সকালবেলা রেডিয়ো খোলা থাকে, কাকাবাবু দু-তিনখানা খবরের কাগজ পড়েন। কাগজ পড়তে-পড়তে কখনও রেডিয়াতে ভাল গান হলে শোনেন কিছুক্ষণ, আবার কাগজ-পড়ায় মন দেন। বেলা নটার আগে তিনি বাইরের কোনও লোকের সঙ্গে দেখা করেন না। কাকাবাবুর মতে, সকালবেলা প্রত্যেক মানুষেরই দু-এক ঘণ্টা আপনমনে সময় কাটানো উচিত। জেগে ওঠার পরেই কাজের কথা শুরু করা ঠিক নয়।
কাকাবাবু ওঠেন বেশ ভোরেই। হাত-মুখ ধুয়ে ময়দানে বেড়াতে যান। সেখানে তিনি বোবা সেজে থাকেন, চেনা মানুষজন দেখলেই চলে যান অন্যদিকে। লোকদের সঙ্গে অপ্রয়োজনে এলেবেলে কথা বলার বদলে গুগুনিয়ে গান করা অনেক ভাল।
বাড়ি ফিরে কয়েক কাপ চা-পান ও খবরের কাগজ পড়া। রেডিয়োতে লোকসঙ্গীত আর রবীন্দ্রসঙ্গীত হলে কাগজ সরিয়ে রাখেন। আর বাংলা খবরটাও শুনে নেন কিছুটা।
বাংলা কাগজের তিনের পাতায় একটা ছোট খবর বেরিয়েছে, রেডিয়োতে ঠিক সেই খবরটাই শোনাচ্ছে : উত্তরবঙ্গের বনবাজিতপুর গ্রামে আবার একটি রহস্যময় বিমান দেখা গেছে বলে গ্রামবাসীরা দাবি করেছে। মাঝরাত্তিরে বিমানটি ভয়ঙ্কর শব্দ করতে করতে খুব নিচুতে এসে গ্রামের ওপর দিয়ে ঘোরে। গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়…পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে…
এই সময় রঘু এসে বলল, কাকাবাবু, আপনার কাছে সেই দুজন ভদ্রলোক আবার এসেছেন!
কাকাবাবু টেবিলের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনও নটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি না?
রঘু কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, কী করব, ওনারা যে আরও অনেকক্ষণ আগে এসে বসে আছেন। চা খাবেন কি না জিজ্ঞেস করলাম, তাও খেতে চাইছেন না, ছটফট করছেন!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেই দুই বাবু মানে কোন দুই বাবু? রঘু বলল, কালকেও যাঁরা এসেছিলেন। একজন বৃদ্ধ ধুতি পাঞ্জাবি পরা, আর একজন মাঝারি কোট-প্যান্ট।
কাকাবাবু বিরক্তভাবে বললেন, আবার এসেছে! জ্বালাতন! সন্তু কোথায়?
রঘু বলল, খোকাবাবু তো পড়তে বসেছিল, তারপর জোজোবাবু এসে তাকে ম্যাজিক শেখাচ্ছে!
কাকাবাবু বললেন, ম্যাজিক একটু পরে শিখলেও চলবে। সন্তুকে গিয়ে বল ওদের সঙ্গে দেখা করতে। সন্তুই যা বলবার বুঝিয়ে দেবে। আমার এখন সময় নেই।
রঘু চলে যাওয়ার পরেও কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে রইলেন। এখন প্রায় প্রত্যেকদিন তাঁর কাছে নানারকম লোক আসে। কারও বাড়ির গয়না চুরি গেছে, কারও বাড়িতে ভূতের উপদ্রব হচ্ছে, কোনও বাড়িতে খুন হয়েছে, সেইসব সমস্যা কাকাবাবুকে সমাধান করে দিতে হবে। কেউ-কেউ এজন্য কাকাবাবুকে অনেক টাকাও দিতে চায়।
এসব প্রস্তাব শুনলেই কাকাবাবু রেগে যান। তিনি বলেন, আমি ডিটেকটিভও নই, ভূতের ওঝাও নই। ওসব কি আমার কাজ? ওসব তো পুলিশের কাজ।
তবু লোকেরা শোনে না, ঝুলোঝুলি করে। কাকাবাবু হাত জোড় করে বলেন, মশাই, আমি খোঁড়া মানুষ, চোর-ডাকাতদের পেছনে ছোটাছুটি করার ক্ষমতা আমার আছে? আমি বাড়িতে বসে বই-টই পড়ি, শান্তিতে থাকতে চাই। আমায় ক্ষমা করবেন!
