প্রজেক্ট নেবুলা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
সন্ধে থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল, হঠাৎ করে বৃষ্টিটা চেপে এল। জব্বার নিচু গলায় একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারটা আরেকটু দ্রুত করে দেয়। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ওয়াইপার দুটো গাড়ির কাচ পরিষ্কার করতে থাকে কিন্তু অন্ধকার দুর্যোগময় রাতে সেটা খুব কাজে আসে না, গাড়ির হেডলাইট মনে হয় সামনের অন্ধকারকে আরো জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার অন্যদিক থেকে দৈত্যের মতো একটা ট্রাক চোখ ধাঁধানো। হেডলাইট জ্বালিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে বিপজ্জনকভাবে পাশ কাটিয়ে গেল–পানির ঝাঁপটায় গাড়ির কাচ মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে যায়, প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা দবির কব্জির কাছে কাটা হাতটি সামনে এগিয়ে অদৃশ্য কিছু একটা ধরে ফেলার ভঙ্গি করে বিরক্ত হয়ে বলল, আস্তে, জব্বার আস্তে।
জব্বার অন্ধকারে দেখা যায় না এরকম একটা রিকশা ভ্যানকে পাশ কাটিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, ভয় পাবেন না ওস্তাদ। আমি কালা জব্বার।
দবির শীতল গলায় বলল, সেইটাই ভয়।
কেন ওস্তাদ। এইটা কেন বললেন?
বলছি কারণ তোর কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই।
জব্বার আড়চোখে দবিরের মুখটা দেখার চেষ্টা করে বোঝার চেষ্টা করল দবির এটা ঠাট্টা করে বলেছে কি না। অন্ধকারে দবিরের মুখ দেখা যাচ্ছিল না তাই সে ঠিক বুঝতে পারল না। তবুও সে কথাটাকে একটা হালকা রসিকতা হিসেবে ধরে নিয়ে প্রয়োজন থেকে জোরে শব্দ করে হেসে বলল, ওস্তাদ, আমার হাতে স্টিয়ারিং হুইল কখনো বেইমানি করে নাই।
দবির দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তা হলে কোনটা বেইমানি করেছে?
জব্বার ভিতরে ভিতরে চমকে ওঠে, হঠাৎ করে ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা ছোটখাটো এই মানুষটি–যার বাম হাতটি কব্জি থেকে কাটা, শহরতলি এলাকায় কব্জি কাটা দবির নামে কুখ্যাত, মানুষটির নিষ্ঠুরতার কথা অপরাধীদের অন্ধকার জগতে সুপরিচিত। অন্ধকার জগতে টিকে থাকার একেবারে আদিম পন্থাটি মাত্র কয়েক বছরে কব্জি কাটা দবিরকে তার সাম্রাজ্যের অলিখিত সম্রাটে পরিণত করে ফেলেছে–দবির তার প্রতিপক্ষকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ দেয় না। জব্বার দবিরের প্রতিপক্ষ নয়, তার বিশ্বস্ত অনুচর কিন্তু সেই বিশ্বস্ততার হিসাবটুকু দবিরের কাছে যথেষ্ট কি না সে ব্যাপারে জব্বার পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। জব্বার শুকনো গলায় বলল, কী বললেন ওস্তাদ?
কিছু বলি নাই।
জব্বার আর কোনো কথা বলল না, কব্জি কাটা দবিরকে ঘাঁটানোর মতো দুঃসাহস তার নেই। সামনে থেকে ছুটে আসা আরেকটা ভয়ঙ্কর ট্রাককে পাশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর কত দূর যাবেন ওস্তাদ?
