লী আকাশের দিকে তাকাল।
লী যা করে, অন্য দুজনও তাই করে। তারাও আকাশের দিকে তাকাল। আকাশের রঙ ঘন হলুদ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে বলেই হলুদ রঙ ক্ৰমে ক্ৰমে ঘঘালাটে সবুজ বর্ণ ধারণ করছে।
লী হঠাৎ বলল, আকাশের বাইরে কী আছে?
এই প্রশ্ন আগেও অনেক বার করা হয়েছে, তবু প্রতিবারই মনে হয় এই যেন প্রথম বারের মতো করা হল। অয়ু মৃদু স্বরে বলল, আকাশের বাইরে আছে আকাশ।
তার বাইরে? তার বাইরে আছে আরেকটি আকাশ।
লী আর প্রশ্ন করল না। আজকাল অয়ু কেমন যেন যুক্তিহীন কথা বলে। আকাশের বাইরে আবার আকা কি? লী বলল, তোমার শরীর ভালো আছে অয়ু?
ভালো।
তোমার পা কেমন?
অয়ু উত্তর দিল না। অর্থাৎ অয়ুর পা ভালো নেই। অথচ একটু আগেই বলেছে শরীর ভালো। কোনো মানে হয় না। যুক্তিহীন কথা।
ঠাণ্ডা বাতাস দিতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে বাতাসের বেগ বাড়বে। সেই সঙ্গে দ্রুত কমতে থাকবে তাপ। মধ্যরাতে চারদিক হবে হিমশীতল। লী বলল, চল এবার যাওয়া যাক।
তারা দুজন কথা বলল না। দুজনেই তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। লী আবার বলল, চল আমরা নেমে পড়ি।
কোথায়? আমরা কোথায় যাব?
উত্তর দিয়েছে নীম। লী লক্ষ করল নীমের কথাবার্তার ধরন হতাশাগ্ৰস্তের মতন। এটি ভালো লক্ষণ নয়। তাদের সঙ্গে আরো একজন ছিল। সেও এরকম কতাবার্তা বলতে শুরু করেছিল। এ সব খুব খারাপ লক্ষণ। লী কঠিন স্বরে বলল, নীম, তুমি একটু আগে বলেছ, আমরা কোথায় যাব?
হ্যাঁ বলেছি।
তুমি কি যেতে চাও না কোথাও?
না।
কেন না?
কোথায় যাব বল?
তা ঠিক। খুবই ঠিক। যাওয়ার জায়গা কোথায়? যেখানেই যাওয়া যাক, সেই একই দৃশ্য। প্রকাণ্ড সব দৈত্যকৃতি হিমশীতল পাথর। ঘন কৃষ্ণবর্ণ বালুকারাশি। যে দিকে যত দূর যাওয়া যায়—একই ছবি। তারা তিন জন প্রতিটি পাথরের অবস্থান নিখুঁতভাবে জানে। তারা জানে, ঠিক কোথায় বালির ঘন কালো রঙ হালকা গেরুয়া হয়েছে।
লী বলল, চল আমরা আরেকবার সেই ঘরটি দেখে আসি। অয়ু এবং নীম উত্তর দিল না। লী বলল, এখন রওনা হলে সকালের মধ্যে আমরা পৌছে যাব।
সেই ঘরটি আমরা ছয় লক্ষ নয় শ এগারো বার দেখেছি।
আরেক বার দেখব। ছয় লক্ষ নয় শ বারো বার হবে।
অয়ু বলল, আমি যেতে চাই না। আমার পা টিতে কোনো অনুভূতি নেই। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমরা যাও।
তুমি কী করবে?
আমি বসে থাকব এখানে। তোমরা আমাকে একটি সমস্যা দিয়ে যাও। আমি সেই সমস্যা নিয়ে চিন্তা করব। বেশ একটি জটিল সমস্যা দিয়ে যাও।
তোমাকে একা ফেলে যাব?
