০১. ম্যাজিস্টিক হোটেল

পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস (এরকুল পোয়ারো)

০১. ম্যাজিস্টিক হোটেল

আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডের কোন সমুদ্রতীরবর্তী শহরই অন্তত দক্ষিণে সেন্ট লু-র মত আকর্ষণীয়ভাবে সুন্দর নয়। জলজ সম্রাজ্ঞী। একেবারে ঠিক নামেই ডাকা হয় অঞ্চলটাকে। আর সেন্ট লু আপনাকে অনিবার্যভাবেই মনে করাবে ফরাসি রিভিয়েরার কথা। দুধসাদা বালির চকচকে ভাব আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আমার প্রিয় বন্ধু এরকুল পোয়ারো-র কাছে আমি এতটাই উচ্ছ্বসিত জায়গাটাকে যে ও সাহাস্যে বলে বলে–ডঃ প্রাণবন্ত বর্ণনা। পর্যটকের আকর্ষণ বাড়াবে তোমার বর্ণনা মনে হয় না। ঠাট্টাকে গায়ে না মেখে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে সহমত নও কি? বন্ধুবর কোন উত্তর দেয় না, তবে ওর ঠোঁটের কোণায় ঝুলতে থাকে একচিলতে মুচকি হাসি। আমি আবার প্রশ্নটা করি। মাপ কোরো হেস্টিংস, আসলে আমার মনটা এখন রয়েছে তোমার তুলনা করা অঞ্চলটাতেই। সর্বত্রগামী মানবমন সেখানেই বিরাজমান এখন।আমি সামান্য চমকিত হই দক্ষিণ ফ্রান্সে?মুচকি হেসে প্রিয়বন্ধু জানায়–হ্যাঁ, গত শীতে আমি সেখানেই ছিলাম। আর কি কাণ্ডটাই যে ঘটেছিল, সেটা ভাবছিলাম।

 আমার মনে পড়ল দা ব্লু ট্রেন মার্ডার। অত্যন্ত জটিল মামলা। পোয়ারো যা তার অতুলনীয় প্রতিভা আর অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে কিস্তিমাত করেছিল। আহ ওই মামলাটায় তোমার সঙ্গী হতে না পারার আক্ষেপ আমার আজও যায়নি। সখেতে বলি–আমারও এইরকম একটা রোমাঞ্চকর কেসে তোমার অভিজ্ঞতার সাহায্য পাওয়াটা আমার পক্ষে মহামূল্যবান হত। আমি চোখের কোণা দিয়ে তাকালাম। পুরানো অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সবসময় বন্ধুবরের প্রশংসা সিরিয়াসলি নেওয়াটা বোকামোর কাজ হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে পোয়ারো অবশ্য যথেষ্ট সিরিয়াস মনে হচ্ছে মন্তব্যটার ব্যাপারে। অবশ্য কেনই বা নয়? সত্যিই তো আমার দীর্ঘতর অভিজ্ঞতা রয়েছে, সত্যিই যা মহামূল্যবান যে কারও পক্ষে। তাছাড়া আমার কাজের একটা বিশেষতর মেথড আছে যা প্রায়শই কাজ হয়ে ওঠে দুর্দান্তভাবে।

আসলে আমি সেটা ওইসময় দারুণভাবে মিস করেছিলাম প্রিয়তম বন্ধু হেস্টিংস, তোমার প্রবল ইমাজিনেশান সে স্বপ্নাতুর গলায় বলে চলে। আসলে, সত্যি ওরকম পরিস্থিতিগুলোয় কিছু হালকা মুহূর্তের প্রয়োজন হয় বৈকি। তোমার মত এক বন্ধু, যার কল্পনাশক্তি অতীব প্রখর, তার অভাব স্বাভাবিকভাবেই বোধ করেছি। তোমার পরিবর্তন হিসাবে আমার পাঁচক যে ছিল, তার সঙ্গে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম বটে।কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে! জার্জের কল্পনাশক্তি মোটেও তোমার মত প্রখরতর হতে পারে না, ছিলও না। পোয়ারোর মন্তব্যে আমি বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম। ব্যাপারটা প্রশংসা? নাকি চিরাচরিত পোয়ারো মার্কা এক অনাবিল ঠাট্টা।

আমরা বসেছিলাম সেন্ট লু-র অন্যতম সেরা ম্যাজিস্টিক হোটেলের একটা বারমুখী বারান্দায়। সমুদ্রের মুখোমুখি। পোয়ারো আরাম কেদারায় এলিয়ে বসে নির্বিকারভাবে গোঁফ মুচড়ে চলেছে। মাসটা আগস্ট। রোদ ঝকঝকে এক সকাল। গতকাল রাতেই আমরা এই শহরে এসে পৌঁছেছি। নেহাতই এক সপ্তাহের ছুটি উপভোগ করতেই আসা। মনে তো হচ্ছে যা পরিবেশ, আবহাওয়া, একটা দুর্দান্ত আদর্শ ছুটি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমি আবার খবরের কাগজে মন দেবার চেষ্টা করলাম। যদিও সেখানে রোমাঞ্চকর বা উৎসাহ জানানোর মত কোনও খবরই পাচ্ছিলাম না, ছিলও না কিছু।

অলস হাতে পাতা ওলটাতে ওলটাতে আমি বললাম-এক আশ্চর্য অসুখ দেখছি এই টিয়াসড়ক সত্যিই, আশ্চর্যজনক–সিভম-য়ে আরও দুজন মারা গেছে। আমি পরের পাতায় যেতে যেতে বলি–নাহ, সেটনের এখনও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ব্যাপারটা সত্যি রহস্যময়। দুঃখজনক। নিজের আবিষ্কার করা, তৈরি করা উড়ানান। অ্যালবাট্রস নিয়ে তিনি পৃথিবী পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।

  পশ্চিমের দিকে যাবার কথা শেষ জানতে পারা গিয়েছিল। তারপর থেকেই আর কোনও খোঁজ নেই সেটনের। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

সত্যি! ব্যাপারটা খুব রহস্যজনক। একটু থেমে আমি আবার সহানুভূতির গলায় বলি, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই হোম সেক্রেটারিকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ফেলেছে?

সে তো নিশ্চয়ই। যে কারণে তাকে এক অযোগ্য ব্যক্তির কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠাতেই হয়।

কথাটা শুনে প্রখর চোখে তাকালাম পোয়ারোর দিকে। একটা মুচকি হাসি ঝুলছে এখন ওর বুদ্ধিদীপ্ত ঠোঁটের কোণায়।

পকেট থেকে একটা একটা চিঠি বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-কাল আমরা এসে পৌঁছানোর আগেই এটা চলে এসেছিল।

আমি চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম, দারুণ ব্যাপার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠি : তোমার ক্ষমতা, দক্ষতার ওপর প্রচণ্ড ভরসা আছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ব্যক্তিগতভাবে তোমার সাহায্য প্রার্থনা করেছেন এই মামলায়।

পোয়ারো সমর্থনসূচক হেসে বলল-তাহলে ছুটির এখানেই বারোটা বাজল।

আমি হতাশ গলায় বলি–না, না, তার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু হোম সেক্রেটারি চিঠিতে লিখেছেন বিষয়টা খুব জরুরি।

হ্যাঁ, তিনি হয়তো ঠিক, আবার হতে পারেন ভুলও। এই রাজনীতিকরা খুব সহজে তাড়াতাড়ি নিজের চোখে দেখা…. প্যারিস, চেম্বার দ্যা ডিপোটিজ…..

পোয়ারো আবার গল্প ফেঁদে বসবার আগেই আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিই, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। পোয়ারো আমাদের কিন্তু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। লন্ডনের এক্সপ্রেসটা ঠিক বারোটায় ছাড়ে। পরের….

শান্ত, শান্ত হও হেস্টিংস। সেই একই রোগ।অল্পে উত্তেজিত হয়ে পড়া। আমরা আজ লন্ডনে যাচ্ছি না। এমনকি আগামিকালও নয়।

কিন্তু এই জরুরী তলব?

তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমি তো পুলিস বাহিনীর গোয়েন্দা নই। আমাকে গোপনে তদন্ত করতে বলা হয়েছিল। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। নিশ্চিতভাবে। অত্যন্ত সবিনয়, যথোচিত সৌজন্যের সঙ্গে আমি ওনাকে আমার অপরাগত জানিয়ে দিয়েছি। ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।

কিন্তু কেন? আমি অবাক গলায় প্রশ্ন করি।

হোম সেক্রেটারির অনুরোধ রাখা সম্ভব নয়, কারণ আমি মনে করি আমি শেষ হয়ে যেতে বসেছি। এরকুল পোয়ারোর সুবিখ্যাত গ্রে সেল-এর কর্মক্ষমতা ম্লান হয়ে আসছে। তাই আমি ঠিক করেছি অবসর নেব। এরকুল পোয়ারো তার শেষ মামলার সমাধান করে দিয়েছে। একটানা কথা বলে বন্ধুবর থামল।

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। যা শুনলাম সেটাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, বা হয়তো বিশ্বাস করতেই পারিছ না যা শুনলাম। তবু ওর সিদ্ধান্তকে কখনও অসম্মান করিনি, আজও করতে পারলাম না। অথচ তখনি বিদ্যুৎ ঝলকের মত প্রশ্নটা আমার মাথায় এল।

পোয়ারো, পরে তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না তো? সেক্ষেত্রে এরকম একটা মামলার কাজ হাতে না নেওয়া, যা অত্যন্ত সম্মানজনক-রহস্যটা সমাধান করতে পারলে সারা পৃথিবী জুড়ে সুখ্যাতি আরও ছড়িয়ে পড়ত। খুব বড়সড় ভুল হবে।

না, না। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা এরকুল পোয়ারোর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারে। অসম্ভব, অসম্ভব।

