নয় নয় শূন্য তিন – সায়েন্স ফিকশন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
রিশান পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল, যতদূর চোখ যায় ততদূর বিস্তৃত এক বিশাল অরণ্য, সবুজ দেবদারু গাছ ঝোঁপঝাড় লতাগুল্ম জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। উপর থেকে এই বিশাল অরণ্যরাজিকে মনে হচ্ছে একটি সবুজ কার্পেট, কেউ যেন নিচে গভীর উপত্যকায় খুব যত্ন করে বিছিয়ে রেখেছে। দূরে পর্বতমালার সারি, প্রথমে গাঢ় নীল, তার পিছনে হালকা নীল, আরো দূরে ধূসর রং হয়ে দিগন্তে মিশে গেছে। কাছাকাছি উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় সাদা খানিকটা মেঘ আটকা পড়ে আছে, এ ছাড়া আকাশে কোথাও কোনো মেঘের চিহ্ন নেই, স্বচ্ছ নীল রঙের আকাশ যেন পৃথিবীকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। পাহাড়ের পাদদেশে যে বুনো নদীটি পাথর থেকে পাথরে ভয়ঙ্কর গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, এই চুড়ো থেকে সেই নদীটিকেই মনে হচ্ছে একটি শান্ত স্রোতধারা। চারদিকে এক ধরনের আশ্চর্য নীরবতা, কান পাতলে গাছের পাতার মৃদু শব্দ, ঝরনার ক্ষীণ গুঞ্জন বা বন্য পাখির অস্পষ্ট কলরব শোনা যায়। কিন্তু সেসব পাহাড়ের চূড়ায় এই আশ্চর্য নীরবতাকে স্পর্শ করে না। রিশান প্রকৃতির প্রায় এই নির্লজ্জ সৌন্দর্যের দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সে গ্রহ থেকে গ্রহে, উপগ্রহ থেকে উপগ্রহে ঘুরে বেড়িয়েছে, মহাকাশের গভীরে হানা দিয়েছে, সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে পার হয়ে গেছে; কিন্তু নিজের পৃথিবীর এই বিস্ময়কর সৌন্দর্যের দিকে কখনো চোখ মেলে তাকায় নি। মাটির পৃথিবীতে যে এত রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানত?
রিশান ঘাড় থেকে তার ছোট ঝোলাটি নামিয়ে রেখে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে। যে প্রচণ্ড প্রাণশক্তি নিয়ে সে জীবনের বড় অংশ পাড়ি দিয়ে এসেছে সেই প্রাণশক্তি কি এখন অকুলান হতে শুরু করেছে? বুকের ভিতরে কোথায় যেন এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে, এক ধরনের অপূর্ণতা এক ধরনের চাপা অভিমান কোথায় জানি যন্ত্রণার মতো জেগে উঠতে শুরু করে। মনে হতে থাকে জীবনের সব চাওয়া পাওয়া সব সাফল্য ব্যর্থতা আসলে অর্থহীন। এই নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় প্রাচীন একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে–থেকেই বুঝি জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে হয়
রিশান একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে তার পা দুটি ছড়িয়ে দিল, আর ঠিক তখন তার হাতের কব্জিতে বাঁধা যোগাযোগ মডিউলটিতে একটা মৃদু কম্পন আর সাথে সাথে উচ্চ কম্পনের একটা তীক্ষ্ণ কিন্তু নিচু শব্দ শোনা যায়। রিশান মডিউলটির দিকে তাকাল। একটি লাল আলো নিয়মিত বিরতি দিয়ে জ্বলছে এবং নিভছে, কেউ একজন তার সাথে কথা বলতে চায়। উপরের লাল বোতামটি স্পর্শ করে সে ইচ্ছে করলেই কথা বলার অনুমতিটি প্রত্যাখ্যান করতে পারে; কিন্তু তার দীর্ঘদিনের সুশৃঙ্খল জীবনের অভ্যাস তাকে লাল বোতামটি স্পর্শ করতে দিল না, সে নিচু গলায় অনুমতি দিল। সাথে সাথে তার চোখের সামনে ত্রিমাত্রিক একটি ছবি ভেসে আসে, সুসজ্জিত অফিসঘরে সুদৃশ্য ডেস্কের সামনে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ উবু হয়ে বসে আছে। মানুষটির মুখ ভাবলেশহীন, শুধুমাত্র হাতের উপর লাল তারাটি বুঝিয়ে দিচ্ছে সে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। নির্জন পাহাড়ের চুড়োয় হলোগ্রাফিক এই দৃশ্যটি এত বেমানান দেখাতে থাকে যে রিশান প্রায় নিজের অজান্তেই মাথা নাড়তে শুরু করে। সরকারি কর্মচারীটি মাথা ঘুরিয়ে রিশানকে দেখতে পেল এবং সাথে সাথে তার ভাবলেশহীন মুখে বিস্ময়ের একটা সূক্ষ্ম ছাপ পড়ে। মানুষটি অভিবাদন করে যখন কথা বলল তার কণ্ঠস্বরে কিন্তু বিস্ময়টুকু প্রকাশ পেল না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, রিশান, আমি মহাজাগতিক কেন্দ্রের মূল দফতর থেকে বলছি, একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমার সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন। তোমার হাতে কি সময় আছে?
এটি একটি সৌজন্যমূলক কথা, রিশান খুব ভালো করে জানে তার সময় না থাকলেও এখন কথা বলতে হবে। সে মানুষটির চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, কী কথা?
