প্রথম পরিচ্ছেদ – মোঙের বিলাপ
বৃদ্ধ হূণ-যোদ্ধা মোঙ্ গল্প বলিতেছিল। নির্জন বনপথের পাশে ক্ষুদ্র একটি জলসত্র; এই সত্রের প্রপাপালিকা যুবতী অদূরে বসিয়া করলগ্নকপোলে মোঙের গল্প শুনিতেছিল।
চারিদিকে প্রস্তুরাকীর্ণ অসমতল ভূমির উপর দেবদারু, পিয়াল ও মধুকের বন। পথের ধারে বন তত ঘন নয়, যত দূরে গিয়াছে ততই নিবিড় হইয়াছে। অনুচ্চ পর্বতের শ্রেণী দ্বিপ্রহরের খর রৌদ্রে শঙ্কাবৃত সরীসৃপের ন্যায় নিদ্রালুভাবে পড়িয়া আছে। নবাগত গ্রীষ্মের আলস্য ও পক্ক মধুক-ফলের গুরু সুগন্ধ মিশিয়া আতপ্ত বাতাসকে মদমন্থর করিয়া তুলিয়াছে।
এই পর্বত-কান্তার-তরঙ্গিত বিচিত্র দৃশ্যের ভিতর দিয়া সঙ্কীর্ণ কুটিল পথটি যেন অতি যত্নে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখিয়া দক্ষিণ হইতে উত্তরাভিমুখে গিয়াছে। দ্বিপ্রহরেও পথ জনহীন; এই পার্বত্য রাজ্যের কেন্দ্রপুরী কপোতকূট এখান হইতে প্রায় ক্রোশেক পথ দক্ষিণে। পথের পাশে রুক্ষ প্রস্তরে নির্মিত একটি কুটির— ইহাই জলসত্র; তাহার দুই পাশে দুইটি দীর্ঘ ঋজু দেবদারু বৃক্ষ ঘন কুঞ্চিত পত্রভারে স্থানটিকে ছায়াশীতল করিয়া রাখিয়াছে। বৃদ্ধ হূণ মোঙ্ একটি দেবদারু কাণ্ডে পৃষ্ঠ-ভার অর্পণ করিয়া জানুদ্বয় বাহু দ্বারা আবেষ্টনপূর্বক নিজ স্মৃতিকথা বলিতেছিল।
মহারাজাধিরাজ পরমভট্টারক মগধেশ্বর স্কন্দের ষোড়শ রাজ্যাঙ্কে উত্তর-পশ্চিম ভারতের শৈলবন্ধুর অধিত্যকার একপ্রান্তে, বিটঙ্ক নামক ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজধানী কপোতকূট হইতে অনতিদূরে এক ক্ষুদ্র জলসত্রের তরুচ্ছায়ামূলে আমাদের আখ্যায়িকা আরম্ভ হইতেছে।
বৃদ্ধ মোঙ্ নিজের বিলাপপূর্ণ স্মৃতিকথা শুনাইতে ভালবাসিত। তাহার যোদ্ধৃ জীবন শেষ হইয়াছে, দেহে আর শক্তি নাই; যে দুর্ধর্ষ প্রকৃতি লইয়া পঁচিশ বৎসর পূর্বে মুক্ত কৃপাণ হস্তে এই রাজ্যে প্রবেশ করিয়াছিল তাহাও বোধকরি নিভিয়া গিয়াছে। তাই, উত্তর মেরুর সুদীর্ঘ রাত্রে তুষার সঙ্কটের মধ্যে অগ্নি জ্বালিয়া মেরুবাসী যেমন সূর্যের স্বপ্ন দেখে, জরাগ্রস্ত মোঙ্, তেমনই হূণ জাতির অতীত বীর্য গৌরবের স্বপ্ন দেখিত। তাহার দেহ খর্ব, মাংসপেশী ক্ষয় হইয়া দেহের-চর্ম লোল করিয়া দিয়াছে; তথাপি সে যে এককালে অতিশয় বলশালী ছিল তাহা তাহার শিথিল-চর্মাবৃত দেহ-কঙ্কালের সুবিপুল প্রস্থ হইতে অনুমান হয়। কেশলেশহীন মুখমণ্ডল অগণিত কুঞ্চন-চিহ্নে শুষ্ক নারিকেল ফলের আকৃতি ধারণ করিয়াছে; উচ্চ হনু ও ভ্রূ-অস্থির মাঝখানে ক্ষুদ্র চক্ষু দু’টি কিন্তু সুকৃষ্ণ। মাথার উপরে কয়েক গুচ্ছ পাংশুবর্ণ কেশ আপন বিরলতার ফাঁকে ফাঁকে করোটির গঠন প্রকট করিতেছে।
