০১. যজুর্বেদ সংহিতা
বস্তুগত সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে যজুর্বেদে প্রতিফলিত যে সমাজচিত্র তা ঋগ্বেদের সমাজচিত্র থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। আর্যরা যখন নিজেদের বসতিতে সুস্থিত হয়ে যুদ্ধ ক’রে আশপাশের অঞ্চলগুলি অধিকার করতে শুরু করলেন এবং উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে ধীরে ধীরে কিছু কিছু পরিবর্তনের সূচনা হ’ল–গোষ্ঠীজীবন কিন্তু তখনও মূলত অপরিবর্তিতই রয়ে গেল। সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংস হওয়ার সময়ে সাময়িকভাবে যে বাণিজ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছিল, যজুর্বেদের সময়ে তা আবার আরম্ভ হ’ল। তামা, ব্রঞ্জ, সীসা, টিন এবং লোহাজাতীয় ধাতু দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আনীত হয়ে আৰ্য-আধ্যুষিত সেই সব অঞ্চলে কাজে ব্যবহৃত হ’ত, সেগুলি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখে এই বাণিজ্য পথের কাছাকাছি অবস্থিত ছিল। যজুৰ্বেদীয় সংস্কৃতির কেন্দ্ৰবিন্দু তখন স্পষ্টতই উত্তর-পশ্চিম ও পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় সরে গিয়েছিল। কৃষিব্যবস্থা তখন উন্নততর পর্যায়ে। দিনপঞ্জীর সাহায্যে মৌসুমি বৃষ্টিপাত তখন মোটামুটি অনেকটা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা যেত, ফলে উপযুক্ত ঋতুতে কৃষিকর্মের ব্যবস্থাপনা সম্ভবপর হয়েছিল। লোহার লাঙল তখনও পর্যন্ত প্রচলিত হয় নি, লম্বা বাঁটযুক্ত কোদাল বা কাঠের তৈরি আদিম পর্যায়ের লাঙল দিয়ে চাষ হত বলে কৃষকের কঠোর পরিশ্রমের তুলনায় স্বল্প পা গুণ ফসলই উৎপন্ন হত। সমস্ত অনুষ্ঠান এবং প্রার্থনায় যেহেতু শস্য, পশু ও ধনের প্রাচুর্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হত। তাই সহজেই অনুমান করা চলে যে, তাদের মধ্যে খাদ্যলাভের অনিশ্চয়তা ও খাদ্যের স্বল্পতাই আভাসিত হয়েছে। রাজা ও গোষ্ঠীপতিদের শাসন ও অধিকার বিস্তুত ছিল কিছু গ্রামপুঞ্জের ওপরে। গ্রাম শব্দটি যদিও প্রাথমিকভাবে বিচরণশীল পশুপালক গোষ্ঠীর সমবায়কেই সূচিত করত, যজুর্বেদে তার তাৎপর্য হ’ল, মোটামুটিভাবে সুনির্দিষ্ট জনবসতি। অর্থাৎ বীজ বপন ও ফসল সংগ্রহের মধ্যবর্তী মাসগুলিতে কোনো জনগোষ্ঠী যে নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাস করত, তাই গ্রামরূপে পরিচিত ছিল–কেননা সে সময়ের পরে ঐ জনগোষ্ঠী সমৃদ্ধতর কর্ষণযোগ্য ভূমির সন্ধানে পূর্বদেশের দিকে পুনরায় যাত্রা করত। কৃষির পরিপূরক রূপে খাদ্যসংগ্ৰহ, মৃগয়া ও গোপালনের দ্বারা সম্পদবৃদ্ধিও প্রচলিত ছিল। আচার-অনুষ্ঠান এবং পুরোহিতদের কার্যকলাপের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম বিভাজন যদিও খাদ্য-সরবরাহের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রাচুর্যের ইঙ্গিত বহন করছে, কিন্তু যজুর্বেদে