পোয়ারো? সত্যি সত্যি এবার বন্ধুবর আমার মুখের দিকে তাকায়। কি যেন ভাবে, কি যেন বোঝবার চেষ্টা করে। সামান্য বিচলিতও দেখায় তাকে। তারপর সে বলে, তুমি ঠিকই বলেছ, কারও এরকম ভাবে কথা বলা উচিত নয়। কাল যদি আমার দিকে একটা গুলি ছুটে আসে, যদি তাতে আমি মারা না যাই, আমি তাহলে খোঁজ বা তদন্ত করে দেখব, কে আমাকে গুলিটা ছুঁড়েছে? আলবাত করব। সে মাথা নাড়ে। কিন্তু ওকে কিছুটা অন্যমনস্ক দেখায়।

বন্ধুবর এরপর চেয়ারে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্থাৎ, ও গভীর কোনও চিন্তায় আচ্ছন্ন। তারপরই, আচমকা সে উঠে দাঁড়াল। এবং হঠাৎ দরজাটা খুলে অন্য মনস্কের মত ঘরের বাইরে পা রাখে। পোয়ারো দরজাটা টেনে খোলা মাত্র আমি দেখেছিলাম এক যুবতী–প্রথম দর্শনেই বেশ নজর কেড়ে নেবার মত সুন্দরী, দ্রুত পায়ে তরতর করে হেঁটে এদিকেই আসছে।

পোয়ারো ধড়াম করে আছড়ে পড়ল। আমি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি এবং আমি ধরাধরি করে বন্ধুকে তুললাম। বলাবাহুল্য, আমার নজর ছিল বন্ধুর দিকে, মনোযোগও। তারই মধ্যে আমার চোখে ধরা পড়ে একগুচ্ছ কালো চুল, দিঘল গভীর নীল চোখ আর ছিপছিপে তন্বী আদল।

উফ, ধন্যবাদ মাদাম জোয়েল।

আ-উচ, আমার পা….. আমি সত্যি সত্যি হাজারবার ক্ষমা চাইছি।

ধরাধরি করে আমি ও যুবতীটি পোয়ারোকে আবার বাইরের বারান্দায় চেয়ারে এনে বসালাম। আমি একজন ডাক্তার ডেকে আনার প্রস্তাব দিলাম।

বন্ধুবর দৃঢ়ভাবে আপত্তি জানাল, না, না, হেস্টিংস, সামান্য একটু গোড়ালিটা…….. কয়েকমিনিট বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখে নিও।

একটু থেমে বন্ধু এবার যুবতীর দিকে তাকায়, ওহ, দেখেছেন? আমি একেবারে ভুলে গেছি। মাদাম জোয়েল, বসুন, আমার বিনীত অনুরোধ।

মেয়েটি একটা চেয়ারে বসে। হয়তো চোটটা সামান্য, তবু আমার মনে হয় একবার পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত ডাক্তারকে দিয়ে। সাবধানের মার নেই।

আমার মনে হয় না তার কোন প্রয়োজন আছে। আপনার সান্নিধ্যে যন্ত্রণা অনেক কমে গেছে। বন্ধুবরের কথায় যুবতী হেসে ওঠে বাচ্চা মেয়ের মত।

বাহ, তাহলে তো চমৎকার।

তাহলে একপাত্র পান করলে কেমন হয়? আমার তো মনে হয় এটা একেবারে যথার্থ উপযুক্ত সময়।

পোয়ানোর প্রস্তাবে যুবতী সামান্য ইতস্তত করার পর বলে, বেশ।

 মার্টিনি?

 হ্যাঁ, ড্রাই মার্টিনি।

আমি উঠে যাই, পানীয়ের অর্ডার দিয়ে ফিরে এসে দেখতে পাই যুবতীর সঙ্গে পোয়ারো গভীর-অন্তরঙ্গ আলোচনায় মগ্ন।

ভাবতে পারো হেস্টিংস, ওই যে কোণের দিকে অসাধারণ সুন্দর বাড়িটা নিয়ে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করছিলাম, সেটার বাসিন্দা এই ইনি!

পোয়ারোর এসব ভনিতার সঙ্গে আমি বিলক্ষণ পরিচিত। তাই অবাক হবার ভান করি।

সত্যি? কি আশ্চর্য যোগাযোগ। অথচ পোয়ারো হঠাৎ এই আনকোরা যুবতীটিকে নিয়ে কেন পড়ল কিছুই মাথায় ঢুকছিল না আমার।

আশ্চর্য, বাড়িটিকে দেখলে মনে হয় যেন আলাদাভাবে এখানে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য সব কিছুর চেয়ে যেন আলাদা ওটি।

এটাকে বলা হয় এন্ড হাউস। বাড়িটাকে আমিও খুব ভালবাসি, তবে ওটা খুবই পুরানো হয়ে পড়েছে। ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে।

পোয়ারো উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, তার অর্থ আপনি একটা প্রাচীন পরিবারের সদস্য?

 মেয়েটি কেমন যেন নিস্পৃহ গলায় বলে।

সেরকমভাবে বলার মত কিছু নয়। তবে আমাদের বার্কলি পরিবারের গ্রাম তিনশো বছরের পুরানো! আমার ভাই চারবছর আগে মারা গেছে, সে অর্থে বলতে গেলে আমিই এই পরিবারের শেষতম সদস্য।

ওহ, খুবই দুঃখের ঘটনা। ওই বাড়িতে আপনি একাই থাকেন মাদাম জোয়েল?

বেশির ভাগ সময়ই আমি বাইরে থাকি। তবে যখন এখানে এসে বাস করি, পরিবারের নানান আত্মীয়-স্বজন আসেন–আমার সঙ্গে থাকেন, যাতায়াত করেন।

পোয়ারো শব্দ করে হেসে ওঠে, আর আমি নিজের কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম অন্ধকার, পুরানো ওই রহস্যময়, ভুতুড়ে বাড়িতে আপনি একা থাকেন আর আপনাকে তাড়া করে বেড়ায় এক বহু পুরানো পারিবারিক অভিশাপ।

যুবতীটি যেন চমকে ওঠে, কি আশ্চর্য, আমাকে বলতেই হবে আপনার মধ্যে অনুমান করার, ছবির মত ভেবে নেবার অসাধারণ এক ক্ষমতা রয়েছে।

না, ওটা ভুতুড়ে বাড়ি নয়। আর তা যদি হয়ও, তারা খুবই উপকারী ভূত। আমি অন্তত তিনবার আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি।

পোয়ারো আচমকা উঠে দাঁড়ায়, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন? হুম, বেশ উত্তেজক কাহিনী বলে মনে হচ্ছে।

না, না, সেরকম চমকপ্রদ কোনও ব্যাপার নয়। নিছক দুর্ঘটনা বলেই আমার বিশ্বাস।

ইতিমধ্যে আমাদের জন্য পানীয় এসে পৌঁছাল। আমরা যে যার গ্লাস তুলে নিলাম।

এই হোটেলের ককটেল সত্যি উপাদেয়। পোয়ারো গ্লাসে একটা চুমুক দেয়, সে কথা মেনে নিতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমরা আবার নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকি ককটেল চুমুকসহ।

আমরা যে বাইরের ঝুল বারান্দায় বসেছিলাম তার ঠিক নিচেই গাঢ় সবুজ ঘাসের রাস্তাটা ক্রমশ ঢাল হয়ে নেমে গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। আর এই মুহূর্তে সেই ঢাল বেয়ে উঠে আসছে একজন পুরুষ। লাল মুখ, একজন টিপিক্যাল নাবিকের চেহারা।

ওহ্ কোথায় যে গেল মেয়েটা। তার তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল, ভেসে এল সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে। …

নিক, নিক। আবার তার গলা ভেসে এল।

মিস বার্কলি উঠে দাঁড়ালেন, এই যে জর্জ, আমি এখানে।

আহ, তুমি ওখানে কি করছ মেয়ে?

ফ্রেডি পানীয়ের জন্য ক্ষেপে উঠেছে একেবারে চলে এস, চলে এস। তাড়াতাড়ি।

নিচের থেকে পোয়ারোর দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল জর্জ।

স্বাভাবিক! নিকের অন্যসব বন্ধুদের তুলনায় পোয়ারো নিঃসন্দেহে চেহারা, গরিত্রে একেবারে ভিন্নতর। ..

যুবতীটি ততক্ষণে আলাপ করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে–ইনি হলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কমান্ডার শ্যালিঙ্গার।

আমি থতমত হয়ে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকাই। কিন্তু সে নির্বিকার মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে জর্জকে অভিবাদন জানায়।

মেয়েটি এবার বন্ধুর পরিচয়ের জন্যে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 পোয়ারোর সঙ্গে পরিচয় দেবার কোন আগ্রহ বা উৎসাহ দেখা যায় না!

 বাধ্য হয়ে নিক বলে–আজ তাহলে চলি। ককটেলের জন্য ধন্যবাদ। আশাকরি আপনার পা খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। ধীর পায়ে সে চলে যায় একসময় শ্যালিঙ্গার আরমিকের চেহারা দুরে সরে যেতে যেতে মিলিয়ে যায়।

সুতরাং, এই তাহলে মাদাম জোয়েলের সঙ্গে এন্ড হাউসের বসূবাসকারী বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের একজন। চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে কিড়বিড় করে পোয়ারো।

তোমার কি মনে হয় হেস্টিংস? তোমাকে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে হলে তুমি কি বলবে? মানুষটি ভাল?

মানুষটি ভাল? এই কথাটির দ্বারা পোয়ারো ঠিক কি বোঝাতে চায়?

আমি ওর চিন্তার খেই ধরতে পারি না। তবে, একঝলকঃচিন্তকরে বলি–হ্যাঁ, আমার তো মনে হয় ভালই। অবশ্যই ওপর ওপর দেখে যতটা বোঝা যায়।

আর তখনই পোয়ারোর নজরে পড়ে তাড়াহুড়োয় নিক তার টুপিটা ফেলে রেখে গেছে।

পোয়ারো টুপিটা তুলে নিয়ে তাতে আঙ্গুল বুলোতে থাকে। গভীর চিন্তাক্লিষ্ট দেখায় তাকে।

লোকটার কি নিকের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে?

