সন্তুর ঘরখানা তার নিজস্ব পৃথিবী। তিনতলার ছাদে ওই একখানাই ঘর, ছাদে বিশেষ কেউ আসে না। ঘরের মধ্যে সন্তু লম্ফঝম্ফ করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেংচি কাটে, কিংবা একলা-একলা তলোয়ার খেলে, কেউ দেখবার নেই। সন্তু যখন আরও ছোট ছিল, কালি দিয়ে মুখে গোঁফ-দাড়ি এঁকে কিংবা নিজেই একটা মুখোশ বানিয়ে কখনও ফ্যান্টম বা ম্যানড্রেক সাজত, কখনও সুপারম্যান, আবার কখনও তীর-ধনুক হাতে অর্জুন। খাটের মাথার দিকটায় উঠে সে ঘোড়া চালাত খুব জোরে, আর মাঝে-মাঝে চেঁচিয়ে উঠত, হে নীল ঘোড়াকা সওয়ার। হো নীল ঘোড়াকা সওয়ার?
সন্তু নিজের একটা নাম দিয়েছিল, সেটা খুব গোপন, আর কেউ জানে না। ক্যাপ্টেন ভামিঙ্গো। সে বাঙালি নয়, এ-পৃথিবীরই কেউ নয়, দূর মহাকাশ থেকে মাঝে-মাঝে পৃথিবীতে বেড়াতে আসে। ক্যাপ্টেন ভামিঙ্গোর মুখের ভাষাও তৈরি করেছিল সন্তু। বিলিবিলি খাণ্ডা গুলু? বুমচাক, বুমচাক ডবাংড়ুলু! উসুখুসু সাকিনা খিনা? কামুলু টামুলু জামুলু। ফিংকা চিংমিনিমিনি মাজুনু জানুনু লাকুনু। পিঠে একটা সাদা চাদর বেঁধে ক্যাপ্টেন ভামিঙ্গো আকাশে উড়ে বেড়ায়, চন্দ্র-সূর্য, এমনকী মেঘের সঙ্গেও সে কথা বলে। ওই ক্যাপ্টেন ভামিঙ্গোর ভাষা সন্তু একটা খাতাতেও লিখে রেখেছিল, তখন সে ক্লাস ফাইভে পড়ে। এখন সেই লেখাটা দেখলে তার হাসি পায়।
এখন আর সন্তু ওরকম কিছু সেজে খেলা করে না বটে, কিন্তু একলা ঘরের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে কবিতা আবৃত্তি করে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়েই সে মেঘনাদবধ কাব্য পুরো মুখস্থ করে ফেলেছিল, অনেক শব্দেরই মানে বুঝত না, তাতে কিছু আসে যায় না। এখন তার একটা নতুন শখ হয়েছে, সে নাচ শিখছে। কারও কাছে শিখতে যায় না, ঘরের দরজা বন্ধ করে ক্যাসেট প্লেয়ারে রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা ইংরিজি গান চালিয়ে সে নিজে নিজে নাচে। তার এই নাচের কথা আর কেউ ঘুণাক্ষরেও জানে না।
ঘরের একদিকের দেওয়ালে একটা বড় বোর্ড। তাতে সন্তু তার প্রিয় সব খেলোয়াড়, গায়ক, লেখকদের ছবি পিন দিয়ে আটকে রাখে। ছবিগুলো মাঝে-মাঝেই বদলে যায়। একটা সাদা কাগজে প্রতি সপ্তাহে সে এক-একটা বাণী লিখে রাখে। বাণীটা তার নিজের জন্য, নিজেরই বানানো। গত সপ্তাহে লেখা ছিল, কফি গরম, আইসক্রিম ঠাণ্ডা, দুটোই একসঙ্গে খাওয়া যায়। খুব রাগ হলেও হো-হো করে হাসি প্র্যাকটিস করো। এ সপ্তাহে তার বদলে লেখা আছে, খিদে পেলে গান গাও, প্রাণ খুলে গান গাও, খুব যদি গান পায়, খুব কষে ঝাল খাও, ঝাল চানাচুর খাও।
সন্তুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র জোজো এই তিনতলার ঘরে আসে। পরশুই এসেছিল। সে সন্তুর ওই বাণীর তলায় লিখে রেখেছে, খুব যদি ঝাল লাগে, নদীতে সাঁতার দাও!
সন্তু অনেক রাত জেগে বই পড়ে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, সমস্ত পাড়াটা নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন বই পড়তে বেশি ভাল লাগে। পড়ার বই, গল্পের বই। ভূতের গল্প পড়তে একটু গা-ছমছম করে বটে, কিন্তু সন্তু জোজোর মতন ভূতে বিশ্বাস করে না। জোজো কক্ষনও একলা ঘরে শুতে পারে না। জোজোদের বাড়ির ঠিক পেছনেই খানিকটা ফাঁকা জমি আর একটা ভাঙা বাড়ি আছে। জোজোর ধারণা, তিনটে ভূত থাকে ওই বাড়িতে। কোনওদিন নিজের চোখে দেখেনি, তবু কী করে জানল যে, ঠিক তিনটে ভূত, তা কে জানে। জোজোর বাবা অবশ্য এমন জোরালো মন্ত্র পড়ে দিয়েছেন যে, ভূতে কোনওদিন জোজোর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।
বই পড়তে-পড়তে রাত দুটো-আড়াইটে বেজে গেলেও কিন্তু বেশি বেলা করে ঘুমোবার উপায় নেই সন্তুর। ছাদে অনেক ফুলের টব আছে। প্রত্যেক দিন ঠিক পৌনে ছটায় মা সেই ফুলগাছগুলোতে জল দিতে আসেন। আগে ডেকে তোলেন সন্তুকে। ঘরের দরজা ভেজানো থাকে, মা ঘরের মধ্যে এসে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বই, গেঞ্জি, রুমাল, কলম সব গুছিয়ে রাখেন। তারপর সন্তুর শিয়রের কাছে এসে তার গালটা বেশ জোরে টিপে ধরে বলেন, ঘুমপরী এবার বাড়ি যাও, আমার খোকাটি এবার ছোলা গুড় খাবে। অ্যাই সন্তু, ওঠ।
সত্যি-সত্যি সন্তুকে রোজ সকালে ভেজানো ছোলা আর আখের গুড় খেতে হয়। তার ভাল লাগে না অবশ্য। তবু এটাই তাদের বাড়ির নিয়ম। সবাই খায়। কাকাবাবু মাঝে-মাঝে আপত্তি করে বলেন, বউদি, এসব তো উঠতি বয়েসের ছেলেমেয়েদের পক্ষে ভাল, আমাকে জোর করে খাওয়াচ্ছ কেন? মা শুনবেন না, খেতেই হবে।
তার আগে, চোখ-মুখ না ধুয়েই সন্তু মাকে গাছে জল দেওয়ায় সাহায্য করে। ট্যাঙ্ক থেকে জল এনে দেয়, কোনও-কোনও গাছের গোড়ার মাটি খুঁচিয়ে দিতে হয়। এক-একদিন সে মাকে বলে, মা, তুমি রোজ-রোজ কষ্ট করে ওপরে আসো কেন? আমিই তো সব গাছে জল দিয়ে দিতে পারি!
মা হেসে বলেন, আমি না এলে তোর আরও অনেকক্ষণ নাক ডাকিয়ে ঘুমোবার খুব সুবিধে হয়, তাই না?
