জন্মেজয় বলে শুনি কহ তপোবন।
কি কি কর্ম্ম করিলেন রুক্মিণীরমণ॥
ভার নিবারণ হেতু হৈয়া অবতার।
একে একে নাশিলেন পৃথিবীর ভার॥
তবে কোন্ কর্ম্ম করিলেন যদুমণি।
বিবরিয়া আমাকে কহিবা মহামুনি॥
ভারত শুনিতে রাজা বড় হৃষ্টমন।
পরাগে করয়ে যেন ষট্পদ ভ্রমণ॥
প্রশ্ন করি সর্ব্ব তত্ত্ব লন মুনিস্থানে।
সাধু সত্ত্বগুণে রাজা পূর্ণ সর্ব্বগুণে॥
নহিল নহিবে হেন সাধু ক্ষিতিতলে।
যার যশ প্রচারিল এ মহীমণ্ডলে॥
নৃপতির প্রশ্ন শুনি মুনি মহাশয়।
সাধু সাধু বলিয়া রাজারে প্রশংসয়॥
বলেন বৈশম্পায়ন শুন কুরুপতি।
দ্বারকায় বিহার করেন লক্ষ্মীপতি॥
একদিন বেদী পরে বসি নারায়ণ।
রুক্মিণী প্রভৃতি নারী সেবয়ে চরণ॥
জাম্ববতী সত্যভামা ভদ্রা নগ্নজিতি।
মিত্রবিন্দা মাদ্রী আর কালিন্দী শ্রীমতি॥
এই অষ্ট পাটরাণী শ্রীকৃষ্ণমোহিণী।
ষোড়শ সহস্র আর কৃষ্ণের রমণী॥
নিজ মনোরথে সবে সেবয়ে শ্রীহরি।
চামর ব্যজন করে নিজ হস্তে করি॥
তাম্বুল যোগায় কেহ মনের হরিষে।
রাতুল চরণ কেহ চাপে পরিতোষে॥
হেনমতে করে সবে প্রভুর সেবন।
অনিত্য সুখেতে লিপ্ত কমলারমণ॥
ব্রহ্মা আদি দেবগণ একত্র হইয়া।
একদিন সবে যুক্তি করেন বসিয়া॥
ত্যজিয়া বৈকুণ্ঠনাথ বৈকুণ্ঠ বসতি।
পৃথিবীতে রহিলেন না করেন স্মৃতি॥
নরদেহ ধরিয়া নাশিতে ক্ষিতি-ভার।
মহা দৈত্যগণেরে করিলেন সংহার॥
করিলেন বহু কর্ম্ম কেলি অনুসারে।
যাহা স্মরি পাপীলোক যায় ভবপারে॥
দিন দিন অবনীতে করেন বিহার।
বৈকুণ্ঠে আসিতে এবে হয় সুবিচার॥
হেনমতে দেবগণ করে অনুমান।
জানিলেন সর্ব্ব অন্তর্য্যামী ভগবান॥
বেদীতে বসিয়া কৃষ্ণ তুলিয়া নয়ন।
দ্বারকার বসতি করিলা নিরীক্ষণ॥
স্থানে স্থানে বসতি লোকেতে পূর্ণ সব।
নগর ভিতরে সব লোক কলরব॥
ঠেলাঠেলি-গতায়াতে পথ নাহি পায়।
পথ ঘাট লোকেতে পূর্ণিত সর্ব্বথায়॥
দেখিয়া চিন্তিত হইলেন নারায়ণ।
কি উপায় করিবেন ভাবেন তখন॥
পৃথিবীর ভার আমি করিব সংহার।
আমা হৈতে হৈল আরো চতুর্গুণ ভার॥
করযোড়ে বলে যত কৃষ্ণের নন্দন।
হের অবগতি কর যত মুনিগণ॥
চিরদিন গর্ভবতী এই ত অঙ্গনা।
না হয় প্রসব বড় পাইছে যন্ত্রণা॥
কতদিনে প্রসবিবে কি হবে অপত্য।
আপনারা মহাজ্ঞানী কহিবেন সত্য॥
এত শুনি মুনিগণ কুমারের বাণী।
ধ্যানস্থ হইয়া দেখি কহিল তখনি॥
জানিলাম শুন ওহে কৃষ্ণের কুমার।
লৌহপাত্রে করিয়াছ গর্ভের আকার॥
অবজ্ঞা জানিয়া ক্রোধ হৈল মুনিগণে।
ক্রোধমুখে কহিতে লাগিল ততক্ষণে॥
কৃষ্ণের নন্দন তোরা যদুকুলোদ্ভব।