কয়েকদিনের মাঝে কিছু মহাকাশচারী একটি তথ্যানুসন্ধানী মিশনে যাচ্ছে। গুরুত্ব মাত্রায় পঞ্চম স্তরের অভিযান। বিশেষ কারণে মহাকাশচারীদের মাঝে একটু রদবদল করা হয়েছে। সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে যার যাবার কথা ছিল তাকে অপসারণ করে সেখানে তোমাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আমাকে?
হ্যাঁ।
আমি পঞ্চম মাত্রার অভিযানের উপযুক্ত মহাকাশচারী নই।
তুমি যদি রাজি থাক সদর দফতর থেকে তোমাকে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার সনদ দেয়া হবে।
রিশান উচ্চপদস্থ এই সরকারি কর্মচারীটির দিকে তাকাল। মানুষটি সম্ভবত সুদর্শন, কিন্তু হলোগ্রাফিক ছবিতে কিছু একটা অবাস্তব ব্যাপার রয়েছে যার কারণে মানুষের চেহারার সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো কখনো ঠিক করে ধরা পড়ে না। মানুষটি উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে তাকিয়ে আছে, যদিও সম্ভবত সে খুব ভালো করেই জানে সে কী বলবে। পঞ্চম স্তরের অভিযানে যাওয়ার সৌভাগ্য খুব কম মহাকাশচারীর জীবনেই এসেছে, স্বেচ্ছায় কেউ কখনো সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বলে মনে হয় না। রিশানের হঠাৎ ইচ্ছে হল সে মাথা নেড়ে বলবে, না আমি যেতে চাই না। হাতে লাল তারা লাগানো এই মানুষটি তখন নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে তাকাবে তারপর ইতস্তত করে বলবে, কেন তুমি যেতে চাও না? রিশান তখন খুব সরল মুখ করে বলবে, আমি গ্রহ থেকে গ্রহে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেছি, আমার এখন বিশ্রাম দরকার। আমি এই নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় একা একা বসে বহুদূরে দেবদারু গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই। বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঝরনার পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে চাই। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের খেলা দেখতে চাই। যখন অন্ধকার নেমে আসবে তখন তাপনিরোধক পোশাকে নিজেকে মুড়ে ফেলে আকাশের নক্ষত্র গুনতে চাই।
কিন্তু রিশান সেসব কিছু বলল না। তার সুদীর্ঘ সুশৃঙ্খল জীবনে সে নিয়মের বাইরে কিছু করে নি, এবারেও করল না। নরম গলায় বলল, পঞ্চম মাত্রার অভিযানে যাওয়া আমার জন্যে একটা অভাবনীয় সুযোগ। আমাকে সেই সুযোগ দেয়ার জন্যে আমি মহাকাশ কেন্দ্রের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমি কি তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে এখানে একটা ছোট বাই ভার্বাল পাঠাব?
রিশান পাহাড়ি নদীটির দিকে তাকিয়ে বলল, না এখানে নয়। আমি ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে এই পাহাড় থেকে নেমে যাব। নিচে একটি ছোট লোকালয় আছে, আমাকে তার কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে তুলে নিলেই হবে।
উচ্চপদস্থ মানুষটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে বিস্মিত হয়ে রিশানের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। রিশান প্রায় কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, এখানে একটি বাই ভার্বালকে অত্যন্ত বিসদৃশ দেখাবে।
নিয়ম অনুযায়ী এই মানুষটির নিজে থেকে বিদায় নেবার কথা, কিন্তু রিশান সেজন্যে অপেক্ষা করল না। তাকে বিদায় জানিয়ে কব্জিতে বাধা যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করে তাকে অদৃশ্য করে দিল। রিশান একটি নিশ্বাস ফেলে হাত দিয়ে একবার মাটিকে স্পর্শ করল। আবার তাকে এই মাটির পৃথিবীকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। মহাকাশে ছুটে ছুটে সে। তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। মহাকাশচারীর জীবন বড় নিঃসঙ্গ, এক একটি অভিযান শেষ করে যখন তারা পৃথিবীতে ফিরে আসে, তারা অবাক হয়ে দেখে পৃথিবীতে শতাব্দী পার হয়ে গেছে। পরিচিতেরা কেউ নেই, প্রিয়জনেরা শীতলঘরে, ভালবাসার মেয়েটির দেহ জরাগ্রস্ত, মুখে বার্ধক্যের বলিরেখা। শহর নগর পাল্টে গিয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, মানুষের মুখের ভাষায় দুর্বোধ্য জটিলতা। শুধু যে জিনিসটি পাল্টে নি সেটি হচ্ছে পর্বতমালা বিশাল অরণ্য আর নীল আকাশ। রিশান আজকাল তাই ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে এই পর্বতমালার খোঁজে, নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় বসে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে তাঁর হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীকে। শৈশব কৈশোর আর যৌবনে যেই প্রকৃতিকে অবহেলায় দূরে সরিয়ে রেখেছে এখন তার জন্যে বুকের ভিতর জন্ম নিচ্ছে গভীর ভালবাসা।
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে একমুঠো মাটি তুলে এনে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সিলিকনের এই যৌগ কী বিচিত্র রহস্যের জন্ম দিয়েছে পৃথিবীতে! প্রাণ নামে এই অবিশ্বাস্য রহস্য কি আছে আর কোথাও?