সেটা আমি কি করে বলতে পারি পোয়ারো?

কথাটা বলেই আমি হাত বাড়াই, দাও, টুপিটা আমাকে নও; মিঙ্গ বার্কলির হয় এটা দরকার হতে পারে। আমি দিয়ে আসি।

নিশ্চয়ই। গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা অন্যমনস্ক জায়গায় পোয়ারো বলো টুপিটা একইভাবে আঙ্গুল বুলিয়ে চলে। টুপিটা ফেরত দিতে এন্ড হাউসে তুমি একা যাবে না মেটেই। আমরা দুজনে যাব। একটু থেমে আবার অদ্ভুত গলায়রুলেআবার ওই সুন্দরী, চার্মিং মহিলাটিকে দেখবার জন্যে আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছি এরই মধ্যে।

আমি কটাক্ষ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার গলায় কুলি-ওই বুড়ো বয়সে শেষপর্যন্ত প্রেমে পড়লে নাকি হে?

মেয়েটি সুন্দরী। তাই নয় কি?

কারণ, হেস্টিংস তার নিজের বোধ, বিচার-বুদ্ধির ওপর আর তেমন কোনও আস্থা নেই। মেয়েটি বিপরীত লিঙ্গের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় বলে তোমার মনে হয় না কি? : আমি কিছুটা বিরক্ত-ভঙ্গিতে বলি–উত্তরটা নিঃসন্দেহে সদর্থক। কিন্তু পোয়ারো, আমি কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না মহিলার প্রতি তুমি এতটা ইন্টারেস্ট কেন দেখাচ্ছ?

আমি মহিলার প্রতি ইন্টারেস্টেড?

তোমার কথাবার্তা কি সেটাই প্রমাণ করছে না? পোয়ারো টুপিটাকে তার চোখের সামনে তুলে ধরে গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

সত্যি কথা বলতে কি বন্ধু হেস্টিংস, মেয়েটির থেকেও আমি ওর টুপিটার প্রতি বেশি উৎসাহি। আমি আবার মোয়রোর দিকে তাকাই। কিন্তু ওর মুখ চোখ যথেষ্ট সিরিয়াস।

হ্যাঁ হেস্টিংস, এই টুপিটা।

সে টুপিটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়–দেখ তো কেন আমি টুপিটার প্রতি এত বিশেষভাবে উৎসাহি বুঝতে পারো কি না।

সুন্দর টুপি! আমি টুপিটা হাতে নেবার আগ্রহ পর্যন্ত দেখাই না।

তবে, খুবই সাধারণ না বলে থাকতে পারি না। বহু মেয়েই এই ধরনের টুপি ব্যবহার করে। শেষ মন্তব্য করার মত করে বলি।

নাহ, এটার মত মোটেই নয়। আমি তীব্র চোখে আবার তাকাই।

দেখতে পাচ্ছো?

–এটা একটা সুন্দর টুপি ঠিকই। সুন্দর স্টাইল। অথচ খুবই সাধারণ।

ওহঃ হেস্টিংস, প্রিয় হেস্টিংস কেন বলত–আমি যা দেখতে পাই তুমি তা দেখতে পাও না? পোয়ারো টুপিটাকে হাতের আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে ঘোরাতে থাকে। সেটা বনবন করে ঘুরতে থাকে।

সবসময় যে মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোকেই গাৈয়েন্দাগিরির জন্য ব্যবহার করতে হবে, তা নয় হেস্টিংস। চোখ…… কখনও কখনও চোখকেও তীক্ষ্ণভাবে চতুরতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়।

কথা শেষ হয় না পোয়ারোর, এবার আমার নজরে পড়ে টুপিটার শীর্ষভাগে নিখুঁত গোল একটা ফুটো। সামান্য একটা ফুটো

 চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যায়। আমি প্রায় হতবাক, স্তব্ধ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাই। বন্ধুবরের মুখে সম্মতিসূচক মৃদু হাসি। মাথা নেড়ে সায় দেবার ভঙ্গিতে সে বলে-তুমি ঠিকই ভেবেছ হেস্টিংস, ঠিক তাই। বুলেট।

বুলেট?

 আমার গলায় অদ্ভুত লাগে কথাটা। মানে তুমি বলতে চাও……..

 আমি বলতে চাই এক ইঞ্চির তফাতে হলেই বুলেটটা টুপি নয় মাথা গর্ত করে দিত।

একটু থেমে তির্যক হেসে আমার দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বলে-এখন কি বুঝতে পারছ প্রিয় বন্ধু, কেন আমি এত ইন্টারেস্টেড?

একটু থেমে সে আবার বলে–অবশ্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কারণ তুমিই তো বলেছিলে অসম্ভব বলে কিছুই নেই, হয় না তাই না?

.

০২.

 এন্ড হাউস

পোয়ারো, আমি ভাবছি খুবই আদরনীয় অভ্যাস, প্রশংসনীয়ও, চালিয়ে যাও। জানালার পাশে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসেছিলাম। দুপুরের খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। গুলিটা খুব কাছ থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। অথচ আমরা কেউ তা শুনতে পেলাম না।

না হেস্টিংস-সোঁ সোঁ তীব্র হাওয়া, উতাল সমুদ্রের ঢেউ-এর গর্জন তার মধ্যে তা সম্ভবই নয়। একেবারেই নয়।

একটু ভেবে নিয়েই পোয়ারো আবার বলে-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের মাদাম জোয়েলের সঙ্গে একবার দেখা করতেই হবে। তিন দিনের মধ্যে তিনটে মৃত্যুর হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া, না–ব্যাপারটা…….

আমরা এরপর নীরবে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আচমকা জানালার বাইরে তাকিয়ে পোয়ারো খুশির গলায় বলে ওঠে–ওহ কি চমৎকার সংযোগ।

আমি তাকালাম। সদলবলে মাদাম জোয়েল বার্কলি এই বেঁস্তোরার দিকেই আসছেন।

পোয়ারো দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় এবং সহাস্যে অভিবাদন জানিয়ে টুপিটা মিস বার্কলির দিকে এগিয়ে দেয়।

মেয়েটি হেসে টুপিটা গ্রহণ করে। ওরা এসে টেবিলে বসে।

ওদের দলটা ছিল চার জনের–মিস বার্কলি, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার, একজন যুবক এবং একজন যুবতী।

আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে ওদের দলটাকে লক্ষ্য করাটা বেশ অসুবিধাজনক ব্যাপার। তারই মধ্যে বারবার আড়চোখে দেখছিলাম আর আড়ি পাতছিলাম। নৌ অফিসারটির উচ্চস্বরে হাসির শব্দ ভেসে আসছিল বারবার। আপাতদৃষ্টিতে মানুষটি আমুদে, প্রাণখোলা এবং সরল প্রকৃতির বলে মনে হয়।

বন্ধুবরকে বেশ কিছুটা মনোযোগাচ্ছিন্ন দেখাচ্ছিল। খাওয়ার প্রতি তার যেন কোনও মনোযোগই ছিল না। নীরবে এলোমেলো ভঙ্গিতে টুকটুক করে খেয়ে চলেছে। আমি বারকয়েক কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওর কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে চুপ করে গেলাম। খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরও পোয়ারো টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে লাগল কখন ওদের মুখোমুখি হবে।

ভাবতে ভাবতে ওরা খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে লাউঞ্জের দিকে এগোচ্ছে।

 পোয়ারো ঝটপট টেবিল থেকে উঠে পড়ল।

ওরা সবে গিয়ে লাউঞ্জে দাঁড়িয়েছে, পিছন থেকে পোয়ারো ডাকল–মাদাম, আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিল।

মেয়েটি পিছন ফিরে তাকাল। ওর চোখে চাপা অস্বস্তি।

আমি ওর মনের অবস্থাটা তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। রোগা চেহারার এই বিদেশিনীর খোঁজখবর না জানি কি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে কে জানে।

মাদাম কয়েক পা সরে দাঁড়ায়। পোয়ারো তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলে।

কয়েকমুহূর্ত পরই আমি ওর চোখে মুখে পরম বিস্ময় ভেসে উঠতে দেখি।

আমি এই পরিস্থিতিতে যথার্থ অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার আমার উদ্ধারে এগিয়ে এলেন। একটা সিগারেট এগিয়ে এলেন। একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে এলোমেলো কথা জুড়ে দিলেন। আমি কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে ছিলাম যে আমি মোটেই আমার কৌতূহলপ্রবণ সঙ্গীটির মত নই। আর সেই ফাঁকে আমি আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেলাম। লম্বা, পাতলা, ফর্সা সপ্রতিভও এক যুবক। কিছুটা মাংসল নাক। নিজের সম্বন্ধে একটা উন্মাসিকতা রয়েছে। সেটা আমার খুব একটা পছন্দ হচ্ছিল না। তারপর আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। ওর মধ্যে একটা অসাধারণত্ব রয়েছে। চূড়ান্ত অসাধারণ এক প্রতিচ্ছবি, ম্যাডোনার মত-ফর্সা রঙ, ধারালো চেহারা। প্রায় রঙহীন চুল। বড় বড় চোখের তারা। ধূসর তার রঙ। যুবকটি আমার দিকে তাকায়।

আপনার বন্ধু নিক-এর সঙ্গে যতক্ষণ না কথা সেরে নিচ্ছেন ততক্ষণ অন্তত আপনি বসুন।

আমি একবার শ্যালিঙ্গার-এর মুখের দিকে তাকাই, তারপর বলি-মিস বার্কলি খুবই দয়ালু মনের মহিলা। সকালে আমার বন্ধুর গোড়ালিতে চোট লেগেছিল। তখন উনি খুব সাহায্য করেছিলেন।

হুম, নিকও সেকথাই বলেছে।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজখবর চেষ্টা করে শ্যালিঙ্গার। তারপর বলে–যাক, এখন তো উনি পুরোপুরি সুস্থ আছেন?

