০১. লাল রঙের নতুন মোটরবাইকটা

লাল রঙের নতুন মোটরবাইকটাকে ইতিমধ্যে জলপাইগুড়ি শহরের অনেকেই চিনে গিয়েছে। শহরের সবাই জানে রোজ সকাল আটটায় বাইকটা কদমতলা থেকে রূপশ্রী সিনেমার সামনে দিয়ে থানাটাকে বাঁ দিকে রেখে একটু এগিয়েই বাঁ দিকে করলার ধার ঘেঁষে হাকিমপাড়ার দিকে চলে যাবে। কেউ-কেউ তো ওই যাওয়া দেখেই বুঝে নেয় এখন আটটা বাজে। মোটরবাইকটা চালাতে খুব আরাম পায় অর্জুন।

বাইকটা উপহার দিয়েছেন নন্দিনীর বাবা দিল্লির মিস্টার রায়। সেই যে নন্দিনীরা চার বন্ধু মিলে নর্থবেঙ্গলে বেড়াতে এসে ঝামেলায় পড়েছিল, তা থেকে উদ্ধার করেছিল বলে তিনি ওই উপহারটি দিয়েছেন। অবশ্যই উপহারটি এসেছিল অমলদার মারফত।

প্রত্যেক সকালে লাল বাইক চালিয়ে অমল সোমের বাড়িতে যাওয়া অভ্যেস অর্জুনের। সেখানে গিয়ে বইপত্তর ঘাঁটে, হাবুর দেওয়া চা খায়। কখনও-সখনও মেজাজ ভাল থাকলে অমলদা গল্প করেন। সত্যসন্ধানের ব্যাপারে তিনি এখন খুব সক্রিয় ভূমিকা নেন না বটে, তবে থানার নতুন দারোগা শ্রীকান্ত বক্সি সমস্যায় পড়লেই ওঁর কাছে ছোটেন।

আজ রূপশ্রী পেরিয়ে থানার সামনে আসতেই অর্জুন দেখল থানার গেটের সামনে শ্রীকান্ত বক্সি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। পাশেই নীল রঙের অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখতে পেয়েই দারোগাবাবু হাত তুললেন, তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি হে। অর্জুন গতি থামাল।।

শ্রীকান্ত বক্সি এগিয়ে এলেন, আমাকে এখনই একটু বেলাকোবায় যেতে হবে। এঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি হরিপদ সেন। আমার কাছে এসেছিলেন অমলবাবুর ঠিকানার জন্য। থাকেন দমদম এয়ারপোর্টের কাছে। এর নাম হল অর্জুন। আমাদের শহরের গৌরব ও। অনেক রহস্য উদ্ধার করেছে। অমলবাবুর শিষ্য।

অর্জুন নমস্কার করতেই ভদ্রলোক প্রতিনমস্কার করলেন। অর্জুন বলল, ওই গাড়িটা কি আপনার?

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, না, শিলিগুড়ি থেকে ভাড়া করেছি।

ও। আপনি ড্রাইভারকে বলুন আমাকে ফলো করতে।

করলা নদীর ধার দিয়ে যেতে-যেতে পেছনে তাকিয়ে সে দেখল, গাড়িটা ঠিকঠাক আসছে। একেবারে কলকাতা থেকে কোনও ক্লায়েন্ট অমলদার খোঁজে আসছে মানে কেউ ওঁকে আসতে বলেছেন। অমলদা নিজে সক্রিয় ভূমিকা নেন না যখন, তখন তাকেই কাজটা করতে হবে। কী ধরনের কাজ তা আন্দাজে না এলেও বেশ উত্তেজনা বোধ করছিল সে। কলকাতায় যেতে হবে নাকি এব্যাপারে?