দবির অনিশ্চিতের মতো হাত নেড়ে তার ভালো হাতটি দিয়ে সিটের নিচে থেকে একটা চ্যাপটা বোতল বের করে দাঁত দিয়ে কামড়ে তার ছিপিটা খুলে ফেলল। প্রায় আধযুগ আগে ঘরে বানানো বোমার বিস্ফোরণে বাম হাতটি উড়ে যাবার পর থেকে সব কাজই তার এক হাতেই করতে হয়। এক হাতে সব কাজ সে এত নৈপুণ্যের সাথে করতে পারে যে কব্জি কাটা দবিরকে দেখলে মনে হতে পারে মানুষের দ্বিতীয় হাতটি একটি বাহুল্য।
দবির বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিকটা হুইস্কি গলায় ঢেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বোতলটা জব্বারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে।
জব্বার নিজের ভিতরে এক ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করল কিন্তু সে বোতলটা ধরল না। মাথা নেড়ে বলল, এখন খাব না ওস্তাদ।
দবির ভুরু কুঁচকে জব্বারের দিকে তাকাল, জম্বার তাড়াতাড়ি অনেকটা কৈফিয়ত দেওয়ার মতো বলল, গাড়ির টায়ার স্লিপ কাটছে, এখন মাল খাব না ওস্তাদ। মাল খেলে গাড়ি চালাতে পারব না।
দবির মুখ শক্ত করে বলল, তোকে নেশা করতেকে বলেছে? খা। এক ঢোক খা।
গলায় আপ্যায়নের সুর নেই, এটি রীতিমত আদেশ। কাজেই জব্বার এক হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে অন্য হাতে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে গলায় খানিকটা তরল ঢেলে দেয়। বোতলটি ফিরিয়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল দবির জানালা দিয়ে চিন্তিত মুখে বাইরে তাকিয়ে আছে। জব্বার আবার এক ধরনের ভীতি অনুভব করে, কারণটি জানা নেই বলে ভীতিটিকে তার কাছে অশুভ বলে মনে হতে থাকে।
আরো মিনিট পনের নিঃশব্দে গাড়ি চালানোর পর হঠাৎ করে বৃষ্টিটা একটু ধরে এল, দবির জানালা পুরোপুরি নামিয়ে দিতেই গাড়ির ভিতরে বাতাসের ঝাঁপটা এসে ঢুকল। অনেক রাত, রাস্তায় গাড়ি খুব বেশি নেই, রাতের ট্রাকগুলো হঠাৎ করে সশব্দে ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে নিচু জমিতে পানি জমেছে, দেখে মনে হয় সুবিশাল হ্রদ। রাতের অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না, দিনের বেলা পুরো এলাকাটিকে খুব মনোরম মনে হয়, শহরের অবস্থাপন্ন মানুষেরা গাড়ি করে এখানে বেড়াতে আসে।
দবির গাড়ির ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে বলল, গাড়িটা থামা।
অজানা আশঙ্কায় আবারের বুক কেঁপে ওঠে। সে শুকনো গলায় বলল, থামাব?
হ্যাঁ।
অন্ধকার রাতে এই নির্জন জায়গায় কেন রাস্তার পাশে গাড়ি থামাবে–জব্বার বুঝতে পারল না, কিন্তু তার কারণটি জানার সাহস হল না। সে তবুও দুর্বল গলায় বলল, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
দবির খেঁকিয়ে উঠে বলল, বৃষ্টি পড়বে না তো কি রসগোল্লার সিরা পড়বে?
জব্বার আর কিছু বলার সাহস পেল না, সে সাবধানে রাস্তার পাশে গাড়িটার গতি কমিয়ে থামিয়ে ফেলল। ইঞ্জিনটা বন্ধ করবে কি না বুঝতে পারছিল না। দবিরের দিকে তাকাতেই সে বলল, ডিকি খোল। দুইটা প্যাকেট আছে, প্যাকেট দুইটা নামা।
জব্বার তখন ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দেয়, ডিকি খুলতে গাড়ির চাবি লাগবে। অন্ধকারে তার ভুরু কুঞ্চিত হয়ে উঠল। গাড়ির পিছনে কোনো প্যাকেট থাকার কথা নয়, দবির ঠিক কী চাইছে? অন্ধকার জগতের প্রাণীর মতো হঠাৎ করে সে সতর্ক হয়ে যায়। সে সাবধানে গাড়ির ডিকি খুলল এবং চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল দবিরও দরজা খুলে নেমে আসছে। ডিকির ভিতরে কিছু জঞ্জাল–কোনো প্যাকেট নেই, জব্বার সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে এল। এবারের দুই হাত পিছনে দবির তার ভালো হাত দিয়ে একটা বেঁটে রিভলবার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না কিন্তু জব্বারের এটি চিনতে অসুবিধে হল না, মাত্র এক সপ্তাহ আগে একটা টেন্ডারের বখরা নিয়ে গোলমালের কারণে দবির এই বেঁটে রিভলবার দিয়ে ট্যারা রতনকে পরপর ছয়বার গুলি করে মেরেছে। প্রথম গুলিটি ছিল হত্যাকাণ্ডের জন্য, বাকি পাঁচটি ছিল শুধুমাত্র মজা করার জন্য। জব্বার হঠাৎ করে বুঝতে পারল তার গৌরবহীন ক্ষুদ্র জীবনটি এই অন্ধকার রাতে রাস্তার পাশে কাদা মাটিতে শেষ হয়ে যাবে। দবিরের বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে সে অসংখ্যবার দবিরকে শীতল চোখে এবং কঠিন মুখে হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াতে দেখেছে–তখন তার মুখের অভিব্যক্তিটি নিষ্ঠুর না হয়ে কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হয়। অন্ধকারে দবিরের মুখটি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু জব্বর জানে এখন তার মুখে এক ধরনের বিষণ্ণতা এসেছে।
জব্বার পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছিল না, ভাঙ্গা গলায় বলল, আমি কী করেছি। ওস্তাদ?
