০১. লোকটির মুখ লম্বাটে

লোকটির মুখ লম্বাটে।

চোখ দুটি তক্ষকের চোখের মতো। কোটির থেকে অনেকখানি বেরিয়ে আছে। অত্যন্ত রোগা শরীর। সরু সরু হাত। হাতের আঙুলগুলো অস্বাভাবিক লম্বা। কাঁধে ঝুলছে নীলরঙা চকচকে ব্যাগ। তার দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে একটি বিনীত ভঙ্গি আছে। নিশ্চয়ই কিছু-একটা গছাতে এসেছে।

দুপুরের দিকে এ রকম উটকো লোকজন আসে। এরা কলিং বেল টিপে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে হাত কচলায়। লাজুক গলায় বলে, আমি নিতান্তই একজন দরিদ্র ব্যক্তি, কাটা কাপড়ের টুকরো বিক্রি করি। আপনি কি অনুগ্রহ করে কিছু কিনবেন? কিনলে আমার খুব উপকার হয়।

এই লোক নিশ্চয়ই সে রকম কিছু বলবে। ইরিনা তাকে সে সুযোগ দিল না। লোকটি মুখ খুলবার আগেই সে বলল, আমাদের কিছু লাগবে না। আপনি যান।

লোকটি কিছুই বলল না চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল। ইরিনা কড়া গলায় বলল, বলেছি তো আমাদের কিছু লাগবে না।

আমি কিছু বিক্রি করতে আসি নি।

আপনি কে? কাকে চান আপনি?

আমি কে? তা কি তুমি বুঝতে পারছি না?

ইরিনা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল লোকটির দিকে। লোকটির দাঁড়িয়ে থাকার যে ভঙ্গিটিকে একটু আগেই বিনীত ভঙ্গি মনে হচ্ছিল, এখন সে-রকম মনে হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে লোকটি ভয়ঙ্কর উদ্ধত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে।

আপনার কি দরকার বলুন?

বাইরে দাঁড়িয়ে কি আর সবকিছু বলা যায়?

বাবা-মা কেউ ঘরে নেই, আপনাকে আমি ভেতরে আসতে বলব না।

লোকটি মেয়েদের রুমালের মত ছোট্ট ফুল আঁকা একটি রুমাল বের করে কপাল মুছল। ইরিনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আপনি কোনো খবর না দিয়ে এসেছেন।

লোকটি বলল, খবর না দিয়ে অনেকেই আসে। জরা আসে, মৃত্যু আসে এবং মাঝে মাঝে গ্যালাকটিক ইন্টেলিজেন্সের লোকজন।

তাহলে আপনি কি-?

লোকটি হাসল। নিঃশব্দ হাসি নয়- বেশ শব্দ করে হাসি। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, হাসির শব্দ অত্যন্ত সুরেলা। শুনতে ভালো লাগে। ইরিনা বলল, আসুন, ভেতরে আসুন।

শুভ দুপুর ইরিনা।

আপনি আমার নাম জানেন?

গ্যালাকটিক ইন্টেলিজেন্সের লোকজন যখন কারোর বাড়ি যায়, তখন বাড়ির লোকজনের নাম জেনেই যায়। সেটাই স্বাভাবিক, তাই না?

ইরিনা কথা বলল না। সে একদৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটি বলল, তুমি কি আমার কার্ড দেখতে চাও? স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমার পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়ার অধিকার তোমার আছে।

আমি কিছুই দেখতে চাই না। আপনি কেন এসেছেন? আমার কাছ থেকে কী জানতে চান?

লোকটি কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, আমি কিছুই জানতে bारे না।

তাহলে এসেছেন কি জন্যে?

তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে।

তার মানে? আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন?

ইরিনা, তুমি কি জান না ইন্টেলিজেন্সের লোকজনদের কোনো প্রশ্ন করা যায় না? বিধি নং চ ২১১/২, তুমি কি এই বিধি জান না? তোমাকে স্কুলে শেখান হয় নি?

হয়েছে।

তাহলে তুমি হয়তো চ ২১১/৩ বিধিটিও জািন।

হ্যাঁ, জানি।

বল তো বিধিটি কি?