কথাটা শুনে আমি কেমন যেন একটু লজ্জিত হলাম, বললাম-হ্যাঁ, সামান্য একটু মচকে গিয়েছিল।

যাক, আমার জেনে ভাল লাগল যে পুরো ব্যাপারটা নিজের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত নয়।

আমি কথাটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠি। মানে?

শ্যালিঙ্গার মাথা নাড়েন। মুচকি হেসে বলেন-এসব ব্যাপারে নিক একেবারে তুখোড়, চরম পটু। প্রায় ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতা বলা চলে। নিক একজন মিথ্যাবাদী।

কথাটা আমি হজম করতে পারছিলাম না; ওরকম মিষ্টি একটা মেয়ে।

ও যা সব সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। কেন, আপনাদের কিছু শোনায়নি? হত্যার চেষ্টা, গাড়ির ব্রেক খুলে রাখা……… শেষের দিকে তীব্র ব্যাঙ্গের মত শোনায় শ্যালিঙ্গারের কথাগুলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে পোয়ারো ফিরে আসে। আমি উঠে দাঁড়াই।

পোয়ারো আমার কব্জি চেপে ধরে, ওনাদের অভিবাদন জানিয়ে দ্রুতপায়ে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলেন। যেতে যেতে শুধু বললেন-সব ঠিক হয়ে গেছে। মাদাম সাড়ে ছ’টায় এন্ড হাউসে আমাদের দেখা করতে বললেন। আপাততঃ উনি এখন মোটর যাত্রায় যাচ্ছেন, আমাদের এখন ওনার ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

তুমি ওনাকে কি বললে?

আমি ওনার সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিস্তারিত কথা বলতে চাইলাম। প্রথমটায় উনি ঠিক রাজি হতে চাইছিলেন না। শেষে অবশ্য আমার কয়েকটা কু শুনে কিছুটা অবাক হয়েই রাজি হলেন আমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে।

বিকেল হতে না হতেই পোয়ারোর মনে এক প্রবল অস্থিরতা দেখা দিল। ঘরময় কেমন অস্থিরভাবে সে হেঁটে বেড়াতে লাগল।

ছ’টা বাজতে না বাজতেই আমরা রওনা দিলাম এন্ড হাউস-এর উদ্দেশ্যে।

অবিশ্বাস্য! তাই না হোটেলের বাগান। পাগল না হলে কেউ এরকম জায়গায় গুলি চালাবার ঝুঁকি নেয়?

না, তোমার কথা মোটেই মানতে পারছি না হেস্টিংস।

আবার একটু ভেবে দেখলে, এর থেকে নিরাপদ জায়গা আর হতে পারে না। প্রথমতঃ বাগান একেবারে নির্জন। দ্বিতীয়তঃ হোটেলে যারা আসে তারা বারান্দায় বসে সমুদ্র এবং বেলাভূমির সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়ে ওঠে। সেইসময় বাগান থেকে কেউ যদি সেই সৌন্দর্যপিপাসুটিকে গুলির শিকার করতে চায় খুবই সহজ ব্যাপার।

আমি অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ঠিক, পোয়ারো ঠিকই বলছে। লম্বা লম্বা গাছ, উঁচু উঁচু ঝোপ, ফুলের ঝাড়। আততায়ীর লুকিয়ে থাকাটা কোনও ব্যাপারই নয়। এখান থেকে আততায়ী নির্বিঘ্নে কাজটা সারতে পারবে।

সত্যি, ব্যাপারটা খুবই সহজ। আততায়ী জানত যে নিক বার্কলি ওই রাস্তাটা ধরে বাড়ি ফিরবে, তবু ব্যাপারটা কেন যেন বেশ ঝুঁকির মনে হচ্ছে আমার। গুলি করে খুন করাকে তো আর দুর্ঘটনা বলে চালানো যাবে না।

আমরা পৌঁছে গেলাম এন্ড হাউসে। আমাদের সামনে পাহাড়ের বাঁকে। শীর্ষদেশে ভেসে উঠল একটা ফটক; যার মাথায় ছোট্ট অক্ষরে লেখা এন্ড হাউস। ফটকের ভিতর প্রবেশ করে সরু গলি ধরে আমরা এসে হাজির হলাম ছোট্ট একটা বাগানে। বিভিন্ন ধরনের ফুলের ঝাড় আর ঘাসে ছাওয়া সুদৃশ্য বাগান সংলগ্ন ছবির মত সুন্দর একটা বাড়ি, যার জানালাগুলো সুন্দর পর্দায় ঢাকা। আমাদের পায়ের শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়সী এক বৃদ্ধ। ফুলের ঝাড় পরীক্ষা করছিলেন তিনি। প্রায় ছ’ফুট লম্বা, পরনে রংচটা জ্যাকেট, মাথা প্রায় ফাঁকা, তবে দু’চোখের চাউনি আশ্চর্য ধরনের।

শুভ সন্ধ্যা। আমাদের দিকে তাকিয়ে অভিবাদন জানালেন।

আমি প্রত্যুতরে অভিবাদন জ্ঞাপন করে ভেতরের দিকে এগোতে লাগলাম। যদিও বুঝতে পারছিলাম আমাকে কেউ যেন অনুসরণ করছে।

আশ্চর্য। পোয়ারো চিন্তান্বিত গলায় বলল।

আমরা বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বেশ পুরানো আমলের বাড়ি। দুর্গের আকারে এই বাড়ি। তবে প্রায় ভগ্ন দশা। মেরামত হয়ই না।

মধ্যবয়সী এক মহিলা দরজা খুলে দিলেন। সেই জানাল যে, মিস নিক বার্কলি এখনও ফেরেননি।

পোয়ারো জানাল মিস বার্কলির সঙ্গে তার আগে থেকেই সময় স্থির করা আছে এবং সে ওনার জন্যে অপেক্ষাও করবে।

আমরা ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পর্দাগুলো সুদৃশ্য–দামী ব্রোকেডের, কিন্তু পুরানো। ঘরের আসবাবপত্রগুলোও সবই পুরানো দিনের। দেওয়ালে বহু বছর নতুন রঙ পড়েনি। তবে সোফা এবং টেবিলের ঢাকনাগুলো সবই ঝকমক করছে, যেন নতুন। ঘরের দেওয়ালগুলো জুড়ে বালি পরিবারের পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্রা ঘরে একটা তারবিহীন ফোনও রয়েছে। সোফার কোণে দরকরচা মেরে পড়ে আছে একটা খবরের কাগজ। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ঘরের দরজা হাট করে খুলে গেল। মিস বার্কলি ঘরে ঢুকলেন। ঠান্ডা বরফ নিয়ে এস এলিন। বেশ চড়া গলায় বললেন তিনি। তারপর আমাদের দিকে ওনার নজর পড়ল।

 ওহ, আপনারা! আমি এসে পড়েছি। তবে আপনার প্রবল কৌতূহল দেখে আমি অবাক হচ্ছি বটে।

নিক থামলেন। কাঁধ ঝাঁকালেন, তারপর আবার বলতে লাগলেন বেশ কিছুটা কৌতুক মিশিয়ে–নিশ্চয়ই বলবেন–আপনি ছবি আঁকেন, আর আমার কাছ সেই ছবি বিক্রি করতে চান?

না, তা হতে পারে না। ওই গোঁফ, তারপর ম্যাজিস্টিকের মত দামি হোটেলে যিনি উঠেছেন–তিনি তো যেরকম কিছু হতে পারেন না।

এরই মধ্যে সেই আগের পরিচারিকা মহিলাটি ককটেলের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢোকে। নিপুন হাতে ককটেল বানায় নিক। আমাদের হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে নিজেও একটা গ্লাস তুলে নিয়ে সোফায় গুছিয়ে বসে। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায়। তাহলে………?

পোয়ারো শান্ত ভঙ্গিতে গ্লাসে চুমুক দেয়–আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে, তার আগে গ্লাস সহ হাত উঁচু করে বলে। মেয়েটি মোটেই বোকা নয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝা যায় তার গলার আওয়াজে-কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার?

অবশ্যই মাদাম জোয়েল। পোয়ারো কয়েকমুহূর্ত থামে, প্রখর চোখে নিককে নিরীক্ষণ করে। তারপর হাতটা মুঠো করে এগোয় হাতটা খুলতেই, তালুর মধ্যে ধরা বুলেটটা।

এটা কি আপনি জানেন?

নিক বিস্ফারিত চোখে বস্তুটার দিকে তাকায়।অবশ্যই। আমি জানি। এটা বুলেট।

ঠিক। সকালে আপনি যেটাকে মৌমাছি বা ভোমরা বলে মনে করেছিলেন–আপনার মুখের পাশ দিয়ে যেটা ছুটে গিয়েছিল, যেটা মোটেই এই ধরনের কিছু ছিল না। বরং ছিল এটা।

নিক বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েই থাকে, তারপর আতঙ্কিত গলায় বলে–তার মানে আপনি বলতে চান হোটেলের বাগান থেকে সকালে আমাকে লক্ষ্য করে কেউ গুলি চালিয়েছিল?

তাই তো মনে হচ্ছে।

নিক কয়েকমুহূর্ত থম মেরে বসে থাকে, তারপর থতমত গলায় আতঙ্ক মেশা ভঙ্গিতে বলে,-কয়েক দিনের মধ্যে আমাকে খুনের চতুর্থ চেষ্টা।

আমি বাকি তিনটের ব্যাপারে জানতে চাই আপনার কাছে।

মৃদু হেসে যোগ করে দুঘর্টনা। নিক সোজা স্পষ্ট চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায়। বন্ধুবর নিকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে–আমি নিশ্চিত হতে চাই যে ওগুলো কোন দুর্ঘটনা নয়, নিশ্চিতভাবেই খুনের চেষ্টা।

নিশ্চয়ই তাই-ই। অন্য কিছু হতে যাবে কেন? পোয়ারো তার গোঁফে মোচড় দেয়–তাহলে মাদাম জোয়েল, আমার মনে হয় মানসিকভাবে আপনার আরও বেশি বিপদের জন্য তৈরি থাকতে হবে। কে আপনার প্রাণহানি ঘটাতে চাইছে?