তুই খুব ভালো করে জানিস তুই কী করেছিস।
আমি জানি না–আল্লাহর কসম।
চুপ কর হারামজাদা–এখানে আল্লাহকে টেনে আনবি না।
বিশ্বাস করেন ওস্তাদ–আপনি বিশ্বাস করেন।
কে বলেছে আমি তোর কথা বিশ্বাস করি নাই? অবশ্যই করেছি, সেই জন্য তোরে আমি কোনো কষ্ট দিব না। তুই ঘুরে দাঁড়া, পিছন থেকে মাথায় গুলি করে ফিনিশ করে দিব। তুই টেরও পাবি না।
জব্বারের সামনে হঠাৎ করে সমস্ত জগৎ–সংসার অর্থহীন হয়ে গেল, সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না, মনে হচ্ছে সময় যেন স্থির হয়ে গেছে। দবিরের প্রত্যেকটি কথা যেন অন্য কোনো জগৎ থেকে খুব ধীরে ধীরে ভেসে আসছে, আদি নেই, অন্ত নেই, শুরু নেই, শেষ নেই– বিস্ময়কর এক অতিপ্রাকৃত জগৎ।
হঠাৎ করে সমস্ত আকাশ চিরে একটি নীল বিদ্যুৎঝলক ছুটে এল, কিছু বোঝার আগে তীব্র আলোতে চারদিক দিনের মতো আলোকিত হয়ে যায়। বাতাস কেটে কিছু একটা ছুটে যাবার শব্দ হল, জব্বার দেখতে পায় দবির বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। কী দেখছে সে জানে না, তার এই মুহূর্তে জানার কোনো কৌতূহলও নেই। দবিরের এক মুহূর্তের জন্য হতচকিত হওয়ার সুযোগে জব্বার তার ওপর সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে দবিরের মুখে আঘাত করে তাকে নিচে ফেলে দিল। দবিরের হাত থেকে রিভলবারটি ছিটকে পড়ে গেছে, জব্বার সেই সুযোগে দবিরের বুকের ওপর চেপে বসে আবার তার মুখে আঘাত করে। অন্ধকারে দেখা যায় না। কিন্তু দবিরের নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে জব্বারের হাত চটচটে হয়ে যায়।
জব্বার অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় দবিরকে আঘাত করতে করতে একটি হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে রিভলবারটি খুঁজে বের করে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে সেটা হাতে নিয়ে সরে দাঁড়াল। দবির কাটা হাতটি দিয়ে মুখ মুছে সোজা হয়ে বসে প্রথমে জব্বারের দিকে তারপর পিছনে দূরে তাকাল।
জব্বারও দবিরের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল, নীল আলোর ছটা ছড়িয়ে যে বিচিত্র জিনিসটি নেমে এসেছে সেটি পানিতে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। জব্বার নিরাপত্তার জন্য আবার ঘুরে দবিরের দিকে তাকাল বলে দেখতে পেল না বিচিত্র জিনিসটির উপরের অংশ খুলে গেছে এবং সেখান থেকে ধাতব পিচ্ছিল এক ধরনের ঘিনঘিনে প্রাণী বের হয়ে আসছে। দবির বিস্ফারিত চোখে সেই প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে রইল এবং জব্বারের গুলিতে তার মস্তিষ্ক চূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও তার মুখ থেকে সেই বিস্ময়াভিভূত ভাবটি সরে গেল না।
জব্বার রিভলবারের পুরো ম্যাগাজিনটি দবিরের ওপর খালি করল–এই মানুষটিকে সে জীবন্ত অবস্থায় বিশ্বাস করে নি, মৃত অবস্থাতেও তাকে সে বিশ্বাস করে না।
জব্বার রিভলবারটি প্যান্টে খুঁজে নিয়ে টলতে টলতে গাড়িতে ফিরে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে চ্যাপ্টা বোতলটা বের করে ঢকঢক করে তার অর্ধেকটা খালি করে দেয়। খুব ধীরে ধীরে তার স্নায়ু শীতল হয়ে আসছে, এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না শহরতলির ত্রাস অন্ধকার জগতের একচ্ছত্র অধিপতি কব্জি কাটা দবিরকে সে নিজে খুন করে ফেলেছে। বিচিত্র একটা আলোর ঝলকানি দিয়ে আকাশ থেকে কিছু একটা নেমে এসেছে, সেটি কী সে জানে না। সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে সেটি নেমে না এলে কেউ তাকে তার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারত না। জব্বার পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এখন চিন্তা করতে পারছে না, দবিরের। মৃতদেহটি পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে তার এখন ফিরে যেতে হবে–আকাশ থেকে নেমে আসা জিনিসটা কাছাকাছি পানিতে ডুবে গেছে, তার গুলির শব্দও নিশ্চয়ই শোনা গেছে; কৌতূহলী মানুষ এসে যেতে পারে। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে ট্রাক ছুটে যাচ্ছে, কোনো একটি ট্রাক থেমে গেলেই বিপদ হয়ে যাবে। জব্বারকে এখনই উঠতে হবে কিন্তু সে উঠতে পারছে না। এক বিচিত্র ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। জব্বার চ্যাপ্টা বোতল থেকে পানীয়টুকু আবার গলায় ঢেলে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করতে থাকে।
জব্বার গাড়িতে বসে ছিল বলে জানতে পারল না আকাশ থেকে নেমে আসা সেই বিচিত্র মহাকাশযান থেকে একটি বিচিত্র প্রাণী গড়িয়ে গড়িয়ে দবিরের মৃতদেহের কাছে এসে তার বুক চিরে ভিতরে প্রবেশ করেছে। আবার দেখতে পেলেও সম্ভবত নিজের চোখকে বিশ্বাস করত না, কারণ হঠাৎ করে দবিরের চোখ দুটো লাল আলোর মতো জ্বলে উঠল। তার কাটা হাতের ভিতর থেকে একটা যান্ত্রিক হাত গজিয়ে যায় এবং চূর্ণ হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের ভিতর। থেকে ধাতব টিউবের মতো কিছু জিনিস সস শব্দ করে বের হয়ে আসে। দবিরের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে সেটা খানিকটা পশু এবং খানিকটা যন্ত্রের মতো হয়ে যায়, মৃতদেহটি হঠাৎ নড়ে উঠল এবং বিচিত্র একটি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। দবিরের দেহটি খুব সাবধানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ছোট শিশুর মতো পা ফেলে হাঁটার চেষ্টা করে পানির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
জব্বার শেষ পর্যন্ত সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং টলতে টলতে গাড়ি থেকে বের হয়ে এল। যেখানে দবিরের মৃতদেহটি পড়ে ছিল সেখানে কিছু নেই। জম্বার বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, তার যতটুকু অবাক হওয়ার কথা কোনো একটি বিচিত্র কারণে সে ততটুকু অবাক হতে পারছে না। খসখস করে কাছাকাছি একটা শব্দ হল, জব্বার মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তার পিছনেই দবির দাঁড়িয়ে আছে। জব্বার রক্তশূন্য মুখে দবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে, দবিরের চোখ দুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছে, অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না কিন্তু মনে হচ্ছে মাথা থেকে সাপের মতো কিলবিলে কিছু একটা বের হয়ে এসেছে। সমস্ত শরীরে একটি বিচিত্র ধাতব আবরণ। দবির খুব ধীরে ধীরে তার কাটা হাতটি উঁচু করল, জব্বার দেখতে পেল সেখান থেকে একটি ধাতব হাত বের হয়ে এসেছে, হাতটি সরসর শব্দ করে আরো খানিকটা বের হয়ে আসে এবং হঠাৎ করে তার ভিতর থেকে বিদ্যুৎঝলকের মতো কিছু একটা জব্বারের দিকে ছুটে বের হয়ে এল।
কী হয়েছে জব্বার কিছু বুঝতে পারল না। সমস্ত শরীর কুঁকড়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, তার শরীর মাটি স্পর্শ করার আগেই তার মৃত্যু ঘটে গেল বলে সে যন্ত্রণাটুকুও অনুভব করতে পারল না। সে বেঁচে থাকলেও তার অমার্জিত, নির্বোধ মস্তিষ্ক ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারত না যে একটি মহাজাগতিক প্রাণী পৃথিবীতে এসে নিজের আশ্রয় বেছে নিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিজগৎ হঠাৎ করে কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে সেটি বোঝার মতো ক্ষমতা জব্বারের ছিল না।