মোঙের কণ্ঠস্বর শ্রুতিমধুর নয়। হূণ জাতির কণ্ঠস্বর স্বভাবতই প্রসাদগুণবর্জিত; মোঙ্ কথা কহিলে মনে হইত, গুরুভারবাহী গো-শকটের তৈলহীন চক্র হইতে আর্ত আপত্তি উত্থিত হইতেছে। নগরের পানশালায় মোঙ্ গল্প বলিতে আরম্ভ করিলেই শ্রোতারা উঠিয়া অন্যত্র প্রস্থান করিত। কিন্তু তথাপি মোঙ্ নিরাশ হইত না; কোনওক্রমে একটি শ্রোতা সংগ্রহ করিতে পারিলেই সে অতীতের কাহিনী আরম্ভ করিয়া দিত।
বর্তমানে মোঙের একটি শ্রোত্রী জুটিয়াছিল— সে এই জলসত্রের প্রপাপালিকা সুগোপা। তপ্ত-কাঞ্চনবর্ণা তন্বী, বয়স অনুমান কুড়ি বাইশ বলিয়া মনে হয়, কিন্তু বস্তুত পঁচিশ বৎসর। অধর প্রান্তে একটু চটুলতার আভাস, চক্ষু দু’টি নীলাঞ্জন মেঘের স্নিগ্ধতায় সরস। সুগোপা কপোতকূটের রাজ-উদ্যানের মালাকরের বনিতা, তাহার হাতের মালা নহিলে রাজকুমারী—
কিন্তু সুগোপার পূর্ণ পরিচয় পরে প্রকাশ পাইবে।
মোঙ্ দন্তধাবন কাষ্ঠের অন্বেষণে প্রায় নগর বাহিরে জঙ্গলের মধ্যে আসে, করঞ্জবৃক্ষের দন্তকাষ্ঠ অন্যত্র পাওয়া যায় না। তখন দু’দণ্ড সুগোপার কাছে বসিয়া সে নিজের প্রিয় কাহিনী বলিয়া যায়; সুগোপাও আপত্তি করে না। সারাদিন তাহাকে একাকিনী এই প্রপায় থাকিতে হয়, ক্বচিৎ দুই চারিজন দূরাগত পথিক জলপান করিবার জন্য ক্ষণেক দাঁড়ায়, তৃষ্ণা নিবারণ করিয়া নগরাভিমুখে চলিয়া যায়; এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে মোঙের গল্প তাহার মন্দ লাগে না। সুদূর বক্ষু নদীর তীরে হূণেরা কি করিয়া জীবনযাপন করিত; তারপর একদিন যাযাবর জাতির স্বভাবজ অস্থিরতা কেমন করিয়া তাহাদের বিশাল গোষ্ঠীকে গান্ধারের সীমান্তে আনিয়া উপনীত করিল; তারপর পঞ্চনদ-ধৌত শ্যামল উপত্যকার লোভে তাহারা কিভাবে পঙ্গপালের মত চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল, স্কন্দের সহিত হূণদের যুদ্ধ, হূণগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল; তারপর দ্বাদশ সহস্র হূণ এই বিটঙ্ক রাজ্য অধিকার করিয়া বসিল, কপোতকূটে প্রবেশ করিয়া রাজপুরী আক্রমণ করিল—