এবারে নিক হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে–হে ভগবান, আমাকে কে খুন করতে চাইবে? আমি তো কোটিপতির উত্তরাধিকারী নই যে আমার মৃত্যুতে কারও আর্থিক লাভ হতে পারে। না, আমার মনে হয় ব্যাপারটায় কোন বাস্তবতা বা সত্যতা নেই।

পোয়ারো মৃদু হাসে। আপনার কথাই হয়তো সত্যি মাদাম জোয়েল। তবু সব শুনতে চাই।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। নিক একটু থামে, কি যেন ভাবে–প্রথমটায়, একরাতে আমি যে বিছানায় ঘুমোচ্ছিলাম তার মাথার দিকের দেওয়াল থেকে ভারি একটা ছবি ভেঙ্গে পড়ে। ভাগ্যবশত আমি সে সময় সেটা বন্ধ করতে উঠেছিলাম। বিছানায় থাকলে নিঃসন্দেহে আমার মাথা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেত।

পোয়ারো চুপচাপ শুনে যায়। ওর মুখ গম্ভীর। তারপর? অন্য দুর্ঘটনাগুলো?

আমাদের এই বাড়ি থেকে সমুদ্রে যাবার একটা পাহাড়ি পথ আছে। খুবই তীক্ষ্ণ, আতঙ্কজনক খাদময় সেই পথ। আমি স্নান করতে গিয়েছিলাম। ওখানে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার জন্যে একটা পাথরের চাতাল মত আছে। সেই জায়গায় একদিন আমার মাথার ওপর থেকে একটা বড় পাথরের চাঙড়…….. মনে হয় কাকতালীয়, তাই না?

হুম, তারপর? চালিয়ে যান।

সেই তুলনায় তৃতীয় ঘটনাটা কিন্তু একেবারে ভিন্নতর। আমার গাড়ির ব্রেকটা কেটে গিয়েছিল সদর দরজা পার হয়ে পাহাড়ি পথে বুঝতে পারি। তবে, গাড়িটার ভাগ্য ভাল একটা পাথরের খাঁজে চাকাটা আটকে যায়। গাড়ি তাই থেমে যায়। তা না হলে গাড়িসহ পাহাড়ের যেকোনও বাঁকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে আছড়ে পড়া আমার নিশ্চিত ছিল।

কিন্তু কেন গাড়ির ব্রেক ফেল হয়েছিল?

 সেটা আপনাকে মট-এর গ্যারেজ থেকে জেনে নিতে হবে।

আপনার সেই গ্যারেজটা কোথায়? রেডমন্ড রোডে। পাহাড়ের ঠিক নিচেই।

এবার পোয়ারো কি যেন ভেবে নেয়, তারপর বলে–আপনার গাড়িটাকে একটু দেখা যাক মাদাম জোয়েল?

নিজের দু’চোখ প্রসারিত করে বিস্ময়চকিত গলায় বলে নিক।

ওহ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বাড়ির অন্যদিকেই আমাদের গ্যারেজ ঘর।

সেটা কি সবসময় তালা দিয়ে বন্ধ করা থাকে?

পোয়ারো চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে বলে–তার মানে কেউ যদি গাড়িতে কোনও কারসাজি করার চেষ্টা করে, খুব সহজেই সেটা করতে পারবে?

পোয়ারোর কথায় এতক্ষণে সে বুঝতে পারে–হ্যাঁ, তা নিশ্চয়ই পারে।

কিন্তু আমার যথেষ্ট বোকা বোকা লাগছে চিন্তাটা। নিক অবিশ্বাসের গলায় বলে।

পোয়ারো মাথা নাড়ে, না মাদাম জোয়েল, এর মধ্যে কোন বোকা বোকা ব্যাপার নেই। পুরোটাই বাস্তব আর সত্যি। আর সেই সত্যিটা হল অতি ভয়ঙ্কর। আপনার প্রাণের ওপর হামলা হয়েছে। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। আপনি ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে রয়েছেন মাদাম। আপনি জানেন আমি কে?

নিক অবাক চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ে না।

আমি এরকুল পোয়ারো।

মুহূর্তে নিকের দু’চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে–হে ভগবান, সত্যি?

 পোয়ারো মৃদু হাসে-আপনি আমার নাম শুনেছিলেন, তাই না?

 বিস্ময় ভরা চোখে হাসি চেপে নিক বলে-ওহ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু ওর কথা বলার মধ্যে একটা অপ্রস্তুত ভাব পোয়ারোর চোখ এড়ায় না।

.

০৩.

 দুর্ঘটনা?

নিঃসন্দেহে, নিকের এই ভঙ্গিটা পোয়ারোর ইগোকে আঘাত করে। সারা পৃথিবী যাকে একডাকে চেনে, অথচ এই মেয়েটি তাকে আদৌ চেনে বলে মনে হচ্ছে না। সে দাবি করলেও সেটা আমাদের কারও কাছেই মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় যেটা, মেয়েটা পোয়ারোর সাবধানবাণীকে আদৌ গুরুত্ব দিচ্ছে না। বয়ষ্ক বিদেশীটি যেন কোনও ভয়ানক মজা-কৌতুকের কথা বলছে। ভঙ্গিটা সেইরকম। নিকের এই অসন্তুষ্ট হওয়া, সেটা সত্যিই পোয়ারোর মত ব্যক্তিত্বের ইগোর পক্ষে মারাত্মক রকমের অস্বাস্থ্যকর।

পোয়ারোর গলাটা বজ্রনির্ঘোষের মত শোনায়।

আপনি কি একটু সিরিয়াস হবেন? আপনারা, এই অল্পবয়সীরা–কেন কোনও কথাতেই গুরুত্ব দেন না? একটু থেমে আগুনঝরা চোখে নিকের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো আবার বলে-মাদাম, আমার কথা শুনে আপনার নিশ্চয়ই খুব হাসি পাচ্ছে? অথচ মাথায় ছোট্ট একটা ফুটো নিয়ে আপনি যদি শুয়ে থাকতেন, তাহলে কিন্তু হাসতে পারতেন না। কারণ মৃতদেহ হাসে না।

নিক পোয়ারোর দিকে সংশয়ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। মিঃ পোয়ারো, আমাকে সাবধান করে দেবার জন্য ধন্যবাদ। তবে আমার সত্যি সত্যিই মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা নিছকই একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

পোয়ারো হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়, সামান্য থমকে নিককে নিরীক্ষণ করে–আহ, আবার সেই কথা, এক কথা। সামান্য থেমে পোয়ারো এবার তীব্র গলায় ঝাঝালো ভঙ্গিতে বলে-মাদাম জোয়েল, দয়া করে আমার কথায় আপনাকে মনোযোগ দিতে অনুরোধ করছি। আপনি ভীষণ রকম বিপদের মুখোমুখি, সকালে কেউ আপনাকে মাউজার পিস্তর দিয়ে গুলি করেছিল।

নিমেষে নিকের চেহারায় ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়। পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক গলায় বলে-মাউজার পিস্তল?

ওকে বিভ্রান্ত দেখায়।

হ্যাঁ, কেন? আপনি কি এরকম কাউকে চেনেন, জানেন, যার কাছে মাউজার পিস্তল রয়েছে?

নিক হাসে, আমার কাছেই আছে। হ্যাঁ, বাবা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসায় দিয়েছিলেন।

একবার সেই বস্তুটা দেখতে পারি?

 হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

নিক উঠে যায়, বরাবর এটা এখানেই থাকে। সে একটা পুরানো আমলের দেরাজের বিশেষ একটা খোপের দিকে ইঙ্গিত করে। তারপর সেটা টেনে খুলতেই ওর মুখের ভাব সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। বিস্ফারিত চোখে চমকিত গলায় সে বলে-ও-ওটা নেই।

নিক (আমরা এতক্ষণে কথা প্রসঙ্গে জেনে ফেলেছি এটা ওর দাদুর দেওয়া নাম, ওর আসল নাম ম্যাগদালা) আবার চেয়ারে ফিরে এসে বসে। ওর মুখে ঘন চিন্তার রেখা। আশ্চর্য ছোট্ট শব্দটায় মনের ভাব প্রকাশ করে সে।

তোমার মনে আছে হিস্টেংস, আমি যে সম্ভাবনাটার কথা আগেই তোমায় বলেছিলাম। মনে পড়ছে?