অমল সোমের বাড়ির গেটে বাইক থামিয়ে সে হাত তুলল। গেট খুলে বাইকটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে দেখল ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে পড়েছেন। সে বলল, এটাই অমলদার বাড়ি। আসুন আমার সঙ্গে।

একটু এগোতেই হাবুকে দেখতে পাওয়া গেল বাগানে। মরা পাতা ছাঁটছে। ইশারায় অমলদাকে খবর দিতে বলতেই দাঁত বের করে দেখিয়ে হাবু ভেতরে চলে গেল। বসার ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় উঠে অর্জুন ভদ্রলোককে বলল, আপনি একটু ভেতরে বসুন।

ভদ্রলোক বললেন, বাঃ, বেশ বড় বড় ফুল হয়েছে তো!

অর্জুন হাসল, এসবই হাবুর কৃতিত্ব। ওর জিভ কথা বলতে পারে না কিন্তু হাত কথা বলে।

হাত কথা বলে? হরিপদ সেন মাথা নাড়লেন, চমৎকার বললেন ভাই।

হরিপদ সেনের বয়স ষাটের ধারেই। একটু অস্বস্তি হলেও আপনি বলার জন্য এখনই আপত্তি করল না অর্জুন। কাজ করতে গিয়ে নানান মানুষের সংস্পর্শে এসে এটুকু পরিবর্তন হয়েছে। সে হরিপদ সেনের চেহারাটা দেখল। হাওয়াই শার্ট-প্যান্ট-চশমায় বেশ নাদুস-নুদুস চেহারা। পায়ে বেশ দামি জুতো। শিলিগুড়ি থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে রেখেছেন, মানে পকেটে ভাল টাকা আছে। লোকটার আঙুলে কোনও আংটি নেই। চেয়ারে বসার পর বোঝ। গেল ডান হাতের কড়ে আঙুল অনেকখানি বাঁকা। ইনি কী করেন তা সে আন্দাজ করতে পারল না।

আপনি এদিকে এর আগে এসেছেন? অর্জুন সময় কাটানোর জন্য প্রশ্ন করল।

অনেকবার। ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না। বিদ্যাসাগরী চটির আওয়াজ পাওয়া গেল। ইদানীং অমলদার খুব পছন্দ ওই চটি। ভেতরের দরজায় শব্দটা থাকতেই অমলদাকে দেখা গেল। ঝুল ফতুয়া আর পাজামা পরা। দেখা হওয়ামাত্র বললেন, ওহে অর্জুন, তোমার-আমার জন্য একটা ভাল খবর আছে।  তারপরেই হরিপদবাবুর ওপর নজর যাওয়া মাত্রই দুটো হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার। আমি অমল। আমার বাড়িতে আপনি এসেছেন, আগে আপনার সঙ্গেই কথা বলা উচিত ছিল। বসুন, বসুন। বলতে বলতে একটি চেয়ার টেনে নিলেন তিনি। হরিপদবাবু মৃদু হেসে বললেন, আমি আপনার নাম শুনেছি আমাদের প্রোফেসর বনবিহারী ভট্টাচার্যের কাছে। একটি অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে সাহায্যের আশায় আপনার কাছে ছুটে এসেছি আমি।

অর্জুন বলল, থানার সামনে শ্রীকান্তবাবু ওঁকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অর্জুন আলাপ করিয়ে দিল।

শ্রীকান্তকে আগেই চিনতেন? অমলদা জিজ্ঞেস করলেন।

না, না। আপনি জলপাইগুড়িতে আছেন এইটুকুই জেনেছিলাম। ভাবলাম, থানায় গেলে নিশ্চয়ই আপনার ঠিকানাটা জানা যাবে।

হরিপদবাবু দুই হাঁটুর ওপর হাত রেখে সোজা হয়ে বসলেন।

আপনার সমস্যাটা কী? খুবই অনাগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন অমলদা।

একটি মানুষের গতিবিধি বের করতে হবে আপনাকে।

ওঃ, সরি। এজন্য কলকাতা থেকে এতদূরে এলেন কেন? কলকাতায় অনেক এজেন্সি আছে, যাদের বললে সাগ্রহে করে দেবে। অমল সোম উঠে দাঁড়ালেন।