কাকাবাবু আর সন্তুর কয়েকটা অভিযানের কথা অনেকে জেনে গেছে, তাই লোকের ধারণা হয়েছে যে, কাকাবাবু অসাধ্যসাধন করতে পারেন! কাল এই দুই ভদ্রলোক এসেছিলেন একটা অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার নিয়ে। ওঁদের বাড়ির উনিশ বছরের একটি ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তাকে কেউ জোর করে ধরে নিয়ে যায়নি, সে নিজেই চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। সেই ছেলেকে খুঁজে বের করতে হবে, কাকাবাবুকে ওঁরা প্রথমেই পঁচিশ হাজার টাকা ফি দিতে চেয়েছিলেন। ছেলেকে পাওয়া গেলে আরও পঁচিশ হাজার।
কাকাবাবু বলেছিলেন, আপনারা পঁচিশ লাখ টাকা দিলেও এব্যাপারে আমি মাথা গলাতে রাজি নই। একটা কলেজে পড়া উনিশ বছরের ছেলে, তার নিজস্ব ভাল-মন্দ বোেঝার জ্ঞান নেই? সে যদি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে বম্বেতে ফিল্ম স্টার হতে চায় কিংবা হিমালয়ে গিয়ে সাধু হতে চায় কিংবা দেশের কাজে প্রাণ দিতে চায়, তাতে আমি বাধা দেব কেন?
তবু নাছোড়বান্দা লোকদুটি আজ আবার এসেছেন!
রেডিয়োর খবরটা পুরোপুরি শোনা হল না। রহস্যময় বিমানটির কথা বাংলা কাগজে ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু রেডিয়োতে পুলিশের বক্তব্য শোনানো হচ্ছিল, সেটা কাগজে নেই। বাংলা কাগজে লিখেছে যে, বিমানটির গা থেকে আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছিল। নিজস্ব সংবাদদাতার ধারণা, সেটা সাধারণ বিমান নয়। মহাকাশযান!
কাকাবাবু অস্ফুট স্বরে বললেন, ইউ এফ ও!
রঘু সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে গেল সন্তুকে ডাকতে। সন্তুকে সে খুব বাচ্চা বয়েস থেকে দেখছে বলে সে এখনও তাকে খোকাবাবু বলে। বন্ধুদের সামনে ওই ডাক শুনলে সন্তু রেগে যায়। শুধু খোকা বললে আপত্তি ছিল না, অনেক বয়স্ক লোকেরও ডাকনাম হয় খোকা, কিন্তু খোকাবাবু শুনলেই মনে হয়
বাচ্চা ছেলে? গত বছর নেপাল থেকে ফেরার পর রিনি ইয়ার্কি করে বলেছিল, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন হল তা হলে?
তিনতলায় একটাই মাত্র ঘর, এই ঘরখানা সন্তুর নিজস্ব। পাশে অনেকখানি খোলা ছাদ। খুব গরমকালে রাত্তিরে সন্তু একটা মাদুর পেতে এই ছাদে শুয়ে থাকে। মেঘের খেলা দেখে, কিংবা নক্ষত্রদের দিকে তাকিয়ে কোটি-কোটি মাইল দূরে তার মন চলে যায়।
এখন ঘরের মধ্যে জোজো তাকে তাস অদৃশ্য করার ম্যাজিক দেখাচ্ছে।
রঘু দরজার কাছে এসে খোকাবাবু বলে ডাকতে গিয়েও চেপে গেল। বলল, এই যে, একবার নীচে যাও! কাকাবাবুর সেক্রেটারি হয়েছ যে। কালকের সেই দুজন ভদ্রলোক এসেছেন, তাদের মিষ্টিমুখে বিদায় করতে হবে।
সন্তু কিছু বলার আগেই জোজো বলল, লোক বিদায় করতে হবে? আমি ওই কাজটা দারুণ পারি। তুই মুখ খুলবি না, সন্তু, যা বলার আমি বলব!
বসবার ঘরে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ম্লান মুখ করে বসে আছেন সোফায়। আর অন্য লোকটি দাঁড়িয়ে আছেন জানলার কাছে, তাঁর মুখে একটা ছটফটে ভাব।
জোজো ঘরে ঢুকে বলল, নমস্কার। আমি মিস্টার রাজা রায়চৌধুরীর ফার্স্ট সেক্রেটারি, আর এ ডেপুটি সেক্রেটারি। আপনাদের কী দরকার বলুন?