আমি নিরাপদ থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করি। প্রিয় বন্ধু আবার একটা নিজস্ব চাল দিয়েছে।

সামান্য বিরতি, পোয়ারো নিকের অভিব্যক্তিটা দ্রুত চোখে নিরীক্ষণ করে, তারপর আবার বলতে শুরু করে–আমার ধারণাটাই সত্যি হল। মাদাম জোয়েলের গুলিবিদ্ধ শরীরটা হোটেলের বাগানে নিথর হয়ে পড়ে থাকত। অনেকক্ষণ যা কারোর নজরে পড়ত না। সেই ফাঁকে, কাজটা খুবই সহজ পিস্তলটা ওর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত। পরে মাদাম এলিন যা সনাক্ত করতেন ওটা অবশ্যই মাদাম জোয়েল এরই পিস্তল এবং তিনি এও জানাতেন, সম্প্রতি মাদম জোয়েল খুব নার্ভাস, মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিলেন।

নিক অস্বস্তির ভঙ্গিতে নড়ে। ওর মুখে-চোখে স্পষ্টতই সংশয়। পোয়ারো আবার বলতে শুরু করে। সুতরাং আবার বলতে ঘটনাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। খুব সহজ হবে ব্যাপারটা।

কি ভয়ঙ্কর! নিকের গলায় স্পষ্ট আতঙ্ক।

পোয়ারো আমার দিকে তাকায়, ওর চোখে বিজয়ীর হাসি। মাথা নেড়ে নিজের আতঙ্ককে সমর্থন করেই যেন পোয়ারো বলে–আর একটা ব্যাপার, চার চারটে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে … পঞ্চমবার হয়তো সেটা হবে না।

নিক পোয়ারোর দিকে তাকায়। দুষ্টিতে সংশয়।

পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন-না, না, মিস বার্কলি, চিন্তা করবেন না। আমরা আছি। আপনাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করব।

মিস বার্কলি সামান্য হাসেন-ধন্যবাদ। আপনি ভয় দেখান সুন্দরভাবে। ঘটনাগুলোর মতই বিপজ্জনক ধরনের, আবার রোমহর্ষক। আমি লক্ষ্য করছিলাম নিক তার নির্দয় অভিজ্ঞতাটাকে ধরে রাখলেও, বজায় রাখবার চেষ্টা করে চললেও-ওর দৃষ্টিতে স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে সমস্যার প্রতিচ্ছবি, বিপদের আঁচ।…

পোয়ারো মৃদু কাশে। তারপর বিনীত ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকে বলে-তাহলে প্রথমেই যেটা করতে হবে, প্রথাগত আলোচনা। নিকের চোখে চোখ রাখে সে-তাহলে…..শুরু করা যাক মাদাম জোয়েল? প্রথমে যে প্রশ্নটা অবশ্যম্ভাবী এসে পড়ে, আপনার কোন শত্রু আছে?

নিক মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দেয়, না।

পোয়ারো সমর্থনসূচক ভঙ্গি করে–বেশ। তাহলে আমরা সিনেমা বা গোয়েন্দা কাহিনীতে গোয়েন্দাকে এরপর যে প্রশ্নটা করতে শুনি-আপনার মৃত্যু হলে কার সবচেয়ে লাভ?

এবার নিককে দৃশ্যতই বিভ্রান্ত দেখায়।

সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। যে কারণে আমার গোটা ব্যাপারটাকে আজব, দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। আমার সেরকম কোনও সম্পত্তি নেই, যার কারণে আমাকে খুন করার চেষ্টা করা হতে পারে। হ্যাঁ, এই বাড়িটা আছে বটে কিন্তু পুরানো এই বাড়িটাও তো বন্ধক রাখা।

বাড়িটা বন্ধক রাখা আছে?

নিক এবার কিছুটা বিমর্ষ গলায় বলে–আমি বাধ্য হয়েছিলাম। পরপর কয়েকটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেল। একটার পর একটা। প্রথমে আমার ঠাকুর্দা। সেটা ছ’বছর আগের ঘটনা। তারপর আমার ভাই। অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম ভীষণভাবে।

পোয়ারো গভীর মনোযোগ দিয়ে নিকের প্রত্যেকটা কথা শুনছিল। মেয়েটা থামতেই আড্ডা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে-আর আপনার বাবা?

উনি যুদ্ধে আহত প্রতিবন্ধী অবস্থায় ফিরে এসেছিলেন। কয়েকবছর পরই নিউমোনিয়াতে মারা যান।

একটু থেমে নিক আবার যোগ করে–আমার শিশু বয়সেই মা মারা গিয়েছিলেন। মায়ের অকাল মৃত্যুর শোক বাবা সহ্য করতে পারেননি। তারপর থেকেই ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হতেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আমি বা আমার ভাই জেরাল্ড কেউই বাবার সঙ্গ পাইনি। ঠাকুর্দার কাছেই মানুষ হয়েছি। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন একজন অতুলনীয় মানুষ। লোকে বলত তিনি যাতে হাত দিতেন তাই নাকি সোনা হয়ে উঠত। তিন তার ভাগ্য পরীক্ষা করতেন জুয়ায়। যার মাধ্যমে প্রচুর রোজগার করেছিলেন তিনি। আমার যখন ষোল বছর বয়স, তিনি মারা যান। তারপর এই বাড়ির মালিকানা পায় আমার ভাই জেরাল্ড। মাত্র বছর তিনেক আগে এক মোটর দুর্ঘটনায় জেরাল্ড মারা যায়।

আপনার পর এ বাড়ির মালিকানা পাবেন সেরকম নিকটাত্মীয় কি কেউ আছেন মাদাম জোয়েল? পোয়ারো প্রশ্ন করল।

নিক দ্রুত কয়েকমুহূর্ত ভেবে বলে–আমার সম্পর্কে এক ভাই চার্লস। চার্লস ভাইস। পেশায় ও একজন দক্ষ আইনজীবী। সব ব্যাপারে আমায় সে খুব সাহায্য করে।

আপনার বিষয় সম্পত্তির দেখাশোনা কি ইনিই করেন?

উফ, সেভাবে দেখতে গেলে দেখাশোনা করার মত বিষয় সম্পত্তি আমার সেরকম নেই। তবে হ্যাঁ, আমার বাড়িটা বন্ধক রাখতে চার্লসই সবরকম ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। লজটা ভাড়া দেবার ব্যবস্থাও সেই করে দিয়েছিল। উফ, লজ, আমি এক্ষুনি এ প্রসঙ্গে আসছিলাম।

ওটাও কি ভাড়া দেওয়া ম্যাদাম?

নিক সায় দেয়,– হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ান এক পরিবারকে। খুবই আন্তরিক এবং মিশুকে পরিবার।

পোয়ারো কি যেন চিন্তা করে। তারপর বলে–এখানে ওরা কতদিন ধরে রয়েছেন?

 বেশিদিন নয়। মাত্র মাসছয়েক।

 আচ্ছা ম্যাদাম, আপনার ওই ভাইটি, চার্লস–সে কি আপনার বাবার দিকের আত্মীয় না মায়ের?

ওহ, চার্লস আমার মায়ের দিকের সম্পর্কিত। আমার মাসতুতো ভাই।

পোয়ারো আবার ঘনঘন দু’পাশে মাথা নাড়ে সমর্থনের ভঙ্গিতে।

 বেশ। এছাড়া আর অন্য আত্মীয়-স্বজন?

খুব কম। ইয়র্কশায়ারে কয়েকজন দূর সম্পর্কের ভাইবোন আছে।

 হুম, তাহলে আপনার তো যথেষ্ট নিঃসঙ্গ জীবন কাটে তাই না?

পোয়ারোর কথায় মিস বার্কলি মৃদু হাসেন–নিঃসঙ্গ? না মিঃ পোয়ারো। আসলে সম্পর্ক তৈরি বা বজায় রাখার সময়ই আমার থাকে না। দেশে তো বলতে গেলে আমি প্রায় থাকিই না।

যাক, এবার আপনার বন্ধুদের বিষয়ে একটু জানব। দুপুরে আপনাকে যাদের সঙ্গে দেখলাম।

ওরা, একজন ফ্রেডি রাইস। আমার অন্যতম প্রিয় এবং ঘনিষ্ট বান্ধবী। ওর জীবনটা বলতে গেলে ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা জানোয়ারের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছিল। মদ আর মাদকই তার জীবন ছিল। বছর খানেকের মধ্যে ফ্রেডি তাকে ছেড়ে চলে আসে। আমি চাই আইনত বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেলে ফ্রেডি জিম লাজরুমকে বিয়ে করুক।

জিম লাজরুম? বন্ড স্ট্রিটের আর্ট ডিলার?

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। জিম তার একমাত্র সন্তান। সুপুরুষ। সৎ। অত্যন্ত ভদ্র। সবচেয়ে বড় কথা, ফ্রেডি নিবেদিত প্রাণ। ওরা হোটেল ম্যাজেস্টিকেই রয়েছে গত একসপ্তাহ ধরে। আগামি সোমবার আমি একটা পার্টি দিচ্ছি। সেদিন ওরা এখানে আসবে।

পোয়ায়োর কপালে ভাঁজটা ক্রমে গম্ভীর হচ্ছে। আমি ওর এই চেহারা খুব ভালভাবেই চিনি। চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে পোয়ারো নিককে উদ্দেশ্য করে বলে–আর মিসেস রাইমের স্বামী?

সেই নেশাখোর হতচ্ছাড়ার তো কোন খোঁজই নেই। সে যে কোথায় কেউ জানে না। ফ্রেডিও সে কারণে ডিভোর্সটা পাচ্ছে না।

হুম। এবার মাদাম জোয়েল আপনার অন্য বন্ধুদের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। কমান্ডার শ্যালিঙ্গার?

জর্জ?–গত পাঁচ বছর ধরে আমি ওকে চিনি।

পোয়ারো এবার নিককে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। এবার বন্ধুর মত প্রশ্ন করে–যদি কিছু মনে না করেন, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি আপনাকে–উনি কি আপনাকে বিয়ে করতে চান?

নিক সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই ব্যক্তিগত প্রশ্নটার জবাব দেয়–হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই কথাটা তোলে।

এ বিষয়ে আপনার কি মত?

না, জর্জকে বিয়ে করার বাসনা আমার কোন মতেই নেই। কারণ ওর বিত্তসম্পদও নেই, বয়সও চল্লিশ পার হয়ে গেছে। তাছাড়া চরিত্রের দিক দিয়ে একটু একঘেয়ে স্বভাবের।

পোয়ারো মৃদু হাসে-সঠিক যুক্তি। আপনার মত একজন প্রাণোচ্ছল যুবতীর সঙ্গে উনি মোটেই মানানসই নন।

একটু থেমে পোয়ারো আবার বলে–আচ্ছা মাদাম যে ছবিটা আপনার বিছানার ওপর ছিঁড়ে পড়েছিল, সেটা কি একবার দেখা যায়?

নিক একঝলক পোয়ারোর মুখের দিকে তাকায় তারপর বলে–হ্যাঁ, কেন নয়?