আপনি একটু শুনুন মিস্টার সোম। আমি জানি প্রস্তাবটা খুবই হাস্যকর শোনাবে, কিন্তু উপায় নেই। সাধারণ ডিটেকটিভ এজেন্সির পক্ষে কাজটা করা সম্ভব নয়। প্রফেসর বনবিহারী আমাকে বললেন আপনিই ঠিক মানুষ। আমি যাঁর গতিবিধি জানতে চাই তি এখনকার মানুষ নন। তিনি ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।

অদ্ভুত। ইন্টারেস্টিং। অমল সোম বসে পড়লেন আবার, এতদিন জীবিত মানুষ নিয়ে কাজ করেছি! মৃত মানুষ, তাও আবার চারশো দশ বছর আগে মৃত মানুষের কেস নিয়ে কেউ আসবেন ভাবতে পারিনি। মানুষটির নাম কি আমরা জানি?

জানা স্বাভাবিক। অন্তত ইতিহাসের বইয়ে দু-চার লাইন প্রত্যেকেই একসময় পড়েছি। ওঁর নাম যাই হোক, ইতিহাস ওঁকে কালাপাহাড় নামে কুখ্যাত করেছে।

কালাপাহাড়! অমলদাকে এমন বিস্মিত হতে অর্জুন এর আগে কখনও দেখেনি।

হরিপদ সেন কথা বলতে যাচ্ছিলেন, এই সময় হাবু এল চায়ের ট্রে নিয়ে। সেইসঙ্গে জলপাইগুড়ির সুর্য বেকারির তৈরি সুজির বিস্কুট। দামি কম্পানির বিস্কুটে আজকাল মন ভরছে না অমলদার। অর্জুন জানে এই বিস্কুট মাসখানেক এ-বাড়িতে চলবে। কিন্তু চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়েও সে হরিপদ সেনকে অবাক হয়ে দেখছিল। কালাপাহাড় লোকটি সম্পর্কে সে ইতিহাসে যা পড়েছে তাতে ভয়ই হয়। ওঁর নামকরণেই সেটা বোঝা যায়। এমন একটি মানুষের গতিবিধি জানতে চারশো বছর পর কেউ উৎসুক হবেন কেন?

অমলদার জন্য চা আসেনি। তিনি এ-সময় চা খান না। বললেন, মিস্টার সেন, আপনি কি কলেজে-টলেজে ইতিহাস নিয়ে পড়াচ্ছেন? মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, না, না। আমার একটা ছোটখাটো ব্যবসা আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, চমৎকার চা। দার্জিলিং-এর?

অমলদা হাসলেন, না। এটা ড়ুয়ার্স অসম দার্জিলিং মিলিয়ে একটা ককটেল।

হরিপদবাবু নিবিষ্ট মনে কয়েক চুমুক দিয়ে বললেন, কালাপাহাড় এ-অঞ্চলে দীর্ঘকাল ছিলেন। ইতিহাস বলছে লোকটি অত্যন্ত ভয়ানক। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে তিনি খুবই নিঃসঙ্গ ছিলেন। এই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, তখন অবশ্য জেলা হিসেবে চিহ্নিত ছিল না, উনি ঘোরাফেরা করেছেন। কিন্তু কোথায়-কোথায় ছিলেন এই ডিটেলস পাওয়া যাচ্ছে না। আপনারা যদি সেটা বের করে দেন…।

কেন? আচমকা প্রশ্নটি বেরিয়ে এল অর্জুনের মুখ থেকে।

অমলদা মাথা নাড়লেন, গুড। এই প্রশ্নটি আসা খুবই স্বাভাবিক। কেন আপনি এই ঐতিহাসিক চরিত্রটির সম্পর্কে এত আগ্রহী? আপনি কি ইতিহাসের ছাত্র?