মাঝবয়েসী লোকটি বললেন, রাজা রায়চৌধুরী, মানে, কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা হবে না?
জোজো বলল, উনি তো রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, ব্যস্ত আছেন। তা ছাড়া, আমাদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করলে তো ওঁর সঙ্গে দেখা করা যায় না!
ভদ্রলোক সন্তু আর জোজোর মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর জোজোর চোখে চোখ রেখে বললেন, তুমিই নিশ্চয়ই সন্তু? তোমার কথা অনেক শুনেছি। তুমি ভাই কাকাবাবুকে একটু বুঝিয়ে বলবে? আমরা খুব বিপদে পড়েছি।
সন্তু বাড়িতে হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পরে থাকে, জোজোর তুলনায় তাকে ছোট দেখায়। তা ছাড়া এমনিতেও সে শান্তশিষ্ট আর লাজুক ধরনের। জোজোর চেহারা সুন্দর, সে পরে আছে ফুল প্যান্ট, ফুল শার্ট, মাথার চুল ওলটানো আর কথা বলে চোখে-মুখে। সন্তু যে কতটা সাহসী আর জোজো যে কতটা ভিতু, তা ওদের চেহারা দেখে বুঝবার উপায় নেই।
জোজো সন্তু সেজে বলল, হ্যাঁ, আপনাদের কেসটা কী বলুন!
ভদ্রলোক বললেন, ইনি আমার দাদা বীরমোহন দত্ত আর আমার নাম রামমোহন দত্ত। কলেজ স্ট্রিটে আমাদের কাগজের দোকান। আমার দাদার সাত মেয়ে, একটিও ছেলে নেই। আমার তিন মেয়ের পর একটিমাত্র ছেলে। উনিশ বছর বয়েস, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে। তিনদিন আগে সে তার মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। টাকা-পয়সা নিয়ে যায়নি, কিছু নিয়ে যায়নি, সে কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে, ভেবে ভেবে আমরা মরে যাচ্ছি। তুমি ভাই কাকাবাবুকে বলো..
জোজো বলল, ছেলেটির কী নাম?
রামমোহন দত্ত বললেন, তপন, তপনমোহন দত্ত।
জোজো এবার হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ছবি? ছবি এনেছেন?
রামমোহন দত্ত বললেন,, হাঁ এনেছি। কালার, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট চারখানা ছবি। এই যে…
সন্তুও উঁকি মেরে ছবিগুলো দেখল। বেশ ভালই দেখতে ছেলেটিকে। রোগা-পাতলা, বড়বড় চোখ, থুতনিতে একটা আঁচিল। একটা ছবিতে তার হাতে একখানা ক্রিকেট ব্যাট।
রামমোহন দত্ত বললেন, তা হলে কি পঁচিশ হাজারের চেকটা…
জোজো পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করে বলল, সতেরো থেকে পঁচিশ তারিখ নেপাল, তারপর জয়পুরের মহারাজার চব্বিশখানা হিরে, মানস সরোবরের তিনটে চোখওয়ালা অদ্ভুত প্রাণী, প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়ার ফাইল চুরি, এর মধ্যে আবার মস্কো যেতে হবে দুবার, কী করে যে এত ম্যানেজ করবেন…, আপনাদের কেসটা মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী নিতে পারে দু মাস সতেরো দিন পর।
রামমোহন দত্ত বললেন, অ্যাঁ?
জোজো বলল, তার আগে উনি সময় দিতে পারবেন না!
রামমোহন দত্ত বললেন, অতদিন ছেলেটা নিরুদ্দেশ হয়ে থাকবে? খাবে কী? ওর মা-ও কিছু খাচ্ছেন না এই তিনদিন। তুমি ভাই প্লিজ কাকাবাবুকে বলে ব্যবস্থা করো, যাতে আমাদের কেসটা আগে নেন।
জোজো ভুরু তুলে বলল, আপনাদের জন্য কাকাবাবু নেপালের মহারাজা, জয়পুরের মহারাজা, ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে মিথ্যে কথা বলবেন? দু মাস সতেরো দিন পর্যন্ত আপনারা যদি অপেক্ষা করতে না পারেন…
বীরমোহন দত্ত এতক্ষণ পর বললেন, তবে আর এখানে বসে থেকে লাভ কী? রামু, চল, পুলিশের কাছেই যাই।
এই সময় আরও দুজন ভদ্রলোক দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, রাজা রায়চৌধুরী আছেন? আমাদের বিশেষ দরকার।
জোজো বলল, আপনাদের কী কে? খুন? নিরুদ্দেশ? চুরি?