মোঙ্ গল্প বলিতেছিল, সুগোপা অদূরে পীঠিকার ন্যায় একটি উচ্চ প্রস্তরখণ্ডের উপর বসিয়া করলগ্নকপোলে শুনিতেছিল—
দর্দূরধ্বনিবৎ একটি শব্দ মোঙের কণ্ঠ হইতে বাহির হইল; ইহা তাহার হাস্য। ক্ষণিক কৌতুক অপনোদিত হইলে মোঙ্ বলিল— ‘মেষ! গড্ডলিকা! হূণ জাতি আর নাই, ভেড়া বনিয়া গিয়াছে। পঁচিশ বৎসর পূর্বে যাহারা সিংহ ছিল, তাহারা আজ ভেড়া। কাহাকে দোষ দিব? আমাদের যিনি রাজা, যিনি একদিন স্বহস্তে এদেশের বীর্যহীন অধিপতির মাথা কাটিয়া শূলশীর্ষে স্থাপন করিয়াছিলেন, তিনি আজ অহিংসা ধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন, বরাহ পর্যন্ত আহার করেন না। ধর্ম! তরবারি যাহার একমাত্র দেবতা, সে চৈত্য নির্মাণ করিয়া কোন্ এক মৃত ভিক্ষুকের অস্থি পূজা করিতেছে। হ হ হ—’ মোঙের কণ্ঠ হইতে আবার শ্লেষপূর্ণ দর্দূরধ্বনি বাহির হইল।
সুগোপা করতল হইতে মুখ তুলিয়া বলিল— ‘মহারাজ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন।’
মোঙ্ও বৃক্ষকাণ্ডের অবলম্বন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া বসিল, তালপত্রের পুত্তলীর ন্যায় সহসা দুই হস্ত আস্ফালিত করিয়া বলিল— ‘সেই কথাই তো বলিতেছি। কিন্তু কেন এমন হইল? দ্বাদশ সহস্র শোণিত-লোলুপ মরু-সিংহ পঁচিশ বৎসর পূর্বে এদেশে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা আজ কোথায়? ভেড়া— সব ভেড়া।’
সুগোপার অধর কোণে একটু হাসি দেখা দিল; সে বলিল— ‘মোঙ্, তবে তো তুমিও ভেড়া।’
মোঙ্ ও কথায় কর্ণপাত না করিয়া পুনশ্চ ঠেস দিয়া বসিল, ক্ষুদ্র চক্ষুযুগল কিছুক্ষণ সুগোপার মুখের উপর স্থাপন করিয়া রহিল; তারপর কতকটা যেন নিজ মনেই বলিল— ‘অসির নখ, ঘোড়ার পিছনের পা এবং স্ত্রীলোকের কটাক্ষ— মানুষের সমস্ত বিপদের মূলে এই তিনটি। হূণ শিশুকাল হইতেই প্রথম দুইটি এড়াইয়া চলিতে শিখে কিন্তু ঐ তৃতীয় বিপদই তার সর্বনাশ করিয়াছে। বেশ ছিলাম আমরা মরুর কোলে; আমাদের বলিষ্ঠ রূপহীনা নারীরা অশ্ব উষ্ট্রের সহিত একসঙ্গে কাজ করিত, দুর্দম হূণশিশু প্রসব করিত— এদেশের কুহকিনীদের মত পুরুষকে মেষশাবকে পরিণত করিতে পারিত না। প্রবাদবাক্য মিথ্যা নয়, অসির নখ, ঘোড়ার পা আর স্ত্রীলোকের কটাক্ষ— ‘মোঙ্ অত্যন্ত ক্ষুব্ধভাবে সুগোপার সুন্দর মুখের পানে চাহিয়া শুষ্ক নারিকেলের মত মাথাটি নাড়িতে লাগিল।
মৃদু হাসিয়া সুগোপা বলিল— ‘মোঙ্, তোমার নাগসেনার কটাক্ষ কি এখনও খুব তীক্ষ্ণ আছে?’