হরিপদ সেন একটু ইতস্তত করলেন, আজ্ঞে না। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। আগ্রহী হওয়ার একটা কারণ ঘটেছে। আমার ঠাকুদার ভাই বিয়ে-থা করেননি। তিনি থাকতেন পুরীতে। একাই। প্রায় নব্বই বছর বয়স। আমার সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। শেষবার পুরীতে গিয়েছিলাম বছর পনেরো আগে। হঠাৎ মাস তিনেক আগে তিনি লেখেন আমাকে সেখানে যেতে। বিশেষ দরকার। গিয়েছিলাম। দেখলাম উনি খুবই অশক্ত হয়ে পড়েছেন। মনে-মনে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছেন। উনি আমাকে কিছু কাগজপত্র দিলেন। এই কাগজগুলো প্রায় দুশো বছর আগে ওঁর প্রপিতামহ লিখেছিলেন। ইনি যক্ষের মতো সব আগলে রেখেছিলেন। আমায় বললেন, ইচ্ছে হলে হদিস করতে পারিস।

কিসের হদিস?

কাগজপত্র দেখলে আপনি বুঝবেন ব্যাপারটা। সংক্ষেপে যেটুকু জেনেছি, বলি। আমরা আসলে কণাটকের মানুষ। পাল যুগে আমাদের কোনও পূর্বপুরুষ আরও অনেকের সঙ্গে গৌড়ভূমিতে আসেন। তাঁরা যুদ্ধ করতে জানতেন, ফলে পালরাজাদের সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতে অসুবিধে হয়নি। আপনারা নিশ্চয়ই সামন্ত সেন, হেমন্ত সেন, বিজয় সেনের নাম শুনেছেন, যাঁরা সেনসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের উত্তরাধিকারী হলেন বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন। আমার পূর্বপুরুষরা এঁদের রাজত্বে ভাল মর্যাদায় ছিলেন। তারপর মহম্মদ বকতিয়ার খিলজি এলেন, মুসলমান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও আমার পূর্বপুরুষরা রাজকর্মচারীর পদ হারালেন না। সুলেমান কিরানি এবং তার ছেলে দাউদের সেনাপতি ছিলেন কালাপাহাড়। ইনি যখন পুরী আক্রমণ করেন তখন আমার এক পূর্বপুরুষ তাঁর অনুগামী হন। কিন্তু সেখানে কালাপাহাড়ের আচরণে সন্তুষ্ট না হয়ে সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করে পুরীতেই থেকে যান। পরে আমার ঠাকুদা ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশে কিন্তু তাঁর ভাই থেকে গিয়েছিলেন। মোটামুটি এই হল বৃত্তান্ত।

খুবই ইন্টারেস্টিং। কিন্তু এত তথ্য কি ওই কাগজপত্রে পেয়েছেন আপনি?

না। কালাপাহাড়ের সঙ্গে আমার যে পূর্বপুরুষ পুরীতে অভিযান করেছিলেন তাঁর নাম নন্দলাল সেন। তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা লেখা আছে। পরে আমি কিছুটা ছোট ঠাকুদার কাছে, কিছুটা ইতিহাস বই ঘেঁটে, আবার প্রোফেসর ভট্টাচার্যের কাছে শুনে এইটে খাড়া করেছি। হরিপদ সেন রুমালে মুখ মুছলেন। এই না-গরম আবহাওয়াতে ওঁর ঘাম হচ্ছিল।

অমল সোম বললেন, আপনার বংশের ইতিহাস শুনলাম। কিন্তু আপনি কেন কালাপাহাড় সম্পর্কে এতটা আগ্রহী তা বোধগম্য হচ্ছে না।

ভদ্রলোক জবাব না দিয়ে উসখুস করতে লাগলেন।

অমল সোম বললেন, দেখুন। আমি এখন সাধারণ কেস নিই না। ভাল লাগে না। যা করার অর্জুনই করে। কিন্তু এটিকে সাধারণ বলা যায় না। আপনাকে সাহায্য করতে পারি যদি আপনি কোনও কথা গোপন না করেন।

আমি জানি, জানি।  ভদ্রলোক রুমাল পকেটে ঢোকালেন, আসলে বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। প্রথমত, তথ্যটা ভুল হতে পারে। দ্বিতীয়ত, আর কেউ জানুক সেটা আমি চাইছি না। ভুল হলেও নয়। বুঝতে পারছেন?

অমলদা বললেন, ডাক্তারকে কোনও রুগী রোগের কথা বললে তিনি তা পাঁচজনকে বলে বেড়ান না। আপনি যদি ভাবেন অর্ধেক জেনে কাজ করব তা হলে ভুল ভেবেছেন।

হরিপদ সেন বললেন, ইয়ে, ছোট ঠাকুদার প্রপিতামহ লিখেছেন, নন্দলাল সেন কালাপাহাড়ের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ এবং অসমে অভিযান করেছিলেন। এই সময় অজস্র সোনা কালাপাহাড় মাটির তলায় গোপনে সরিয়ে রাখেন। তাঁর নবাবও কিন্তু এই খবর জানতেন না। নন্দলাল মনে করতেন সেই সোনার একটা অংশ তাঁর পাওনা। কালাপাহাড় তাঁকে সেটা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে সেই সোনা উদ্ধার করা কালাপাহাড়ের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। নন্দলালের মুখ থেকে তাঁর পুত্র-পৌত্ররা যা শুনে এসেছে তা হল, কালাপাহাড় যেখানে সোনা রেখেছিলেন তার চারপাশে প্রায় দুর্ভেদ্য জঙ্গল, একটা বিশাল বিল আর শিবমন্দির ছিল। জায়গাটা উত্তরবঙ্গ অথবা অসমে। অসমে হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, কারণ তখন তারা পুরীর দিকে যাত্রা করেছিলেন। মিস্টার সোম, আমি নন্দলাল সেনের উত্তরাধিকারী। ওই সোনার একটা অংশের ওপর আমার অধিকার আছে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

পারছি। কিন্তু আপনি আমাকে অনুরোধ করেছেন কালাপাহাড়ের এ অঞ্চলের গতিবিধির খবর জোগাড় করে দিতে। সোনা খুঁজে দিতে নয়।

না, না। এটা আমি আপনাকে বলতাম। তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন হরিপদ সেন।

অমল সোম হাসলেন, আপনি বুনো হাঁসের খোঁজে আমাকে ছুটতে বলছেন?

হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেইরকমই। আবার তাও নয়।

নয় মানে?

আমার বিশ্বাস হচ্ছে এর পেছনে সত্যতা আছে।

কীরকম?

হরিপদ সেন পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন। সেটা এগিয়ে দিলেন অমল সোমের দিকে। অমল সোম কাগজটি খুলে চোখ রাখলেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে কৌতুক ফুটে উঠল, এটি কবে পেয়েছেন?

গত সপ্তাহে। তারপরেই প্রোফেসর আমাকে বললেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে।

আপনার এই তথ্য আর কে কে জানেন?

কেউ না। আমার ছোট ঠাকুর্দা আর আমি। পূর্বপুরুষরা যাঁরা জানতেন, তাঁরা অনেককাল আগে দেহ রেখেছেন।

আপনার বাবা জানতেন না?

না। জানলেও আমাকে বলেননি। তা ছাড়া আমার ঠাকুদা অল্পবয়সেই চাকরি নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন বলে বাবার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।

কিন্তু কেউ একজন জানেন, এটি তার প্রমাণ।

হ্যাঁ।

আপনার ঠাকুর্দা, আই মিন ছোট ঠাকুর্দা, এখন কেমন আছেন?

হরিপদ সেন মাথা নাড়লেন, আমি চলে আসার দিন দশেক বাদে সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে উনি মারা গিয়েছেন।

স্নান করতে গিয়ে মারা গেছেন? উনি সমুদ্রস্নান করতেন ওই বয়সে?

না। ভাল করে হাঁটতেও পারতেন না। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন উনি নিষেধ করেছিলেন সমুদ্রে স্নান করতে। বলেছিলেন জলে খুব ভয় ওঁর। চৈতন্যদেবের উচিত হয়নি জলের কাছে যাওয়া।

চৈতন্যদেব?

ঠাকুদা চৈতন্যদেবের ভক্ত ছিলেন।

ওঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে যাননি কেন?