ইরিনা যন্ত্রের মতো বলল, আপনি যদি আমাকে কোথাও যেতে বলেন, তাহলে যেতে হবে।

যদি যেতে অস্বীকার কর, তাহলে কি হবে বল তো?

প্ৰথম শ্রেণীর অপরাধ করা হবে।

এই অপরাধের শাস্তি কি জান?

জানি। কিন্তু আমি যাব না। আমার বাবা-মা না আসা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না।

লোকটি ছোটো ছোটো পা পেলে ঘরে মধ্যেই হাঁটছিল। হাঁটা বন্ধ করে চেয়ারে বসল। খুব আরামের একটা নিঃশ্বাস ফেলল। যেন এই বাড়ি-ঘর তার দীর্ঘদিনের চেনা। সে যেন নিতান্ত পরিচিত কেউ। অনেক দিন পর বেড়াতে এসেছে।

ইরিনা আবার বলল, বাবা-মা বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। বাবা-মা না ফেরা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকব।

এই কথাগুলো তুমি পর পর তিনবার বললে। একই কথা বারবার বললে কথা জোরাল হয় না।

লোকটি সিগারেট ধরাল। ছাই ফেলবার জন্যে নিজেই উঠে গিয়ে একটা এ্যাশট্রে আনল। ইরিনার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ কী যেন দেখল, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে খুব সহজ গলায় বলল, তোমার বাবা-মা আর এ বাড়িতে ফিরে আসবে না।

ইরিনা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী বলছে এই লোকটি! সে প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কি বলতে চান?

ঠিক এই মুহুর্তে তোমার বাবা-মা দুজনেই আছেন খাদ্য দপ্তরে। বেলা তিনটে পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবেন। তারপর তাদের পাঠান হবে প্রথম নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখান থেকে তাদের ঠিক পাঁচটায় নেয়া হবে সেন্ট্রাল কমিউনে। আরো শুনতে চাও?

না।

তুমি বোধ হয় আমার কথা বিশ্বাস করছ না?

না। ইন্টেলিজেন্সের লোকজন কখনো সত্যি কথা বলে না।

এটা তুমি ভুল বললে ইরিনা। শুধু মিথ্যা বললে মিথ্যা ধরা পড়ে যায়। মিথ্যা বলতে হয়। সত্যের সঙ্গে মিশিয়ে। আমরা এক হাজার সত্যি কথার সঙ্গে একটা মিথ্যে কথা ঢুকিয়ে দিই। কারো সাধ্য নেই সেই মিথ্যা ধরে। হা হা হা।

লোকটি সুরেলা গলায় হেসে উঠল। এমন একজন কু-দৰ্শন লোক এত চমৎকার করে হাসে কী করে!

ইরিনা, তুমি কি আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াবে? সেই সঙ্গে কিছু খাবার। আশা করি ঘরে কিছু খাবার আছে।

খাবার নেই। কপি খাওয়াতে পারি।

ইরিনা হিটারে পানি গরম করত লাগল। তার একবার ইচ্ছা হল রান্নাঘরের দরজা দিয়ে চুপিসারে চলে যায় কোথাও। কিন্তু তা সম্ভব হয়। এ রকম কিছু চিন্তা করাও বোকামি।

টেলিফোন বাজছে। ইরিনা তাকাল লোকটির দিকে। ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমি কি টেলিফোন ধরতে পারি?

হ্যাঁ পার।

টেলিফোন করেছেন ইরিনার বাবা। তার গলায় বারবার কথা আটকে যাচ্ছে। যেন কোনো কারণে তিনি অসম্ভব ভয় পেয়েছেন। কথার ফাঁকে ফাকে এবড় বড় করে শ্বাস ফেলছেন।

তুমি কোথেকে কথা বলছি বাবা?

খাদ্য দপ্তর থেকে ৷

তুমি কিছু বলবে?

না।

শুধু শুধু টেলিফোন করেছ?

ইয়ে মা শোন— আমাকে কোথায় যেন পাঠাচ্ছে।

কোথায় পাঠাচ্ছে?

তা তো জানি না। অনেকক্ষণ শুধু শুধু বসিয়ে রাখল। এখন বলছে-

কী বলছে?