হ্যাঁ, এটি ভালোই হবে। আমি আশা করে থাকব, তোমরা হয়ত নতুন কোনো খবর নিয়ে আসবে। আশায় আশায় সময় ভালো কাটবে।
নীম বলল, তোমার পায়ের ব্যথা কি অনেক বেড়েছে?
অয়ু জবাব দিল না।
লী এবং নীম ঠাণ্ডা পাথরের গা বেয়ে নিচে নেমে এল। তারা অয়ুকে একটি সমস্যা দিয়ে এসেছে। সমস্যাটি হচ্ছে–আমাদের সঙ্গে সেই ঘরটির সম্পর্ক কী?
অয়ু ভাবতে শুরু করল। তার পায়ের ব্যথা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যথা ভুলতে হলে সমস্যাটি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। অয়ু আরাম করে বসতে চেষ্টা করল। সে তার এগারোটি পা লম্বালম্বি করে চারদিকে ছড়িয়ে দিল। মাথার দুপাশের চারটি খ ঢুকিয়ে নিল শরীরের ভেতর। এখন লুখগুলির আর প্রয়োজন নেই। অয়ু কোনো শব্দ শুনতে চায় না। চারদিকে থাকুক সীমাহীন নিস্তব্ধতা। শব্দে চিন্তার ব্যাঘাত হবে। অয়ু ভাবতে শুরু করল।
ঘর সব মিলিয়ে ছটি। ছটি ঘরই প্ৰকাণ্ড, প্রায় আকাশছোয়া। এই ছয়ের সঙ্গে কি আমাদের কোনো যোগ আছে? আমাদের পা এগারোটি। প্রতিটি পায়ে তিনটি করে আঙুল, মোট সংখ্যা তেত্রিশ। তিনটি কর্মী-পায়ে আছে একটি করে বাড়তি আঙুল–সর্বমোট ছত্রিশ। তার বর্গমূল হচ্ছে ছয়। না, এই মিলটি চেষ্টাকৃত। এদিকে না ভাবাই উচিত। তাহলে ভাবা যাক, এই ঘরগুলি কি আমাদের জন্যে তৈরি হয়েছে? উত্তর হচ্ছে না। এত প্রকাণ্ড ঘর আমাদের জন্য হতে পারে না। কারণ এই ঘরগুলির ভেতর দীর্ঘ সময় থাকা যায় না। অন্ধকার ঘর। অন্ধকারে আমরা থাকতে পারি না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে আলো দরকার। তার উপর ঘরের মেঝেগুলি অসম্ভব মসৃণ। মসৃণ মেঝেতে আমরা চলাফেরা করতে পারি না। এই ঘর আমাদের জন্যে তৈরি হলে মেঝে হত খসখসে।
অয়ু হঠাৎ অন্য একটি জিনিস ভাবতে বসল। সে দেখেছে, কোনো একটি জটিল সমস্যা নিয়ে ভাববার সময় হঠাৎ করে অন্য কিছু ভাবলে ফল খুব ভালো হয়। আবার সমস্যাটিতে ফিরে গেলে অনেক নতুন যুক্তি আসে মাথায়। অয়ু ভাবতে লাগল, আকাশের কোনো সীমা আছে কি? প্রতিটি জিনিসের সীমা আছে। পাথরগুলির সীমা আছে। ঘরগুলির সীমা আছে। ধূলিকণার সীমা আছে। কাজেই আকাশের একটি সীমা থাকা উচিত। এই যুক্তির ভেতর দুর্বলতা কী কী আছে? প্রথম দুর্বলতা, যেসব জিনিসের সীমা আছে, তাদের স্পর্শ করা যায়। কিন্তু আকাশ স্পর্শ করা যায় না। তাহলে যেসব জিনিস স্পর্শ করা যায় না, সেসব কি সীমাহীন? একটি জটিল সমস্যা। তিন জন এক সঙ্গে বসে ভাবতে হবে। অয়ু আবার ফিরে গেল ঘরের সমস্যায়। ঘরগুলির সঙ্গে তাদের সত্যি কি কোনো সম্পর্ক আছে।
ঘরগুলি তৈরি হয়েছে এমন সব বস্তু দিয়ে, যা এখানে পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারটিতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই একটি জিনিস তারা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেছে। ঘরের কম্পনমাত্রা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি অত্যন্ত রহস্যময়। যে জিনিসগুলি এখানে আছে, তাদের কম্পনমাত্রা এখানকার মতোই হওয়া উচিত। কিন্তু ঘরগুলি অন্য রকম। রহস্য! বিরাট রহস্য! অয়ু নিজের পায়ের যন্ত্রণার কথা ভুলে গেল। তাপমাত্রা যে অসম্ভব নিচে নেমে গেছে, তাও ঠিক বুঝতে পারল না। কোনো একটি রহস্যময় সমস্যা নিয়ে ভাবার মতো আনন্দ আর কিসে হতে পারে?