ব্রাহ্মণেরে উপহাস করহ যাদব॥
যে লৌহপাত্রেতে কৈলে গর্ভের আকৃতি।
এখনি উত্তম বংশ হইবে উৎপত্তি॥
তাহা হৈতে তোমা সবে হবে বড় ভয়।
যদুকুল ধ্বংস হবে জানিহ নিশ্চয়॥
হেনই সময় সেই জাম্ববতী-সুত।
মুষল প্রসব এক কৈল আচম্বিত॥
চিন্তিত হইল দেখি যতেক কুমার।
কি করিব কি হইবে করেন বিচার॥
মুষল দেখিয়া অতি বিষাদিত মন।
সকল কুমার হৈল মলিন বদন॥
আপনার দোষে হৈল কুলের নিধন।
কুল অন্ত হবে হেন বুঝয়ে কারণ॥
অজ্ঞান হইয়া কৈনু দ্বিজে উপহাস।
রক্ষা নাহি নিশ্চয় হৈবে সর্ব্বনাশ॥
শুনিয়া কি বলিবেন দেব গদাধর।
না জানি কি কহিবেন দেব হলধর॥
কি হেতু কুবুদ্ধি আজি হৈল মোসবার।
কোন্ মতে হৈবে ইহার প্রতিকার॥
কোন লাজে লোকে তবে দেখাব বদন।
শুনিলে এখনি ক্রুদ্ধ হবে নারায়ণ॥
বড় লজ্জা ভয় আজি হ’ল মোসবার।
বাহুড়িয়া গৃহে পুনঃ যাইব না আর॥
এই অনুতাপ করে যত শিশুগণ।
অন্তর্য্যামী জানিলেন সব নারায়ণ॥
পুত্রগণ সন্নিকটে আসি গদাধর।
কহেন সবার প্রতি মধুর উত্তর॥
কি কারণে মৌনভাব দেখি পুত্রগণ।
কোন্ দুঃখে দুঃখী হৈলে কহত কারণ॥
কৃষ্ণের বচনে কহে যতেক কুমার।
দৈবেতে কুবুদ্ধি তাত হৈল মোসবার॥
কুকর্ম্ম হৈল আজি বুদ্ধি হৈল হ্রাস।
মুনিগণে দেখি করিলাম উপহাস॥
তার প্রতিফল এই হইল মুষল।
কোপে শাপ দিয়া গেল ব্রাহ্মণ সকল॥
ইহা হ’তে হইবেক যদুবংশ ক্ষয়।
এই হেতু আমাদের হইয়াছে ভয়॥
লজ্জা ভয়ে হইয়াছে আকুল পরাণ।
বুঝিয়া যা হয় দেব করহ বিধান॥
কুমারগণের কথা শুনিয়া শিহরি।
শিশুগণে আশ্বাসিয়া কহেন শ্রীহরি॥
এই হেতু চিন্তা কেন কর সর্ব্বজন।
যাহা কহি তাহা শুন যদি লয় মন॥
মুষল লইয়া যাহ প্রভাসের তীরে।
ঘষিয়া করহ ক্ষয় পাষাণ উপরে॥
ঘর্ষণে করিলে ক্ষয় ভয় কিবা আর।
সত্বর গমনে যাহ যতেক কুমার॥
আসিয়া প্রভাস-তীরে করি স্নানদান।
পাষাণে ঘর্ষয়ে সবে আনন্দ বিধান॥
ঘর্ষণে করয়ে ক্ষয় কুমার সকল।
ঘষিতে ঘষিতে ক্ষয় হইল মুষল॥
অবশেষে অল্পমাত্র রহিল কিঞ্চিৎ।
দেখিয়া কুমার সব হইল বিস্মিত॥
হাতে ধরি ঘষিতে আয়ত্ত নাহি হয়।
কেমনে করিব ইহা পাষাণেতে ক্ষয়॥
খণ্ডিল মনের ত্রাস কৃষ্ণ উপদেশে।
কি আর করিব ভয় অল্প অবশেষে॥
এতেক বালক সব মনে অনুমানি।
শেষ লৌহ প্রভাস সলিলে ফেলে টানি॥
হরষিতে স্নান করি প্রভাসের জলে।
দ্বারাবতী চলে গেল বালক সকলে॥
গোবিন্দের আগে আসি কহিল কাহিনী।
শিশুগণে আশ্বাসেন দেব চক্রপাণি॥
ভারতে মুষলপর্ব্ব অপূর্ব্ব আখ্যান।
কাশীরাম দেব কহে শুনে পুণ্যবান॥