ইরিনার বাবা খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। যেন কাউকে দেখে ভয় পেয়েছেন। অনেক কিছু বলার ছিল, বলা হল না। ইরিনা টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাচ্ছে। লোকটি তার দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বলল, কোনো লাভ নেই, কেউ টেলিফোন ধরবে না। সত্যি কেউ ধরল না। ইরিনার কাঁদতে ইচ্ছা! হচ্ছে, কিন্তু এই কুৎসিত লোকটিকে চোখের জল দেখাতে ইচ্ছা করছে না। কান্না চেপে রাখা খুব কঠিন ব্যাপার। এই কঠিন ব্যাপারটি সে কী করে পারছে কে জানে। কতক্ষণ পারবে তাও জানা নেই।

পানি ফুটছে। কফি বানিয়ে ফেল। চিনি বেশি করে দেবে। আমি প্রচুর চিনি খাই। বুদ্ধিমান লোকেরা চিনি বেশি খায়, এই তথ্য কি তুমি জান?

ইরিনা জবাব দিল না।

লোকটি কফি খেল নিঃশব্দে। তার ধরনধারণ দেখে মনে হয়, কোনো তাড়া নেই। দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থাকতে পারবে। কফি শেষ করেই সে তার নীল ব্যাগ থেকে কি-একটা বই বের করে পড়তে শুরু করল। বইয়ের লেখাগুলো অদ্ভুত, নিশ্চয়ই কোনো অপরিচিত ভাষা। লোকটি পড়তে পড়তে মুচকি মুচকি হাসছে। নিশ্চয় মজার কোনো বই। একটি লোহার রড হাতে নিয়ে চুপিচুপি লোকটির পেছনে চলে গেলে কেমন হয়। আচমকা প্ৰচণ্ড বেগে লোহার রডটি তার মাথায় বসিয়ে দেবে। ইরিনা মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই রকম কল্পনার কোনো মানে হয় না।

লোকটি হাতের ঘড়িতে সময় দেখল। বইটি বন্ধ করে নীল ব্যাগে রেখে বলল, সন্ধ্যা সাড়ে ছাঁটায় আমাদের ট্রেন। কাজেই অনেকখানি সময় আছে। রাতে খাওয়া-দাওয়া আমরা ট্রেনেই সারব। কাজেই রান্নাবান্নার জন্যে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। তুমি যদি সঙ্গে কিছু নিতে চাও, নিতে পাের। একটা মাঝারি ধরনের সুটকেস গুছিয়ে নাও।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

বিধি চ ২১১/৩; আমাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।

ইরিনা চুপ করে গেল। একবার ইচ্ছা হল গলা ফাটিয়ে কাদে। কিন্তু কী হবে কেন্দে? কে শুনবে?

তুমি কি সঙ্গে কিছুই নেবে না?

না।

খুব ভালো কথা। ভ্রমণের সময় মালপত্র যত কম থাকে, ততই ভালো। সবচে ভলো যদি কিছুই না থাকে। হা হা হা।

ইরিনা বলল, আমি কোনো অন্যায় করি নি। দুই শ পঞ্চাশটি বিধির প্রতিটি মেনে চলি। শৃঙ্খলা বোর্ড একবারও আমাকে সাবধান কার্ড পাঠায় নি। আপনি কেন শুধু শুধু আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন?

তুমি প্রতিটি বিধি মেনে চল, এটা ঠিক বললে না। এই মুহুর্তে তুমি বিধি ভঙ্গ করেছ। আমাকে প্রশ্ন করেছ।

আর করব না।

এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা। কাদছ কেন তুমি?

আমি কাঁদতেও পারব না? বিধিতে কিন্তু কাঁদতে পারব না, এমন কথা নেই।

তা নেই। তবে কাঁদলেই লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। আমি তা চাই না। আমি চাই খুব সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তুমি আমার সঙ্গে হাঁটবে। আমি চমৎকার সব হাসির গল্প জানি। সেই সব গল্প তোমাকে পথে যেতে যেতে বলল। শুনে হাসতে হাসতে তুমি আমার হাত ধরে হাঁটবে।

ইরিনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, দয়া করে বলুন, আমি কি করেছি।

লোকটি শান্ত গলায় বলল, আমি জানি না তুমি কি করেছ। সত্যি আমি জানি না। আমাকে শুধু বলা হয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে।

কোথায়?