কিন্তু আয়ু বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না। আচমকা সে সমস্ত শরীরে একটি তীব্র কম্পন অনুভব করল। যেন একটি শক্তিশালী আলো হঠাৎ তার শরীরে এসে পড়ছে। অয়ু চোখ মেলে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। ঘরগুলির মতোই প্ৰকাণ্ড কোনো একটি জিনিস আকাশ থেকে নেমে আসছে। অয়ু দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করল। দ্রুত ভাবতে হবে অত্যন্ত দ্রুত। অয়ুর মাথার দুপাশের চারটি খ বেরিয়ে মাথার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। জিনিসটির কম্পনমাত্রা জানতে হবে। অয়ু দিশাহারা হয়ে গেল। জিনিসটির কম্পন নেই। একটা হতে পারে না। এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। সব জিনিসের কম্পন আছে। তার কম্পনও থাকতে হবে।
দ্রুত ভাবতে হবে। দ্রুত। জিনিসটির মধ্যে আছে অকল্পনীয় শক্তি। কারণ তার উপস্থিতির জন্যে যে পাথরটির উপর অয়ু বসে আছে, তার কম্পনমাত্রা বেড়ে গেছে। এ রকম অবিশ্বাস্য ব্যাপার কী করে হয়! অয়ু বলল, কে, তুমি কে?
উত্তর নেই। অয়ু আবার বলল, আমার নাম অয়ু। আমরা তিন জন এখানে থাকি। তুমি কে?
জিনিসটি আকাশের গায়ে স্থির হয়ে আছে।
কম্পনহীন শক্তির আধার। তুমি আমার কথার জবাব দাও।
জবাব নেই। কোনো জবাব নেই। অয়ু লক্ষ করল, জিনিসটি থেকে দুটি তীব্ৰ আলোকবিন্দু এসে পড়েছে নিচে। আলোকবিন্দু দুটি নড়াচড়া করছে।
দয়া করে আমার কথার জবাব দাও। প্রতিদানে আমি তোমাদের সমস্যার জন্যে ভাবতে বসব।
জবাব পাওয়া গেল না। অয়ু দেখল, প্ৰকাণ্ড সেই জিনিসটি থেকে একটি ছোট্ট কিছু দ্রুত নিচে নেমে আসছে।
যে জিনিসটি আসছে তার কম্পন আছে। অয়ু ভালো করে দেখবার জন্যে পাথরের গা বেয়ে নেমে এল। জিনিসটির কম্পনমাত্রা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার সঙ্গে মিল নেই। ঘরগুলির সঙ্গে মিল নেই।
মহাশূন্যযান থেকে যে স্কাউটশিপ গ্রহটিতে নেমে এল তার আরোহী দুজন অবাক হয়ে মন্তব্য করল এটা কেমন জায়গা? কী কুৎসিত! এই সব জায়গায় স্কাউটশিপ পাঠানো অর্থহীন। শক্তি ও সম্পদের নিদারুণ অপচয়।