আমি পুরী থেকে ফিরেই চণ্ডীগড় গিয়েছিলাম ব্যবসার কাজে। বাড়ির লোক ঠিকানা জানত না। ফিরেছিলাম দিন কুড়ি বাদে। তখন গিয়ে কোনও লাভ হত না।

আপনাদের পুরীর বাড়ির কী অবস্থা? নিজস্ব বাড়ি নিশ্চয়ই।

তালাবন্ধ আছে। যে ঠাকুদাকে দেখাশোনা করত সে জানিয়েছে।

এই চিঠি পোস্টে এসেছে?।

আজ্ঞে হ্যাঁ। মিস্টার সোম, আপনি একটু সাহায্য করুন। যদিও চারশো বছরের বেশি সময় চলে গিয়েছে, কিন্তু সোনায় তো জং পড়ে না।

আপনার ব্যবসার অবস্থা কেমন মিস্টার সেন?

খুব ভাল নয়।

আপনি আজকের রাতটা এখানকার হোটেলে থাকুন। থানার কাছে রুবি বোর্ডিং নামে একটা সাধারণ হোটেল পাবেন। কাল সকালে আসুন। আমি ভেবে দেখি।

হরিপদ সেনের মুখে হাসি ফুটল, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। শিলিগুড়ির দিল্লি হোটেল আমার পরিচিত। ওখান থেকে আসতে ঘণ্টাখানেকও লাগবে না। জিনিসপত্র সেখানেই রেখে এসেছি। কাল তা হলে আসব?

বেশ। আপনার গাড়িতে কাগজপত্র আছে দিয়ে যান।

নিশ্চয়ই। আপনাকে দক্ষিণা বাবদ কত দিতে হবে এখন?

দক্ষিণা পরে। আপাতত খরচ বাবদ হাজার তিনেক দেবেন। যদি কেস হাতে না নিই তা হলে আগামীকাল টাকা ফেরত পাবেন।

হরিপদ সেন তৈরি হয়েই এসেছিলেন। পকেট থেকে একটা মোটা বান্ডিল বের করে গুনে-গুনে তিন হাজার টেবিলে রাখলেন। রেখে বললেন, কেসটা রিফিউজ করবেন না মিস্টার সোম। প্লিজ।

অমলদা কোনও কথা না বলে অর্জুনকে ইঙ্গিত করলেন হরিপদ সেনের সঙ্গে যেতে। বাগান পেরিয়ে গাড়ির পেছনের সিটের নীচে ফেলে রাখা একটা কাপড়ের ব্যাগ থেকে মোটা চওড়া খাম বের করে ভদ্রলোক অর্জুনের হাতে। দিলেন।

অর্জুন বললেন, এগুলো এভাবে ফেলে রেখেছেন?

ড্রাইভারের কান বাঁচিয়ে হরিপদ জবাব দিলেন, বাজারের ব্যাগে রেখেছি বলে কেউ সন্দেহ করবে না। আচ্ছা, আসি।

গাড়িটা বেরিয়ে গেলে অর্জুন ভেতরে এসে অমল সোমের হাতে প্যাকেটটা দিল। তিনি সেটা নিয়ে বললেন, বেশির ভাগ অপরাধের পেছনে কাজ করে মানুষের লোভ। ও হ্যাঁ, বিষ্ণুসাহেব এখানে আসছেন। তখন খবরটা বলা হয়নি। কাল চিঠি পেয়েছি।

বিষ্টুসাহেব? চিৎকার করে উঠল অর্জুন। আনন্দে। কালিম্পং-এর বিষ্টুসাহেব। এখন আমেরিকায় আছেন। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। সে কিছু বলার আগেই অমলদা ভাঁজ করা কাগজটা এগিয়ে দিলেন, এটা পড়ো আগে।

কাগজটা খুলল অর্জুন। সুন্দর হাতের লেখা :

হরিপদ সেন। যা করছ তাই করে খাও। নন্দলালের সম্পত্তির দিকে হাত বাড়ালে হাত খসে যাবে : কালাপাহাড়।