সাধারণভাবে সমাজের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা সাধারণ মানুষের খাদ্য যোগানের ক্ষেত্রে বিরলতা ও অনিশ্চয়তারই প্রমাণ দেয়। তুলনামূলকভাবে সমাজের সমৃদ্ধতর অংশ যদিও বিবিধ কুটিরগত কারুশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করত তবুও দরিদ্রতর বৈশ্য, দেশিয় আদি কৃষক, পশুপালক, ক্ষুদ্র শিল্পী এবং শূদ্ৰদের জন্য খাদ্যের যোগান নিরতিশয় স্বল্প ছিল।
ঋগ্বেদের শেষ পর্যায়ে রচিত একটি মন্ত্রে যে জাতিভেদ উল্লিখিত হয়েছিল, যজুর্বেদে এসে সে জাতিভেদ প্রতিষ্ঠিত সত্য ; খাদ্য বণ্টন ও সম্পদ সংগ্রহে গুরুতর অসাম্য যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের গোড়াপত্তন করেছিল, যজুর্বেদ তা তর্কাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত বলে সমাজ ক্রমশ স্পষ্ট কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গেল। শ্রেণীগত ভিন্নতার ফলেই সমাজের একটি বিশেষ অংশ পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হ’ল যাদের শ্রেণী-স্বাৰ্থ সাধারণ জনতার বৃত্ত থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে গেল। যজুর্বেদ রচনার অন্তিম পর্যায়ে এই প্রবণতা আনুষ্ঠানিক ধর্মগ্রন্থ রচনার সৃজনশীল পৰ্যায় অর্থাৎ প্রধান ‘ব্রাহ্মাণ’ গ্ৰন্থসমূহ প্রণয়নের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বিদ্যমান ছিল। তখন আমরা রাজা, বিজয়ী বীর, সম্পদশালী ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন পৃষ্ঠপোষকদের প্রয়োজনে বহু নুতন যজ্ঞানুষ্ঠান উদ্ভাসিত হতে দেখি। আবার এখানে আরও একবার প্রমাণিত হচ্ছে যে, সংখ্যাগত দিক দিয়ে সাধারণ জনতার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ অর্থাৎ প্রাথমিক উৎপাদকরা ও ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পে ব্যাপৃত কারিগররা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নিম্পেষিত। যখন মুষ্টিমেয় ক্ষমতাসম্পন্ন ও সম্পদশালী ব্যক্তির হাতে সামাজিক ধন পুশ্ৰীভূত হয়ে উঠেছিল সে সময়ে যজুর্বেদের অনুষ্ঠানগুলি বহুধা বিভাজিত ও বর্ধিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের অধিকাংশই অতি তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে সেই খাদ্য-বিরলতার দিনগুলিতে নিজেদের শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হ’ত ব’লে তারা ক্রমশ অতিদরিদ্র নিঃসম্বল জনতায় পরিণত হচ্ছিল। সার্বিক বিশ্লেষণে আমরা লক্ষ্য করি যে, পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজ ও সাহিত্য পূর্ববতী যুগের তুলনায় মূলগতভাবেই ভিন্ন, কেননা অর্থনৈতিক অন্তর্বিন্যাস ও সাংস্কৃতিক ঊর্ধবিন্যাস–দুটােই প্রাথমিক বৈদিক যুগ থেকেই চরিত্রগতভাবে পৃথক্ হয়ে পড়েছিল।