নিকের পেছন পেছন আমরা ওর শোবার ঘরে এসে হাজির হলাম।

মাথার দিকে ওপরে ফ্রেমে বাঁধানো একটা তেলচিত্র। পোয়ারো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল–আগের দড়িটাও কি একইরকম পোক্ত ছিল?

হ্যাঁ, প্রায়? মিস বার্কলি অন্যমনস্ক গলায় উত্তর দেয়।

পোয়ারো দড়িটা দেখতে দেখতে বলে–আগের দড়িটা আছে কি?

নিক অবাক গলায় বলে–একটা ছেঁড়া তার, সেটা রেখে দেওয়া হবে কেন?

পোয়ারো গভীর আক্ষেপের মাথা নাড়ে–মাদাম জোয়েল, তারটা দেখলে বোঝ যেত সেটা সত্যিই ছিঁড়ে গিয়েছিল না কি সেটা কেটে দেওয়া হয়েছিল?

নিক খুবই তাচ্ছিল্যের গলায় বলে-না, না, সেরকম কিছুই নয়। ওটা নিছকই একটা দুর্ঘটনা ছিল। আর কিছুই হতে পারে না।

হ্যাঁ, মাদাম জোয়েল জোর গলায় বলা যায় না যে এটা দুর্ঘটনা নয়। কিন্তু আপনার গাড়ির ব্রেক নট করে দেওয়া বা পিস্তলের গুলি ছোঁড়া, এগুলো কোনভাবেই দুর্ঘটনা হতে পারে না। এমন কি পাথরের চাতাল থেকে পাথরের চাঁই গড়িয়ে পড়া, সেটাও খুবই সন্দেহজনক।

পোয়ারো এবার বাড়িটা ভাল করে ঘুরে ঘুরে দেখল। সারা বাড়িতে আশ্চর্য এক নিঃশব্দ বিরাজমান।

মাদাম, আপনার বন্ধুদের মধ্যে এমন কেউ আছেন যাকে আপনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেন?

বলতে গেলে ফ্রেডি। কেন বলুন তো?

এখন থেকে আপনার সঙ্গে কারও সর্বক্ষণ থাকা উচিত, পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে।-তবে মিসেস রাইসনয়। অন্য কেউ।

কথাগুলো শুনে নিক এবার যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারপর কি যেন ভাবে কিছুক্ষণ–এবার বলে ম্যাগি, ওর ওপর ভরসা করা যায় অবশ্যই।

ম্যাগি? তিনি কে?

আমার ইয়র্কশায়ারের তুতোদের একজন। একটু থামে নিক। পোয়ারোর মুখের দিকে তাকায়–আমারই সমবয়সী। ওকে দিয়ে আপনার কাজ চলবে?

নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আপনার তুতো বোন যখন তিনি নিশ্চয়ই ভরসাযোগ্য।

 নিক একটা গভীর শ্বাস ছাড়ে।–বেশ–আমি তাহলে ম্যাগিকে তার পাঠাচ্ছি, কিন্তু ওকে আপনি ঠিক কি করতে বলছেন?

মাদাম জোয়েল বার্কলি, সম্ভব হলে, না না সম্ভব হলে নয়, নিশ্চিত করবেন যেন উনি রাতে আপনার সঙ্গে ঘুমোন।

ঠিক আছে।

কিন্তু এরকম একটা আবদার করলে উনি কিছু মনে করবেন না তো?

না না, ম্যাগি সেরকম মেয়ে নয়। তাছাড়া আমরা খুবই ঘনিষ্ট।

আমরা আবার বসবার ঘরে এসে বসলাম। নিক কিছুটা বিভ্রান্ত গলায় বলে–আপনি কি সব ঘটনা ম্যাগিকে জানাবেন?

না, না, আপনি নিশ্চিত থাকুন ম্যাদাম। আর যাই ঘটুক, সব কিছু সাহসের সঙ্গে মুখোমুখি হবেন। একটু থেমে পোয়ারোর যেন হঠাৎ মনে পড়ল–ওহ, ভাল কথা, আপনি কি কখনও সম্পত্তির ইচ্ছাপত্র করেছিলেন?

হ্যাঁ, অপারেশনের আগে আমি একটা ইচ্ছাপত্র করেছিলাম।

অপারেশন?

হ্যাঁ, মিঃ পোয়ারো আমার অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হয়েছিল মাসছয়েক আগে। তখন আমার মনে হয়েছিল তার আগে একটা উইল করে যাওয়া উচিত।

পোয়ারো আমার দিকে তাকায়। ওর চোখের ভাষা আমার চেনা। তাই অপ্রিয় প্রশ্নটা আমাকেই করতে হল।

মিস বার্কলি যদি কিছু মনে না করেন, সেই উইলের ব্যবস্থাটা কিরকম ছিল?

নিক একটা শ্বাস নেয়। একটু ভেবে নিয়ে বলে–এন্ড হাউসটা চার্লসের নামে লিখে দিয়েছিলাম আমি। এছাড়া আর আমার তেমন কিছু সম্পত্তি নেই।

পোয়ারো অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। তারপর নিকের দিকে তাকিয়ে বলে–মাদাম জোয়েল এবার আমরা আসব।

একটু থেমে নিকের দিকে তাকায়–মাদাম একটু সাবধানে থাকবেন।

 নিক আশঙ্কিত চোখে তাকায়–কি থেকে?

পোয়ারো উদাস গলায় বলে–সেটা এই মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। আশাকরি দিন কয়েকের মধ্যে আসল সত্যটা আমি আবিষ্কার করতে পারব। আপাতত নিজের বিচার বুদ্ধিকে ব্যবহার করে সতর্ক থাকবেন–কোথায় আপনি নিরাপদ, কোন দিক থেকে বিপদ আসতে পারে।

.

০৪.

কিছু ঘটবে, ঘটবেই

 পোয়ারো রাস্তায় এসে দাঁড়ানো মাত্র আমি বললাম-একটা কথা তোমার অতি অবশ্যই জেনে রাখা উচিত।

সেটা কি?

আমি আজ দুপুরে কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গারের মুখ থেকে শোনা নিকের দুর্ঘটনাগুলো বর্ণনা করলাম।

বেশ মনযোগ দিয়ে পোয়ারো কথাগুলো শুনল। তারপর হাসিমুখে বলে–হ্যাঁ, অবশ্যই এরকম কিছু চরিত্র থাকে যারা এধরনের ভয়ঙ্কর গল্প নিজের সম্পর্কে প্রচার করে সবার কাছে, অন্যদের কাছে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে চায়।

আমি সরাসরি পোয়ারোর মুখের দিকে তাকাই। ওর মনের ভাব পড়বার চেষ্টা করি।

তোমার কি মনে হয় মিস বার্কলি……

 পোয়ারো আমার কথা শেষ করতে দেয় না, বাধা দিয়ে বলে ওঠে–না, না, হেস্টিংস, অবশ্যই নয়–তুমি লক্ষ্য করনি, উনি সত্যি সত্যি চরম বিপদের মধ্যে রয়েছেন সেটা ওনাকে বোঝাতে আমার কেমন ঘাম ছুটে গেল?–যদিও বা বোঝানো গেল, তবু মনে হয় না নিজের বিপদের ব্যাপারটা উনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেছেন।

তাহলে? অকারণে কেন শ্যালিঙ্কার আমাকে ওইসব কথাগুলো বলল?

নিছক মিথ্যেবাদী প্রতিপন্ন করতে চাইল কেন? সবচেয়ে যেটা বড় হয়ে আমার চোখে এখন ধরা পড়েছে, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্কার দুপুরে গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলেন এই কথাগুলো বলবার জন্যেই। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে এনেছিলেন ব্যাপারটাকে, কিন্তু কেন? মিস বার্কলিকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে ওনার কি লাভ?

পোয়ারোকে কথাগুলো বলতে সেও মৃদু রহস্যময় হাসি হাসল।

তুমি সত্যি খুব ভাল জায়গায় আঙুল ছুঁইয়েছ বন্ধু। কিন্তু সত্যি কথাটা হল আমরা এখনও উত্তরটার দরজায় পা রাখিনি।

কিন্তু পোয়ারো আমি প্রশ্ন করি–তুমি এত তাড়াহুড়ো করে মাদাম জোয়েলের তুত বোনকে ওনার সঙ্গে থাকবার ব্যবস্থা করলে কেন?

পোয়ারো শূন্যে হাত দোলায়, ওর আঙ্গুলগুলোয় ঢেউ তোলে। প্রিয় হেস্টিংস, এক্ষেত্রে আমার যে প্রতিদ্বন্দ্বী তুমি কি বুঝতে পারছ না। আমাদের দু’হাত শক্ত করে বাঁধা। কোনও অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর যেটার সমাধান করা এরকুল পোয়ারোর কাছে কোনও সমস্যার ব্যাপার নয়। অপরাধী তো অপরাধের শরীরে তার নাম সই করে যায়। আমি সেটার পাঠোদ্ধার করি মাত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে তো কোনও অপরাধ ঘটেই নি, এবং আমরা চাইও না–কোনও অপরাধ ঘটুক। কোনও অপরাধ ঘটবার আগেই তাকে নির্ণয় করা দুর্লভতম কঠিন কাজ।

পোয়ারো একটু থামে–আমাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হল মাদাম জোয়েলের নিরাপত্তা। তাই তো? এবং সেটি মোটেও সহজ কাজ নয়। না, একেবারেই সহজ কাজ নয় হেস্টিংস। আমাদের পক্ষে দিন এবং রাত সর্বক্ষণ তার ওপর নজর রাখা সম্ভব নয়। আমরা কোনও পুলিশকেও নজরদারি করতে পাঠাতে পারি না। একজন যুবতীর শোবার ঘরে তো আমরা রাত কাটাতে পারি না।

পোয়ারো থামে, যেন দম নেয়–কিন্তু আমাদের সম্ভাব্য খুনির কাজটাকে আরও কঠিন করে তুলতে আমরা একটা কাজ করতে পারতাম। পোয়ারো থামে, এর বেশি কিছু বলবার দরকারও ছিল না। আমি তখন বেশ খুশি হয়ে উঠলাম এবং নিকের নিরাপত্তা কথা ভেবে নিশ্চিতবোধ করতে লাগলাম, ঠিক তখনই পোয়ারো কথা বলল আবার। এবং একেবারে ভিন্ন গলার স্বরে। আমি চমকিতবোধ করলাম কথাটা শুনে।

কিন্তু হেস্টিংস, আমার যথেষ্ট ভয় করছে।

সবিস্ময়ে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলি-ভয়?