ওঁদের মধ্যে একজন বললেন, কাল রাত্তিরে আমাদের বাড়িতে একটা খুন হয়েছে, সে আমাদের বাড়ির কেউ নয়, ছাদে পড়ে আছে ডেডবডি।
জোজো জিজ্ঞেস করল, ছেলে, না মেয়ে? ভদ্রলোক বললেন, মেয়ে।
জোজো বলল, আপনাদের বাড়ির কেউ নয়, তা হলে ডেড বডি ছাদে কী করে এল?
ভদ্রলোক বললেন, সেইটাই তো রহস্য! আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।
জোজো বলল, দু মাস সতেরো দিন।
বীরমোহন আর রামমোহন দত্ত চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে এঁদের কথা শুনছিলেন। এই নতুন ভদ্রলোকও রামমোহন দত্তর মতনই বললেন, আঁা?
জোজো গম্ভীরভাবে বলল, আপনাদের বাড়ির ওই রহস্যের সমাধান যদি মিস্টার রাজা রায়চৌধুরীকে দিয়ে করাতে চান, তা হলে দু মাস সতেরো দিন অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে পর্যন্ত উনি বুড। একটুও সময় নেই। এই দত্তবাবুদের জিজ্ঞেস করে দেখুন!
সবাই চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে দিয়ে জোজো বলল, ভাবছি আমি নিজেই একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলব।
সন্তু বলল, সেটা বোধ হয় তুই ভালই পারবি।
জোজো বলল, আমি যদি কাকাবাবু হতাম, তা হলে দত্তদের কাছ থেকে পঁচিশ হাজার টাকার অ্যাডভান্সটা নিয়ে নিতাম। ও ছেলেটা তো দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে বোঝা যাচ্ছে।
সন্তু বলল, তুই কোনওদিন কাকাবাবুর মতন হতে পারবি না। সেইজন্য কেউ তোকে আগে থেকেই পঁচিশ হাজার টাকা দিতেও চাইবে না।
একথাটা গায়ে না মেখে জোজো কথা ঘুরিয়ে বলল, দশ-দশটা দিদি। ওরে বাপ রে! আমি তপন দত্ত হলে আমিও বাড়ি ছেড়ে পালাতাম।
সন্তু হেসে বলল, বেশি দিদি থাকা তো ভালই। ঘুরে-ঘুরে সব দিদিদের বাড়িতে খাওয়া যায়।
জোজো বলল, দশটা দিদি মানে দশখানা জামাইবাবু, সেটা ভুলে যাচ্ছিস? সবাই মিলে কত উপদেশ দেবে।
সিঁড়ি দিয়ে ওরা উঠে এল দোতলায়। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, চলে গেছে তো?
জোজো বলল, শুধু ওরা নয়, আরও নতুন ক্লায়েন্ট এসেছিল, কাকাবাবু। তাদেরও বিদায় করে দিয়েছি।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি জোজোকে তোমার প্রাইভেট সেক্রেটারি রাখতে পারো। দারুণভাবে ম্যানেজ করল।
জোজো সন্তুর দিকে ফিরে বলল, টেকনিকটা বুঝলি তো? কাউকেই মুখের ওপর না বলতে নেই। কাকাবাবু পারবেন না কিংবা রাজি নন, তাও বলতে হল না। কাকাবাবু জোজোর মুখে সব শুনে খুব হাসতে লাগলেন।
ড্রয়ার খুলে দুটো চকোলেট বের করে দুজনকে দিয়ে বললেন, জোজো আমাকে এরকমভাবে রোজ বাঁচালে তো ভালই হত। কিন্তু পড়াশুনো ফেলে রোজ সকালে তো আর এখানে এসে বসে থাকতে পারবে না। আমি ভাবছি কয়েক দিনের জন্য কলকাতা ছেড়ে পালাব। সন্তু, তোর এখন পড়াশুনোর চাপ কীরকম? আমার সঙ্গে কোচবিহার যাবি!
জোজো সঙ্গে-সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কোচবিহারের মহারাজা আপনাকে নেমন্তন্ন করেছেন বুঝি?
কাকাবাবু বললেন, না হে জোজোবাবু, কোনও মহারাজা-টহারাজার সঙ্গে আমার আলাপ নেই। আমাকে তাঁরা নেমন্তন্ন করবেনই বা কেন? আমি যাচ্ছি বেড়াতে। সেইসঙ্গে খানিকটা কৌতূহলও মিটিয়ে আসা যাবে। তুমি ইউ এফ ও কাকে বলে জানো?