মোঙ্ দুই হাত নাড়িয়া সুগোপার পরিহাস দূরে সরাইয়া দিয়া বলিল— ‘এক পুরুষের মধ্যে একটা জাতি নিবীর্য হইয়া গেল! আমরা না হয় বুড়া হইয়াছি— যৌবন ও অশ্বিনীদুগ্ধজাত মদ্যের মাদকতা চিরদিন থাকে না, কিন্তু আমাদের সন্তানেরাই বা কী? তাহারা হূণের পুত্র বটে, তবু তাহারা হূণ নয়। মরু-সিংহের ঔরসে একপাল ভেড়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে।’
ভেড়ার উপমাটা বৃদ্ধিকে চাপিয়া ধরিয়াছে, তদুপরি সে উত্তরোত্তর উষ্ণতর হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া সুগোপা বলিল— ‘সেজন্য বিলাপ করিয়া লাভ নাই। এ দেশের নারীরা তোমাদের সাধিয়া বিবাহ করে নাই, তোমরাই বলপূর্বক তাহাদের বিবাহ করিয়াছিলে— এখন কাঁদিলে চলিবে কেন? আর, ফলও নিতান্ত মন্দ হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। তোমাদের বংশধরেরা— আর কিছু না হোক তোমাদের চেয়ে সুশ্রী। তাহাদের কুল না থাক, শীল আছে।’
‘শীল আছে!’ মোঙের স্বর ক্রোধে আরও তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল— ‘কী প্রয়োজন শীলের? শিষ্টতার দ্বারা শত্রুর মুণ্ড কাটিয়া লওয়া যায়? কশার পরিবর্তে সৌজন্য প্রয়োগ করিলে ঘোড়া অধিক দৌড়ায়? আমরা যেদিন রাজধানী অধিকার করি সেদিন কি শিষ্টতা দেখাইয়াছিলাম? বাজপাখির মত আমরা কপোতকূটের উপর পড়িয়াছিলাম— নগরের পয়োনালক পথে রক্তের স্রোত বহিয়া গিয়াছিল। রাজপ্রাসাদের রক্ষীরা আমাদের বাধা দিবার চেষ্টা করিয়াছিল— হ হ হ—’ মোঙ্ আবার হাসিল— ‘রাজপ্রাসাদের বিজয়ের কথা স্মরণ হইলে এখনও আমার রক্ত নৃত্য করিয়া ওঠে—’
সুগোপা বলিল— ‘রক্তপিপাসু, হূণ, তবে সেই গল্পই বল, তোমার আক্ষেপ শুনিবার আগ্রহ আমার নাই।’
দূরস্থ শিকারের প্রতি চলচ্ছক্তিহীন স্থবির ব্যাঘ্র যেভাবে তাকাইয়া থাকে, মোঙ্ সেইভাবে শূন্যে তাকাইয়া রহিল, লালায়িত রসনায় বলিতে লাগিল— ‘সেদিন দুই মুঠি ভরিয়া সোনা লুঠ করিয়াছিলাম। প্রাসাদের নিম্নে অন্ধকূপ কক্ষে সোনার দীনার স্তূপীকৃত ছিল— আটজন রক্ষী সেই গর্ভগৃহ পাহারা দিতেছিল— তুষ্ফাণ প্রথমে সেই গুপ্ত কোষাগারের সন্ধান পায়; আমরা ত্রিশজন হূণ গিয়া রক্ষীদের কাটিয়া ফেলিলাম। তারপর সকলে মিলিয়া সেই দীনার স্তূপ…এত সোনা আর কখনও দেখিব না। তুষ্ফাণ ছিল আমাদের নায়ক, অধিকাংশ দীনার তাহার ভাগে পড়িল। যুদ্ধ শেষ হইবার পর সেই সোনা আমাদের রাজাকে উপহার দিয়া তুষ্ফাণ চষ্টন দুর্গের অধিপতি হইয়া বসিল—’
সুগোপা বলিল— ‘তা জানি। তারপর আর কি করিলে?