সেটা তোমাকে বলতে পারব না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না। সহজ কথায় তুমি অত্যন্ত মূল্যবান।

কী করে বুঝলেন?

তোমাকে ন্যার জন্য আমকাএ পাঠান হয়েছে, সেই কারনেই অনুমান করছি। আমি কোনো হেঁজিপোঁজি ব্যক্তি নই, আমি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।

আমাকে এইসব কেন বলছেন?

যাতে অকারণে তুমি ভয় না পাও, সেজন্যে বলছি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। ঠিক তোমার মতো আমার একটি মেয়ে আছে। তার চোেখও নীল। সে-ও তোমার মতো সুন্দর।

আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আপনার কোনো মেয়ে নেই। কেউ মিথ্যা বললে আমি বুঝতে পারি। মিথ্যা বলার সময় মানুষের চোখের দৃষ্টি বদলে যায়।

তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আমি অবিবাহিত।

ইরিনা শান্ত স্বরে বলল, আপনি কি দয়া করে বলবেন, আমার বাবা-মা এ বাড়িতে ফিরে আসবেন কি না?

আমার মনে হয়, তারা আর ফিরে আসবে না।

ঘরে তালা লাগানোর তাহলে আর কোনো প্রয়োজন নেই, তাই না?

আমার মনে হয়, নেই।

আমি নিজেও বোধ হয়। আর কোনোদিন এ বাড়িতে ফিরে আসব না।

সেই সম্ভাবনাই বেশি।

চলুন আমরা রওনা হই।

আমার হাত ধর।

ইরিনা তার হাত ধরল। লোকটি বিনা ভূমিকায় একটা হাসির গল্প শুরু করল। লোকটির গল্প বলার ঢং অত্যন্ত চমৎকার। ইচ্ছা না করলেও শুনতে হয়। একজন মানুষ কী করে হঠাৎ একদিন ছোট হতে শুরু করলো সেই গল্প। ছোট হতে হতে মানুষটা একটা পিপড়ের মতো হয়ে গেল। তার চিন্তা-ভাবনাও হয়ে গেল পিপড়ের মতো। বড়ো কিছু এখন সে আর ভাবতে পারে না।

বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। কনকনে বাতাস বইছে। একটা ভারি জ্যাকেট ইরিনার গায়ে। লাল রঙের মাফলারে কান ঢাকা, তবু তার শীত করছে। রাস্তাঘাটে লোকজন দ্রুত কমছে। রাত আটটার ভেতর একটি লোকও থাকবে না। থাকার নিয়ম নেই। ফেডারেল আইন। বেরুতে হলে কমিউন থেকে পাস নিতে হয়। সেই পাস কখনো পাওয়া যায় না। রাতে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে ডাক্তার এসে চিকিৎসা করেন, তাকে হাসপাতালে যেতে হয় না। তবু মাঝেমধ্যে কেউ কেউ বের হয়। তারা আর ফিরে আসে না। কোথায় হারিয়ে যায় কে জানে?

তোমার শীত লাগছে ইরিনা?

না।

তুমি কিন্তু কাঁপছ?

আমার শীত লাগছে না।

তুমি কিন্তু এখনো আমার নাম জানতে চাও নি।

আপনার নাম দিয়ে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।

তা খুবই ঠিক। তোমার বয়স কত ইরিনা?

ইন্টলিজেন্সের লোক যখন কারো কাছে আসে, তখন তার নাম এবং বয়স জেনেই আসে।

ঠিক। খুবই সত্যি কথা। তোমার বয়স এপ্রিলের তিন তারিখে আঠার হবে।

ইরিনা হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল, আপনি আর কী কী জানেন আমার সম্বন্ধে?