হ্যাঁ, হেস্টিংস। ভয়! কারণ, লোকটা একেবারে শয়তান ধূর্ত। না হে, আমি একেবারে স্বস্তি পাচ্ছি না বন্ধু।

পোয়ারো, আমি তীক্ষ্ণ গলায় বললাম–তুমি আমাকে বেশ উদ্বিগ্ন করে তুলছ হে বন্ধু।

আমিও তোমার মত উদ্বিগ্ন হেস্টিংস, কেন জানো? স্থানীয় খবরের কাগজটিতে ছোট্ট একটা খবর বের হয়েছে। মাদাম জোয়েলের বাড়িতে বিখ্যাত গোয়েন্দা। এরকুল পোয়ারো ম্যাজিস্টিক হোটেলে উঠেছেন। হেস্টিংস, সবাই আমার নাম জানে আর ওতো ঝানু অপরাধী, সে তো আমার নাম জানবেই। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি আমার উপস্থিতি জানবার পরে তার কি করা উচিত?

অবশ্যই আত্মগোপন করা উচিত। পোয়ারোর আত্মগর্বকে উসকে দিয়ে আমি বলি–অযথা সে বৃথা সময় নষ্ট করবে না। পোয়ারো তদন্ত শুরু করার আগেই আমাকে যা করার করে ফেলতে হবে, ভেবে নিয়ে দ্রুত চরম আঘাত হানতে চাইবে–তাই নয় কি?

একটু থেমে পোয়ারো আবার যোগ করে–আর খবরের কাগজটা যেভাবে ভাঁজ করা ছিল, কেউ সেটা পড়েছিল। আর শুনলে তো হেস্টিংস, মিস বার্কলি বললেন–তিনি আজ খবরের কাগজ পড়েননি। তাহলে? কে পড়েছিল খবরের কাগজটা?

এবার আমিও বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম–তার মানে বাড়িরই কেউ………

 নিঃসন্দেহে-হেস্টিংস, নিঃসন্দেহে।

 তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?

 পোয়ারো হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে শূন্যে ছোঁড়ে।

না, এই অপরাধের মোটিভ যাইহোক না কেন–সেটা দ্রষ্টব্য নয়। নিছক খুন করার কারণ কি হতে পারে? পুরানো বন্ধক রাখা এই বাড়ি? সম্পত্তি? হাস্যকর। তাহলে? তাহলে? তাহলে?

কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার? একমাত্র সন্দেহের তালিকায় ওকেই রাখা যায়।

পোয়ারো দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে–নাহ, আমি জানি কেন তুমি একথা বলছ, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস-কম্যান্ডারের সঙ্গে এই মামলার কোনও যোগাযোগ নেই। উনি একজন পাক্কা সাহেব।

কিন্তু পোয়ারো উনি মিস বার্কলি সম্পর্কে……..

আমায় শেষ করতে না দিয়েই পোয়ারো হাত তুলে বাধা দেয়। বন্ধু, আমার মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে উনি অন্যের মুখে শোনা কথা সত্যি বলে বিশ্বাস করে তোমার কাছে উগড়ে দিয়েছেন।

অন্যের মুখের কথা? সেটা কার হতে পারে?

পোয়ারো দুই আঙুলে গোঁফের একটা প্রান্তকে মোচড়াতে মোচড়াতে কৌতুকের গলায় বলে–সঠিক বলতে পারব না–হয়তো মিসেস রাইস।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম সেই গ্যারাজটিতে, যার কথা মিস বার্কলি উল্লেখ করেছিলেন।

পোয়ারো গ্যারেজ মালিককে নিজের পরিচয় দেয় মিস বার্কলির পরিচিত বলে, সঙ্গে একথাও বলে–মিস বার্কলির পরামর্শেই তিনি সেখান থেকে লঙ ড্রাইভেও যাবার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করতে এসেছেন। এসব কাজে কথাবার্তা চালাতে চালাতেই, সুচতুরভাবে কখন যেন ঢুকে পড়ে মিস বার্কলির গাড়ির গণ্ডগোলের প্রসঙ্গে।

গ্যারাজ মালিক যা বলল সেটা পুরোটাই যাত্রিক কথাবার্তা, কৌশলগত গাড়ির বিষয়। আমি সেই মোটর যানের নির্মাণ কৌশলের বিষয়ে পুরোপুরিই অন্ধ। পোয়ারো নিজেও এ বিষেয়ে খুব একটা বিজ্ঞ নয়। তবে তারই মধ্যে আমরা যা চাইছিলাম সেটা পেয়ে গেলাম। মোটর মেকানিক ও গ্যারাজ মালিকের কথার ভেতর থেকেই তা বেরিয়ে এল। নিকের গাড়িটা ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ বিগড়িয়েছিলেন এবং খুব সহজেই তা করা সম্ভব।

আমরা যখন রাস্তা ধরে হোটেলের দিকে ফিরছিলাম তখন পোয়ারো মন্তব্য করল–তাহলে, এই ব্যাপার?

একটু থেমে ভুরু কুঁচকে সে আবার বলে–নিক তাহলে ঠিক সন্দেহেই করেছিল।

তাহলে, এখন আমাদের কর্তব্য কি?

 একটা টেলিগ্রাম করা। যদি না খুব বেশি দেরি হয়ে গিয়ে থাকে।

টেলিগ্রাম? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।

হ্যাঁ, টেলিগ্রাম।

আমরা পোষ্ট অফিসে এসে হাজির হলাম। পোয়ারো টেলিগ্রামের বয়ান লিখল, সেটা পাঠিয়েও দিল কাকে, কোথায় কিছুই বলল না। ও হয়তো চেয়েছিল আমি প্রশ্ন করে জানতে চাইব। আমি সযত্নে যে পথ পরিহার করলাম।

সোমবারের আগে মিঃ ভাইসের সাথে কথা বলা যাবে না। কাল তো আবার রবিবার। মুশকিল। পোষ্ট অফিস থেকে ফেরার পথে পোয়ারো মন্তব্য করল।

কিন্তু মিঃ ভাইসের থেকে তোমার জানবার মত এমন কি জরুরি বিষয় আছে?

খুব সহজ। পেশাদারি ভঙ্গিতে আমাকে জেনে নিতে হবে যে আজ দুপুর ১২-৩০ মিনিট নাগাদ তিনি কি নিজের বাড়িতে ছিলেন? পোয়ারো গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা অন্যমনস্ক গলায় বলে।যে ক্ষেত্রে গুলিটা উনি নিশ্চিতভাবে ছোড়েননি সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে।

আমি পাদটীকা জুড়ি–আচ্ছা পোয়ারো, ম্যাজেস্টিক হোটেলে নিকের যে তিনজন বন্ধু-বান্ধবী রয়েছেন তাদের অ্যালিবাই যাচাই করে দেখবে না?

সেটা খুব সহজ কাজ নয়। ওদের মধ্যে কেউ একজন কয়েক মিনিটের জন্যে অন্যদের থেকে আলাদা হতেই পারে।

লাউঞ্জ, ধুমপানের ঘর, কাপড় ধোবার ঘর, নিচের বসবার ঘর, বাহানা অনেক হতে পারে। তারপর বাগানে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করা, মেয়েটা কখন সে জায়গাটা দিয়ে যাবে। সবই ঠিক আছে হেস্টিংস। কিন্তু সেটা আমরা প্রমাণ করব কিভাবে?

হাতের তালুতে সজোরে একটা ঘুষি মারে পোয়ারো, তারপর বলে–ভেবে দেখ হেস্টিংস, আমরা তো মাত্র কয়েকজনের কথা জেনেছি নিকের মুখে। আরও কতজন রয়ে গেছেন, নিক যাদের আদৌ সন্দেহের যোগ্য বিবেচিত না করায় তাদের প্রসঙ্গ তোলেই নি। যেমন লজের ভাড়াটে অচেনা অস্ট্রেলিয়রা। আরও অন্যেরা–যারা নিকের কাছের, ঘনিষ্ট, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন। হেস্টিংস–আমার বোধ, অনুভূতি বলছে কিছু একটা আছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে, যা এখনও আলোয় আসেনি।

পোয়ারো হাসে, গভীর একটা শ্বাস ছাড়ে।

 পোয়ারো তুমি বলতে চাইছে, নিক আমাদের কাছে কিছু একটা আড়াল করছে?

 আমার কথায় পোয়ারো সজোরে মাথা নাড়ে।

না, ঠিক তা নয়। আসলে তিনি হয়তো কথাগুলো বলার প্রয়োজনই মনে করেননি। কারণ–তিনি ভেবেছেন এই মামলার সঙ্গে ওইসব কথার কোনও রকম সম্পর্ক থাকতে পারে না। আর আমি সেটাই ঠিক কি জানতে চাই। আত্মগর্ব নয়, তবে, খুব গর্বের সঙ্গে বলব–সাধারণ মানুষের থেকে আমার বুদ্ধিটা একটু বেশি। আমি, এরকুল পোয়ারো–সেই যোগাযোগটা দেখতে পেতাম, যেটা উনি পারছেন না। হয়তো সেই দরজাটা খুঁজে পেতাম যেটা এই রহস্যের অন্দরমহলে পৌঁছে দিত আমাকে। পোয়ারোকে এভাবে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হত না।

আমার বিশ্বাস তুমি সেটা খুঁজে পাবে। তার আগেই না খুব বেশি দেরি হয়ে যায়।