জোজো এমনভাবে সন্তুর দিকে তাকাল, যেন এইসব সহজ প্রশ্নের উত্তর সে নিজে দেয় না, তার সহকারীর ওপর ভার দেয়।
সন্তু বলল, আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট।
কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীর নানা জায়গায় নাকি এগুলো দেখা যায়। কেউ-কেউ বলে, উড়ন্ত চাকি। চৌকো, লম্বা, গোল অনেক রকমের হয়, আকাশে একটুক্ষণ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। অনেকের ধারণা ওগুলো পৃথিবীর বাইরে থেকে আসে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ একটারও ছবি তুলতে পারেনি। ওরকম যে সত্যিই কিছু আসে, তার কোনও নিশ্চিত প্রমাণও পাওয়া যায়নি। অথচ প্রায়ই শোনা যায়। কোচবিহার জেলার বনবাজিতপুর নামে একটা গ্রামে নাকি সেইরকম একটা ইউ এফ ও দেখা যাচ্ছে মাঝে-মাঝে।
সন্তু বলল, এত জায়গা থাকতে হঠাৎ এইরকম একটা গ্রামে কেন ইউ এফ ও আসবে?
কাকাবাবু বললেন, সেটাও একটা প্রশ্ন তো বটেই। সে-গ্রামের নোক নাকি দু-তিনবার দেখেছে, সেটার বর্ণনাও দিয়েছে। সে কথা ছাপা হয়েছে খবরের কাগজে, রেডিয়োতেও বলেছে। সুতরাং এত কাছাকাছি যখন ব্যাপার, তখন চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে এলেই তো হয়। তা হলে কিন্তু আজই যেতে হবে, দেরি করার কোনও মানে হয় না। বউদির মত আছে কি না জিজ্ঞেস কর।
মা স্নান করতে গেছেন, সন্তু উঠে এল নিজের ঘরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। মা-বাবা আপত্তি করবেন না, তা সন্তু জানে।
জোজো তার সঙ্গে-সঙ্গে এসে নিচু গলায় বলল, কাকাবাবু কীরকম মানুষ রে, সন্তু? পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে লোকে সাধাসাধি করছে সামান্য একটা কেস সম্ভ করার জন্য, সেটা না নিয়ে উনি নিজের পয়সা খরচা করে চললেন উড়ন্ত চাকি দেখতে কোচবিহার?
সন্তু বলল, একটু আগেই তো বললাম, তুই জীবনেও কাকাবাবুর মতন হতে পারবি না, তাই এসবের মর্মও বুঝবি না।
জোজো বলল, কোচবিহার এমন কিছু বেড়াবার মতন জায়গা নয়। আর উড়ন্ত চাকি-ফাকি দেখবারই বা কী আছে?
সন্তু কোনও উত্তর দিল না।
জোজো বলল, সরি সন্তু, এবারে আমি তোদের সঙ্গে যেতে পারছি না। জাপানের সম্রাট বাবাকে নেমন্তন্ন করেছেন, আমাকেও যেতে বলেছেন বিশেষ করে। কালই আমরা জাপান রওনা হচ্ছি। টোকিয়োতে হোটেল বুক করা হয়ে গেছে।
সন্তু এবার হাসিমুখে তাকাল। জোজোকে সঙ্গে নেওয়ার কথা কাকাবাবু একবারও বলেননি, তাই জোজোর অভিমান হয়েছে।
সন্তু বলল, তোর পায়ে ধরে সাধলেও যাবি না?
জোজো বলল, জাপানের সম্রাটের বোনের বিয়ে। বাবাকে দিয়ে কোষ্ঠী পরীক্ষা করাবেন। আমাদের না গেলে চলবে কী করে?
সন্তু বলল, তা অবশ্য ঠিক। জাপানের রাজবাড়ির নেমন্তন্ন ফেলে কি কোচবিহার যাওয়া যায়? ফিরে এসে তোর কাছে জাপানের গল্প শুনব।
জোজো বলল, তুই ক্যামেরা নিয়ে যাচ্ছিস তো! যদি উড়ন্ত চাকির ছবি তুলে আনতে পারিস, তা হলে তোকে আমি টোরা-টোরা-ফ্লোরা খাওয়াব।
সেটা যে কী জিনিস, তা আর জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না সন্তু।