মোঙ্ বলিয়া চলিল— ‘রত্নাগার হইতে উপরে আসিয়া আমরা রাজ-অবরোধের দিকে ছুটিলাম। আমাদের পূর্বেই সেখানে বহু হূণ পৌঁছিয়াছিল; চারিদিক হইতে নারীকণ্ঠের চিৎকার, ক্রন্দন, আর্তনাদ উঠিতেছিল। আমরা অবরোধের অলিন্দে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, সেখানে এক পরম কৌতুককর খেলা চলিতেছে। ছয় সাতজন হূণ যোদ্ধা একটা ক্ষুদ্র বালকের দেহ লইয়া মুক্ত কৃপাণের উপর লোফালুফি করিতেছে। বালকাটা রাজপুত্র— এক বৎসর বয়ঃক্রম হইবে— মাংসের একটা উলঙ্গ পিণ্ড বলিলেই হয়। একজন তাহাকে তরবারির ফলার উপর লইয়া আর একজনের দিকে ছুঁড়িয়া দিতেছে, দ্বিতীয় ব্যক্তি তাহাকে তরবারির ফলার উপর গ্রহণ করিতেছে, মাটিতে পড়িতে দিতেছে না। শূন্যে শূন্যে খেলা চলিতেছে। শিশুটা মরে নাই, মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কাতরোক্তি করিতেছে। পাছে তরবারির আঘাতে কাটিয়া দ্বিখণ্ডিত হইয়া যায় এইজন্য সকলেই তাহাকে ফলার পার্শ্বদেশে গ্রহণ করিতেছে; তবু শিশুটার সর্বাঙ্গ কাটিয়া রক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে।
‘আমরাও গিয়া খেলায় যোগ দিলাম; মাঝে মাঝে হাসির অট্টরোল উঠিতে লাগিল। একটা যুবতী দ্বার পথে উঁকি মারিয়া সহসা চিৎকার করিয়া পলায়ন করিল, আমাদের মধ্যে দুই চারিজন খেলা ছাড়িয়া তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিল।
‘এই সময় কে একজন আসিয়া সংবাদ দিল, রাজা ধরা পড়িয়াছে। রক্তপাগল হূণের দল শিশুকে সেইখানে ফেলিয়া চলিয়া গেল। আমি কিন্তু তাঁহাদের সঙ্গে গেলাম না। শুধু হত্যা আর লুণ্ঠনে হূণের তৃপ্তি হয় না, নগ্ন তরবারি হস্তে আমি অবরোধের ভিতর প্রবেশ করিলাম।’
এতক্ষণ গল্প বলিতে বলিতে মোঙের ক্ষুদ্র চক্ষুযুগল হিংস্র উল্লাসে জ্বলিতেছিল, এখন সহসা যেন চক্ষুর জ্যোতি নিভিয়া গেল। সে ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া বিষণ্ণ স্বরে বলিল— ‘এই অবরোধের একটা কক্ষে প্রথম নাগসেনার সাক্ষাৎ পাই। পালঙ্কের নীচে লুকাইয়াছিল; তাহাকে টানিয়া বাহির করিলাম। সে কঙ্কণ দিয়া আমার কপালে আঘাত করিল। আমি তরবারি ফেলিয়া তাহাকে সাপটাইয়া ধরিলাম; সে আমার বক্ষে কামড়াইয়া দিল। কামড়ের দাগ এখনও আমার বুকে আছে। সেই অবধি—’ মোঙের স্বর অত্যন্ত করুণ হইয়া ক্রমে থামিয়া গেল।
সুগোপা করতলে কপোল রাখিয়া নিঃশব্দে শুনিতেছিল, এই নৃশংস কাহিনী তাহাকে বিচলিত করিতে পারে নাই। দেশব্যাপী বিপ্লবের মধ্যে যাহার জন্ম, অমানুষিক নিষ্ঠুরতার বহু চিত্র যাহার শৈশব স্মৃতির মূল উপাদান, যাহার নিজের জননী ও বহু পরিজন এই শোণিতস্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে— মোঙের কাহিনী শুনিয়া তাহার বিচলিত হইবার কথা নয়। শুধু রাজপুরী অধিকারের এই পুরাবৃত্ত তাহার অজ্ঞাত ছিল বলিয়াই সে মনোযোগ দিয়া শুনিতেছিল।
কিয়ৎকাল নীরবে কাটিবার পর সুগোপা মুখ তুলিয়া বলিল— ‘সেই শিশুর কি হইল?’
‘শিশুর—?’ মোঙ্ স্মৃতির জলে পুনরায় ডুব দিয়া বলিল— ‘শিশুটা সেই অলিন্দে রক্ত-কর্দমের মধ্যে পড়িয়া ছিল— তারপর—? হাঁ ঠিক, মনে পড়িয়াছে। চু-ফাঙ্! পাগলা চু-ফাঙ্! অবরোধ হইতে নাগসেনাকে লইয়া যখন বাহির হইতেছি, দেখি আমাদের পাগল চু-ফাঙ্ শিশুটাকে নিজের ঝোলার মধ্যে পুরিতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম,’এটাকে লইয়া কী করিবে— শূল্য মাংস তৈয়ার করিয়া খাইবে? ‘চু-ফাঙ্ ভাঙ্গা দাঁত বাহির করিয়া হাসিল—’ মোঙ্ আবার চিন্তামজ্জিত হইয়া পড়িল— ‘আশ্চর্য, চু-ফাঙ্কে সেদিনের পর আর দেখি নাই, হয়তো মরিয়া গিয়াছে। হূণের আয়ু আর মরীচিকার মায়া কখন শেষ হইবে কেহ জানে না। চু-ফাঙ্ পাগল ছিল বটে কিন্তু অনেক তন্ত্র-মন্ত্র জানিত, গাছের পাতা ও শিকড়ের রস দিয়া দেহের অস্ত্রক্ষত অবিকল জুড়িয়া দিতে পারিত—’
সুগোপা জিজ্ঞাসা করিল— ‘আর সেই যুবতী? তাহার কি হইল?’
‘কোন্ যুবতী? নাগসেনা?’
সুগোপার অধর একটু প্রসারিত হইল, সে বলিল— ‘না, নাগসেনার কী হইল তাহা আমরা জানি; নাগসেনা এখন নাগিনী হইয়া তোমার কণ্ঠ চাপিয়া ধরিয়াছে। আমি অন্য যুবতীর কথা বলিতেছি। যে তোমাদের খেলা দেখিয়া চিৎকার করিয়া পলাইয়াছিল—’
মোঙ্ তাচ্ছিল্যভরে বলিল— ‘কে তাহার সংবাদ রাখে। দুই তিনজন তাহাকে ধরিবার জন্য ছুটিয়াছিল— তারপর কি হইল জানি না। রাজপুরীতে বহু কিঙ্করী পরিচারিকা ছিল, হূণেরা যে যাহাকে পাইল দখল করিল। কয়েকটা যুবতী আত্মহত্যা করিয়াছিল—’
সুগোপা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল— ‘বোধহয় সেই যুবতীই আমার মাতা। তিনি রাজপুত্রের ধাত্রী ছিলেন, আমরা একই স্তনদুগ্ধ পান করিয়াছিলাম।’
মোঙ্ বিস্ময় প্রকাশ করিল না, নিরুৎসুকভাবে সুগোপার পানে চাহিয়া বলিল— ‘হইতেও পারে। তাহার বয়স তোমারই মতন ছিল।’
ভূমির দিকে তাকাইয়া থাকিয়া সুগোপা বলিল— ‘জানি না আমার মায়ের কি দশা হইয়াছিল। তিনি আর রাজপুরী হইতে গৃহে ফিরেন নাই। হয়তো আত্মহত্যাই করিয়াছিলেন—’
এই সময় তাহাদের বিশ্রম্ভালাপে বাধা পড়িল।