত্য সব, কিন্তু নামরূপ-পারে
নিত্যমুক্ত আত্মা আনন্দে বিহরে।
জান ‘তত্ত্বমসি’, করো না ভাবনা‚
করহ সন্ন্যাসি, সদাই ঘোষণা—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৪
সত্য কিবা তারা জানে না কখনও,
সবাই যাহারা দেখয়ে স্বপন—
পিতা মাতা জায়া অপত্য বান্ধব—
আত্মা তো কখনও নহে এই সব;
নাহি তাহে কোন লিঙ্গালিঙ্গভেদ,
নাহিক জনম, নাহি খেদাখেদ।
কার পিতা তবে, কাহার সন্তান?
কার বন্ধু শত্রু কাহার ধীমান?
একমাত্র যেবা—যেবা সর্বময়,
যাহা বিনা কোন অস্তিত্বই নয়,
‘তত্ত্বমসি’ ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
উচ্চরবে তাই এই তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৫
একমাত্র মুক্ত জ্ঞাতা আত্মা হয়,
অনাম অরূপ অক্লেদ নিশ্চয়;
তাঁহার আশ্রয়ে এ মোহিনী মায়া
দেখিছে এ সব স্বপনের ছায়া;
সাক্ষীর স্বরূপ—সদাই বিদিত,
প্রকৃতি-জীবাত্মারূপে প্রকাশিত;
‘তত্ত্বমসি’ ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
ধর ধর ধর, উচ্চ তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৬
অন্বেষিছ মুক্তি কোথা বন্ধুবর?
পাবে না তো হেথা, কিম্বা এর পর;
শাস্ত্রে বা মন্দিরে বৃথা অন্বেষণ;
নিজ হস্তে রজ্জু—যাহে আকর্ষণ।
ত্যজ অতএব বৃথা শোকরাশি,
ছেড়ে দাও রজ্জু, বল হে সন্ন্যাসি—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৭
দাও দাও দাও সবারে অভয়,
বল—‘প্রাণিজাত, করো নাকো ভয়;
ত্রিদিব পাতাল থাক যে যেখান,
সকলের আত্মা আমি বিদ্যমান;
স্বরগ নরক, ইহামুত্রফল
আশা ভয় আমি ত্যজিনু সকল।’
এইরূপে কাটো মায়ার বন্ধন,
গাও গাও গাও করে প্রাণপণ—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৮
ভেবো না দেহের হয় কিবা গতি,
থাকে কিম্বা যায়—অনন্ত নিয়তি;
কার্য অবশেষ হয়েছে উহার,
এবে ওতে প্রারব্ধের অধিকার;
কেহ বা উহারে মালা পরাইবে,
কেহ বা উহারে পদ প্রহারিবে;
চিত্তের প্রশান্তি ভেঙো না কখনও,
সদাই আনন্দে রহিবে মগন;
কোথা অপযশ—কোথা বা সুখ্যাতি?
স্তাবক-স্তাব্যে একত্ব-প্রতীতি,
অথবা নিন্দুক-নিন্দ্যের যেমতি।
জানি এ একত্ব আনন্দ-অন্তরে,
গাও হে সন্ন্যাসি, নির্ভীক অন্তরে—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৯
পশিতে পারে না কভু তথা সত্য,
কাম-লোভ-বশে যেই হৃদি মত্ত;
কামিনীতে করে স্ত্রীবুদ্ধি যে জন,
হয় না তাহার বন্ধন-মোচন;
কিম্বা কিছু দ্রব্যে যার অধিকার,
হউক সামান্য—বন্ধন অপার;
ক্রোধের শৃঙ্খল কিম্বা পায়ে যার,
হইতে না পারে কভু মায়া পার।
ত্যজ অতএব এ সব বাসনা,
আনন্দে সদাই কর হে ঘোষণা—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১০
সুখ তরে গৃহ করো না নির্মাণ,
কোন্ গৃহ তোমা ধরে, হে মহান্?
গৃহছাদ তব অনন্ত আকাশ,
শয়ন তোমার সুবিস্তৃত ঘাস;
দৈববশে প্রাপ্ত যাহা তুমি হও,
সেই খাদ্যে তুমি পরিতৃপ্ত রও;
হউক কুৎসিত, কিম্বা সুরন্ধিত,
ভুঞ্জহ সকলি হয়ে অবিকৃত।
শুদ্ধ আত্মা যেই জানে আপনারে,
কোন্ খাদ্য-পেয় অপবিত্র করে?
হও তুমি চল-স্রোতস্বতী মত,
স্বাধীন উন্মুক্ত নিত্য-প্রবাহিত।
উঠাও আনন্দে উঠাও সে তান,
গাও গাও গাও সদা এই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১১
তত্ত্বজ্ঞের সংখ্যা মুষ্টিমেয় হয়,
অ-তত্ত্বজ্ঞ তোমা হাসিবে নিশ্চয়;
হে মহান্, তোমা করিবেক ঘৃণা,
তাহাদের দিকে চেয়েও দেখো না।
স্বাধীন উন্মুক্ত—যাও স্থানে স্থানে,
অজ্ঞান হইতে উদ্ধারো অজ্ঞানে—
মায়া-আবরণে ঘোর অন্ধকারে,
নিয়তই যারা যন্ত্রণায় মরে।
বিপদের ভয় করো না গণনা,
সুখ অন্বেষণে যেন হে মেতো না;
যাও এ উভয় দ্বন্দ্ব-ভূমিপারে,
গাও গাও গাও, গাও উচ্চস্বরে—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১২
এইরূপে বন্ধো, দিন পর দিন,
করমের শক্তি হয়ে যাবে ক্ষীণ;
আত্মার বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে,
জনম তাহার আর না হইবে;
‘আমি’ বা ‘আমার’ কোথায় তখন?
ঈশ্বর—মানব—তুমি—পরিজন—
সকলেতে ‘আমি’, আমাতে সকল—
আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ কেবল।
সে আনন্দ তুমি, ওহে বন্ধুবর,
তাই হে আনন্দে ধর তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১৩