সায়ণাচাৰ্য যে ঋগ্বেদের আগেই যজুর্বেদের ভাষ্য রচনা করেছিলেন, তার কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন যে, যজ্ঞে যজুর্বেদের গুরুত্বই সর্বাধিক। ঋগ্বেদের পুরোহিত হােতা যেখানে ঋগ্বেদের মন্ত্র আবৃত্তি করতেন এবং সামবেদের পুরোহিত উদ্গাতা সামগান করতেন, সেখানে যজুর্বেদের পুরোহিত অধ্বর্যু প্রকৃতপক্ষে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন এবং সেই সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু মন্ত্রও উপাংশু স্বরে উচ্চারণ করতেন।
যজুর্বেদ-সংহিতা দুটি স্পষ্ট শাখায় বিভক্ত—শুক্ল ও কৃষ্ণ। অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় যজুর্বেদের পুরোহিত যে সমস্ত মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, শুক্ল যজুর্বেদে শুধু সেইগুলিই পাওয়া যায়। তাই শুক্ল যজুর্বেদের ‘ব্রাহ্মণ’সমূহ স্বতন্ত্র রচনারূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও কৃষ্ণ যজুর্বেদের ‘ব্রাহ্মণগুলি প্রকৃতপক্ষে পরবর্তীকালে প্রথিত, গদ্যে রচিত নির্দেশমালা ও ব্যাখ্যাসমূহের ধারাবাহিক সংযোজন। কৃষ্ণ-যজুর্বেদে অনুষ্ঠানের বর্ণনা ও তার বিধিবদ্ধ ব্যাখ্যার সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানের সূত্রগুলিও রয়েছে। মন্ত্র-বহির্ভূত অন্যান্য অংশে গদ্যে রচিত এবং ব্রাহ্মণ-গ্ৰন্থসমূহের পূর্বগামী।
শুক্ল যজুর্বেদের একমাত্ৰ সাহিত্যকর্ম বাজসনেয়ী-সংহিতাটি দুটি শাখায় ঈষৎ ভিন্ন পাঠে পাওয়া যায়–কাণ্ব ও মাধ্যন্দিন ; এই বিভাজন ‘ব্রাহ্মণ’-গ্ৰন্থগুলির মধ্যেও রয়েছে। অবশ্য শুক্ল যজুর্বেদ প্রতিশাখ্য এই দুটি ভাগকেই একসঙ্গে উল্লেখ করেছে। আলোচ্য শাখা দুটির মধ্যে কাণ্বই প্রাচীনতর। দুটি শাখার মধ্যে পাঠগত ভিন্নতার মূল কারণ ভৌগোলিক ; যখন এক প্ৰজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম এই শ্রুতি-সাহিত্য মৌখিকভাবে সঞ্চারিত হত, স্থানগত ভিন্নতায় স্বাভাবিকভাবেই পাঠও ভিন্ন হয়ে পড়ছিল। মাধ্যন্দিন শাখায় বাজসনেয়ী সংহিতা মোট ৪০টি অধ্যায়, ৩০৮ অনুবাক্ ও ১৯৭৫ কণ্ডিকায় বিভক্ত। প্ৰথম ২৫টি অধ্যায়ে সাধারণভাবে প্ৰচলিত যে সব যজ্ঞের অনুষ্ঠানবিধি সূত্রবদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে—দর্শপুর্ণমাস (১-২), অগ্নিহােত্র অর্থাৎ প্ৰাতঃকালীন ও সায়ংকালীন সংক্ষিপ্ত যজ্ঞানুষ্ঠান (৩), সাধারণ সোমযাগ (৪-৭), সোমযাগের দুটি বিশেষ ধনন (৯-১০), যজ্ঞবেদী নির্মাণ ও যজ্ঞাগ্নিসমূহের আধান (১১-১৮), সৌত্ৰিমণী যাগ, ইন্দ্রের প্রতি নিবেদিত বিশেষ কিছু কিছু অনুষ্ঠান ও প্ৰায়শ্চিত্তের নানা যাজ্ঞিক অনুষ্ঠানবিধির বিবরণ (১৯-২১) এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি (২২-২৫)। এদের মধ্যে প্রথম আঠাশটি অধ্যায় পরবর্তী সাতটি অধ্যায়ের তুলনায় প্রাচীনতর। সংহিতার দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ ২৬–৩৫তম অধ্যায়। পরবর্তীকালে সংযোজিত ; তাই ভাষ্যকার মহীধর এই অংশকে ‘খিল’ বলে অভিহিত