তারপর একটা গাছে আদর করে হাত বুলোতে বুলোতে আবার বলেন, সারা দিনে তো একবারই ছাদে আসি। যে গাছগুলো লাগিয়েছি, তা একবারও দেখব না? ফুল তো দেখবার জন্যই। জানিস সন্তু, গাছকে আদর করলে গাছ ঠিক বোঝে। তাতে তাড়াতাড়ি ফুল ফোটে।
তিনতলায় বাথরুম নেই, সকালবেলা সন্তু মায়ের সঙ্গেই নীচে নেমে যায়।
ছুটির দিনগুলোতে প্রায় সারাদিনই সন্তু নিজের ঘরে কাটায়। রান্নাঘর, খাবার জায়গা একতলায়, খিদে-তেষ্টা পেলে সেখানে যেতে হয় সন্তুকে। ছেলেবেলা থেকে তাকে শেখানো হয়েছে, বাড়ির কাজের লোককে এক গেলাস জলও এনে দিতে বলা চলবে না। নিজেরটা নিজেকে করে নিতে হবে। দরকার হলে সন্তু ডিম সেদ্ধ করতে পারে, কফি বানাতে পারে।
দোতলায় সিঁড়ির পাশের ঘরটা কাকাবাবুর। ভেতরের দিকে দিদির ঘরটা এখন খালি পড়ে থাকে, অন্যটা মা বাবার। বাবা অবশ্য বেশিরভাগ সময়ই নীচের বৈঠকখানা ঘরে কাটান। তার পাশে একটা লাইব্রেরি ঘরও আছে।
কাকাবাবুর সঙ্গে বাবার স্বভাবের কত তফাত। কাকাবাবু খোঁড়া পা নিয়েও পাহাড়ে-জঙ্গলে কত অ্যাডভেঞ্চারে যান, আর বাবা বাড়ি থেকে বেরোতেই চান না। একবার দার্জিলিং গিয়েছিলেন, হোটেল বুক করা ছিল সাতদিনের, দুদিন থেকেই শীতের ভয়ে পালিয়ে এলেন। মায়ের তাড়নায় বাবাকে বাধ্য হয়ে কয়েকবার বেড়াতে যেতে হয়েছে বটে, প্রত্যেকবার ফিরে এসে বলেছেন, উঃ কী ঝকমারি! কুলির মাথায় জিনিস চাপাও, ঠিক সময় ট্রেনে ওঠো, ঠিক-ঠিক স্টেশনে নামো, আবার কুলি, গাড়ি নিয়ে দরাদরি, হোটেলে গিয়ে দেখবে বাথরুমে জল নেই..। কী দরকার বাপু এতসব ঝামেলা করার। বই পড়লেই তো সব জানা যায়।
বাবা ভ্রমণকাহিনী পড়তে খুব ভালবাসেন। বিছানায় শুয়ে সেইসব বই পড়তে-পড়তে তিনি মনে-মনে সাহারা মরুভূমি, আফ্রিকার জঙ্গল, হিমালয় পাহাড় কিংবা আলাস্কা ঘুরে আসেন। কাকাবাবু ভ্রমণকাহিনী পড়েন না, তিনি সময় পেলেই সামনে মেলে ধরেন নানা দেশের ম্যাপ। হিসেব করেন, কোথায়-কোথায় তাঁর এখনও যাওয়া হয়নি। এ-পৃথিবীর প্রায় অনেকখানিই তাঁর দেখা।
আজ একটা ছুটির দিন। সকালবেলা জলখাবারের টেবিলে কাকাবাবুর সঙ্গে সন্তুর দেখা হয়েছিল। মাঝে-মাঝে কাকাবাবু দুপুরের খাওয়াটা বাদ দেন, আজ শুধু একবাটি সুপ খেয়েছেন নিজের ঘরে বসে। সকালবেলা সন্তু দেখেছিল, কাকাবাবুর গালে খরখরে দাড়ি। তাতে সে বেশ অবাক হয়েছিল। প্রতিদিন কাকাবাবু মর্নিংওয়াকে যান, তারপর আর বাড়ি থেকে না বেরোলেও তিনি দাড়ি কামিয়ে রোজ ফিটফাট থাকেন।
সন্তুর চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পেরে কাকাবাবু নিজের গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিলেন, দাড়ি কামাবার সাবান ফুরিয়ে গেছে–
বাবা বললেন, তুই আমারটা নিলেই পারিস।
কাকাবাবু বললেন, না, তোমার ওই সাবানে আমার চলবে না। আমার ফোম সাবান ব্যবহার করা অভ্যেস হয়ে গেছে। সন্তু, তুই যখন বাড়ি থেকে বেরোবি, আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে যাস, একটা ওই সাবান কিনে আনিস।
সারাদিন সন্তু পড়াশুনো করেছে, খানিকটা নেচেছে, খানিকটা ঘুমিয়েছে, ঘর থেকে আর বেরোয়নি। কাকাবাবুর কথাটা ভুলেই গিয়েছিল। বিকেলবেলা তার ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলতে যাওয়ার কথা, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে গেল। সারাদিন কাকাবাবুর দাড়ি কামানো হয়নি!
কাকাবাবুর ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সন্তু বলল, কাকাবাবু, তোমার ফোম সাবান কিনে আনব, টাকাটা দাও।
কাকাবাবুর লেখাপড়ার টেবিলটা জানলার পাশে। রিভলভিং চেয়ারে বসে কাকাবাবু জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছেন। মুখটা ফেরালেন। কাকাবাবুর মুখের মধ্যে ওটা কী?
সন্তু ভাল করে দেখল, কাকাবাবুর মুখে একটা থার্মোমিটার।
এই অবস্থায় কোনও কথা বলা যায় না। কাকাবাবু নিঃশব্দে ড্রয়ার খুলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে এগিয়ে দিলেন সন্তুর দিকে।
টাকাটা নিয়েও সন্তু নড়ল না।
কাকাবাবুর টেবিলের ওপর বেশ বড় একটা গ্লোব। একদিকের দেওয়ালজোড়া এভারেস্ট-এর চূড়ার ছবি। আর একদিকের দেওয়ালে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ। এই ম্যাপ কাকাবাবু প্রায়ই বদলান। কাকাবাবু কি এবার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন? সন্তুর বেশ আনন্দ হল। তা হলে এবার অস্ট্রেলিয়া দেখা হয়ে যাবে।
মুখ থেকে থার্মোমিটারটা বার করে নিয়ে কাকাবাবু দেখতে লাগলেন।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কত?
কাকাবাবু বললেন, কিছু না। দেখছিলাম এই ঘরের টেম্পারেচারের সঙ্গে আমার শরীরের টেম্পারেচারের কোনও তফাত হয় কি না!
কথাটা সন্তুর বিশ্বাস হল না।
কাকাবাবুর চোখ দুটো লালচে দেখাচ্ছে। চুল উসকোখুসকো। দেখলেই মনে হয়, বেশ জ্বর হয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, সদারি করে দাদাবউদিকে কিছু বলতে হবে না। আমার কিচ্ছু হয়নি। তুই খেলতে যা।
সন্তু কাকাবাবুকে কখনও অসুখে ভুগতে দেখেনি। কাকাবাবুর শুধু একটা পা জখম, কিন্তু স্বাস্থ্য দারুণ ভাল। একবার শুধু তাঁর শত্রুরা তাঁকে গুলি করেছিল, সেটাও আবার বাঘকে ঘুম পাড়াবার গুলি। সেবার কাকাবাবু বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। তখনও অনেকে বলেছিল, ওই গুলিতে মানুষের বাঁচা প্রায় অসম্ভব, কাকাবাবু সেরে উঠেছিলেন বেশ তাড়াতাড়ি।
নীচে নেমেই সন্তু মাকে বলল, মা, কাকাবাবুর খুব জ্বর হয়েছে। তোমাদের বলতে বারণ করলেন।
বাবাও খুব অবাক। জলের মাছের সর্দি হওয়ার মতনই যেন কাকাবাবুর জ্বর হওয়াটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
মা আর বাবা দুজনেই ওপরে উঠে এলেন সঙ্গে-সঙ্গে।
মা কাকাবাবুর কপালে হাত দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, বেশ জ্বর। একশো তিন-চার হবে বোধ হয়।
বাবা বললেন, কবে থেকে জ্বর হচ্ছে? রাজা, তুই আমাদের কাছে কিছু বলিস না কেন? ডাক্তার দেখাতে হবে না?
সন্তু লুকিয়ে রইল দরজার আড়ালে। কাকাবাবু বললেন, তোমরা আবার ব্যস্ত হলে কেন, এমন কিছু হয়নি।
মা বললেন, ইস, কিছু হয়নি? জ্বরে একেবারে গা পুড়ে যাচ্ছে। তুমি শুয়ে পড়ো, তোমার মাথা ধুইয়ে দেব।
বাবা বললেন, তা হলে তো ডাক্তারকে খবর দিতে হয়। চতুর্দিকে ম্যালেরিয়া হচ্ছে।
কাকাবাবু আর্তস্বরে বলে উঠলেন, না না, ডাক্তার ডাকতে হবে না। জ্বর হয়েছে, এমনই সেরে যাবে। ডাক্তার এলেই একগাদা ওষুধ দেবে, পটপট ইঞ্জেকশান ফুঁড়ে দেবে!
সন্তু মুচকি হাসল। কাকাবাবু রিভলভারের সামনে বুক পেতে দিতে ভয় পান না, কিন্তু ইঞ্জেকশান নিতে বড় ভয়। আফ্রিকা যাওয়ার সময় ইয়োলা ফিভারের ইঞ্জেকশান নিতে হয়েছিল, তখন তিনি আড়ষ্ট মুখে চোখ বুজে ছিলেন।
টেলিফোনটা তুলতে-তুলতে বাবা বললেন, রাজা, তুই কি মনে করিস, তুই ভীম না হারকিউলিস? সব মানুষেরই মাঝে-মাঝে অসুখ-বিসুখ করে, ডাক্তার দেখাতেও হয়। না হলে ডাক্তারদেরই বা চলবে কী করে?
কাকাবাবু গজগজ করতে-করতে বললেন, এবার আমার অসুখের কথা চারদিকে ছড়াবে, আর দলে দলে আত্মীয় বন্ধুরা দেখতে আসবে। বাঙালিদের এই এক স্বভাব, অসুস্থ লোকের ঘরে ভিড় করে বসে থাকবে আর চেনাশুনো মানুষরা কে কোন অসুখে মরে গেছে, সেই গল্প করবে। আর চা-মিষ্টি খাবে!
ডাক্তার রথীন বসু কাকাবাবুরই বন্ধু। তিনি ঘরে ঢুকতে-ঢুকতেই বললেন, বা বা বা, রাজার অসুখ হয়েছে। খুব খুশি হয়েছি। এমনকী ডাক্তারদেরও কখনও সখনও অসুখ হয়, আর রাজা রায়চৌধুরীর কোনওদিন অসুখ হবে না, এতে আমাদের হিংসে হয় না? আমরা বিছানায় পড়ে থাকি আর ও জঙ্গলে-পাহাড়ে লাফিয়ে বেড়ায়। এবার রাজা, তোকে অন্তত সাতদিন শুইয়ে রাখব, আর রোজ দুবেলা ইঞ্জেকশান!
কাকাবাবু বললেন, ইঞ্জেকশান না দিলে রোগ সারে না? তুই কি ঘোড়ার। ডাক্তার? ইঞ্জেকশান দেওয়ার চেষ্টা করে দেখ না, ঘুসিতে তোর নাক ফাটিয়ে দেব।
দুজন বয়স্ক লোক বাচ্চাদের মতন খুনসুটি করতে লাগলেন।
কাকাবাবুকে সত্যিই কয়েকদিন শুয়ে থাকতে হল। শরীর বেশ দুর্বল। রক্ত পরীক্ষায় জানা গেছে, ম্যালেরিয়া নয়, তাঁর নিউমোনিয়া হয়েছে।
বাবা বললেন, অনেকদিন এ-রোগটার নামই শুনিনি। তুই এ-রোগ কী করে বাধালি রাজা?
কাকাবাবু অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, কিছু না, বুকে একটু ঠাণ্ডা বসে গেছে, তাই রথীন বলে দিল নিউমোনিয়া। ওরা বড়বড় নাম দিতে ভালবাসে। ওষুধগুলোর নাম দেখো না, কীরকম শক্ত-শক্ত।
কয়েকদিন আগে কাকাবাবু ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন পড়াশুনো করতে। ফেরার পথে দারুণ বৃষ্টি নেমেছিল। কাকাবাবু বৃষ্টি গ্রাহ্য করেন না, ট্যাক্সি পাননি, ইচ্ছে করেই বাসে না উঠে ময়দান দিয়ে হেঁটে এসেছেন চৌরঙ্গি পর্যন্ত। তারপর সেই ভিজে জামা পরেই গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র ভার্মার সঙ্গে দেখা করতে। বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
অনেক ওষুধ খেতে হচ্ছে। কাকাবাবুর ধারণা, ওষুধগুলোর জন্যই তাঁর শরীর বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
অসুখের কথা কী করে রটে যায় কে জানে! সত্যিই, দলে-দলে লোক কাকাবাবুকে দেখতে আসতে লাগল সকালে-বিকেলে। নরেন্দ্র ভার্মা খুব হতাশ। তিনি দিল্লি থেকে এসেছিলেন একটা রহস্য সন্ধানের ব্যাপারে কাকাবাবুকে নাগাল্যান্ডে নিয়ে যেতে। দেখতে এসে বললেন, রাজা রায়চৌধুরীর অসুখ, এ যেন আগুনের পেট গরম! তুমি নাগাল্যান্ডে যেতে চাও না, সেইজন্য অসুখের ভান করোনি তো?
কাকাবাবু বললেন, তুমি আমার বদলে সন্তুকে নিয়ে যাও!
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটা পড়ার পর নরেন্দ্র ভার্মা সস্নেহে সন্তুর দিকে তাকালেন। তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, হ্যাঁ, সন্তু এখন প্রায় হিরো হয়ে উঠেছে বটে। দুদিন বাদে তোমাকে-আমাকে টেক্কা দেবে! কিন্তু তোমার অসুখের সময় সন্তুকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমাকে আজই রওনা দিতে হবে।
আজ সকালে চার-পাঁচজন দেখা করতে এসেছে। কেউ মাসতুতো ভাই, কেউ পিসতুতো দাদা। একজন মহিলা মায়ের সঙ্গে ইস্কুলে পড়তেন। বহুদিন এঁদের দেখা যায়নি। কাকাবাবুর কথা মিলে গেছে, মা এঁদের চা ও মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। তাই খেতে-খেতে এঁরা অন্যদের অসুখের গল্প করছেন।
মাঝখানের চেয়ারে গম্ভীরভাবে বসে আছেন একজন হৃষ্টপুষ্ট পুরুষ। কাকাবাবুর বয়েসী হবেন, মুখে মোটা গোঁফ আর চাপদাড়ি, বেশ দামি সুট পরা।
তিনি সকলের কথা শুনছেন, নিজে কিছু বলছেন না। আর সবাই একেএকে চলে যাওয়ার পর তিনি বললেন, আমিও এবার উঠব রাজা, শরীরের অযত্ন কোরো না। কিছুদিন বিশ্রাম নাও।
এরকম উপদেশ শুনতে-শুনতে কাকাবাবুর কান ঝালাপালা হয়ে গেছে, তিনি কোনও উত্তর দিলেন না।
দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি আবার বললেন, শুধু ওষুধ খেলে অসুখ সারে না। এই রোগের আসল চিকিৎসা হল শুয়ে থাকা। অন্তত সাতদিন শুয়ে থাকতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, হুঁঃ!
লোকটি উঠে দাঁড়ালেন। যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। এ-ঘরে ঢোকার সময় সবাই বাইরে জুতো খুলে আসে, এঁর পায়ে চকচকে কালো জুত। বাঁ হাতটা আগাগোড়া কোটের পকেটেই ছিল, একবার বার করতেই সন্তু লক্ষ করল, সেই হাতটায় পাতলা রবারের দস্তানা পরা।
তিনি বললেন, তা হলে আমি চলি? কোনও দরকার-টরকার হলে আমাকে খবর দিয়ো। আমি সপ্তাহখানেক পরে আবার আসব।
ভদ্রলোক বেরিয়ে যেতেই কাকাবাবু চোখের ইঙ্গিতে মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে?
মা বললেন, জানি না তো। জম্মে দেখিনি।
কাকাবাবু বললেন, সে কী! আমিও তো চিনি না। আমি ভাবলাম, তোমাদের কোনও আত্মীয়-টাত্মিয় হবে বুঝি।
মা বললেন, আমিও তো ভেবেছি, তোমার কোনও বন্ধু!
কাকাবাবু বললেন, আমার বন্ধুর চেয়ে শত্রু বেশি। তুমি-তুমি বলে কথা বলল, যেন কতদিনের চেনা। অথচ আমি একেবারেই চিনতে পারলাম না? মুখভর্তি অবশ্য দাড়ি-গোঁফ।
চোখ বুজে কাকাবাবু একটুক্ষণ চিন্তা করলেন।
তারপর বললেন, উঁহুঃ, মনে পড়ছে না। সন্তু এক কাজ করতো। দেখে আয় তো লোকটা কোথায় যায়। সঙ্গে আর কেউ আছে কি না!
সন্তু দৌড়ে নীচে নেমে গেল।
ভদ্রলোকটি ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে পড়েছেন। বাড়ির সামনে কোনও গাড়ি নেই। তিনি হাঁটতে লাগলেন বড় রাস্তার দিকে। সন্তু তাঁর পিছু নিল।
সন্তু ইচ্ছে করলে ছুটে গিয়ে ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়াতে পারে। তারপর সে কী করবে? আপনার নাম কী, কোথা থেকে এসেছেন, কাকাবাবুকে আপনি কী করে চিনলেন, এসব কথা কি ওরকম একজন রাশভারী চেহারার লোককে জিজ্ঞেস করা যায়?
লোকটির দুটি হাতই এখন পকেটের বাইরে। বাঁ হাতের পাতলা দস্তানাটা সন্তুর আবার নজরে পড়ল। একজন লোক শুধু একহাতে দস্তানা পরে থাকে কেন?
সন্তু আর-একটু কাছে যেতেই ভদ্রলোক পেছন ফিরে তাকালেন এবং বাঁ হাতটা চট করে পকেটে ভরে ফেললেন।
সন্তু যেন কোনও জিনিস কিনতে বেরিয়েছে, এইরকম ভাব করে একটুখানি হাসল। ভদ্রলোক হাসলেনও না, কোনও কথাও বললেন না।
এইসময় একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থামল লোকটির কাছে। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই। ড্রাইভারটির মাথায় একটা খাকি রঙের টুপি।
ভদ্রলোক পেছনের দরজা খুলে উঠে পড়লেন গাড়িতে। তারপর সেটা চলতে শুরু করতেই জানলা দিয়ে কেমন যেন কটমট করে তাকালেন সন্তুর দিকে।