তুমি লাল ও বেগুনি- এই দুটি রঙ খুব পছন্দ করা। তোমার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। তোমার পছন্দের বিষয় হচ্ছে প্রাচীন ইতিহাস। তুমি এই বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছি। তুমি খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে এবং তুমি…

থাক, আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না।

লোকটি হাসতে লাগল। যেন বেশ মজা পেয়েছে। সিকিউরিটির একটি গাড়ি তাদের সামনে এসে থামল, কিন্তু লোকটির হাসি বন্ধ হল না। গাড়ি থেকে দুজন অফিসার লাফিয়ে নামল। দুজনের চেহারাই সুন্দর। চকলেট রঙের ইউনিফর্মেও তাদের ভালো লাগছে।

আপনাদের সন্ধ্য পাস দেখতে চাই।

এখনই সন্ধ্য পাস দেখতে চান? আটটা এখনো বাজে নি। আটটা বাজতে দিন।

অফিসার দুজনে মুখ কঠোর হয়ে গেল। সে তাকাল তার সঙ্গীর দিকে। সঙ্গী তীক্ষ্ণ গলায় বলল, যা করতে বলা হয়েছে, করুন।

ইরিনা দেখল ইন্টেলিজেন্সের লোকটি ওদের দুজনকে কী যেন দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে অফিসার দুজনেই হকচাকিয়ে গেল। এক জনের মুখ অনেকখানি লম্বা হয়ে গেল। সে টেনে টেনে বলল, স্যার, আপনারা কোথায় যাবেন বলুন, আমরা পৌঁছে দেব।

আমার হাঁটতে ভালো লাগছে।

তাহলে আমরা কি আপনার পেছনে পেছনে আসব?

তারাও কোনো প্রয়োজন দেখছি না।

ইরিনা লক্ষ করল, লোক দুটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। যেন তারা চোখের সামনে ভূত দেখছে। একজন পকেট থেকে রুমাল বের করে এই শীতেও কপালেরর ঘাম মুছল। ইরিনা অনেক দূর এগিয়ে যাবার পর পেছন ফিরে দেখল, অফিসার দুজন তখনাে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাদের দেখছে। একজন ওয়াকিটকি বের করে কী যেন বলছে। সম্ভবত তাদের কথাই বলছে। কারণ এরপর বেশ কিছু সিকিউরিটির লোকজনের সঙ্গে দেখা হল। তারা কেউ কোনো প্রশ্ন করল না। স্যালিউট দিয়ে মূর্তির মতো হয়ে গেল। ইরিনার সঙ্গের লোকটি প্রত্যেকের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলল। যেমন—

কি, তোমরা ভালো? আজি বেশ শীত পড়েছে মনে হয়। আবহাওয়ার প্যাটার্ন বদলে যাচ্ছে, তাই না?

এরা এইসব কথাবাতাঁর উত্তরে কিছু বলছে না। শুধু মাথা নাড়ছে। যেন কথা বলাই একটা ধৃষ্টতা। ইরিনা একসময় বলল, ওরা আপনাকে দেখে এরকম করছে কেন?

তোমাকে তো বলেছি আমি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।

আপনার কী নাম?

তুমি একটু আগেই বলেছি, আমার নাম জানতে তুমি আগ্রহী নও। কি বল নি এমন কথা?

বলেছি।

এখন কেন নাম জানতে চাও?

আপনার যদি ইচ্ছা হয় বলতে পারেন।

ইচ্ছা-অনিচ্ছা নয়, তুমি জানতে চাও কিনা সেটা বল।

না থাক, আমি জানতে চাই না।

আমার নাম অরচ লীওন।

ইরিনা সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। অরচ লীওন হচ্ছেন গ্যালাকটিক ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। তার নাম না জানার কোনো কারণ নেই। এরকম একজন মানুষ তার মতো সাধারণ একটি মেয়েকে নিতে এসেছেন, কেন?

ইরিনা, তোমার কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?

না, কষ্ট হচ্ছে না।

শীল লাগছে, তাই না?

জি লাগছে।

এই তো এসে পড়েছি। ট্রেনে উঠলেই দেখবে ভালো লাগছে।

ভালো লাগলেই ভালো।

আর একটা গল্প বলব, শুনবে?

বলুন।

তারা শহরের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে। স্টেশনের লাল বাতি দেখা যাচ্ছে। বাতি জুলছে ও নিভছে। চারদিকে নীরব-নিস্তব্ধ। কুয়াশা ঘন হয়ে পড়েছি। ইরিনা ফিসফিস করে বলল, আমি চলে যাচ্ছি, আর কোনো দিন ফিরে আসব না।