করেছেন। শেষ পাঁচটি অধ্যায় অর্থাৎ ৩৬-৪০ অধ্যায়সমূহে পুরুষমেধ, সর্বমেধ, পিতৃমেধ ও পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত প্ৰবর্গ্য যজ্ঞের বিধি সূত্রবদ্ধ হয়েছে। এই সমস্ত অধ্যায়ের কোনো কোনো অংশ স্পষ্টতই দার্শনিক ব্যঞ্জনাগর্ভ ; যেমন শতরুদ্রীয় নামক রুদ্রদেবের প্রতি নিবেদিত বিখ্যাত সূক্তটি (১৬শ অধ্যায়) ঋগ্বেদীয় পুরুষসূক্ত (৩১তম অধ্যায়) এবং ‘তদেব’ সূক্ত (৩২তম অধ্যায়)। এছাড়া ৩৪তম অধ্যায়ে ‘শিবসংকল্প’ নামক সুপরিচিত সূক্তটিতে নতুন এক ধরনের দেববাদী ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে। সংহিতার শেষ অধ্যায়টিই (৪০) ঈশোপনিষদ।
শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে যজ্ঞবিধি সম্পর্কিত রচনারূপে কৃষ্ণ-যজুৰ্বেদ সংকলিত হওয়ার ফলে তাতে বহু শাখার বিকাশ ঘটেছে ; কখনও অঞ্চল এবং কখনও পরিবারভেদে এই সংহিতায় পাঠগত ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত পাঁচটি বা ছয়টি শাখার স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে– তৈত্তিরীয়, কাঠক, আত্ৰেয়, হরিদ্রাবিক, মানব এবং মৈত্রায়ণীয়। এদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূৰ্ণ তৈত্তিরীয় শাখা আপস্তম্ব ও বৌধায়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ; মধ্যদেশে তার উৎপত্তি হয়েছিল।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাজসনেয়ী শাখা উত্তর পূর্বকাশ্মীরে এবং কাঠক ও কপিষ্ঠল পাঞ্জাবে, মৈত্রায়ণীয় গুজরাট, বিন্ধ্য পর্বত ও নর্মদা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এবং মানবশাখা ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।
কাঠক ও কপিষ্ঠল সংহিতা চারায়ণীয় (সাধারণভাবে চরকের সঙ্গে সম্পর্কিত) শাখার অন্তর্ভুক্ত। এই পাঠ বিশ্লেষণ করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এটি কৃষ্ণ ও শুক্ল যজুর্বেদের মধ্যে কিছুটা সমন্বয় করতে চেয়েছে। স্বভাবত স্বতন্ত্র এই পাঠ মোট পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত ; প্রথম তিনটি অধ্যায় আবার চল্লিশটি স্থানক বা উপবিভাগে বিভক্ত। চতুর্থ অধ্যায়টি বিভিন্ন ধরনের যে সমস্ত সম্পদের বিবরণ দিয়েছে, সে সব মূলত তাৎপৰ্যহীন। পঞ্চম বা শেষ অধ্যায়টি অশ্বমেধ যজ্ঞের বিবরণ দিয়েছে।
আত্ৰেয়-সংহিতা মোটামুটিভাবে তৈত্তিরীয় শাখারই ভিন্ন পাঠ ; এতে কয়েকটি কাণ্ড রয়েছে–প্ৰত্যেকটি কাণ্ড কয়েকটি ‘প্রশ্নে’ এবং প্রত্যেকটি ‘প্রশ্ন’ কয়েকটি অনুবাকে বিন্যস্ত। মৈত্রায়ণীয় বা কলাপ শাখার পাঠ হরিদ্রাবিক বলে অভিহিত। যাঙ্কাচাৰ্য যজুর্বেদের ব্রাহ্মণরূপে একমাত্র মৈত্ৰায়ণীয় শাখারই উল্লেখ করেছিলেন, এতে মনে হয় তিনিই যজুর্বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মাণগুলিকে সুবিন্যস্ত করে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন।